Ajker Patrika

রয়টার্সের প্রতিবেদন /তেলের গাড়ি বিদেশে পাঠিয়ে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি বাড়াচ্ছে চীন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭: ০০
চীন নিজ দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়িকে পর্যাপ্ত জায়গা দিতে গ্যাসোলিনচালিত গাড়িগুলো পাঠাচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের দেশে। ছবি: সংগৃহীত
চীন নিজ দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়িকে পর্যাপ্ত জায়গা দিতে গ্যাসোলিনচালিত গাড়িগুলো পাঠাচ্ছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিশ্বের দেশে। ছবি: সংগৃহীত

চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির শিল্প কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অর্ধেক বাজার দখল করে নিয়েছে। এতে এক সময়ের শক্তিশালী বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর গ্যাসোলিনচালিত বা তেল–গ্যাসচালিত গাড়ির বিক্রি কার্যত গুঁড়িয়ে গেছে। তবে এতে কেবল বিদেশিরাই নয়, বহু চীনা ঐতিহ্যবাহী গাড়ি নির্মাতা কোম্পানিও নিজ দেশে বিক্রি কমে যাওয়ার ধাক্কা খেয়ে অবিক্রীত গাড়ি বিদেশে রপ্তানি করতে শুরু করেছে।

পশ্চিমা নীতিনির্ধারকেরা যখন চীনের ভর্তুকি–নির্ভর ইলেকট্রিক ভেহিক্যাল বা ইভিগুলোকেই মূল হুমকি হিসেবে দেখে শুল্ক আরোপ করছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোম্পানিগুলো আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—চীনা গ্যাসোলিন গাড়ির। যেগুলো পোল্যান্ড থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে পর্যন্ত বাজারে হানা দিচ্ছে।

রয়টার্সের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সাল থেকে চীনের মোট গাড়ি রপ্তানির ৭৬ শতাংশই গ্যাসোলিনচালিত, আর মোট বার্ষিক রপ্তানি ১০ লাখ থেকে বাড়তে বাড়তে এ বছর ৬৫ লাখ ছাড়াতে পারে বলে জানিয়েছে চীনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অটোমোবিলিটি।

ইভির ভর্তুকি ও নীতিই এই গ্যাসোলিন রপ্তানির উল্লম্ফনের পেছনে বড় চালিকাশক্তি—যে নীতি ফক্সওয়াগন, জিএম, নিশানসহ বহু বিদেশি ব্র্যান্ডের চীনের বাজারে ব্যবসাকে ধ্বংস করেছে। শত শত চীনা ইভি কোম্পানিকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যে মূল্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তার অভিঘাতই এখন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।

শুধু গ্যাসোলিন গাড়ির রপ্তানিতেই—ইভি বা প্লাগ-ইন হাইব্রিড বাদ দিয়েও—চীন গত বছর বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি-রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠেছে। রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, চীনের গ্যাসোলিন গাড়ির বন্যা দেখা যাচ্ছে প্রধানত সেই সব উদীয়মান বা দ্বিতীয় স্তরের বাজারে, যেখানে চার্জিং অবকাঠামো দুর্বল। এর পেছনে রয়েছে বেইজিংয়ের বর্তমান ইভি নীতি এবং গত কয়েক দশকের গ্যাসোলিন গাড়ি শিল্পকে বিদেশিদের সহযোগিতায় গড়ে তোলার পুরোনো নীতির দ্বন্দ্ব।

সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারকদের মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত পুরোনো কোম্পানি—এসএআইসি, বিএআইসি, দোংফেং, চানআন—যারা বিদেশি ব্র্যান্ডের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রযুক্তি ও মুনাফা অর্জন করত। ১৯৮০-এর দশকে বেইজিং জোর করে তৈরি করা এই জোটগুলোই একসময় ছিল প্রধান শক্তি। কিন্তু বেসরকারি ও উদ্ভাবনী চীনা ইভি নির্মাতাদের উত্থানে এসব যৌথ উদ্যোগের বিক্রি ভেঙে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এসএআইসি-জিএম এর বার্ষিক বিক্রি ২০২০ সালের ১৪ লাখ থেকে ২০২৪ সালে কমে ৪ লাখ ৩৫ হাজারে নেমে এসেছে।

এখন এসব রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি তাদের বিদেশি অংশীদারদের একসময়কার বাজারেই নতুন করে দখল নিচ্ছে। এসএআইসির রপ্তানি ২০২০ সালের ৪ লাখ থেকে বেড়ে গত বছর ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। দোংফেং–এর রপ্তানি গত বছর প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার—পাঁচ বছরে প্রায় চারগুণ। অথচ তার চীনা অংশীদার হোন্ডা ও নিশানের যৌথ উদ্যোগগুলোর বিক্রি পতনের সর্পিল ঘূর্ণিতে আটকে গেছে। ২০২০ সাল থেকে দোংফেং–এর বিশ্বব্যাপী বিক্রি কমেছে ১০ লাখ। তবু কোম্পানির ইউরোপ ব্যবস্থাপক ইয়েলটে ভারনুই বললেন, চিন্তার কিছু নেই—কারণ পেছনে রয়েছে বেইজিং। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা রাষ্ট্রায়ত্ত—এটাই আসল কথা। টিকে থাকার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।’

গ্যাসোলিন গাড়ির চাহিদাই বেশি দ্বিতীয় স্তরের বাজারগুলোতে—পূর্ব ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা—যেখানে চার্জিং নেটওয়ার্ক দুর্বল। দীর্ঘমেয়াদে বেইজিং বিশ্ব ইভি ও প্লাগ-ইন হাইব্রিড বাজার দখল করতে চায়। কিন্তু আপাতত চীনা নির্মাতারা বিদেশে নিজেদের ব্র্যান্ড দাঁড় করাতে ক্রেতাদের যা চাই, তাই দিচ্ছে।

চীনের শীর্ষ রপ্তানিকারক চেরি। তাদের বিশ্বব্যাপী বিক্রি ২০২০ সালের ৭ লাখ ৩০ হাজার থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে হয়েছে ২৬ লাখ। এদের চার ভাগের তিন ভাগ গাড়িই গ্যাসোলিনচালিত। শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারকের মধ্যে আরও আছে পাঁচ রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি এবং দুই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গিলি ও গ্রেট ওয়াল মোটর।

শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারকের মধ্যে কেবল দুই কোম্পানি পুরোপুরি ব্যাটারি চালিত গাড়ি বিক্রি করে—যুক্তরাষ্ট্রের টেসলা ও চীনের বিওয়াইডি। বিওয়াইডির বিদেশযাত্রা এ বছর চীনকে প্লাগ-ইন গাড়ির রপ্তানিতে শক্তিশালী করেছে। তবু গ্যাসোলিন গাড়ির রপ্তানি ৪৩ লাখ ছাড়িয়ে মোট রপ্তানির দুই-তৃতীয়াংশ থাকবে।

চেরি, দোংফেং ও রাষ্ট্রায়ত্ত এফএডব্লিউয়ের বিদেশি কর্মকর্তারা জানান—চীনের নির্মম মূল্য যুদ্ধের বাজারে টিকে থাকার জন্য রপ্তানি ছাড়া উপায় নেই। এফএডব্লিউয়ের ডিজাইন প্রধান জাইলস টেলর বলেন, কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী মাত্র একটি ভুল পণ্যে ব্যর্থ হলেই ধসে পড়তে পারে। তাঁর ভাষায়, ‘চীনের গাড়ি বাজার এতটাই ভরাট, যেন দাঁত-নখ বের করে লড়াই।’

ইঞ্জিনভিত্তিক গাড়ি রপ্তানিই তাদের প্রধান ভরসা। কারণ, অধিকাংশ দেশের জন্য সেটিই বেশি উপযোগী। চানআনের ইউরোপীয় বিপণন পরিচালক নিক টমাস বলেন, তারা চাইলে প্রতিটি বাজারের জন্য আলাদা করে গাড়িকে সাজিয়ে দিতে পারে। এসএআইসি, বিএআইসি, গিলি, গ্রেট ওয়াল বা সরকারের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন এ বিষয়ে মন্তব্য করেনি।

বৈশ্বিক গাড়ি কোম্পানিগুলো চীনা প্রতিযোগীদের হুমকি হিসেবে স্বীকার করলেও, তাদের দৃষ্টি ছিল মূলত সস্তা ইভিগুলোর দিকে। টয়োটা, জিএম, ফোর্ড, হোন্ডা, নিশান, হুন্দাই—কেউই রপ্তানির এই উল্লম্ফন নিয়ে মন্তব্য করেনি। কেউ কেউ অবশ্য লড়াইয়ে নামার প্রস্তুতির কথা বলেছে। ফক্সওয়াগনের দক্ষিণ আমেরিকা প্রধান আলেক্সান্ডার সাইটজ বলেন, তিনি চীনাদের ভয় পান না। তাদের তিনি প্রতিযোগী হিসেবে সম্মান দেন। ফক্সওয়াগনও এখন চীনে বানানো গাড়ি বেশি দেশে রপ্তানির পরিকল্পনা করছে। জিএম প্রধান নির্বাহী মেরি বার্রা বলেছেন, সঠিক প্রযুক্তি ও সঠিক মূল্যে তাঁর কোম্পানি প্রতিযোগিতা করবে।

চীনে ইভির দ্রুত বিস্তার বহু গ্যাসোলিন গাড়ির কারখানাকে অচল করে দিয়েছে। অটোমোবিলিটির প্রধান বিল রুসো বলেন, বছরে প্রায় ২ কোটি গাড়ি বানানোর ক্ষমতা এখন কার্যত অকেজো। ফলে কোম্পানিগুলো রপ্তানির পথেই সেই বাড়তি ক্ষমতা ঢালছে। পরামর্শক অ্যালিক্সপার্টনারস ধারণা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চীনা গাড়ি নির্মাতাদের বিদেশি বিক্রি বছরে আরও ৪ মিলিয়ন বাড়বে, আর পাঁচ বছরের মধ্যেই তারা পুরো বিশ্বের গাড়ি বাজারের ৩০ শতাংশ দখল করবে।

স্থানীয় সরকারগুলো ইভি কারখানার জন্য জমি, অর্থ, অবকাঠামো সবই দিয়েছে। এর ফলে গ্যাসোলিন গাড়ির অতিরিক্ত সক্ষমতা তৈরি হয়েছে ৩ কোটি গাড়ির মতো, যা অভ্যন্তরীণ চাহিদার বহু গুণ বেশি। সাবেক উপমন্ত্রী সু বো বলেন, গ্যাসোলিন গাড়ির বিক্রি কমায় এই অতিরিক্ত সক্ষমতা পুরো শিল্পকে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ঠেলে দিয়েছে।

ইভি নতুন কারখানায় ব্যস্ত থাকতে থাকতে পুরোনো রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো গ্যাসোলিন গাড়ি ঠেলে দিচ্ছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। পোল্যান্ডের ওয়ারশতে প্লাজা শোরুমে ঝকঝকে ‘বেইজিং’ লোগোওয়ালা নতুন এসইউভি দাঁড়িয়ে। এগুলো বানিয়েছে বিএআইসি। ২০২৩ সাল থেকে পোল্যান্ডে ৩৩টি চীনা ব্র্যান্ড এসেছে, বেশির ভাগই গ্যাসোলিনচালিত গাড়ি নিয়ে।

সেখানকার ডিস্ট্রিবিউটররা বলছেন, একই ধরনের এত গাড়ি এসেছে যে সাধারণ ক্রেতা পার্থক্য করতে পারে না। জিএসি ও গিলির স্থানীয় ব্যবস্থাপক এটাকে ‘উন্মাদনা’ বলেছেন। উদীয়মান বাজারগুলো চীনা নির্মাতাদের প্রধান টার্গেট—কারণ এখানকার ক্রেতারা ইভি নয়, গ্যাসোলিন গাড়ির দিকেই ঝুঁকে। কোস্টারিকা, পেরু, ইন্দোনেশিয়া বা গ্রিসে একেকটি বাজারের চাহিদা একেক রকম—চীনারা সেই বাস্তবতাই ধরছে।

অস্ট্রেলিয়ার মতো ধনী দেশেও চেরির বিক্রি প্রায় সবই গ্যাসোলিনচালিত। ইভি এসেছে এখনো অল্প। চিলি, দক্ষিণ আফ্রিকা, উরুগুয়ে—সবখানে একই ছবি। ভালো নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য আর প্রতিযোগিতামূলক দামে চীনা গাড়ি সেখানে বিদেশি ব্র্যান্ডকে পেছনে ফেলছে।

উরুগুয়েতে দোংফেং বিক্রি করছে নিশানের ফ্রন্টিয়ার ট্রাকের প্রায় একই সংস্করণ, নাম রিচ–৬। দাম নানা ক্ষেত্রে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম। স্থানীয় কৃষক মারিয়ানা বেতিজাগাস্তি বলেন, ‘একটা ব্র্যান্ডেড গাড়ির দামে এখানে দুটো চীনা ট্রাক পাওয়া যায়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিএনপির আপত্তি তোলা দুই অধ্যাদেশে উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন

লন্ডনে চিকিৎসা যাত্রায় খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী ১৪ জন, তালিকায় ছয় চিকিৎসক ও দুই এসএসএফ

ভারতে পা রাখলেন পুতিন, নিয়ম ভেঙে ‘কোলাকুলি’ করলেন মোদি

ঢাকার তিনটিসহ আরও ২৮ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা বাকি থাকল

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ