বিভুরঞ্জন সরকার

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়, বরং একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের জন্য পরিচালিত সংগ্রাম। কিন্তু এক বছর পর দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি মেলেনি। সরকার বদলালেও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বরং আগের ব্যবস্থাই এখন নতুন নেতৃত্বের হাতে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এই বক্তব্যে আমরা একটি হতাশা লক্ষ করি, কিন্তু সেই হতাশার গভীরে ভবিষ্যতের জন্য একধরনের দায়িত্ববোধের প্রতিফলনও দেখতে পাই। নাহিদ ইসলামের ভাষায়, ‘আমাদের লড়াইটা ছিল ব্যবস্থার সঙ্গে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেনি।’ এখানে মূল সংকেত হলো—শুধু সরকার পরিবর্তন কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং মূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই পরিবর্তন বাহ্যিক।
এই অভ্যুত্থানের সময় প্রস্তুতির অভাব ছিল, নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ছিল এবং সবচেয়ে বড় যে ঘাটতিটি ছিল তা হলো সংগঠন ও দর্শনের পরিষ্কার কাঠামো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল এক প্রবল শক্তি, কিন্তু সেটি কোনো সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম ছিল না। ৫ আগস্টের পর যখন এটিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তখনই নানা প্রতিকূলতা দেখা দেয়। নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, কর্মসূচির অস্পষ্টতা এবং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের স্থায়ীভাবে মাঠে রাখা যায়নি। ফলে আন্দোলনের সংগঠিত কাঠামো গড়ে ওঠেনি, বরং একেকটি গোষ্ঠী নিজ নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নাহিদ ইসলাম এখানে যে কথাটি বলেন তা আন্দোলনের প্রকৃত ব্যর্থতা: ‘জুলাইয়ের পরে প্রত্যেকে যার যার অ্যাজেন্ডায় চলে গেছে।’ এই চলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের লড়াই এবং পুরোনো ব্যবস্থার মোহ।
নাহিদ বলেছেন, যে ঐক্যটি শুরুতে তৈরি হয়েছিল—ছাত্র, সেনাবাহিনী, কিছু রাজনৈতিক দল এবং অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সমর্থনের এক অলিখিত সমঝোতা—তা অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত সবাই একত্র ছিল, কিন্তু পতনের পর কেউ আর এক জায়গায় থাকেনি। ফলে, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যর্থতার দায় কেবল কোনো একটি গোষ্ঠীর নয়, বরং অভ্যুত্থানের সব পক্ষের মধ্যে সামষ্টিক সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী।
বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নাহিদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, কিন্তু সেই পরিস্থিতি ধরে রাখার জন্য যে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। পুলিশের সক্রিয়তা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ৫ আগস্টের পর অনেক থানাই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংগঠিত না রাখতে পারায় সেই গতিও থেমে যায়। সরকার যখন প্রো-অ্যাকটিভ থাকে না, তখনই আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। নাহিদ মনে করেন, যাদের ‘মব’ বলে অপমান করা হচ্ছে, তারা আসলে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা। সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে। এই বাস্তবতা বুঝতে না পারলে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু এই ‘মব’ নামক সামাজিক শক্তির বেপরোয়া আচরণ দমন না করলে পরবর্তী সময়ে এটা আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে পারে।
এই এক বছরে অভ্যুত্থানের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি, পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং শহীদ পরিবারদের অভিযোগও উপেক্ষিত থেকেছে। সরকার বাজেট বরাদ্দ দিলেও তা সরাসরি ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছায়নি। নাহিদ মনে করেন, এই দেরি ও অব্যবস্থার পেছনে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব এবং সদিচ্ছার ঘাটতি। সরকার চাইলে তালিকাপ্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করে দিয়ে শহীদদের সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারত, নিখোঁজদের অবস্থান জানাতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি।
অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তা কেন দ্রুত ভেঙে গেল, সে প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট করেছেন নাহিদ। তিনি মনে করেন, অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠেন। কে উপদেষ্টা হতে পারল আর কে পারল না—এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি করে। আবার আন্দোলনের সময় যেসব ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি, তারাও পরে নিজেকে ঐক্যভুক্ত অংশ বলে দাবি করে। নাহিদ এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সর্বদলীয় ঐক্য প্ল্যাটফর্ম ছিল না। এরপরও তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রত্যাশার কথা বলেন, জাতির প্রয়োজনে যেন সবাই এক হতে পারে, সেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলা উচিত।
নাহিদ ইসলাম এই মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি মনে করেন, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই অভ্যুত্থানের শক্তিকে ধারণ করতে পারবে না বলেই তাঁরা নতুন দল গঠন করেছেন। যদিও দলের সংগঠন এখনো পুরোপুরি মাঠে গড়ায়নি, তবু জনগণের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান। তিনি এটাও স্বীকার করেন, তাঁদের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। তাঁর মতে, নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপি নিজেরা আগে সংগঠিত হতে চায়, তার পরই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন ৫ আগস্টের পর, যদি এর আগে প্রতিশ্রুত ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ করা যায়।
এখানে এসে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে আসে, জুলাই সনদ এক বছরেও কেন হয়নি? সরকার দুই দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা দিতে পারেনি। ফলে এনসিপি এখন নিজেই সেই সনদ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা একটি বিকল্প দর্শন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা দিতে চায়। তাদের ভাষায়, যদি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দিশা না দেওয়া যায়, তাহলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।
তবে রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে গিয়ে তাঁরা নানা বাধার মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে ছাত্র উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, নেতাদের ব্যক্তিগত অডিও ফাঁস ইত্যাদি নানা ঘটনা অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এসব বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, শুরুতে দুর্নীতি ছিল না, কিন্তু পুরোনো ব্যবস্থার লোকেরা সুযোগ পেয়ে পুরোনো প্রক্রিয়া চালু করেছেন। অন্য ছাত্রসংগঠনের সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে অপপ্রচার। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে, বিশেষ করে নারীনেত্রীদের বিরুদ্ধে। নাহিদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের একটি প্রধান নৈতিক শক্তি ছিল নারীরা। তাই নারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো চলছে।’
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে। অনেকেই তাদের একটি ইসলামপন্থী দলের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন। নাহিদ ইসলাম এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, এনসিপি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়। একাত্তর, ইসলাম, নারী–এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার। তিনি মনে করেন, যোগাযোগের ঘাটতি এবং একটি সংগঠিত অপপ্রচারই এই ভুল ধারণার সৃষ্টি করছে। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ যুগের রাজনীতির ভাষা দিয়ে নতুন রাজনীতিকে বিচার করা ঠিক নয়। নাহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি হলো, ‘সুশীল সমাজ এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়নি। গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতার মাধ্যমে।’
বিএনপির ভূমিকাও এনসিপি ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না। তাদের মতে, বিএনপি পুরোনো বন্দোবস্তের বিপক্ষে নয় এবং শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে নিজেরাই ‘নতুন আওয়ামী লীগ’ হতে চায়। তারা নিজস্ব রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জামায়াত সম্পর্কিত অবস্থান পরিষ্কার করছে না। ফলে একটি পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিই আবার ফিরে আসছে।
সবশেষে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, অভ্যুত্থানের এক বছরে আপনি সরকারের পারফরম্যান্সকে কত নম্বর দেবেন, তখন তিনি নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সরকার কেবল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে, অন্য কোনো দলের কাছ থেকে নয়। সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও প্রত্যাশিত সমর্থন আসেনি। সরকারের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, সরকারকে বারবার পুরোনো বন্দোবস্তে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন। নাহিদ নিজে উপদেষ্টা পদ ছাড়ার পর নিজের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশ করেছেন, কোনো বিদেশ সফর করেননি। সরকারে থেকেও কোনো অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করেননি বলে দাবি করেন।
নাহিদের পুরো বক্তব্যের সারকথা হলো—ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থান যদি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা ব্যর্থ হবে। শুধু শেখ হাসিনার পতন কোনো অর্জন নয়। নাহিদ ইসলাম যে কথাটি বলেন, সেটি এই রাজনৈতিক মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি উপলব্ধি—‘নতুন বন্দোবস্ত না হলে, আওয়ামী লীগের পতন করে কী লাভ হলো, যদি আরেকটা আওয়ামী লীগই আসে?’ এই কথাটি নিছক একটি বাক্য নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি একটি নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব, নাকি পুরোনো কুশাসনের পাথরে ফের মাথা ঠুকব? প্রশ্নের উত্তর এখনো সময়ের হাতে। সময়ের সময় কবে শেষ হবে, দেখার বিষয় সেটাই।
লেখক:– জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়, বরং একটি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসানের জন্য পরিচালিত সংগ্রাম। কিন্তু এক বছর পর দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, সেই সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত পরিণতি মেলেনি। সরকার বদলালেও ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়নি, বরং আগের ব্যবস্থাই এখন নতুন নেতৃত্বের হাতে পুনঃস্থাপিত হয়েছে। এই বক্তব্যে আমরা একটি হতাশা লক্ষ করি, কিন্তু সেই হতাশার গভীরে ভবিষ্যতের জন্য একধরনের দায়িত্ববোধের প্রতিফলনও দেখতে পাই। নাহিদ ইসলামের ভাষায়, ‘আমাদের লড়াইটা ছিল ব্যবস্থার সঙ্গে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটেছে, কিন্তু ব্যবস্থার বিলোপ ঘটেনি।’ এখানে মূল সংকেত হলো—শুধু সরকার পরিবর্তন কোনো কৃতিত্ব নয়, বরং মূল কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া এই পরিবর্তন বাহ্যিক।
এই অভ্যুত্থানের সময় প্রস্তুতির অভাব ছিল, নেতৃত্বের মধ্যে বিভাজন ছিল এবং সবচেয়ে বড় যে ঘাটতিটি ছিল তা হলো সংগঠন ও দর্শনের পরিষ্কার কাঠামো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল এক প্রবল শক্তি, কিন্তু সেটি কোনো সংগঠিত প্ল্যাটফর্ম ছিল না। ৫ আগস্টের পর যখন এটিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করা হয়, তখনই নানা প্রতিকূলতা দেখা দেয়। নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা, কর্মসূচির অস্পষ্টতা এবং প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষার্থীদের স্থায়ীভাবে মাঠে রাখা যায়নি। ফলে আন্দোলনের সংগঠিত কাঠামো গড়ে ওঠেনি, বরং একেকটি গোষ্ঠী নিজ নিজ অভিপ্রায় অনুযায়ী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। নাহিদ ইসলাম এখানে যে কথাটি বলেন তা আন্দোলনের প্রকৃত ব্যর্থতা: ‘জুলাইয়ের পরে প্রত্যেকে যার যার অ্যাজেন্ডায় চলে গেছে।’ এই চলে যাওয়ার পেছনে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নেতৃত্বের লড়াই এবং পুরোনো ব্যবস্থার মোহ।
নাহিদ বলেছেন, যে ঐক্যটি শুরুতে তৈরি হয়েছিল—ছাত্র, সেনাবাহিনী, কিছু রাজনৈতিক দল এবং অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি সমর্থনের এক অলিখিত সমঝোতা—তা অভ্যুত্থানের পর ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত সবাই একত্র ছিল, কিন্তু পতনের পর কেউ আর এক জায়গায় থাকেনি। ফলে, রাষ্ট্র পুনর্গঠনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা নষ্ট হয়ে যায়। এই ব্যর্থতার দায় কেবল কোনো একটি গোষ্ঠীর নয়, বরং অভ্যুত্থানের সব পক্ষের মধ্যে সামষ্টিক সমন্বয়ের অভাব এর জন্য দায়ী।
বর্তমান সরকারের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নাহিদ যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, তা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো, কিন্তু সেই পরিস্থিতি ধরে রাখার জন্য যে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। পুলিশের সক্রিয়তা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির ওপর নির্ভরশীল ছিল। ৫ আগস্টের পর অনেক থানাই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সক্রিয় হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংগঠিত না রাখতে পারায় সেই গতিও থেমে যায়। সরকার যখন প্রো-অ্যাকটিভ থাকে না, তখনই আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। নাহিদ মনে করেন, যাদের ‘মব’ বলে অপমান করা হচ্ছে, তারা আসলে অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা। সঠিক কর্মসূচি ও নেতৃত্ব না থাকার কারণে তারা বিভ্রান্ত হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে। এই বাস্তবতা বুঝতে না পারলে সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কিন্তু এই ‘মব’ নামক সামাজিক শক্তির বেপরোয়া আচরণ দমন না করলে পরবর্তী সময়ে এটা আরও বিস্ফোরক রূপ নিতে পারে।
এই এক বছরে অভ্যুত্থানের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হয়নি, পুনর্বাসনপ্রক্রিয়ায় রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং শহীদ পরিবারদের অভিযোগও উপেক্ষিত থেকেছে। সরকার বাজেট বরাদ্দ দিলেও তা সরাসরি ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছায়নি। নাহিদ মনে করেন, এই দেরি ও অব্যবস্থার পেছনে রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব এবং সদিচ্ছার ঘাটতি। সরকার চাইলে তালিকাপ্রক্রিয়াটি উন্মুক্ত করে দিয়ে শহীদদের সংখ্যা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারত, নিখোঁজদের অবস্থান জানাতে পারত। কিন্তু তা করা হয়নি।
অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ঐক্য ছিল, তা কেন দ্রুত ভেঙে গেল, সে প্রশ্নের উত্তরও স্পষ্ট করেছেন নাহিদ। তিনি মনে করেন, অনেকেই রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠেন। কে উপদেষ্টা হতে পারল আর কে পারল না—এই প্রশ্ন অনেকের মধ্যে ঈর্ষা তৈরি করে। আবার আন্দোলনের সময় যেসব ছাত্রসংগঠনের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়েনি, তারাও পরে নিজেকে ঐক্যভুক্ত অংশ বলে দাবি করে। নাহিদ এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কোনো সর্বদলীয় ঐক্য প্ল্যাটফর্ম ছিল না। এরপরও তিনি ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রত্যাশার কথা বলেন, জাতির প্রয়োজনে যেন সবাই এক হতে পারে, সেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলা উচিত।
নাহিদ ইসলাম এই মুহূর্তে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি মনে করেন, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো এই অভ্যুত্থানের শক্তিকে ধারণ করতে পারবে না বলেই তাঁরা নতুন দল গঠন করেছেন। যদিও দলের সংগঠন এখনো পুরোপুরি মাঠে গড়ায়নি, তবু জনগণের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন বলে জানান। তিনি এটাও স্বীকার করেন, তাঁদের পারফরম্যান্সে সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। তাঁর মতে, নতুন একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে এনসিপি নিজেরা আগে সংগঠিত হতে চায়, তার পরই নির্বাচনী কৌশল নির্ধারণ করা হবে। নির্বাচন নিয়ে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবেন ৫ আগস্টের পর, যদি এর আগে প্রতিশ্রুত ‘জুলাই সনদ’ প্রকাশ করা যায়।
এখানে এসে একটি গভীর প্রশ্ন সামনে আসে, জুলাই সনদ এক বছরেও কেন হয়নি? সরকার দুই দফা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা দিতে পারেনি। ফলে এনসিপি এখন নিজেই সেই সনদ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মাধ্যমে তারা একটি বিকল্প দর্শন ও রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা দিতে চায়। তাদের ভাষায়, যদি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের দিশা না দেওয়া যায়, তাহলে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।
তবে রাজনৈতিক কাঠামো গড়তে গিয়ে তাঁরা নানা বাধার মুখে পড়েছেন। বিশেষ করে ছাত্র উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ, নেতাদের ব্যক্তিগত অডিও ফাঁস ইত্যাদি নানা ঘটনা অভ্যুত্থানের নৈতিক ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এসব বিষয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, শুরুতে দুর্নীতি ছিল না, কিন্তু পুরোনো ব্যবস্থার লোকেরা সুযোগ পেয়ে পুরোনো প্রক্রিয়া চালু করেছেন। অন্য ছাত্রসংগঠনের সুযোগসন্ধানী কেউ কেউ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরিচয় ব্যবহার করে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি হয়েছে অপপ্রচার। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চরিত্র হননের চেষ্টা হয়েছে, বিশেষ করে নারীনেত্রীদের বিরুদ্ধে। নাহিদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের একটি প্রধান নৈতিক শক্তি ছিল নারীরা। তাই নারীদের রাজপথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো চলছে।’
একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নিয়ে। অনেকেই তাদের একটি ইসলামপন্থী দলের ঘনিষ্ঠ বলে মনে করেন। নাহিদ ইসলাম এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, এনসিপি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক রাজনীতি করতে চায়। একাত্তর, ইসলাম, নারী–এ বিষয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার। তিনি মনে করেন, যোগাযোগের ঘাটতি এবং একটি সংগঠিত অপপ্রচারই এই ভুল ধারণার সৃষ্টি করছে। তাঁর মতে, আওয়ামী লীগ যুগের রাজনীতির ভাষা দিয়ে নতুন রাজনীতিকে বিচার করা ঠিক নয়। নাহিদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি হলো, ‘সুশীল সমাজ এই গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়নি। গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে সাধারণ ছাত্র-জনতার মাধ্যমে।’
বিএনপির ভূমিকাও এনসিপি ইতিবাচকভাবে নিতে পারছে না। তাদের মতে, বিএনপি পুরোনো বন্দোবস্তের বিপক্ষে নয় এবং শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে নিজেরাই ‘নতুন আওয়ামী লীগ’ হতে চায়। তারা নিজস্ব রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং জামায়াত সম্পর্কিত অবস্থান পরিষ্কার করছে না। ফলে একটি পুরোনো ধাঁচের রাজনীতিই আবার ফিরে আসছে।
সবশেষে যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, অভ্যুত্থানের এক বছরে আপনি সরকারের পারফরম্যান্সকে কত নম্বর দেবেন, তখন তিনি নম্বর দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, সরকার কেবল শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে রাজনৈতিক সমর্থন পেয়েছে, অন্য কোনো দলের কাছ থেকে নয়। সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও প্রত্যাশিত সমর্থন আসেনি। সরকারের পক্ষে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, সরকারকে বারবার পুরোনো বন্দোবস্তে ঢোকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কিন্তু তাঁরা সেটা প্রত্যাখ্যান করেছেন। নাহিদ নিজে উপদেষ্টা পদ ছাড়ার পর নিজের ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও সম্পত্তির বিবরণ প্রকাশ করেছেন, কোনো বিদেশ সফর করেননি। সরকারে থেকেও কোনো অনৈতিক সুযোগ গ্রহণ করেননি বলে দাবি করেন।
নাহিদের পুরো বক্তব্যের সারকথা হলো—ফ্যাসিবাদবিরোধী অভ্যুত্থান যদি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা ব্যর্থ হবে। শুধু শেখ হাসিনার পতন কোনো অর্জন নয়। নাহিদ ইসলাম যে কথাটি বলেন, সেটি এই রাজনৈতিক মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি উপলব্ধি—‘নতুন বন্দোবস্ত না হলে, আওয়ামী লীগের পতন করে কী লাভ হলো, যদি আরেকটা আওয়ামী লীগই আসে?’ এই কথাটি নিছক একটি বাক্য নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমরা কি একটি নতুন রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ করব, নাকি পুরোনো কুশাসনের পাথরে ফের মাথা ঠুকব? প্রশ্নের উত্তর এখনো সময়ের হাতে। সময়ের সময় কবে শেষ হবে, দেখার বিষয় সেটাই।
লেখক:– জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক আজকের পত্রিকা

সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা...
১০ ঘণ্টা আগে
বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়...
১০ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ দিন আগেকোনো রাজনীতিকের সামনে সুযোগ বারবার আসে না। সেদিক থেকে তারেক রহমান সৌভাগ্যবান। তাঁর সামনে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এসেছে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার, শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর। রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধাঁচে নিয়ে যাওয়ার অপতৎপরতা রুখে দিতেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন।
আজাদুর রহমান চন্দন

সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা-ভঙ্গুরতার কারণে এই অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এমন কোনো দল বা নেতার প্রয়োজন বোধ করছিলেন মনেপ্রাণে, ঠিক সে সময়ে তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছরের ‘নির্বাসিত’ জীবন শেষ করে দেশে ফিরে সবাইকে নিয়ে সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা-প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘আজ আমাদের সময় এসেছে, সবাই মিলে দেশ গড়ার। এ দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছেন, এ দেশে একইভাবে সমতলেরও মানুষ আছেন; এ দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন।’ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসুন, আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, যে রাজনৈতিক দলেরই সদস্য হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই, আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যেকোনো মূল্যে এ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে; যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে; যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারেন। শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকেন, এই হোক আমাদের চাওয়া।’
এটা ঠিক, এ দেশে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য মানুষ খুব কমই আমলে নেয়। ‘ওসব তো রাজনীতির কথা’—এমন মন্তব্যের মাধ্যমে রাজনীতিবিদেরাও নানা সময়ে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের বক্তব্য নিছকই কথার কথা। তা সত্ত্বেও সংকটে-দুর্বিপাকে মানুষ রাজনীতিকদের ওপরই ভরসা করে থাকেন। এমনই এক সংকটকালে তারেক রহমানের ওপর আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক মানুষকেও, যাঁরা একসময় তাঁকে পছন্দ করতেন না। অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা সত্ত্বেও তারেক রহমান ছাড়া ভরসা করার মতো কাউকে কি এ মুহূর্তে চোখে পড়ছে? রাজনীতিসচেতন মানুষদের কাছে বিএনপির পরিচয় একটি ডান বা মধ্য-ডানপন্থী দল হিসেবে। অতি ডানপন্থার ঝুঁকির মধ্যে এই দলের নেতা কি পারবেন ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে অনেক মানুষের।
এই অবস্থায় তারেক রহমানও আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ মুহূর্তে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের ভেতরের কোন্দল মেটানো, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সকল পর্যায়ে দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে নেতা-কর্মীদের বাধ্য করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো, নেতাদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করাও তাঁর জন্য জরুরি। এরই মধ্যে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা তারেক রহমানের জন্য এক কঠিন কাজ হবে। মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির ভেতরে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তা নিরসন করাও খুব সহজ কাজ নয়। বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণার পাশাপাশি মিত্রদের জন্য কিছু আসন ছাড়ার পর কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ হয়েছে। যশোর-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মনিরামপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। নীলফামারী-১ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রার্থী ঘোষণা করার পর সেখানেও একই ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। কিশোরগঞ্জ-৪ ও ঝিনাইদহ-৪ আসনেও মিত্রদের ছাড় দেওয়ায় তৃণমূল নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করেছেন বিএনপির আলোচিত নেত্রী রুমিন ফারহানা।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে আছে বিএনপি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ২৫৯টি ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৬৬ জন নিহত এবং ২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছেন। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, দলে শৃঙ্খলা ফেরানো কতটা জরুরি। তারেক রহমান এত বছর দল পরিচালনা করেছেন ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে। এখন তিনি দেশে উপস্থিত থাকার সময় যদি দলীয় নেতা-কর্মীরা অপকর্মে জড়ান, তবে তাতে তাঁর সুনাম নষ্ট হবে এবং প্রতিপক্ষ আরও বেশি করে সমালোচনার সুযোগ পাবে।
তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন কি না, সে নিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। সে সুযোগে যাঁরা অনেকটা ‘ফাঁকা মাঠে’ গোল দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে বিএনপির নেতার প্রত্যাবর্তন। উদীয়মান কোনো কোনো দল তো এখন টলমল অবস্থায়। কিছুদিন আগেও যেখানে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার খবর পাওয়া যেত, সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে গেছে। তবে আসন্ন ক্ষমতার হাতছানি দেখে গণমাধ্যমের আনত মস্তকে বন্দনায় মেতে ওঠাটা বিপজ্জনক। বন্দনা ও চাটুকারিতা প্রশ্রয় পেয়ে গেলে নেতৃত্বের সামনে বিপথে চালিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ঝুঁকি কতটা এড়িয়ে চলতে পারেন, সেটিও দেখার বিষয়।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন মাস তিনেক আগে বলেছিলেন, ‘এ দেশে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও নানা ধর্মের মানুষ ও জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করছেন। এখানে সব মত-পথ এবং ধর্মের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারে—এমন নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী অথচ সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতার প্রয়োজন। এ ধরনের নেতা তারেক রহমানকে ছাড়া কাউকে দেখছি না। কারণ, তারেক রহমান মধ্যপন্থী ধারার রাজনীতি করলেও ইসলামি মূলধারার রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদী নেতার যেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই; তেমনি ইঙ্গো-মার্কিন চেতনা এবং বাম চেতনায় বিশ্বাসী তথাকথিত প্রগতিশীল নেতার গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাপিত জীবনে ইসলামি চেতনা ধারণ করেন; কিন্তু কথাবার্তা ও কর্মের মাধ্যমে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’ বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত মাওলানা আবু জাফর কাশেমীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এবং সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান খায়রুল আহসানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল দৈনিক ইনকিলাব ভবনে সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এ এম এম বাহাউদ্দীনের এই মূল্যায়নের মর্যাদাও যদি তারেক রহমান রাখতে পারেন, তবে সামনের দিনগুলোতে সেটিও দেশের জন্য একেবারে কম হবে না।
কোনো রাজনীতিকের সামনে সুযোগ বারবার আসে না। সেদিক থেকে তারেক রহমান সৌভাগ্যবান। তাঁর সামনে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এসেছে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার, শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর। রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধাঁচে নিয়ে যাওয়ার অপতৎপরতা রুখে দিতেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান শাসনকালের সূচনার দিকে তখনকার বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি (মোহাম্মদ গোলাম) তোয়াবের দিক থেকে এমনই এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। এম জি তোয়াব আগে থেকেই কট্টর পাকিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দিক থেকে চ্যালেঞ্জ থাকার কারণেই তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও সীমিত সমর্থন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ মুহূর্তে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও নিরাপত্তার কড়াকড়িতে তারেক রহমানের চলাফেরাসহ কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাটে পোহানো কষ্টটুকু মানুষ মন থেকে মেনে নিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা না-ও হতে পারে। বিষয়টির দিকে বিএনপির নেতার সুনজর বিবেচনা রাখে। সামগ্রিকভাবে তারেক রহমান সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, সে অনুযায়ী অগ্রসর হলেই আপাতত পাওয়া স্বস্তিটুকু স্থায়ী হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা-ভঙ্গুরতার কারণে এই অস্থির ও ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে শান্তিপ্রিয় মানুষ যখন এমন কোনো দল বা নেতার প্রয়োজন বোধ করছিলেন মনেপ্রাণে, ঠিক সে সময়ে তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছরের ‘নির্বাসিত’ জীবন শেষ করে দেশে ফিরে সবাইকে নিয়ে সবার জন্য নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার ইচ্ছা-প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘আজ আমাদের সময় এসেছে, সবাই মিলে দেশ গড়ার। এ দেশে যেমন পাহাড়ের মানুষ আছেন, এ দেশে একইভাবে সমতলেরও মানুষ আছেন; এ দেশে মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করেন।’ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘আসুন, আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, যে রাজনৈতিক দলেরই সদস্য হই, অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই, আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যেকোনো মূল্যে এ দেশের শান্তিশৃঙ্খলা ধরে রাখতে হবে; যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে; যেকোনো মূল্যে আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারেন। শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক, যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকেন, এই হোক আমাদের চাওয়া।’
এটা ঠিক, এ দেশে রাজনীতিবিদদের বক্তব্য মানুষ খুব কমই আমলে নেয়। ‘ওসব তো রাজনীতির কথা’—এমন মন্তব্যের মাধ্যমে রাজনীতিবিদেরাও নানা সময়ে বুঝিয়ে দেন, তাঁদের বক্তব্য নিছকই কথার কথা। তা সত্ত্বেও সংকটে-দুর্বিপাকে মানুষ রাজনীতিকদের ওপরই ভরসা করে থাকেন। এমনই এক সংকটকালে তারেক রহমানের ওপর আস্থা রাখতে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক মানুষকেও, যাঁরা একসময় তাঁকে পছন্দ করতেন না। অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা সত্ত্বেও তারেক রহমান ছাড়া ভরসা করার মতো কাউকে কি এ মুহূর্তে চোখে পড়ছে? রাজনীতিসচেতন মানুষদের কাছে বিএনপির পরিচয় একটি ডান বা মধ্য-ডানপন্থী দল হিসেবে। অতি ডানপন্থার ঝুঁকির মধ্যে এই দলের নেতা কি পারবেন ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে অনেক মানুষের।
এই অবস্থায় তারেক রহমানও আজ কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। এ মুহূর্তে তাঁর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের ভেতরের কোন্দল মেটানো, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং সকল পর্যায়ে দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে নেতা-কর্মীদের বাধ্য করা। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামানো, নেতাদের ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করাও তাঁর জন্য জরুরি। এরই মধ্যে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কয়েকজন নেতা স্বতন্ত্র বা ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের বুঝিয়ে নির্বাচন থেকে বিরত রাখা তারেক রহমানের জন্য এক কঠিন কাজ হবে। মিত্রদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে বিএনপির ভেতরে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তা নিরসন করাও খুব সহজ কাজ নয়। বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণার পাশাপাশি মিত্রদের জন্য কিছু আসন ছাড়ার পর কয়েকটি জেলায় বিক্ষোভ হয়েছে। যশোর-৫ আসনে বিএনপির প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় মনিরামপুর এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন দলীয় নেতা-কর্মীরা। নীলফামারী-১ আসনে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম প্রার্থী ঘোষণা করার পর সেখানেও একই ধরনের বিক্ষোভ হয়েছে। কিশোরগঞ্জ-৪ ও ঝিনাইদহ-৪ আসনেও মিত্রদের ছাড় দেওয়ায় তৃণমূল নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচার শুরু করেছেন বিএনপির আলোচিত নেত্রী রুমিন ফারহানা।
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে সমালোচনার মুখে আছে বিএনপি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ২৫৯টি ঘটনা ঘটেছে। এতে অন্তত ৬৬ জন নিহত এবং ২ হাজার ৯২৩ জন আহত হয়েছেন। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, দলে শৃঙ্খলা ফেরানো কতটা জরুরি। তারেক রহমান এত বছর দল পরিচালনা করেছেন ভার্চুয়ালি যুক্ত থেকে। এখন তিনি দেশে উপস্থিত থাকার সময় যদি দলীয় নেতা-কর্মীরা অপকর্মে জড়ান, তবে তাতে তাঁর সুনাম নষ্ট হবে এবং প্রতিপক্ষ আরও বেশি করে সমালোচনার সুযোগ পাবে।
তারেক রহমান দেশে ফিরতে পারবেন কি না, সে নিয়ে কিছুদিন আগে পর্যন্ত একধরনের অনিশ্চয়তা ছিল। সে সুযোগে যাঁরা অনেকটা ‘ফাঁকা মাঠে’ গোল দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাঁদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে বিএনপির নেতার প্রত্যাবর্তন। উদীয়মান কোনো কোনো দল তো এখন টলমল অবস্থায়। কিছুদিন আগেও যেখানে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেওয়ার খবর পাওয়া যেত, সেখানে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টে গেছে। তবে আসন্ন ক্ষমতার হাতছানি দেখে গণমাধ্যমের আনত মস্তকে বন্দনায় মেতে ওঠাটা বিপজ্জনক। বন্দনা ও চাটুকারিতা প্রশ্রয় পেয়ে গেলে নেতৃত্বের সামনে বিপথে চালিত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ঝুঁকি কতটা এড়িয়ে চলতে পারেন, সেটিও দেখার বিষয়।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীন মাস তিনেক আগে বলেছিলেন, ‘এ দেশে শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান হলেও নানা ধর্মের মানুষ ও জাতিগোষ্ঠী একসঙ্গে বসবাস করছেন। এখানে সব মত-পথ এবং ধর্মের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারে—এমন নেতৃত্বের খুবই প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী অথচ সব ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতার প্রয়োজন। এ ধরনের নেতা তারেক রহমানকে ছাড়া কাউকে দেখছি না। কারণ, তারেক রহমান মধ্যপন্থী ধারার রাজনীতি করলেও ইসলামি মূলধারার রাজনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদী নেতার যেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই; তেমনি ইঙ্গো-মার্কিন চেতনা এবং বাম চেতনায় বিশ্বাসী তথাকথিত প্রগতিশীল নেতার গ্রহণযোগ্যতা নেই। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যাপিত জীবনে ইসলামি চেতনা ধারণ করেন; কিন্তু কথাবার্তা ও কর্মের মাধ্যমে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।’ বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমিরে শরিয়ত মাওলানা আবু জাফর কাশেমীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এবং সম্মিলিত ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান খায়রুল আহসানের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল দৈনিক ইনকিলাব ভবনে সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এসব কথা বলেন। এ এম এম বাহাউদ্দীনের এই মূল্যায়নের মর্যাদাও যদি তারেক রহমান রাখতে পারেন, তবে সামনের দিনগুলোতে সেটিও দেশের জন্য একেবারে কম হবে না।
কোনো রাজনীতিকের সামনে সুযোগ বারবার আসে না। সেদিক থেকে তারেক রহমান সৌভাগ্যবান। তাঁর সামনে দ্বিতীয়বারের মতো সুযোগ এসেছে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার, শান্তিশৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা ফেরানোর। রাষ্ট্রকে পাকিস্তান-আফগানিস্তান ধাঁচে নিয়ে যাওয়ার অপতৎপরতা রুখে দিতেও তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারেন। তাঁর পিতা জিয়াউর রহমান শাসনকালের সূচনার দিকে তখনকার বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি (মোহাম্মদ গোলাম) তোয়াবের দিক থেকে এমনই এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন। এম জি তোয়াব আগে থেকেই কট্টর পাকিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দিক থেকে চ্যালেঞ্জ থাকার কারণেই তখন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিরও সীমিত সমর্থন পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। এ মুহূর্তে দলীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও নিরাপত্তার কড়াকড়িতে তারেক রহমানের চলাফেরাসহ কর্মসূচির কারণে রাস্তাঘাটে পোহানো কষ্টটুকু মানুষ মন থেকে মেনে নিলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা না-ও হতে পারে। বিষয়টির দিকে বিএনপির নেতার সুনজর বিবেচনা রাখে। সামগ্রিকভাবে তারেক রহমান সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, সে অনুযায়ী অগ্রসর হলেই আপাতত পাওয়া স্বস্তিটুকু স্থায়ী হতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়,
০৩ জুলাই ২০২৫
বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়...
১০ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ দিন আগেবিমল সরকার

বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়, বারবার রাজনৈতিক কলহ, শত রকমের বাধাবিপত্তি ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও এ সময়ে কী পাইনি আমরা! আসলে নির্মোহ ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে দেখতে পারলে দুটি পক্ষের কোনোটির মতামতকেই উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না—‘কী পেয়েছি’ আর ‘কী পাইনি’।
এখানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি নিয়ে আমার ছিটেফোঁটা আলোকপাত করার প্রয়াস। ইংরেজরা প্রথমবারের মতো ১৯০৫ সালে বাংলাকে (ব্রিটিশ বাংলা) ভাগ এবং ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রদেশ সৃষ্টি করে। নবগঠিত প্রদেশটির রাজধানী স্থাপন করা হয় ঢাকায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জন-অধ্যুষিত এলাকার চাহিদা ও অন্যান্য যৌক্তিক কারণে করা হলেও মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ সালে তা বাতিল করা হয়। বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকাসহ গোটা পূর্ববঙ্গ ও এই এলাকার মুসলিম জনগণের প্রতি শাসককুল ইংরেজদের একটি বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
বঙ্গভঙ্গের সময় অবিভক্ত বাংলায় একটিই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৫৭ সাল)। এ ছাড়া অবিভক্ত বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম প্রভৃতি) কলেজ ছিল মোট ৩৭টি। এই ৩৭টির মধ্যে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসামে’ (নবগঠিত প্রদেশ) ১১টি এবং অবশিষ্ট বঙ্গে ছিল ২৬টি কলেজ। একই সময় (১৯০৫) সারা বাংলায় এমএ পড়ার কলেজ ছিল মোট তিনটি। বিখ্যাত ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তখন ‘ভরা যৌবন’; খ্যাতি ও গৌরব-গরিমা অনেক দিক থেকেই। তা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ও আসামে (নবগঠিত প্রদেশের অংশ) এমএ পড়ার মতো কোনো কলেজ বা বন্দোবস্ত ছিল না সে সময়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন শর্ত অনুযায়ী ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী ২৫ মাইল পরিধি এলাকায় অবস্থিত কলেজগুলোই (ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ প্রভৃতি ৭টি) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রাখা হয়। পূর্ববঙ্গের বাকি সব কলেজ থেকে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (যা ১৯৪৭ সালে দেশভাগ পর্যন্ত বহাল থাকে)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের প্রথম, অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় (প্রথমটি কলকাতা) এবং উপমহাদেশের ১১তম বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অঞ্চলে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় কলেজসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ববঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে এবং তখনই পূর্ববঙ্গ শিক্ষা অধ্যাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কাম শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ‘এফিলিয়েশন’-এর ব্যবস্থা যোগ করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর (ডিগ্রি স্তরের ৩৪টি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরের ২৩টি) এফিলিয়েশন ও তত্ত্বাবধানের ভার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ওপর ন্যস্ত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় বাংলাদেশ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় একটিই ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল কলেজও একটিই, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ইংরেজ আমলে ১৯৪৬ সালে স্থাপিত)। এ ছাড়া সারা দেশে কলেজ ছিল মোট ৫৫টি (ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরে; এগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ ৪টি)। ঠিক এ সবকিছু নিয়েই পাকিস্তান আমলে যাত্রা শুরু হয় আমাদের।
পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরে অন্যায়, শোষণ আর বৈষম্যের মধ্যেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কাজ সম্পন্ন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এ সময়ে (পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর ২০ বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। এ ছাড়া পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একে একে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় আটটি।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে নানাবিধ, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশে বর্তমানে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি আছে ১১৫টি। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি; বেসরকারি ৭৩টি। বিভাগীয় পাঁচ শহরে রয়েছে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় গোটা জাতিকে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মাথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে?
আসলেই তো! আগে যেমনই থাক বা না থাক, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে কি নেই আমাদের? স্বীকার না করে উপায় নেই, উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশে এ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। সরকারি-বেসরকারি দেড় শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় (১৭২টি)। একইভাবে এক শর বেশি মেডিকেল কলেজ (১১০টি)। রয়েছে পাঁচ বিভাগীয় শহরে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ৭০৮টি সরকারি কলেজ। ডিগ্রি স্তরে পাঠদান উপযোগী কলেজ দুই হাজারের বেশি (২,২৫৭টি)। আর সরকারি-বেসরকারি সাড়ে আট শ কলেজে (৮৮২) অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স (১৭৫) পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত রয়েছে। এসব বিবেচনায় শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপ্লব বলা যেতে পারে।
আমি আবারও কিছুটা অতীতমুখী হতে চাই। ১৯৪৭ সালে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় আর একটি মেডিকেল কলেজ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। ২৪ বছর পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, আটটি মেডিকেল কলেজ, ডিগ্রি স্তরের ১১০টি কলেজ, (যেগুলোর মধ্যে ২৬টি সরকারি) আর অনার্স পড়ানোর মতো কলেজ ২০টি। সে তুলনায় আজ অভাবনীয় পরিবর্তন ও অগ্রগতি সহজেই দৃশ্যমান। তবে উপযুক্ত দেখভালের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক কিছু থাকার পরও কী যেন নেই আমাদের। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক যাযাবরের (বিনয়কুমার মুখোপাধ্যায়) অমর সৃষ্টি ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। যাযাবর তাঁর কালজয়ী উপন্যাস শেষ করেন এই বাক্যটি দিয়ে—‘যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।’ আমাদের উচ্চ শিক্ষপ্রতিষ্ঠানেও যেন এমন শিক্ষারূপী আগুন আছে, যা আলো দেয় না অথচ প্রতিনিয়ত দহন করে চলেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়, বারবার রাজনৈতিক কলহ, শত রকমের বাধাবিপত্তি ও দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও এ সময়ে কী পাইনি আমরা! আসলে নির্মোহ ও পক্ষপাতহীন দৃষ্টিতে দেখতে পারলে দুটি পক্ষের কোনোটির মতামতকেই উপেক্ষা করার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না—‘কী পেয়েছি’ আর ‘কী পাইনি’।
এখানে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রটি নিয়ে আমার ছিটেফোঁটা আলোকপাত করার প্রয়াস। ইংরেজরা প্রথমবারের মতো ১৯০৫ সালে বাংলাকে (ব্রিটিশ বাংলা) ভাগ এবং ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম’ নামে স্বতন্ত্র একটি প্রদেশ সৃষ্টি করে। নবগঠিত প্রদেশটির রাজধানী স্থাপন করা হয় ঢাকায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জন-অধ্যুষিত এলাকার চাহিদা ও অন্যান্য যৌক্তিক কারণে করা হলেও মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯১১ সালে তা বাতিল করা হয়। বঙ্গভঙ্গ এবং বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকাসহ গোটা পূর্ববঙ্গ ও এই এলাকার মুসলিম জনগণের প্রতি শাসককুল ইংরেজদের একটি বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়।
বঙ্গভঙ্গের সময় অবিভক্ত বাংলায় একটিই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছিল—কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৫৭ সাল)। এ ছাড়া অবিভক্ত বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম প্রভৃতি) কলেজ ছিল মোট ৩৭টি। এই ৩৭টির মধ্যে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসামে’ (নবগঠিত প্রদেশ) ১১টি এবং অবশিষ্ট বঙ্গে ছিল ২৬টি কলেজ। একই সময় (১৯০৫) সারা বাংলায় এমএ পড়ার কলেজ ছিল মোট তিনটি। বিখ্যাত ঢাকা কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, রাজশাহী কলেজ, জগন্নাথ কলেজসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের তখন ‘ভরা যৌবন’; খ্যাতি ও গৌরব-গরিমা অনেক দিক থেকেই। তা সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) ও আসামে (নবগঠিত প্রদেশের অংশ) এমএ পড়ার মতো কোনো কলেজ বা বন্দোবস্ত ছিল না সে সময়।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন শর্ত অনুযায়ী ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী ২৫ মাইল পরিধি এলাকায় অবস্থিত কলেজগুলোই (ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজ প্রভৃতি ৭টি) এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় রাখা হয়। পূর্ববঙ্গের বাকি সব কলেজ থেকে যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে (যা ১৯৪৭ সালে দেশভাগ পর্যন্ত বহাল থাকে)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ববঙ্গের প্রথম, অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় (প্রথমটি কলকাতা) এবং উপমহাদেশের ১১তম বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গ এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই অঞ্চলে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় কলেজসহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।
১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। পূর্ববঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় পাকিস্তানের সঙ্গে এবং তখনই পূর্ববঙ্গ শিক্ষা অধ্যাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক কাম শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে ‘এফিলিয়েশন’-এর ব্যবস্থা যোগ করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর (ডিগ্রি স্তরের ৩৪টি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরের ২৩টি) এফিলিয়েশন ও তত্ত্বাবধানের ভার এই বিশ্ববিদ্যালয়টির (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ওপর ন্যস্ত হয়।
পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় বাংলাদেশ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় একটিই ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মেডিকেল কলেজও একটিই, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ইংরেজ আমলে ১৯৪৬ সালে স্থাপিত)। এ ছাড়া সারা দেশে কলেজ ছিল মোট ৫৫টি (ডিগ্রি ও ইন্টারমিডিয়েট স্তরে; এগুলোর মধ্যে সরকারি কলেজ ৪টি)। ঠিক এ সবকিছু নিয়েই পাকিস্তান আমলে যাত্রা শুরু হয় আমাদের।
পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছরে অন্যায়, শোষণ আর বৈষম্যের মধ্যেও উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেশ কিছু উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কাজ সম্পন্ন হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় এ সময়ে (পাকিস্তান সৃষ্টির ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৩ সালে হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর ২০ বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)। এ ছাড়া পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে একে একে মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় আটটি।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে নানাবিধ, তেমনি উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশে বর্তমানে ৫৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি আছে ১১৫টি। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি; বেসরকারি ৭৩টি। বিভাগীয় পাঁচ শহরে রয়েছে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এত কিছু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় গোটা জাতিকে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরের মাথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে?
আসলেই তো! আগে যেমনই থাক বা না থাক, শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমানে কি নেই আমাদের? স্বীকার না করে উপায় নেই, উচ্চশিক্ষায় আমাদের দেশে এ এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। সরকারি-বেসরকারি দেড় শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় (১৭২টি)। একইভাবে এক শর বেশি মেডিকেল কলেজ (১১০টি)। রয়েছে পাঁচ বিভাগীয় শহরে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া ৭০৮টি সরকারি কলেজ। ডিগ্রি স্তরে পাঠদান উপযোগী কলেজ দুই হাজারের বেশি (২,২৫৭টি)। আর সরকারি-বেসরকারি সাড়ে আট শ কলেজে (৮৮২) অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স (১৭৫) পড়ানোর ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত রয়েছে। এসব বিবেচনায় শিক্ষাক্ষেত্রে এক বিপ্লব বলা যেতে পারে।
আমি আবারও কিছুটা অতীতমুখী হতে চাই। ১৯৪৭ সালে একটিমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় আর একটি মেডিকেল কলেজ দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। ২৪ বছর পর ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়, আটটি মেডিকেল কলেজ, ডিগ্রি স্তরের ১১০টি কলেজ, (যেগুলোর মধ্যে ২৬টি সরকারি) আর অনার্স পড়ানোর মতো কলেজ ২০টি। সে তুলনায় আজ অভাবনীয় পরিবর্তন ও অগ্রগতি সহজেই দৃশ্যমান। তবে উপযুক্ত দেখভালের অভাব ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে অনেক কিছু থাকার পরও কী যেন নেই আমাদের। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অস্বস্তি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে সব সময় ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক যাযাবরের (বিনয়কুমার মুখোপাধ্যায়) অমর সৃষ্টি ‘দৃষ্টিপাত’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে। যাযাবর তাঁর কালজয়ী উপন্যাস শেষ করেন এই বাক্যটি দিয়ে—‘যে আগুন আলো দেয় না অথচ দহন করে, সেই দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহনে পলে পলে দগ্ধ হলেন কাণ্ডজ্ঞানহীন হতভাগ্য চারুদত্ত আধারকার।’ আমাদের উচ্চ শিক্ষপ্রতিষ্ঠানেও যেন এমন শিক্ষারূপী আগুন আছে, যা আলো দেয় না অথচ প্রতিনিয়ত দহন করে চলেছে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়,
০৩ জুলাই ২০২৫
সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা...
১০ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য তাসনিম জারা। এখন তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। গতকাল পদত্যাগ করেন আরেক নেত্রী তাজনূভা জাবীন। এর আগে দল থেকে পদত্যাগ করেন এনসিপিতে জামায়াতবিরোধী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত মীর আরশাদুল হক। এরপর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দলের ৩০ জন নেতা এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামকে ‘সম্ভাব্য জোট বিষয়ে নীতিগত আপত্তি’র বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো ধরনের জোট এনসিপির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের জোট এনসিপির বহু কর্মী, সমর্থক এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মসহ অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে এনসিপির নিজস্ব মধ্যপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিছুদিন আগে বিএনপি ও জামায়াত জোটের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এনসিপি ও এবি পার্টি মিলে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন করেছিল। আপাতত এ জোটের কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ‘জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। গতকাল ২৮ ডিসেম্বর সকালে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ মিডিয়া গ্রুপে এ মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে জোটগত রাজনীতি একটা পুরোনো সংস্কৃতি। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য সমমনা দলের সঙ্গে জোট করা নতুন বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগকে পরাস্ত করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। এরপর নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করার জন্য ত্রিদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। তাদের সম্মিলিত আন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে নির্বাচনী জোটে দেশ ও জনগণের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যেমন বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে সরকার গঠন করেছিল। এরপর শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী হওয়ার ক্ষেত্রে এই জোটের ভূমিকাও ছিল। সবচেয়ে ক্ষতির দিক হলো, ছোট দলগুলো সুবিধার জন্য জোট করে পরবর্তী সময়ে বড় দলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তাদের আর নিজস্ব রাজনীতি থাকে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করা দল এনসিপি সম্ভবত একই ভুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নানা সমালোচনার পরও দলটি যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সাময়িক নির্বাচনী সুবিধার জন্য সে সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার পথে। এতে হতাশ হবে তরুণদের একটি বড় অংশ। হতাশ হবে দেশের নতুন রাজনীতিপ্রত্যাশী একটি শক্তি, যারা বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের বাইরে বিকল্প খুঁজছিল।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির নির্বাচনী আসন সমঝোতার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দল থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ও রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য তাসনিম জারা। এখন তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। গতকাল পদত্যাগ করেন আরেক নেত্রী তাজনূভা জাবীন। এর আগে দল থেকে পদত্যাগ করেন এনসিপিতে জামায়াতবিরোধী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত মীর আরশাদুল হক। এরপর ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দলের ৩০ জন নেতা এনসিপির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামকে ‘সম্ভাব্য জোট বিষয়ে নীতিগত আপত্তি’র বিষয়ে একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। তাতে তাঁরা বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো ধরনের জোট এনসিপির নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এ ধরনের জোট এনসিপির বহু কর্মী, সমর্থক এবং বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মসহ অনেক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও হতাশা সৃষ্টি করবে। এর মাধ্যমে এনসিপির নিজস্ব মধ্যপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কিছুদিন আগে বিএনপি ও জামায়াত জোটের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, এনসিপি ও এবি পার্টি মিলে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট গঠন করেছিল। আপাতত এ জোটের কোনো ভবিষ্যৎ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ‘জামায়াতে ইসলামী নির্ভরযোগ্য মিত্র নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। গতকাল ২৮ ডিসেম্বর সকালে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ মিডিয়া গ্রুপে এ মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশে জোটগত রাজনীতি একটা পুরোনো সংস্কৃতি। প্রতিপক্ষ রাজনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য সমমনা দলের সঙ্গে জোট করা নতুন বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগকে পরাস্ত করতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যুক্ত ফ্রন্ট গঠিত হয়েছিল। এরপর নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলন করার জন্য ত্রিদলীয় জোট গঠিত হয়েছিল। তাদের সম্মিলিত আন্দোলনে এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। তবে নির্বাচনী জোটে দেশ ও জনগণের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়। যেমন বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ১৪ দলীয় জোট গঠন করে সরকার গঠন করেছিল। এরপর শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী হওয়ার ক্ষেত্রে এই জোটের ভূমিকাও ছিল। সবচেয়ে ক্ষতির দিক হলো, ছোট দলগুলো সুবিধার জন্য জোট করে পরবর্তী সময়ে বড় দলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তাদের আর নিজস্ব রাজনীতি থাকে না।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করা দল এনসিপি সম্ভবত একই ভুলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
নানা সমালোচনার পরও দলটি যে সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল, সাময়িক নির্বাচনী সুবিধার জন্য সে সম্ভাবনা নষ্ট হওয়ার পথে। এতে হতাশ হবে তরুণদের একটি বড় অংশ। হতাশ হবে দেশের নতুন রাজনীতিপ্রত্যাশী একটি শক্তি, যারা বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের বাইরে বিকল্প খুঁজছিল।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়,
০৩ জুলাই ২০২৫
সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা...
১০ ঘণ্টা আগে
বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়...
১০ ঘণ্টা আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১ দিন আগে
ড. কামরুল হাসান মামুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। হামবোল্ট রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন জার্মানির পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার অসংগতি, বৈষম্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন তিনি। শিক্ষা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান, ছাত্র সংসদ, ছাত্ররাজনীতির গতিধারা এবং শিক্ষাব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা
মাসুদ রানা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মূল দাবি ছিল ‘বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠন’। গত দেড় বছরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেই কাঙ্ক্ষিত বৈষম্যহীনতার পথে কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
প্রশ্ন হলো, বৈষম্যহীনতা মূল রেখে, ডালপালা ছাঁটলে তো কোনো লাভ হবে না। বৈষম্য তো রয়ে গেছে আমাদের মূলে। একটা দেশে কীভাবে কওমি মাদ্রাসা, আলিয়া মাদ্রাসা, বাংলা মিডিয়াম, বাংলার আবার ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম থাকতে পারে? আমি আমার শিক্ষকতা জীবনে দেখেছি, এইসব শিক্ষাকাঠামোর কোথাও মিলনস্থান নেই। এভাবে আমরা আমাদের দেশের মানুষকে শিক্ষা, অর্থনীতি ও ধর্ম দিয়ে বিভাজিত করেছি। এ রকম একটা সমাজে বৈষম্যহীন করার জন্য যে ধরনের প্রজ্ঞা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি লাগে, তার তো সব অনুপস্থিতি এখনো আছে।
সুতরাং আমি গত দেড় বছরে বাংলাদেশের কোনো পর্যায়েই বৈষম্যহীনতা তো দূরের কথা, বৈষম্য কমানোর চেষ্টা দেখিনি। গরিব মানুষ আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়তোবা আরও বেশি ধনী হয়েছে। কিন্তু বৈষম্য কোনো দিক দিয়েই কমেনি।
আগের সরকারের প্রবর্তিত নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। বর্তমান সরকার যে পরিমার্জন এনেছে, তা শিক্ষাব্যবস্থার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা কি রেখেছে?
আগের সরকার যা করেছে এবং বর্তমান সরকার যা করছে, আসলে তা হলো মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আগের সরকার মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সব সদস্যকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যবহার করেছে। আর এই সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই চব্বিশের আন্দোলনকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কোনো বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটা সময় লাগে। ইতিহাসকে আসলে একটা সময় দিতে হয়। এটা সত্যি সত্যি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য কি না, সেটা সময়ের আলোকে আসলে রেকটিফাই ও টেস্ট করতে হয়। মানে ফিল্টারিং প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এখনই এটা দেওয়ার মানে হলো, আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান, ঠিক যেভাবে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছিল। ইতিহাস তো ব্যবহার্য বিষয় না। ইতিহাস তো ধারণ করার বিষয়।
চব্বিশকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা মানেই হলো, আপনাদের কোনো লাভের বিষয় আছে। আপনারা এটাকে ব্যবহার করতে চান টিস্যু পেপারের মতো। শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহার করে আপনারা আপনাদের হীন স্বার্থ হাসিলের ব্যবস্থা করবেন, সেটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কাকে বাদ দেওয়া হবে? রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দকে বাদ দেওয়া যায়? এঁদের কবিতা ও অন্যান্য লেখা দিয়ে ধর্ম ও জাতিভেদের ব্যাপারগুলো টেনে নিয়ে আসা ঠিক না। তাঁরা সময় দ্বারা পরীক্ষিত। ভালো মানের লোক দিয়ে একটা শিক্ষা কমিশন করা দরকার ছিল। কিন্তু এই সরকারের কি ম্যান্ডেট থাকতে পারে আমলাদের দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় যোগ বা বিয়োগ করার? তাদের এই যোগ ও বাদ দেওয়ার কোনোটাই সমর্থন করতে পারি না।
গত দেড় বছরের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির পটপরিবর্তনকে কীভাবে দেখেন?
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর মানুষের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনীতি করবে, লেজুড়বৃত্তি করবে না। কোনো দলের জাতীয় নেতারা অন্যায় করলে সেটার প্রতিবাদ করবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের দাবির মধ্যে থাকবে, শিক্ষায় কীভাবে বাজেট বৃদ্ধি করা যায়, গবেষণায় কীভাবে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায়; শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে ও এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে যুক্ত থাকবে এবং সব সময় সজাগ দৃষ্টি রাখবে—দেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যখন দলীয় বৃত্তের মধ্যে চলে যায়, তখন একটা দলের মধ্যে আটকে থাকলে তো তারা পুরো আকাশ দেখতে পাবে না। সে কারণে তারা সেই দলের কোনো অন্যায় কর্মকাণ্ডকে মাফ করে দেয়। আর অন্য দলের সামান্য অন্যায়কে বড় করে দেখে থাকে। এটা শিক্ষার্থীদের চরিত্র হওয়া উচিত না। এই আকাঙ্ক্ষাটা জুলাই আন্দোলনের পর তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেটা আবার ফিরে এসেছে। দলান্ধতা আবার বেড়ে
গেছে। কিন্তু সবার না। যেমন উগ্র ডানপন্থীদের কার্যক্রম প্রচণ্ড রকম বেড়ে গেছে। কিন্তু এটাকে প্রতিহত করার জন্য তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে ডাকসুসহ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের কার্যক্রমকে কীভাবে দেখেন?
ছাত্র সংসদের কিছু দায়িত্ব আছে। তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত এবং কী করা উচিত না, সেগুলোর সবকিছু লিখিত না থাকলেও অধিকাংশ জনের কাছে সেগুলোর একটা ধারণা আছে। ছাত্র সংসদের কাজ তো ছিন্নমূল মানুষকে লাঠির বাড়ি দিয়ে উঠিয়ে দেওয়া না। ছাত্র সংসদের কাজ গুন্ডামি করা নয় বা কাউকে পেটানো না। তারা নিজেদের প্রশাসনের অংশ মনে করে। উপাচার্য বলেন, ‘তোমরা আমাদেরই পার্ট।’ তা হতে পারে না।
ছাত্র সংসদের নির্ধারিত কাজ হচ্ছে সাংস্কৃতিক, খেলাধুলার বিষয়গুলো দেখভাল করা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও গবেষণাকে কীভাবে অগ্রসর করা যায়, কীভাবে লেখাপড়ার মান আরও উন্নত করা যায়—এসব নিয়ে কাজ করা। উন্নত দেশের ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিরা নতুন ছাত্র যারা ভর্তি হয়েছে, তাদের প্রয়োজনে বাসস্ট্যান্ড ও বিমানবন্দর থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে থাকে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে বা গ্রাম থেকে যখন শিক্ষার্থীরা আসে, নতুন একটা শহর চেনার কথা না। ছাত্র সংসদের প্রতিনিধিদের কাজ আসলে এগুলোই। শিক্ষার্থীরা কীভাবে স্কলারশিপ পাবে, কে আর্থিকভাবে দুর্বল—এদের জন্যই তারা কাজ করবে। কিন্তু আসল কাজ বাদ দিয়ে এরা যা করছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটা দলকে কীভাবে জাতীয় নির্বাচনে জয়ী করা যায়, সেগুলোতে তাদের মূল আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পরিবেশ ফিরে এসেছে?
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই সরকার তো নির্দলীয়। এই নির্দলীয় সরকার কি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সত্যিকারের একাডেমিকভাবে যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিয়েছে? সব ক্ষেত্রেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ দলীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই দলীয় উপাচার্যরা নিয়োগ পাওয়ার পর প্রশাসনিক সব পদে প্রভোস্ট, প্রক্টর ও ডিনদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। গত সরকার যা করেছে, এর আগে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন যা করেছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেও কোনো পার্থক্য দেখা গেল না।
সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একটি নতুন সরকার ক্ষমতায় আসবে। তারা কি শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে নতুন আশার আলো দেখাতে পারবে?
এই দেশে সবদিক দিয়ে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যা হলো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা। যেহেতু দেশের শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের মান ভালো না, সেহেতু দেশের লক্ষ-কোটি টাকা ডলারে রূপান্তরিত হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। প্রতিবছর দেশ থেকে প্রায় ১৫-২০ হাজার শিক্ষার্থী শুধু পড়ালেখার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার একটা বড় অংশ শুধু শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে। শুধু অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে না, অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বিদেশে চলে যাচ্ছেন। কোনো সরকার কি পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে, যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তার কত অংশ দেশে ফিরে আসছেন? এ দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা শেষ করে এই যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিদেশে চলে যাচ্ছেন, এটাকেই বলা হয় ‘ব্রেন ড্রেন’। আমরা যাঁদের মেধাবী হিসেবে তৈরি করছি, তাঁদের সেবাটা পাচ্ছে না এ দেশ। তার চিত্রটা দেখা পাওয়া যায় রাস্তাঘাটে হাঁটলে। শুধু তা-ই না, এ দেশে আরেকটা সমস্যা তৈরি হয়েছে—গত সাড়ে ১৫ বছরে থিয়েটার, টেলিভিশন, গানের শিল্পীসহ নানা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে গেছেন। সুতরাং শিক্ষক, ছাত্র ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব দেশ থেকে চলে যাওয়ার কারণে দেশে মেধাবীদের একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
একটা দেশ উন্নত হওয়ার জন্য প্রয়োজন একটা নির্দিষ্টসংখ্যক উচ্চ মানের মানুষের। এঁদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে শরীরের রক্তশূন্যতার মতো। আমরা এখন সেই রক্তশূন্যতার মধ্যে ভুগছি। প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যাও কমে গেছে। সমাজকে সুস্থ রাখার জন্য প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়া দরকার।
শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি ভালো করা না যায়, তাহলে দেশে বেকার সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার কারণে বেকারের সংখ্যা প্রচুর। বেকারত্বের কারণেই দেশে নানা ধরনের অরাজকতা তৈরি হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের কাছে আমার আবেদন বা অনুরোধ থাকবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কারণ, প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষ তৈরি হয়। আগে উন্নত মানুষ তৈরি করতে হবে। কারণ, উন্নত মানুষের মাধ্যমেই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব। দালানকোঠা নির্মাণ করে দেশ উন্নত করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর এমন একটা দেশ পাওয়া যাবে না, যে দেশ শিক্ষায় উন্নত না হয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হতে পেরেছে। একটা উদাহরণ দিই। আজ থেকে ৩০ বছর আগেও চীনের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে ১০০-এর মধ্যে ছিল না। সেই চীনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০-এর মধ্যে অবস্থান করছে। আশা করা যায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যে তারা দশের মধ্যে চলে আসবে। এই যে চলে আসা এবং তাদের যে অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন, দুটিই হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা ও আপনাকেও ধন্যবাদ।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল, তার বছরপূর্তি সামনে রেখে ওই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকারে দেওয়া বক্তব্য থেকে আমরা জানতে পারি, জুলাই অভ্যুত্থান ছিল শুধু সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন নয়,
০৩ জুলাই ২০২৫
সুযোগসন্ধানী উগ্রপন্থীদের মব-তাণ্ডবে সৃষ্ট মারাত্মক অস্থির-অনিশ্চিত এক সময়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তন যেন স্বস্তির একরাশ হাওয়ার মতো। দেশে বাম, মধ্য বাম ও উদার মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতা...
১০ ঘণ্টা আগে
বেশ খেদের সঙ্গে অনেকেরই জিজ্ঞাসা—স্বাধীনতা লাভের পর বিগত পাঁচ দশক তথা ৫৪ বছরে (১৯৭১-২০২৫) শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের অর্জন কী; কী পেয়েছি এই সুদীর্ঘ সময়ে? আবার তৃপ্তির ঢেকুর তুলে খুবই উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে অনেককে এ কথাও বলতে শোনা যায়...
১০ ঘণ্টা আগে
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণদের দল এনসিপিতে মহাদঙ্গল শুরু হয়েছে। দলটি মধ্যপন্থী রাজনীতি, দ্বিতীয় রিপাবলিক এবং নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে যাত্রা শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠার এক বছর না যেতেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধতা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
১০ ঘণ্টা আগে