Ajker Patrika

৬০ কোটি ডলারের বকেয়ায় আটকে এলএনজি আমদানি, বিদ্যুতের ভোগান্তি চরমে

শাহ আলম খান, ঢাকা
আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২: ৩১
৬০ কোটি ডলারের বকেয়ায় আটকে এলএনজি আমদানি, বিদ্যুতের ভোগান্তি চরমে

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছে আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতে সরকারের বিপুল বকেয়া জমেছে। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাবদ সরকারের বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬০৭ দশমকি ৩৫ মিলিয়ন বা ৬০ কোটি ডলারের বেশি। এই বকেয়া পরিশোধ না করায় নতুন করে এলএনজি কেনা বন্ধ আছে। গ্যাস সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বড় ঘাটতিতে ব্যাপক লোডশেডিং চলছে সারা দেশে। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস অবস্থার মধ্যে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ে জনজীবনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। মানুষের ভোগান্তির সঙ্গে অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে জ্বালানিসংকট।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান উপকরণ ডিজেল, পেট্রল, অকটেন, ফার্নেস অয়েল ও এলএনজি। দেশে ব্যবহৃত এসব জ্বালানির শতকরা ৬০ ভাগই আমদানি করতে হয়। এখন জ্বালানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এতে কয়েক দিন ধরেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন কমেছে।

দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মোট উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৮ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৬ হাজার ৫০০ থেকে ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে কমপক্ষে ২ হাজার মেগাওয়াট। ফলে ব্যাপক মাত্রায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে।

ডলার-সংকটের কারণে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সময় এলএনজির পরিশোধ করা যায়নি। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন সচল রাখতে প্রয়োজনীয় জ্বালানির নিশ্চয়তা এবং বকেয়া অর্থ চাইছে। কিন্তু সরকারের কাছে ডলারের ঘাটতি থাকায় তা মেটানো যাচ্ছে না। এখন জ্বালানিসংকট তীব্র হওয়ার এটা বড় কারণ। আট মাস ধরেই এ পরিস্থিতি চলতে থাকায় মজুত জ্বালানিও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। ভারতের আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। আদানি গ্রুপ বকেয়া শোধের তাগিদ দিয়ে চিঠি দিয়েছে।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বকেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত

এলএনজি আমদানির বকেয়া বিলের পরিমাণ ছিল ৬৩ কোটি ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর কাতার এনার্জিকে এর একটা ছোট অংশ (আড়াই কোটি ডলার) পরিশোধ করেছে সরকার। জ্বালানি সরবরাহ অব্যাহত রাখতে বাকি ৬০ কোটি ডলার দ্রুত পরিশোধের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে থাকে। এর আগে আইটিএফসি থেকে ঋণ নিয়ে কাতার এনার্জির দুটি বিল গত মে ও জুলাই মাসে পরিশোধ করেছিল জ্বালানি বিভাগ। মে মাসে আইটিএফসির সেই ঋণের একটি কিস্তিও বকেয়া পড়ে।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন মতে, গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৯ আগস্ট পর্যন্ত মার্কিন কোম্পানি শেভরনের মোট সাতটি বিল বকেয়া পড়েছে। শেভরনের সরবরাহ করা গ্যাসের বকেয়া জমেছে ২২৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার। ১০ সেপ্টেম্বর কোম্পানিটিকে ৩ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। গত বুধবার অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাকি অর্থ পরিশোধ করার অনুরোধ করেছেন শেভরনের কর্মকর্তারা।

চুক্তির বাইরে দ্রুত সরবরাহ পেতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভিটল এশিয়া, গানভর সিঙ্গাপুর প্রাইভেট লিমিটেড ও এক্সেলারেট এনার্জির মাধ্যমে গ্যাস কিনেছে জ্বালানি বিভাগ। এ তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্যাসের দামের ৮৭ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।

জানা গেছে, বকেয়ার অঙ্ক বেশি থাকায় ২ ও ৯ সেপ্টেম্বর দুই কার্গো এলএনজি খালাস না করে সরবরাহকারীরা ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ পর্যন্ত নিয়েছিল। পরে জ্বালানি বিভাগ জরুরিভাবে অনুরোধ করে তা খালাসের ব্যবস্থা করে।

আটকে ছিল এলএনজি আমদানির উদ্যোগ
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলন চলাকালে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার বৈঠক সময়মতো হয়নি। এ কারণে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানির কয়েকটি প্রস্তাবের অনুমোদন আটকে ছিল। আন্দোলন ঠেকাতে বিগত সরকার দীর্ঘ সময় ইন্টারনেট বন্ধ রাখায় বিদেশের সঙ্গে লেনদেন করা সম্ভব হয়নি। এর ফলেও বকেয়ার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। এ ছাড়া কয়েক মাস আগে ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে কক্সবাজারের দুটি ভাসমান স্টোরেজ অ্যান্ড রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিটের (এফএসআরইউ) মধ্যে একটি অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে আমদানি করা এলএনজি খালাসের সক্ষমতাও অর্ধেকে নেমে আসে। গত বুধবার থেকে দুটি এফএসআরইউ সচল হয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এগুলোর মাধ্যমে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

আশাবাদ জানালেন উপদেষ্টা
চলমান বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের পরিকল্পনা জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, সংকট কাটাতে দ্রুত জ্বালানি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর কিছু আসবে দীর্ঘমেয়াদি প্যাকেজে। আর কিছু আসবে তাৎক্ষণিক কেনার স্পট মার্কেট থেকে। উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন, ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে জ্বালানি আসা শুরু হবে। এই জ্বালানি এলেই পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতিমধ্যে কিছু পেমেন্ট হয়েছে। এটি চলমান থাকবে। তবে এই বকেয়া শুধু জ্বালানির ক্ষেত্রেই নয়। সারসহ আরও নানা রকম বকেয়া আছে। এর মধ্যেই আমরা যতটা পারি সমন্বয় করার চেষ্টা করছি।’

এ বিষয়ে ভোক্তা–অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্থনীতির চক্রাকার তৎপরতাকে সচল রাখার মূল চাবিকাঠি হচ্ছে জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। একইভাবে চাহিদামাফিক বিদ্যুতের সরবরাহ দেওয়া। তাই সরকারের এখন উচিত, সব উন্নয়ন প্রকল্পের বিনিয়োগ স্থগিত এবং সেই অর্থ প্রত্যাহার করে অবিলম্বে জ্বালানি খাতে বরাদ্দের মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের পথ তৈরি করা।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈঠক: স্মার্টফোনে নগদ সহায়তা ইন্টারনেটে ছাড়ের প্রস্তাব

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নগদবিহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য বাস্তবায়নে স্মার্টফোন কেনা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে ভর্তুকি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিউআর কোড চালু থাকলেও কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পাওয়ায় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে এই নতুন উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট স্মার্টফোনে ব্যবহৃত সিমের ওপর কর ও ভ্যাট কমানোর বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এসব প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তারা জানান, নগদবিহীন লেনদেন প্রসারে একক ও আন্তসংযোগ-ভিত্তিক পেমেন্ট সিস্টেম চালুর বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হন অংশগ্রহণকারীরা। প্রস্তাবগুলো পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত আকারে উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ‘বাংলা কিউআর’ চালুর মাধ্যমে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) অ্যাপ ব্যবহার করে নগদবিহীন লেনদেন শুরু হয়। বর্তমানে এই ব্যবস্থায় ৪৩টি ব্যাংক, ৫টি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) এবং ৩টি পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) যুক্ত রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি এখনো জনপ্রিয়তা পায়নি। গবেষণায় দেখা গেছে, স্মার্টফোনের অভাব, সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ব্যয় এবং অতিরিক্ত চার্জের কারণে প্রান্তিক ও সাধারণ গ্রাহকদের বড় একটি অংশ এই ব্যবস্থার বাইরে রয়ে গেছে।

এই বাস্তবতায় স্মার্টফোন কেনায় নগদ সহায়তা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে বিশেষ ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পাশাপাশি মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবাকে সাশ্রয়ী করতে অপারেটরদের জন্য ভ্যাট ও করছাড় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে দেশের খুচরা লেনদেনের অন্তত ৭৫ শতাংশ ডিজিটাল মাধ্যমে সম্পন্ন করা হবে। আর ২০৩১ সালের মধ্যে সব ধরনের লেনদেন ক্যাশলেস করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’-এর চার স্তম্ভ—স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ বাস্তবায়নের অংশ। এই লক্ষ্যে ব্যাংক, এমএফএস, মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য পেমেন্ট সেবাদাতাকে একটি একক আন্তসংযোগ ব্যবস্থার আওতায় আনার কাজ চলছে। ইন্টারঅপারেবিলিটি পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সহজে টাকা আদান-প্রদানের সুযোগ তৈরিই এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশকে ক্যাশলেস করতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের কাছে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে স্মার্টফোন পৌঁছাতে হবে। প্রয়োজনে এ জন্য বিশেষ সুবিধাও দেওয়া হবে। একই সঙ্গে শিগগির সব সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরে ২৪ ঘণ্টা ‘রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট সিস্টেম’ চালুর কথাও জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পেমেন্ট সিস্টেম প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে এখনো ৭২ শতাংশের বেশি লেনদেন নগদে হচ্ছে। যদিও ছোট ও মাঝারি অঙ্কের লেনদেনে ডিজিটাল ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, ডিজিটাল অবকাঠামো শক্তিশালী করা এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি নিশ্চিত করা ছাড়া ক্যাশলেস অর্থনীতি গড়া সম্ভব নয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নগদনির্ভরতা কমাতে হলে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রতি আস্থা তৈরি করতে হবে। একবার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে মুদ্রণ ব্যয়সহ আর্থিক ব্যবস্থাপনার খরচও উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ক্যাশ ইজ কিং’ ধারণা এখনো বাস্তবতা। দেশের অধিকাংশ লেনদেন অনানুষ্ঠানিক খাতে হয়। এসব খাতকে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার আওতায় না আনলে ক্যাশলেস সমাজ গড়া কঠিন। নগদে স্বচ্ছন্দ থাকার পুরোনো মানসিকতার কারণে এই রূপান্তরে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

অর্থবছরের ৫ মাস: রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি

আসাদুজ্জামান নূর, ঢাকা 
আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪৩
অর্থবছরের ৫ মাস: রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি
ছবি: সংগৃহীত

রাজস্ব খাতে ব্যাপক সংস্কার এবং সব খাতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাপনা (অটোমেশন) চালুর উদ্যোগের পাশাপাশি কর্মকর্তাদের বাড়তি তৎপরতা সত্ত্বেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) লক্ষ্য অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করতে পারছে না। প্রতিমাসে রাজকোষের হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে ঘাটতির ব্যবধান স্পষ্ট হচ্ছে এবং চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত সেই ধারাবাহিকতা বজায় আছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১ লাখ ৭৩ হাজার ২৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে মাত্র ১ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা বা ১৩.৮৯ শতাংশ।

তবে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো—রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধি হয়েছে ১৫.১৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায় হয়েছিল ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা।

এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, ব্যবসা-বাণিজ্যের ধীরগতির কারণে রাজস্ব আদায় প্রত্যাশার তুলনায় কম হয়েছে। তবে বছরের শেষ দিকে সাধারণত আদায় বাড়ে। করের আওতা বৃদ্ধি, কর পরিপালন জোরদার করা এবং ফাঁকি প্রতিরোধে এনবিআর সক্রিয়।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা বলছেন, সামগ্রিক অর্থনৈতিক মন্দাভাব, কাঠামোগত দুর্বলতা ও সক্ষমতার অভাব সরাসরি রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তা ছাড়া অর্থবছরের মাঝপথে লক্ষ্যমাত্রা একলাফে ৫৫ হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর কারণে বাস্তবতার সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার ব্যবধান আরও প্রকট হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। তবে ১০ নভেম্বর বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটি তা ৫ লাখ ৫৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করে। ফলে বাকি সাত মাসে এনবিআরকে ৪ লাখ ৫ হাজার ২৪ কোটি টাকা আদায় করতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এ প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রতিবছর রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি থাকে। প্রধান কারণ হলো এনবিআরের সক্ষমতার চেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ। মানবসম্পদ, কারিগরি দক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা পর্যাপ্ত নয়; পাশাপাশি করদাতা এবং করযোগ্য ব্যক্তির মধ্যে বড় ব্যবধান রয়েছে, কর ফাঁকিও প্রচুর। বর্তমান ব্যবসায়িক মন্দা, খরচ বৃদ্ধি, আয় হ্রাস এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগ কমে যাওয়াও রাজস্ব আদায়ে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো, অটোমেশন ও সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন করলে রাজস্ব ফাঁকি রোধ করে আদায় বাড়ানো সম্ভব।

সাবেক আমলা ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, এনবিআরের সামর্থ্যের চেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি প্রশাসনিক পদে বড় রদবদলের কারণে কার্যক্রম গোছাতে কিছুটা সময় লাগা স্বাভাবিক।

রাজস্ব খাত অনুযায়ী, ভ্যাট থেকে সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। প্রথম পাঁচ মাসে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৫৮ হাজার ২৩১ কোটি টাকা, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা; ঘাটতি ৩ হাজার ৮১৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা বা ৬.১৫ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১.৯৭ শতাংশ।

দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাজস্ব আসে আয়কর খাতে। আদায় হয়েছে ৪৭ হাজার ৮৮১ কোটি, লক্ষ্যমাত্রা ৫৯ হাজার ৯৯৫ কোটি ২৫ লাখ; ঘাটতি ২০.১৯ শতাংশ। আগের বছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ শতাংশ। কাস্টমস বা শুল্ক খাতে ৪২ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা আদায় হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা ৫০ হাজার ৯৭৯ কোটি ৫৬ লাখ; ঘাটতি ১৫.৯১ শতাংশ, তবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫.২৮ শতাংশ।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার অপরিহার্য। এনবিআরের মানবসম্পদ, প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রক্রিয়ার সরলীকরণ এবং অটোমেশন কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আদালতের রায়ে ইতিহাস গড়লেন ইলন মাস্ক, সম্পদ ছাড়াল ৭০০ বিলিয়ন ডলার

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ২৪
টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত
টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্ক। ছবি: সংগৃহীত

পে প্যাকেজ বা বেতন-ভাতাসংক্রান্ত একটি মামলার রায়ের পর টেসলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্কের সম্পদ গত শুক্রবার রাতে ৭৪৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকেছে।

ফোর্বসের বিলিয়নিয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ডেলাওয়্যার সুপ্রিম কোর্ট মাস্কের ১৩৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের টেসলা স্টক অপশনগুলো পুনর্বহাল করার পরই তাঁর সম্পদে এই বিশাল উল্লম্ফন দেখা যায়।

উল্লেখ্য, গত বছর আদালত এই সুবিধাগুলো বাতিল করেছিলেন।

২০১৮ সালে মাস্কের যে বেতন প্যাকেজের মূল্য ৫৬ বিলিয়ন ডলার ছিল, সেটিই গত শুক্রবার ডেলাওয়্যার সুপ্রিম কোর্ট পুনর্বহাল করেন। এর দুই বছর আগে নিম্ন আদালত ওই পারিশ্রমিক চুক্তিকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যা দিয়ে বাতিল করেছিলেন।

সুপ্রিম কোর্ট রায়ে বলেছেন, ২০২৪ সালে দেওয়া যে সিদ্ধান্তে বেতনের প্যাকেজটি বাতিল করা হয়েছিল, তা সঠিক ছিল না এবং মাস্কের প্রতি অন্যায্য ছিল।

এর আগে চলতি সপ্তাহে মহাকাশ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স শেয়ারবাজারে আসতে পারে—এমন প্রতিবেদনের পর মাস্কের সম্পদ ৬০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এর মধ্য দিয়ে তিনি ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এই মাইলফলক স্পর্শ করেন।

এদিকে গত নভেম্বরে টেসলার শেয়ারহোল্ডাররা আলাদাভাবে মাস্কের জন্য ১ ট্রিলিয়ন ডলারের একটি পারিশ্রমিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেন।

এটি করপোরেট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বেতন প্যাকেজ। বিনিয়োগকারীরা বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা টেসলাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসভিত্তিক এক শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরে মাস্কের পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানান।

ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী, মাস্কের বর্তমান সম্পদমূল্য গুগলের সহপ্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের চেয়ে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার বেশি। ল্যারি পেজ বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পুঁজিবাজারে নথি জমা এখন এক ক্লিকে

‎নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা‎
পুঁজিবাজারে নথি জমা এখন এক ক্লিকে

দীর্ঘদিন ধরে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর তথ্য জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া ছিল জটিল ও সময়সাপেক্ষ। একই তথ্য বারবার ছাপিয়ে আলাদা স্টক এক্সচেঞ্জে জমা দিতে হতো। এ সমস্যার সমাধান হিসেবে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সম্প্রতি চালু করেছে সম্পূর্ণ অনলাইনভিত্তিক স্মার্ট সাবমিশন সিস্টেম (এসএসএস)।

নতুন এই সিস্টেমের মাধ্যমে কোম্পানি ও ফান্ডগুলো মূল্য সংবেদনশীল ঘোষণা, আর্থিক প্রতিবেদন ও অন্যান্য রেগুলেটরি ফাইলিং কাগজ ছাড়াই অনলাইনে জমা দিতে পারবে। এতে সময় ও খরচ কমার পাশাপাশি তথ্য ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা এবং ট্র্যাকিং ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

ডিএসই সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া এই প্ল্যাটফর্ম ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। সর্বশেষ দুটি নতুন মডিউল যুক্ত হওয়ায় এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তথ্য একই ডিজিটাল গেটওয়ে দিয়ে জমা দেওয়া সম্ভব। ফলে দ্বৈত সাবমিশনের ঝামেলা প্রায় সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে কাগুজে নথির ওপর নির্ভরতা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে। ডিজিটাল সাবমিশন শুধু সুবিধার বিষয় নয়, এটি বাজার শৃঙ্খলা ও সময়ানুবর্তিতা নিশ্চিত করার একটি কাঠামোগত পরিবর্তন।

ডিএসই জানায়, চায়নিজ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে কাজ করে প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতা বাড়ানোর পর সিস্টেমটি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে ভবিষ্যতে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ফিচার যুক্ত করা সহজ হবে।

প্রযুক্তিগত দিক থেকে এর গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে ডিএসইর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা ড. মো. আসিফুর রহমান বলেন, একক ডিজিটাল সাবমিশন পয়েন্ট চালু হওয়ায় ম্যানুয়াল হস্তক্ষেপজনিত ভুল কমবে এবং তথ্য জমার প্রতিটি ধাপ ডিজিটালি যাচাইযোগ্য থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই উদ্যোগের প্রভাব শুধু স্টক এক্সচেঞ্জেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত