Ajker Patrika

গাজায় রমজান: ধ্বংসস্তূপের মাঝে বিশ্বাসে অবিচল

শুরু হয়েছে পবিত্র রমজান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মতো ইসরায়েলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার মানুষেরাও শুরু করেছেন রোজা। তবে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের মানুষ যতটা উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে রমজান শুরু করেছেন, শোকাহত গাজাবাসীর সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কোনো কমতি নেই। গাজাবাসীর রমজান ও বিশ্বাসের বিষয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় লিখেছেন ফিলিস্তিনি লেখিকা ইসরা আবু ক্বামার।

ধ্বংসস্তূপের মাঝে সদ্য পরিষ্কার করা রাস্তায় লম্বা টেবিল ফেলা হয়েছে। যেখানে আজানের অপেক্ষা করছেন গাজার পুরুষেরা। ছবি: এএফপি
ধ্বংসস্তূপের মাঝে সদ্য পরিষ্কার করা রাস্তায় লম্বা টেবিল ফেলা হয়েছে। যেখানে আজানের অপেক্ষা করছেন গাজার পুরুষেরা। ছবি: এএফপি

বিশ্বের অন্য প্রান্তে যখন মানুষ উৎসবের আবহে রমজানের রোজা ও ইবাদত শুরু করছে, তখন আমরা তা করছি শোক ও বেদনার মধ্যে। যুদ্ধের আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, কেউ জানে না। সবাই উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবারই আশঙ্কা—যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!

গত এক বছরে আমরা যা দেখেছি, যা সহ্য করেছি, তার স্মৃতি ও ট্রমা আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে রেখেছে। তবে এটি প্রথম নয় যে, আমরা যুদ্ধের মধ্যে রমজান পালন করছি। ২০১৪ সালেও যুদ্ধ চলাকালে রমজান কেটেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র ৯ বছর। তবুও স্পষ্ট মনে আছে, কীভাবে সেসময় বিমান হামলা আর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আমাদের রমজানের রাতগুলো কেটেছিল। স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পাড়ায় বোমা বর্ষণের সময় কীভাবে আমরা অন্ধকারের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম।

কিন্তু গত বছরের রমজান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা ছিল অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। চারপাশে শুধুই ক্ষুধা। সারা দিন উপবাস থেকে ইফতার করতাম এক ক্যান হামুস বা মটরশুঁটি দিয়ে। এইটুকু খাবারও খেতাম ছয়জন মিলে ভাগ করে। বিদ্যুৎ না থাকায় সেই বিস্বাদ টিনজাত খাবার অন্ধকারে চিবিয়ে খেতাম। টেবিলের ওপারে থাকা পরিবারের সদস্যদের মুখও দেখতে পেতাম না।

আমরা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের থেকেও দূরে ছিলাম। যাদের সঙ্গে আগে রমজান কাটাতাম—আমার দাদি, খালা, ফুফু, চাচাতো-খালাতো ভাইবোনরা—সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছিল। কেউ আশ্রয়শিবিরের তাঁবুতে, কেউ আটকে ছিল উত্তরে। যে মাসটি একত্রিত হওয়ার, তা আমাদের জন্য হয়ে উঠেছিল বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার মাস।

আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল রমজানের আনন্দময় আবহ। আমরা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করতাম মাগরিবের আজানের জন্য, ফজরের আজানের জন্য—কিন্তু সেই ডাক কখনো শোনা যেত না। সব মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যারা আজান দিতে চেয়েছিল, তারাও ভয় পেয়েছিল। ভয় ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর হয়তো বোমার নিশানা বানিয়ে দেবে, তারা হয়তো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।

কাছের মসজিদের লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনার বদলে আমরা ইফতার করতাম ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ আর গোলাগুলির শব্দে। যুদ্ধের আগে, ইফতারের পর পরিবারের সঙ্গে মসজিদে যেতাম নামাজ পড়তে, আপনজনদের সঙ্গে দেখা করতে। তারপর গাজার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতাম, রমজানের প্রাণবন্ত পরিবেশ উপভোগ করতাম, শেষে বাড়ি ফিরে তাজা কাতায়েফ খেতাম। কিন্তু গত বছর, গণহত্যার মধ্যে, আমাদের কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না।

গাজার সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর একটি—গ্রেট ওমরি মসজিদ, যেখানে আমার বাবা ও ভাইয়েরা রমজানের শেষ দশ রাত কাটাতেন, যেখানে কোরআন তিলাওয়াত হতো সুমধুর কণ্ঠে—সেটাও ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। যে স্থান একসময় ছিল ইবাদত ও শান্তির প্রতীক, তা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।

এ বছরের রমজান শুরু হচ্ছে যুদ্ধবিরতির মধ্যে। ইফতারের সময় আর বোমার আঘাতে জমিন কাঁপে না। ফজরের নীরবতা ভেঙে আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় না। এখন অন্তত এই ভয় নেই যে, ঘর সাজানোর রঙিন বাতি ঘরগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেবে।

ব্যথা আর বিপর্যয়ের মাঝেও গাজার রাস্তায় জীবন ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট এখনো টিকে আছে, সেগুলো আবার খুলেছে। ফেরিওয়ালারাও ফিরে এসেছে। নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট হাইপার মল আবার চালু হয়েছে। রমজানের আগে আমার বাবা আমাকে ও আমার বোনকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলোকিত মলে ঢুকে আমরা উচ্ছ্বাস সামলাতে পারছিলাম না। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, যেন আমরা অতীতে ফিরে গিয়েছি। তাকাগুলো আবার ভরে গিয়েছে—চকোলেট, বিস্কুট, চিপসের নানা ব্র্যান্ডে। ছিল রমজানের সাজসজ্জা, নানা আকৃতির ফানুস, খেজুরের বাক্স, রঙিন শুকনো ফল আর ক্বমর আল-দিন।

কিন্তু এই প্রাচুর্য বিভ্রমমাত্র। দোকানপাটে যা কিছু রয়েছে, তার বেশির ভাগই এসেছে বাণিজ্যিক ট্রাকে, যা মানবিক সাহায্যের পরিবর্তে গাজায় ঢোকার অনুমতি পেয়েছে। অথচ এসব পণ্য অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে—যারা তাদের জীবন ও জীবিকা হারিয়েছে।

তাহলে গাজার বেশির ভাগ মানুষ এবার ইফতারে কী খাবে? হয়তো টিনজাত খাবারের চেয়ে একটু ভালো কিছু—একটা সাধারণ খাবার, হয়তো ভাত, মোলোখিয়া বা যতটুকু সবজি তারা কিনতে পারবে।

আমাদের পরিবারের জন্য প্রথম ইফতারে থাকছে মুসাখান—পালংশাকের রুটি, মুরগি ও প্রচুর পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি এক ফিলিস্তিনি খাবার। আমরা জানি, আমরা ভাগ্যবান। গাজার বেশির ভাগ মানুষ সেই মুরগিও কিনতে পারবে না, যা এখন বাজারে পাওয়া গেলেও যুদ্ধের আগে দামের দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

কিন্তু খাবারই একমাত্র জিনিস নয়, যা এ বছরের রমজানের টেবিল থেকে হারিয়ে যাবে। যুদ্ধের এই সময়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারি তালিকা থেকে তাদের নামই মুছে গেছে। তারা আর কখনো রমজান পালন করবে না।

অসংখ্য ইফতার টেবিলে থাকবে এক শূন্য আসন—একজন বাবা, যার কণ্ঠে আর শোনা যাবে না সন্তানদের ডাক; এক ছেলে, যে আর অধীর আগ্রহে ইফতারের অপেক্ষা করবে না; এক মা, যার হাতে আর কখনো তৈরি হবে সুস্বাদু খাবার।

আমিও আমার প্রিয় মানুষদের হারিয়েছি। আমার খালার স্বামী, যিনি প্রতি বছর আমাদের ইফতারে ডাকতেন, তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার বন্ধু শাইমা, লিনা আর রোয়া—যাদের সঙ্গে আমি তারাবির নামাজের পর মসজিদে দেখা করতাম—তাঁরা সবাই শহীদ হয়েছে।

উৎসবের আমেজ হয়তো নেই, কিন্তু রমজানের মূল সত্তা টিকে আছে। এই মাস আমাদের জীবনের অন্যান্য ব্যস্ততা ও চিন্তা থেকে দূরে সরে গিয়ে ইমানের সঙ্গে সংযোগ করার সুযোগ দেয়। এটি ক্ষমার সময়। এটি আল্লাহর কাছে ঘনিষ্ঠতা ও আধ্যাত্মিক ধৈর্য খোঁজার মাস।

আমাদের মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস ভাঙেনি। আমরা এখনো ধ্বংসস্তূপে, তাঁবুর নিচে তারাবির নামাজ পড়ব। আমরা আমাদের সব আশা নিয়ে দু’আ করব, কোরআন তিলাওয়াতে সান্ত্বনা খুঁজব, এই বিশ্বাস নিয়ে যে, আমাদের সব কষ্টের প্রতিদান আল্লাহ দেবেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইয়েমেন সংঘাতে মুখোমুখি অবস্থানে সৌদি ও আরব আমিরাত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯: ৪৬
আমিরাত সমর্থিত ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’-এর সৈন্যরা। ছবি: দ্য টাইমস
আমিরাত সমর্থিত ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’-এর সৈন্যরা। ছবি: দ্য টাইমস

ইয়েমেনের দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতে এবার নতুন মাত্রার উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। এক সময় একই জোটে থাকা সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন কার্যত বিপরীত অবস্থানে। সাম্প্রতিক বিমান হামলা ও কূটনৈতিক বক্তব্যে এই বিভাজন প্রকাশ্যে এসেছে, যা ওই অঞ্চলের যুদ্ধকে আরও জটিল করে তুলছে।

যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ইনডিপেনডেন্ট জানিয়েছে, মঙ্গলবার ভোরে সৌদি আরব ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। এই হামলার লক্ষ্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত–সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল’ (এসটিসি)।

সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের দাবি—হাদরামাউতের বন্দরনগরী মুকাল্লায় এসটিসির জন্য অস্ত্র ও সাঁজোয়া যান নামানো হচ্ছিল, যা তাদের ‘সীমারেখা’ অতিক্রমের সমান। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাহাজগুলোর ট্র্যাকিং সিস্টেম বন্ধ ছিল এবং এসব অস্ত্র তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করছিল।

অন্যদিকে, এসটিসি এই হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের দাবি, হামলায় হাদরামাউতে মোতায়েন এসটিসির অভিজাত ইউনিটগুলোকে লক্ষ্য করা হয়েছে। যদিও সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, রাতের আঁধারে হামলা চালানো হয়েছে যাতে বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি না হয়।

এই সংঘর্ষ সৌদি আরব ও ইউএইর মধ্যে বাড়তে থাকা মতবিরোধকে প্রকাশ্যে এনেছে। হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন একসঙ্গে লড়াই করলেও, ইয়েমেনের ভেতরে দুই দেশ ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে আসছে। সৌদি আরবের অভিযোগ, এসটিসিকে আমিরাতের সমর্থন ইয়েমেন ও পুরো অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। রিয়াদ একে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি হিসেবেও উল্লেখ করেছে।

এই উত্তেজনার মধ্যেই ইয়েমেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের প্রেসিডেনশিয়াল লিডারশিপ কাউন্সিলের প্রধান রাশাদ আল-আলিমি আরব আমিরাতের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি বাতিল করেন এবং দেশটি থেকে আমিরাতের সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি সাময়িক সময়ের জন্য আকাশ ও নৌ অবরোধও ঘোষণা করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ ইয়েমেনে এসটিসির দ্রুত সম্প্রসারণ দেশটিকে কার্যত বিভক্ত করার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দক্ষিণে গুরুত্বপূর্ণ তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল ও বন্দর, আর উত্তরে রাজধানী সানাসহ হুতিদের শক্ত ঘাঁটি—এই বাস্তবতায় ইয়েমেন আবারও এক গভীর ও বহুমাত্রিক সংকটের দিকে এগোচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘২০২৫’ নিয়ে ১৯৯৮ সালে করা আমেরিকানদের ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু মিলেছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০০: ৫৭
ছবি: সিএনএন
ছবি: সিএনএন

১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজ বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। সেই বছর প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন অভিশংসন প্রক্রিয়ার মুখে পড়েছিলেন, অস্কারে রাজত্ব করেছিল টাইটানিক, আর অধিকাংশ আমেরিকানের ঘরে ছিল ল্যান্ডলাইন ফোন। ঠিক সেই সময়েই গ্যালাপ ও ইউএসএ টুডে এক ব্যতিক্রমী জরিপ চালায়। ল্যান্ডলাইন ফোনে ১ হাজার ৫৫ জন আমেরিকানের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাওয়া হয়—দূর ভবিষ্যৎ ‘২০২৫ সাল’ কেমন হবে বলে তাঁরা মনে করেন।

সোমবার (২৯ ডিসেম্বর) সিএনএন জানিয়েছে, ২০২৫ সাল নিয়ে সে সময় মার্কিনরা যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো করেছিল, সেগুলো সংরক্ষিত আছে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোপার সেন্টারের জরিপ আর্কাইভে। ২০২৫ সালের শেষ প্রান্তে এসে এখন দেখা যাচ্ছে—সেই সব অনুমানের কোনোটা মিলেছে, আর কোনোটা মেলেনি।

এ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেই সময়ের অনেক পূর্বাভাসই ছিল বিস্ময়করভাবে সঠিক। অধিকাংশ আমেরিকান তখনই ধারণা করেছিলেন, আগামী ২৭ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন, সমকামী বিবাহ বৈধ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে এবং একটি ‘মারাত্মক নতুন রোগ’ বিশ্বকে নাড়িয়ে দেবে। বাস্তবে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়া, সমকামী বিবাহের আইনি স্বীকৃতি এবং করোনা মহামারি সেই অনুমানগুলোকে সত্য প্রমাণ করেছে।

একইভাবে অনেকেই সেই সময় সঠিকভাবে ধারণা করেছিলেন, সাধারণ মানুষের জন্য মহাকাশ ভ্রমণ খুব সাধারণ বিষয় হয়ে উঠবে না এবং ভিনগ্রহের প্রাণীর সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগাযোগ ঘটবে না।

তবে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র একজন নারী প্রেসিডেন্ট পাবে—যা এখনো ঘটেনি। অর্ধেকের বেশি মানুষ আশা করেছিলেন ক্যানসারের নিরাময় আবিষ্কৃত হবে এবং ৬১ শতাংশ মনে করেছিলেন মানুষ নিয়মিতভাবে ১০০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবে। বাস্তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রগতি হলেও এসব প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

জরিপে দেশের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। সেখানে ফুটে উঠেছিল প্রবল হতাশা। ৭০ শতাংশ মনে করেছিলেন ধনীদের জীবনমান উন্নত হবে, কিন্তু মধ্যবিত্তদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভক্ত মতামত ছিল। দরিদ্রদের জীবন আরও কঠিন হবে—এমনটাই ভাবতেন বেশির ভাগ। প্রায় ৮০ শতাংশ ধারণা করেছিলেন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কমবে, আর ৫৭ শতাংশ মনে করেছিলেন ব্যক্তিগত স্বাধীনতাও হ্রাস পাবে। অপরাধ বৃদ্ধি, পরিবেশের অবনতি এবং নৈতিক মূল্যবোধের পতনের আশঙ্কাও ছিল প্রবল। ৭১ শতাংশ মত দিয়েছিলেন, সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে বড় করা আরও কঠিন হবে।

তবে কিছু আশাবাদী দিকও ছিল। অধিকাংশ আমেরিকান বিশ্বাস করতেন, জাতিগত সম্পর্কের উন্নতি হবে এবং চিকিৎসাসেবা আরও সহজলভ্য হবে—যদিও তা হবে ব্যয়বহুল।

গ্যালাপ আজও জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও এখন ল্যান্ডলাইনের ওপর নির্ভরতা কম। এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে জনমতও নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। ১৯৯৮ সালে যেখানে প্রায় ৬০ শতাংশ আমেরিকান দেশের গতিপথ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন, বর্তমানে সেই হার নেমে এসেছে মাত্র ২৪ শতাংশে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুতিনের বাসভবনে ড্রোন হামলার অভিযোগ—‘মিথ্যা’ বলছে ইউক্রেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪: ২৭
ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি
ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন—এমন অভিযোগ করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার এই দাবিকে পুরোপুরি ‘মিথ্যা ও সাজানো’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই হামলার কারণে চলমান শান্তি আলোচনায় রাশিয়ার অবস্থানের ‘পরিবর্তন বা পুনর্বিবেচনা’ করা হতে পারে। তবে মস্কো এখনই আলোচনা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে না।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন সের্গেই লাভরভের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, গতকাল রোববার রাত থেকে আজ সোমবার ভোর পর্যন্ত পুতিনের বাসভবন লক্ষ্য করে ৯১টি দূরপাল্লার ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। রুশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সবকটি ড্রোন ভূপাতিত করেছে। তবে এতে কোনো হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি।

লাভরভ হুমকি দিয়ে বলেন, ইউক্রেনের এমন হঠকারী কর্মকাণ্ডের জবাব দেওয়া হবে। রুশ সামরিক বাহিনী ইতিমধ্যে পাল্টা হামলার জন্য লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণ করে ফেলেছে। তবে হামলার সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন নোভগোরোদের ওই বাসভবনে ছিলেন কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি।

ফ্লোরিডায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক শেষ করে ইউরোপে ফেরার পথে জেলেনস্কি রাশিয়ার এই দাবিকে নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া আবারও ভয়ংকর সব মিথ্যা বিবৃতি দিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক অগ্রগতির সাফল্য নষ্ট করতেই এমন নাটক সাজানো হচ্ছে। তারা মূলত কিয়েভের সরকারি ভবনগুলোতে বড় ধরনের হামলার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য এই অজুহাত দিচ্ছে।’

জেলেনস্কি জানান, ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার প্রায় ৯০ শতাংশ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যা রাশিয়াকে বিচলিত করে তুলেছে।

এদিকে ক্রেমলিন বলছে, আজ প্রেসিডেন্ট পুতিন টেলিফোনে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এই ড্রোন হামলার বিষয়টি জানিয়েছেন। পুতিন ট্রাম্পকে বলেছেন, এই হামলার পর রাশিয়া তাদের শান্তি আলোচনার শর্তগুলো পুনরায় খতিয়ে দেখবে।

রুশ গণমাধ্যমগুলো ক্রেমলিনের সহকারী ইউরি উশাকভের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এই খবর শুনে ট্রাম্প ‘বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ’ হয়েছেন। তবে হোয়াইট হাউস থেকে এই ফোনালাপকে কেবল ‘ইতিবাচক’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে, বিস্তারিত কিছু জানানো হয়নি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

তাইওয়ানকে ঘিরে ধরেছে চীনের যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান ও ড্রোন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মহড়ায় সরাসরি গুলির অনুশীলনও করা হচ্ছে। ছবি: চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড
মহড়ায় সরাসরি গুলির অনুশীলনও করা হচ্ছে। ছবি: চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড

তাইওয়ানকে ঘিরে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সামরিক মহড়া শুরু করেছে চীন। সোমবার শুরু হওয়া এই মহড়ায় যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও সরাসরি গোলাবর্ষণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ‘জাস্টিস মিশন ২০২৫’ নামের এই অভিযানে তাইওয়ানকে চারদিক থেকে ঘিরে সাতটি সামুদ্রিক অঞ্চলে সমন্বিত স্থল, নৌ ও আকাশ মহড়া চালানো হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি এখন পর্যন্ত তাইওয়ানকে লক্ষ্য করে চীনের সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে আক্রমণাত্মক সামরিক প্রদর্শন।

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় থিয়েটার কমান্ড জানিয়েছে—মহড়ায় স্থল ও সমুদ্রের লক্ষ্যবস্তুর ওপর সিমুলেটেড হামলা, পাশাপাশি তাইওয়ানের প্রধান বন্দরগুলো অবরোধ করার অনুশীলন করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করতে বা চাপের মুখে ফেলতে এই ধরনের অবরোধ ব্যবহৃত হতে পারে বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকেরা। সরাসরি গোলাবর্ষণের মহড়া মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) পর্যন্ত চলবে এবং আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার তাইওয়ানের আরও কাছাকাছি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে।

এই মহড়ার ফলে বেসামরিক বিমান ও নৌ চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। বেশ কয়েকটি এয়ারলাইন তাদের ফ্লাইটের রুট পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে এবং তাইওয়ানের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বিকল্প আকাশপথ ব্যবহারের প্রস্তুতি নিয়েছে। চীনা সামরিক কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এই মহড়া ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতাপন্থী শক্তি’ ও ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবার্তা।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি তাইওয়ানের কাছে ১১.১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যা ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্যাকেজ। এতে রয়েছে ৮২টি হিমার্স রকেট লঞ্চার, ৪২০টি দূরপাল্লার এটিএসিএমএস ক্ষেপণাস্ত্র, স্বচালিত হাউইটজার, উন্নত ড্রোন ব্যবস্থা ও অ্যান্টি-আর্মার অস্ত্র। বেইজিং এই অস্ত্রচুক্তিকে তীব্রভাবে নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এতে তাইওয়ান একটি ‘বারুদের স্তূপে’ পরিণত হচ্ছে।

তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মহড়া চলাকালে তাদের দ্বীপভূমির চারপাশে ৮৯টি চীনা সামরিক বিমান, ১৪টি নৌজাহাজ ও ১৪টি কোস্ট গার্ড জাহাজ শনাক্ত করা হয়েছে। কিছু চীনা জাহাজ তাইওয়ানের উপকূলের খুব কাছাকাছি অবস্থানে এসে চোখ রাঙাচ্ছে। এই প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রেখেছে তাইওয়ান।

চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম জানিয়েছে, মহড়ার মূল লক্ষ্য তাইওয়ানের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর—উত্তরের কিলুং ও দক্ষিণের কাওশিয়ুং বন্ধ করে দেওয়ার সক্ষমতা পরীক্ষা। চীন তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড দাবি করলেও তাইওয়ান বলছে, দ্বীপটির ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার শুধু সেখানকার জনগণেরই আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত