Ajker Patrika

মিয়ানমারে ‘মার্সিডিজ ভিক্ষু’ ও সবুজ উর্দির অশুভ মৈত্রী, মানবহত্যা বন্ধ করবে কে

আপডেট : ০৮ জুন ২০২৪, ১৯: ৩২
মিয়ানমারে ‘মার্সিডিজ ভিক্ষু’ ও সবুজ উর্দির অশুভ মৈত্রী, মানবহত্যা বন্ধ করবে কে

অতি সম্প্রতি ইয়াঙ্গুন বা মান্দালয়ে গিয়ে থাকলে একটি বিষয় আপনার চোখে পড়ার কথা। শহরের বিভিন্ন স্থানে মার্সিজিড বা বেন্টলির মতো বিলাসবহুল গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। অবাক হবেন না— পুরো মিয়ানমারেই এই চিত্র। নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের পর জান্তা সরকারকে যে ভিক্ষুরা সমর্থন দিয়েছেন, তাদের সবারই ‘আঙুল ফুলে কলা গাছ’ হয়ে গেছে। 

সাধারণ জনগণ এই ভিক্ষুদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁরা সুবিধাবাদী চরিত্রের এসব ভিক্ষুদের ‘সেলেব (তারকা) মঙ্ক’, ‘দালাল ভিক্ষু’ বলে গালি দিচ্ছেন; সামাজিকভাবে বয়কট করেছেন। তবে এতে যে ভিক্ষুদের চরিত্র পাল্টাচ্ছে তা নয়। তাঁরা শুরুতেও যেমন নগ্নভাবে জান্তা সরকারকে সমর্থন দিতেন, এখনো তা-ই দিয়ে যাচ্ছেন। দেশজুড়ে জান্তাবাহিনীর বর্বরতার মুখেও তাঁরা নিশ্চুপ। 

অথচ এই ভিক্ষুরা এতটা নির্লজ্জ ছিলেন না। রাজনৈতিক ইতিহাসে তাঁদের প্রতিবাদী চরিত্রও ছিল। একটা সময় ছিল, যখন এই ভিক্ষুরা রাজনৈতিকভাবে খুবই সচেতন ছিলেন। তাঁরা ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। এমনকি এই জান্তা সরকারের আগের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধেও তাদের বড় অংশ সরব ছিলেন এবং প্রকাশ্যে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু এখন তাঁদের বেশিরভাগ ভোল পাল্টেছেন; নেতৃত্বস্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক ভিক্ষু সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। তাঁদের ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। 
 
জান্তা সরকারের সঙ্গে ভিক্ষুদের এই সহগামী সম্পর্ককে ‘ম্যারেজ অব কনভেনিয়েন্স’ বা ‘স্বার্থসিদ্ধির বিয়ে’ হিসেবে বর্ণনা করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। কারণ, জান্তা সরকারকে সহযোগিতার হাত যারা বাড়িয়েছেন, সেই ভিক্ষুদের সম্পদ যেমন বেড়েছে তেমনি তাদের জান-মাল সুরক্ষাও পেয়েছে। বিনিময়ে জান্তা সরকার বৈধতা পেয়েছে এবং ইসলামের প্রসার বৌদ্ধ-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে হুমকির ফেলেছে বলে নিজেদের বৌদ্ধ ধর্মের রক্ষক হিসেবে চিত্রিত করছেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের রক্ষণশীল উগ্র জাতীয়তাবাদী ভিক্ষুরা জান্তা সরকারের প্রতি তাদের সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য এই হাত অভ্যুত্থানের আগে থেকেই বাড়ানো ছিল। ধর্মের গুটি ব্যবহার করে সুবিধা নিতে জান্তাবাহিনী সবসময়ই রক্ষণশীল বৌদ্ধ ভিক্ষু গোষ্ঠী হলো—মা বা থার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। 
 
উগ্র জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এই সংগঠনটির যাত্রা শুরু ২০১২ সালে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগ, এই গোষ্ঠী মিয়ানমারে জাতীয়তাবাদী বিদ্বেষ ও ধর্মীয় সহিংসতা উসকে দিয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড চালাতে ২০১১-২০১৬ সাল পর্যন্ত মা বা থা নামের এই সংঘকে সরাসরি আর্থিক অনুদান, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছেন তৎকালীন জান্তা শাসক থেইন সেইন। ২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর বর্তমান জান্তা সরকারও একই ধরনের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। 

মিয়ানমারে জান্তার অনুকূলে ধর্মের গুটি খেলার দায়ে অভিযুক্ত প্রধান দুই ভিক্ষু হলেন—সিতাগু সায়াদাও আশিন ন্যানিসরা ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা। ৮৭ বছর বয়সী সিতাগু সায়াদাও মায়ানমারের নয়টি বৌদ্ধ ভিক্ষু গোষ্ঠীর একটি ‘শ্বে কিন’—সম্প্রদায়ের নেতা। সর্বশেষ অভ্যুত্থানের আগে মিয়ানমারের মানুষের কাছে তিনি শ্রদ্ধেয় ও প্রভাবশালী ভিক্ষু হিসেবে বিবেচিত ছিলেন। দেশ-বিদেশে হাজার হাজার অনুসারী ছিল তাঁর। 

অপরদিকে, বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবছর শত শত তরুণ-তরুণীকে আকৃষ্ট করে নিজের খ্যাতি তৈরি করেছেন ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দা। তিনি ইয়াঙ্গুনের ইন্টারন্যাশনাল থেরাবাদা বৌদ্ধ মিশনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান এবং দেশব্যাপী তার কয়েক হাজার অনুসারী রয়েছে। এদের অনেকেই জান্তাবাহিনীর। 

আশঙ্কার বিষয় হলো—২০২১ সালে ক্ষমতা দখলের পর উভয় ভিক্ষু নেতাই জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ে সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করেছেন। এই দুজনই কয়েক মাস আগেই সামরিক বাহিনীকে ক্ষমতা দখলের আহ্বান জানান। জান্তার নৃশংসতা চোখের সামনে দেখেও মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন তাঁরা উভয়েই।

ভিক্ষু সীতাগু সায়াদাও ও তাঁর মার্সিজিড২০২০ সালে সীতাগু সায়াদাওকে মিয়ানামারে সর্বোচ্চ ভিক্ষুর মর্যাদা দেয় জান্তা সরকার। এরপর তিনি জান্তা সরকারের প্রধান মিন অং হ্লাইংকে ‘রাজা’ উপাধিও দেন। তিনি বলেন, ‘মিন অং হ্লাইং মহৎ, মহানুভব ও প্রাজ্ঞ’ নেতা। অথচ তার আগেই এই জান্তাপ্রধানের হাত কয়েক হাজার মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেছে। 

এই তোষামোদি বৃথা যায়নি, অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে নেপিদোর ‘রাজা’ বৌদ্ধ ধর্মের এসব ভিক্ষুদের নিরাশ করেননি। নগদ আর্থিক অনুদান, দামি গাড়ি, বিদেশ সফরের টিকিট, সরকারি সব পদক এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ের অংশীদারত্ব— এই ভিক্ষুদের সবকিছু ঢেলে দিয়েছেন। 

জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিতাগু সায়াদাও আশিন ন্যানিসরা ও ধম্মদুতা আশিন চেকিন্দার রাশিয়া সফরের সময় তাদের মধ্যেকার ‘অশুভ সম্পর্ক’ প্রকাশ্যে আসে। তবে এই ভাবমূর্তি ঢাকতে তাঁরা মস্কোয় মঠ উদ্বোধনের কাজে গিয়েছিলেন বলে প্রচার করা হয়। কিন্তু আদতে জান্তা সরকারের অংশ হিসেবেই তাঁরা সেখানে গিয়েছিলেন। 

যুক্তরাজ্যের একটি দাতব্য সংস্থা প্রকাশিত বৈশ্বিক উদারতা সূচকে ২০১৩ ও ২০১৯ সালে মিয়ানমারের অবস্থান শীর্ষস্থানের কাছাকাছি ছিল। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশটির ‘গভীর কর্মময় মানসিকতাকে’ কল্যাণের প্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এটি অংশত মিয়ানমারে থেরবাদ বৌদ্ধ মতের জোরালো প্রভাবের প্রতিফলন। এই মতের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, আপনি এই জীবনে যা করবেন, তার পরিণতি পরবর্তী সময়ে ভোগ করতে হবে। আর এই বিশ্বাসের মূল উৎস হিসেবেই কাজ করেন ভিক্ষুরা। 

বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি সাধারণ অনুশাসন হলো—‘সংসার’। বৌদ্ধ ধর্মমত অনুসারে সংস্কৃত বা পালি ভাষার এই শব্দের অর্থ হলো—মানুষের অনন্ত জীবনচক্র। বৌদ্ধধর্মে সংসার হল— দুর্ভোগ-ভারাক্রান্ত জীবন, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের ক্রমাগত চক্র, যার কোনো শুরু বা শেষ নেই। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা সাধারণত জীবনে পাঁচটি মূলমন্ত্র অনুসরণ করেন। সেগুলো হলো—হত্যা, চুরি, অবৈধ যৌনাচার, মিথ্যা ও মাদক ব্যবহার থেকে বিরত থাকা, ভিক্ষু ও মঠে দান করার মাধ্যমে পূণ্য অর্জন করা এবং ভালো কাজের মাধ্যমে উপযোগী পুনর্জন্মের আশা করা। 

দুঃখজনক হলেও সত্য, এই দানের উদ্দেশ্য পুনর্জন্ম লাভ হলেও এখন তার সুফল পাচ্ছেন কেবল সীতাগু সায়াদাওয়ের মতো ভিক্ষুরা; সাধারণ ভিক্ষুদের তাতে তেমন উপকার হচ্ছে না। জান্তার মদদে এসব দানে মার্সিডিজ, লিঙ্কনস ও বেন্টলিসহ বিলাসবহুল গাড়িবহরের মালিক হচ্ছেন উগ্রজাতীয়তাবাদী প্রভাবশালী এই ভিক্ষুরা। 

মিয়ানমারের মঠগুলোর আশপাশের সামগ্রিক ‘অর্থনীতির’ ব্যাপ্তি ঠিক কতটা তা জানা যায় না। তবে অনুমান করা যেতে পারে, দেশটির মঠগুলো ঘিরে বছরে কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলারের লেনদেন হয়। এর সুবাদে ভিক্ষুদের ভাগ্যের চাকা দারুণভাবে ঘুরে গেলেও দেশটির ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। তারপরও এই ধর্মভীরু সাধারণ মানুষেরাই মিয়ানমারের মঠগুলোতে ভিড় জমান; তাঁরা সেখানে দান করছেন এবং ভিক্ষুদের লোভের বৃক্ষের গোড়ায় পানি ঢেলে চলছেন।
 
সীতাগু সায়াদাওয়ের সঙ্গে জান্তা সরকার প্রধান মিন অং হ্লাইংকিছুদিন আগে থাইল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম খাওসোদের বার্মিজ সংস্করণে থাইল্যান্ডের এক ভিক্ষুকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল—তিনি ভক্তের কাছ থেকে দান হিসেবে ২ লাখ ডলার মূল্যের একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি উপহার নিয়েছেন। সেই খবর প্রকাশের পর মিয়ানমারের পাঠকেরা মজা করে বলেছিলেন, এই গল্প তাদের জন্য নতুন কিছু নয়, বরং হাস্যকর। কারণ, মিয়ানমারের ‘তারকা ভিক্ষুদের’ কাছে এসব বিএমডব্লিউ হাসির খোরাক। কারণ, এর চেয়ে দামি ও বিলাশবহুল অনেক গাড়ি তাঁদের আছে। 

কিন্তু সবসময় এমন বাস্তবতা ছিল না। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে ২১ শতকের শুরু অবধি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মিয়ানমারের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। সময় বদলে এখন ভিক্ষুরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন, সুবিধায় আক্রান্ত হয়েছেন। কারণ, জান্তাবিরোধী ভিক্ষুদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে, নইলে তাদের সমাজচ্যুত করা হয়েছে। কেবল যারা যারা সক্রিয়ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেন বা কেবল নিরপেক্ষ থাকেন, তাদেরকেই অবাধে টিকে থাকতে অকুণ্ঠ সমর্থন দিচ্ছে জান্তা সরকার। 

প্রতিনিয়ত মানুষের রক্তে হাত রাঙানো, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারা মিয়ানমারের জেনারেলরা এই সব সুবিধাবাদী ভিক্ষুদের অফিস বা বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা নিজেরাও ভিক্ষুদের আশ্রম, মঠ পরিদর্শনে যান এবং বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে আশীর্বাদ কেনেন। 

এখন প্রশ্ন হলো—যেসব ভিক্ষু তাদের নিঃস্ব অবস্থা থেকে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন, যারা দামি দামি সব গাড়ি উপহার নিয়েছেন এসব ভিক্ষুরা কী আর কখনো, কোনো দিন জান্তা জেনারেলদের মানবহত্যা বন্ধ করতে বলতে পারবেন। তাঁরা বলুন বা না বলুন, আশার কথা হলো—মিয়ানমারের তরুণেরা তাদের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছেন। এরপর কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। 

ইরবতী থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত