
নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু প্রতিহিংসা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে স্বীকার করে, অপরাধীদের দায় স্বীকার করিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এ কারণেই তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেছিলেন, যা অতীতের অপরাধ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে পুনর্মিলন ও পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু এর পরপরই জাতি গভীর বিভাজনের শিকার হয়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর নানা রকম আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে স্থায়ী কোনো রূপ নিতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড, এরপর সামরিক শাসনের দীর্ঘ সময়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী শাসন, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরা কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসর, যারা নিজ জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই অপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়া জাতির বিভাজনকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিষয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং ১৯৭৫ সালের পর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়ে। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেটি রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রতিহিংসার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল যে ম্যান্ডেলার মডেল এখানে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে করতে হলে নিরপেক্ষতা ও আস্থার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস, প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় কোনো সত্য কমিশন গঠন করলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে এলেও প্রতিটি নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সহিংসতা এবং বিরোধী দল দমনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা, ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ—এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। ফলে শুধু ১৯৭১ সালের নয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কিছু করা দরকার।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ম্যান্ডেলার পথ অনুসরণ করতে চায়, তাহলে প্রথমত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক না থাকে। তৃতীয়ত, অতীতের অন্যায়ের স্বীকারোক্তি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপরাধ স্বীকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
দুই. বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি পর্বই রক্তাক্ত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষে ভরা। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের অধীনে দেশে একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটা দমনে সহিংসতা কম হয়নি। ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সময়ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চলে। দেশের সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানোয় ২৪ জনের প্রাণহানি ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে না হতেই বিডিআর বিদ্রোহের নামে এক লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ ঘটে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, মামলা-হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দল দমনে সরকারি বাহিনীগুলোর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর। এসব ঘটনার কোনোটিরই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, হয়নি পুনর্মিলনের উদ্যোগ। ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমাগত বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে সত্য ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে চলতে হলে সত্য প্রকাশ করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মতো একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এটি এমন একটি কাঠামো হতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের আস্থা থাকবে এবং যা শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা অপরাধীদের রক্ষা করে এবং বিরোধীদের দমন করে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, শুধু বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতির ঐক্যের স্বার্থে একটি স্বীকারোক্তির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কখনোই অপরাধ স্বীকার করেন না; বরং প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করে।
চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অতীতের সত্য তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠক্রম বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে একেক সময় একেক ধরনের সত্য প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড—এসব বিষয়ে একটি একক, গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক বয়ান থাকতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং সত্যের ভিত্তিতে একে অপরকে বোঝার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান হওয়া যাবে না; বরং বিচার বিভাগের অধীনে স্বাধীন কমিশন হিসেবে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশনে সব রাজনৈতিক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ এটিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ তুলতে না পারে। তৃতীয়ত, শুধু অতীতের বিচার নয়, ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। যদি প্রতিহিংসার চক্র চলতেই থাকে, তাহলে কোনো পুনর্মিলন সম্ভব হবে না।
নেলসন ম্যান্ডেলার সফলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। তিনি শুধু ক্ষমা করার কথা বলেননি, বরং সত্যকে গ্রহণ করে, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় এনে এবং সর্বোপরি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশে তেমন একজন তেজোদীপ্ত নেতা থাকলেও তাঁকে দলীয় বৃত্তে বন্দী করে বিতর্কিত করা হয়েছে। এখানে ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায় না।
তবে বাংলাদেশে সত্য ও পুনর্মিলনের মডেল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে, এমন বলা যায় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, যদি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়—তাহলে একটি নতুন ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ প্রয়োজন, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নীতি পরিহার করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা হবে।
বাংলাদেশের জন্য ম্যান্ডেলার পথ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। একমাত্র শর্ত হলো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সদিচ্ছা। যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশেও একদিন ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের একটি গ্রহণযোগ্য পথ রচনা করা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু প্রতিহিংসা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে স্বীকার করে, অপরাধীদের দায় স্বীকার করিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এ কারণেই তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেছিলেন, যা অতীতের অপরাধ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে পুনর্মিলন ও পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু এর পরপরই জাতি গভীর বিভাজনের শিকার হয়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর নানা রকম আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে স্থায়ী কোনো রূপ নিতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড, এরপর সামরিক শাসনের দীর্ঘ সময়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী শাসন, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরা কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসর, যারা নিজ জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই অপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়া জাতির বিভাজনকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিষয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং ১৯৭৫ সালের পর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়ে। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেটি রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রতিহিংসার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল যে ম্যান্ডেলার মডেল এখানে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে করতে হলে নিরপেক্ষতা ও আস্থার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস, প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় কোনো সত্য কমিশন গঠন করলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে এলেও প্রতিটি নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সহিংসতা এবং বিরোধী দল দমনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা, ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ—এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। ফলে শুধু ১৯৭১ সালের নয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কিছু করা দরকার।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ম্যান্ডেলার পথ অনুসরণ করতে চায়, তাহলে প্রথমত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক না থাকে। তৃতীয়ত, অতীতের অন্যায়ের স্বীকারোক্তি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপরাধ স্বীকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
দুই. বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি পর্বই রক্তাক্ত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষে ভরা। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের অধীনে দেশে একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটা দমনে সহিংসতা কম হয়নি। ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সময়ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চলে। দেশের সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানোয় ২৪ জনের প্রাণহানি ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে না হতেই বিডিআর বিদ্রোহের নামে এক লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ ঘটে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, মামলা-হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দল দমনে সরকারি বাহিনীগুলোর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর। এসব ঘটনার কোনোটিরই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, হয়নি পুনর্মিলনের উদ্যোগ। ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমাগত বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে সত্য ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে চলতে হলে সত্য প্রকাশ করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মতো একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এটি এমন একটি কাঠামো হতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের আস্থা থাকবে এবং যা শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা অপরাধীদের রক্ষা করে এবং বিরোধীদের দমন করে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, শুধু বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতির ঐক্যের স্বার্থে একটি স্বীকারোক্তির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কখনোই অপরাধ স্বীকার করেন না; বরং প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করে।
চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অতীতের সত্য তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠক্রম বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে একেক সময় একেক ধরনের সত্য প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড—এসব বিষয়ে একটি একক, গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক বয়ান থাকতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং সত্যের ভিত্তিতে একে অপরকে বোঝার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান হওয়া যাবে না; বরং বিচার বিভাগের অধীনে স্বাধীন কমিশন হিসেবে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশনে সব রাজনৈতিক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ এটিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ তুলতে না পারে। তৃতীয়ত, শুধু অতীতের বিচার নয়, ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। যদি প্রতিহিংসার চক্র চলতেই থাকে, তাহলে কোনো পুনর্মিলন সম্ভব হবে না।
নেলসন ম্যান্ডেলার সফলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। তিনি শুধু ক্ষমা করার কথা বলেননি, বরং সত্যকে গ্রহণ করে, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় এনে এবং সর্বোপরি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশে তেমন একজন তেজোদীপ্ত নেতা থাকলেও তাঁকে দলীয় বৃত্তে বন্দী করে বিতর্কিত করা হয়েছে। এখানে ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায় না।
তবে বাংলাদেশে সত্য ও পুনর্মিলনের মডেল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে, এমন বলা যায় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, যদি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়—তাহলে একটি নতুন ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ প্রয়োজন, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নীতি পরিহার করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা হবে।
বাংলাদেশের জন্য ম্যান্ডেলার পথ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। একমাত্র শর্ত হলো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সদিচ্ছা। যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশেও একদিন ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের একটি গ্রহণযোগ্য পথ রচনা করা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু প্রতিহিংসা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে স্বীকার করে, অপরাধীদের দায় স্বীকার করিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এ কারণেই তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেছিলেন, যা অতীতের অপরাধ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে পুনর্মিলন ও পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু এর পরপরই জাতি গভীর বিভাজনের শিকার হয়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর নানা রকম আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে স্থায়ী কোনো রূপ নিতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড, এরপর সামরিক শাসনের দীর্ঘ সময়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী শাসন, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরা কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসর, যারা নিজ জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই অপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়া জাতির বিভাজনকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিষয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং ১৯৭৫ সালের পর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়ে। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেটি রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রতিহিংসার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল যে ম্যান্ডেলার মডেল এখানে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে করতে হলে নিরপেক্ষতা ও আস্থার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস, প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় কোনো সত্য কমিশন গঠন করলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে এলেও প্রতিটি নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সহিংসতা এবং বিরোধী দল দমনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা, ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ—এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। ফলে শুধু ১৯৭১ সালের নয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কিছু করা দরকার।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ম্যান্ডেলার পথ অনুসরণ করতে চায়, তাহলে প্রথমত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক না থাকে। তৃতীয়ত, অতীতের অন্যায়ের স্বীকারোক্তি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপরাধ স্বীকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
দুই. বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি পর্বই রক্তাক্ত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষে ভরা। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের অধীনে দেশে একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটা দমনে সহিংসতা কম হয়নি। ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সময়ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চলে। দেশের সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানোয় ২৪ জনের প্রাণহানি ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে না হতেই বিডিআর বিদ্রোহের নামে এক লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ ঘটে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, মামলা-হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দল দমনে সরকারি বাহিনীগুলোর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর। এসব ঘটনার কোনোটিরই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, হয়নি পুনর্মিলনের উদ্যোগ। ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমাগত বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে সত্য ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে চলতে হলে সত্য প্রকাশ করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মতো একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এটি এমন একটি কাঠামো হতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের আস্থা থাকবে এবং যা শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা অপরাধীদের রক্ষা করে এবং বিরোধীদের দমন করে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, শুধু বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতির ঐক্যের স্বার্থে একটি স্বীকারোক্তির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কখনোই অপরাধ স্বীকার করেন না; বরং প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করে।
চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অতীতের সত্য তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠক্রম বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে একেক সময় একেক ধরনের সত্য প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড—এসব বিষয়ে একটি একক, গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক বয়ান থাকতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং সত্যের ভিত্তিতে একে অপরকে বোঝার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান হওয়া যাবে না; বরং বিচার বিভাগের অধীনে স্বাধীন কমিশন হিসেবে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশনে সব রাজনৈতিক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ এটিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ তুলতে না পারে। তৃতীয়ত, শুধু অতীতের বিচার নয়, ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। যদি প্রতিহিংসার চক্র চলতেই থাকে, তাহলে কোনো পুনর্মিলন সম্ভব হবে না।
নেলসন ম্যান্ডেলার সফলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। তিনি শুধু ক্ষমা করার কথা বলেননি, বরং সত্যকে গ্রহণ করে, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় এনে এবং সর্বোপরি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশে তেমন একজন তেজোদীপ্ত নেতা থাকলেও তাঁকে দলীয় বৃত্তে বন্দী করে বিতর্কিত করা হয়েছে। এখানে ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায় না।
তবে বাংলাদেশে সত্য ও পুনর্মিলনের মডেল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে, এমন বলা যায় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, যদি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়—তাহলে একটি নতুন ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ প্রয়োজন, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নীতি পরিহার করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা হবে।
বাংলাদেশের জন্য ম্যান্ডেলার পথ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। একমাত্র শর্ত হলো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সদিচ্ছা। যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশেও একদিন ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের একটি গ্রহণযোগ্য পথ রচনা করা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি নতুন জাতি গঠনের প্রয়াস পেয়েছে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, শুধু প্রতিহিংসা নয়, বরং ইতিহাসের নির্মম সত্যকে স্বীকার করে, অপরাধীদের দায় স্বীকার করিয়ে এবং ভুক্তভোগীদের কণ্ঠকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এ কারণেই তিনি ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন করেছিলেন, যা অতীতের অপরাধ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি জনগণের মধ্যে পুনর্মিলন ও পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, কিন্তু এর পরপরই জাতি গভীর বিভাজনের শিকার হয়। একদিকে ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির প্রশ্ন, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি। স্বাধীনতার পর নানা রকম আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে স্থায়ী কোনো রূপ নিতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের হত্যাকাণ্ড, এরপর সামরিক শাসনের দীর্ঘ সময়, গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিটি নির্বাচনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে। ফলে বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ ধরনের কোনো প্রক্রিয়া সম্ভব হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত বর্ণবাদী শাসন, যেখানে শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘুরা কালো সংখ্যাগরিষ্ঠদের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অপরাধীরা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর স্থানীয় দোসর, যারা নিজ জাতির মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। স্বাধীনতার পর এই অপরাধীদের বিচার না হওয়া এবং রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হওয়া জাতির বিভাজনকে বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির বিষয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন করা হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং ১৯৭৫ সালের পর যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন এবং রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ন্যায়বিচারের বদলে প্রতিহিংসার রাজনীতি আরও দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়ে। ২০০৯ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও সেটি রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং প্রতিহিংসার সংস্কৃতি এতটাই প্রবল যে ম্যান্ডেলার মডেল এখানে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে করতে হলে নিরপেক্ষতা ও আস্থার পরিবেশ থাকা প্রয়োজন, যা বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস, প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকায় কোনো সত্য কমিশন গঠন করলেও তা বিশ্বাসযোগ্য হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সহিংসতা ও দমন-পীড়নের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ১৯৯০-এর পর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফিরে এলেও প্রতিটি নির্বাচন এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় সহিংসতা এবং বিরোধী দল দমনের ঘটনা ঘটেছে। ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা, ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহ—এসব ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। ফলে শুধু ১৯৭১ সালের নয়, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রেও ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কিছু করা দরকার।
বাংলাদেশ যদি সত্যিকার অর্থে ম্যান্ডেলার পথ অনুসরণ করতে চায়, তাহলে প্রথমত রাজনৈতিক প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিচারব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে, যাতে কোনো অপরাধীর শাস্তি নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক না থাকে। তৃতীয়ত, অতীতের অন্যায়ের স্বীকারোক্তি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে এসে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছিল, কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অপরাধ স্বীকারের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি।
দুই. বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি কেবল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের প্রতিটি পর্বই রক্তাক্ত এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বিষে ভরা। শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর সামরিক শাসকদের অধীনে দেশে একধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এ পরিস্থিতির ধারাবাহিকতায় ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হন। ১৯৮২ সালে এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তাঁর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, সেটা দমনে সহিংসতা কম হয়নি। ১৯৯১ সালে ও ১৯৯৬ সালে ক্ষমতার পালাবদলের সময়ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ওপর সহিংসতা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চলে। দেশের সবগুলো জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। তা ছাড়া, আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা চালানোয় ২৪ জনের প্রাণহানি ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়।
এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হতে না হতেই বিডিআর বিদ্রোহের নামে এক লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ ঘটে। ২০১৩-১৪ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে গুম-খুন, মামলা-হামলার অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দল দমনে সরকারি বাহিনীগুলোর আচরণ ছিল নিষ্ঠুর। এসব ঘটনার কোনোটিরই নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি, হয়নি পুনর্মিলনের উদ্যোগ। ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন ক্রমাগত বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে সত্য ও পুনর্মিলনের প্রশ্নটি অত্যন্ত জটিল হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলন একসঙ্গে চলতে হলে সত্য প্রকাশ করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকার ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মতো একটি নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনাগুলো অনুসন্ধান করা যেতে পারে। এটি এমন একটি কাঠামো হতে হবে, যেখানে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ জনগণের আস্থা থাকবে এবং যা শুধু প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না।
দ্বিতীয়ত, প্রতিটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নির্ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় দেখা যায়, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা অপরাধীদের রক্ষা করে এবং বিরোধীদের দমন করে। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে পুনর্মিলন সম্ভব নয়।
তৃতীয়ত, শুধু বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, জাতির ঐক্যের স্বার্থে একটি স্বীকারোক্তির পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অপরাধীরা প্রকাশ্যে তাদের অপরাধ স্বীকার করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা কখনোই অপরাধ স্বীকার করেন না; বরং প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করে।
চতুর্থত, শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে অতীতের সত্য তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠক্রম বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, যার ফলে একেক সময় একেক ধরনের সত্য প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড—এসব বিষয়ে একটি একক, গ্রহণযোগ্য ঐতিহাসিক বয়ান থাকতে হবে, যাতে নতুন প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানতে পারে এবং সত্যের ভিত্তিতে একে অপরকে বোঝার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিশনের মতো কোনো উদ্যোগ সফল করতে হলে কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, এটি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান হওয়া যাবে না; বরং বিচার বিভাগের অধীনে স্বাধীন কমিশন হিসেবে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, কমিশনে সব রাজনৈতিক পক্ষের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ এটিকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অভিযোগ তুলতে না পারে। তৃতীয়ত, শুধু অতীতের বিচার নয়, ভবিষ্যতে প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। যদি প্রতিহিংসার চক্র চলতেই থাকে, তাহলে কোনো পুনর্মিলন সম্ভব হবে না।
নেলসন ম্যান্ডেলার সফলতার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। তিনি শুধু ক্ষমা করার কথা বলেননি, বরং সত্যকে গ্রহণ করে, দোষীদের জবাবদিহির আওতায় এনে এবং সর্বোপরি বিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে একটি কার্যকর ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। বাংলাদেশে তেমন একজন তেজোদীপ্ত নেতা থাকলেও তাঁকে দলীয় বৃত্তে বন্দী করে বিতর্কিত করা হয়েছে। এখানে ক্ষমতার জন্য লড়াই চলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ঐক্যের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করতে দেখা যায় না।
তবে বাংলাদেশে সত্য ও পুনর্মিলনের মডেল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হবে, এমন বলা যায় না। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব সত্যিকার অর্থে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখা যায়, যদি জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়—তাহলে একটি নতুন ঐক্য প্রক্রিয়া গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে শুধু ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ প্রয়োজন, যেখানে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করার নীতি পরিহার করে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তোলা হবে।
বাংলাদেশের জন্য ম্যান্ডেলার পথ কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। একমাত্র শর্ত হলো সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস এবং অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সদিচ্ছা। যদি সেটা সম্ভব হয়, তবে বাংলাদেশেও একদিন ন্যায়বিচার ও পুনর্মিলনের একটি গ্রহণযোগ্য পথ রচনা করা যাবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৯ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৯ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৯ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৯ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি...
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৯ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৯ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৯ ঘণ্টা আগেজাহীদ রেজা নূর

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি...
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৯ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৯ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৯ ঘণ্টা আগেস্বপ্না রেজা

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি...
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৯ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৯ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৯ ঘণ্টা আগেসানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

নেলসন ম্যান্ডেলা ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার একজন জনপ্রিয় নেতা। শুধু বর্ণবাদী শাসনের অবসান ঘটানো একজন নেতা নন; তিনি বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এক মহানায়ক। তাঁর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা অতীতের দুঃসহ বিভাজন থেকে মুক্তি পেয়েছে, তবে প্রতিশোধের পথে না গিয়ে সত্য ও পুনর্মিলনের মাধ্যমে একটি...
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৯ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৯ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৯ ঘণ্টা আগে