Ajker Patrika

এশিয়ার অর্থনীতির টাইম বোমা এখন তরুণদের বেকারত্ব

আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১৭: ২৪
এশিয়ার অর্থনীতির টাইম বোমা এখন তরুণদের বেকারত্ব

এশিয়ার কয়েকটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশে তরুণদের বেকারত্বের হার দিনদিন বাড়ছে। তবে দেশগুলো বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এসব দেশের তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। বাংলাদেশে এখন তরুণ বেকারদের হার বেড়ে ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল এক প্রতিবেদনে এ খবর জানিয়েছে। 

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য অনুসারে, অতি দারিদ্র্য কমানোর ক্ষেত্রে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ। গত এক দশকে প্রতিবছর গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে যুব বেকারত্বের হার ১৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা গত তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। 

চীন এবং ভারতেও যুব বেকারত্বের হার একই। আর ইন্দোনেশিয়ায় এটি ১৪ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় সাড়ে ১২ শতাংশ। জনবহুল এসব দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। তাঁরা হন্য হয়ে চাকরি খুঁজলেও কপালে জুটছে না কিছুই। আইএলওর তথ্য অনুসারে, বিশ্বব্যাপী মোট বেকার যুবকদের সংখ্যা সাড়ে ৬ কোটি, এর প্রায় অর্ধেকই এশিয়ায়। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং জার্মানির মতো ধনী দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এই পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ দেখায়। প্রথম বিশ্বের এসব দেশের তরুণেরা দ্রুতই চাকরি পায়। তবে ধীরে বর্ধনশীল দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশ ইতালি এবং স্পেনের চিত্র সন্তোষজনক নয়, এসব দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ তরুণ কাজ পাচ্ছে না। 

যেসব এশীয় দেশে চীনের বড় কোনো কারখানা নেই, উচ্চ বেকারত্বের সেসব দেশ উন্নয়ন ও ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই যুব বেকারত্বের সর্বশেষ বিস্ফোরণ ঘটেছে বাংলাদেশে। ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে ১৫ বছরের শক্ত স্বৈরতন্ত্র ফেলে দেশ ছাড়তে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ভারতের অর্থনীতি গত বছর ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল এ বছরের নির্বাচনে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। 

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের যুব বেকারত্ব কমলেও বিশ্বব্যাপী গড়ের ওপরে রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মোদির বিপর্যয়ের প্রধান কারণ এই যুব বেকারত্ব। 

চীনে রেকর্ড এক পঞ্চমাংশেরও বেশি যুবক কাজ পাচ্ছে না। এর ফলে দেশটির সরকার গত বছর যুব বেকারত্বের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেনি। ইন্দোনেশিয়ার ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আসছে বড় অংশে খনন এবং খনিজ প্রক্রিয়াকরণ থেকে। এসব খাতে প্রচুর ভারী মেশিন কাজ করে, মানুষ নয়। 

এশিয়ার দেশগুলোর তরুণদের বেকারত্বের হার। ছবি: সংগৃহীত অনেক দেশে ২০ বছর বয়সীরা ভালো কাজ পাচ্ছে না। গত বছর দক্ষিণ এশিয়ায় ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী কর্মীদের ৭১ শতাংশ অনিরাপদ কাজ নিযুক্ত। দুই দশক আগে এটি রেকর্ড ৭৭ শতাংশ ছিল, সেদিক থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে এই হার কমেনি। 

বিশ্বব্যাপী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার মোট শ্রমশক্তির তুলনায় বাড়ছেই। চীনের হাত ধরে উন্নয়নের মইয়ে পা দেওয়া উন্নয়নশীল এশিয়ার বিভিন্ন অংশজুড়ে এই চিত্র আরও ভয়াবহ। এমন পরিস্থিতে প্রশ্ন উঠছে, উন্নয়নের সেই মই কি তবে ভেঙে গেছে? 

বিশ্বের তৈরি পোশাকশিল্পের কেন্দ্র হয়ে বাংলাদেশ অতি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়েছে। বড় বড় পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জিন্স, শার্ট এবং সোয়েটার তৈরি করেছে। লাখ লাখ শ্রমিক কৃষি ছেড়ে কারখানায় কাজ শুরু করেছে। এরপর হঠাৎ থমকে গেছে বাংলাদেশ। ইলেকট্রনিকস, ভারী যন্ত্রপাতি বা সেমিকন্ডাক্টরের মতো জটিল কিন্তু উচ্চমূল্যের উৎপাদন ব্যবস্থায় যেতে পারেনি, যেসব সেক্টর উচ্চ দক্ষ কর্মী ও ভালো বেতনের চাকরি সৃষ্টি করে। এসব উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্টি করেই জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়েছে। এখন সেই প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়েছে।

যেসব দেশ এখন সেমিকন্ডাক্টরের মতো পণ্য তৈরি করতে চায়, তাঁদের অবশ্যই সুদক্ষ চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত অর্থনীতির দেশও সেমিকন্ডাক্টরের মতো নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চাইছে। প্রকৃতপক্ষে, উৎপাদন ব্যবস্থায় অটোমেশনই যুবকদের বেকার করছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পও শ্রমশক্তির চেয়ে মেশিনের দিকে ঝুঁকছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে, তবে এই সময়ে এ খাতে সামগ্রিক কর্মসংস্থান অনেক ধীর গতিতে বেড়েছে। 

এরপরই রয়েছে যোগ্যতা অনুসারে কাজ না পাওয়া। এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রতি বছর অনেক যুবক উচ্চশিক্ষা এবং কলেজ ডিগ্রি অর্জন করছে। শিক্ষাজীবন শেষে তাঁরা নকশা, বিপণন, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতির মতো ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণির (হোয়াইট-কলার) চাকরি খোঁজেন। কিন্তু তাঁদের দেশে এমন কাজের সেক্টর খুবই স্বল্প। 

উদাহরণস্বরূপ, ভারত তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ে তুলেছে, তবে খাতের কাজও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কবজায় যেতে বসেছে। বেঙ্গালুরুর আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটির ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের ২৫ বছরের কম বয়সী স্নাতকদের ৪০ শতাংশেরও বেশি বেকার। একই বয়সীদের ১১ শতাংশ শিক্ষিত কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করেনি। 

চীনের তাইঝুতে একটি চাকরি মেলা। ছবি: সংগৃহীত ফিনল্যান্ডের ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটি ওয়ার্ল্ড ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস রিসার্চের ডিরেক্টর কুনাল সেন বলেন, এখন যুবকেরা শিক্ষিত হয়েছে, যেখানে তাঁদের মা-বাবা ছিলেন না। এসব যুবক তাঁদের মা-বাবার মতো চাকরিতে আটকে থাকতে চান না। আমি মনে করি, এই সমস্যা রাজনীতিকেরা বুঝতে পারেননি। 

২০২২ সালের সরকারি জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশে যাদের কলেজ ডিগ্রিধারীদের বেকারত্বের হার মোট সংখ্যার তিনগুণ। দেশের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে বেকাররা বই নিয়ে পীড়াপীড়ি করেন। তাঁরা প্রথম, দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয়বারের চেষ্টায় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করতে মরিয়া। তাঁদের অনেকে এখনো বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে।

২৮ বছর বয়সী আকতারুজ্জামান ফিরোজ, ২০২১ সালে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৫০টি পদের জন্য আবেদন করা সত্ত্বেও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি এ বছর একটি সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন, যেখানে দুটি পদের জন্য ৫০০ জন আবেদনকারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত গেলেও চাকরি পাননি।

কোনোমতে চলার জন্য ফিরোজ তাঁর বাবার কাছ থেকে টাকা নেন। তাঁর নিম্নস্তরের সরকারি কর্মচারী বাবার সম্প্রতি ওপেন-হার্ট সার্জারি করতে হয়েছে। বিয়ে এখন তাঁর কাছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তাই সেই আশা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি নিজের খরচ চালাতে না পারি, পরিবারের দায়িত্ব নিতে না পারি, তবে কীভাবে বিয়ে করব?’ 

বেশির ভাগ বাংলাদেশি যুবক সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহী, কারণ দেশটির অনুন্নত বেসরকারি খাতে মর্যাদাপূর্ণ (হোয়াইট-কলার) চাকরি পাওয়া যায় না। সেই সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযুদ্ধ কোটা রাখার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। 

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ২৬ বছর বয়সী ছাত্রনেতা আসিফ মাহমুদ এখন সরকারের যুব ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তিনি ওয়াল স্ট্রিটকে বলেন, ‘এই বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল চাকরির সংকট।’ স্নাতক পাস করা বেকার হ্রাস করতে স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিল্পের সঙ্গে কাজ করতে সক্ষম করা তাঁর লক্ষ্য। 

আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য মোট কাজের সুযোগ যথেষ্ট নয়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন

ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ৮০০ কোটি টাকার একটি সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বন্ডটি অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) তালিকাভুক্ত করতে হবে।

আজ বুধবার ৯৮৮তম কমিশন সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

বিএসইসি জানায়, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ৮০০ কোটি টাকা মূল্যের আনসিকিউরড, নন-কনভার্টিবল, ফুললি রিডিমেবল, ফ্লোটিং রেট, কুপন বিয়ারিং সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব কমিশন সভায় অনুমোদন করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্ডটি হবে আনসিকিউরড, অর্থাৎ এর বিপরীতে ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট সম্পদ জামানত হিসেবে রাখছে না। একই সঙ্গে এটি নন-কনভার্টিবল, ফলে ভবিষ্যতে এই বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ থাকবে না। তবে বন্ডটি ফুললি রিডিমেবল, অর্থাৎ মেয়াদ শেষে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের সম্পূর্ণ মূল টাকা ফেরত পাবেন।

এই বন্ডের কুপন রেট বা সুদের হার হবে ফ্লোটিং রেট, অর্থাৎ বাজারভিত্তিক রেফারেন্স রেটের সঙ্গে ওঠানামা করবে। বন্ডটি কুপন বিয়ারিং, ফলে বিনিয়োগকারীরা নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদ পাবেন।

বন্ডটির কুপন রেট নির্ধারণ করা হয়েছে রেফারেন্স রেটের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ কুপন মার্জিন যোগ করে। অর্থাৎ, যদি রেফারেন্স রেট ৮ শতাংশ হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা মোট ১১ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। ভবিষ্যতে রেফারেন্স রেট বাড়লে বা কমলে বন্ডের কুপন রেটও সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে।

এই বন্ড প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, উচ্চসম্পদশালী ব্যক্তি, স্থানীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানিগুলো এতে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। বন্ডটির প্রতি ইউনিটের অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

বিএসইসি জানায়, এই বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ ব্যাসেল–৩ নীতিমালার অধীনে ইস্টার্ন ব্যাংকের টায়ার-২ মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করতে ব্যবহার করা হবে। আন্তর্জাতিক এই নীতিমালার লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো এবং আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা জোরদার করা।

ব্যাংকিং খাতে টায়ার-২ মূলধনের মধ্যে সাধারণত সাব-অর্ডিনেট বন্ড অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা দেউলিয়াত্বের ক্ষেত্রে আমানতকারী ও অন্যান্য বড় ঋণের পরে পরিশোধযোগ্য। এ কারণে এসব বন্ড তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদের হার সাধারণত বেশি হয়ে থাকে।

বন্ডটির ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি। আর ইস্যুর অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

  • পাঁচ মাসেই ব্যয় কমেছে ৬ হাজার কোটি।
  • শুধু নভেম্বরে ব্যয় কমেছে ৪ হাজার কোটি।
  • সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট।
  • নির্বাচন ইস্যুতে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৪
আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের উন্নয়ন ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়ে, তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বড় হলেও বাস্তব অগ্রগতি একেবারেই হতাশাজনক।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ১১.৭৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় পিছিয়ে আছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যেন এগোচ্ছেই না। সরকারি তহবিল, বৈদেশিক সহায়তা ও সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন—প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন ব্যয়ের এ তিন উৎসের প্রতিটিতেই যেন মন্থরতা লক্ষণীয়।

শুধু অর্থবছরের সার্বিক পরিস্থিতিই নয়, এডিপির মাসওয়ারি অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নভেম্বর মাসের তথ্য আরও চিন্তার। এই এক মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৮ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার মতো, যেখানে আগের বছরের নভেম্বরেই ব্যয় ছিল ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক মাসেই ব্যয় কমে গেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতির হার মাত্র ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধীরগতি কোনো স্বাভাবিক মৌসুমি প্রবণতা নয়; বরং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ভেতরে জমে থাকা নানা অচলাবস্থার ফল।

প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব, টেন্ডারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া, দক্ষ ঠিকাদারের অভাব, মাঠপর্যায়ে প্রকৌশল বিভাগগুলোর সংকোচন—এসব মিলেই উন্নয়ন ব্যয় জমে থাকছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনে তৈরি হওয়া মন্থরতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা। আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে পুরো প্রশাসনিক কাঠামো একধরনের অচল অবস্থায় ছিল, যার ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যয়ে বৈষম্যও স্পষ্ট। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সংসদবিষয়ক সচিবালয় মন্ত্রণালয় পাঁচ মাসে এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। কিছু বিভাগ অগ্রগতি দেখালেও, তা সমগ্র চিত্র বদলে দেওয়ার মতো নয়। বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ ১৩২.৭৮ শতাংশ ব্যয় করেছে, যা বরাদ্দের চেয়েও বেশি ব্যয়—এটি চলমান প্রকল্পগুলোর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইএমইডির মতে, প্রকৃত ব্যয় ও আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যকার এ ধরনের ব্যবধান ভবিষ্যতে প্রকল্প মূল্যায়নকে আরও জটিল করে তুলবে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, ‘বাস্তবায়নের হার স্পষ্টতই কম। শুধু সংখ্যা নয়, কেন এই অবস্থা, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় ব্যবস্থাপনায় আরও ধীরতা দেখা দিতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে সাধারণত কিছুটা ধীরতা দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাধারণত ঝুঁকিনির্ভর হয় না, ফলে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

সব মিলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দ্বিধা এবং মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা মিলিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন—এমনটি ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেও।

চলতি অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসে যে গতি দেখা গেছে, তাতে বছরের শেষে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্ন এখন আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডলারের বিপরীতে রুপির আরও দরপতন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত

যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান আরও ২৩ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ০১-এ পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে এখন পর্যন্ত এটিই রুপির সর্বনিম্ন দর। ধারাবাহিক বিদেশি তহবিলের প্রস্থান, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনায় স্থবিরতা এবং স্থায়ী ডলার ক্রয়কে এই পতনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার দিনের শুরুতে রুপি ৩৬ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ১৪-এ পৌঁছায়, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন, পরে সামান্য পুনরুদ্ধার হয়। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে এবং ডলারের শক্তি কিছুটা কমেছে, তারপরও রুপির পতন অব্যাহত রয়েছে।

গত ১০টি লেনদেনের দিনে রুপি ৯০ থেকে ৯১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু গত পাঁচ দিনে রুপির মান ডলারের তুলনায় ১ শতাংশ কমেছে। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম চলতি মাসে ৯২ ছাড়িয়ে যাবে।  

আজ মঙ্গলবার আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রুপি ৯০ দশমিক ৮৭ থেকে লেনদেন শুরু হয়। পরে ৯০ দশমিক ৭৬ থেকে ৯১ দশমিক ১৪-এর মধ্যে ওঠানামা করে। শেষে ৯১ দশমিক ০১-এ বন্ধ হয়। গত সোমবার রুপি ৯০ দশমিক ৭৮-এ বন্ধ হয়েছিল, যা আগের দিনের তুলনায় ২৯ পয়সা কম।

ফিনরেক্স ট্রেজারি অ্যাডভাইজার্সের হেড অব ট্রেজারি অনিল কুমার বানসালি বলেন, ‘ডলারের ক্রয় অব্যাহত থাকায় রুপি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের নতুন বাণিজ্য প্রস্তাব মেনে না নেওয়ায় চুক্তি স্থগিত রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৬
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি পেপ্যাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, এটি পেপ্যাল ব্যাংক তৈরি করার জন্য ইউটাহ ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস এবং ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে আবেদন জমা দিয়েছে।

পেপ্যালের প্রধান নির্বাহী অ্যালেক্স ক্রিস বলেন, ‘পুঁজির নিরাপত্তা ছোট ব্যবসাগুলোর বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। পেপ্যাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা ছোট ব্যবসার উন্নয়ন এবং মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।’

১৯৯৮ সালে ইলন মাস্ক ও পিটার থিয়েল পেপ্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি গ্রাহককে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। মার্কিন ব্যাংকিং লাইসেন্স পাওয়ার পর কোম্পানি তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রাহকের আমানতকে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে বিমার আওতায় আনতে পারবে।

পেপ্যালের আবেদন এসেছে এমন সময়ে, যখন একাধিক ক্রিপ্টো কোম্পানি এবং নিওব্যাংক এই বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি সুবিধা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিং খাতে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে। এ বছরের মধ্যে নুবাঙ্ক, কয়েনবেসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং চার্টারের জন্য আবেদন করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত