Ajker Patrika

ভোটের আগে নেশার বাণিজ্য

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা 
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশে ফেনসিডিলের পাশাপাশি নেশা-জাতীয় একই ধরনের নতুন তিনটি সিরাপের বিস্তার ঘটাতে চাইছে ভারতের মাদক কারবারিরা। বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতের ১০ জেলার কারখানায় তৈরি এসব মাদক ঢুকছে দেশের আট সীমান্ত জেলা দিয়ে। ইতিমধ্যে ছোট কয়েকটি চালান আটকও হয়েছে। মাদক হিসেবে এখনো অপরিচিত নতুন এসব সিরাপ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যস্ততার সুযোগে নতুন এসব মাদকের বড় বড় চালান বাংলাদেশে পাঠানোর ছক কষছে ভারতের মাদক কারবারিরা। ফেনসিডিলের মতো এসব সিরাপও কোডিন ফসফেট মিশ্রিত। বোতলজাত এসব মাদকের দেশে প্রবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।

অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, ফেনসিডিলের মতো নেশাজাতীয় নতুন এই সিরাপগুলো হলো ‘ব্রনোকফ সি’, ‘চকো প্লাস’ ও ‘উইন কোরেক্স’। এগুলোর মধ্যে ব্রনোকফ সি নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন অধিদপ্তর। নেশাজাতীয় উপাদান থাকায় কাশির এসব সিরাপ ইতিমধ্যে ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নাম নতুন হলেও এই তিন সিরাপের নেশার মাত্রা ফেনসিডিলের সমান। ফেনসিডিলের বোতলে ভরে নতুন নামের মোড়ক লাগিয়ে পাঠানো হচ্ছে। এর আগে ভারত থেকে এস্কাফ নামের সিরাপও একইভাবে দেশে ঢুকেছিল।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮৩ লাখ। তাদের বেশির ভাগ পুরুষ। নারী ও শিশুদের মধ্যেও মাদকাসক্তি রয়েছে। ৩ লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মাদকসেবী ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে আসক্ত।

অধিদপ্তরের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অধিশাখা বলছে, এসব মাদক সেবনে গলা শুকিয়ে যাওয়া, ঝিমুনি, লিভার-কিডনি অকেজো হওয়া এবং দীর্ঘ মেয়াদে পুরুষের প্রজননক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো মারাত্মক ক্ষতি হয়।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, ভারতের সীমান্তবর্তী ১০টি জেলায় কমপক্ষে ৬২টি কারখানায় নেশাজাতীয় নতুন তিন ধরনের সিরাপ তৈরি হচ্ছে। এসব কারখানা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা, নদীয়া, মালদা, মুর্শিদাবাদ, ত্রিপুরার পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চল, সিপাহীজলা, বিলোনিয়া, শান্তির বাজার ও মেঘালয় রাজ্যের একটি জেলায়। এসব কারখানাকেন্দ্রিক ৩৭৪ ভারতীয় মাদক কারবারি বাংলাদেশে মাদক চোরাচালান করে। এসব মাদক ঢুকছে সীমান্ত জেলা সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, অধিদপ্তর ভারতে মাদক তৈরির এসব কারখানা ও কারবারিদের বিস্তারিত পরিচয়, ঠিকানা, পাঠানোর রুট এবং জিরো লাইন থেকে দূরত্ব পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করেছে। এসব তথ্য ভারতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে দিয়ে কারখানাগুলো বন্ধের সুপারিশ করবে বাংলাদেশ সরকার। পাশাপাশি এই মাদক দেশের যে আট সীমান্ত জেলা দিয়ে ঢুকছে, সেখানকার পুলিশ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সতর্ক করা হবে।

তবে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভারতীয় মাদক তৈরির কারখানার তালিকা করে কখনো খুব একটা ফল আসেনি। অভিযোগ দিলেও আগে ভারত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নতুন তিনটি নেশাজাতীয় সিরাপের মধ্যে ‘ব্রনোকফ সি’ বেশি উদ্বেগের কারণ। রাজশাহীর চারঘাট ও দামকুড়া এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নতুন এই সিরাপ বেশি ঢুকছে। সহজলভ্যতার কারণে এটি দ্রুত ওষুধজাত মাদকের বিকল্প হয়ে উঠেছে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যস্ত হয়ে পড়লে এই মাদক পাচার বহুগুণ বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

নতুন মাদকের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের উপপরিচালক মোহা. জিললুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোডিন ফসফেট মিশ্রিত সিরাপের বাণিজ্যিক নাম ফেনসিডিল, ব্রনোকফ সি, চকো প্লাস বা উইন কোরেক্স যা-ই হোক না কেন, এগুলোর দেশে প্রবেশ বন্ধে প্রথমে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সতর্কতা প্রয়োজন। সীমান্তে ঠেকাতে পারলে দেশে এসব মাদক নিয়ন্ত্রণ অনেক সহজ হবে। তিনি বলেন, ভারতের ল্যাবোরেট ফার্মাসিউটিক্যালস নামের প্রতিষ্ঠান সিরাপগুলো কাশির ওষুধ হিসেবে প্রস্তুত করে। নেশাজাতীয় উপাদান ব্যবহারের কারণে ভারতেই এগুলো নিষিদ্ধ; তবে উৎপাদন বন্ধ হয়নি। ফলে সেগুলো ভারতীয় বিভিন্ন রাজ্যে এবং সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ছড়াচ্ছে।

অধিদপ্তরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ইউসুফপুর ও দামকুড়া থানার মুরারীপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কয়েকজন স্থানীয় ব্যবসায়ী ‘ব্রনোকফ সি’ আনা-নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক সদস্য নতুন মাদকের ধরনটি এখনো না চেনায় পাচারকারীরা সহজে সীমান্ত পার করতে পারছে। ব্রনোকফ সির প্রবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছে অধিদপ্তর।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তে ৩ ডিসেম্বর ‘চকো প্লাস’ সিরাপের একটি চালান জব্দ করে বিজিবি। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবির মহানন্দা ব্যাটালিয়ন সীমান্তে টহল জোরদার করে এবং ১৫০ বোতল চকো প্লাস উদ্ধার করে। গত এক মাসে একই ব্যাটালিয়ন প্রায় ২০০ বোতল চকো প্লাস জব্দ করেছে। চকো প্লাস নামের সিরাপ এই সীমান্তে এর আগে আটক হয়নি।

জানতে চাইলে বিজিবির মহানন্দা ব্যাটালিয়নের (৫৯ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে বিজিবি জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে। নতুন মাদক নিয়েও আমরা সতর্ক রয়েছি এবং মাদক প্রতিরোধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’

সূত্র জানায়, যশোরের শার্শা ও বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বেশি আসছে ‘উইন কোরেক্স’ নামের নেশাজাতীয় সিরাপ। গত নভেম্বরের প্রথম ১০ দিনে বিজিবি ৮৫০ বোতল এই সিরাপ জব্দ করেছে। এক বোতল ফেনসিডিল বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়, কিন্তু এক বোতল উইন কোরেক্স বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকায়। বোতলের আকারসহ সবকিছু ফেনসিডিলের মতো হওয়ায় তরুণদের মধ্যে নতুন এই সিরাপে আগ্রহ দ্রুত বাড়ছে। অভিযোগ রয়েছে, পাচারকারীরা নেশার মাত্রা বাড়াতে ছিপি খুলে সিরাপের সঙ্গে প্যাথেডিন মিশিয়ে দিচ্ছে। এতে এটি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও বাংলাদেশে নানা ধরনের মাদক ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ওষুধের আড়ালে ভিন্ন ভিন্ন নামে যদি নতুন মাদক প্রবেশ করে, তাহলে সেগুলোর বিষয়ে প্রতিটি সংস্থাকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। তা না হলে দেশে মাদকাসক্ত তরুণের সংখ্যা আরও বাড়বে; যার পরিণতি দেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন মিলে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’, মুখপাত্র নাহিদ ইসলাম

সাংবাদিক শওকত মাহমুদকে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে গেল ডিবি

২০৯৮ পর্যন্ত কবে কোন দেশ বিশ্বকাপ নেবে—ভবিষ্যদ্বাণী করল গ্রোক এআই

বরিশালে ব্যারিস্টার ফুয়াদের সঙ্গে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাগ্‌বিতণ্ডা, ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ স্লোগানে ধাওয়া

খালেদা জিয়ার রিপোর্ট ভালো, চেষ্টা করছেন কথা বলার: চিকিৎসক

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ