Ajker Patrika

এ ছায়া যুদ্ধের আড়ালে আছে অনেক কিছুই

বিজন সাহা
এ ছায়া যুদ্ধের আড়ালে আছে অনেক কিছুই

ইউক্রেন যুদ্ধ রাশিয়ার সঙ্গে মূলত ন্যাটোর ছায়া যুদ্ধ। এর আড়ালে যুদ্ধ চলছে অনেক ক্ষেত্রেই। বেশ কিছুদিন ধরে চীন বেইজিং থেকে ইউরোপ পর্যন্ত সিল্করুটের অনুরূপ এক নতুন পথ (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই) তৈরির কথা বলছে, যেখানে রাশিয়া পালন করবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুক্তরাষ্ট্র এই পথের বিরোধিতা করে আসছে বিভিন্ন কারণে। ভারতও এই বিরোধিতায় সামিল হয়েছে, ঠিক যেমনটা ইউক্রেন নর্থ স্ট্রীম–২ এর বিরোধিতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এতে কী লাভ? এই পথ না হলে চীনের সঙ্গে ইউরোপের যোগাযোগের মাধ্যম সমুদ্র পথই থাকবে। আর এ পথ যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সেদিক থেকে এই বিআরআই চীনকে ইউরোপের কাছে নিয়ে আসছে। এতে চীনের ওপর মার্কিন কর্তৃত্ব শিথিল হয়। তাই ইউক্রেনের যুদ্ধ বহুমুখী।

মুদ্রা নিয়েও আছে আরেক যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রাথমিক ফল হিসেবে প্রথম ধাক্কাই লাগে রুশ মুদ্রা রুবলে। এ নিয়ে শুরুতে কড়াকড়ি আরোপ করা হলেও পরে তা শিথিল করা হয়। বলা হয়, এখন থেকে যে কেউ ইচ্ছামতো বিদেশি মুদ্রা কিনতে পারবে। তবে হাতে পাবে ১০ হাজার ডলার বা তার সমমানের ইউরো। বাকিটা নিতে হবে রুবলে। জ্বালানি তো আছে। গ্যাস বিক্রি থেকে এ বছর রাশিয়া অতিরিক্ত তিন শতাধিক বিলিয়ন ডলার আয় করবে। এরই মধ্যে রাশিয়া ডলারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনেছে। তারা ডলার রিজার্ভের পরিমাণ মোট রিজার্ভের ৪০ থেকে ১৭ শতাংশে কমিয়ে এনেছে। শুধু তাই নয়, ডলার ও ইউরোতে লেনদেন বন্ধের পর এরা রুবলে তেল ও গ্যাস বিক্রির কথা ঘোষণা করেছে। আবার চীন ও ভারতের সঙ্গে ইউয়ান ও রুপিতে বাণিজ্য করার ঘোষণাও এসেছে। এতে একদিকে যেমন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যাবে, অন্যদিকে তেমনি সেটা হবে ডলারের ওপর এক বিরাট আঘাত। এটা করতে এরা ইতিমধ্যে রুবলকে সোনার সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে। ফলে রুবল এক সময় শক্তিশালী মুদ্রাও হয়ে উঠতে পারে। 

মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ডলার ছিল আন্তর্জাতিক ব্যবসার একমাত্র মাধ্যম। এ থেকে যুক্তরাষ্ট্র বড় অঙ্কের কমিশন পেত। এটা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকেই সচল রাখত না। ডলার ছিল অন্য দেশের ওপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির শক্তিশালী হাতিয়ার। এই বাজারে ভাগ বসাতে এল ইউরো। আর এর ফল হিসেবে ব্রেক্সিট প্রত্যক্ষ করছে বিশ্ব। দু-একটা ছোটখাটো ঘটনা বাদ দিলে এতদিন পর্যন্ত ডলারের ওপর বিশ্বাস হারানোর কারণ ঘটেনি। কিন্তু রাশিয়ার রিজার্ভ আটকে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ডলার সেই আস্থা হারিয়েছে। এখন অনেক দেশই নিজেদের ডলারের নাগপাশ থেকে বের করে আনার কথা ভাবছে। কাজটা সহজ হবে না। তবে করতে পারলে তা বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অনেকটাই খর্ব করবে। 

নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত জনগণের সব উপার্জন, তার কলকারখানা, তার শিল্প, তার খনি—সবকিছু যখন কিছু লোকের হাতে চলে যায়, তারাই হয়ে ওঠে এ দেশের ভাগ্যবিধাতা। ইয়েলৎসিনের রাশিয়ায় তারাই ছিল সব ক্ষমতার অধিকারী। কথিত আছে, ২০০০ সালে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন এসব ধনকুবেরদের ডেকে বলেন, তাদের ব্যবসায় রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না, তারাও যেন রাষ্ট্রের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করে; তখন সে সময়ের রাশিয়ার সবচেয়ে বিত্তশালী খাদারকভস্কি পুতিনকে শুনিয়ে পেছন থেকে খুব সম্ভবত পতানিনকে বলেন, ‘তুমি প্রধানমন্ত্রী হও, আর আমি প্রেসিডেন্ট। এ কথা বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন সেই সময়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান গেরাসেঙ্কো। এরপরই খাদারকভস্কি গ্রেপ্তার হন এবং ইউকস জাতীয়করণ হয়। তাঁর নামে মামলাটি কিন্তু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ছিল। 

এখানে বলে রাখি, নাভালনিও কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই সাজাপ্রাপ্ত। বাইরের প্রোপাগান্ডায় মনে হতে পারে, সে প্রচণ্ড জনপ্রিয় নেতা। বাস্তব সেটা বলে না। হাতেগোনা কয়েক শতাংশ সমর্থন আছে তাঁর। কিন্তু রাশিয়ার রাজনৈতিক আকাশে তিনি নক্ষত্র নন, বড়জোর ছোটখাটো উল্কা। ক্যারিশমাটিক, তবে প্রচণ্ড রকম জাতীয়তাবাদী। পশ্চিমা প্রোজেক্ট। নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ নিয়ে পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ করে দিয়েছে। ইউক্রেনে যেমন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা অপ্রাপ্তবয়স্কদের রাজনীতিতে টানছিল, নাভালনিও সে পথেই যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তবে আমার পরিচিত অনেক নাভালনি-সমর্থক ওই ঘটনার পর তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। 

যা হোক, খাদারকভস্কিকে আইনের আওতায় আনা ছিল ধনকুবেরদের প্রতি পুতিনের সিগন্যাল। যেহেতু ইয়েলৎসিনের হাত ধরেই ক্ষমতায় আসা, তিনি চেষ্টা করেছেন, সেই সময়ে গৃহীত আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে যারা বিত্তশালী হয়েছে, তাদের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকতে। তবে একটাই শর্তে—তাঁরা রাজনৈতিক ব্যাপারে নাক গলাবে না। এরপরও এ দেশে ধনকুবেররা নির্বিঘ্নে কাজ করে গেছেন। অধিকাংশই এ দেশে আয় করলেও অর্থ রেখেছেন পশ্চিমা ব্যাংকে। তবে এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করেছে। ফলে অনেকের বিশ্বাস ভবিষ্যতে রাশিয়ার রাজনীতি ধনকুবেরদের প্রভাব থেকে মুক্ত হবে। ২০১৪ সালের পর থেকেই এখানে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা হয় সোশ্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। গত গ্রীষ্মে ৭ হাজার কিলোমিটার জার্নির সময় সেটা নিজের চোখে দেখেছি। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি চোখে পড়ার মতো। অনেক বছর হলো প্রতিটি বাচ্চার জন্ম দেওয়ার জন্য মায়েরা ভাল অঙ্কের অর্থ সাহায্য পাচ্ছে। অনেকেরই ধারণা এর পর থেকে এ দেশ আরও বেশি করে সমাজমুখী ও গণমুখী হবে। সেটা অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়ন হবে না। তবে নব্বইয়ের দশকে যখন সোভিয়েত অর্জনগুলো ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল, এর পর থেকে সেই সময়ের অর্জনগুলোর অনেক কিছুই ফিরে আসবে। আমি আশাবাদী যে শিক্ষা ব্যবস্থা আবার সেই সোভিয়েত আমলের মতোই হবে। সে ব্যবস্থা সারা বিশ্বেই সমাদর পেয়েছিল। এখনও ফিনল্যান্ডে সেই শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়। 

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী হবে? এ নিয়েও বিভিন্ন কথা হচ্ছে। রাশিয়া বলেছে, তারা ইউক্রেন দখল করবে না। সে দেশের সামরিক শক্তি খর্ব ও সেখানে বান্দেরার অনুসারীদের হাত থেকে মুক্ত করাই তার মিশন। দনবাসে যুদ্ধ চলছে। জাপারোঝিয়া, খেরসন—এসব এলাকায় নতুন প্রশাসন গঠিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রায় সমস্ত মুক্ত এলাকায় স্থানীয়রা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা উত্তোলন করছে। কেন? মনে হয় এখনো সোভিয়েত অতীতই ১৫টি রিপাবলিকের অনেককেই এক করে। আর সোভিয়েত পতাকাই ছিল ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রতীক। রেইখস্ট্যাগের ওপরে উত্তোলিত সেই লাল পতাকাই তাদের সাহস জোগায় নব্য ফাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। 

কিন্তু এর পর কী? এটাই আজ তাদের জীবন-মরণ প্রশ্ন। কারণ, তাদের ভয়—রুশ সৈন্য যদি ইউক্রেন ছেড়ে চলে যায়, তবে ইউরোপ বা অন্য কোথাও আশ্রয় নেওয়া বান্দেরার অনুসারীরা ফিরে এসে তাদের ওপর নতুন করে অত্যাচার চালাবে। কারণ, তারা দেখছে বুচা বা অন্যান্য শহরে, যেখানে জনগণ রুশদের কাছ থেকে ত্রাণ গ্রহণ করেছে, তাদের অনেকেই রুশ সেনা চলে যাওয়ার পর ইউক্রেন সেনাদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে, অনেকে প্রাণও হারিয়েছে কোলাবরেশনের অভিযোগে। এসব ভিডিও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেই প্রচার করা হয়েছে। তাই এখন রাশিয়ায় এ নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক চলছে। 

তবে একটা বিষয় ঠিক। দনবাস মানে দানিয়েৎস্ক ও লুহানস্ক আর কখনোই ইউক্রেনে ফিরবে না। একদল চাইছে খারকভ থেকে শুরু করে ওদেসা পর্যন্ত সমস্ত দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে, যেখানে রুশপন্থীরা বরাবরই শক্তিশালী, সেখানে রাশিয়ার প্রতি লয়াল সরকার গঠন করতে। অনেকে মনে করে, সমস্ত ইউক্রেন বান্দেরামুক্ত করে ওদের হাতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেওয়া উচিত। তবে যেহেতু উত্তর-পশ্চিম ইউক্রেন সবসময়ই রুশবিরোধী তাই অনেকের ধারণা—ওই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে। 

তাহলে? এ রকম মতও আছে যে, ইউক্রেন আসলে তিন অংশে বিভক্ত হবে—কিয়েভ, পলতাভা–এসব অংশ নিয়ে হবে ইউক্রেন; আর খারকভ থেকে ওদেসা পর্যন্ত এলাকা নিয়ে হবে মালাইয়া রাশিয়া (আসলে ঐতিহাসিক ভাবেই এর অস্তিত্ব ছিল)। আর লভভ, ইভান ফ্রাঙ্কো, জাকারপাতিয়া–এসব যাবে পোল্যান্ডের অধীনে। তবে এখানে অন্য প্রশ্ন আসতে পারে। পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় এসব অঞ্চলে ন্যাটোর ঘাঁটি স্থাপিত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে? ধরেই নেওয়া হয়ছে যে, রাশিয়া এ যুদ্ধে জিতবেই। কেন? রাশিয়ার হারার কোনো বিকল্প নেই। হারা মানে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে রুশ জাতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। হিটলার এই পরিকল্পনা নিয়েই এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। এই পরিকল্পনা থেকে পশ্চিমা বিশ্ব কখনোই সরে আসেনি। আর যুক্তরাষ্ট্রের সেই অভিজ্ঞতা তো আছেই। তিন শ বছর আগে যেমন ভারতীয়দের রিজার্ভেশনে পাঠিয়েছিল, এখন কেন রুশদের পারবে না। অন্তত এখানকার বুদ্ধিজীবীদের একাংশ এ রকমটাই ভাবেন। তাই তাঁরা মনে করেন, যুদ্ধে রাশিয়ার হারার কোনো প্রশ্নই আসে না, এমনকি যদি সেটা চরম মূল্যের বিনিময়েও হয়। 

প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এবং আরও কিছু স্বার্থ থাকার কারণেই রাশিয়া ইউক্রেনে জোর হামলা চালাচ্ছে না বলে মনে করা হচ্ছেচরম মূল্য আসলে কী? মস্কোর পক্ষ থেকে এরই মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের কথাও উচ্চারণ করা হয়েছে। উচ্চারণ না করলেও এ বাস্তবতা সবারই জানা। এ আশঙ্কা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিদিন ইউক্রেনে নতুন নতুন অস্ত্র আসছে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো থেকে। আগেই বলেছি রাশিয়াকে বিভিন্ন দিক থেকে ব্যস্ত রাখার পরিকল্পনার কথা। এরই মধ্যে বাল্টিকের দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে কালিনিনগ্রাদের সংযোগকারী স্থলপথ বন্ধ করে দিতে চাইছে। এর মানে কালিনিনগ্রাদ অবরোধ। এটা রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াবে। জেলেনস্কি এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছেন। আসলে তিনি তো একজন অভিনেতা। আর একজন অভিনেতার মতোই তিনি তাঁর ভূমিকা পালন করছেন। যখন যে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কথা বলছেন, অবস্থান নিচ্ছেন তাঁর মতো করে। কারণ তিনি জানেন, যুদ্ধ শেষ মানেই তাঁর ভূমিকা শেষ। অনেকের ধারণা জেলেনস্কির এ অভিনেতা মনস্তত্ত্বই আসলে দেশটির মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের সময় তাদের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে এমন নিষেধাজ্ঞাগুলো এড়িয়ে চলছে। যেমন, সারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ইউরেনিয়াম এই তালিকায় কখনোই আসেনি। কিন্তু ইউরোপ সেটা করছে ভালোমন্দ কোনো দিকে না তাকিয়ে। এর অর্থ ইউরোপ আত্মরক্ষার ইনস্টিংকট হারিয়ে ফেলেছে। এটাই বিপজ্জনক। কারণ, যখন কেউ আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা হারিয়ে ফেলে, সে তখন যেকোনো আত্মঘাতী কাজ করতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান বলেছেন, তিনি ডিপ্লোম্যাসি নয়, যুদ্ধের মাঠেই এই সমস্যার সমাধান চান। ওদিকে পেন্টাগনের মুখপাত্র বলেছেন, তিনি চান ইউক্রেনের মাটিতে রুশ বাহিনীর পরাজয় দেখতে। এর আগেও বাইডেন পুতিনকে খুনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীও’ বললেন। অথচ এই বাইডেনের হাত হাজার হাজার সার্ব ও আরবের রক্তে রঞ্জিত। অবশ্য শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বারাক ওবামার হাতেও কম খুন নেই। কিন্তু কথা হলো দেশের নেতৃত্বের এ ধরনের ভাষা কূটনীতির পথ বন্ধ করে দেয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, পুতিন নিজে বা রাশিয়ার কোনো উচ্চপদস্থ নেতা কোনো দেশের কোনো নেতা সম্পর্কে এমন ভাষা ব্যবহার করেননি। আসলে ইউক্রেনের এই যুদ্ধ আসলে রাশিয়ান রুলেটের মতো। 

অনেক আগে বিসমার্ক বলেছিলেন, ‘আমি হাজারটা উপায় জানি রুশ ভালুককে তার গুহা থেকে বের করে আনার, কিন্তু তাকে গুহায় ফিরিয়ে নেওয়ার একটা উপায়ও আমা জানা নেই।’ মনে হয় এই কথা এখন আর কেউই মনে রাখে না। ফলে বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায়ই যুদ্ধংদেহী স্লোগান দিচ্ছে। তবে এখানে অনেকের ধারণা পেন্টাগনে এখনো কিছু লোক আছে, যারা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের ভয়াবহতা বুঝতে পারে। এটাই হয়তো এবারের মতো পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবে। 

গত ডিসেম্বরে রাশিয়া আমেরিকার কাছে তার নিরাপত্তা বিষয়ে কিছু দাবি পেশ করে। ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে এর জবাব দিয়েছিল ওয়াশিংটন। তখন নর্থ স্ট্রিম-২ নিয়ে জার্মানির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ঝামেলা চলছিল। যুদ্ধের কয়েক দিনের মধ্যেই যখন জার্মানি কার্যত নর্থ স্ট্রিম-২ এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করল, ইউক্রেন আক্রমণ করে পুতিন বিশ্বের অন্যতম ‘জননন্দিত’ নেতা থেকে ‘জননিন্দিত’ ব্যক্তিতে পরিণত হলেন। দুই স্লাভিয়ান দেশের মানুষ আরও বেশি দূরে সরে গেল। আর সেটা হলো যুক্তরাস্ট্রের পক্ষ থেকে একটি গুলিও খরচ না করে। ভাবা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধটা তাড়াতাড়ি শেষ করার পদক্ষেপ নেবে। সেটা হলো না। তখন যুদ্ধের পক্ষে এ দেশে জনসমর্থন ছিল ৫০ শতাংশের একটু বেশি। যদিও দনবাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে সমর্থন আরও বেশি ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র গেল উত্তেজনা বাড়ানোর পথে। তাদের ধারণা ছিল, এতে মানুষ পুতিনের বিরুদ্ধে নামবে। বাইডেন এমনকি পোল্যান্ডে এসে রুশ জনগণের প্রতি সেই আহ্বানও জানালেন। ফল হলো উল্টো। জনমত যুদ্ধের পক্ষেই গেল। তবে এটা ঠিক, এই যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে, এমনকি ন্যাটোর দেশগুলোতেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জনগণ এক হয়ে দাঁড়িয়েছে রাশিয়ার বিপক্ষে। অনেক দিন পর ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিক দল দুটো কোন কোন বিষয়ে একমত হয়, আর বরিস জনসন পতনের হাত থেকে রক্ষা পান। 

কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে, ইউরোপের মানুষ ততই তাদের সরকারগুলোর ভূমিকা বুঝতে পারছে। বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিল হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে রুশদের পক্ষেও। ছোট, কিন্তু ছোট থেকেই তো বড় হয়। রাশিয়াকে ভাগ করাই কি পশ্চিমা বিশ্বের উদ্দেশ্য? মনে হয় না। অন্তত এখন তো নয়ই। কারণ, এখন তারা রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছে পরে চীনকে ধরবে বলে। এখন রাশিয়াকে ভাগ করলে সাইবেরিয়া যে চীনের দখলে যাবে না, সে গ্যারান্টি নেই। তেমনটি হলে চীন আরও শক্তিশালী হবে। অন্যদিকে যদি রাশিয়া পরাজিত হয় চীনের বিআরআই পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে। ফলে চীন রাশিয়ার পরাজয়ে উৎসাহী নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শান্ত হোন

সম্পাদকীয়
শান্ত হোন

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে গভীর অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই সংকটময় সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজ—উভয়ের জন্যই সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শান্ত থাকা, সংযম বজায় রাখা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। ইতিহাস বলে, উত্তেজনার মুহূর্তে ভুল সিদ্ধান্তই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড আমাদের গভীরভাবে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত করেছে। এ ধরনের নৃশংস ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন নাগরিকের প্রাণহানি মানেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার ব্যবস্থার ওপর সরাসরি আঘাত। এই হত্যাকাণ্ডের দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অবশ্যকর্তব্য।

তবে এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের পাশাপাশি যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। ইতিমধ্যে দুটি গণমাধ্যম ও একটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান—যা-ই থাকুক না কেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজের শিল্প-সংস্কৃতিচর্চার পরিসরকে আঘাত করা। এসব কর্মকাণ্ড কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং অবিলম্বে তা বন্ধ করতে হবে। নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। কেন তাঁকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করা হলো, তা বোধগম্য নয়।

এই পরিস্থিতিতে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাই ছাড়া তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে, যা জনমনে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। এই সময়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় হলো—সংযত ভাষা ব্যবহার করা, তথ্য যাচাই করা এবং উসকানিমূলক পোস্ট বা মন্তব্য থেকে বিরত থাকা।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জন করাও জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে—উসকানি নয়, সংলাপ ও সহনশীলতার পথ বেছে নিতে হবে।

দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে। এ সময় প্রতিটি দলকেই ধৈর্য ধরতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। শান্ত রাখতে হবে দলের কর্মীদের। নেতারা যদি এ সময় দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে দেশের পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহু কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি রাজনৈতিক দল যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে অরাজকতার মোকাবিলা করতে পারে, তাহলেই কেবল সামনে আশার আলো দেখা যাবে। বিশেষ করে তরুণসমাজকে মনে রাখতে হবে—দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই পথেই দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করা সম্ভব। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয়। বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

অরুণ কর্মকার
শঙ্কা যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে গণভোটের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ততই যেন জটিলতর হয়ে উঠছে। সন্ত্রাস, সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড চলেছে অব্যাহতভাবে। ফলে জনমনে প্রতিদিনই নতুন নতুন শঙ্কা, সংশয় দানা বাঁধছে। এই শঙ্কা ও সংশয় শুধু শহর-নগরবাসী মানুষের মধ্যে নয়, গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যেও সমানভাবে বিরাজ করছে। গত সপ্তাহে পাঁচ দিন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কয়েকটি জেলা-উপজেলা শহর ও বেশ কিছু গ্রামাঞ্চলে গিয়েছি। পরিচিত-অপরিচিত অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে কোনো মানুষ স্বস্তিতে নেই।

মফস্বল শহর এবং গ্রামগঞ্জের মানুষের এই অস্বস্তি যে কেবল রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে, তা নয়। আয়-উপার্জনে গভীর মন্দা থেকে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার বিষয়ও এই অস্বস্তির কারণ। শত্রুতা করে মামলায় ফাঁসানো, ব্যক্তিগত শত্রুতাকে রাজনৈতিক রং দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া—এগুলো বন্ধ হয়নি। আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে আছে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। তার মধ্যে আছে নির্বাচন ঘিরে সম্ভাব্য সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা, যা আমাদের দেশের যেকোনো নির্বাচনকালীন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। এবারও পরিস্থিতি অন্য রকম হওয়ার কোনো লক্ষণ সাধারণ মানুষ দেখছে না। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অতীতকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও তাদের আশঙ্কা। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার মানুষকে অব্যাহতভাবে আশ্বস্ত করে যাচ্ছে।

ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান নগরকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বকেন্দ্রিক পরিস্থিতির দিকে তাকালেও ভিন্ন কোনো চিত্র দেখা যায় না। সম্প্রতি জাতীয় পার্টি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে আগামী নির্বাচনটি একটি ‘পাতানো’ নির্বাচন হতে পারে। দলটির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারি অনেক রকম আশঙ্কার কথা বলেছেন। যেমন ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হতে পারে। ভোটের নির্ধারিত সময়ের পরে ভোট হতে পারে। মিডিয়া ভোট হতে পারে। কোনো আশঙ্কাই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’ যদিও তাঁরা ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন দলের নেতা-কর্মীদের নিরাপত্তা দিতে না পারলে তাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবেন বলেও বলে রেখেছেন। এর চেয়েও ভয়ানক এবং স্পর্শকাতর যে বিষয়টি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন তা হলো, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়, গ্রহণযোগ্য না হয়, ক্রেডিবল না হয়, রিফ্লেকটিভ না হয় তাহলে ভবিষ্যতে দেশে গৃহযুদ্ধ হতে পারে।

জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির এসব বক্তব্য হয়তো রাজনৈতিক বিবেচনায় বিবেচিত হবে। কারণ, তাদের ওপর স্বৈরাচারের দোসর ট্যাগ লাগানো রয়েছে। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের একেবারে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে যাদের অবস্থান, তারাও তো স্বস্তিতে নেই! তাদের মধ্যেও তো কেউ কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। যেমন আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসনে দলের প্রার্থী ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ গত বুধবার নির্বাচন কমিশনে উপস্থিত হয়ে নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ করে বলেছেন, পুলিশ তাঁকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে না।

আরেকজন, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী রেহা কবির সিগমাও নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন ওই বুধবারই। তিনি নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলেছেন, ‘আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন পক্ষপাতমুক্ত, সুষ্ঠু ও সবার জন্য নির্বিঘ্ন করা অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়। কিন্তু এসব প্রশ্নবিদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করার প্রক্রিয়া ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে অবিলম্বে জড়িত ও দায়ীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার আবেদন করছি।’ পরে সাংবাদিকদের রেহা কবির বলেন, ‘পুলিশ ভীতি সৃষ্টি করছে। আমার কর্মী ও আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তাই ইসি ও প্রশাসনের কাছে সার্বিক সহযোগিতা চেয়েছি।’

দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন কার্যালয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনা শুরু হয়েছে। রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর হামলা, হত্যাকাণ্ড চলছে। নির্বাচনের আগে আগে এসব ঘটনা জনমনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। সরকার অবশ্য এসব ঘটনার জন্য কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগকেই দায়ী করছে। কিন্তু তাদের এসব কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার কার্যকর কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে বলে মনে হয় না। যদি তা-ই হয় এবং আওয়ামী লীগ এ রকম কর্মকাণ্ড চালাতেই থাকে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে হয়তো স্বাভাবিক—সে ক্ষেত্রে সরকার নির্বাচনটা কীভাবে শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে, সেই প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।

আরেকটি বিষয় বোধ হয় সরকারের ভেবে দেখা দরকার। তা হলো কোনো কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী পর্দার অন্তরালে থেকে সরকারের নাকের ডগায় বসে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কোনো অপচেষ্টা চালাচ্ছে কি না। ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান বিন হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর এই প্রশ্নটি আরও গভীরভাবে সামনে এসেছে। কোনো পেশাদার শুটার কাউকে হত্যা করার অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দিনের পর দিন প্রকাশ্যে সেই ব্যক্তির আশপাশে থেকে নিজের চেহারা দেখাবে কি না, প্রশ্ন সেটি। অনেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমনটা সাধারণত হয় না। কারণ সে ক্ষেত্রে শুটার নিজেই নিজেকে চিহ্নিত করার কাজটি সহজ করে দেয়। কিন্তু ওসমান হাদির ক্ষেত্রে সেই ঘটনাটাই ঘটেছে।

তা ছাড়া, ওসমান হাদির ওপর প্রাণঘাতী হামলার পর (অবশ্য তার আগেও বেশ কয়েকবার) দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য ভারতের জন্য স্পর্শকাতরতা সৃষ্টি করেছে। ফলে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সৃষ্ট তীব্র টানাপোড়েন আমরা কয়েক দিন ধরে দেখেছি। নির্বাচনপূর্ব সময়ে দুই দেশের মধ্যে আন্তসীমান্ত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে, কূটনৈতিক টানাপোড়েন বৃদ্ধি পেলে, তা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে জনমনের অস্বস্তি বাড়াবে কি না, সেটাও বিবেচনার বিষয়। কেননা, আমাদের এখন প্রধান লক্ষ্য সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান।

অবশ্য যেকোনো অজুহাতে নির্বাচন বিঘ্নিত করার কোনো প্রয়াস যে নেই, তা-ও মানুষ বিশ্বাস করে না। কারণ, মানুষ অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করার মতো নানা কর্মকাণ্ডও দেখতে পাচ্ছে। তবে সবার জানা এবং বোঝা দরকার যে আগামী নির্বাচন বিঘ্নিত হলে দেশ অনেক বড় ধরনের অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই সংযত আচরণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের বড় কোনো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই পরিস্থিতি বোধ হয় আমাদের কারও জন্যই সুফল বয়ে আনবে না। দেশের জন্য তো নয়ই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাদি হত্যা এবং আগামী নির্বাচন

এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০: ৫১
ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত
ওসমান হাদি। ছবি: সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে। বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকেই তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হলেও তিনি তাতে ভীত হননি। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও বার্তায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘ভয় পেয়ে ৫০ বছর বেঁচে থেকে লাভ নেই, যদি এই বেঁচে থাকা সমাজে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে না পারে।’

অবশেষে ওসমান হাদি সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে মারা গেছেন। হাদিকে এভাবে হত্যা করে নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য একটি রেড অ্যালার্ট। তবে রাষ্ট্র ও সরকার জুলাই যোদ্ধা ও অকুতোভয় কণ্ঠস্বরগুলোকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হলে দেশটা গভীর সংকটে নিপতিত হতে বাধ্য।

বহু জল্পনা-কল্পনা-আলোচনার পর দেশ যখন নির্বাচনমুখী ট্রেনে, ঠিক তখন নির্বাচনে সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থীকে আততায়ীরা নিশানা করল কেন? যার ফলে উত্তপ্ত পুরো দেশ। প্রশ্নের মুখে পড়েছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সন্দেহ নেই, উদ্ভূত পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে এটি আসন্ন নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত হয়ে উঠতে পারে। নির্বাচন ইস্যুতে বিভিন্ন দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড পরিস্থিতি জটিল করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে হাদির ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আরও শক্তিশালীরূপে ফিরে এসেছে জুলাই আন্দোলনের পর লুণ্ঠিত অস্ত্রের বিষয়টি। সে সময়ে এই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা গেলে এখনকার উদ্ভূত পরিস্থিতি সৃষ্টি নাও হতে পারত বলে অনেকের ধারণা।

এখন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে, নির্বাচন কি আদৌ হবে? নাকি নির্বাচন বানচালের অপতৎপরতা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে?

এ ঘটনা নিঃসন্দেহে প্রার্থীদের আতঙ্কিত করে তুলছে। এই আতঙ্কের কারণেই বিজয় দিবসের দিন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী নিজেকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। ভয়ের ছায়া তাঁদের গ্রাস করছে। এরই মধ্যে হাদির ওপর আততায়ীর হামলার ঘটনা জনপ্রতিনিধি তো বটেই; জনমনেও একধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে, যা ভালো নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তরায়। ফলে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে এ পরিস্থিতির উন্নতি একমাত্র পথ।

শুধুই কি নির্বাচন বানচাল করা, নাকি এর পেছনে আরও বড় কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে? নির্বাচন বানচাল হলে কার লাভ আর কার ক্ষতি? নির্বাচন বানচাল হলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে যাদের লাভ, হাদির ওপর হামলায় তাদের কোনো ইন্ধন রয়েছে কি না বা রাজনৈতিক বিভক্তির সুযোগ নিয়ে তৃতীয় কোনো পক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাইছে কি না? বা দেশি-বিদেশি কোনো শক্তি চরম অস্থিরতা তৈরি করে তাদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চায়?

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা বিরাজ করছে, তার সমাধান কী? কোনো কোনো মহল ভাবছে নির্বাচন ঘিরে দেশে সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চোরাগোপ্তা হামলা, অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার ও নাশকতার আশঙ্কাও আছে। তবে সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে পুলিশের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের জন্য নিরাপত্তা প্রটোকল দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে রাজধানীতে ৩৫২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। শুধু রাজধানীতেই নয়, ঢাকা বিভাগেও গড় হিসাব করলে গত বছরের তুলনায় এ বছর বেশি খুন হয়েছে। এই খুনের হার বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপের অভাব।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, এই নির্বাচনটি বানচাল হয়ে গেলে বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুলে গেলে দেশ এখন যে সংকটে আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি সংকট ঘনীভূত হবে। সুতরাং রাজনৈতিক আদর্শ, দর্শন ও কর্মসূচি ভিন্ন হলেও এই মুহূর্তে ক্রিয়াশীল সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বারবার জাতীয় ঐক্যের কথা বলা হচ্ছে, সেই ঐক্যে যে বড় ধরনের ফাটল ধরেছে, তা নানা ঘটনায় স্পষ্ট। কিন্তু এখন অন্তত হাদির এই ঘটনার পরে সেই ফাটল দূর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রত্যাশা, যথাযথ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অচিরেই উন্নতি ঘটবে। দূর হবে আস্থার সংকট। দেশ এগিয়ে যাবে একটি সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচনের দিকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দেশের অর্থনীতির দ্বৈত বাস্তবতা

ড. মো. শফিকুল ইসলাম
দেশের অর্থনীতির দ্বৈত বাস্তবতা

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে সংখ্যার ভাষা আর মানুষের অভিজ্ঞতা এক বিন্দুতে মিলছে না। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, অর্থনীতি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সেই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রতিফলন এখনো স্পষ্ট নয়। উচ্চ সুদের চাপ, বিনিয়োগের স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের সংকট—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে অর্থনীতির ওপর এমন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে পরিসংখ্যান আর বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে ব্যবধান ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একদিকে কিছু সামষ্টিক সূচকে ঘুরে দাঁড়ানোর আভাস, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জীবনে বাড়তে থাকা অনিশ্চয়তা—এই দ্বৈত বাস্তবতা আজকের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সাম্প্রতিক প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ স্টেট অব দ্য ইকোনমি ২০২৫’ এই বাস্তবতাকে পরিসংখ্যানের আয়নায় তুলে ধরেছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরুতে অর্থনীতিতে যে শ্লথগতি দেখা গিয়েছিল, তার প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাটেনি। যদিও কিছু সূচকে পুনরুদ্ধারের ইঙ্গিত রয়েছে, তবু সেই পুনরুদ্ধার কতটা টেকসই, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে আসে মাত্র ২ শতাংশে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বাজারে আস্থার সংকট শিল্প ও সেবা খাতে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কৃষি খাতেও প্রবৃদ্ধি ছিল অত্যন্ত সীমিত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রান্তিকে শিল্প খাত কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও অর্থনীতিবিদদের মতে, এই প্রবৃদ্ধির পেছনে শক্ত ভিত নেই। কারণ, টেকসই প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি বিনিয়োগ, যা এখনো দুর্বল। এখানে নতুন নির্বাচিত সরকার এলে, এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক দায়িত্ব রয়েছে অর্থনীতিকে সচল রাখার বিষয়ে। নির্বাচিত সরকার এলে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অবস্থার পরিবর্তনও হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার ১০ শতাংশে স্থির রেখেছে। এই সিদ্ধান্ত স্বল্প মেয়াদে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কমাতে সহায়ক হলেও এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পড়ছে বিনিয়োগে। উচ্চ সুদের কারণে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে এসেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। জুন ২০২৫ নাগাদ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি, যা একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনকভাবে কম। তাই অর্থ উপদেষ্টাকে এখানে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

একই সময়ে সরকারি ঋণ গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থপ্রবাহ আরও সংকুচিত হয়েছে। ফলে বেসরকারি উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নতুন শিল্প স্থাপন, বিদ্যমান শিল্প সম্প্রসারণ কিংবা উদ্ভাবনী উদ্যোগ—সবকিছুই উচ্চ সুদের চাপে থমকে যাচ্ছে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন বাড়ে না, আর উৎপাদন না বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না—এই সরল অর্থনৈতিক সত্যটি আবারও সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

শিল্প উৎপাদনের চিত্রও সেই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করছে। যদিও কিছু মাসে শিল্প উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, তবু সামগ্রিকভাবে এই গতি স্থায়ী নয়। উৎপাদনের ধারাবাহিকতা না থাকায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে সীমিত পরিসরে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শ্রমবাজারে।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা আনুমানিক ২৬-২৭ লাখের মধ্যে (২.৬১-২.৭৪ মিলিয়ন)। গত বছরের একই সময়ে তা ছিল ২৪ লাখ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে প্রায় ৩ লাখের বেশি। বাস্তবে বেকারত্বের হার আরও অনেক বেশি বলে কেউ কেউ মনে করছেন। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বেকারত্বের হার ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে দেশের বেকারত্বের হার বেড়ে ৪.৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সামগ্রিক বেকারত্বের হার বেড়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো যুব বেকারত্ব। শিক্ষিত তরুণদের একটি বড় অংশ কাজ, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ জনগোষ্ঠী যদি উৎপাদনপ্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তবে জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ জনসংখ্যাগত বোঝায় পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।

মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি এখনো সীমিত। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নামলেও চালের দাম সাধারণ মানুষের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন বাড়লেও বাজারে তার সুফল না পৌঁছানো বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করে। খাদ্যপণ্যের দামে সামান্য অস্থিরতাও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বাজেটে বড় ধাক্কা দেয়। কৃষি খাতেও চ্যালেঞ্জ কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ঘন ঘন বন্যা এবং অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষি উৎপাদনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। আউশ ও আমন উৎপাদনে ঘাটতির তথ্য ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। কৃষি যদি স্থিতিশীল না থাকে, তবে মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্য—দুটোই বাড়ার আশঙ্কা থাকে।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। পর্যটনশিল্প একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত, যা তুলনামূলকভাবে কম বিনিয়োগে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি কার্যকর উৎস হিসেবে কাজ করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এখনো এই খাতটি যথাযথ গুরুত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন লাভ করতে পারেনি। অন্যদিকে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মতো আমাদের দেশের জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পর্যটন খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেওয়ার বিকল্প নেই।

এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কাঠামোগত সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং বিনিয়োগ আকর্ষণে নানামুখী উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এসব উদ্যোগের সুফল পেতে সময় লাগবে, আর সেই সময়টা অর্থনীতি কতটা সহ্য করতে পারবে—সেটিই বড় প্রশ্ন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রাখে, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু উচ্চ সুদের চাপে বিনিয়োগ স্থবির থাকলে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হলে এই পুনরুদ্ধার টেকসই হবে না। এখন প্রয়োজন সুসমন্বিত নীতি, বাস্তবমুখী সংস্কার এবং এমন সিদ্ধান্ত, যা কেবল পরিসংখ্যানে নয়, মানুষের জীবনে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত