বিজন সাহা

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো
বিজন সাহা

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ করছে প্রতিবেশী দেশে। মূল উদ্দেশ্য সেখানে যাতে অ্যান্টি-রাশিয়া তৈরি না হয়, ইউক্রেন যেন বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়। তাই তাকে সে দেশের জনগণের কথা ভাবতে হয়; আর সেখান থেকেই যুদ্ধের কৌশল।
এখানে আরেকটা কথা মনে রাখা দরকার। বর্তমান ইউক্রেন তো বটেই, অধুনালুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি রিপাবলিকের সবকিছু, তা সে শিল্প হোক, কৃষি হোক, শিক্ষা ব্যবস্থা হোক—সবই গড়ে উঠেছিল সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। গত ৩০ বছরে অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেটা হয়েছে হয় সোভিয়েত আমলের ভিত্তির ওপর, অথবা তাকে অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অংশটা সত্য মূলত বাল্টিকের দেশগুলো ও ইউক্রেনের জন্য। ফলে সোভিয়েত আমলের তুলনায় তারা শিল্পে খুব একটা এগিয়ে যেতে পারেনি। কারণ, এসব দেশে উৎপন্ন দ্রব্য পশ্চিমা বিশ্ব নিতে আগ্রহী নয়। পশ্চিমা বিশ্বের প্রয়োজন এসব দেশের সস্তা কায়িক শ্রম, তাও তাদের নিজেদের দেশে। যেমন পূর্ব ইউরোপের জনগণ, তা সে পোলিশ হোক, বাল্টিক হোক বা অন্য কেউ অপেক্ষাকৃত কম বেতনে কাজ করে জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ফ্রান্সে। আর তারা যে শূন্যতা তৈরি করে নিজ দেশে, সেটা তারা পূরণ করতে চায় ইউক্রেনের সস্তা শ্রমিকদের দিয়ে। তাই ইউক্রেন বা অন্য কোনো পূর্ব ইউরোপের দেশে শিল্প গড়ে তারা নিজেদের শ্রমিকদের প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করতে আগ্রহী নয়। এটা নতুন কিছু নয়। সেই ব্রিটিশ আমলেও ইংরেজরা আমাদের তাঁত শিল্প ধ্বংস করেছিল নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে। সেদিক থেকে ইউরোপ এতটুকুও বদলায়নি। যা হোক, এসব কারণে ইউক্রেনের শিল্প বা জনগণের ওপর আঘাত রাশিয়ার ব্যাপক জনগণ নিজেদের অতীতের ওপরে আঘাত বলে মনে করে। এটাও কী রাজনৈতিক, কী সামরিক নেতৃত্বকে বাধ্য করে যুদ্ধ পরিচালনায় জনগণের এই আবেগ মাথায় রাখতে।
পশ্চিমা বিশ্বে অনেকেই বলার চেষ্টা করছে, যুদ্ধ কি বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে? পোল্যান্ড চায় এই সুযোগে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড বা জার্মানির পরিবর্তে নিজেকে ইউরোপের শেরিফ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত অন্য ফেজে চলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার ভান্ডারের সব অস্ত্রই ব্যবহার করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে ইউরোপের পাশে দাঁড়াবে কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই যুদ্ধ ইউরোপের বাজার দখলের, আর তার অর্থনৈতিক শক্তি খর্ব করার। সেই সঙ্গে রাশিয়ারও। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। তাই ন্যাটোর বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক যুদ্ধে নামবে বলে মনে হয় না।
সিরিয়ায় বছর তিনেক আগে যখন তুরস্ক রুশ বিমান আক্রমণ করে ও দু দেশের মধ্যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোর এই যুদ্ধে জড়ানোর বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অজুহাত ছিল—তুরস্ক নিজেই আক্রমণের হোতা। যদি রাশিয়া বাধ্য হয় ইউরোপে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে তখন সেই ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম আগ্রহ সৃষ্টি করবে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে ইউরোপীয়দের সতর্ক হতে হবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর যাই হোক ইউরোপের স্বামী নয়, প্রেমিক। শুধু তাই নয়–বিবাহিত প্রেমিক। যুক্তরাষ্ট্র অন্য যেকোনো দেশে যায় পরকীয়া করতে। এর ফলাফল কী হয় সেটা ভুক্তভোগী মাত্রই জানে।
দ্বন্দ্বের মূল কতটা রাজনীতি
রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের এই কনফ্রন্টেশন কি শুধুই বাজার নিয়ে? শুধুই অর্থনৈতিক? না। এর মূলে আছে মূল্যবোধ। যদিও সোভিয়েত আমলে এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক বা সঠিকভাবে বললে অর্থনৈতিক আদর্শ—সামাজিক সম্পদ বণ্টন প্রশ্নে দ্বিমত, এখন এর মূলে আছে সামাজিক মূল্যবোধ। কী সেই মূল্যবোধ? যদিও সোভিয়েত আমলে এ দেশে ধর্ম চর্চা প্রায় বন্ধ ছিল এবং বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, এ দেশের মাত্র ২ শতাংশ মানুষ বিশ্বাসী। তারপরও অর্থোডক্স চার্চ তাদের মূল্যবোধে গভীর ছাপ রেখেছে। আরও তিন প্রধান ধর্ম ইসলাম, বৌদ্ধ ও ইহুদি ধর্ম। যদি মধ্যযুগে ইউরোপের খ্রিষ্টান ধর্ম বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে যায়, রাশিয়ায় কিন্তু তেমনটা হয়নি। তা ছাড়া ইউরোপে যদি ভ্যাটিকানের পোপ হন সব ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে জার ছিলেন রুশ চার্চের প্রধান। তা ছাড়া সে সময় চার্চ ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে—এসব ব্যাপারেও সরকারি দায়িত্ব পালন করত। ফলে রাশিয়ায় চার্চ রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন হওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় জীবনে অংশ নেয়, বা বলা চলে রাষ্ট্র এদের বিভিন্ন সামাজিক কাজে, বিশেষ করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কাজে ব্যবহার করে। তাই পশ্চিমা বিশ্বে আজ যখন এলজিবিটি আন্দোলন সরকারি অনুমোদনে হয়, এরা তার বিরোধিতা করে। না, এদের বিরুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা নেই, তবে এসবের প্রোপাগান্ডার সুযোগ নেই। বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এসব প্রোপাগান্ডা দণ্ডনীয়।
একইভাবে সম লিঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে এদের আইনগত বাধা আছে। তাদের কথা—পরিবার এটা নারী ও পুরুষের সংঘ, যা বিয়ের মাধ্যমে হয়। দুই নারী বা দুই পুরুষের একত্রে থাকতে অসুবিধা নেই, কিন্তু তাদের ফর্মাল বিয়ে এরা রেজিস্ট্রি করে না। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ার প্রচুর পরিবার ফর্মাল বিয়ে করে না। এটাকে তারা বলে সিভিল ম্যারেজ। যদি এ নিয়ে সম্পত্তিগত কোনো সমস্যা দেখা দেয়, সেটা তারা উইল করে মিটিয়ে ফেলতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার—রাশিয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশ হলেও এর জনসংখ্যা মাত্র ১৪৫ মিলিয়ন। তাই এরা প্রতিটি সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য মাকে ভালো অঙ্কের আর্থিক সহায়তা দেয়। অন্তত ডেমোগ্রাফির দিক থেকে দেখলেও এরা যে এ ধরনের লিবারিলিজমের বিরোধিতা করবে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই যদি সোভিয়েত আমলে পশ্চিমের সঙ্গে এদের বিরোধ ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক, এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারও।
আগেই বলেছি, রাশিয়ার আধুনিক ইতিহাসের শুরু কিয়েভিয়ান রুশ থেকে। এর আগে এ দেশের ছোট ছোট রাজন্যবর্গের মধ্যে অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই স্থানীয়রা রিউরিখের শরণাপন্ন হয়। তিনি ছিলেন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান। কিছুদিন আগেই নভগোরাদ দখল করে সেখানকার রাজা হন। শুরু হয় রুশ ইতিহাস। এখান থেকে আমরা যেটা পাই, তা হলো সেই জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশের মানুষ শক্তিশালী নেতৃত্ব খুঁজেছে নিজেদের জন্য। পরবর্তীকালেও আমরা সেটাই দেখব। যখনই নেতৃত্ব দুর্বল হয়েছে, দেখা দিয়েছে অরাজকতা। আর সবল নেতার হাতে পড়ে রুশ দেশ নতুন করে নিজেকে বিকশিত করেছে। এ জন্যই তো ইভান গ্রজনি (আইভান দ্য টেরিবল), পিওতর ভেলিকি (পিটার দ্য গ্রেট), স্তালিনের (স্ট্যালিন) মতো নেতারা এ দেশে এখনো জনপ্রিয়। তার মানে এই নয় যে, দেশটির মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয় নয়। একেবারেই উল্টো। আর তাই বলতে গেলে এরা সব সময়ই স্বাধীন ছিল।
আশির দশকের শেষের দিকে যখন অর্থনীতি তলানিতে, মানুষ ভেবেছিল যুক্তরাষ্ট্র তাদের সাহায্য করবে। কিন্তু যে মুহূর্তে তারা দেখল যুক্তরাষ্ট্র আসলে তাদের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে চায়, দেশকে করতে চায় অনুগত ভৃত্য, এমনকি নব্বইয়ের দশকের সেই শত অনিশ্চয়তার মধ্যেও তারা এটাকে মেনে নেয়নি। আর সে কারণেই পুতিনের আগমনকে তারা স্বাগত জানিয়েছে। পুতিনের ক্ষমতায় এই দীর্ঘ অবস্থান তাই ভোট চুরি নয়, দেশটির মানুষের ঐতিহাসিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। এ কথা যারা পুতিনের দীর্ঘ শাসন নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেন, তাদের জন্য।
একটু ভেবে দেখতে পারেন নেহরু, মের্কেল—তাঁরা কত দিন ক্ষমতায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধুও কিন্তু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দুইই ছিলেন। আসলে ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার যে সংবিধান তৈরি হয়, তা করেছিল মার্কিনরা নিজেদের স্বার্থে, গৃহীত হয়েছিল পার্লামেন্ট ভবনে কামান দেগে। শেষ যে পরিবর্তন হয়েছে, তা হয়েছে গণভোটে। সবচেয়ে বড় কথা—কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, না থাকবে সেটা তো সেই দেশের জনগণের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্রে তো অনেক সিনেটর যুগ যুগ ক্ষমতায় থাকেন। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না? আমার ধারণা, সুযোগ থাকলে সেখানেও অনেকে দুই কেন, পাঁচ সাত টার্ম প্রেসিডেন্ট থাকতে গররাজি হতেন না। রুজভেল্ট চার টার্ম ছিলেন। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন শিল্পপতিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন, তাঁরাই আর চাইলেন না দীর্ঘমেয়াদি প্রেসিডেন্টকে। কারণ, সে ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন। তাঁকে তখন ম্যানিপুলেট করা কষ্ট। এটা অবশ্য আমার মত। বাস্তব হয়তো ভিন্ন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনে যে, বড় পুঁজি বিরাট রোল প্লে করে, সে ব্যাপারে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রায়ই অনেককে রুশ সৈন্যদের বর্বরতার কথা বলতে শুনি। তবে এসব নিয়ে আবেগি হওয়ার আগে সংখ্যাটা দেখে নেওয়া ভালো। জাতিসংঘের হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস যে তথ্য দিচ্ছে সেটা নিম্নরূপ—
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ভোর ৪টা থেকে ৩ এপ্রিল ২০২২ মধ্যরাত পর্যন্ত টোটাল বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ৩ হাজার ৫২৭ জন, যার মধ্যে ১৪৩০ জন মৃত (২৯৭ পুরুষ, ২০২ নারী, ২২ বালিকা, ৪০ বালক, ৫৯ শিশু ও ৮১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি)। আহত ২ হাজার ৯৭ জন, যার মধ্যে ২৪৮ পুরুষ, ১৮৯ নারী, ৪২ বালিকা, ৩৮ বালক, ৯৮ শিশু ও ১ হাজার ৪৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক, যাদের লিঙ্গ এখনো জানা যায়নি। এলাকাভিত্তিক হিসেবে দনেৎস্ক ও লুহানস্কে মোট হতাহত ১৫৩৮ (৪৭২ মৃত, ১০৪৬ আহত)। এর মধ্যে ইউক্রেন নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ৪০৫ নিহত ও ৭৯৩ আহত এবং মুক্ত এলাকায় ৬৭ নিহত ও ২৫৩ আহত। ইউক্রেনের অন্য এলাকায় নিহত ৯৫৮ ও আহত ১০৫১। এ হিসাবে ২৪ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে ৩ এপ্রিল মধ্যরাত—এই ৩৯ দিনে মোট নিহত ১৪৩০ জন। অর্থাৎ দিনে গড়ে ৪০ জনেরও কম।
অনেক দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায়। না, এর অর্থ এই নয় যে, আমি যুদ্ধে কোনো মৃত্যুর পক্ষে। কিন্তু যারা এই যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে বলে রাশিয়ার শ্রাদ্ধ করছে, তাদের বলব, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া—এসব দেশে ন্যাটোর বম্বিংয়ে কত লোক মারা গেছে, সেই সংখ্যার সঙ্গে এর একবার তুলনা করতে। তাহলেই বুঝবেন কেন এই যুদ্ধ এত দিন চলছে।
এখানে আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছিল, যখন রুশ ট্যাংকের সামনে ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করছিল। আবার ফিরে আসি বাংলাদেশের যুদ্ধের কথায়। যুদ্ধের সময় আমরা বাড়িছাড়া হয়ে যেখানে থাকতাম, একবার সেখানে রাজাকার আসে। আমরা পালিয়ে যাই। মা সাঁতার কাটতে জানতেন না। তিনি বেতের জঙ্গলে কোনো রকমে নাক ভাসিয়ে ডুবে ছিলেন। টু শব্দ করেননি। কারণ জানতেন, শব্দ পেলেই গুলি চলবে। এ রকম ঘটনা তখন অনেকের সঙ্গেই ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা এসব ভালোভাবেই জানে। আচ্ছা, বলুন তো কজন মানুষ বন্দুকের সামনে দাঁড়াবে যদি জানে যে, গুলি করবে? যে মানুষগুলো ইউক্রেনে প্রতিবাদ করেছিল, তাদের দেশপ্রেমকে খাটো করে করে দেখাচ্ছি না। তবে এটা বলতে চাই যে, এই লোকগুলো জানত যে, রুশ সৈন্যরা তাদের গুলি করবে না। এখন পর্যন্ত তারা সেটাই করে আসছে। এখানে মনে রাখা দরকার, ২০১৪ সালে বিজয় দিবসে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যখন ট্যাংক নিয়ে দানেৎস্ক ঢোকে, তখন সেখানকার সাধারণ মানুষ এভাবেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিল, আর ওরা ট্যাংক দিয়ে অনেককে পিষে মেরেছিল।
যারা রুশ সেনাবাহিনী কর্তৃক ইউক্রেনের শহর ও লোকালয় ধ্বংসের কথা বলছেন, তাদের বলি সাধারণত আগ্রাসী যুদ্ধবাজরা প্রথমে জল, বিদ্যুৎ—এসব সরবরাহ ধ্বংস করে। একইভাবে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বারবার দনবাসের এসব কেন্দ্র আক্রমণ করছে। অন্যদিকে রুশ সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে এসব মেরামত হচ্ছে। এমনকি প্রায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া মারিউপোলেও জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে। এটাই প্রমাণ করে পশ্চিমা সংবাদ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য। স্মরণ করা যেতে পারে ইরাক আক্রমণের আগে কলিন পাওয়েলের মিথ্যা অভিযোগ এসব সংবাদমাধ্যমই জনগণের কাছে প্রচার করেছিল। তাই তাদের কাছে সত্য সেটাই, যেটা তাদের স্বার্থে কাজ করে।
যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী একটা দেশ যখন অন্য দেশ আক্রমণ করে, তাদের সৈন্য সংখ্যা হয় প্রতিপক্ষের তিনগুণ। কারণ, তারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করছে, আর স্থানীয় সেনারা দেশবাসীর কাছ থেকে সাহায্য পায়। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনে সৈন্য সংখ্যা ছিল আড়াই লাখের মতো, আর রিজার্ভে আরও লাখ তিনেক। সেখানে রুশদের উচিত ছিল প্রায় সাত লাখ সৈন্য নামানো। কিন্তু তারা এসেছে মাত্র ১৮০ হাজার সৈন্য নিয়ে। যদিও প্রায় প্রতি দশ দিন অন্তর অন্তর চলেছে রোটেশন।
কেন রুশরা কিয়েভ দখল করেনি? কিয়েভে ইউক্রেনের সৈন্য ৭০ হাজার, যাদের মাত্র ৩৫ হাজার সেনা দিয়ে রুশরা আটকে দিয়েছে। দনবাসের মূল সেনাবাহিনীকে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এদের রণকৌশল ছিল অভূতপূর্ব। নিজ দেশের মাটি, সংখ্যার আধিক্য—এসব থাকার পরও ইউক্রেন কিন্তু হেরে যাচ্ছে, হারছে পশ্চিমা বিশ্ব। কারণ, এরাই গত সাত বছর ধরে এই সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। এখনো ইউক্রেন পশ্চিমা প্রশিক্ষক দিয়ে ভরা। আরও আছে ভাড়াটে সৈন্য, যারা আসলে ন্যাটোর রেগুলার আর্মি—সাময়িকভাবে ছুটি নিয়ে এসেছে যুদ্ধ করতে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ইউক্রেন সেনাবাহিনী যোদ্ধা হিসেবে ভালো, যেমনটা রুশ বাহিনী। এদের অনেকেরই আছে সোভিয়েত প্রশিক্ষণ।
আরেকটা কথা, রুশ সেনারা কিন্তু বন্দীদের ওপর অত্যাচার করছে না; তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করছে। এক কথায় জেনেভা কনভেনশন মেনে চলছে। সে কথা বলা যাবে না ইউক্রেনের ক্ষেত্রে। ওদের নিজেদের প্রচারিত ভিডিও থেকে দেখি, বন্দী রুশ সেনাদের পায়ে গুলি করছে তারা, অত্যাচার করে মেরে ফেলছে। সে দেশের উচ্চপর্যায়ের অনেকেই বলছে, বন্দীদের হত্যা করার জন্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেশে রুশদের হত্যা করার জন্য তারা কথা বলছে। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের কোনো বিকার নেই। তাদের চোখে ভালো রুশ হচ্ছে মৃত রুশ। বন্দী দশায় এভাবে রুশ সেনা হত্যা কাউকে কি রাজাকারদের বাঙালি বন্দীদের হত্যার কথা একটুও মনে করিয়ে দেয় না?
যখন রাশিয়া বারবার কিয়েভের পেছন থেকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, ফ্যাসিবাদী বান্দেরার অনুসারীদের শাসনের কথা বলে, অনেকেই বলার চেষ্টা করে জেলেনস্কি নিজে ইহুদি, সেখানে এটা হয় কীভাবে? আচ্ছা, বারাক ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন কি বর্ণবাদ উঠে গিয়েছিল? যুক্তরাষ্ট্রে কি আফ্রো-আমেরিকানরা নিগ্রহের শিকার হয়নি? কে না জানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বান্দেরার রোল? কিয়েভ যখন সেই স্তেপান বান্দেরাকে হিরো ঘোষণা করে, তখন পোল্যান্ড পর্যন্ত এর বিরোধিতা করেছিল। ইসরায়েল এখনো করে। কারণ, বান্দেরা আর তাঁর অনুসারীরা ইহুদি-বিদ্বেষী। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ না জানলেও প্রশাসনের সেটা না জানার কথা নয়। বাইডেন প্রশাসনে সেক্রেটারি অব ট্রেজারি, স্টেট, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি, হেলথ অ্যান্ড হিউম্যান সার্ভিস, অ্যাটর্নি জেনারেল, ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স, সিআইএসহ অনেকেই ইহুদি বংশোদ্ভূত। তারপরও কিন্তু তারা বান্দেরার সমর্থকদের শুধু সাহায্যই করছে না, গড়েও তুলেছে। ইসলামের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কখনোই খুব একটা সদয় ছিল না। এটা কিন্তু তাদের তালেবান, আল-কায়েদা, ইসলামিক স্টেট—এসব গড়তে বাধার সৃষ্টি করেনি। আসলে যুদ্ধে সব পদ্ধতিই ভালো।
লেখক: শিক্ষক, রাশিয়ান পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো

ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
১৮ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
২ দিন আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
১৮ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
২ দিন আগেআজাদুর রহমান চন্দন

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।
অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!
হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’
এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।
এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?
এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।
জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।
এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে। সচিবালয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ডিসি-ইউএনও পাঠিয়ে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এ সমস্যার সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সরকার। এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘এগুলোর সল্যুশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে হয় না। এগুলো করতে পারে একটি রাজনৈতিক সরকার। কারণ তাদের এ মোরাল সল্যুশন করার সক্ষমতা থাকে। তাদের ভয়েসটা দিতে পারে। তাদের কর্মীরা আছে। তাদের সেটআপ আছে। কিন্তু এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডিসিকে পাঠিয়ে, ইউএনওকে পাঠিয়ে এগুলো কন্ট্রোল করা ডিফিকাল্ট।’ উপদেষ্টা ‘রাজনৈতিক সরকার’ শব্দযুগল ব্যবহার করলেও কার্যত নির্বাচিত সরকারকেই বুঝিয়েছিলেন। দশ-বিশ-পঞ্চাশ বছর অনির্বাচিত সরকার রাখার বাসনা যাদের, তারা এ বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হয়ে থাকতেও পারেন। তবে অনির্বাচিত সরকারের একটি সীমাবদ্ধতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরায় সালেহউদ্দিন আহমেদ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের প্রশংসা কুড়াবেন আরও বহুদিন।
অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলেন মাস ছয়েক আগে। কিন্তু ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সত্যিই অনুষ্ঠিত হবে কি না, সে নিয়ে শঙ্কা-সংশয়-সন্দেহ পিছু ছাড়েনি এক দিনের জন্যও। দেশে ক্রিয়াশীল সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এমন সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। অবশেষে গত বৃহস্পতিবার ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই খোদ রাজধানীতে সম্ভাব্য এক প্রার্থীকে গুলি করার ঘটনায় পুরোনো শঙ্কা-সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। কে না জানে, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা অন্যতম প্রধান শর্ত। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ‘ভালোমন্দ’ নির্ধারক প্রায় সব সূচকই নিম্নমুখী। সবশেষ গত শুক্রবার রাজধানীতে দিনদুপুরে গুলি করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান বিন হাদিকে, যিনি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন। আগের মাসেই চট্টগ্রামে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর জনসংযোগে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এসব ঘটনাকে ‘সাধারণ অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করা কঠিন।
হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই এর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্রে রাজনৈতিক সহিংসতার কোনো জায়গা নেই। কোনো সময়ই না। আমাদের মতাদর্শ যা-ই হোক, যে কেউ ভয়ভীতি বা শক্তির আশ্রয় নিলে তাকে একসঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।’ গুলিবিদ্ধ হাদিকে দেখতে সেদিন বিকেলেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ঢাকা-৮ আসনে দলটির ঘোষিত প্রার্থী মির্জা আব্বাস। সে সময় সেখানে উপস্থিত ইনকিলাব মঞ্চের কর্মীদের এবং মির্জা আব্বাসের সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। উভয় পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। কিছুক্ষণ পর মির্জা আব্বাস তাঁর কর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে চলে যান। এর আগে এবং বলা চলে হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপর এক ছাত্রনেতা ঘটনার জন্য ইঙ্গিতে বিএনপিকে দায়ী করে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানেরও ডাক দেন। শোনা যাচ্ছে, ওই ছাত্রনেতাও নাকি ঢাকা-৮ আসনে নিজ দলের প্রার্থী হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে হাদির সঙ্গে তাঁরই মূলত ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আপাতদৃষ্টিতে বদনামের ভাগীদার বিএনপি!
হাদির ওপর হামলার মাধ্যমে কেউ এক ঢিলে বহু পাখি মারার চেষ্টা করেছে কি না, সেটি এখনই বলা যাবে না। তদন্তসংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই হয়তো প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করলেও করতে পারে। তবে বিষয়টি যে বিএনপিকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বক্তব্যে উদ্বেগ স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এভাবেই কি চলতে থাকবে? তাহলে কোনো মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কি না—এটা আজকে সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে।’ তিনি বলেন, ‘কেউ আবার ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিচ্ছেন। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি রাজনৈতিক দল বিএনপিকে লক্ষ্য করে ফেসবুকে বার্তা দিচ্ছে। এগুলোতে তো সন্দেহ জাগে। একজন উপদেষ্টা মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে বলে দিলেন, জনগণ তো আমাদের ম্যান্ডেট দেয়নি কত দিন থাকব। সবকিছু মিলিয়েই নানা সন্দেহ, নানা সংশয়, নানা ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছে।’
এদিকে ইনকিলাব মঞ্চের এক সদস্যের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে, যারা ওসমান হাদির ওপর হামলা চালিয়েছে, তারা প্রায় দুই সপ্তাহ আগে তাঁর প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য মোহাম্মদ ওসামা একটি গণমাধ্যমে জানান, একটি মোটরসাইকেলে করে আসা দুজনের মধ্য থেকে একজন ওসমান হাদির ওপর গুলি চালায়। এই দুজন প্রায় দুই সপ্তাহ আগে ওসমান হাদির প্রচার টিমে যোগ দিয়েছিল। মাঝখানে কিছুদিন তাদের দেখা যায়নি। কয়েক দিন আগে তারা আবার এসে প্রচার কাজে যোগ দেয়। কেউ কেউ সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে একজনের অতীত ‘লীগসংশ্লিষ্টতা’ প্রমাণ করতেও বেজায় তৎপর।
এ তৎপরতা দেখে কেবলই মনে পড়ছে, গণ-অভ্যুত্থানের নায়কের আদলে যেসব ‘মুখ’ এখন ঝলসে উঠছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিন্তু একই রকম সংশ্লিষ্টতা ছিল। অর্থাৎ তখন তারা ছিল লীগের ‘মুখোশ’। সন্দেহভাজন ব্যক্তিও তেমনই একজন মুখোশধারী কি না, কে বলতে পারে? কারণ এই ব্যক্তি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে ১৭ লাখ টাকা লুটের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিল। আগে লীগসংশ্লিষ্ট হয়েও এখন তাহলে কোন সংশ্লিষ্টতার জাদুবলে এত সহজে জামিন পেয়ে ইনকিলাব মঞ্চে ভিড়ে একেবারে সংগঠনের শীর্ষনেতার গা ঘেঁষে বসার সুযোগ পেয়ে গেল?
এক দলের সদস্য হয়েও অন্য দলে কাজ করার নজির যে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল, তা কিন্তু নয়। স্বাধীনতা-পূর্বকালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকাবস্থায় দলটির অনেক সদস্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের মতো বড় দলে কাজ করতেন। তবে তাঁরা ওই দলগুলোর জন্য বদনাম বয়ে আনার মতো কোনো কাজ করেননি। বরং তাঁদের কারণে সংশ্লিষ্ট দলগুলোই উপকৃত হয়েছিল। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রয়াত আবদুস সামাদ আজাদও একসময় গোপনে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। প্রয়াত মহিউদ্দীন আহমেদ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও ন্যাপের নেতা ছিলেন। পরে বাকশাল হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও তাঁর পরিচিতি ছিল ‘আওয়ামী লীগের ন্যাপ নেতা’ হিসেবে। সেই পরিচয় ছিল গৌরবের। তাঁরা কারও সঙ্গে প্রতারণা বা ছলনা করেননি। সে প্রসঙ্গ থাক।
জুলাই আন্দোলনের মাঝামাঝি থেকেই অনেকের মুখের মুখোশ খসে পড়ছিল। ৫ আগস্টের পর তো অনেকের মুখ থেকে মুখোশ পরার মাজেজাও বেরিয়ে আসে অবলীলায়। ইদানীং আবার শুরু হয়েছে মুখ ও মুখোশের খেলা। সামনের দিনগুলোতে নাকি এ খেলা জমজমাট হবে। এক অনুজ সংবাদকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারলাম, মুখোশ পরায় পারদর্শী একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা নাকি কিছুদিন আগে তাঁর ঘনিষ্ঠ সাংবাদিকদের বলেছেন, বিএনপিতে তাঁদের কত লোক আছে, তা জানলে সবার চোখ কপালে উঠবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, ওই ব্যক্তিরাও ততই বেশি সংখ্যায় বেরিয়ে আসবেন মুখোশ ছেড়ে! তথ্যটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, গত সপ্তাহেই নরসিংদীতে একটি ইউনিয়ন বিএনপির ৭৫ নেতা-কর্মী অন্য একটি দলে যোগ দিয়েছেন।
এমনিতেই গত বছর লুট হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরকের সব এখনো উদ্ধার হয়নি। উদ্ধার না হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের সংখ্যা দেড় হাজারের মতো। গণ-অভ্যুত্থানের সময় এবং তার পরপর বিভিন্ন কারাগার, থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ স্থাপনা থেকে এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি-বিস্ফোরক লুট করা হয়েছিল। এসব অস্ত্রশস্ত্র কাদের অবৈধ দখলে থাকতে পারে, তা কি আঁচ করা একেবারেই অসম্ভব? অস্ত্রের রাজনীতিতে কারা সিদ্ধহস্ত, তা কি সবার অজানা? এই অস্ত্রধারীরা যে এক মুখোশ ছেড়ে নতুন কোনো মুখোশ নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে তৎপর হবে না, তারই বা নিশ্চয়তা কী?
লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।
আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।
দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। এই অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৬০টি রিক্রুটিং এজেন্সি প্রায় ৪ হাজার ৫৪৫ কোটি ২০ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শ্রমিকের রক্ত-ঘাম ঝরানো এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত ১২৪ জন মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক। এ নিয়ে ১১ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। ২০১৮ সালে এই সিন্ডিকেটের কারণেই মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। দীর্ঘ আলোচনা ও চুক্তির পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শ্রমবাজারটি আবার চালু হলেও রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র আবারও তাদের পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করেছে।
অভিযুক্ত ব্যক্তিদের তালিকায় জনতা ট্রাভেলসের মালিক ও বিসিবির পরিচালক আমজাদ হোসেন এবং ত্রিবেণী ইন্টারন্যাশনালের সেলিনা আলী ও নাবিলা আলীর মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম থাকায় ইঙ্গিত দেয়, এই অনিয়ম কেবল সামান্য কিছু এজেন্সির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর শিকড় আরও গভীরে ছড়িয়ে পড়েছে।
যে শ্রমিকেরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে বড় ভূমিকা রাখেন, বিদেশে কাজের জন্য নিজেদের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে দেন, তাঁদের এমন অসহায়ত্বের সুযোগ নেওয়া চরম অমানবিকতা। সরকার যেখানে একটি নির্দিষ্ট ফি নির্ধারণ করে দেয়, সেখানে এজেন্সির এমন মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন এবং শ্রমিকের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা।
আমাদের প্রশ্ন, সরকারিভাবে ফি নির্ধারণ করা সত্ত্বেও কীভাবে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এই অনিয়ম করতে পারল? তদারকি সংস্থাগুলো কি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছে? নাকি উচ্চপর্যায়ের যোগসাজশেই এ দুর্নীতি ডালপালা মেলেছে? দুদকের কাছে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এটি কেবল অতিরিক্ত অর্থ আদায়ই নয়, এটি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি দরিদ্র মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলার শামিল।
দুদকের মামলা করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সময়োপযোগী পদক্ষেপ। তবে কেবল মামলা করাই যথেষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে দ্রুত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং আত্মসাৎ করা অর্থ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ফিরিয়ে দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে শুধু আর্থিক জরিমানা নয়; বরং তাদের লাইসেন্স বাতিল এবং মালিকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
দেশের শ্রমবাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত রাখতে এবং কর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে। রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর নিয়মিত তদারকি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি অর্থ আদায় করা সম্ভব না হয়। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য জনশক্তি রপ্তানিপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
১৮ ঘণ্টা আগে
আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা।
২ দিন আগেশহীদ বুদ্বিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য।
সেলিম জাহান

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

আজ ১৪ ডিসেম্বর—শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ৫৪ বছর আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের সূর্যসন্তানদের—শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষকদের, গুণী শিল্পীদের, খ্যাতনামা সাংবাদিকদের, প্রথিতযশা কবি-লেখকদের। এঁদের হত্যা করার নীলনকশা তৈরি করেছিল পাকিস্তানি শাসকেরা আর তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল তাদের দোসর সহযোগীরা। পরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে ঢাকা সেনানিবাসে গোপন বৈঠক বসেছিল প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে আলবদর-আলশামস বাহিনীর কেন্দ্রীয় অধিনায়কদের। রাও ফরমান আলীর হাতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা—এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের বিশেষ বিশেষ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নামের তালিকা, যেটি তিনি নিজে তৈরি করেছিলেন আট মাস আগে, একাত্তরের এপ্রিল মাসে। কী ভয়ংকর মানুষ ছিলেন রাও ফরমান আলী! কতখানি ভেবে রেখেছিলেন তিনি—কেমন করে বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করবে! জানতেন তিনি, বাঙালি জাতির বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলে এ জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ভাবা যায়, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তিনি তালিকাটি তৈরি করেছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা হিসেবে, যার বাস্তবায়নের দায়িত্ব তিনি তুলে দিয়েছিলেন আলবদর ও আলশামসের অধিনায়কদের হাতে।
পরবর্তী সময়ে রাও ফরমান আলীর ডায়েরি থেকে সেই তালিকা উদ্ধার করা হয়েছিল। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যকার অনন্যসাধারণ একরাশ নাম সেখানে। ঠান্ডা মাথায় নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। খুঁটিনাটি কিছুই ফরমান আলীর চিন্তা এড়ায়নি। তাই কোন শিক্ষক কোন বিভাগের, সেটাই শুধু তিনি লিখে রাখেননি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় তাঁদের বাড়ির ঠিকানাও লিখে রেখেছিলেন। জনান্তিকে শুনেছি যে রাও ফরমান আলীর কন্যা শাহীন ফরমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল, পড়ত মনোবিজ্ঞান বিভাগে। আমাদেরই সহপাঠী ছিল সে। কন্যার শিক্ষকদের হত্যা করতে রাও ফরমান আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্বিকার। আজ এটাও ইতিহাসের অংশ যে এ তালিকার বাইরে এবং সে দিনেরও আগে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছিল। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ১০ ডিসেম্বরে। রক্তক্ষরা সেসব কাহিনি লিপিবদ্ধ হয়েছে, যা আমাদের ইতিহাসের অংশ। নীলনকশা থেকে দেখা যায়, সে তালিকায় নাম ছিল প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আহসানুল হক, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া, অধ্যাপক সাদ’উদ্দীনের মতো শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের। ভাগ্যক্রমে তাঁরা বেঁচে গেছেন।
তারপরের সব ঘটনা এখন ইতিহাস। যে শয়তানেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়েছিল, তাদের অনেকেই এই বরেণ্য শিক্ষকদের শিক্ষার্থী ছিল। বিজয়ের একেবারে অন্তিম সীমায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে যারা এঁদের তুলে নিয়ে এসেছিল, তারা কিন্তু ভিনদেশি সৈনিক নয়, এ দেশেরই মানুষ। তাদের হাত কাঁপেনি এই সোনার মানুষদের চোখ বেঁধে দিতে, ঠোঁট কাঁপেনি সেই মিথ্যা আশ্বাস দিতে, ‘আবার ফিরিয়ে দিয়ে যাব’, বুক কাঁপেনি এই নরম মনের মানুষদের আঘাত করতে। না, তাঁরা ফেরেননি, সে দিনও না, কোনো দিনও না আজতক। বধ্যভূমিই হয়েছে তাঁদের শেষ শয্যা।
পারিবারিক সূত্রে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর অপহরণের কথা আমি শুনেছি। এবং এ-ও শুনেছি যে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। অসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি আর ফেরেননি। সে ভয়াবহ দিনের কথা নানাভাবে শুনেছি। সেন্ট্রাল রোডে পৈতৃক নিবাস ‘দারুল আফিয়াতে’ দুপুরবেলা স্নান সেরে চুল আঁচড়াচ্ছিলেন তিনি। তাঁর মা টেবিলে ভাত বেড়ে রেখেছিলেন। তখনই তাঁকে তুলে নেওয়া হয়। যে তুলে নিতে এসেছিল, সে শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীরই ছাত্র। শুনেছি, বাড়ির লোক আপত্তি করলে সেই লোকটি জবাব দিয়েছিল, ‘এই কিছুক্ষণের মধ্যেই স্যারকে নিয়ে আসব।’ না, আর তিনি ফিরে আসেননি। বেড়ে রাখা ভাত সন্তান খেতে পারেনি বলে মুনীর চৌধুরীর মা আজীবন একটি দুঃখ হৃদয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী ১২ ডিসেম্বরের দিকে তাঁর অগ্রজ প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে ফোন করেছিলেন। ফোন ছেড়ে দেওয়ার আগে তাঁর শেষ কথা ছিল, ‘স্বাধীনতা তো আমাদের দোরগোড়ায় এসে গেল, তাই না?’ তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ছিল, কিন্তু তিনি সে স্বাধীনতা দেখে যেতে পারেননি।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে আমার তিন দল মানুষের কথা বড় মনে হয়। যাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের কথা—বড় বেদনার সঙ্গে। সেই সব শহীদের সন্তানদের, যাঁদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাঁদের কথা—বড় মমতার সঙ্গে এবং সেইসব হন্তারকের কথা—তীব্র ঘৃণার সঙ্গে, যারা এমন পাশবিক কাজ করে আজও বহাল তবিয়তে আছে। আমার প্রায়ই মনে হয়, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হয়ে পড়েছি। ভাবতেই পারি না যে আমার প্রাণপ্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরণ্ময় কিছু মানুষকে আর কোনো দিন দেখতে পাব না, বহু প্রিয় লেখকের নতুন লেখা আর পড়তে পারব না, অনেক সংগীতশিল্পীর কণ্ঠ আর সামনাসামনি শুনতে পারব না। আমরা অনেকেই এইসব স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষদের ঠিক চিনতে পারিনি, পাকিস্তানিরা কিন্তু ঠিকই পেরেছিল। বাংলাদেশের সৃষ্টশীলতা আর সৃজনশীলতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিল্প-সাহিত্যকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যই তারা বেছে নিয়েছিল এই অনন্যসাধারণ মানুষদের। মানুষ চিনতে ওরা ভুল করেনি।
অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, লাখ লাখ নিহত মানুষের মধ্যে কেন বারবার শুধু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা উঠে আসে। আমার মনে হয়, এর উত্তর দুটো—একটি প্রত্যক্ষ আর অন্যটি পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ কারণটি হচ্ছে, এ মানুষগুলো আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির জগতের অনন্য কিছু মানুষ ছিলেন; যাঁদের স্বপ্নদৃষ্টি, দিক্-দর্শন, চিন্তাভাবনা, শিক্ষা ও পরামর্শ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে প্রতিনিয়ত। তাই আমাদের হৃদয়ে তাঁদের জন্য বিশেষ স্থান আছে। পরোক্ষ কারণটি হচ্ছে, আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা বহু শহীদের স্মৃতি একসঙ্গে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তখন আমরা প্রতীক খুঁজে নিই। ১৪ ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সেই প্রতীক। এই প্রতীকের মাঝখান দিয়েই আমরা পৌঁছে যাই অন্য সব জানা-অজানা শহীদদের কাছে।
একাত্তর-উত্তর সময়ে শিক্ষক হিসেবে আমার সুবর্ণ সুযোগ ঘটেছিল উপর্যুক্ত শহীদদের অনেকেরই সন্তানদের সঙ্গে—বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যাদের শিক্ষার্থী হিসেবে পাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছে, তাদের মধ্যে আমার হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান আছে ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের জন্য। আশির দশকে এদের অনেককেই আমার শ্রেণিকক্ষে আমি পেয়েছি। এ দশকের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনীতি বিভাগে পড়াতে গিয়ে দেখি যে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী হিসেবে বসে আছে শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্রদ্বয় তানভীর হায়দার চৌধুরী (শোভন) ও প্রয়াত সুমন হায়দার চৌধুরী (সুমন), শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার কন্যা দ্যুতি অরণি (মিতি), শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের পুত্র তৌহীদ রেজা নূর (তৌহীদ)। এ আমার পরম প্রাপ্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শততম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে আমি যখন ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শিক্ষকদের ও শহীদ চিকিৎসক মোহাম্মদ মর্তুজার স্মৃতিচারণা করছিলাম, তখন শোভন, সুমন, মিতি ও তৌহীদের চেহারাটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ওরা হয়তো জানেও না, আশির দশকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকে ওদের দিকে তাকালে আমার মনটা হু হু করে উঠত। বহুবার এমন হয়েছে যে আমি ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারিনি। কোনো দিন হয়তো বলা হয়নি, আজ ওদের এই কথাটুকুই শুধু বলে যাই—আর কিছু নয়।
শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, কিন্তু অন্যভাবেও কাছে পেয়েছি অন্য শহীদ-সন্তানদের। বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বৃহত্তর অঙ্গনে কাছাকাছি এসেছি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তানত্রয়ের সঙ্গে—আহমেদ মুনীর (ভাষণ), প্রয়াত আশফাক মুনীর (মিশুক) ও আসিফ মুনীরকে (তন্ময়)। স্বল্পকালের জন্য মিশুক আমার সহকর্মীও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবয়ব পত্রের (ফেসবুক) মাধ্যমে পরিচিত হয়েছি মাহমুদার সঙ্গে (শহীদ অধ্যাপক সিরাজুল হক খানের সন্তান)। জেনেছি মাহমুদকে—শহীদ অধ্যাপক রাশীদুল হাসানের পুত্র সে। সেই সঙ্গে এটাও মনে হয়েছে, সেদিনের যে শিশু, কিশোর-কিশোরীরা পশুশক্তির কাছে তাদের বাবাকে হারিয়েছে, তারা আজ পরিণত বয়সের মানুষ। তাদের মনের পিতৃ হারানোর বেদনা আমরা কেউ বুঝব না। কারণ, সব দুঃখই তো মানুষের ব্যক্তিগত, সব বেদনাই তো তার নিজস্ব। কিন্তু এটা তো বুঝি যে তাদের পিতার হন্তারকদের ‘বিচারের দাবি তাদের মনে নিভৃতে কাঁদে’ অহর্নিশ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের বিচারভিন্ন কোনো পথ নেই—শুধু ন্যায্যতার কারণে নয়, শুধু মানবিকতার কারণেও নয়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মার শান্তির জন্য, শহীদ-সন্তানদের অন্তরের বিচারের দাবি মেটানোর জন্য, জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তির জন্য। সে দায় রাষ্ট্রের, সমাজের ও ব্যক্তি মানুষের। সে দায়ভাগে আমরা সবাই সমান অংশীদার। জাতি হিসেবে আমরা যেন সে দায় ভুলে না যাই। সে আমাদেরই দায় এবং তার মোচনেই আমাদের মুক্তি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ

অনেকেই ফোন করে বলেন, রাশিয়া এত সময় নিচ্ছে কেন? কেন আমেরিকার মতো কার্পেট বোম্বিং করে তাড়াতাড়ি যুদ্ধ শেষ করে না? আসলে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ করে নিজ দেশ থেকে অনেক দূরে। স্থানীয় লোকজন তাদের প্রতি কী মনোভাব পোষণ করল, না করল, তা নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। তাদের দরকার তেল বা ভৌগোলিক অবস্থান। রাশিয়া যুদ্ধ
২৭ এপ্রিল ২০২২
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
১৮ ঘণ্টা আগে
ধান কাটার মৌসুমে চালের দাম যে ঊর্ধ্বমুখী, সেটি সিন্ডিকেটের কারণে নাকি অন্য কোনো কারণে—এমন একটি প্রশ্নের মুখে অনেকটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ সপ্তাহ তিনেক আগে।
১৮ ঘণ্টা আগে
মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের চুক্তিতে যেখানে বিমানভাড়াসহ একজন কর্মীর বিদেশ যাওয়ার মোট ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেখানে একশ্রেণির অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সি চক্র কর্মীদের কাছ থেকে এর প্রায় পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে।
১৮ ঘণ্টা আগে