Ajker Patrika

এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণে কাটা হবে শতবর্ষীসহ ৪৬ গাছ, আন্দোলনে পরিবেশবাদীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম
এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণে কাটা হবে শতবর্ষীসহ ৪৬ গাছ, আন্দোলনে পরিবেশবাদীরা

চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে র‍্যাম্প নির্মাণের জন্য শতবর্ষীসহ ৪৬টি গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরই মধ্যে নগরীর টাইগারপাস ও সিআরবি এলাকার এসব গাছ কাটার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। তবে পরিবেশবাদীরা এসব গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, গাছ কাটার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা অবিলম্বে না আসলে জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। 

আজ সোমবার ওই র‍্যাম্প নির্মাণে গাছ কাটার বিরোধিতা করে দিনভর নগরীর টাইগারপাস মোড়ে শতবর্ষী গাছের নিচে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে পরিবেশবাদীরা। 

সমাবেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ডা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যদি র‍্যাম্প করতে হয়, অনেক জায়গা আছে এখানে গাছ কেটে কেন করতে হবে। এখানে কোনো গাছ কাটা চলবে না। প্রকৃতি অক্ষুণ্ন রেখে যে কোনো কিছু করতে পারে, তারা সেটা করুক। মূল লক্ষ্য এসব শতবর্ষী গাছ ও দ্বিতল রাস্তাটি নষ্ট করে সিআরবির পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করা। শতবর্ষী গাছ কেটে নতুন চারা লাগানোর কোনো প্রয়োজন নেই।’ 

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, ‘যারা এসব সিদ্ধান্ত নেন তারা বিভিন্ন স্বার্থে কাজ করেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমন সব লোককে ওপরে বসান, যাদের কোনো ট্রেনিং নেই। এই গাছগুলো থেকে নানা রকম সুবিধা পেয়ে থাকি এটা নিয়ে তারা অবহিত নন। প্রকৃতি থেকে যে আমরা নানা সুবিধা পাই, এসব নিয়ে তাদের জানাশোনা, জ্ঞান কিছু নেই। এসব জায়গায় যারা বসেন তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত।’ 

পরিবেশবাদী অধ্যাপক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ‘যারা ৬ কিলোমিটার রাস্তা করতে ১৮টি গাছ কাটে তারা মানুষ নামের শকুন। জলাবদ্ধতা নিরসনে তাঁদের দারুণ দক্ষতা আমরা দেখেছি। যারা সিআরবি ধ্বংস করতে পারেনি তারা এখন সিআরবির প্রতিবেশ ধ্বংস করতে চায়। তাঁরা বলছে মাত্র ৪৬টি গাছ কাটা হবে। এটা কেমন মূর্খতা। তারা শতবর্ষী গাছ কেটে চারা লাগাতে চায়। ধিক্কার জানানোর ভাষা আমাদের নেই।’ 

চট্টগ্রামের টাইগারপাস–সিআরবি সড়কের শতবর্ষী গাছ এবং একমাত্র দ্বিতল সড়ক রক্ষার দাবিতে নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ। ছবি: আজকের পত্রিকা খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগরী কমিটির সভাপতি একিউএম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এই সড়ক শুধু চট্টগ্রামের নয়। দেশের ও বিশ্ব প্রকৃতির সম্পদ। যা সৃষ্টি করতে পারবেন না, তা কেন ধ্বংস করছেন। এই নান্দিকতা দেশের সম্পদ। সিডিএর লোকজন যা বলছেন তা হঠকারিতা। সিআরবির মাটি কামড়ে আমরা পড়েছিলাম। এখানে এক টুকরো মাটিও কাটতে দেওয়া হবে না। নয়তো আমরা প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে এই সম্পদ রক্ষা করব। অবিলম্বে সিডিএ সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ঘোষণা দিন। নিউমার্কেট থেকে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের অনেক বিকল্প আছে।’ 

নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘বারবার চট্টগ্রামের প্রকৃতির ওপর আঘাত কেন? এখন গাছ নষ্ট করে কেন। বিকল্প অনেক সুযোগ ছিল। কিন্তু তারা সেটা করছে না। আবারও বলছি, এর বিকল্প ভাবুন।’ 

চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‍্যাম্প নির্মাণের জন্য নগরীর টাইগারপাস থেকে রেলওয়ে পাবলিক হাইস্কুল গেট পর্যন্ত সড়কের মাঝখানে থাকা ছোট–বড় গাছ কাটবে সিডিএ। শতবর্ষী গাছগুলো কাটার জন্য দেওয়া হয়েছে চিহ্নিত করণ নম্বর। নগরীর সিআরবি এলাকায়। ছবি: হেলাল সিকদার। নাট্যজন ও সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজি বলেন, ‘দ্রুত বিকল্প স্থানে র্যাম্প করার ঘোষণা না দিলে লাগাতার আন্দোলন করে আমরা টাইগারপাস সিআরবির এই সড়ক ও গাছ রক্ষা করব।’ 

প্রতিবাদ সমাবেশে আরও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। 

গাছগুলো কাটার জন্য দেওয়া হয়েছে চিহ্নিতকরণ নম্বর। নগরীর সিআরবি এলাকায় আজ সোমবার। ছবি: হেলাল সিকদার। চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ নভেম্বর ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। মূল অংশের নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ শেষ না হওয়ায় যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়নি। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। 

মূল এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি ওঠা–নামার জন্য ১৫টি র্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে দুটি আছে নগরের টাইগারপাসে। দুটি র্যাম্পের মধ্যে টাইগারপাস থেকে পলোগ্রাউন্ড পর্যন্ত মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কে গাড়ি ওঠার র্যাম্প নির্মাণ করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বাকেরগঞ্জে একই ঘরে ৩ জন অচেতন, বৃদ্ধার লাশ উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল
সন্ধ্যা রানী সাহাকে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা
সন্ধ্যা রানী সাহাকে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ছবি: আজকের পত্রিকা

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার কবাই ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের মোল্লার বাজার সংলগ্ন মরণ সাহার বাড়িতে চেতনানাশক স্প্রে করে পরিবারের সবাইকে অচেতন করে মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এসময় ঘরের মালিক মরণ সাহার মা অঞ্জলি রানী সাহা (৯০) মারা গেছেন। গুরুতর অবস্থায় অচেতন মরণ সাহা (৫৫) কে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে ও তার স্ত্রী সন্ধ্যা রানী সাহা (৪৮) কে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, মোল্লার বাজার সংলগ্ন ওই ঘরে বসবাস করেন প্রশান্ত কুমার ওরফে মরণ সাহা, তার মা অঞ্জলি সাহা এবং স্ত্রী সন্ধ্যা রানী। প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে তারা খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। দুপুর পর্যন্ত তাদের কাউকে বাইরে দেখা না যাওয়ায় এবং ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ অবস্থায় দেখে স্থানীয়রা ডাকাডাকি করেন। কোনো সাড়া না পেয়ে একপর্যায়ে তারা দরজা ভেঙে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। এ সময় ঘরের মেঝেতে তিনজনকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার মধ্যে অঞ্জলি সাহাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। এ সময় ঘরের মালামাল এলোমেলো অবস্থায় পড়ে ছিল।

স্থানীয় লোকজন দ্রুত তাদের উদ্ধার করে বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক প্রশান্ত সাহাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সন্ধ্যা রানীকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ভর্তি করে চিকিৎসা দিয়েছেন।

বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, মরণ সাহার স্ত্রী সন্ধ্যা রানীর অবস্থা অনেকটা ভালো। তবে মরণ সাহা বেশি অসুস্থ ও অজ্ঞান থাকায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এপারে বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম সোহেল রানা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, কারা কিভাবে ঘটনা ঘটিয়েছে তা নিশ্চিত নয়। প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে, চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে। দুষ্কৃতকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য কাজ চলছে এবং ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

পটুয়াখালীর কলাপাড়া: এক রাখাইন পরিবারের ৪০ একর জমি দখল

  • রাখাইন পরিবারটি অস্ট্রেলিয়ায় থাকার সুযোগে জমি জবরদখল ও বিক্রি
  • অতিরিক্ত সচিবের বিরুদ্ধে ১৫৫ শতাংশ দখলের লিখিত অভিযোগ
  • ভুয়া আমমোক্তারনামা মূলে প্রতারণার মাধ্যমে কবলা দলিল তৈরি
মীর মহিবুল্লাহ, পটুয়াখালী
অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন রাখাইন পরিবারের সদস্যরা। সেই সুযোগে তাঁদের জমিগুলো দখল করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সরকারি কর্মকর্তা। সম্প্রতি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কালাচানপাড়ায়। ছবি: আজকের পত্রিকা
অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন রাখাইন পরিবারের সদস্যরা। সেই সুযোগে তাঁদের জমিগুলো দখল করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সরকারি কর্মকর্তা। সম্প্রতি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কালাচানপাড়ায়। ছবি: আজকের পত্রিকা

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলী ইউনিয়নের কালাচানপাড়ায় একটি রাখাইন পরিবারের প্রায় ৪০ একর জমি জবরদখল হয়েছে। গত ১৫ বছরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা, সরকারি কর্মকর্তাসহ প্রভাবশালীরা জালিয়াতির মাধ্যমে অধিকাংশ জমি দখলে নিয়ে বিক্রি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ২৩ নভেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. খাদেম উল কায়েস ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ওই জমির ১৫৫ শতাংশ দখলের লিখিত অভিযোগ করা হয়। প্রধান বিচারপতি, আইন উপদেষ্টা, আইনসচিবসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে অভিযোগ পাঠিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন জমির মালিক লাচাউ রাখাইন।

লাচাউ রাখাইনের স্বজনেরা জানান, লাচাউয়ের স্বামী অংশাচিং রাখাইন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় (এফএও) কর্মকর্তা হিসেবে বহু বছর কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি চাকরিসূত্রে বদলি হন অস্ট্রেলিয়ায়। তারপর থেকে তিনি পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস শুরু করেন। লাচাউ রাখাইন ও তাঁর দুই ছেলে পরে সেখানকার নাগরিকত্বও পান। যদিও তাঁরা প্রতিবছর কলাপাড়ার কালাচানপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে আসতেন। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অংশাচিং অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে বছর তাঁদের আর দেশে আসা সম্ভব হয়নি। দুই ছেলে সেখানকার সরকারি চাকরিতে থাকায় তাঁরাও দেশে ফিরতে পারেননি। এভাবেই কেটে যায় এক যুগ।

লাচাউয়ের স্বজনদের অভিযোগ, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে লাচাউ রাখাইন দেশে এসে জানতে পারেন, তিনি ও তাঁর দুই ছেলের নামে ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করে একাধিক নকল খতিয়ান, জাল দলিল এবং ভুয়া উত্তরাধিকার সনদ বানানো হয়েছে। এসব নথির ভিত্তিতে তাঁদের জমি আত্মসাৎ করা হয়। আর এ দখলে নেতৃত্ব দিয়েছেন কুয়াকাটা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বারেক মোল্লা, তাঁর ভাই ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সভাপতি হোসেন মোল্লাসহ অনেক নেতা। যাঁরা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে পলাতক। এ ছাড়া রয়েছেন আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাদেম উল কায়েস, তাঁর ভাই মাওলানা হারুন ও বেয়াই ইউসুফ মুসল্লিসহ কয়েকজন।

এই চক্রের বিভিন্ন সদস্যের বিরুদ্ধে জালিয়াতির মামলা করায় লাচাউদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি দেশে এসেছিলেন লাচাউ রাখাইন ও তাঁর বড় ছেলে উয়েন চিং রাখাইনের স্ত্রী খেনমা ম্যা। লাচাউ রাখাইন (৮৬) বলেন, ‘আমি জমি উদ্ধার করতে গেলে আমাকে হুমকি-ধমকি দেয়; যাতে আমরা এলাকায় না যেতে পারি। এই অন্যায়ের সঙ্গে যারা জড়িত, আমি তাদের সবার বিচার চাই বাংলাদেশ সরকারের কাছে।’

অভিযোগে যা আছে

অতিরিক্ত সচিব খাদেম উল কায়েসের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগের বিবরণ অনুযায়ী, কলাপাড়ার আলীপুর মৌজার ৬৩ নম্বর বিএস খতিয়ানের ৪২০৪, ৫, ৬, ১১, ১২, ৭৪ ও ৪৪৪২, ৪৩৮৭ এবং ৪৬১০ নম্বর দাগের ৮.০৬ একর ভূমির মালিক লাচাউ রাখাইন ও তাঁর পরিবার। তবে তাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালে লাচাউ রাখাইন ও তাঁর দুই ছেলে উয়েন চিং ও ম্যাওয়েন চিংয়ের নামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ও অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনের সিল ও সই জাল করে ২০০০ সালের ৮ আগস্ট ক্ষমতাপত্র তৈরি করা হয়। ওই আমমোক্তারনামা মূলে জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে খাদেম উল কায়েস তাঁর স্ত্রী মোসা. আইরিন জেসমিন ও বেয়াই মো. ইউসুফ মুসল্লির নামে ২০১০ সালের ১১ এপ্রিল কবলা দলিল তৈরি করে ১৫৫ শতাংশ জমি দখল করেন।

ওই আমমোক্তারনামার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ১৬ জুন জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের প্রথম আদালতে লাচাউ বাদী হয়ে মামলা করেন। বিচারক মামলাটি পটুয়াখালী সদর থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ ও সিআইডিকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আমমোক্তারনামার বৈধতা যাচাইয়ে সিআইডি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তথ্য চাইলে ২০২৫ সালের ২৪ এপ্রিল রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর (আরডিসি) মো. তানজিল কবির স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে জানানো হয়, ক্যানবেরায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ‘৪৩০ নম্বর আমমোক্তারনামা’ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ২৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও আদালতকে এই আমমোক্তারনামা-সংক্রান্ত কোনো তথ্য না পাওয়ার কথা জানায়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কুয়াকাটা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি বারেক মোল্লা আলীপুর মৌজার ১০৪২ এসএ খতিয়ান এবং ৩০৫ নম্বর বিএস খতিয়ানের জমি জাল কাগজ তৈরি করে কিছু দখল করেছেন। অন্যদিকে তাঁর ভাই এলাকার যুবলীগের সাবেক সভাপতি হোসেন মোল্লা একই ১০৪২ এসএ খতিয়ান ও ১৭৬১ নম্বর বিএস খতিয়ানের ২১৯ দাগ থেকে ১৮ শতাংশ, ৪৭৪ নম্বর খতিয়ান, ১০৮৬ ও ১০৮৮ খতিয়ান থেকে ৮.৫০ শতাংশ এবং ৬২ নম্বর খতিয়ানের ৪২০৬ দাগ থেকে ১২ শতাংশ জমি দখল করে বিভিন্ন স্থানে বসতবাড়ি ও মার্কেট নির্মাণ করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা ৪৩০টি ভুয়া আমমোক্তারনামা নোটারি করে এসব জমি নিজেদের দখলে নেন।

এ বিষয়ে হোসেন মোল্লা মোবাইল ফোনে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা, ভুল কথা। আমরা অংশাচির কাছ থেকে দলিল নিয়েছি, তিনি আমাদের কাছে বিক্রি করেছেন, বসাইয়াও দিয়েছেন। ২০১০ সালের পর কিছু জমি দখল হয়েছে, সেটা তো আমরা করিনি।’

জানতে চাইলে বারেক মোল্লা মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘দলিল ছাড়া আমার জমি নাই ১ শতাংশও। আমার জমি তাদের থেকে নিলে অল্প নেওয়া থাকতে পারে। কিন্তু আমার জমি অন্য মানুষের থেকে নেওয়া, মংচোবার থেকে নেওয়া। এ ছাড়া তাদের অনেক জমি আছে, তারা দলিল দেয় নাই। কিন্তু মানুষ দখল করে আছে। দলিল দেছে, আর না দেছে, সব অংশাচি বাবুর ডায়েরিতে লেখা আছে। সে যদি আসে এবং একদিন বসে কোটি কোটি টাকার জমি বের হয়ে যাবে।’

সরেজমিন চিত্র

সম্প্রতি এক বিকেলে আলীপুরের থ্রি পয়েন্টের পশ্চিম পাশে গিয়ে লাচাউয়ের অভিযোগে উল্লেখ করা দাগের ২১ শতাংশ জমির ওপর একটি মার্কেট দেখা যায়। সেখানে রয়েছে ৮টি দোকান এবং পেছনে নির্মিত হয়েছে ৫টি বসতঘর। এলাকাবাসীর ভাষ্য, এই মার্কেটটি ‘খাদেম উল কায়েস জজের মার্কেট’ নামে পরিচিত। এর আশপাশে অধিকাংশ জমি ইউসুফ মুসল্লি বিভিন্নজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে দখল বুঝিয়ে দিয়েছেন।

এ সময় কথা হয় ওই মার্কেটের ঝালাইয়ের দোকানদার মো. কালামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানি, এটা জজ (খাদেম উল) সাহেবের জমি, তাঁর বউয়ের নামে। এখানে ৮টি দোকান ও ৫টির মতো ঘর আছে। এসবের ভাড়া তাঁর ভাই হারুন মাওলানা উঠান।’

এ সময় ওই এলাকার বাসিন্দা টাইলস দোকানের মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘ইউসুফ মুসল্লির সঙ্গে যুদ্ধ করে আমার আসতে হয়েছে, সে আমার থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়েছে, বলেছে এ জমি সব তাঁর। স্ট্যাম্প আছে। সে এখানে অনেকের কাছ থেকে নিয়েছে। এখনো বলে জমি তাঁর।’ ইসমাইল আরও বলেন, ‘ইউসুফ মুসল্লি বহুত টাকা খাইছে। ১ কোটি টাকার মতো নেছে। উনি (খাদেম উল সাহেব) ওনার (ইউসুফ মুসল্লি) সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় এসে ঠ্যাক (সমর্থন) দিতেন।’

অতিরিক্ত সচিব যা বলেন

অভিযোগের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খাদেম উল কায়েস মোবাইল ফোনে বলেন, ‘আইন, নিয়ম সবার জন্য সমান। সেখানে যদি কোনো ঝামেলা থাকে সেটা কোর্ট দেখবে, অথরিটি দেখবে। কিন্তু কথা হলো, জমি তো সবাই কিনতে পারবে, আল্লাহ যদি সামর্থ্য দেয় আপনি কিনতে পারবেন, আমি ১ ইঞ্চি পারব। আইন আছে, সাবরেজিস্ট্রি অফিস আছে। কেউ যদি কারও প্রতি অন্যায় করে দেখার মতো এজেন্সিও আছে।’

ইউসুফ মুসল্লি ও মাওলানা হারুনের বিষয়ে জানতে চাইলে খাদেম উল কায়েস বলেন, ‘আমার বেয়াই বলে কথা না, আইনে যার জন্য যেটা প্রযোজ্য, তার জন্য সেটাই হবে। ইউসুফ মুসল্লির জবাব সে দেবে। আমার ভাই কিছু করলে তাঁর সাথে কথা বলেন, তাঁরা কী বলে শোনেন। নিয়মের বাইরে গেলে আমরা কেউ কিছু করতে পারব না, সাপোর্ট করি না, করবও না।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইউসুফ মুসল্লি ও মাওলানা হারুনের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল দিলেও তাঁরা রিসিভ করেননি।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাওরে বিদ্যুৎ সংযোগ: বাঁশ দিয়ে ৩৩,০০০ কেভির খুঁটি

  • অষ্টগ্রাম ও মিঠামইনে ৭টি বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের তার
  • বর্ষা মৌসুমে বসানো এসব অস্থায়ী খুঁটি শুষ্ক মৌসুমেও অপসারণ করেনি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি
  • ঝুঁকিপূর্ণ খুঁটি অপসারণের দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের
  • দ্রুত বাঁশের খুঁটি অপসারণ করে সিমেন্টের খুঁটি বসানো হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ
মো. ফরিদ রায়হান,অষ্টগ্রাম (কিশোরগঞ্জ) 
আপডেট : ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭: ৫৬
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের বড় হাওরে বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের তার। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা
কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের বড় হাওরে বাঁশের খুঁটির ওপর দিয়ে টানা হয়েছে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের তার। ছবিটি সম্প্রতি তোলা। ছবি: আজকের পত্রিকা

কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার বড় হাওরে এখন আর থইথই পানি নেই। বিস্তীর্ণ হাওরের মধ্য দিয়ে টানা হয়েছে ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। কিন্তু উচ্চমাত্রার এই বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে। বাঁশ, কাঠ ও জিআই তারের তৈরি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের খুঁটির মাথায় এমন ছয়টি বাঁশের খুঁটি রয়েছে। পাশের উপজেলা মিঠামইনের নবাবপুর হাওরে আরও একটি বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, হাওরে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উচ্চ ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার টানার জন্য বাঁশের খুঁটি ব্যবহার করায় স্থানীয় বাসিন্দারা দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাঁরা দ্রুত এসব খুঁটি অপসারণ করে সিমেন্টের তৈরি খুঁটি স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।

জানা গেছে, গত ১৫ সেপ্টেম্বর অষ্টগ্রামের হাওরে বর্ষার পানির স্রোতে ছয়টি সিমেন্টের খুঁটি পড়ে যায়। এতে সে সময় প্রায় ৭২ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন থাকে অষ্টগ্রাম উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় ৩৩ হাজার গ্রাহক। এর আগে আগস্টে একটি খুঁটি পড়ে গিয়ে সারা দিন বিদ্যুৎ বন্ধ থাকে মিঠামইন সদর ইউনিয়নের নবাবপুরে।

বিস্তীর্ণ হাওরে বর্ষার পানির প্রবল স্রোতের মধ্যে নৌকায় দাঁড়িয়ে তৈরি করতে হয় এসব বাঁশের খুঁটি। ১২-১৪ জন শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান মিলে দুই দিনে তৈরি হয় একেকটি খুঁটি। প্রতিটি অস্থায়ী খুঁটিতে খরচ পড়ে ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা। শুষ্ক মৌসুমে বর্ষায় নির্মিত বাঁশের খুঁটির স্থলে বসানো হয় নতুন বৈদ্যুতিক খুঁটি।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ভাষ্য, বর্ষা মৌসুমে হাওরাঞ্চলে বৈদ্যুতিক খুঁটি পানিতে পড়ে গেলে বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখতে বাঁশের অস্থায়ী খুঁটি ব্যবহার করা হয়। পরে শুষ্ক মৌসুমে তা অপসারণ করে সিমেন্টের তৈরি খুঁটি স্থাপন করা হয়।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মিঠামইন জোনাল অফিসের অধীনে তিন হাওর উপজেলা অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইনে ১০৮ কিলোমিটার ৩৩ হাজার ভোল্টেজ (কেভি) ও ৯৪৫ কিলোমিটার ১১ কেভি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন রয়েছে। তিন উপজেলায় গ্রাহক রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার ৬৩৫ জন। তাদের মধ্যে অষ্টগ্রামে ৩৩ হাজার ৫১৩ জন, মিঠামইনে ২৭ হাজার ৬৫৩ ও ইটনা আংশিকে ১৯ হাজার ৩৬৯ জন গ্রাহক।

বর্ষাকালে বিস্তীর্ণ হাওরের পানিতে থাকা বৈদ্যুতিক খুঁটির গোড়ার মাটি নরম থাকে। এতে পানির স্রোত, ঝড়, নৌকা ও পর্যটকবাহী ট্রলারের ধাক্কায় অনেক সময় হেলে পড়ে। কখনো একেবারেই পড়ে যায় বৈদ্যুতিক খুঁটি। পানিতে ছিঁড়ে পড়ে বৈদ্যুতিক তার। দুর্ঘটনা এড়াতে দু-এক দিন ধরে বন্ধ থাকে কয়েক হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ। ভোগান্তিতে পড়ে লাখো মানুষ।

তবে গত চার বছর আগে হাওরাঞ্চলে বৈদ্যুতিক খুঁটি পড়া রোধে টেকসই স্থায়ী সমাধানের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা প্রস্তাব পাঠানো হয় পল্লী বিদ্যুতের ঊর্ধ্বতন কার্যালয়ে। কিন্তু কোনো কার্যক্রম গ্রহণ হয়নি।

মিঠামইন সদর ইউনিয়নের বিদ্যুৎ গ্রাহক ফরহাদ আহমেদ (৪০) বলেন, ‘পানির সময় কারেন্টের পিলার পড়লে হাওরের পানিতে বাঁশের খুঁটি করে বিদ্যুৎ দেওন ছাড়া কোনো উপায় নাই, তা জানি। বেশি সুবিধা দিতে কিছু অসুবিধাও হয়। তবে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হলে বিপদ কমবে না।’

তিন উপজেলা নিয়ে পরিচালিত মিঠামইন পল্লী বিদ্যুতের জোনাল অফিসের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা) মো. নবী উল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘হাওরে বর্ষাকালে খুঁটি পড়ে গেলে সিমেন্টের তৈরি খুঁটি বসানো সম্ভব হয় না। গ্রাহকের সুবিধার্থে কিছু ঝুঁকি থাকলেও বিকল্প উপায়ে এই বাঁশের খুঁটি দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রাখি। বর্ষা শেষে সরবরাহ লাইন মেরামত করা হয়। এখন পানি নেমে গেছে। দ্রুত বাঁশের খুঁটি অপসারণ করে সিমেন্টের খুঁটি বসানো হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

গভীর নলকূপ খনন: বরেন্দ্রজুড়ে শত শত মৃত্যুকূপ

  • সংকটের মধ্যেও অবৈধ সেমিডিপ বসিয়ে পানির ব্যবসা
  • এক স্থানে পানি না পেলে বোরহোল হচ্ছে অন্য স্থানে
  • ঝুঁকিপূর্ণ এক বোরহোলে পড়ে শিশু সাজিদের মৃত্যু
 রিমন রহমান, রাজশাহী
ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

পানির স্তর নিচে নামছে। নামতে নামতে একটা সময় আর পানিই পাওয়া যাচ্ছে না। তখন অগভীর নলকূপ (সেমিডিপ) তুলে অন্য জায়গায় বসানো হচ্ছে। কিন্তু পুরোনো নলকূপের গর্তটি সেভাবেই পড়ে থাকছে অনেক জায়গায়। আবার নতুন নলকূপ স্থাপনের ক্ষেত্রেও পানি পেতে একাধিক জায়গায় খনন করার প্রয়োজন পড়ছে। তখনো পড়ে থাকছে পরিত্যক্ত গর্তটি। রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর ও নাচোল এবং নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা ও সাপাহার উপজেলায় এ রকম শত শত পরিত্যক্ত গর্ত রয়েছে। এগুলোর ব্যাসার্ধ ৮ থেকে ১২ ইঞ্চি। গত বুধবার এমন একটি মৃত্যুকূপে পড়েই মারা যায় রাজশাহীর তানোরের কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামের রাকিবুল ইসলামের দুই বছরের সন্তান সাজিদ।

বরেন্দ্র অঞ্চলে মূলত কৃষকদের সেচ দেওয়ার কাজটি করে থাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। কৃষিজমিতে সেচের জন্য এই অঞ্চলে তাদের কয়েক হাজার গভীর নলকূপ রয়েছে। এর পাশাপাশি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আরও কয়েক হাজার সেমিডিপ বসে গেছে ব্যক্তিমালিকানায়।

পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামতে থাকায় ২০১৫ সালে বিএমডিএ সিদ্ধান্ত নেয়, তারা নতুন করে আর কোনো গভীর নলকূপ বসাবে না। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা আর গভীর নলকূপ বসাচ্ছেও না। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানায় সেমিডিপ বসানোর কাজ থেমে নেই।

বিদ্যমান সেচ আইন অনুযায়ী বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার গভীর বা অগভীর নলকূপ স্থাপনের কোনো সুযোগ নেই। তারপরও ব্যক্তিমালিকানার সেমিডিপের অনুমোদন দেওয়া হয় সেখানে। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে উপজেলা সেচ কমিটিকে ম্যানেজ করে এসব অনুমোদন দেওয়া হয়। সবশেষ গত বছর তানোরে ৩২টি সেমিডিপ বসানোর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

অনুমোদন না নিয়েও সেমিডিপ

কৃষি দপ্তর থেকে জানা গেছে, তানোর উপজেলায় সেচযন্ত্র আছে ২ হাজার ১৯৫টি। এগুলোর মধ্যে বিএমডিএর গভীর নলকূপ ৫২৯টি। ব্যক্তিমালিকানায় গভীর নলকূপ আছে ১৬টি, বাকিগুলো অগভীর। এর বাইরে প্রায় আড়াই হাজার অনুমোদনহীন সেমিডিপ রয়েছে। শুধু তানোর নয়, গোটা রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে উপজেলা সেচ কমিটির অনুমোদন ছাড়াও শত শত সেমিডিপ চলছে। এসব সেমিডিপ থেকে ৩০ থেকে ৪০ বিঘা পর্যন্ত জমিতে সেচ দেওয়া যায়। কোথাও মুরগির খামার, কোথাও আবাসিক কিংবা ক্ষুদ্রশিল্পের নামে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে নলকূপ বসিয়ে সেচপাম্প চালাচ্ছেন অনেকে।

নিহত শিশু সাজিদের বাড়ি যাওয়ার রাস্তায় পড়ে দুবইল গ্রাম। সরেজমিন দেখা যায়, এই গ্রামের একটি বাড়ির পাশে ‘মোহাম্মদ আলী পোলট্রি খামার’ লেখা সাইনবোর্ড। এর মালিক শফিকুল ইসলাম। খামারে কোনো মুরগি নেই। এর পাশেই বসানো হয়েছে সেমিডিপ। শফিকুল ইসলাম জানান, মুরগির খামারের বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়ে তিনি সেমিডিপ চালাচ্ছেন। তাঁর মতো আরও অনেকে এভাবে সেমিডিপ চালান বলে তিনি জানান।

সংকটের মধ্যে রমরমা ব্যবসা

রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ভূগর্ভস্থ পানি কমছেই। কোথাও কোথাও মাটির ২০০ ফুট গভীরে পানির স্তর পাওয়া যায় না। তাই এই তিন জেলার ৪ হাজার ৯১১ মৌজায় এখন খাওয়ার পানি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তোলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গত ৬ নভেম্বর এ-সংক্রান্ত গেজেট জারি করা হয়।

তবে পানিসংকট নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, এই সংকটের মধ্যেও অবৈধভাবে নতুন নতুন সেমিডিপ ব্যক্তিমালিকানায়। উন্নয়নকর্মী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলে পানি একটি দামি ব্যবসা। এখান থেকে ভালো মুনাফা হয়। অন্তত ৭৫ শতাংশ লাভ থাকে। তাই অবৈধভাবে সেমিডিপ বসানোর প্রতিযোগিতা চলছে। বিভিন্ন আলোচনায় বিএমডিএ দাবি করে, তাদের যত গভীর নলকূপ রয়েছে, তারও বেশি আছে অগভীর নলকূপ।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘এমনিতে মাটির নিচে পানি নেই। তাই মাঝে মাঝে আমরা দেখি, দুই বছর পর এক স্থান থেকে সেমিডিপ সরিয়ে অন্য জায়গায় বসানো হচ্ছে। এটাকে রিবোরিং বলা হয়। খুঁজলে দেখা যাবে, তিন ভাগের এক ভাগ সেমিডিপ এভাবে স্থান বদল করেছে। স্থান পরিবর্তনের পর পাইপের গর্তটিও অনেক স্থানে থেকে গেছে। আবার নতুন সেমিডিপ বসানোর সময় নিচে পানির লেয়ার পাওয়া যায় না। তখন এক স্থান বোরহোলের পর আবার অন্য স্থানে বোরহোল করতে হয়। এভাবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সংকটাপন্ন এলাকাগুলোতে বহু গর্ত আছে। এমন একটি গর্তেই ছোট বাচ্চাটা পড়ে যায়।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত