Ajker Patrika

ন্যাটোতে সুইডেন: এরদোয়ানের নয়া মোড়, তুরস্ক ইইউ সদস্যপদ পাচ্ছে কি 

মুহম্মদ আবদুল বাছেদ
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৩, ১৯: ৪৯
ন্যাটোতে সুইডেন: এরদোয়ানের নয়া মোড়, তুরস্ক ইইউ সদস্যপদ পাচ্ছে কি 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পরে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করে। বছরাধিক অপেক্ষার পর গত এপ্রিলে ন্যাটোর সদস্যপদ পেয়েছে ফিনল্যান্ড, কিন্তু সুইডেনের প্রতীক্ষার অবসান হয়নি।

এর মধ্যেই খবর এসেছে, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানে তুরস্ক সমর্থন দেবে। এ বিষয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে বলে বিবিসি জানিয়েছে। লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে গত সোমবার তুর্কি ও সুইডিশ নেতাদের আলোচনার পর ন্যাটোর প্রধান স্টলটেনবার্গ এ তথ্য দিয়েছেন। তবে এটুকুই পুরো তথ্য নয়।

দীর্ঘদিন ধরে বেঁকে বসে থাকা এরদোয়ান হঠাৎ কীভাবে রাজি হলেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। কয়েক দিন আগেও সুইডেনের মসজিদে কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এরদোয়ান বলেছিলেন, ন্যাটো সদস্যপদে তুরস্ক এই দেশকে সমর্থন দেবে না। 

এরদোয়ান যে অত্যন্ত কৌশলী শাসক, তা এরই মধ্যে বিশ্বদরবারে প্রতিভাত হয়েছে। বিনিময়ে কিছু না পেয়ে এত সহজে রাজি হওয়ার পাত্র নন এরদোয়ান। কড়ির বদলে কড়ি নিয়েই ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে। 

১৯৮৭ সালে নাকচ হয়ে যাওয়া তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের দাবিকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছেন তিনি। গত মঙ্গলবার ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে আঙ্কারা ছাড়ার আগে এরদোয়ান বলে দিয়েছেন, ন্যাটো সামরিক জোটে সুইডেনের যোগদানের প্রস্তাব তুরস্কের সংসদে পাস হওয়ার আগে ইইউর উচিত আঙ্কারার অন্তর্ভুক্তির পথ খুলে দেওয়া।  

এ সময় তুরস্ককে প্রায় ৫০ বছর ধরে ইইউর দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য তিনি সমালোচনাও করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ২০০৫ সালে তুরস্কের ইইউতে সদস্যপদ পাওয়া নিয়ে আলোচনা আবার শুরু হলেও বেশি দূর এগোয়নি। 

২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর আঙ্কারার সঙ্গে এই জোটের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক তিক্ত হয়। পরে সম্পর্কের উন্নতি হয়। কারণ, অভিবাসনসহ নানা দিক থেকে ইইউ তুরস্কের ওপর নির্ভরশীল।  

তুরস্কের দাবির বিষয়ে ইউরোপীয় কমিশনের এক মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কোনো দেশের যোগ্যতার ভিত্তিতে ইইউতে অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখন এরদোয়ান যদি গো ধরে থাকেন, তাহলে সুইডেনের সদস্যপদ পাওয়া হবে না। 

চতুর এরদোয়ানের কৌশলে নতুন চাপে পড়েছেন ইউরোপ-আমেরিকার মোড়লেরা। নতুন চাপ বলা হচ্ছে কারণ, এর আগেও এরদোয়ান ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিষয়ে সুইডেনের ওপর বেশ কিছু শর্ত চাপিয়েছিলেন। সেই সব শর্ত পূরণের পর এরদোয়ান নতুন এই দাবি তুললেন। 

এরদোয়ানের জুড়ে দেওয়া আগের শর্ত
সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে সবচেয়ে বড় ইস্যু ছিল ‘সন্ত্রাসবাদ’ প্রশ্ন। আঙ্কারা অভিযোগ করে, তুরস্ক যাদের সন্ত্রাসী হিসেবে বিবেচনা করে, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি সুইডেন। মূলত নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সদস্যদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে এরদোয়ান প্রশাসন। তুরস্ক, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র এই গোষ্ঠীকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে। 

আর ঈদুল আজহার দিন সুইডেনের স্টকহোমে মসজিদের সামনে কোরআন পোড়ানোর অনুমতি দেয় দেশটির সরকার। কোরআন পোড়ানোও হয়। এ নিয়ে তুরস্কসহ আরব বিশ্বে বিক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় ওঠে, যা ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদান আরও ঘোলাটে করে দেয়। পরে সুইডেন কোরআন পোড়ানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে।  

গত ১৭ মে এরদোয়ান বলেন, ‘সবার আগে যে কথা বলতে চাই তা হলো—যারা তুরস্কের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাদের ইতিবাচক কিছু বলব না। তা বললে ন্যাটো আর সামরিক জোট থাকবে না। সেখানে (পিকেকে-কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) ‘সন্ত্রাসীদের’ প্রতিনিধিত্ব চলে আসবে।’

তবে ন্যাটোর সদস্যপদ পেতে মরিয়া সুইডেন এরদোয়ানের শর্ত মেনে নিয়েছে। সুইডেন নিজের সংবিধান সংশোধন, আইন পরিবর্তন, পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি, যা তুরস্কে নিষিদ্ধ) সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান প্রসার এবং তুরস্কে আবার অস্ত্র রপ্তানি শুরু করেছে। 

তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের ঢিমেতাল
তুরস্ক ১৯৮৭ সালে প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদের জন্য আবেদন করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালে ইইউ তুরস্ককে সদস্যপ্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে। তবে ইইউ-তুর্কি কাস্টমসের বেশ কিছু বৈঠকের পর স্তিমিত হয়ে পড়ে এসব। এরপর ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোয়ানের প্রথম মেয়াদে ইইউতে তুরস্কের সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে ২০১৬ সালে তুরস্কে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর আঙ্কারা ও ইইউ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হলে এই আলোচনাও স্থগিত হয়ে পড়ে। 

কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সেই সম্পর্কের উন্নতি হতে থাকে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের নিয়ন্ত্রণে ইইউ ন্যাটো মিত্র আঙ্কারার সহযোগিতার ওপর নির্ভর করে। সম্প্রতি বিষয়টি আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নানা ক্ষেত্রে আঙ্কারা গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। এরদোয়ান মস্কোয় প্রভাবশালী ন্যাটো নেতা হিসেবে অনন্য ভূমিকা পালন করেছেন। 

তিনি গত বছরে কৃষ্ণসাগরের শস্য চুক্তি অনুমোদনে মধ্যস্থতাকারী ছিলেন। এর ফলে ইউক্রেন কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে সক্ষম হয়েছিল। বারবার রাশিয়ার প্রত্যাহার হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক চুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করেছে। তুরস্ক ইউক্রেনে সশস্ত্র ড্রোন সরবরাহ করে ক্রেমলিনকে ক্ষুব্ধ করেছে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বিমত
লিথুনিয়ায় যাওয়ার আগে ইস্তাম্বুলে সংবাদ সম্মেলনে এরদোয়ান বলেন, ‘প্রথমে ইইউতে তুরস্কের যোগদানের জন্য পথ উন্মুক্ত করুন। এরপর আমরা সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদানের অনুমতি দেব, যেমনটি ফিনল্যান্ডকে দিয়েছি।’ 

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ান ইইউতে তুরস্কের যোগদানের তোলা দাবিকে ইইউ ভালোভাবে নেয়নি। ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্প্রসারণ আলাদা প্রক্রিয়া। প্রতিটি প্রার্থী দেশের যোগদান প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট দেশের যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। দুটি প্রক্রিয়াকে মিলিয়ে ফেলা যাবে না। 

এবার তুরস্ক কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাবে?
আগের যেকোনো পরিস্থিতি থেকে ইউরোপের রাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। এ অবস্থায় বিশ্বের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা ভিন্ন ভিন্ন ধারণা পোষণ করছেন। কেউ বলছেন তুরস্কের জন্য এটাই ইইউতে যোগদানের মোক্ষম সুযোগ। আবার কেউ বলছেন, ইইউতে যোগদানের সুযোগ আরও দীর্ঘায়িত হবে।   

ব্লুমবার্গে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে কলাম লেখেন ববি ঘোষ। তিনি বলেছেন, ‘ইইউর সদস্য হতে হলে তুরস্কে বেশ কিছু সংস্কার করতে হবে। এসবের মধ্য অন্যতম হলো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর আইন বাতিল করা। কিন্তু এরদোয়ান সেই আইন পুনর্বহাল করেছেন। ২০১৬ সালের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর দমন-নিপীড়ন ও শরণার্থীদের ইউরোপে পাঠানোর পর্যায়ক্রমিক হুমকিও রয়েছে। 

‘এখন ন্যাটোতে সুইডেনের যোগদানের সঙ্গে তুরস্কের ইইউতে যোগদানকে গুলিয়ে ফেলছেন। এটি ইইউতে তুরস্কের যোগদানের বিষয়ে আরও বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সত্যি বলতে, তুরস্কের ইইউতে যোগদানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা এখন স্বয়ং এরদোয়ান।’

সাবেক কূটনীতিক ও ইস্তাম্বুলভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ফরেন পলিসি স্টাডিজের পরিচালক সিনান উলগেন বলেছেন, এরদোয়ানের কৌশল পরিবর্তন ভিলনিয়াস সম্মেলনে তুরস্কের হাতকে শক্তিশালী করবে না। এই অবাক করা পদক্ষেপের ইতিবাচক দিকটি হলো, তুরস্ক এখনো ইইউ সদস্য হওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি লালন করে। তবে এটা বলা কঠিন যে, এর ফলে তুরস্কের ইইউ সদস্যপদ পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে কোনো সহযোগিতা করবে।

এরদোয়ানের অনড় অবস্থান
তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এবার ইইউতে যোগদানের আগে সুইডেনকে ন্যাটোতে প্রবেশের অনুমতি দেবে না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান গত গ্রীষ্মে মাদ্রিদে জোটের শীর্ষ সম্মেলনের একটি চুক্তি বাস্তবায়নের ওপর নির্ভরশীল। আঙ্কারার কাছ থেকে কারও ছাড় আশা করা উচিত নয়।’

তবে এরদোয়ান আরও বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের অবসান হলে কিয়েভের ন্যাটো সদস্যপদের প্রক্রিয়া সহজ হবে।

যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও ন্যাটোর সম্মতির সুর 
এক বিবৃতিতে ন্যাটো বলেছে, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানে এগিয়ে আসায় সুইডেন বিষয়টিকে সহজ করতে কাজ করবে। এর মধ্য ইইউ-তুর্কি কাস্টমস ইউনিয়নের আধুনিকায়ন এবং ভিসা উদারীকরণ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। 

এদিকে এরদোয়ানের মন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে ন্যাটো মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘আঙ্কারার ইইউ সদস্যপদকে তিনি সমর্থন করেন। তবে এখনকার বিবেচনার বিষয় হলো, সুইডেন ইতিমধ্যে ন্যাটোতে যোগদানের প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করেছে।’ 

এক সংবাদ সম্মেলনে স্টলটেনবার্গ বলেছেন, ‘ভিলনিয়াসে সুইডেনের বিষয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেওয়া এখনো সম্ভব।’

সোমবার হোয়াইট হাউস বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার প্রস্তাবকে সমর্থন করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছ। তবে এটি আঙ্কারা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ সদস্যের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তই মুখ্য।

সুইডেনের প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, তারা চান, ইইউ ও তুরস্ক আরও কাছে আসুক এবং সমন্বয় করে চলুক।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইউরো নিউজ, ডেইলি সাবাহ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

তাসনিম জারাকে দেওয়া টাকা ফেরত চান? উপায় বলে দিলেন জারা নিজেই

তাসনিম জারার পদত্যাগের পর সামান্তা শারমিনের রহস্যময় পোস্ট

এনসিপি থেকে বেরিয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করার ঘোষণা তাসনিম জারার

মারা গেছেন ঢাকা ক্যাপিটালসের কোচ, শোকাচ্ছন্ন বিপিএল

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত