
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একসময় তিনি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সাপ্তাহিক কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এখনও তিনি আজকের পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। আগামীকাল ২৩ জুন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৯০তম জন্মদিন। এই উপলক্ষে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার

আজকের পত্রিকা: জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা। জীবনের ৮৯ বছর পেরিয়ে আসলেন কেমন লাগছে, আপনার অনুভূতি কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও শুভেচ্ছা। এতোগুলো জন্মদিন পেরিয়ে এসে আজ পড়ন্ত বেলায় অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো এই দীর্ঘসময়কালে ঘটনা ও দুর্ঘটনা অনেক দেখলাম। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হবার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্য হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বাঁচার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল; এখনো সেটা কমছে না। বরঞ্চ বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজরে না নেওয়ার কারণ কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহিতার দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।
দেখা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় সরকারি লোকদের আশ্রয়ে, নয় তো প্রশ্রয়ে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য-উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরো বেশি ধনী হয়। তাছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে।
মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-কানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুদ রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তাঁরা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে সরকারের মুখ চেয়ে। এঁরা হয়তো ইতিমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেন তাঁরাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাঁদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।
বুর্জোয়া দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত সেগুলোর দিকে যেতে চান না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য সেটা তাঁরা মানতে চান না। মানলে তাঁদের খুবই অসুবিধা। তাঁরা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তাঁরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চান; দেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন তাঁরা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
তাছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নেই। সরকার সংশ্লিষ্টরা আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায় চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।
আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না তাঁদের সংখ্যা অল্প। যাঁরা আছেন তাঁরাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাঁদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাঁদেরকে অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাঁদেরকে অবাঞ্ছিত বলে জানে।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের সাথে সাধারণ মানুষের যে যোগাযোগ থাকার কথা, তা কি লক্ষ্য করা যায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনাবিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলবার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে তা সে-বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হবার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দু’পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার জায়গাতে নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকার পক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন বরাবরের মতোই সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।
দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দু’টি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়ার প্রশ্নেই উঠছে না। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। উপর-কাঠামোতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে-রকমেরই রয়ে গেছে। পুরানো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া নব্য-ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করছে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে বৈকি। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না-ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ-পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপোসের কোনো সুযোগ দেখি না।
আজকের পত্রিকা: জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন, বিষয়টা কতটা পরিষ্কার হয়েছে পাঠকের কাছে বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধারণা ও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরিষ্কার হয়। শুধু লেখার কারণেই যে মানুষের কাছে জিনিসটা পরিষ্কার হবে তা নয়। অভিজ্ঞতাই শেখাবে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য কী ও কতটা।
জাতীয়তাবাদ আসলেই খুব জরুরি ব্যাপার। এর ইতিবাচক গুণ আছে, রয়েছে নেতিবাচক দুর্বলতাও। ইতিবাচক দিক হলো এই যে জাতীয়তাবাদ ঐক্যের সৃষ্টি করে এবং সে-ঐক্যের ভিত্তিতে থাকে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম সমষ্টিগত উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম মানুষকে সংবেদনশীল এবং সচেতন করে। দুটোই খুব বড় গুণ। তদুপরি দেশপ্রেম বিচ্ছিন্নতা কমায়।
জাতীয়তাবাদের শত্রু বাইরে থাকে, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমণ করে, আগ্রাসন চালায়, দখল করে নিতে চায়। এযুগে বিশ্বপুঁজিবাদ ওই কাজটাই করছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মানুষের ভয়ঙ্কর শত্রু।
কিন্তু জাতীয়তাবাদের শত্রু আবার জাতীয়তাবাদের ভেতরেই রয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদ উগ্রতা, অন্ধত্ব, অহমিকা ইত্যাদি তৈরি করে। এর অন্তরে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ নেতা খোঁজে এবং ব্যক্তিকে একক নেতা করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে বিকাশকে সহায়তা দেয়। এসব জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা।
তবে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ মূল শত্রুটা হচ্ছে বৈষম্য। জাতির অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য থাকে। ওই বৈষম্য ঐক্য গড়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা কর্তা হয়ে বসে এবং গরিবকে দমন করে। আমরা সবাই একই জাতির সদস্য, পরস্পরের আত্মীয়, জাতীয়তাবাদীরা এই বোধটা সঞ্চারিত করে শ্রেণি দ্বন্দ্বের সত্যটাকে আড়ালে রাখতে চায়। শাসকশ্রেণি জাতির নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্রেণিশোষণকে ভুলিয়ে দেয়। শ্রেণিবৈষম্য আবার পুঁজিবাদেরই অবদান। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকমের যে পুঁজিবাদ বাইরে থেকে তো বটেই ভেতর থেকেও শত্রুতা করছে। বাইরে সে আগ্রাসী, ভেতরে সে অন্তর্ঘাতী।
জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ এবং শ্রেণিবিভাজনের দরুন জাতীয়তাবাদের ভেতরে কার্যকর দুর্বলতা, দুটোই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। দেখাতে চেয়েছি যে বাইরে যেমন ভেতরেও তেমনি, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ এবং তাকে পরাভূত করতে না-পারলে মানুষের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তাই নিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে, বক্তব্যটা এরকমের।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বঘোষিতরূপেই জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তাদের কোনোটিই পুঁজিবাদবিরোধী নয়। জাতি বলতে তারা নিজেদেরকেই মনে করে। এদের জাতীয়তাবাদ জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করে না। এদের জাতীয়তাবাদ ধনিক শ্রেণির এবং সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসকামী। জাতীয়তাবাদী শাসকেরা নিজেদের শ্রেণির বান্ধব, জনগণের বান্ধব নন।
জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ব্রিটিশের শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার দরুন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণির জীবনে মাতৃভাষার চর্চা কমে এসেছে। এটাও প্রমাণ করে যে এরা দেশপ্রেমিক অবস্থানে নেই।
আমরা জাতি রাষ্ট্রের কথা শুনি। এযুগে এক রাষ্ট্রে এক জাতি বসবাস করবে এটা সম্ভব নয়। এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকে এবং থাকবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালি, কিন্তু তাই বলে এখানে অবাঙালি জাতিসত্তা যে নেই তা নয়। অবশ্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটা হবে ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে আমরা যা চাই তা জাতি রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালি থাকবে অবাঙালিও থাকবে, কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বলেই চলে। কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশপ্রেম একেবারেই নেই এটা সত্য নয়। আছে; তবে সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দু’কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা, প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে ধনীদের মধ্যেও এক ধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিক ভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।
ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে।
গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে-টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরৎ চলে যায়।
গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে, নইলে ভেঙে পড়তো। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।
আজকের পত্রিকা: আপনি এদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী যেমন-দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, এসব নিয়ে কিছু বলুন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, এসব বড় বড় ঘটনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার বয়সী সবাইকেই এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেশভাগ ছিল আমাদের দেশের জন্য মস্ত বড় এক দুর্ঘটনা। ১৭৫৭-তে পলাশীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এটি অবশ্যই সে মাপের নয়, তবে কাছাকাছি বটে। ১৭৫৭-তে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু, ১৯৪৭-এ তার অবসান ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি। নব্য-ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে এবং দেশভাগের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ঘটেছে সেটা অপূরণীয়।
১৯৫২-তে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ওই অভ্যুত্থান একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ওই পথে এগিয়ে আমরা উনসত্তরের জনঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং একাত্তরের যুদ্ধে সামিল হয়েছি। ওটি ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি চূড়ান্ত পর্যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরাতন পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা, যে আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেয়েছিল রাষ্ট্রের সংবিধানে। কিন্তু রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী শাসক শ্রেণি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে একেবারে ধুয়েমুছে ফেলাতে। শাসকশ্রেণির একাংশ ওই নীতিগুলোকে বাদ দিয়েছে, অপর অংশগুলো যে তাদেরকে ফেরৎ আনতে আগ্রহী এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৪৭-এর দেশভাগ মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বৈষয়িক উন্নতির। ১৯৭১-এ তাদের সে সুযোগ আরো প্রসারিত হয়েছে। উন্নতি ঘটেছে পুরাতন পুঁজিবাদী পন্থাতেই। সে-উন্নতি অল্পকিছু মানুষের এবং অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে। জনগণ মুক্তি পায়নি, মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ।
মুক্তির লড়াইটা অপরিহার্যরূপে পুঁজিবাদবিরোধী। সে লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে। বাংলাদেশেও তাকে অব্যাহত রাখা চাই। নইলে সমষ্টিগত ভাবে আমরা কেবলই নিচে নামতে থাকবো, এখন যেমন নামছি।
আজকের পত্রিকা: দেশভাগকে বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। এ ছিল মস্ত বড় ভুল এবং বিপর্যয়। যেটা উচিত ছিল তা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের যথার্থ বিতাড়ন। প্রয়োজন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা জাতিগুলোর প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা।
এই উপমহাদেশ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, দেশভাগের সময় এখানে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল, তাদের প্রত্যেকের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আবশ্যক ছিল। রাষ্ট্রগুলো জাতি-রাষ্ট্র হতো না, এক রাষ্ট্রে অন্যজাতির মানুষও থাকতো, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হতো জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলে শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করাটা সহজ হতো।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেটা চায়নি। তারা কৃত্রিম ভাবে দেশভাগ করে নিজেদের অনুগত লোকজনের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশি শাসকেরা পুঁজিবাদী, এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি অনুগত। ফলে দেখা গেছে যে ইংরেজ সরে গেছে বটে, কিন্তু না ভেঙেছে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা না তাদের হাতে-গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। করুণ সত্য এটাই যে জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সমষ্টিগত মুক্তিও অর্জিত হয়নি।
আজকের পত্রিকা: সমাজ দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। ধর্মান্ধতার অভিমুখে বললে ভুল হবে না।
উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য এবং ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: জীবনের এ পর্যায়ে এসেও লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে। কোথায় খুঁজে পান এতো প্রাণরস?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা এবং ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।
আজকের পত্রিকা: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা। জীবনের ৮৯ বছর পেরিয়ে আসলেন কেমন লাগছে, আপনার অনুভূতি কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও শুভেচ্ছা। এতোগুলো জন্মদিন পেরিয়ে এসে আজ পড়ন্ত বেলায় অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো এই দীর্ঘসময়কালে ঘটনা ও দুর্ঘটনা অনেক দেখলাম। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হবার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্য হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বাঁচার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল; এখনো সেটা কমছে না। বরঞ্চ বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজরে না নেওয়ার কারণ কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহিতার দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।
দেখা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় সরকারি লোকদের আশ্রয়ে, নয় তো প্রশ্রয়ে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য-উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরো বেশি ধনী হয়। তাছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে।
মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-কানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুদ রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তাঁরা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে সরকারের মুখ চেয়ে। এঁরা হয়তো ইতিমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেন তাঁরাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাঁদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।
বুর্জোয়া দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত সেগুলোর দিকে যেতে চান না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য সেটা তাঁরা মানতে চান না। মানলে তাঁদের খুবই অসুবিধা। তাঁরা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তাঁরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চান; দেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন তাঁরা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
তাছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নেই। সরকার সংশ্লিষ্টরা আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায় চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।
আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না তাঁদের সংখ্যা অল্প। যাঁরা আছেন তাঁরাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাঁদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাঁদেরকে অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাঁদেরকে অবাঞ্ছিত বলে জানে।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের সাথে সাধারণ মানুষের যে যোগাযোগ থাকার কথা, তা কি লক্ষ্য করা যায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনাবিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলবার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে তা সে-বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হবার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দু’পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার জায়গাতে নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকার পক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন বরাবরের মতোই সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।
দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দু’টি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়ার প্রশ্নেই উঠছে না। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। উপর-কাঠামোতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে-রকমেরই রয়ে গেছে। পুরানো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া নব্য-ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করছে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে বৈকি। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না-ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ-পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপোসের কোনো সুযোগ দেখি না।
আজকের পত্রিকা: জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন, বিষয়টা কতটা পরিষ্কার হয়েছে পাঠকের কাছে বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধারণা ও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরিষ্কার হয়। শুধু লেখার কারণেই যে মানুষের কাছে জিনিসটা পরিষ্কার হবে তা নয়। অভিজ্ঞতাই শেখাবে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য কী ও কতটা।
জাতীয়তাবাদ আসলেই খুব জরুরি ব্যাপার। এর ইতিবাচক গুণ আছে, রয়েছে নেতিবাচক দুর্বলতাও। ইতিবাচক দিক হলো এই যে জাতীয়তাবাদ ঐক্যের সৃষ্টি করে এবং সে-ঐক্যের ভিত্তিতে থাকে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম সমষ্টিগত উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম মানুষকে সংবেদনশীল এবং সচেতন করে। দুটোই খুব বড় গুণ। তদুপরি দেশপ্রেম বিচ্ছিন্নতা কমায়।
জাতীয়তাবাদের শত্রু বাইরে থাকে, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমণ করে, আগ্রাসন চালায়, দখল করে নিতে চায়। এযুগে বিশ্বপুঁজিবাদ ওই কাজটাই করছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মানুষের ভয়ঙ্কর শত্রু।
কিন্তু জাতীয়তাবাদের শত্রু আবার জাতীয়তাবাদের ভেতরেই রয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদ উগ্রতা, অন্ধত্ব, অহমিকা ইত্যাদি তৈরি করে। এর অন্তরে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ নেতা খোঁজে এবং ব্যক্তিকে একক নেতা করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে বিকাশকে সহায়তা দেয়। এসব জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা।
তবে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ মূল শত্রুটা হচ্ছে বৈষম্য। জাতির অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য থাকে। ওই বৈষম্য ঐক্য গড়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা কর্তা হয়ে বসে এবং গরিবকে দমন করে। আমরা সবাই একই জাতির সদস্য, পরস্পরের আত্মীয়, জাতীয়তাবাদীরা এই বোধটা সঞ্চারিত করে শ্রেণি দ্বন্দ্বের সত্যটাকে আড়ালে রাখতে চায়। শাসকশ্রেণি জাতির নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্রেণিশোষণকে ভুলিয়ে দেয়। শ্রেণিবৈষম্য আবার পুঁজিবাদেরই অবদান। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকমের যে পুঁজিবাদ বাইরে থেকে তো বটেই ভেতর থেকেও শত্রুতা করছে। বাইরে সে আগ্রাসী, ভেতরে সে অন্তর্ঘাতী।
জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ এবং শ্রেণিবিভাজনের দরুন জাতীয়তাবাদের ভেতরে কার্যকর দুর্বলতা, দুটোই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। দেখাতে চেয়েছি যে বাইরে যেমন ভেতরেও তেমনি, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ এবং তাকে পরাভূত করতে না-পারলে মানুষের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তাই নিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে, বক্তব্যটা এরকমের।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বঘোষিতরূপেই জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তাদের কোনোটিই পুঁজিবাদবিরোধী নয়। জাতি বলতে তারা নিজেদেরকেই মনে করে। এদের জাতীয়তাবাদ জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করে না। এদের জাতীয়তাবাদ ধনিক শ্রেণির এবং সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসকামী। জাতীয়তাবাদী শাসকেরা নিজেদের শ্রেণির বান্ধব, জনগণের বান্ধব নন।
জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ব্রিটিশের শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার দরুন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণির জীবনে মাতৃভাষার চর্চা কমে এসেছে। এটাও প্রমাণ করে যে এরা দেশপ্রেমিক অবস্থানে নেই।
আমরা জাতি রাষ্ট্রের কথা শুনি। এযুগে এক রাষ্ট্রে এক জাতি বসবাস করবে এটা সম্ভব নয়। এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকে এবং থাকবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালি, কিন্তু তাই বলে এখানে অবাঙালি জাতিসত্তা যে নেই তা নয়। অবশ্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটা হবে ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে আমরা যা চাই তা জাতি রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালি থাকবে অবাঙালিও থাকবে, কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বলেই চলে। কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশপ্রেম একেবারেই নেই এটা সত্য নয়। আছে; তবে সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দু’কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা, প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে ধনীদের মধ্যেও এক ধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিক ভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।
ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে।
গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে-টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরৎ চলে যায়।
গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে, নইলে ভেঙে পড়তো। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।
আজকের পত্রিকা: আপনি এদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী যেমন-দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, এসব নিয়ে কিছু বলুন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, এসব বড় বড় ঘটনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার বয়সী সবাইকেই এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেশভাগ ছিল আমাদের দেশের জন্য মস্ত বড় এক দুর্ঘটনা। ১৭৫৭-তে পলাশীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এটি অবশ্যই সে মাপের নয়, তবে কাছাকাছি বটে। ১৭৫৭-তে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু, ১৯৪৭-এ তার অবসান ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি। নব্য-ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে এবং দেশভাগের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ঘটেছে সেটা অপূরণীয়।
১৯৫২-তে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ওই অভ্যুত্থান একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ওই পথে এগিয়ে আমরা উনসত্তরের জনঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং একাত্তরের যুদ্ধে সামিল হয়েছি। ওটি ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি চূড়ান্ত পর্যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরাতন পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা, যে আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেয়েছিল রাষ্ট্রের সংবিধানে। কিন্তু রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী শাসক শ্রেণি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে একেবারে ধুয়েমুছে ফেলাতে। শাসকশ্রেণির একাংশ ওই নীতিগুলোকে বাদ দিয়েছে, অপর অংশগুলো যে তাদেরকে ফেরৎ আনতে আগ্রহী এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৪৭-এর দেশভাগ মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বৈষয়িক উন্নতির। ১৯৭১-এ তাদের সে সুযোগ আরো প্রসারিত হয়েছে। উন্নতি ঘটেছে পুরাতন পুঁজিবাদী পন্থাতেই। সে-উন্নতি অল্পকিছু মানুষের এবং অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে। জনগণ মুক্তি পায়নি, মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ।
মুক্তির লড়াইটা অপরিহার্যরূপে পুঁজিবাদবিরোধী। সে লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে। বাংলাদেশেও তাকে অব্যাহত রাখা চাই। নইলে সমষ্টিগত ভাবে আমরা কেবলই নিচে নামতে থাকবো, এখন যেমন নামছি।
আজকের পত্রিকা: দেশভাগকে বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। এ ছিল মস্ত বড় ভুল এবং বিপর্যয়। যেটা উচিত ছিল তা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের যথার্থ বিতাড়ন। প্রয়োজন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা জাতিগুলোর প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা।
এই উপমহাদেশ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, দেশভাগের সময় এখানে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল, তাদের প্রত্যেকের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আবশ্যক ছিল। রাষ্ট্রগুলো জাতি-রাষ্ট্র হতো না, এক রাষ্ট্রে অন্যজাতির মানুষও থাকতো, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হতো জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলে শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করাটা সহজ হতো।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেটা চায়নি। তারা কৃত্রিম ভাবে দেশভাগ করে নিজেদের অনুগত লোকজনের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশি শাসকেরা পুঁজিবাদী, এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি অনুগত। ফলে দেখা গেছে যে ইংরেজ সরে গেছে বটে, কিন্তু না ভেঙেছে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা না তাদের হাতে-গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। করুণ সত্য এটাই যে জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সমষ্টিগত মুক্তিও অর্জিত হয়নি।
আজকের পত্রিকা: সমাজ দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। ধর্মান্ধতার অভিমুখে বললে ভুল হবে না।
উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য এবং ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: জীবনের এ পর্যায়ে এসেও লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে। কোথায় খুঁজে পান এতো প্রাণরস?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা এবং ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।
আজকের পত্রিকা: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। একসময় তিনি ‘গাছপাথর’ ছদ্মনামে তিনি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সাপ্তাহিক কলাম লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। এখনও তিনি আজকের পত্রিকাসহ বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখছেন। শিক্ষায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। আগামীকাল ২৩ জুন অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ৯০তম জন্মদিন। এই উপলক্ষে আজকের পত্রিকার পক্ষ থেকে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার

আজকের পত্রিকা: জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা। জীবনের ৮৯ বছর পেরিয়ে আসলেন কেমন লাগছে, আপনার অনুভূতি কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও শুভেচ্ছা। এতোগুলো জন্মদিন পেরিয়ে এসে আজ পড়ন্ত বেলায় অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো এই দীর্ঘসময়কালে ঘটনা ও দুর্ঘটনা অনেক দেখলাম। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হবার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্য হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বাঁচার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল; এখনো সেটা কমছে না। বরঞ্চ বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজরে না নেওয়ার কারণ কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহিতার দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।
দেখা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় সরকারি লোকদের আশ্রয়ে, নয় তো প্রশ্রয়ে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য-উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরো বেশি ধনী হয়। তাছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে।
মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-কানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুদ রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তাঁরা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে সরকারের মুখ চেয়ে। এঁরা হয়তো ইতিমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেন তাঁরাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাঁদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।
বুর্জোয়া দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত সেগুলোর দিকে যেতে চান না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য সেটা তাঁরা মানতে চান না। মানলে তাঁদের খুবই অসুবিধা। তাঁরা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তাঁরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চান; দেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন তাঁরা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
তাছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নেই। সরকার সংশ্লিষ্টরা আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায় চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।
আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না তাঁদের সংখ্যা অল্প। যাঁরা আছেন তাঁরাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাঁদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাঁদেরকে অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাঁদেরকে অবাঞ্ছিত বলে জানে।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের সাথে সাধারণ মানুষের যে যোগাযোগ থাকার কথা, তা কি লক্ষ্য করা যায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনাবিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলবার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে তা সে-বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হবার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দু’পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার জায়গাতে নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকার পক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন বরাবরের মতোই সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।
দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দু’টি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়ার প্রশ্নেই উঠছে না। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। উপর-কাঠামোতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে-রকমেরই রয়ে গেছে। পুরানো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া নব্য-ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করছে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে বৈকি। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না-ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ-পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপোসের কোনো সুযোগ দেখি না।
আজকের পত্রিকা: জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন, বিষয়টা কতটা পরিষ্কার হয়েছে পাঠকের কাছে বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধারণা ও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরিষ্কার হয়। শুধু লেখার কারণেই যে মানুষের কাছে জিনিসটা পরিষ্কার হবে তা নয়। অভিজ্ঞতাই শেখাবে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য কী ও কতটা।
জাতীয়তাবাদ আসলেই খুব জরুরি ব্যাপার। এর ইতিবাচক গুণ আছে, রয়েছে নেতিবাচক দুর্বলতাও। ইতিবাচক দিক হলো এই যে জাতীয়তাবাদ ঐক্যের সৃষ্টি করে এবং সে-ঐক্যের ভিত্তিতে থাকে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম সমষ্টিগত উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম মানুষকে সংবেদনশীল এবং সচেতন করে। দুটোই খুব বড় গুণ। তদুপরি দেশপ্রেম বিচ্ছিন্নতা কমায়।
জাতীয়তাবাদের শত্রু বাইরে থাকে, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমণ করে, আগ্রাসন চালায়, দখল করে নিতে চায়। এযুগে বিশ্বপুঁজিবাদ ওই কাজটাই করছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মানুষের ভয়ঙ্কর শত্রু।
কিন্তু জাতীয়তাবাদের শত্রু আবার জাতীয়তাবাদের ভেতরেই রয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদ উগ্রতা, অন্ধত্ব, অহমিকা ইত্যাদি তৈরি করে। এর অন্তরে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ নেতা খোঁজে এবং ব্যক্তিকে একক নেতা করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে বিকাশকে সহায়তা দেয়। এসব জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা।
তবে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ মূল শত্রুটা হচ্ছে বৈষম্য। জাতির অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য থাকে। ওই বৈষম্য ঐক্য গড়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা কর্তা হয়ে বসে এবং গরিবকে দমন করে। আমরা সবাই একই জাতির সদস্য, পরস্পরের আত্মীয়, জাতীয়তাবাদীরা এই বোধটা সঞ্চারিত করে শ্রেণি দ্বন্দ্বের সত্যটাকে আড়ালে রাখতে চায়। শাসকশ্রেণি জাতির নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্রেণিশোষণকে ভুলিয়ে দেয়। শ্রেণিবৈষম্য আবার পুঁজিবাদেরই অবদান। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকমের যে পুঁজিবাদ বাইরে থেকে তো বটেই ভেতর থেকেও শত্রুতা করছে। বাইরে সে আগ্রাসী, ভেতরে সে অন্তর্ঘাতী।
জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ এবং শ্রেণিবিভাজনের দরুন জাতীয়তাবাদের ভেতরে কার্যকর দুর্বলতা, দুটোই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। দেখাতে চেয়েছি যে বাইরে যেমন ভেতরেও তেমনি, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ এবং তাকে পরাভূত করতে না-পারলে মানুষের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তাই নিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে, বক্তব্যটা এরকমের।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বঘোষিতরূপেই জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তাদের কোনোটিই পুঁজিবাদবিরোধী নয়। জাতি বলতে তারা নিজেদেরকেই মনে করে। এদের জাতীয়তাবাদ জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করে না। এদের জাতীয়তাবাদ ধনিক শ্রেণির এবং সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসকামী। জাতীয়তাবাদী শাসকেরা নিজেদের শ্রেণির বান্ধব, জনগণের বান্ধব নন।
জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ব্রিটিশের শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার দরুন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণির জীবনে মাতৃভাষার চর্চা কমে এসেছে। এটাও প্রমাণ করে যে এরা দেশপ্রেমিক অবস্থানে নেই।
আমরা জাতি রাষ্ট্রের কথা শুনি। এযুগে এক রাষ্ট্রে এক জাতি বসবাস করবে এটা সম্ভব নয়। এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকে এবং থাকবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালি, কিন্তু তাই বলে এখানে অবাঙালি জাতিসত্তা যে নেই তা নয়। অবশ্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটা হবে ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে আমরা যা চাই তা জাতি রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালি থাকবে অবাঙালিও থাকবে, কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বলেই চলে। কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশপ্রেম একেবারেই নেই এটা সত্য নয়। আছে; তবে সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দু’কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা, প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে ধনীদের মধ্যেও এক ধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিক ভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।
ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে।
গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে-টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরৎ চলে যায়।
গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে, নইলে ভেঙে পড়তো। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।
আজকের পত্রিকা: আপনি এদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী যেমন-দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, এসব নিয়ে কিছু বলুন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, এসব বড় বড় ঘটনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার বয়সী সবাইকেই এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেশভাগ ছিল আমাদের দেশের জন্য মস্ত বড় এক দুর্ঘটনা। ১৭৫৭-তে পলাশীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এটি অবশ্যই সে মাপের নয়, তবে কাছাকাছি বটে। ১৭৫৭-তে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু, ১৯৪৭-এ তার অবসান ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি। নব্য-ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে এবং দেশভাগের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ঘটেছে সেটা অপূরণীয়।
১৯৫২-তে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ওই অভ্যুত্থান একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ওই পথে এগিয়ে আমরা উনসত্তরের জনঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং একাত্তরের যুদ্ধে সামিল হয়েছি। ওটি ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি চূড়ান্ত পর্যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরাতন পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা, যে আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেয়েছিল রাষ্ট্রের সংবিধানে। কিন্তু রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী শাসক শ্রেণি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে একেবারে ধুয়েমুছে ফেলাতে। শাসকশ্রেণির একাংশ ওই নীতিগুলোকে বাদ দিয়েছে, অপর অংশগুলো যে তাদেরকে ফেরৎ আনতে আগ্রহী এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৪৭-এর দেশভাগ মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বৈষয়িক উন্নতির। ১৯৭১-এ তাদের সে সুযোগ আরো প্রসারিত হয়েছে। উন্নতি ঘটেছে পুরাতন পুঁজিবাদী পন্থাতেই। সে-উন্নতি অল্পকিছু মানুষের এবং অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে। জনগণ মুক্তি পায়নি, মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ।
মুক্তির লড়াইটা অপরিহার্যরূপে পুঁজিবাদবিরোধী। সে লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে। বাংলাদেশেও তাকে অব্যাহত রাখা চাই। নইলে সমষ্টিগত ভাবে আমরা কেবলই নিচে নামতে থাকবো, এখন যেমন নামছি।
আজকের পত্রিকা: দেশভাগকে বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। এ ছিল মস্ত বড় ভুল এবং বিপর্যয়। যেটা উচিত ছিল তা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের যথার্থ বিতাড়ন। প্রয়োজন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা জাতিগুলোর প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা।
এই উপমহাদেশ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, দেশভাগের সময় এখানে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল, তাদের প্রত্যেকের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আবশ্যক ছিল। রাষ্ট্রগুলো জাতি-রাষ্ট্র হতো না, এক রাষ্ট্রে অন্যজাতির মানুষও থাকতো, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হতো জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলে শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করাটা সহজ হতো।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেটা চায়নি। তারা কৃত্রিম ভাবে দেশভাগ করে নিজেদের অনুগত লোকজনের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশি শাসকেরা পুঁজিবাদী, এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি অনুগত। ফলে দেখা গেছে যে ইংরেজ সরে গেছে বটে, কিন্তু না ভেঙেছে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা না তাদের হাতে-গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। করুণ সত্য এটাই যে জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সমষ্টিগত মুক্তিও অর্জিত হয়নি।
আজকের পত্রিকা: সমাজ দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। ধর্মান্ধতার অভিমুখে বললে ভুল হবে না।
উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য এবং ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: জীবনের এ পর্যায়ে এসেও লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে। কোথায় খুঁজে পান এতো প্রাণরস?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা এবং ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।
আজকের পত্রিকা: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা। জীবনের ৮৯ বছর পেরিয়ে আসলেন কেমন লাগছে, আপনার অনুভূতি কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও শুভেচ্ছা। এতোগুলো জন্মদিন পেরিয়ে এসে আজ পড়ন্ত বেলায় অনেকগুলো অনুভূতির একটি হলো এই দীর্ঘসময়কালে ঘটনা ও দুর্ঘটনা অনেক দেখলাম। কিন্তু অন্য সবার সঙ্গে আমারও যে স্বপ্ন ছিল সেটা বাস্তবায়িত হলো না। হবার সম্ভাবনা ছিল। হয়নি। সমাজে ফাটল ধরেছে, রাষ্ট্রে ভাঙচুর দেখলাম; কিন্তু ব্যবস্থাটা আগের মতোই রয়ে গেল। ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। একাত্তরে খুব বড় মাপের আশা জেগেছিল, আশা ভেঙে যাওয়াটা তাই খুবই বেদনাদায়ক হয়েছে। তবু আশা রাখি যে নতুন দিন আসবে। সেই অভ্যুদয় আমি হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু যারা থাকবে তারা দেখবে; এমন আশা বুকের মধ্যে ধারণ করি। স্বপ্নের জন্য হতাশার চেয়ে বড় শত্রু আর নেই। বাঁচার সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রামের অব্যাহত ধারা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে, এ আশা সব সময়ই ছিল; এখনো সেটা কমছে না। বরঞ্চ বাড়ছেই, দেখতে পাচ্ছি।
আজকের পত্রিকা: সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে অনেক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রপক্ষ বিষয়গুলোর প্রতি যথাযথ নজরে না নেওয়ার কারণ কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এর কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্র জনগণের স্বার্থ দেখে না; স্বার্থ দেখে কতিপয়ের। এ রাষ্ট্র জনমতের তোয়াক্কা করে না। জবাবদিহিতার দায়ভার গ্রহণ করে না। যে অন্যায়গুলো ঘটছে সেগুলো জনগণের জন্য বড় রকমের সমস্যা, কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য নয়। রাষ্ট্র এগুলোকে তার নিজের জন্য কোনো হুমকি বলে মনে করে না।
দেখা যায় যে, অপরাধীদের শাস্তি হয় না, যে জন্য অপরাধের মাত্রা বাড়তেই থাকে। অনুসন্ধান করলে জানা যাবে, অনেক অপরাধ সংঘটিত হয় সরকারি লোকদের আশ্রয়ে, নয় তো প্রশ্রয়ে। সরকারি বলতে রাজনীতিক ও বিভিন্ন ধরনের আমলাতন্ত্রের সদস্য-উভয়কেই বুঝতে হবে। শাসক শ্রেণি জনগণের সম্মতি নিয়ে দেশ শাসন করে না। কখনো কখনো তারা জোরজবরদস্তির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেয়। যখন ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তখনো জনগণের স্বার্থ দেখবে এমন লোকেরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয় না; ভোটে জেতে তারাই যাদের টাকা আছে। টাকাওয়ালারা নির্বাচনে টাকা খরচ করে, জেতে এবং জিতে আরো বেশি ধনী হয়। তাছাড়া এমন ঘটনাও তো ঘটে যে ভোটার আসে না, ভোট দেয় না, তবু কথিত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে যান এবং দেশ শাসন করেন। সরকার যে টিকে থাকে সেটা জনসমর্থনের দরুন নয়, ক্ষমতার জোরে ও দাপটে। বর্তমানে শাসক শ্রেণির জন্য জনসমর্থনের চেয়েও বিদেশি শক্তির সমর্থন অধিক জরুরি হয়ে উঠেছে।
মোট কথা, রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়িয়েছে শাসক শ্রেণির স্বার্থকে নিরাপত্তা দেওয়া। নিরাপত্তা বিধানের জন্য আইন-কানুন, সরকারি-বেসরকারি বাহিনী, সবকিছুই মজুদ রয়েছে। আমাদের এই রাষ্ট্রকে তাই বুর্জোয়া অর্থেও গণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেন ঠিকই, বলতে হয়, নইলে তাঁরা বুদ্ধিজীবী কেন; কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই কথা বলেন লাইন ধরে। একদল থাকেন সরকারের পক্ষে, কথা বলেন ইনিয়ে বিনিয়ে সরকারের মুখ চেয়ে। এঁরা হয়তো ইতিমধ্যেই সুবিধা পেয়েছেন, নয়তো পাবেন বলে আশা করছেন। সরকারের বিরুদ্ধে যাঁরা বলেন তাঁরাও আশাবাদী; আশা রাখেন যে এখন পাচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু আগামীতে সুদিন আসবে এবং তখন সুবিধা পাবেন। তবে তাঁদের কথায় তেমন জোর থাকে না। প্রথমত, গণমাধ্যম তাদেরকে তেমন একটা পাত্তা দেয় না, কেননা গণমাধ্যমের মালিকেরা সরকারের বিরুদ্ধে যেতে চায় না, ভয় পায়। দ্বিতীয়ত, সরকার নিজেও বিরুদ্ধ মত পছন্দ করে না, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করতে পারলে খুশি হয়।
বুর্জোয়া দলের কোনো দলই জনজীবনের গভীরে যেসব সমস্যা রয়েছে, যেগুলো রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত সেগুলোর দিকে যেতে চান না। দৃশ্যমান সমস্যাগুলো যে গভীর এক অসুখেরই প্রকাশ এবং সে অসুখের নাম যে বিদ্যমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও আদর্শের দৌরাত্ম্য সেটা তাঁরা মানতে চান না। মানলে তাঁদের খুবই অসুবিধা। তাঁরা চান ব্যবস্থাটাকে যেমন আছে তেমনি রেখে দিয়ে নিজেদের যা প্রাপ্য সেটা বুঝে নিতে। সুবিধা ভাগাভাগির লড়াইটাকে তাঁরা মতাদর্শিক লড়াইয়ের আবরণ দিতে চান; দেনও। কিন্তু যতই লুকোচুরি খেলুন তাঁরা যে জনগণের পক্ষের শক্তি নন এ সত্য মিথ্যা হয়ে যায় না।
তাছাড়া এটাও তো মানতে হবে যে, গভীর ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার চর্চা আমাদের দেশে উৎসাহ পায় না। এখানে মতাদর্শিক বিতর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদ নেই। সরকার সংশ্লিষ্টরা আত্মসন্তুষ্ট দম্ভোক্তি, চাটুকারিতা ও অনুপস্থিত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারে সর্বক্ষণ মুখরিত থাকে। গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন ও ছবি যত পাওয়া যায় চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা তার শতভাগের এক ভাগও পাওয়া যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের কদর নেই। শিক্ষা ক্ষেত্রে তথাকথিত বিস্ফোরণ চিন্তার মানের ও জ্ঞান প্রকাশের ভাষাগত দক্ষতার বৃদ্ধি ঘটিয়েছে এমনটা বলা যাচ্ছে না, বরঞ্চ উল্টোটাই ঘটেছে বলে সন্দেহ।
আনুগত্যের বাইরে যে বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, যাঁরা মনে করেন রাষ্ট্র ও সমাজকে গণতান্ত্রিক করতে না পারলে মানুষের মুক্তি আসবে না তাঁদের সংখ্যা অল্প। যাঁরা আছেন তাঁরাও সুসংগঠিত নন, পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং তাঁদের বক্তব্য প্রচার পায় না। সরকার তাঁদেরকে অপছন্দ করে; গণমাধ্যম তাঁদেরকে অবাঞ্ছিত বলে জানে।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের সাথে সাধারণ মানুষের যে যোগাযোগ থাকার কথা, তা কি লক্ষ্য করা যায়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ অবশ্যই আছে। থাকতেই হবে। রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষমতা, আয় উপার্জন সে তো সাধারণ মানুষের কারণেই। তবে সম্পর্কটা একপক্ষীয়, দ্বিপক্ষীয় নয়। রাষ্ট্র হুকুম দেয়, জনগণ শোনে। জনগণ যা বলতে চায় রাষ্ট্র তা শোনে না। রাষ্ট্র শাসন করে, জনগণ শাসিত হয়। রাষ্ট্র তার সিদ্ধান্তগুলো বিনাবিচারে ও নির্দ্বিধায় জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়; জনগণের কিছু বলবার থাকে না, তারা শুধু দেখে এবং সহ্য করে।
রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। আইন প্রণয়ন বিভাগে সত্যিকার জনপ্রতিনিধি বলতে প্রায় কেউই থাকে না। ওদিকে বিচার বিভাগ জনগণের বড় অংশের জন্য অনেকটা নিষিদ্ধই হয়ে আছে। আদালতে যেতে হলে টাকা লাগে, গেলে ন্যায়বিচার কতটা পাওয়া যাবে এবং কবে পাওয়া যাবে তা সে-বিষয়ে গভীর সংশয় রয়েই যায়। মামলা করে নিঃস্ব হবার দৃষ্টান্ত বিরল নয়।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যোগাযোগ তাই মোটেই দ্বিপক্ষীয় নয়, একপক্ষীয় বটে। দু’পক্ষের যোগাযোগের একটি কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে গণমাধ্যম। গণমাধ্যম পারে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষোভ-বিক্ষোভকে তুলে ধরতে; পারে কিছু পরিমাণে হলেও রাষ্ট্রকে জবাবদিহিতার জায়গাতে নিয়ে আসতে। কেবল যে পারে তা নয়, পারাটা উচিতও বটে। কিন্তু আমাদের দেশে গণমাধ্যম সে কাজটা করে না। সরকারের অর্জন, সরকারি ও সরকার পক্ষীয় লোকদের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করাটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গণমাধ্যমের প্রধান দায়িত্ব। এর কারণ মালিকেরা সবাই বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়ে পড়েছেন বরাবরের মতোই সরকারপন্থি। এই পক্ষপাত মতাদর্শিক অনুপ্রেরণায় নয়, স্বার্থের টানে।
দেশে বেকার সমস্যা ক্রমাগত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। জনজীবনে নিরাপত্তার অভাব বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে মেয়েরা দুঃসহ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। অন্য সমস্যা তো বটেই, জনদুর্ভোগের এই দু’টি বড় বিষয়ে গণমাধ্যমের কাছ থেকে যে সরবতা প্রত্যাশিত তা পাওয়া যাচ্ছে না।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের ধর্ম দুর্বলকে রক্ষা আর দুর্জনকে প্রতিরোধ; তার কোনোটাই বর্তমান সময়ে হচ্ছে না, এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দুর্বলকে রক্ষা করা এবং দুর্জনকে দমন করা একটি আদর্শের কথা। এমন আদর্শ রাষ্ট্র পাওয়া কঠিন, এখন তো পাওয়ার প্রশ্নেই উঠছে না। আমাদের রাষ্ট্রে দুর্বলরা রয়েছে দুর্জনদের কর্তৃত্বাধীন। রাষ্ট্র ধনীদের ইচ্ছায় চলে। ধনীরা উৎপাদনের সূত্রে ধনী হয়নি। উৎপাদন যা করার করে মেহনতি মানুষ। ধনীদের অধিকাংশই ধনী হয়েছে প্রতারণা ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এরা দুর্বল নয়, এরা দুর্জন। এদের পক্ষে দুর্জন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দুর্জনদের কারণেই দুর্বলরা দুর্বল থাকে এবং অসহায় বোধ করে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সহজ উপায় নেই। উত্তরণের জন্য আমরা দীর্ঘকাল সংগ্রাম করেছি, কিন্তু সফল হইনি। সফল না হওয়ার কারণ আমাদের দেশে কোনো সামাজিক বিপ্লব ঘটেনি। উপর-কাঠামোতে ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেনি। শাসক শাসিতের সম্পর্কটা রাজা ও প্রজার যে সম্পর্ক সে-রকমেরই রয়ে গেছে। পুরানো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসকেরা এসেছে, কিন্তু শাসক-শাসিতের সম্পর্কে মৌলিক রদবদল ঘটেনি। হঠাৎ করে ক্ষমতা পাওয়া নব্য-ধনীরা গরিবদের জ্বালাতন করছে। এ ঘটনা আগেও ছিল, এখনও আছে বৈকি। ধনবৈষম্য আগের তুলনায় কমে তো নয়ই, বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন না আসার কারণ সমাজে বিপ্লব না-ঘটা। উত্তরণের জন্য সমাজ-পরিবর্তনের অব্যাহত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ব্যাপারে আপোসের কোনো সুযোগ দেখি না।
আজকের পত্রিকা: জাতীয়তাবাদ নিয়ে লিখছেন দীর্ঘদিন, বিষয়টা কতটা পরিষ্কার হয়েছে পাঠকের কাছে বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: জাতীয়তাবাদ হচ্ছে একটি ধারণা ও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই ধারণা গড়ে ওঠে এবং পরিষ্কার হয়। শুধু লেখার কারণেই যে মানুষের কাছে জিনিসটা পরিষ্কার হবে তা নয়। অভিজ্ঞতাই শেখাবে জাতীয়তাবাদের তাৎপর্য কী ও কতটা।
জাতীয়তাবাদ আসলেই খুব জরুরি ব্যাপার। এর ইতিবাচক গুণ আছে, রয়েছে নেতিবাচক দুর্বলতাও। ইতিবাচক দিক হলো এই যে জাতীয়তাবাদ ঐক্যের সৃষ্টি করে এবং সে-ঐক্যের ভিত্তিতে থাকে দেশপ্রেম। দেশপ্রেম সমষ্টিগত উন্নতির জন্য অত্যাবশ্যক। দেশপ্রেম মানুষকে সংবেদনশীল এবং সচেতন করে। দুটোই খুব বড় গুণ। তদুপরি দেশপ্রেম বিচ্ছিন্নতা কমায়।
জাতীয়তাবাদের শত্রু বাইরে থাকে, ভেতরেও থাকে। বাইরের শত্রু আক্রমণ করে, আগ্রাসন চালায়, দখল করে নিতে চায়। এযুগে বিশ্বপুঁজিবাদ ওই কাজটাই করছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছে। এই পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদ মানুষের ভয়ঙ্কর শত্রু।
কিন্তু জাতীয়তাবাদের শত্রু আবার জাতীয়তাবাদের ভেতরেই রয়ে গেছে। জাতীয়তাবাদ উগ্রতা, অন্ধত্ব, অহমিকা ইত্যাদি তৈরি করে। এর অন্তরে রয়েছে একনায়কতন্ত্রী প্রবণতা। জাতীয়তাবাদ নেতা খোঁজে এবং ব্যক্তিকে একক নেতা করে ফ্যাসিবাদী প্রবণতাকে বিকাশকে সহায়তা দেয়। এসব জাতীয়তাবাদের দুর্বলতা।
তবে জাতীয়তাবাদের অভ্যন্তরীণ মূল শত্রুটা হচ্ছে বৈষম্য। জাতির অভ্যন্তরে শ্রেণিবৈষম্য থাকে। ওই বৈষম্য ঐক্য গড়ার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ধনীরা কর্তা হয়ে বসে এবং গরিবকে দমন করে। আমরা সবাই একই জাতির সদস্য, পরস্পরের আত্মীয়, জাতীয়তাবাদীরা এই বোধটা সঞ্চারিত করে শ্রেণি দ্বন্দ্বের সত্যটাকে আড়ালে রাখতে চায়। শাসকশ্রেণি জাতির নামে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, শ্রেণিশোষণকে ভুলিয়ে দেয়। শ্রেণিবৈষম্য আবার পুঁজিবাদেরই অবদান। ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই রকমের যে পুঁজিবাদ বাইরে থেকে তো বটেই ভেতর থেকেও শত্রুতা করছে। বাইরে সে আগ্রাসী, ভেতরে সে অন্তর্ঘাতী।
জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে আমি জনগণের মুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণ এবং শ্রেণিবিভাজনের দরুন জাতীয়তাবাদের ভেতরে কার্যকর দুর্বলতা, দুটোই আমার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে। দেখাতে চেয়েছি যে বাইরে যেমন ভেতরেও তেমনি, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ এবং তাকে পরাভূত করতে না-পারলে মানুষের মুক্তি নেই। জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে তাই নিয়ে যেতে হবে সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের দিকে, বক্তব্যটা এরকমের।
বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো স্বঘোষিতরূপেই জাতীয়তাবাদী। কিন্তু তাদের কোনোটিই পুঁজিবাদবিরোধী নয়। জাতি বলতে তারা নিজেদেরকেই মনে করে। এদের জাতীয়তাবাদ জনগণের মুক্তির জন্য কাজ করে না। এদের জাতীয়তাবাদ ধনিক শ্রেণির এবং সর্বদাই সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপোসকামী। জাতীয়তাবাদী শাসকেরা নিজেদের শ্রেণির বান্ধব, জনগণের বান্ধব নন।
জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে ভাষা। ব্রিটিশের শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিল ভাষাকে সরিয়ে দিয়ে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার দরুন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণির জীবনে মাতৃভাষার চর্চা কমে এসেছে। এটাও প্রমাণ করে যে এরা দেশপ্রেমিক অবস্থানে নেই।
আমরা জাতি রাষ্ট্রের কথা শুনি। এযুগে এক রাষ্ট্রে এক জাতি বসবাস করবে এটা সম্ভব নয়। এক রাষ্ট্রে একাধিক জাতি থাকে এবং থাকবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই বাঙালি, কিন্তু তাই বলে এখানে অবাঙালি জাতিসত্তা যে নেই তা নয়। অবশ্যই আছে এবং তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করাটা হবে ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেওয়া। আসলে আমরা যা চাই তা জাতি রাষ্ট্র নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে বাঙালি থাকবে অবাঙালিও থাকবে, কিন্তু প্রত্যেক নাগরিকের জন্যই থাকবে অধিকার ও সুযোগের সাম্য।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সমস্যা থেকে উত্তরণ এসব বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে সেটি আমাদের মাঝে বিন্দুমাত্র নেই বলেই চলে। কেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশপ্রেম একেবারেই নেই এটা সত্য নয়। আছে; তবে সবার ক্ষেত্রে সমান ভাবে নেই। ধনীদের ক্ষেত্রে দেশপ্রেম কমছে। দু’কারণে। ধনীরা নিজেদেরকে দেশের গরিব মানুষদের সমপর্যায়ের মনে করে না। ভাবে তারা স্বতন্ত্র, কারণ তারা ধনী। তারা যে স্বতন্ত্র এটা প্রমাণ করার জন্য দেশের ভেতরেই তারা বিদেশিদের মতো আচরণ করে। তাদের জীবনাচার, ভোগ-বিলাসিতা, সর্বোপরি মাতৃভাষার প্রতি অনীহা, অনেকক্ষেত্রে অবজ্ঞা, প্রমাণ করে যে তারা দেশপ্রেমিক নয়। এরা ধরেই নেয় যে এদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই সম্পদ, সম্পত্তি, সন্তান-সন্ততি সবকিছু এরা বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়িও তৈরি করে রাখে। তবে ধনীদের মধ্যেও এক ধরনের দেশপ্রেম জেগে ওঠে যখন তারা বিদেশিদের দ্বারা অপমানিত হয়। তখন তারা মানসিক ভাবে দাঁড়াবার জায়গা খোঁজে, কিন্তু পায় না।
ধনীরা পুঁজিবাদী। পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ও কর্তৃত্বকারী বাস্তবতা। পুঁজিবাদ মানুষকে উৎপাটিত করে, নিরাশ্রয় করে ছাড়ে।
গরিব মানুষের জন্য কিন্তু বড় বিশ্ব বলে কিছু নেই; তাদের জন্য নিজের গ্রাম, শহর, দেশ এগুলোই হলো বিশ্ব। মাতৃভাষাই তাদের একমাত্র ভাষা। অন্য কোনো দেশ নেই, অন্য কোনো ভাষাও নেই। এরা যখন বিদেশে যায় তখনো দেশপ্রেমিকই থাকে। দেশের জন্য তাদের মন কাঁদে, খেয়ে না-খেয়ে টাকা পাঠায়, যে-টাকার অনেকটাই ধনীদের তৎপরতার দরুন বিদেশে ফেরৎ চলে যায়।
গরিব মানুষের শ্রমের ওপরই দেশ টিকে আছে, নইলে ভেঙে পড়তো। ধনীরা দেশের ক্ষতি করে; তারা তাদের দেশপ্রেমের নিম্নগামিতাকে অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত করে দেয়। তাদের অত্যাচার অনাচারে দেশের সুনাম ভূলুণ্ঠিত হয়।
আজকের পত্রিকা: আপনি এদেশের অনেক ঘটনার সাক্ষী যেমন-দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা, এসব নিয়ে কিছু বলুন।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, এসব বড় বড় ঘটনা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। আমার বয়সী সবাইকেই এই অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
দেশভাগ ছিল আমাদের দেশের জন্য মস্ত বড় এক দুর্ঘটনা। ১৭৫৭-তে পলাশীতে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এটি অবশ্যই সে মাপের নয়, তবে কাছাকাছি বটে। ১৭৫৭-তে যে ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু, ১৯৪৭-এ তার অবসান ঘটার কথা। কিন্তু ঘটেনি। নব্য-ঔপনিবেশিকতা রয়ে গেছে এবং দেশভাগের ফলে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ক্ষতি ঘটেছে সেটা অপূরণীয়।
১৯৫২-তে নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গের মানুষের অভ্যুত্থান ঘটেছিল। ওই অভ্যুত্থান একদিকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যদিকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ওই পথে এগিয়ে আমরা উনসত্তরের জনঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছি এবং একাত্তরের যুদ্ধে সামিল হয়েছি। ওটি ছিল জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের একটি চূড়ান্ত পর্যায়। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল পুরাতন পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে ভেঙে ফেলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা, যে আকাঙ্ক্ষা স্বীকৃতি পেয়েছিল রাষ্ট্রের সংবিধানে। কিন্তু রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী শাসক শ্রেণি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না। এর নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া গেছে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারকে একেবারে ধুয়েমুছে ফেলাতে। শাসকশ্রেণির একাংশ ওই নীতিগুলোকে বাদ দিয়েছে, অপর অংশগুলো যে তাদেরকে ফেরৎ আনতে আগ্রহী এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
১৯৪৭-এর দেশভাগ মুসলিম মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিয়েছিল বৈষয়িক উন্নতির। ১৯৭১-এ তাদের সে সুযোগ আরো প্রসারিত হয়েছে। উন্নতি ঘটেছে পুরাতন পুঁজিবাদী পন্থাতেই। সে-উন্নতি অল্পকিছু মানুষের এবং অধিকাংশ মানুষের বিপরীতে। জনগণ মুক্তি পায়নি, মুক্ত হয়েছে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ।
মুক্তির লড়াইটা অপরিহার্যরূপে পুঁজিবাদবিরোধী। সে লড়াই আজ বিশ্বব্যাপী চলছে। বাংলাদেশেও তাকে অব্যাহত রাখা চাই। নইলে সমষ্টিগত ভাবে আমরা কেবলই নিচে নামতে থাকবো, এখন যেমন নামছি।
আজকের পত্রিকা: দেশভাগকে বাঙালির ঐতিহাসিক ভুল বলে আপনি মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই। এ ছিল মস্ত বড় ভুল এবং বিপর্যয়। যেটা উচিত ছিল তা হলো ঔপনিবেশিক শাসকদের যথার্থ বিতাড়ন। প্রয়োজন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার ভিত্তিতে গড়ে-ওঠা জাতিগুলোর প্রত্যেকটির জন্য স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং সেই রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি রাষ্ট্রসংঘ গঠন করা।
এই উপমহাদেশ কখনোই এক জাতির দেশ ছিল না, দেশভাগের সময় এখানে কমপক্ষে ১৭টি জাতি ছিল, তাদের প্রত্যেকের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা আবশ্যক ছিল। রাষ্ট্রগুলো জাতি-রাষ্ট্র হতো না, এক রাষ্ট্রে অন্যজাতির মানুষও থাকতো, কিন্তু রাষ্ট্রের ভিত্তি হতো জাতীয়তাবাদী। ধর্মভিত্তিক নয়, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী। জাতি প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে গেলে শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসা করাটা সহজ হতো।
কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকেরা সেটা চায়নি। তারা কৃত্রিম ভাবে দেশভাগ করে নিজেদের অনুগত লোকজনের হাতে শাসনক্ষমতা তুলে দিয়ে চলে গেছে। দেশি শাসকেরা পুঁজিবাদী, এবং ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রতি অনুগত। ফলে দেখা গেছে যে ইংরেজ সরে গেছে বটে, কিন্তু না ভেঙেছে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা না তাদের হাতে-গড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। করুণ সত্য এটাই যে জাতি সমস্যার সমাধান হয়নি এবং সমষ্টিগত মুক্তিও অর্জিত হয়নি।
আজকের পত্রিকা: সমাজ দর্শনের জায়গা থেকে যদি বলেন, আমাদের বর্তমান সমাজ কোন দিকে এগিয়ে চলছে?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বর্তমানে অগ্রগামিতা মোটেই ভালোর দিকে নয়; খারাপ দিকে বটে। ধর্মান্ধতার অভিমুখে বললে ভুল হবে না।
উন্নতি যা ঘটছে তা বৈষয়িক ও বাহ্যিক; অন্তরালে বাড়ছে বৈষম্য। যত উন্নতি তত বৈষম্য বৃদ্ধি, এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিয়মবিধি। এমন সুবিস্তৃত বৈষম্য আগে কখনো দেখা যায়নি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দারিদ্র্য এবং ক্ষোভ দুটোকেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধনীরাই আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের দেশপ্রেমহীনতা ও ভোগবাদিতা বঞ্চিত মানুষদের মধ্যেও সংক্রমিত হচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: জীবনের এ পর্যায়ে এসেও লিখে চলছেন অবিরত, কথা বলেন সাহসী কণ্ঠে। কোথায় খুঁজে পান এতো প্রাণরস?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ক্ষেত্রে লেখাই বেশি ঘটেছে, বলা কম। অবশ্য লেখার ভেতরেও বক্তব্য থাকে। লিখি কিছুটা অভ্যাসবশত, অনেকটা এর চেয়ে ভালো কোনো কাজ করার ক্ষমতা নেই বলে। তবে সূত্রাকারে বলতে গেলে বলতে হয় বাইরের অবস্থা এবং ভেতরের সংবেদনশীলতাই দায়ী লেখা, পত্রিকা সম্পাদনা, সংগঠন গড়ে তোলা ইত্যাদি কাজে আমার যুক্ত থাকার জন্য।
আজকের পত্রিকা: সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৪ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৭ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান। নাটকটি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন এই অভিনেতা।
বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকা

‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।
‘ভাসানে উজান’ নাটকের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতাটা কেমন?
দস্তয়ভস্কির বিখ্যাত ছোটগল্প দ্য জেন্টেল স্পিরিট অবলম্বনে এই নাটক। দস্তয়ভস্কি মানেই মানুষের অন্তর্লোকের গভীরতম স্তরে প্রবেশ। ভাসানে উজান আমার জন্য শুধুই একটি নাটক নয়, এটি একধরনের আত্মসংলাপ। এই গল্পে ঢুকতে গিয়ে আমাকে বারবার নিজের ভেতরের অচেনা কোণগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছে। এ ছাড়া অপূর্বদার নাট্যরূপে সাহিত্যের সৌন্দর্য যেমন অটুট আছে, তেমনি আছে মঞ্চের ভাষা। আর শুভাশীষদার নির্দেশনা ছিল ধ্যানের মতো—নীরব, গভীর এবং সংযত। এই দুজনের সমন্বয় আমাকে অভিনয়ে আরও সংযমী করেছে।
ভাসানে উজানের চরিত্রটি উপস্থাপনে মানসিকভাবে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
এই চরিত্রটি বাহিরের নয়, ভেতরের অভিনয় দাবি করে। এখানে কান্না নেই, চিৎকার নেই—আছে চাপা অপরাধবোধ আর নীরব অনুশোচনা। এই নীরবতাই ছিল সবচেয়ে কঠিন। আমি মনে করি, আজকের মানুষ ভেতরে ভেতরে খুব একা। ভাসানে উজান সেই একাকিত্বের আয়না। দর্শক যদি নিজের ছায়াটা একটু দেখতে পান, সেটাই আমাদের সাফল্য।
চতুর্থ প্রদর্শনীতে এসে ভাসানে উজান নাটকে কি কোনো পরিবর্তন বা পরিণতি এসেছে?
প্রতিটি প্রদর্শনীতেই নাটকটা একটু একটু করে বদলায়। আমি নিজেও বদলাই। দর্শকের নিশ্বাস, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে নাটকটি আরও পরিণত হয়ে ওঠে।
একক অভিনয়ে দীর্ঘ সময় মঞ্চে থাকতে হয়, সঙ্গ দেওয়ার কেউ থাকে না। এই একাকিত্বকে কীভাবে অনুভব করেন?
একাকিত্ব এখানে শূন্যতা নয়, বরং একধরনের গভীর উপস্থিতি। দর্শক, আলো, নীরবতা—সবকিছু মিলিয়ে এক অদৃশ্য সংলাপ তৈরি হয়। সেই সংলাপই আমাকে টেনে নেয় পুরো সময়জুড়ে।
দীর্ঘ দুই দশকের নাট্যচর্চার পরেও কি নাট্যমঞ্চে অভিনয়ের ক্ষেত্রে নতুন করে ভয় বা উত্তেজনা কাজ করে?
ভয় না থাকলে অভিনয় মৃত হয়ে যায়। প্রতিটি প্রদর্শনীর আগে আমি নতুন করে ভয় পাই, এই ভয় আমাকে সৎ রাখে, জীবিত রাখে একজন অভিনেতা হিসেবে।
ভবিষ্যতে একক নাটক ও থিয়েটার নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
আমি চাই, থিয়েটার আরও স্থির হোক, আরও গভীর হোক। একক নাটক নিয়ে আরও গবেষণাধর্মী কাজ করতে চাই, যেখানে অভিনয় হবে আত্মানুসন্ধানের একটি মাধ্যম।
মঞ্চ ও টেলিভিশনের আসন্ন কাজ নিয়ে দর্শকদের জন্য কী বলতে চান?
আমার অভিনীত নাটকগুলোর নিয়মিত প্রদর্শনী চলছে। পাশাপাশি নতুন একটি রেপার্টরি নাটকে যুক্ত হচ্ছি। এ ছাড়া কয়েকটি টেলিভিশন নাটকের কাজও শেষের পথে। নাটকগুলো শিগগির দর্শকদের সামনে আসবে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
২২ জুন ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৭ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ। তাঁর সঙ্গে কথা বলে পর্দার আড়ালের সেই অভিজ্ঞতাগুলোই তুলে ধরেছেন মনিরুল ইসলাম।
মনিরুল ইসলাম

কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।
কীভাবে আপনি সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন?
প্রতিটি স্বপ্নের পেছনে একটি করে গল্প থাকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার অনুপ্রেরণারও তেমনি একটি গল্প আছে। সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার আগেও ছোটবেলা থেকে আমার বড় মামাকে দেখেছি, তাঁর কথা বলার স্টাইল ছিল ভীষণ হৃদয়গ্রাহী, যা মানুষকে খুব কাছে টানত। ঠিক তখন থেকেই বড় মামা হয়ে যান আমার সুপার হিরো। আমিও চেষ্টা করতাম তেমন করে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারপর দেখলাম এর সেরা উপায় হলো সংবাদ উপস্থাপক হওয়া। তাঁদের সুন্দর করে কথা বলাটা আমার পছন্দ হতো। সেখান থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত হওয়া। তা ছাড়া আমার মরহুম আব্বুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। তাঁর উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা এবং আমার আম্মুর নীরব সমর্থন আমাকে এ পেশায় আসতে সহযোগিতা করেছে।
শুরুতে সংবাদ উপস্থাপনার প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি কেমন ছিল?
ছোটবেলা থেকেই কবিতা আবৃত্তি করতাম। সেটাও বড় মামার হাত ধরেই। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যখন নিউজ প্রেজেন্টার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম, তখন থেকেই চিন্তা করতাম এখানে শুদ্ধ উচ্চারণের বিকল্প নেই। তাই উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে টিএসসিভিত্তিক একটি আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। সেখানেও নিউজ প্রেজেন্টেশনের ক্লাস হতো। তারপর শুধু নিউজ প্রেজেন্টেশনের জন্য একটা একাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে ভর্তি ফি ছিল ৭ হাজার টাকা। পুরোটা দেওয়ার সামর্থ্য তখন ছিল না। তাই তাদের বলেছিলাম, ইনশা আল্লাহ একদিন নিউজ প্রেজেন্টার হয়ে আপনাদের এখানে ফ্রি ক্লাস নেব। সেই থেকে মনের মধ্যে ইচ্ছাটাও প্রবল হয়েছিল।
প্রথমবার লাইভ নিউজ উপস্থাপন করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
প্রথমবার একটা অনলাইন টিভিতে নিউজ পড়েছিলাম। তাদেরও অভিষেক হয়েছিল আমাকে দিয়ে। তাই উচ্ছ্বাসটা দু’পক্ষেরই একটু বেশি ছিল। আমি তাদের গ্রুমিং করা প্রেজেন্টারদের মধ্যে প্রথম ছিলাম। নিজেকে প্রথম কোনো পর্দায় দেখে কি যে ভালো লেগেছিল, তা বলার ভাষা নেই।
উপস্থাপনায় ভাষা, উচ্চারণ ও টোন কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
এ পেশাটা অন্য যেকোনো পেশার চেয়ে একটু আলাদা। এমনকি বাচিক যেকোনো পেশার চেয়েও। যেমন কাস্টমার কেয়ার, কিংবা কল সেন্টার থেকেও। এখানে ভুল উচ্চারণের কোনো মার্সি বা ক্ষমা নেই। তবে এখানে সংবাদের ভিন্নতার কারণে টোনের পরিবর্তন করতে হয়। নিউজের ভিন্ন ভিন্ন আবেদন টোনের ওঠানামায় ফুটিয়ে তুলতে হয়। টোনের ভেরিয়েশনের কারণে দর্শকের কানও প্রশান্তি পায়।
সংবাদ উপস্থাপনায় সময় ব্যবস্থাপনা বা কলাকৌশল কীভাবে পালন করেন?
এখানে সময় ব্যবস্থাপনাটা সবার আগে। প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডের মূল্য এখানে দিতে হয়। নিউজ শুরুর অনেক আগেই একজন প্রেজেন্টারকে স্টেশনে হাজির থাকতে হয়। সবকিছু বুঝে নিতে হয়। নিউজ শুরু হলে তো তাঁকে আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হয় সময় সম্পর্কে। কারণ প্রতিটি টাইমফ্রেম এখানে গুরুত্বপূর্ণ।
লাইভ সম্প্রচারে হঠাৎ সময় পরিবর্তন হলে কীভাবে সামলান?
লাইভ নিউজে যেকোনো কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হয়। প্রেজেন্টারদের কানে একটা গোপন টকব্যাক লাগানো থাকে। যার সঙ্গে পিসিআর অর্থাৎ প্রডিউসার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রডিউসার যেকোনো আপডেট নিউজ টকব্যাকে জানিয়ে দেন। সেটার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। খুব ঠান্ডা মাথায় যেকোনো ব্রেকিং বুঝে তারপর ডেলিভারি দিতে হয়।
উপস্থাপনার সময় ঘড়ি বা প্রম্পটার দেখে কীভাবে সময় নিয়ন্ত্রণ করেন?
পুরো নিউজটা একটা টাইমফ্রেমে বাঁধা থাকে। বিশেষ কারণ ছাড়া এর বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। প্রতিটি নিউজের জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ থাকে। সেটা বিবেচনা করেই নিউজ পড়ার গতি নির্ধারণ করতে হয়। সময় কন্ট্রোল করার জন্য পিসিআর এবং এমসিআর-মাস্টার কন্ট্রোল রুম সদা তৎপর থাকে। সেভাবেই একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে চলতে হয়।
ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস ধরে রাখার কৌশল কী?
আত্মবিশ্বাসটা অনেক কিছুর সমন্বিত একটা রূপ। যেকোনো ভালো প্রিপারেশন আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। এখানে একজন নিউজ প্রেজেন্টারের ভালো প্রিপারেশন অনেক কিছুর সমন্বয়ে হয়ে থাকে। যেমন তাঁর উচ্চারণ, নিউজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা। নিউজ রুম, পিসিআর, এমসিআর, রানডাউন (যেখানে নিউজের ধারাবাহিকতা সাজানো থাকে) সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাঁর আত্মবিশ্বাস অটুট থাকে।
ভুল হয়ে গেলে কীভাবে পরিস্থিতি সামলান?
লাইভ নিউজে ভুল হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তবে বারবার একই ভুল যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। ভুল হলে দর্শকের কাছে বিনয়ের সঙ্গে সেটি উপস্থাপন করাটাও ভালো প্রেজেন্টারের কাজ। দর্শকের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগ রাখতে হয়।
লাইভ নিউজে হঠাৎ অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি এলে আপনার মানসিক কৌশল কেমন থাকে?
লাইভ নিউজে প্রতিটি সেকেন্ডই চ্যালেঞ্জের। যেকোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে মাথা সম্পূর্ণ ঠান্ডা রেখে সামলাতে হয়। মানসিকভাবে সব সময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমি সব সময় একটা কথা বলি, একজন নিউজ প্রেজেন্টারকে একটা লোকাল বাসের ড্রাইভারের ভূমিকা পালন করতে হয়। লোকাল বাসের ড্রাইভারকে যেমনিভাবে হরেক রকমের যাত্রীর কথা শুনেও হেলপারের সহযোগিতায় সঠিকভাবে গাড়ি চালাতে হয়, তেমনি প্রেজেন্টারকেও পিসিআরের শত কথা কানে নিয়েও প্রডিউসারের সঠিক দিকনির্দেশনায় টিভি স্টেশন চালাতে হয়। মনে রাখতে হয়, একজন নিউজ প্রেজেন্টার একটি নিউজ বুলেটিনের লাস্ট গেটওয়ে। তাই তাঁকে অনেক সতর্ক থাকতে হয়।
দর্শকদের আগ্রহ ধরে রাখতে আপনি কীভাবে সংবাদ উপস্থাপন করেন?
আমি তো ভাবি, আমি একজন দর্শকের ঘরের লোক। ভাবি নিউজের মাধ্যমে আমি গ্রামের একজন চাষি থেকে শুরু করে দেশের প্রধানের সঙ্গেও নিউজের মাধ্যমে যোগাযোগ করে থাকি। প্রতিটি সংবাদের আলাদা আবেদন আছে। চেষ্টা করি সেটাকে সেভাবেই উপস্থাপনের। দর্শক যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ মনে করে, তেমনি সেভাবেই তার মনোজগতের কথা চিন্তা করে সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা করি।
সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আপনি কতটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেন?
শিশু আর পাগল ছাড়া সবারই নিজস্ব মতাদর্শ আছে। এটা যেমন সঠিক, তেমনি সংবাদিকদেরও নিজস্ব মতাদর্শ থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু পেশাগত দায়িত্ব পালনে তাঁকে শতভাগ সেটি নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। কারণ দর্শক পক্ষপাতদুষ্ট নিউজ প্রেজেন্টার কিংবা সাংবাদিক কাউকেই পছন্দ করেন না। সচেতন দর্শকও চান না তাঁর দলের হয়ে সাংবাদিক কথা বলুক। তিনিও চান সাংবাদিক তাঁর নিউজে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখুক। তাই এসব ব্যাপার মাথায় রেখেই আমাদের চলতে হয়।
যারা ভবিষ্যতে সংবাদ উপস্থাপক হতে চান, তাঁদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
অধ্যবসায়ের কোনো বিকল্প নেই। আমার মনে আছে, যখন থেকে সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য মনস্থির করেছি, তখন রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও নিউজের লিংক পড়তাম। চেষ্টা করতাম কতটা হৃদয়গ্রাহী করে একটা সংবাদ উপস্থাপন করা যায়। তাই আমার কাছে মনে হয়, সঠিক রাস্তা চিনে লেগে থাকতে পারলে সফলতা আসবেই। সেটা ভিন্নভাবে হলেও। তবে পরিশ্রম কখনো বৃথা যায় না। সেটা কোনো না কোনোভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কোন গুণ বা দক্ষতা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন?
সবার আগে এটাকে পেশা হিসেবে নিতে মনস্থির করা। শখের বসে নয়। আপনাকে কোনো একটি পেশায় টিকে থাকতে হলে সে পেশার উপযোগী যত গুণ আছে, সেগুলো রপ্ত করার চেষ্টা করতে হবে। যেমন নিজের উচ্চারণ ঠিক রাখ, আঞ্চলিকতা পরিহার করা। সর্বোপরি নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
২২ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৪ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’। আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশে প্যানোরামা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছে বর্ষণ অভিনীত দুটি সিনেমা। ইমতিয়াজ বর্ষণের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শিহাব আহমেদ।
শিহাব আহমেদ

দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ওয়েব ফিল্ম অমীমাংসিত। কেমন লাগছে?
আমরা অভিনয়শিল্পীরা কাজ করি দর্শকের জন্য। সেই কাজটা অনেক দিন আটকে থাকা অবশ্যই কষ্টের। অবশেষে ওয়েব ফিল্মটি দর্শক দেখতে পারবেন, এটাই সবচেয়ে ভালো লাগার। সিনেমাটিতে রহস্যের গন্ধ রয়েছে। রহস্যজনকভাবে কে বা কারা খুন করেছে, এর প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। এটি বানিয়েছেন রায়হান রাফী। ভিজ্যুয়াল লুকেও দর্শক নতুনত্ব পাবেন।
ওটিটি কনটেন্ট হওয়ার পরেও গত বছর তৎকালীন সেন্সর বোর্ড আটকে দিয়েছিল সিনেমাটি। অনেকেই বলছেন এটি নির্মিত হয়েছে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে। আপনিও কি মনে করেন এই কারণেই এটি আটকে দেওয়া হয়েছিল?
একদম তাই। সবাই যেটা ধারণা করেছে, সেই কারণেই সিনেমাটি এত দিন আটকে ছিল। তৎকালীন সেন্সর বোর্ড গল্পটি সেনসেটিভ ভেবে সিনেমাটি আটকে দিয়েছিল। মুক্তির আগে এর বেশি এখন বলতে চাই না।
এটা নিয়ে প্রথম থেকেই অনেক আলোচনা। দর্শকেরও আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন?
প্রতিটি কাজই শিল্পী ও নির্মাতাদের একধরনের প্রেশার ক্রিয়েট করে। আমি নিজেও যেকোনো কাজ মুক্তির আগে চাপ অনুভব করি। দর্শক কীভাবে নেবেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। আমরা তো আসলে দর্শকদের ভালো লাগার জন্য, তাঁদের বিনোদন দেওয়ার জন্য কাজ করি। দর্শকের সন্তুষ্টি আমাদের জন্য আশীর্বাদ। অভিনেতা হিসেবে সব সময় আশা রাখি আমার কাজটি যেন দর্শকের ভালো লাগে, গুণে মানে যেন সবার মনঃপূত হয়।
ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহেও আপনার সিনেমা মুক্তি পাচ্ছে। সেই সিনেমা নিয়ে কিছু বলুন।
‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’ নামের সিনেমাটি বানিয়েছেন আহমেদ হাসান সানি। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন, এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের গল্প নিয়ে সিনেমা। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ফুটে উঠেছে রাজনীতি নিয়ে মানুষের ভাবনা। আমাদের দেশে অনেক রেস্টুরেন্ট বা আড্ডার স্থানে লেখা থাকে এখানে রাজনৈতিক আলাপ নিষিদ্ধ বা করা যাবে না। আমি মনে করি, এটা মিস কনসেপ্ট। রাজনৈতিক আলাপ প্রতিটি জায়গায় হওয়া উচিত। কারণ, আমরা কেউ রাজনীতির বাইরে নই। প্রতিটি মানুষ রাজনীতির অংশ। সেটা সচেতনভাবে হোক কিংবা অসচেতনভাবে। যারা সচেতন, তারা একটু দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সক্রিয় থাকে। কিন্তু যারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন বা কেয়ারলেস, তাদেরও একটা ভূমিকা থাকে।
এটা আহমেদ হাসান সানির প্রথম সিনেমা। নির্মাতা হিসেবে কেমন লাগল তাঁকে?
এর আগে আহমেদ হাসান সানির নির্দেশনায় বিজ্ঞাপনে কাজ করেছি। তবে নির্মাতা হিসেবে আগে থেকেই তাঁকে চিনি। উনি একজন আধুনিক নির্মাতা, তাঁর ভাবনাও আধুনিক। ছোটখাটো বিষয়েও সমান খেয়াল রাখেন তিনি। চিত্রনাট্য, অ্যাক্টিং, সেট—সব ব্যাপারেই তিনি খুঁতখুঁতে। এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি সিনেমাটি দেখার সময় দর্শক তাঁর যত্নের ছাপ দেখতে পাবেন। আমি বিশ্বাস করি, ওনার কাছ থেকে ভালো মানের আরও কাজ পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি ছাড়পত্র পেয়েছে আপনার আরেক সিনেমা ‘যাপিত জীবন’। সেই সিনেমার গল্প কী নিয়ে?
এটি একটি পিরিয়ডিকাল সিনেমা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে গল্প। এই সিনেমায় আরও অভিনয় করেছেন আফজাল হোসেন, রোকেয়া প্রাচী, আশনা হাবিব ভাবনা প্রমুখ। পরিচালনা করেছেন হাবিবুল ইসলাম হাবিব।
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি এবং যাপিত জীবন সিনেমা দুটি ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে প্রদর্শিত হবে। কেমন অনুভূতি?
২০২০ সাল থেকে প্রায় প্রতিবছর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে আমার কোনো না কোনো সিনেমা প্রদর্শিত হয়। এটা আমার জন্য আনন্দের ও গর্বের। এ বছর দুটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ প্যানোরামা বিভাগে। শুনছি দুটি সিনেমাই ডিসেম্বরে মুক্তি পাবে। এটা নিয়ে আমার আপত্তি আছে। ভিন্ন সময়ে সিনেমা দুটি মুক্তি পেলে ভালো হতো।
সিনেমা মুক্তি নিয়ে এই আপত্তির কথা জানিয়েছেন নির্মাতাদের?
এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি নিয়ে নির্মাতার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ওনারা সিনেমার মুক্তি ও প্রমোশন নিয়ে তাঁদের পরিকল্পনার কথা আমাকে জানিয়েছেন। যাপিত জীবন নিয়ে আমি অফিশিয়ালি এখনো কিছু জানি না। তাই কথা হয়নি।
‘রবি ইন ঢাকা’ নামের সিনেমার শুটিং করছেন। এ সিনেমাটি নিয়ে বলুন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সিনেমার শুটিং শিডিউল আছে। এরপর একটা বিরতি নিয়ে শুরু হবে পরের লটের শুটিং। এই সিনেমার গল্পটিও সমকালীন। নতুন প্রজন্মের কথা আছে। আসলে আমরা যেই সময়েই বসবাস করি না কেন, দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ-বেদনা আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। এই শহরে অনেক মানুষ দেখি যাদের দূর থেকে দেখলে মনে হয় সুখে আছে। কিন্তু আসলে তাদের ভেতরে অনেক কষ্ট। নানা ধরনের কষ্টের মাঝেও আমরা এই শহরে আনন্দ খুঁজে বেড়াই। এমন একটা গল্প নিয়েই রবি ইন ঢাকা। গল্পে মিস্ট্রি আছে, সাসপেন্সও আছে। পরিচালনা করছেন রাজীব সালেহীন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
২২ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৪ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৭ দিন আগে
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়।
১৫ নভেম্বর ২০২৫
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়েছেন ইউসুফ ইবনে কামাল নিলয়। গত ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির ৩৭তম সমাবর্তনে এমন সাফল্যের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে ওআইসি স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। নিলয় বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি নিজের অসামান্য কৃতিত্বের নেপথ্যের গল্প জানিয়েছেন আজকের পত্রিকাকে। তার কথাগুলো শুনেছেন ইলিয়াস শান্ত।
ইলিয়াস শান্ত

গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।
গত ২৭ অক্টোবর আইইউটির ৩৭ তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আপনি এতে অংশ নিয়েছেন। আপনার বিভাগ ও ফলাফল সম্পর্কে বলুন।
কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগ থেকে আমি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। প্রথম সেমিস্টারে একটি কোর্সে এ+ পাইনি। তাই সেই সেমিস্টারে আমার জিপিএ ছিল ৩.৯৭। তবে এরপরের সাতটি সেমিস্টারেই আমি ধারাবাহিকভাবে ৪.০০ পেয়েছি।
দ্বিতীয় সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর আমার সিজিপিএ দাঁড়ায় ৩.৯৮। তৃতীয় সেমিস্টারের পর হয় ৩.৯৯। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ সেমিস্টারে ৪ ধরে রাখতে পারলেও সিজিপিএ তখনও ৩.৯৯ ছিল। শেষ পর্যন্ত সপ্তম সেমিস্টারে ৪ পাওয়ার পর সিজিপিএ অবশেষে ৪–এ পৌঁছায়। তখন সত্যিই আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। এরপর শেষ বা অষ্টম সেমিস্টারেও একই পারফরম্যান্স ধরে রাখার চেষ্টা করি। আলহামদুলিল্লাহ সেটাও সম্ভব হয়। ফলে আমি সিজিপিএ ৪ নিয়ে স্নাতক সম্পন্ন করতে পেরেছি।
এমন সাফল্যের কৃতিত্ব কাকে দিতে চান?
সবার আগে আমি আমার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি। তারা সবসময় আমার পাশে থেকেছে। প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এরপর আমার শিক্ষকদের কথা, যাদের দিকনির্দেশনা ও আন্তরিক সহযোগিতা আমাকে প্রতিটি ধাপে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। আর আমার বন্ধুদের কথাও বলতে হবে। এই চার বছরের যাত্রায় আমার বন্ধুরা সবসময় পাশে থেকেছে–কখনো সহায়তায়, কখনো বা মোটিভেশনে। সবার সম্মিলিত সহযোগিতা আর আমার প্রচেষ্টায় এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে।
আপনার বড় বোনের কথা শুনেছি। তাঁর অবদান কতটুকু?
হ্যাঁ, আমার দুজন বড় বোন আছেন। একজন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন। অন্যজন আইইউটির ছাত্রী ছিলেন। তিনি আইইউটির ১৭ তম ব্যাচের বিজনেস টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি শুরু থেকেই আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণার একজন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি আমাকে পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস থাকতে উৎসাহ দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি আমাকে বোঝাতেন নিয়মিত উপস্থিতি বজায় রাখা, কুইজ ও মিডটার্মের মতো মূল্যায়নগুলো গুরুত্ব সহকারে দেওয়া কতটা জরুরি। এগুলোই আসলে একটি ভালো ফলের ভিত্তি তৈরি করেছে। তার দেওয়া পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা আমার পুরো চার বছরের যাত্রায় দারুণভাবে কাজে দিয়েছে।
স্বর্ণপদক পাওয়ার খবরে আপনার বাবা–মা কী বলেছিলেন?
তারা উভয়েই খুব খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের মুখে আনন্দের হাসিটা দেখে মনে হয়েছিল, এই মুহূর্তের জন্যই হয়তো তারা এত বছর ধরে পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে এসেছেন। আমার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার। জীবনে তিনি সবসময় নিয়ম, অধ্যবসায় আর সততার মূল্য শিখিয়েছেন। আর মা একজন গৃহিণী। মা আমাদের পরিবারের মূল শক্তি। ছোটবেলা থেকেই তিনি আমাদেরকে শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারূপ করেছেন। সবসময় পাশে থেকেছেন, কখনো ক্লান্ত হননি।
এমন অসামান্য ফলাফল অর্জনে নিজেকে কীভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, পড়ালেখার ধরন কেমন ছিল?
প্রথম থেকেই আমি জানতাম সিএসই এমন একটি বিষয়, যেখানে ধারাবাহিক পরিশ্রম ও মনোযোগ ছাড়া ভালো ফল করা সম্ভব নয়। যেহেতু ভর্তি হওয়ার আগে আমার কোডিং নিয়ে তেমন কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আমি নিজের ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা শুরু করেছি। ইউটিউবে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল দেখে প্রোগ্রামিংয়ের বেসিকগুলো ভালোভাবে আয়ত্ত্ব করে নিয়েছি। আর সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে ধীরে ধীরে নিজের দক্ষতা বাড়িয়েছি।
আমার পড়ালেখার ধরনটা ছিল বেশ দলভিত্তিক। আমি সবসময় বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ স্টাডি করতাম। এতে করে অনেক কঠিন বিষয় সহজে বোঝা যেত। আর কাউকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলতে গিয়ে নিজের বোঝাটাও আরও মজবুত হতো। এই সহযোগিতামূলক পরিবেশটাই আসলে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমি ক্লাসের উপস্থিতি, কুইজ ও মিডটার্ম পরীক্ষাগুলোতে বেশ গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ এগুলোই মূলত চূড়ান্ত ফলে বড় ভূমিকা রাখে। সিনিয়র ভাইদের তৈরি করা নোটগুলোও অনেক সময় কাজে দিয়েছে, বিশেষ করে প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে। সবশেষে, প্রতিটি প্রজেক্টও আমি সমান গুরুত্ব দিয়ে করতাম। যেন শুধু নম্বরের জন্য নয়, শেখার জন্যও কাজটা সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়।
সিজিপিএ–৪ এর মধ্যে ৪ পেয়ে আপনি এখন গ্র্যাজুয়েট। আপনি ওআইসি স্বর্ণপদক পেয়েছেন। অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে প্রস্তুতি নিলে এমন ফল করতে পারতেন, তাদের প্রস্তুতির কোন কোন জায়গায় ঘাটতি ছিল বলে মনে হয়?
আসলে প্রত্যেকের পড়ার ধরনটা আলাদা হয়। এখানে যে ধরন একজনের জন্য সবচেয়ে কার্যকর, সেটা অন্য কারও জন্য নাও হতে পারে। তাই একেবারে নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন যে, কে কীভাবে পড়লে এমন ফল করতে পারতেন। তবুও আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কয়েকটা জিনিস নিয়মিতভাবে মেনে চললে ভালো ফলাফল পাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে আগে, ক্লাসের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তারপর কুইজ আর মিডটার্ম। অনেকে এগুলোকে হালকাভাবে নেন। আমি মনে করি ফলাফলে এগুলোই আসলে মূল ভিত্তি তৈরি করে দেয়। যদি আগে থেকেই কুইজ ও মিডটার্মে ভালো করা যায়, তাহলে ফাইনাল পরীক্ষার সময় চাপ অনেকটাই কমে যায়। আমার গ্রুপ স্টাডির কথা তো আগেই বলেছি। গ্রুপ স্টাডি শেখার পরিবেশটাকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে। কেউ নির্দিষ্ট কোনো বিষয় না বুঝলে অন্য সেটা কেউ বুঝিয়ে দিতে পারছে। এতে পারস্পরিকভাবে সবারই উপকার হয়।
আপনার শৈশব, মাধ্যমিক–উচ্চ মাধ্যমিক ও পরিবার সম্পর্কে জানতে চাই।
আমাদের পারিবারিক শেকড় বরিশালে। তবে আমার শৈশবের একটা অংশ কেটেছে ফরিদপুরে। সেখানে আমি সানরাইজ স্কুলে পড়ালেখা করেছি। পরে পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসি। উত্তরায় আসার পর আমি ক্লাস ৩–৫ শ্রেণি পর্যন্ত মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পড়েছি। এরপর ৬–৯ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে। পরবর্তীতে আমি আবার মাইলস্টোন কলেজে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে মাধ্যমিক সম্পন্ন করি। নটর ডেম কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেছি। এখানে আমার কলেজ জীবনের সুন্দর দুইটি বছর কেটেছে।
ছোটবেলায় আপনার কি হওয়ার স্বপ্ন ছিল?
ছোটবেলায় আকাশে প্লেন উড়তে দেখলেই মনে হতো, ‘ইশ! একদিন যদি আমিও এমন করে উড়তে পারতাম!’ তখন পাইলট হওয়ার স্বপ্নটাই ছিল সবচেয়ে বড়। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, আর বাস্তবতা একটু একটু করে বুঝতে শুরু করার পর সেই স্বপ্নটা বদলে গেছে। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। এখন আমার স্বপ্ন একটু অন্যরকম।
পরবর্তী লক্ষ্য কী, কেমন জব অফার পাচ্ছেন?
এখন আমার মূল লক্ষ্য হলো আইইউটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করা। এজন্যই আমি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করছি। যাতে ক্লাসে পড়ানো এবং গবেষণার কাজ–দুটোই ভালোভাবে করতে পারি। একইসঙ্গে গবেষণার মাধ্যমে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে চাই। শেখা আর শেখানোর এই প্রক্রিয়াটার ভেতরেই আমি এখন সবচেয়ে বেশি আনন্দ খুঁজে পাই। দূরদৃষ্টি হিসেবে আমার আরও বড় লক্ষ্য হলো–ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা, বিশেষ করে পিএইচডি করা। আমি গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বিষয় জানা ও শেখার সুযোগকে আরও প্রসারিত করতে চাই। আমার বিশ্বাস, এই প্রচেষ্টা আমাদের শিক্ষার্থীদের কাজে দেবে।
আইইউটিতে ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আগ্রহীদের কোন কোন বিষয়গুলো বেশি বিবেচনায় নেওয়া হয়?
আমার জানা মতে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়কে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো: একাডেমিক রেজাল্ট, অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং পূর্ববর্তী ফলাফল। এছাড়া গবেষণার অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতেও গুরুত্ব দেওয়া হয়।
দেশের বাস্তবতায় সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির সুযোগ কেমন?
বর্তমান বাজারে সিএসই গ্র্যাজুয়েটদের জন্য চাকরি সুযোগ খুবই প্রশস্ত। তবে এতে প্রতিযোগিতা রয়েছে। আমি বলবো, প্রয়োজনীয় দক্ষতা থাকলে চাকরি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। আমার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা তাদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই চাকরি পেয়ে গেছেন। এটা আইইউটির ঐতিহ্য। আইইউটি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই চাকরির অফার পাওয়ার বেশ নজির আছে। এটা ভালো একাডেমিক পরিবেশ, যুগোপযোগী সিলেবাস এবং শিক্ষার্থীদের প্রচেষ্টার কারণে সম্ভব হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি এন্ট্রি লেভেলের চাকরির জন্যেও আইইউটি গ্র্যাজুয়েটদের ভালো বেতন অফার করে থাকে।
উচ্চশিক্ষার জন্য আপনি আইইউটিকে কেন বেছে নিয়েছিলেন?
কলেজ লাইফ শুরুর আগে আমার স্বপ্ন ছিল বুয়েটে পড়ার। তবে তখনো নির্দিষ্ট করে ভাবিনি কোন বিষয়ে পড়বো। এইচএসসির পর আইইউটিতে পরীক্ষা দিয়ে সিএসই বিভাগে চান্স পাই। এরপর বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায়ও সাফল্য আসে। সেখানে পেয়েছিলাম ইইই বিভাগ। কিন্তু ততদিন বুয়েটের ক্লাস শুরু করতে করতে আইইউটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারের বেশিরভাগ সময় পার যায়। ওই সময়টায় আমি উপলব্ধি করি, কম্পিউটার সায়েন্সের প্রতি আমার গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি এতে ভালোও করছি। আইইউটির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এখানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো দীর্ঘ সেশনজট নেই। তাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করা যায়। একাডেমিক জীবনটা অনেক বেশি সুসংগঠিত থাকে। সবমিলিয়ে আমি বুঝতে পারি, একটি বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একটি অনুকূল একাডেমিক পরিবেশই সর্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তাই বুয়েটের ইইই–এর পরিবর্তে আইইউটির সিএসইতে স্থির হয়ে যাই।
স্নাতকের পুরো জার্নিতে পড়ালেখার পাশাপাশি আপনি আর কি কি করেছিলেন?
পড়ালেখার পাশাপাশি আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছি। নতুন নতুন জায়গা ঘুরে দেখেছি। মাঝে মাঝে ফুটবল, ক্যারমের মতো খেলা খেলেছি। এছাড়া কম্পিউটারে গেমও খেলেছি। পড়ালেখার পাশাপাশি কিছু সময় টিউশনি করেছি। যা নিজের ধারণাকে পরিষ্কার করতে এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে সহায়ক হয়েছে।
সিএসই নিয়ে পড়তে আসা নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি আপনার কি বার্তা থাকবে?
নিজেকে শুধুমাত্র একাডেমিক সিলেবাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে না। প্রথম থেকেই নিজের মধ্যে বাড়তি শেখার আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। কোড ফোর্স, হ্যাকার র্যাঙ্ক–এর মতো প্ল্যাটফর্মের কনটেস্টে নিয়মিত অংশ নিতে হবে। এ ছাড়া কম্পেটিটিভ প্রোগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিলে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি যুক্তির গভীরতাও শাণিত হবে। ইউটিউবেও পছন্দের বিষয়গুলোর অসংখ্য টিউটোরিয়াল রয়েছে। সেগুলো কাজে লাগিয়ে শেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মনে রাখতে হবে, চাকরির ক্ষেত্রে যে স্কিলগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে, তা অনেক সময় একাডেমিক পড়ালেখার চেয়ে কিছুটা আলাদা। একাডেমিক প্রোজেক্টগুলোও কখনই হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। এগুলো যতটা সম্ভব ভালোভাবে করতে হবে। কারণ ভবিষ্যতে সেগুলোই সিভিতে স্থান করবে এবং দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকার জন্যেও শুভকামনা রইলো।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন। দীর্ঘ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। বর্তমানে বিভাগটির ইমেরিটাস অধ্যাপক। মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ অধ্যাপক চৌধুরী নতুন দিগন্ত পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।
২২ জুন ২০২৫
নাট্যদল বিবেকানন্দ থিয়েটারের ২৫তম প্রযোজনা ‘ভাসানে উজান’। গত নভেম্বরে মঞ্চে এসেছে নাটকটি। ২৯ ডিসেম্বর রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হবে নাটকটির চতুর্থ প্রদর্শনী। অপূর্ব কুমার কুণ্ডুর নাট্যরূপ এবং শুভাশীষ দত্ত তন্ময়ের নির্দেশনায় একক অভিনয় করেছেন মো. এরশাদ হাসান।
৪ দিন আগে
টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা ভিশনের জনপ্রিয় সংবাদ উপস্থাপক মামুন আব্দুল্লাহর সাবলীল উপস্থাপনার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ অনুশীলন, দক্ষতা ও অবিচল আত্মবিশ্বাস। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে সংবাদ উপস্থাপনার কৌশল, লাইভ সম্প্রচারের চাপ সামলানোর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ পেশায় আগ্রহীদের জন্য মূল্যবান পরামর্শ।
১৭ দিন আগে
দীর্ঘদিন আটকে থাকার পর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘অমীমাংসিত’ ওয়েব ফিল্মের মুক্তির ঘোষণা এসেছে। ৪ ডিসেম্বর ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইস্ক্রিনে মুক্তি পাবে সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছেন ইমতিয়াজ বর্ষণ। এ ছাড়া আসছে ডিসেম্বরে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাবে তাঁর অভিনীত ‘এখানে রাজনৈতিক আলাপ জরুরি’।
০১ ডিসেম্বর ২০২৫