Ajker Patrika

আ. লীগ আমলের মামলায় অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নের বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতের পরোয়ানা

অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ছবি: সংগৃহীত
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির ফেডারেল আদালতের বিচারক অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বিরুদ্ধে আদালতে হাজিরের পরোয়ানা জারি করেছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের এখতিয়ার চ্যালেঞ্জ করেছে। গতকাল শুক্রবার পরোয়ানা স্থগিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী।

দুই যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া চুক্তি বাতিলে একটি মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানির মামলায় তাঁদের সাক্ষ্য দেওয়ার কথা ছিল বলে আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে মোট ৩১ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারের সালিসি ক্ষতিপূরণ আদায় করার চেষ্টা করছে। বিচারক কার্ল জে. নিকোলস ইউএস মার্শাল সার্ভিসকে নির্দেশ দেন যেন, সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং আহসান এইচ মনসুরকে আদালতে হাজির করার জন্য আটক করা হয়। এই নির্দেশের পরই বাংলাদেশ সরকার তাৎক্ষণিকভাবে আপিল করে।

বাংলাদেশ সরকার ডিসি সার্কিট আদালতকে জানায়, বিচারক নিকোলসের এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির কোনো এখতিয়ার নেই। এছাড়া, যাদের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি হয়েছে, তাঁরা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ কূটনীতিক। তাঁদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি মামলা হতে পারে না। সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দায়মুক্তি দেওয়া আছে।

মার্কিন বিদ্যুৎ কোম্পানি স্মিথ কোজেনারেশন গত বুধবার আদালত অবমাননার আবেদন করে। তাদের দাবি, সালেহউদ্দিন আহমেদ ও আহসান এইচ মনসুর সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বুধবার হাজির হওয়ার নির্দেশ অমান্য করেছেন। স্মিথ কোজেনারেশন আদালতকে জানায়, এই নির্দেশ না পেলে বাংলাদেশ সরকার আদালতের কর্তৃত্বকে অবজ্ঞা করতে থাকবে এবং সাক্ষ্য দেওয়ার নোটিশগুলোর কোনো জবাব দেবে না।

চলতি সপ্তাহে সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং আহসান এইচ মনসুর বর্তমানে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক সম্মেলনে ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করার কথা।

স্মিথ কোজেনারেশন জানায়, এই সাক্ষ্য নেওয়া তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটি কোম্পানির সালিসি ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তিতে সহায়ক হবে।

আবেদনে বলা হয়েছে, প্রদেয় সম্পত্তির অবস্থান সম্পর্কে এই দুই ব্যক্তির ঘনিষ্ঠভাবে জানাশোনা রয়েছে। তাঁরা নিশ্চিতভাবে মূল্যবান তথ্য দিতে পারবেন। এ ছাড়া বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট দাতাসংস্থাগুলোর বাংলাদেশ সরকারকে ৩ বিলিয়ন ডলার অনুদান দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

আবেদনে আরও বলা হয়েছে, কোম্পানির বিশ্বাস, এই তহবিলের একটি অংশ সরকারের ঋণদাতাদের ঋণ বা সুদ পরিশোধে ব্যবহৃত হবে। সুতরাং, আবেদনকারীকে অতি দ্রুত তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন রয়েছে, যাতে তহবিল হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যে কোনো অধিকার সুরক্ষিত রাখা যায়।

স্মিথ কোজেনারেশন দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ২০০২ ও ২০০৩ সালের সালিশি রায়গুলো কার্যকর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

এই বিরোধের শুরু ১৯৯৭ সালে, যখন স্মিথ কোজেনারেশন বাংলাদেশ সরকার এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে একটি বার্জ–মাউন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য এটি করা হয়েছিল। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ।

স্মিথ কোজেনারেশন ২০০৬ সালে ওয়াশিংটন ডিসি আদালতে এটি বাস্তবায়নের জন্য আবেদন করে। সরকার তাদের প্রকল্প সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় সব অনুমোদন দিতে সম্মতও হয়েছিল বলে নথিতে উল্লেখ রয়েছে।

তবে, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সরকার প্রকল্পটি বাতিল করে এবং কোম্পানিকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন কখনোই দেয়নি। এরপর তারা ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন পারফরমেন্স বন্ড গ্যারান্টি ফেরত দেয় যা স্মিথ কোজেনারেশন সরকারকে দিয়েছিল।

কোম্পানিটি সেই বছর আইসিসি ট্রাইবুনালে সালিশের প্রক্রিয়া শুরু করে। ট্রাইবুনাল পরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ১৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার দিতে নির্দেশ দেয়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে অতিরিক্ত ৩৯ হাজার ডলার পরিশোধ করতেও বলা হয়। পিডিবি ও বাংলাদেশ সরকারকে আরও মোট ২ লাখ ২২ হাজার ডলার দেওয়ার নির্দেশ দেয় বলে আদালতে দেওয়া নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

ডিসির ফেডারেল বিচারক ২০০৭ সালে এই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ পুনর্বহাল রাখেন। সে বছরের মে মাসে স্মিথ কজেনারেশন–এর অনুরোধে আদালত চূড়ান্ত রায় দেন। স্মিথ কজেনারেশন–এর আইনজীবী সংবাদমাধ্যম ল’ ৩৬০–কে জানিয়েছেন, সুদ এবং অন্যান্য খরচসহ স্মিথ কজেনারেশনকে এখন ৩১ মিলিয়নের ডলার বেশি অর্থ দিতে বাধ্য থাকবে বাংলাদেশ।

স্মিথ কজেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড–এর পক্ষে আদালতে প্রতিনিধিত্ব করছেন ব্রায়ান এইচ. পান্ড্যা, হ্যারল্ড ই. প্যাট্রিকফ, জেসিকা ম্যারোকুইন এবং প্রিসিলা বান্দেইরা।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করছেন অ্যান্ড্রু বি. লোয়েনস্টাইন, মার্ক ডি. ফিনস্টারওয়াল্ড, ক্রিস্টিনা জি. হিউরাস, নিকোলাস এম. রেন্জলার এবং জেমস এম. গ্রস।

এই মামলা স্মিথ কজেনারেশন (বাংলাদেশ) প্রাইভেট লিমিটেড বনাম বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং অন্যান্য নামে আদালতে নথিভুক্ত। মামলা নম্বর 1: 06-cv-01827। ইউএস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া–তে এই মামলা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারী তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক একটি চুক্তি বাতিলের দায়ে স্মিথ কোজেনারেশন ক্ষতিপূরণ দাবি করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে একটি মামলা করে। ১৯৯৭ সালে স্মিথ কোজেনারেশন তৎকালীন বাংলাদেশের সরকারের সাথে একটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে একটি বার্জ-মাউন্টেড বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের জন্য অনুমতি প্রদান করেছিল সরকার। এই মামলায় দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর পর ওয়াশিংটন ডিসি সার্কিট কোর্ট অনেকটা এখতিয়ার বহির্ভূত একটি রায় প্রদান করে, যা আজ শুক্রবার আদালত কর্তৃক স্থগিত করা হয়। যদিও বিষয়টির সাময়িক অবসান ঘটেছে তবে লুটেরা সরকারের দায় রক্তস্নাত বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিতে পারে না। বাংলাদেশ সরকারের সে সময়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে এবং বিষয়টি বর্তমান সরকারের নজরে না এনে ধামাচাপাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
ইস্টার্ন ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকার বন্ড অনুমোদন

ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ৮০০ কোটি টাকার একটি সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বন্ডটি অল্টারনেটিভ ট্রেডিং বোর্ডে (এটিবি) তালিকাভুক্ত করতে হবে।

আজ বুধবার ৯৮৮তম কমিশন সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ।

বিএসইসি জানায়, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ৮০০ কোটি টাকা মূল্যের আনসিকিউরড, নন-কনভার্টিবল, ফুললি রিডিমেবল, ফ্লোটিং রেট, কুপন বিয়ারিং সাব-অর্ডিনেট বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব কমিশন সভায় অনুমোদন করা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বন্ডটি হবে আনসিকিউরড, অর্থাৎ এর বিপরীতে ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট সম্পদ জামানত হিসেবে রাখছে না। একই সঙ্গে এটি নন-কনভার্টিবল, ফলে ভবিষ্যতে এই বন্ডকে শেয়ারে রূপান্তরের সুযোগ থাকবে না। তবে বন্ডটি ফুললি রিডিমেবল, অর্থাৎ মেয়াদ শেষে বিনিয়োগকারীরা তাঁদের সম্পূর্ণ মূল টাকা ফেরত পাবেন।

এই বন্ডের কুপন রেট বা সুদের হার হবে ফ্লোটিং রেট, অর্থাৎ বাজারভিত্তিক রেফারেন্স রেটের সঙ্গে ওঠানামা করবে। বন্ডটি কুপন বিয়ারিং, ফলে বিনিয়োগকারীরা নির্দিষ্ট সময় পরপর সুদ পাবেন।

বন্ডটির কুপন রেট নির্ধারণ করা হয়েছে রেফারেন্স রেটের সঙ্গে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ কুপন মার্জিন যোগ করে। অর্থাৎ, যদি রেফারেন্স রেট ৮ শতাংশ হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীরা মোট ১১ শতাংশ হারে সুদ পাবেন। ভবিষ্যতে রেফারেন্স রেট বাড়লে বা কমলে বন্ডের কুপন রেটও সেই অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে।

এই বন্ড প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে ইস্যু করা হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠান, উচ্চসম্পদশালী ব্যক্তি, স্থানীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিমা কোম্পানিগুলো এতে বিনিয়োগের সুযোগ পাবে। বন্ডটির প্রতি ইউনিটের অভিহিত মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ লাখ টাকা।

বিএসইসি জানায়, এই বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ ব্যাসেল–৩ নীতিমালার অধীনে ইস্টার্ন ব্যাংকের টায়ার-২ মূলধন ভিত্তি শক্তিশালী করতে ব্যবহার করা হবে। আন্তর্জাতিক এই নীতিমালার লক্ষ্য হলো ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ততা বাড়ানো এবং আর্থিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা জোরদার করা।

ব্যাংকিং খাতে টায়ার-২ মূলধনের মধ্যে সাধারণত সাব-অর্ডিনেট বন্ড অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা দেউলিয়াত্বের ক্ষেত্রে আমানতকারী ও অন্যান্য বড় ঋণের পরে পরিশোধযোগ্য। এ কারণে এসব বন্ড তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিনিয়োগকারীদের জন্য সুদের হার সাধারণত বেশি হয়ে থাকে।

বন্ডটির ট্রাস্টি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে ডিবিএইচ ফাইন্যান্স পিএলসি। আর ইস্যুর অ্যারেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে ইবিএল ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

  • পাঁচ মাসেই ব্যয় কমেছে ৬ হাজার কোটি।
  • শুধু নভেম্বরে ব্যয় কমেছে ৪ হাজার কোটি।
  • সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট।
  • নির্বাচন ইস্যুতে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।
‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৪
আইএমইডির নভেম্বর মাসের প্রতিবেদন: এডিপি বাস্তবায়নে বড় ধাক্কা

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই সরকারের উন্নয়ন ব্যয় আশঙ্কাজনকভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। মাঠপর্যায়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন যেমন প্রত্যাশার তুলনায় অনেক পিছিয়ে, তেমনি সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সমন্বয় ঘাটতি, প্রশাসনিক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাবও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার বড় হলেও বাস্তব অগ্রগতি একেবারেই হতাশাজনক।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ২৮ হাজার ৪৩ কোটি টাকা, যা বরাদ্দের মাত্র ১১.৭৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৩৪ হাজার ২১৫ কোটি টাকা বা ১২ দশমিক ২৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় পিছিয়ে আছে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর থেকে স্পষ্ট হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প যেন এগোচ্ছেই না। সরকারি তহবিল, বৈদেশিক সহায়তা ও সংস্থাগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন—প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়ন ব্যয়ের এ তিন উৎসের প্রতিটিতেই যেন মন্থরতা লক্ষণীয়।

শুধু অর্থবছরের সার্বিক পরিস্থিতিই নয়, এডিপির মাসওয়ারি অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, নভেম্বর মাসের তথ্য আরও চিন্তার। এই এক মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে ৮ হাজার ১৬৫ কোটি টাকার মতো, যেখানে আগের বছরের নভেম্বরেই ব্যয় ছিল ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এক মাসেই ব্যয় কমে গেছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে অগ্রগতির হার মাত্র ৩ দশমিক ৪২ শতাংশ। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ধীরগতি কোনো স্বাভাবিক মৌসুমি প্রবণতা নয়; বরং প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ভেতরে জমে থাকা নানা অচলাবস্থার ফল।

প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব, টেন্ডারপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া, দক্ষ ঠিকাদারের অভাব, মাঠপর্যায়ে প্রকৌশল বিভাগগুলোর সংকোচন—এসব মিলেই উন্নয়ন ব্যয় জমে থাকছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনে তৈরি হওয়া মন্থরতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা। আইএমইডি কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময়ে পুরো প্রশাসনিক কাঠামো একধরনের অচল অবস্থায় ছিল, যার ধাক্কা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।

মন্ত্রণালয়ভিত্তিক ব্যয়ে বৈষম্যও স্পষ্ট। বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও সংসদবিষয়ক সচিবালয় মন্ত্রণালয় পাঁচ মাসে এক টাকাও ব্যয় করতে পারেনি। কিছু বিভাগ অগ্রগতি দেখালেও, তা সমগ্র চিত্র বদলে দেওয়ার মতো নয়। বিপরীতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সর্বোচ্চ ১৩২.৭৮ শতাংশ ব্যয় করেছে, যা বরাদ্দের চেয়েও বেশি ব্যয়—এটি চলমান প্রকল্পগুলোর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আইএমইডির মতে, প্রকৃত ব্যয় ও আর্থিক প্রতিবেদনের মধ্যকার এ ধরনের ব্যবধান ভবিষ্যতে প্রকল্প মূল্যায়নকে আরও জটিল করে তুলবে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলছেন, ‘বাস্তবায়নের হার স্পষ্টতই কম। শুধু সংখ্যা নয়, কেন এই অবস্থা, সেটাই এখন সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন।’ বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় ব্যবস্থাপনায় আরও ধীরতা দেখা দিতে পারে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, অর্থবছরের শুরুতে সাধারণত কিছুটা ধীরতা দেখা গেলেও এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। নির্বাচনকালীন প্রশাসন সাধারণত ঝুঁকিনির্ভর হয় না, ফলে প্রকল্পের গতি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল।

সব মিলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রশাসনিক দ্বিধা এবং মাঠপর্যায়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা মিলিয়ে এডিপি বাস্তবায়ন যে পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন খুব কঠিন—এমনটি ধারণা করা হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেও।

চলতি অর্থবছরে এডিপি বরাদ্দ ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু প্রথম পাঁচ মাসে যে গতি দেখা গেছে, তাতে বছরের শেষে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি অর্জন আদৌ সম্ভব হবে কি না, সে প্রশ্ন এখন আরও তীব্র হয়ে উঠছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ডলারের বিপরীতে রুপির আরও দরপতন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত
ভারতীয় রুপি ও মার্কিন ডলার। ছবি: সংগৃহিত

যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির মান আরও ২৩ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ০১-এ পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে এখন পর্যন্ত এটিই রুপির সর্বনিম্ন দর। ধারাবাহিক বিদেশি তহবিলের প্রস্থান, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য আলোচনায় স্থবিরতা এবং স্থায়ী ডলার ক্রয়কে এই পতনের মূল কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়, গতকাল মঙ্গলবার দিনের শুরুতে রুপি ৩৬ পয়সা কমে ৯১ দশমিক ১৪-এ পৌঁছায়, যা ইতিহাসের সর্বনিম্ন, পরে সামান্য পুনরুদ্ধার হয়। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমেছে এবং ডলারের শক্তি কিছুটা কমেছে, তারপরও রুপির পতন অব্যাহত রয়েছে।

গত ১০টি লেনদেনের দিনে রুপি ৯০ থেকে ৯১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। শুধু গত পাঁচ দিনে রুপির মান ডলারের তুলনায় ১ শতাংশ কমেছে। মুদ্রা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে রুপির দাম চলতি মাসে ৯২ ছাড়িয়ে যাবে।  

আজ মঙ্গলবার আন্তব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা রুপি ৯০ দশমিক ৮৭ থেকে লেনদেন শুরু হয়। পরে ৯০ দশমিক ৭৬ থেকে ৯১ দশমিক ১৪-এর মধ্যে ওঠানামা করে। শেষে ৯১ দশমিক ০১-এ বন্ধ হয়। গত সোমবার রুপি ৯০ দশমিক ৭৮-এ বন্ধ হয়েছিল, যা আগের দিনের তুলনায় ২৯ পয়সা কম।

ফিনরেক্স ট্রেজারি অ্যাডভাইজার্সের হেড অব ট্রেজারি অনিল কুমার বানসালি বলেন, ‘ডলারের ক্রয় অব্যাহত থাকায় রুপি নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতের নতুন বাণিজ্য প্রস্তাব মেনে না নেওয়ায় চুক্তি স্থগিত রয়েছে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ২২: ৫৬
যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের আবেদন করল পেপ্যাল

ডিজিটাল পেমেন্ট কোম্পানি পেপ্যাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাংকিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে। কোম্পানিটি জানিয়েছে, এটি পেপ্যাল ব্যাংক তৈরি করার জন্য ইউটাহ ডিপার্টমেন্ট অব ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস এবং ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে আবেদন জমা দিয়েছে।

পেপ্যালের প্রধান নির্বাহী অ্যালেক্স ক্রিস বলেন, ‘পুঁজির নিরাপত্তা ছোট ব্যবসাগুলোর বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। পেপ্যাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা ছোট ব্যবসার উন্নয়ন এবং মার্কিন অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারব।’

১৯৯৮ সালে ইলন মাস্ক ও পিটার থিয়েল পেপ্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী ৪ লাখ ২০ হাজারের বেশি গ্রাহককে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। মার্কিন ব্যাংকিং লাইসেন্স পাওয়ার পর কোম্পানি তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে গ্রাহকের আমানতকে ফেডারেল ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স করপোরেশনে বিমার আওতায় আনতে পারবে।

পেপ্যালের আবেদন এসেছে এমন সময়ে, যখন একাধিক ক্রিপ্টো কোম্পানি এবং নিওব্যাংক এই বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি সুবিধা নিয়ে নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিং খাতে প্রবেশের সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা করছে। এ বছরের মধ্যে নুবাঙ্ক, কয়েনবেসসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং চার্টারের জন্য আবেদন করেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত