Ajker Patrika

চড়ক

রাজীব কুমার সাহা
চড়ক

বাঙালি লোকসংস্কৃতির একটি অতিপরিচিত শব্দ হলো চড়ক। গ্রামবাংলার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি লোক-উৎসব চড়ক পূজা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পালনীয় এই উৎসবটির নাম কীভাবে চড়ক হলো? আমরা কি জানি চড়ক শব্দের সাদৃশ্যে তৈরি হওয়া চড়কগাছ কি আসলে কোনো গাছ? আবার চড়কের বাদ্যি বলে আরেকটি শব্দ রয়েছে, এর অর্থ কী? গাজন উৎসবের সঙ্গে কি চড়ক বা চড়ক পূজার কোনো সম্পর্ক রয়েছে? ঠিক এ বিষয়গুলোকে মাথায় রেখে চলুন আজ জানব চড়ক বা চড়ক উৎসবের গল্পগাথা।

চড়ক শব্দটি তৎসম শব্দ ‘চক্র’ থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। চড়ক শব্দের সঙ্গে ঘূর্ণনের একটি যোগ রয়েছে। এর অর্থ হলো চৈত্র মাসের সংক্রান্তিতে উদ্‌যাপিত পর্ববিশেষ; গাজন উৎসব। গাজন উৎসবের সঙ্গে রয়েছে চড়কের ওতপ্রোত সম্পর্ক। চড়ক পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতিবছর চৈত্রসংক্রান্তিতে বা চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয় এবং বৈশাখের প্রথম দুই-তিন দিনব্যাপী চড়ক পূজার উৎসব চলে। এটি চৈত্র মাসে পালিত হিন্দু দেবতা শিবের গাজন উৎসবের অন্যতম একটি অঙ্গ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে যা ‘চড়ক সংক্রান্তির মেলা’ নামে পরিচিত। নীল পূজা, গম্ভীরা পূজা, শিবের গাজন, হাজরা পূজা, হরব প্রভৃতি নামে পরিচিত এই চড়ক পূজা।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ‘লিঙ্গপুরাণ’, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে’ চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে রচিত গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদী’ ও রঘুনন্দনের ‘তিথিতত্ত্বে’ও এ পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে পাশুপত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। প্রাচীন কাহিনি অনুসারে জানা যায়, দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে ভগবান শিবের একনিষ্ঠ ভক্ত বাণ রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভোলানাথের কৃপা পেয়ে অমরত্ব লাভের জন্য বাণ রাজা নিজের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে মহাদেবকে তুষ্ট করেছিলেন ভক্তিমূলক নাচ-গান করে। এই সময় থেকেই মূলত চড়ক পূজার সূত্রপাত। এই উৎসবে মূলত শরীরে আঘাত করে ভগবান ভোলানাথকে তুষ্ট করার প্রথা রয়েছে যা চড়ক পূজার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই পূজায় কখনো জ্বলন্ত কয়লার ওপর দিয়ে হাঁটা কিংবা ছুরি বা কাঁটার ওপর দিয়ে লাফানো, শরীরে বাণ বিদ্ধ করে চড়কগাছে ঝোলা প্রভৃতি এই পূজার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। শ্রীকৃষ্ণ ও বাণ রাজার যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ১৪৮৫ সালে রাজা সুন্দরানন্দ ঠাকুর এই পূজার প্রচলন করেছিলেন বলে অনেকে মনে করে থাকেন। সেই সময় থেকে প্রধানত শৈব সম্প্রদায়ের ভক্তরাই এই উৎসব পালন করে আসছেন।

চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুষ্ঠিত হয়। এ পূজার বিশেষ অঙ্গের নাম নীল পূজা। চড়ক পূজার আগের দিন নীলচণ্ডিকার পূজা হয়। এদিন কয়েকজনের একটি দল সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দুজন সখী। তাদের সঙ্গে থাকে ঢোল-কাঁসরসহ বাদক দল, যারা একটানা বাদ্য বাজাতে থাকে (এখান থেকেই ‘চড়কের বাদ্যি’ কথাটা এসেছে। এর মানে হলো বাদ্যযন্ত্রের বিরামহীন জোরালো শব্দ)। সখীরা গান ও বাজনার তালে তালে নেচে থাকে। এদের ‘নীল পাগলের দল’ও বলা হয়। এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে। চড়ক পূজার আগের দিন চড়কগাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা (শিবের পাটা) রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পতিত ব্রাহ্মণ এ পূজার পৌরহিত্য করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুরির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে (চড়ক পূজার দিন একটি গাছের থামে আড়াআড়িভাবে বাঁশ বাঁধা হয় এবং তাতে দড়ি লাগানো হয়। দড়ির শেষ মাথায় একটি বড় বড়শি গাঁথা থাকে। ওই বড়শিতে মানুষকে গেঁথে ঘোরানো হয়। এই কাজের জন্য যে গাছের থামটি ব্যবহার করা হয় তাকে চড়কগাছ বলে) দোলা, দানো-বারনো বা হাজরা পূজা প্রভৃতি। চড়ক পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা সহ্যকরণ ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।

চড়কের দিন সন্ন্যাসীরা বিশেষ বিশেষ ফল, ফুল নিয়ে বাদ্য সহকারে নানা ভঙ্গিমায় শিবপ্রণাম করে। এ ছাড়া দেবতার প্রতি অবিচল ভক্তি ও নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য তারা ধারালো বঁটি, গাছের কাঁটার ওপর ঝাঁপ দেন কিংবা পা দুটি ওপরে, মাথা নিচের দিকে রেখে ঝুলে থাকেন। এ পর্যায়গুলো যথাক্রমে ‘বঁটি-ঝাঁপ’, ‘কাঁটা-ঝাঁপ’ ও ‘ঝুল-ঝাঁপ’ নামে পরিচিত। আরও আত্মনির্যাতনের জন্য আড়াই থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লৌহশলাকা সারা দিন জিভে বিদ্ধ করে রেখে সন্ধ্যার আগে পুকুরে গিয়ে সেটি খুলে ফেলে দেওয়া হয়, এর নাম ‘বাণ-সন্ন্যাস’। পিঠের দুই দিকে চামড়া ভেদ করে একটি সরু বেত প্রবেশ করিয়ে দেওয়াকে বলে ‘বেত্র-সন্ন্যাস’। আর চড়কগাছটি চড়কতলায় প্রোথিত করে তার মাথায় আরেকটি কাষ্ঠখণ্ড মধ্যস্থলে ছিদ্র করে স্থাপন করা হয়, যাতে চড়কগাছকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠখণ্ডটি শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরতে পারে। এর এক প্রান্তের ঝোলানো দড়িতে একজন সন্ন্যাসী (আগেকার সময়ে সন্ন্যাসীরা পিঠের চামড়া ভেদ করে শিরদাঁড়াতে বড়শির মতো বাঁকানো একটি লোহার কাঁটা গেঁথে ঝুলে থাকতেন) কোমরে গামছা বা কাপড় বেঁধে ঝুলে থাকেন, অপর প্রান্তে কাষ্ঠখণ্ডটিকে চক্রাকারে চরকির মতো ঘোরানো হয়; এই প্রক্রিয়াটির নাম ‘বড়শি সন্ন্যাস’। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এসব প্রথা বন্ধ করলেও গ্রামাঞ্চলে সাধারণ লোকের মধ্যে এখনো কমবেশি প্রচলিত রয়েছে।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’তে গ্রামবাংলায় গাজন ও চড়ক উৎসবের প্রাণবন্ত উপস্থিতি রয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘চড়কের আর বেশি দেরি নাই। বাড়ি বাড়ি গাজনের সন্ন্যাসী নাচিতে বাহির হইয়াছে। দুর্গা ও অপু আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসীদের পিছনে পিছনে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়াইল।’ তা ছাড়া কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় (১৮৬২) কলকাতায় চড়কপার্বণ উদ্‌যাপনের বর্ণনা রয়েছে। চড়ক প্রধানত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব হলেও এতে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের লোকজনই অংশগ্রহণ করে থাকেন। তাই চড়কের মেলা প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মূলত এ উৎসবগুলোই আমাদের দেশজ সংস্কৃতির আদি উৎসসূত্র।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না’ লেখা পোস্টটি সরিয়ে ফেললেন ফয়েজ তৈয়্যব

দেশে ফিরলেন আওয়ামী লীগ নেতা, বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার

পার্লামেন্টে জুতায় বিয়ার ঢেলে পান করে রাজনীতিকে বিদায় জানালেন এমপি

বড় ধাক্কার মুখে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো, জাতিসংঘের সতর্কবার্তা

পোস্টে কমেন্ট করায় কর্মচারী বরখাস্ত প্রসঙ্গে যা বললেন সারজিস আলম

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত