হুসাইন আহমদ

মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।

মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।

মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:
হুসাইন আহমদ

মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।

মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

মানবিক করিডর এখন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডর প্রস্তাব করা হয়েছে। চলতি বছর মার্চে বাংলাদেশ সফরে এসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর পথ (হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ) দেওয়ার সম্ভাবনার কথা তুললে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আর সম্প্রতি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন মানবিক সহাcয়তা করিডর দিতে ‘সরকার নীতিগতভাবে সম্মত’ বলে জোরালো আলোচনা ও বিতর্ক উসকে দিয়েছেন।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার কীভাবে ‘নীতিগত’ সিদ্ধান্ত নিল, সেই প্রশ্ন তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। করিডরে মানবিক সহায়তার উদ্দেশ্য কতটুকু সাধন হবে এবং বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে কি না, তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। জাতীয় সংসদের অনুপস্থিতিতে এই ধরনের সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকার আদৌ নিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
এ তো গেল বাংলাদেশের দিক, এখানে মিয়ানমার ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তির সংশ্লিষ্টতার দিকও আছে। সেই শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য না হলে করিডরের উদ্দেশ্য কোনোভাবেই সফল হবে না। করিডরের জন্য মিয়ানমারে জান্তা সরকার, আরাকান আর্মি ও সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক সব পক্ষ থেকে সম্মতির দরকার হবে। বিশেষ করে, ভারত ও চীন কী ভূ-রাজনৈতিক কৌশল নিতে পারে, তা ভাবাটা অপরিহার্য। এসব ঠিকঠাক করে করিডর দেওয়া হলেও তা বাংলাদেশের জন্য সামরিক ও নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলে এমন করিডর থেকে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল নয়। নিরাপদে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া এবং ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য মানবিক করিডর ব্যবহৃত হয়। সে ক্ষেত্রে যুদ্ধরত পক্ষ চুক্তি বা সমঝোতা লঙ্ঘন করলে করিডরের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে পারে। এমন ব্যর্থতার উদাহরণ বিরল নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানবিক করিডরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, ফলে সরতে থাকা মানুষ ও ত্রাণকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন। আর গাজার জন্য খোলা করিডরেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত ছিল।
কাজেই পর্যাপ্ত নজরদারি, পারস্পরিক আস্থা ও আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মানবিক করিডর পরিচালিত না হলে তা সহায়তার পরিবর্তে ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেই বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা গাজা হতে চাই না।’ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সরকারের এ ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেন তিনি।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে করিডরের বিকল্প প্রস্তাবও জনপরিসরে আসছে। ঠিক কোন জায়গা দিয়ে করিডর দেওয়া হবে, তা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না পেলেও যে জায়গাটি নিয়ে গণমাধ্যমে বেশ গুঞ্জন রয়েছে, সেটি ঠিক বঙ্গোপসাগরের ওপরে। অনেকে বলছেন, বঙ্গোপসাগরের তীরে মিয়ানমারের এ রকম বহু উপকূলীয় জায়গা আছে, যেগুলো জাতিসংঘ ও পশ্চিমা দেশগুলো রাখাইনে মানবিক সহায়তার জন্য ব্যবহার করতে পারে। সিত্তে বন্দর এ রকম একটি এলাকা হতে পারে। তা ছাড়া ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওয়ের সঙ্গেও মিয়ানমারের সীমান্ত আছে। এই দেশগুলোর কাছেও করিডর চাইতে পারে জাতিসংঘ।

মানবিক করিডরের জন্য যে জায়গাটি নিয়ে আলোচনা চলছে, তা টেকনাফ সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত সিলখালী। আশপাশে ঘন জঙ্গল, গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ারিং রেঞ্জ। এখানে করিডর করার পেছনে পশ্চিমা শক্তিগুলোর চীনবিরোধী প্রক্সি যুদ্ধের পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মধ্যে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিক ও সেনা কর্মকর্তাদের ঢাকা সফরের পর যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তার মধ্যে সে রকম ইঙ্গিত রয়েছে।
করিডরে শর্তাবলি কী হবে, তা এখনো জানা যায়নি। সরকার যেমন মানবিক দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছে, তেমনি সীমান্তের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়বদ্ধতাও কোনো অংশ কম নয়। রাখাইনে ত্রাণ পাঠানোর করিডরে আরাকান আর্মির মতো সশস্ত্র গোষ্ঠী লাভবান হতে পারে। মিয়ানমার জান্তার পাশপাশি তাঁদের বিরুদ্ধেও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী করিডরে উপকৃত হলে তা বাংলাদেশের ‘নৈতিক অবস্থান ও আন্তর্জাতিক সুনামকে’ ক্ষুণ্ন করতে পারে।
তা ছাড়া মিয়ানমার সীমান্তে সংঘাত ছড়িয়ে পড়লে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে, যা নতুন করে মানবিক বিপর্যয়ের জন্ম দেবে। তখন করিডর অরক্ষিত হতে পারে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে। এই সংকটে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মক হুমকিতে পড়বে। পোশাকশিল্প, চট্টগ্রাম-মংলা বন্দর, বিদেশি বিনিয়োগ, এমনকি চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলেও নিরাপত্তার সংকট তৈরি হতে পারে।
রাখাইনে করিডরকে যেভাবে দেখতে পারে ভারত-চীন
রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের প্রস্তাব মানবিক উদ্যোগ হলেও এর আড়ালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মিকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে গণমাধ্যমে লেখা হচ্ছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে ভারত ও চীনের সুসম্পর্ক। দুই দেশেরই রাখাইনে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আরাকান আর্মির কারণে সেই বিনিয়োগ কোনোভাবে ঝুঁকিতে পড়লে তা ভারত ও চীনের জন্য বাস্তব উদ্বেগের কারণ।
রাখাইনে কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট প্রজেক্ট (কেএমটিটিপি) বাস্তবায়ন করছে ভারত। এটি সড়ক, নদী ও সমুদ্রপথ—তিনটির সমন্বয়ে গঠিত একটি বহুমুখী পরিবহনব্যবস্থা। ৪৮ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারের এই প্রকল্প সমুদ্রপথে ভারতের কলকাতা সমুদ্রবন্দরকে সিত্তে সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে এবং মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে বিকল্প বাণিজ্যিক রুট তৈরির মাধ্যমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মিজোরামকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এখন আরাকান আর্মি বিদেশি সহায়তা পেলে এই প্রকল্প আক্রান্ত হতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা রয়েছে। এর সঙ্গে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরাকান আর্মির পুরোনো সম্পর্কের পুরোনো উদ্বেগ তো আছেই।
মিয়ানমার জান্তার আরেক বন্ধু চীনেরও বড় উদ্বেগের কারণ আছে। ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে রাখাইনে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে চীন, যা ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এই বিনিয়োগের মূল লক্ষ্য হলো চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশকে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করা, মালাক্কা প্রণালির ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করা।
চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের (সিএমইসির) অংশ হিসেবে রাখাইনের কিয়াকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দর, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ করছে চীন। এই বন্দর ইউনানের সঙ্গে সংযোগকারী তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের প্রান্তবিন্দু। এটি চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
সেখানে চীনের জাতীয় পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের তেল ও গ্যাস টার্মিনাল রয়েছে, যা থেকে কুনমিং পর্যন্ত চীনের পাইপলাইন বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে কিয়াকফিউ বন্দরের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এসব প্রকল্পসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও জ্বালানি খাতভিত্তিক একগুচ্ছ প্রকল্পে রাখাইনে চীনের সহায়তায় মোট ২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রকল্প চলমান আছে।
‘মালাক্কা ডিলেমা’ হিসেবে পরিচিত ভারতের কাছে চীনের কৌশলগত দুর্বলতা কাটানোর একমাত্র পথ রাখাইন। কারণ, মালাক্কা প্রণালি ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ। এই পথেই চীনকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হয়, যা চীনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিকল্প হিসেবে রাখাইনের বন্দর তৈরি করছে চীন। এখন সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য প্রভাব চীনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ খোঁজে, তাহলে এতে চীন ও ভারতের অসন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা উদ্বেগ— দুটিই বাড়ার যৌক্তিক কারণ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় এই করিডরকে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখতে পারে ভারত ও চীন। এতে ভবিষ্যতে দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অবনতি ঘটবে।
এখন প্রশ্ন হলো— দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাতের এবং ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির ঝুঁকির বিনিময়ে করিডর দিয়ে বাংলাদেশ কী পাবে। দেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হলে সেটা ভাবার হয়তো সুযোগ আছে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত না হলে সেটার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না।
মানবিক সহায়তা করিডর হয়তো কিছু জীবন রক্ষা করতে পারে, যদিও এর নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু ভুল কৌশল নতুন সংকট ডেকে আনতে পারে। এই সুযোগে বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের একটা কৌশলগত অবস্থান তৈরি হবে কি না, তা জাতির জন্য বড় ভাবনার ও আশঙ্কার বিষয়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—স্বার্থপর ও সাময়িক কূটনৈতিক লাভের ফাঁদে না পড়ে নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দেশের নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ভারসাম্য বজায় রাখা।
লেখক:
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আরও খবর পড়ুন:

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
১৩ ঘণ্টা আগে
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন...
১৩ ঘণ্টা আগে
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা...
১৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ...
১৩ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।
গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।
বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।
এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।
এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে চরম ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি। মিয়ানমারের জান্তা, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ভারত-চীনের প্রতিক্রিয়া না বুঝে করিডর চালু করলে তা ‘প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদে’ পরিণত হতে পারে। ভারতের কালাদান প্রকল্প ও চীনের ২১ বিলিয়ন ডলারের
৩০ এপ্রিল ২০২৫
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন...
১৩ ঘণ্টা আগে
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা...
১৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ...
১৩ ঘণ্টা আগেঅরুণ কর্মকার

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।
এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।
দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।
প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!
তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?
কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।
এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।
এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।
দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।
প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!
তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?
কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।
সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে চরম ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি। মিয়ানমারের জান্তা, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ভারত-চীনের প্রতিক্রিয়া না বুঝে করিডর চালু করলে তা ‘প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদে’ পরিণত হতে পারে। ভারতের কালাদান প্রকল্প ও চীনের ২১ বিলিয়ন ডলারের
৩০ এপ্রিল ২০২৫
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
১৩ ঘণ্টা আগে
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা...
১৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ...
১৩ ঘণ্টা আগেহাসান আলী

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।
প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।
পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।
বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।
আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।
বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।
প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।
আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।
প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।
পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।
বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।
আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।
বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।
প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।
আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে চরম ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি। মিয়ানমারের জান্তা, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ভারত-চীনের প্রতিক্রিয়া না বুঝে করিডর চালু করলে তা ‘প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদে’ পরিণত হতে পারে। ভারতের কালাদান প্রকল্প ও চীনের ২১ বিলিয়ন ডলারের
৩০ এপ্রিল ২০২৫
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
১৩ ঘণ্টা আগে
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন...
১৩ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ...
১৩ ঘণ্টা আগেসাদিয়া সুলতানা রিমি

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।
বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।
এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।
বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।
বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।
কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।
বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।
এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।
একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।
নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।
বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।
বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।
শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

রাখাইনে মানবিক করিডরের প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য একদিকে মানবিক দায়িত্ব পালনের সুযোগ, অন্যদিকে চরম ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি। মিয়ানমারের জান্তা, বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ভারত-চীনের প্রতিক্রিয়া না বুঝে করিডর চালু করলে তা ‘প্রক্সি যুদ্ধের ফাঁদে’ পরিণত হতে পারে। ভারতের কালাদান প্রকল্প ও চীনের ২১ বিলিয়ন ডলারের
৩০ এপ্রিল ২০২৫
খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম...
১৩ ঘণ্টা আগে
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন...
১৩ ঘণ্টা আগে
মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা...
১৩ ঘণ্টা আগে