Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /সুদান থেকে যেভাবে পাচার হচ্ছে কোকাকোলা ও দামি চকলেটের মূল উপাদান

আপডেট : ০৫ মার্চ ২০২৫, ১৫: ০৭
গৃহযুদ্ধের কারণে সুদানের গাম অ্যারাবিকের পুরো বাজারই পরিণত হয়েছে কালোবাজারে। প্রতীকী ছবি
গৃহযুদ্ধের কারণে সুদানের গাম অ্যারাবিকের পুরো বাজারই পরিণত হয়েছে কালোবাজারে। প্রতীকী ছবি

গাম অ্যারাবিক! একাশিয়া গাছ থেকে প্রাপ্ত একধরনের প্রাকৃতিক পদার্থ, যা কোকা-কোলা, এমঅ্যান্ডএমের তৈরি মিষ্টি চকলেট, ল’রিয়েলের লিপস্টিক, নেসলের পশুখাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের উপাদান মিশ্রণ স্থিতিস্থাপক ও ঘন করতে ব্যবহৃত হয়। বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। সম্প্রতি এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের বাণিজ্য সুদানের গৃহযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠী এই গাম অ্যারাবিকের উৎপাদন অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে এবং পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর জন্য এই পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতের প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলছে। বিশ্বের প্রায় ৮০ শতাংশ গাম অ্যারাবিক উৎপাদনকারী দেশ সুদান। গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটি থেকে এই পণ্য সরবরাহ ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় দেশটির আধা সামরিক বাহিনী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)। এই বাহিনী গত বছর সুদানের প্রধান গাম সংগ্রহ এলাকা কর্দোফান ও দারফুরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই অঞ্চলগুলোতে কাঁচামালটির নিয়ন্ত্রণ এখন একচেটিয়াভাবে সুদানি ব্যবসায়ীদের হাতে। অবশ্য তাদের আরএসএফকে বখরা দিতে হয়। আশঙ্কার বিষয় হলো, এই গাম প্রায়শই অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ও সীমান্ত বাজারের মাধ্যমে সঠিক সার্টিফিকেশন ছাড়াই পাচার করা হয়।

সংঘাত শুরুর আগে কাঁচা গাম রাজধানী খার্তুমে বাছাই করা হতো এবং এরপর পোর্ট সুদান থেকে সুয়েজখালের মাধ্যমে জাহাজে করে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হতো। কিন্তু আরএসএফ মূল উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে পশ্চিম কর্দোফান এবং দক্ষিণ সুদানের সীমান্ত বরাবর চোরাচালান বাজারে বিপুল পরিমাণে গাম অ্যারাবিক দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় ভূমিমালিকদের কাছ থেকে গাম সংগ্রহ করে এবং মার্কিন ডলারের বিনিময়ে দক্ষিণ সুদানের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে।

আরএসএফ এই পুরো প্রক্রিয়ার ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার বিনিময়ে কেবল নগদ অর্থই গ্রহণ করে না, পাশাপাশি সোনা, গবাদিপশু, কৃষি এবং ব্যাংকিংয়ের মতো অন্যান্য লাভজনক উপাদান গ্রহণ করে।

গাম অ্যারাবিকের এই নতুন, অস্পষ্ট বাণিজ্য শিল্পের উৎস এবং ক্রেতাদের মধ্যে গুরুতর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তাঁরা আশঙ্কা করছেন, পাচারকৃত পণ্যটি বিশ্বব্যাপী উপাদান প্রস্তুতকারকদের ক্রয়ব্যবস্থায় অনুপ্রবেশ করতে পারে।

শিল্প প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন, ঐতিহ্যগত সরবরাহ শৃঙ্খল সংঘাতের কারণে বিপর্যস্ত হয়েছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিশেষ খাদ্য উপাদান সরবরাহকারী ইকো-এগ্রির গ্লোবাল মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ হার্ভে ক্যানেভেট সুদানে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতার প্রভাব সম্পর্কে বলেন: ‘আজ, সুদানের গামের সবটাই পাচার করা হয়। কারণ, দেশে কোনো প্রকৃত কর্তৃপক্ষ নেই।’

মূলত আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে থাকা বেশির ভাগ গাম অ্যারাবিক উৎপাদন কোনো কার্যকর সরকারি কর্তৃপক্ষ তদারকি করে না। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে চোরাবাজারের আশ্রয় নেন, যেখানে বৈধতা যাচাই করা কঠিন। এই অবস্থায় ক্রেতারা ক্রমশ সতর্ক হয়ে উঠছেন সেডেক্স সার্টিফিকেশন ছাড়া সরবরাহ গ্রহণ করতে। সেডেক্স সার্টিফিকেশন সরবরাহকারীদের টেকসই এবং নৈতিক মানদণ্ড পূরণের মূল নিশ্চয়তা।

কিছু ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অস্বাভাবিক কম দামে পণ্য সরবরাহ করছেন। এই কমদামি পণ্যের মূল উৎস প্রায়শই চাদ এবং সেনেগালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো। মিসর, দক্ষিণ সুদানের মতো দেশগুলো থেকেও বিক্রি হচ্ছে এই উপাদান। অথচ নিকট অতীতেও গাম অ্যারাবিকের রপ্তানি বাজারে এসব দেশের তেমন কোনো ভূমিকা ছিল না।

চোরাচালান হওয়ার কারণে গাম অ্যারাবিকের দাম যথেষ্ট কমে যাচ্ছে। যেমন—এক হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় এক বিক্রেতা জানান, তিনি প্রতি মেট্রিক টন গাম অ্যারাবিক বিক্রি করতে চান ১ হাজার ৯০০ ডলারে, যেখানে ক্রেতার অনুমান ছিল, প্রতি মেট্রিক টনের দাম হতে পারে ৩ হাজার ডলার। এ ছাড়া, এই বাজার এমনভাবে পরিচালিত হয়, যার ফলে মূল্য নির্ধারণ, সময়সূচি নির্ধারণ এমনকি সরবরাহ রুটের বিষয়েও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করা হয় এবং সঠিক ডকুমেন্টেশনের অনুপস্থিতি পণ্যের উৎস ট্রেস করা কঠিন করে তোলে।

খার্তুমভিত্তিক ইউনিটি অ্যারাবিক গামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হুসেইন সর্জের কথায় এই চোরাচালানের সঙ্গে আরএসএফের সম্পৃক্ততা আরও স্পষ্ট হয়। সর্জে জানান, ডিসেম্বরে সেনেগাল ও চাদের ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে গাম অ্যারাবিক বিক্রি করতে চান। তার আগে আরএসএফ ২০২৩ সালে সর্জের সব গাম সরবরাহ বাজেয়াপ্ত করে। পরে তিনি মিসরে পালিয়ে যান। কম দাম এবং সংশ্লিষ্ট ডকুমেন্টেশনের অভাবের কারণে সর্জে পণ্য ক্রয় করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন।

সর্জে বলেন, ‘পাচারকারীরা আরএসএফের মাধ্যমে গাম অ্যারাবিক পাচার করতে সক্ষম হয়। কারণ, আরএসএফ পুরো উৎপাদন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করে।’

মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে আরএসএফের এক কর্মকর্তা তাঁর গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের সমর্থনে বলেন, তারা ‘গাম অ্যারাবিকের’ বাণিজ্য সুরক্ষিত করেছে এবং এটি করতে গিয়ে নামমাত্র ‘ফি গ্রহণ’ করেছে। তিনি জানান, আরএসএফের বিরুদ্ধে আনা আইন ভঙ্গের অভিযোগ মূলত সম্মানহানির লক্ষ্যে প্রচারিত।

তবে গাম অ্যারাবিক সংশ্লিষ্ট শিল্প খাতের লোকজন এই পণ্যের ওপর বৈধ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ না থাকার বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। নেক্সিরা, অ্যালান্ড অ্যান্ড রবার্ট এবং ইনগ্রেডিয়নের মতো বেশ কয়েকটি কোম্পানি সুদান থেকে গাম অ্যারাবিকা না কিনে বিকল্প উৎসের কথা ভাবছেন। নেক্সিরা সুদান ছাড়াও আরও ১০টি দেশ থেকে কেনার প্রচেষ্টা শুরু করেছে। ইনগ্রেডিয়ন সরবরাহ শৃঙ্খলে লেনদেনে বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর প্রোটোকল বজায় রাখার চেষ্টা করছে এখনো।

প্রচলিত বাজার ছাড়াও, গাম অ্যারাবিকের অবৈধ বাণিজ্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইসম সিদ্দিক নামে ব্রিটেনে আশ্রয় নেওয়া এক সুদানি জানান, ২০২৩ সালের এপ্রিলে তিনি নমুনা হিসেবে তিন সুটকেস গাম নিয়ে দেশ ছাড়েন। পরে তার খার্তুমে তাঁর গুদামগুলো লুট করে আরএসএফ।

ইসম সিদ্দিক জানান, এক বছর পরে তাঁর ব্র্যান্ডেড গাম একটি অনলাইন ফেসবুক গ্রুপে বিক্রির জন্য দেখা যায়। তিনি জানান, এ থেকে এটি স্পষ্ট যে, আরএসএফ কেবল প্রচলিত বাণিজ্য পথই নয় বরং আধুনিক বিক্রয় চ্যানেলগুলোকেও ব্যবহার করছে ফায়দা তোলার কাজে। এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য পদ্ধতি, সীমান্ত পাচার এবং অনলাইন বিক্রি বিশ্বব্যাপী বৈধভাবে গাম অ্যারাবিক কেনা কোম্পানিগুলোর জন্য জটিল চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

সুদানের সংকট বিশ্বব্যাপী গাম অ্যারাবিকের বাজারকে অবৈধ চ্যানেল এবং সন্দেহজনক অনুশীলনের এক গোলকধাঁধায় পরিণত করেছে। আরএসএফের প্রভাব সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি ধাপে থাকায় ক্রেতারা ঝুঁকি গ্রহণ বা বিকল্প উৎস থেকে পণ্য ক্রয়ে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু উৎস কম থাকায় পুরো বিষয়টি এখন আরএসএফের দয়ার ওপর নির্ভর করছে।

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে উত্তেজনা: শিখ ও হিন্দু বিক্ষোভকারীদের মধ্যে হাতাহাতি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বিক্ষোভকারী শিখদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে ওসমান হাদির ছবিও দেখা যায়। ছবি: এক্স
বিক্ষোভকারী শিখদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে ওসমান হাদির ছবিও দেখা যায়। ছবি: এক্স

লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে গত শনিবার একটি বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বেশ উত্তেজনা তৈরি হয়। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কথিত নির্যাতনের প্রতিবাদে আয়োজিত এই সমাবেশে স্বাধীন খালিস্তানপন্থী শিখ অধিকার কর্মী এবং একদল হিন্দু বিক্ষোভকারী মুখোমুখি হলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রিটিশ পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ও আয়োজকদের বরাত দিয়ে পাকিস্তানি দৈনিক ডন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আয়োজিত সমাবেশে খালিস্তান রেফারেন্ডাম অভিযানের সমন্বয়ক পরমজিৎ সিং পাম্মা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের হাতে ধরা প্ল্যাকার্ডে হরদীপ সিং নিজ্জার এবং শরিফ ওসমান বিন হাদির ছবি দেখা গেছে। সমাবেশের একপর্যায়ে ভারতীয় এক হিন্দু বিক্ষোভকারীর সঙ্গে পাম্মার কথা-কাটাকাটি এবং পরে হাতাহাতি শুরু হয়। ঘটনার গুরুত্ব বুঝে সেখানে দায়িত্বরত মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা দ্রুত পদক্ষেপ নেন এবং দুই পক্ষকে আলাদা করে দেন।

বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রবেশপথের কাছে একটি কর্ডন তৈরি করে তাদের কর্মসূচি চালিয়ে যান। এ সময় তাঁরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক স্লোগান দেন। বিশেষ করে হরদীপ সিং নিজ্জার হত্যা এবং অন্যান্য শিখ নেতাদের খুনের পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার হাত রয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।

উল্লেখ্য, ভারত সরকার পরমজিৎ সিং পাম্মাকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্ট’ বা অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত করলেও পাম্মা ও তাঁর সমর্থকেরা এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।

গত বছরের জুনে কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জার খুন হওয়ার পর থেকে ভারত ও কানাডার মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চরম আকার ধারণ করেছে। একইভাবে, যুক্তরাষ্ট্রে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা গুরপতবন্ত সিং পান্নুনকে হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গেও ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছে মার্কিন বিচার বিভাগ।

লন্ডনের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে সেই বৈশ্বিক উত্তেজনার ছায়া দেখা গেছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, কোনো বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি এবং পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো গ্রেপ্তারের খবর পাওয়া যায়নি।

খালিস্তান আন্দোলনের শিকড় ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ এবং পাঞ্জাব বিভাজনের সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবিতে এই আন্দোলন দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। এই আন্দোলন বর্তমানে বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারত-কানাডা এবং ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি সংবেদনশীল ইস্যু হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসরায়েল কেন প্রথম দেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসরায়েলের স্বীকৃতির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সোমালিল্যান্ড। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলের স্বীকৃতির ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে সোমালিল্যান্ড। ছবি: এএফপি

ইসরায়েল কেন সোমালিয়া থেকে স্বাধীন হতে চাওয়া সোমালিল্যান্ডকে প্রথম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিল—এই প্রশ্ন ঘিরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়েছে। আফ্রিকার হর্ন অঞ্চলের স্বঘোষিত স্বাধীন রাষ্ট্র সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে ইসরায়েল শুধু একটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্তই নেয়নি, বরং মধ্যপ্রাচ্য ও লোহিত সাগর ঘিরে চলমান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই স্বীকৃতির পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক—এই তিনটি প্রধান কারণ। সোমালিল্যান্ডের অবস্থান অত্যন্ত কৌশলগত। এটি এডেন উপসাগরের তীরে অবস্থিত এবং ইয়েমেনের খুব কাছেই, যেখানে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা সক্রিয়। চলতি বছরে হুতি ও ইসরায়েলের মধ্যে একাধিকবার হামলা ও পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিবাদে হুতিরা লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালায়। জবাবে ইয়েমেনের সানা ও হোদেইদায় হুতি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হামলা চালায় ইসরায়েল।

এই প্রেক্ষাপটে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গবেষক ডেভিড মাকোভস্কি প্রশ্ন তুলেছেন—সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে কি ইসরায়েল সেখানে সামরিক সুবিধা বা গোয়েন্দা উপস্থিতির পথ খুলেছে? বিশেষ করে হুতি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় এটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

ইসরায়েলের গণমাধ্যম ‘চ্যানেল ১২’ জানিয়েছে, সোমালিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আব্দিরাহমান মোহাম্মদ আবদুল্লাহি গোপনে একাধিকবার ইসরায়েল সফর করেছেন। গত অক্টোবরে তিনি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ ও মোসাদের প্রধান ডেভিড বারনিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে নেতানিয়াহু এই স্বীকৃতির ক্ষেত্রে মোসাদের ভূমিকার কথা তুলে ধরেন।

তবে এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছে সোমালিয়া ও আফ্রিকান ইউনিয়ন। মিসর ও ফিলিস্তিনসহ কয়েকটি আরব দেশও এর সমালোচনা করেছে। অতীতে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোর করে সোমালিল্যান্ডে স্থানান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যদিও সোমালিল্যান্ডের কর্মকর্তারা এই ধরনের কোনো যোগাযোগের কথা অস্বীকার করেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি ইসরায়েলের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। সোমালিল্যান্ডের বন্দরনগরী বেরবেরা ইসরায়েলকে লোহিত সাগরে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। এমন হলে বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাব আল-মানদেব প্রণালির ওপর নজরদারি চালাতে পারবে ইসরায়েল। তবে সব মিলিয়ে, সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিয়ে ইসরায়েল ইতিহাস তৈরি করলেও এর পূর্ণ প্রভাব ও ফলাফল এখনো স্পষ্ট নয়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

২০২৫ সালের সেরা সিইও কে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: দ্য ইকোনমিস্ট
ছবি: দ্য ইকোনমিস্ট

২০২৫ সাল ছিল বিশ্ব করপোরেট নেতৃত্বের জন্য এক কঠিন পরীক্ষার বছর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার ফলে শুরু হয় নতুন বাণিজ্যযুদ্ধ ও অনিশ্চিত নীতিনির্ধারণ। একই সঙ্গে চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে প্রযুক্তিগত আধিপত্যের লড়াই আরও তীব্র হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে বিপুল প্রত্যাশা থাকলেও, সেটিকে লাভজনক ব্যবসায় রূপ দেওয়ার কাজ অনেক সিইওর জন্য হতাশাজনকই থেকে যায়।

তবে এই অস্থিরতার মধ্যেও কিছু প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ব্যতিক্রমী সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। টানা তৃতীয়বারের মতো ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ এবারও (২০২৫ সাল) সেরা সিইও নির্বাচন করেছে। এ ক্ষেত্রে এসঅ্যান্ডপি ১২০০ সূচকের অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোকে তাদের খাতভিত্তিক গড়ের তুলনায় অতিরিক্ত শেয়ারহোল্ডার রিটার্নের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর তিন বছরের কম সময় দায়িত্বে থাকা সিইওদের বাদ দিয়ে শীর্ষ ১০ জনকে প্রাথমিক তালিকায় রাখা হয়।

এই তালিকায় ছিলেন—জার্মান অস্ত্র নির্মাতা রাইনমেটালের আরমিন পাপারগার, স্বর্ণখনি জায়ান্ট নিউমন্টের টম পামার, ফুজিকুরার ওকাদা নাওকি, ওয়ার্নার ব্রাদার্স ডিসকভারির ডেভিড জাসলাভ, হানহা অ্যারোস্পেসের সন জে-ইল, মাইক্রনের সঞ্জয় মেহরোত্রা, কিনরস গোল্ডের জে পল রোলিনসন, রবিনহুডের ভ্লাদিমির টেনেভ, এসকে হাইনিক্সের কাক নো-জং এবং সিগেট টেকনোলজির ডেভ মসলে।

তবে অতীতের দুর্বল পারফরম্যান্স, করপোরেট গভর্ন্যান্স সমস্যা কিংবা নিছক সৌভাগ্যের কারণে অনেকেই চূড়ান্ত বিবেচনা থেকে বাদ পড়েছেন। স্বর্ণের দাম প্রায় ৬৫ শতাংশ বেড়ে যাওয়ায় খনি কোম্পানিগুলোর শেয়ারদর বাড়লেও, সেটিকে সিইওদের কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হয়নি। মেমোরি চিপ খাতে এআই বুমের সুফল পেলেও, সেখানে এসকে হাইনিক্সের গবেষণা ও উন্নয়নে ধারাবাহিক বিনিয়োগ আলাদা করে প্রশংসা কুড়িয়েছে।

সবশেষে ২০২৫ সালের সেরা সিইও হিসেবে রাইনমেটালের আরমিন পাপারগারকেই বেছে নিয়েছে ‘দ্য ইকোনমিস্ট’। তাঁর নেতৃত্বে কোম্পানিটি শেয়ারহোল্ডারদের জন্য লভ্যাংশসহ ১৫৮ শতাংশ রিটার্ন দিয়েছে। ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাইনমেটাল বড় বড় চুক্তি জয় করেছে এবং নৌযান নির্মাণ খাতেও সম্প্রসারণে নেমেছে। ২০১৩ সাল থেকে দায়িত্বে থাকা পাপারগার ইউক্রেন যুদ্ধের আগেই ইউরোপের প্রতিরক্ষা শিল্পের সম্ভাবনা অনুধাবন করেছিলেন। দূরদর্শিতা, সাহস ও দৃঢ় নেতৃত্বের ফলেই ২০২৫ সালের সেরা সিইওর স্বীকৃতি তাঁর হাতেই উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার ট্রাম্প ও জেলেনস্কির বৈঠক—কী আছে সর্বশেষ ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সিএনএন
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: সিএনএন

ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে একটি ২০ দফা শান্তি প্রস্তাবকে সামনে রেখে রোববার (২৮ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনস্কি। জেলেনস্কির কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এই খসড়া প্রস্তাবকে তিনি ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ করার একটি সম্ভাব্য ভিত্তি হিসেবে দেখছেন।

এর আগে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২৮ দফার একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চললেও সেটিকে রাশিয়ার দাবির প্রতি অতিরিক্ত সহানুভূতিশীল মনে করা হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহের আলোচনার পর প্রস্তাবটি সংশোধন করে ২০ দফায় নামিয়ে আনা হয়। জেলেনস্কি জানিয়েছেন, অধিকাংশ বিষয়ে পক্ষগুলোর অবস্থান অনেকটাই কাছাকাছি এসেছে। তবে এখনো দুটি ইস্যুতে ঐকমত্য হয়নি—ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ এবং জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা ও পরিচালনা।

প্রস্তাবনার শুরুতেই ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব পুনর্ব্যক্ত করার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিঃশর্ত আগ্রাসনবিরোধী চুক্তির প্রস্তাব রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শান্তি বজায় রাখতে সীমান্তবর্তী সংঘর্ষরেখা নজরদারির জন্য মহাকাশভিত্তিক মানববিহীন প্রযুক্তি ব্যবহারের কথাও এতে অন্তর্ভুক্ত আছে।

এই কাঠামো অনুযায়ী, ইউক্রেন তার সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান শক্তি—প্রায় ৮ লাখ সেনা—অক্ষুণ্ন রাখবে। যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটো ও ইউরোপীয় দেশগুলো ন্যাটোর অনুচ্ছেদ ৫-এর আদলে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেবে। অপরদিকে ইউক্রেন ও ইউরোপের বিরুদ্ধে আগ্রাসন না করার নীতি নিজ দেশের আইনে এবং পার্লামেন্টের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন দিতে হবে রাশিয়াকে।

অর্থনৈতিক দিক থেকে ইউক্রেনের জন্য রয়েছে বড় পরিসরের পুনর্গঠন ও উন্নয়ন পরিকল্পনা। ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল পুনর্গঠন, মানবিক সহায়তা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য একাধিক তহবিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার লক্ষ্য প্রায় ৮০০ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ। ইউক্রেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাবে এবং অস্থায়ীভাবে ইউরোপীয় বাজারে বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পন্ন করার কথাও বলা হয়েছে।

সবচেয়ে জটিল ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ভূখণ্ড প্রশ্ন। রাশিয়া দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে ইউক্রেনীয় সেনা প্রত্যাহার চায়, অন্যদিকে ইউক্রেন বর্তমান যুদ্ধরেখায় সংঘর্ষ বন্ধের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে একটি নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চল ও মুক্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রস্তাব দিয়েছে।

যুদ্ধবন্দীর মতো মানবিক বিষয়ে ‘সবার বিনিময়ে সবার মুক্তি’, আটক বেসামরিক নাগরিক ও শিশুদের ফেরত এবং যুদ্ধাহতদের সহায়তার কথা রয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর দ্রুত নির্বাচন আয়োজন করবে ইউক্রেন।

এই শান্তিচুক্তি আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক হবে এবং এর বাস্তবায়ন তদারক করবে একটি ‘পিস কাউন্সিল’, যার সভাপতিত্ব করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সব পক্ষ একমত হলে সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে—এমনটাই বলা হয়েছে এই ২০ দফা প্রস্তাবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত