Ajker Patrika

এএফপির প্রতিবেদন /জুলাই অভ্যুত্থানের স্বপ্ন বড় হোঁচট খেল বেকারত্বে

ঢাকায় সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে আসা একদল তরুণ। ছবি: এএফপি
ঢাকায় সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে আসা একদল তরুণ। ছবি: এএফপি

বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল বাংলাদেশের তরুণ ছাত্র-জনতা। কোটা সংস্কার আন্দোলন একসময় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। মূলত বৈষম্য, বেকারত্ব দূর করে এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়েছে। কিন্তু বিপ্লবের ছয় মাস পর অনেকেই বলছেন, চাকরি খোঁজা ব্যারিকেড সামলানোর চেয়ে কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিজওয়ান চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল, এই আন্দোলন যুবকদের জন্য অফুরান সুযোগ এনে দেবে। কিন্তু নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে তিনি কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখতে পাননি। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘সরকার এখনো কোনো ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেয়নি।’ শেখ হাসিনাকে তাড়াতে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সক্রিয় অংশীদার ছিলেন ২৫ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থী। তাঁর মতো তরুণদের আন্দোলনের ফলেই শেখ হাসিনা গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে চলে যান।

বেকারত্ব ছিল গত বছরের আন্দোলনের অন্যতম মূল কারণ। কিন্তু বিপ্লবের পর এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে চাকরিপ্রত্যাশী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬ লাখ ৬০ হাজারে। এই সংখ্যা আগের বছরের ২৪ লাখ ৯০ হাজার থেকে ৬ শতাংশ বেশি।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সেপ্টেম্বরে সতর্ক করে বলেছিল, ‘অর্থনৈতিক কার্যক্রম উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়েছে, তবে মূল্যস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে।’ কর রাজস্ব কমার পাশাপাশি ব্যয় বাড়ার চাপও বেড়েছে।

শেখ হাসিনার পতনের পর যে উচ্ছ্বাস দেখা গিয়েছিল, তা অনেকের কাছে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। রিজওয়ান চৌধুরী বলেন, ড. ইউনূস ছাত্রনেতাদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিলেও তাদের দাবিগুলো উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধি প্রশাসনে থাকলেও আমাদের কণ্ঠ শুনছে কি না, সন্দেহ আছে।’

সাহিত্যের ছাত্র শুক্কুর আলী (৩১) নিজের অসুস্থ ও বৃদ্ধ বাবা-মাকে সাহায্য করতে খণ্ডকালীন কাজ করে কোনো রকমে দিন পার করছেন। তিনি বলেন, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এমন পরিস্থিতিতে যা পাই তাই করি।’ তিনি জানান, পত্রিকার পাতায় চাকরির বিজ্ঞাপন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

সুক্কুর বলেন, ‘আগে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ব্যাংকে চাকরির জন্য আবেদন করতাম, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি। এখন যেকোনো কাজই চলবে। শুধু একটা চাকরি চাই।’

ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষক জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শ্রমশক্তি পর্যাপ্ত কাজ না পেয়ে যেকোনো কাজ করে খরচ চালানোর চেষ্টা করছে।’

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নাটকীয়ভাবে এগিয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে মূলত তৈরি পোশাকশিল্পের কারণে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু পোশাক কারখানার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকদের জন্য চাকরির সংখ্যা খুবই কম।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার ৮৭ শতাংশ। সরকার দাবি করছে, তারা সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ব্যাপক কর আদায়ের মাধ্যমে সরকার জনখাতে বিনিয়োগ করে ‘বেশ কিছু’ চাকরি সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। তিনি বলেন, ‘কর সংগ্রহ বাড়ানো আমাদের অগ্রাধিকার। কারণ, আগের সরকার একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতি রেখে গেছে।’

তবে ৮৪ বছর বয়সী ক্ষুদ্রঋণের পথিকৃৎ ড. ইউনূস বলছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠনের ‘অত্যন্ত কঠিন’ চ্যালেঞ্জ তাঁকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই সংস্কারগুলোর মধ্যে সংবিধান ও জনপ্রশাসন পুনর্গঠন উল্লেখযোগ্য, যাতে স্বৈরাচার আর ফিরতে না পারে।

এ বিষয়ে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে যে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি পেয়েছে, তা সামাল দিতেই ব্যস্ত।’ তিনি আরও বলেন, ‘যুবকদের সহায়তায় কেবল বিচ্ছিন্ন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’ উদাহরণ হিসেবে তিনি ট্রাফিক পুলিশের কাজে ছাত্রদের খণ্ডকালীন নিয়োগের বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন পূর্ণ গতিতে কাজ করছে না। আমি তাদের ১০০-এর মধ্যে ৫০ নম্বর দেব।’

বাংলাদেশের বর্তমান চাকরির বাজারে তরুণদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বিশাল কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। এ বিষয়ে জনপ্রিয় অনলাইন চাকরির সন্ধানদাতা সাইট বিডিজবসের প্রধান এ কে এম ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘সরকারি খাতে বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার স্নাতক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব, অথচ প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ স্নাতক পাশ করে বের হয়।’

বেসরকারি খাত ৮৫ শতাংশ চাকরি দিলেও সেখানেও আশার আলো কম। এ বিষয়ে ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নিয়োগ ধীর হয়ে গেছে।’

বিক্ষোভ বিনিয়োগকারীদেরও ভয় পাইয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৭৭ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে শেখ হাসিনার আমলে একই সময়ে ৬১৪ মিলিয়ন ডলারের তুলনায় যা এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কম।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি তাসকিন আহমেদ বলেছেন, সরকারকে যুবকদের সহায়তায় কর্মসূচি নিতে হবে, যার মধ্যে ‘যুবকদের ব্যবসা শুরুর জন্য ঋণ প্রকল্প’ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।

তবে কারও কারও জন্য চাকরি-বাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সব প্রচেষ্টা এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়েছে, অনেক দেরি হয়ে গেছে। যেমন—৩১ বছর বয়সী সুবীর রায় একটি সরকারি চাকরির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন, কিন্তু অজানা কারণে তা বাতিল হয়। তিনি বলেন, ‘বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য জমি বিক্রি করেছিলেন...এখন আমি খালি হাতে বাড়ি ফিরছি। আমি বাবার সঙ্গে ধানখেতে কাজ করব।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল: আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪২
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জ্বালানি তেল প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের (এসএওসিএল) প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল সোমবার দুদকের উপপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. জাহাঙ্গীর আলম মামলাটি করেন।

মামলার আসামিরা হলেন এসএওসিএলের কর্মকর্তা (এইচআর) আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩৭), উপব্যবস্থাপক (হিসাব) ও ডিপো ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহমুদুল হক (৪৫), গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন গিয়াস (৪৬), আজহার টেলিকমের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল রানা (৪৪) এবং মেসার্স মদিনা কোয়ালিটির স্বত্বাধিকারী মো. মাসুদ মিয়া (৫১)।

দুদক চট্টগ্রামের উপপরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের হিসাব থেকে প্রায় ২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বিভিন্নভাবে স্থানান্তর ও আত্মসাৎ করেন।

এজাহার থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসএওসিএলের এলসি-সংক্রান্ত লেনদেনের নামে প্রকৃত সরবরাহকারীর পরিবর্তে ভুয়া ও সম্পর্কহীন প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে চেক ইস্যু করার বিষয় দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে। পরে এসব চেকের অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর কিংবা নগদে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো এলসি খোলা হয়নি এবং লেনদেনগুলো কোম্পানির জেভি-০৮ ও জেনারেল লেজারে অন্তর্ভুক্তও করা হয়নি।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাঁচটি চেকের মধ্যে তিনটির অর্থ গোল্ডেন সিফাত এন্টারপ্রাইজ, আজহার টেলিকম ও মদিনা কোয়ালিটির অ্যাকাউন্টে জমা হয় এবং বাকি দুটি চেকের অর্থ নগদে উত্তোলন করা হয়। চেক জমাদানকারী হিসেবে বারবার আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাম পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট ভাউচারে নিরীক্ষা বিভাগের স্বাক্ষর না থাকাও অনিয়মের প্রমাণ হিসেবে উঠে এসেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি
ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছবি: বিজ্ঞপ্তি

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গতকাল রোববার (২৮ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক টাওয়ারে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মুফতি ছাঈদ আহমাদ।

সভায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির ম্যানেজিং ডাইরেক্টর মো. ওমর ফারুক খাঁন এবং শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের সদস্যসচিব অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ। এ ছাড়া কাউন্সিলের অন্য সদস্যবৃন্দ সভায় অংশগ্রহণ করেন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যশোরের খেজুর রস: লক্ষ্য ১২০ কোটি টাকার গুড় উৎপাদন

জাহিদ হাসান, যশোর
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
রসের জন্য খেজুরগাছ কেটে প্রস্তুত করছেন গাছি। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

শীতের রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই যশোরের গ্রামাঞ্চলে শুরু হয় ব্যস্ততা। খেজুরগাছের নিচে হাজির হন গাছিরা। আগের বিকেলে কাটা গাছের ‘চোখ’ বেয়ে সারা রাত মাটির হাঁড়িতে জমেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। ভোরে সেই রস নামিয়ে শুরু হয় আরেক কর্মযজ্ঞ; চুলায় জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরাই মূলত এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। কয়েক ঘণ্টা জ্বালানোর পর তৈরি হয় সুস্বাদু খেজুর গুড় ও পাটালি।

শীত মৌসুম এলেই এমন দৃশ্য দেখা যায় খেজুর গুড়ের জেলা খ্যাত যশোরের প্রায় প্রতিটি গ্রামে। সম্প্রতি যশোরের খেজুর গুড় ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্যের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও নতুন করে সামনে এসেছে।

উৎপাদন ও বাজারের চিত্র

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে যশোরে প্রায় ১২০ কোটি টাকার খেজুর রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরও গতিশীল করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

বর্তমানে খেজুরের কাঁচা রস প্রতি মাটির হাঁড়ি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা, দানা গুড় প্রতি কেজি ৩৫০-৪০০ টাকা এবং পাটালি প্রতি কেজি ৪৫০-৬০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারদর বাড়লেও গাছিরা বলছেন, শ্রম ও ঝুঁকির তুলনায় লাভ সীমিত।

গাছির সংকট বড় চ্যালেঞ্জ

যশোর সদর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের গাছি আজিবর প্রায় ৩৫ বছর ধরে খেজুর গাছ কাটছেন। তিনি বলেন, ‘আগে দেড় শ গাছ কাটতাম, এখন বয়সের কারণে ৩৫-৪০টার বেশি পারি না। রস ও গুড়ের দাম বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু কাটার মতো গাছ কমে গেছে। আবার গাছ থাকলেও দক্ষ গাছির অভাব। এবার বেশি শীত পড়ায় রসও ভালো নামছে, গুড়ের উৎপাদনও বেশি।’

গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
গাছ থেকে নামিয়ে আনা খেজুরের রস জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরি করছেন এক নারী। গতকাল যশোরের চৌগাছা উপজেলার চাকলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

মনিরামপুর উপজেলার সরসকাটি গ্রামের গাছি অতিয়ারও প্রায় ৪০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত। তিনি বলেন, এবার ৫০টা গাছ কাটছি। প্রতিদিন ৮-১০ কেজি গুড় তৈরি হয়। কাজটা খুব কষ্টের। তবে শীত মৌসুমে এই আয়েই পুরো বছরের সংসার চলে।

ই-কমার্সে বাড়ছে চাহিদা

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, যশোর জেলায় মোট খেজুরগাছের সংখ্যা ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৯৫। এগুলোর মধ্যে চলতি মৌসুমে রস আহরণের উপযোগী গাছ রয়েছে ৩ লাখ ৭ হাজার ১৩০টি।

উৎপাদিত গুড় প্রথমে স্থানীয় হাটে বিক্রি হয়, পরে পাইকারদের মাধ্যমে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। যশোরের খেজুর গুড় এখন বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক উদ্যোক্তাদের হাত ধরে গুড় ও পাটালি সরাসরি ভোক্তার ঘরে পৌঁছানো হচ্ছে। এতে বাজার যেমন সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান।

কৃষি বিভাগের উদ্যোগ

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, যশোরের খেজুর গুড়ের স্বাদ ও মানের কারণে চাহিদা সব সময় বেশি। এবার শীত বেশি হওয়ায় রসের পরিমাণ ও মান—দুটোই ভালো। চলতি মৌসুমে প্রায় ১২০ কোটি টাকার রস ও গুড় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নিরাপদ খেজুর রস এবং গুড় উৎপাদনে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে গাছিদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

ইসলামি ১০ ও সরকারি ৬ ব্যাংক: ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২৭
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা
গ্রাফিক্স: আজকের পত্রিকা

দেশের ব্যাংকিং খাতের ভেতরে জমে থাকা অনিয়ম, রাজনৈতিক আশ্রয় ও কৃত্রিম হিসাবের পর্দা চলতি বছর যেন একে একে সরে যেতে শুরু করেছে। আর তাতেই সামনে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। সরকারি ও শরিয়াহভিত্তিক ইসলামি ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের ভারে এখন কার্যত দিশেহারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৪৯ দশমিক ৬৫ শতাংশে, আর ইসলামি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে তা আরও বেশি—৫৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ, এই দুটি খাতেই বিতরণ করা ঋণের অর্ধেকের বেশি অনাদায়ি হয়ে পড়েছে। যেখানে বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপির হার ৪১ দশমিক ৯৫ ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপির হার মাত্র ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শরিয়াহভিত্তিক ১০টি ইসলামি ব্যাংক মোট ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা ঋণ বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৫ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, প্রতি ১০ টাকার প্রায় ৬ টাকাই এখন আদায় অনিশ্চিত। সেই তুলনায় শরিয়াহসহ দেশীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৬৩ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এই তুলনাতেই স্পষ্ট, খেলাপির বোঝা এককভাবে সবচেয়ে বেশি ইসলামি ব্যাংকগুলোর ঘাড়েই।

সরকারি ছয় ব্যাংকের অবস্থাও খুব একটা ভিন্ন নয়। এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৯২ কোটি টাকা। মোট বিতরণ করা ঋণের প্রায় অর্ধেকই সেখানে অনাদায়ি। ব্যাংকার ও বিশ্লেষকদের মতে, এই সংকট রাতারাতি তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে দুর্বল তদারকি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে আড়াল করার প্রবণতা ধীরে ধীরে ব্যাংকগুলোকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, খেলাপি ঋণের এত উচ্চ হার শুধু ব্যাংকিং খাতের ভেতরের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় ঝুঁকি। ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে পারছে না, বিনিয়োগ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে, শিল্প-কারখানার সম্প্রসারণ থেমে যাচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থানে। তাঁর মতে, খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ঋণ আদায়ে বাস্তবসম্মত উদ্যোগ ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়।

ইসলামি ব্যাংকিং খাতে এস আলম, নাসা ও বেক্সিমকো গ্রুপের নাম বারবার আলোচনায় এসেছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, দীর্ঘদিন সরকারি মদদে এসব গ্রুপ বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হলেও তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। এখন সেই বাস্তবতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট।

সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যাংকিং খাতের চিত্র আরও উদ্বেগজনক। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ১৮ লাখ ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে প্রায় ৬ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর যে অপচেষ্টা ছিল, তা এখন ভেঙে পড়েছে। সঠিক হিসাব সামনে আসায় হার ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা বাস্তবতারই প্রতিফলন। তিনি আবারও শীর্ষ ১০ খেলাপির জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান জানান, আগের সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রকাশ পাওয়ায় এই হার বেড়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ঋণ আদায়ে কঠোর নির্দেশনার কারণে আগের তুলনায় আদায় বেড়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত