আব্দুর রহমান

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এ দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা আট দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই। আর ইরান বলছে, তারা শান্তপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই পরমাণু শক্তি চায়। তাদের অস্ত্র অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের ওপর হামলা চালায়। জবাবে ইরানও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। গত বছরও ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করেছিল ইসরায়েলে। তবে সেই সংঘাত ছিল সীমিত পরিসরে।
যাই হোক, আজকের দিনে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি। দেশ দুটি আজ যেমন চিরশত্রু, মাত্র কয়েক দশক আগেও তেমনটা ছিল না। তবে এই শত্রুতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস। একসময় দুই দেশের মধ্যে ছিল গোপন সহযোগিতা, কৌশলগত জোট ও পারস্পরিক স্বার্থের মিল। একসময় তারা বন্ধু ছিল, পরে গোপনে একে অপরের মিত্র হয়ে ওঠে, আর শেষে পরিণত হয় চিরশত্রুতে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সবচেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো দেশগুলোর একটি ইরান। এটি ইরানের দৃঢ় ইসরায়েলবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে প্রায়ই ‘চিরশত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। উভয় দেশ পরস্পরকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ইরান বৈরিতার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল লেবানন ও সিরিয়ায়ও মাঝে মাঝেই হামলা চালাচ্ছে। এ দুই দেশেই ইরানের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশারের পতনের পর এবং লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই প্রভাবে ভাটা পড়ে।
গত বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে এক বিস্ফোরণে হামাসের তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন। হামাস ও ইরান এটিকে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বৈরুতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সব সময় এমন বৈরিতামূলক ছিল না। একসময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা পর্যায়ে উঠানামা করেছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত শাসন করা পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক মোটেই বৈরী ছিল না। বরং, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তুরস্কের পরই ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ যে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ইরান ছিল তার ১১ সদস্যের একটি। এই কমিটিতে ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে এই অঞ্চলে বহু প্রজন্ম ধরে সহিংসতা চলতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এরিক কভিন্ডেসল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া একটি বিকল্প পরিকল্পনা দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন—যেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকবে, কিন্তু আরব ও ইহুদি অঞ্চলে বিভক্ত থাকবে ফিলিস্তিন। এটাই ছিল ইরানের আপসের প্রস্তাব। তারা চেয়েছিল প্রো-জায়নিস্ট পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী আরব-মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে।’
কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড দখল করে নিলে, ১৯৫০ সালে ইরান—তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনে—ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে।
কভিন্ডেসল্যান্ড জানান, সে সময় প্রায় ২ হাজার ইরানি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁদের সম্পত্তি ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে। এই সম্পদ রক্ষার জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেহরান। তবে এর পেছনে ছিল ইসরায়েলের তথাকথিত ‘পেরিফেরি নীতি।’ সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাই তিনি আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র—যেমন ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গেই সফল যোগাযোগ হয়।
এরপর, ১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণ করেন। এই তেলশিল্প তখন পুরোপুরি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ, তিনি একে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখতেন।
তবে ইতিহাসবিদ কভিন্ডেসল্যান্ড বলছেন, মোসাদ্দেকের কাছে মূল বিষয় ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো, রাজতন্ত্র দুর্বল করা ও আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ছিল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘গৌণ ক্ষতি।’
ইরানে তখন কিছুটা হলেও জায়নবাদবিরোধী চিন্তা ছড়িয়েছিল। প্রভাবশালী শিয়া আলেম নবাব সাফাভি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি ইসরায়েল ও জায়নিজমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে মোসাদ্দেকের কাছে মূল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে সমর্থন পাওয়া।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাহলভি পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপর ইসরায়েল তেহরানে একটি দূতাবাস খোলে। ১৯৭০-এর দশকে দুই দেশ দুই দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হয়। ইরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান তেল সরবরাহকারী। সে সময় ইসরায়েল হয়ে ইউরোপে তেল পাঠানোর জন্য ইরান একটি পাইপলাইনও নির্মাণ করে।
এই সম্পর্ক ছিল মূলত গোপন, যেন আরব রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ না হয়। কভিন্ডেসল্যান্ড বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানকে যতটা প্রয়োজন মনে করত, ইরান ততটা না। ইসরায়েল সব সময়ই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে শাহও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ইসরায়েলকে কাজে লাগাতে চাইতেন।’
ইরানের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাক গঠনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তা ছিল বলেও ইতিহাসবিদেরা জানান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়েছে, শাহের আমলে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানে অস্ত্র বিক্রি করত। নথিতে বলা হয়, ‘এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের নবগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা করে তোলে, আর পারস্পরিক বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইরান থেকে দরকারি তেল পাওয়া যেত, যার বিনিময়ে ইসরায়েল অস্ত্র ও কারিগরি সহায়তা দিত।’
সিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইরানের সমর্থনে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল। এর বদলে, ইরানও সম্ভবত ইরাকি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা তথ্য মোসাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত ৯০ হাজার ইহুদির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল। তবে শাহ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শে দেশ পরিচালনার ডাক দেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসরায়েল ছিল ‘ছোট শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্র ‘বড় শয়তান’। তিনি বলতেন, এই শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
তেহরান ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসরায়েলি দূতাবাসকে পরিণত করা হয় ফিলিস্তিনি দূতাবাসে। ইরানি নাগরিকদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোমেনি পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি জেরুজালেমের (যাকে আরবিতে বলা হয় আল-কুদস) মুক্তির দাবিতে প্রতিবছর ইরানে বড় বড় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, খোমেনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের নয়, ইসলামের একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইরান শুধু এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতেই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে—এমন ভিত্তি গড়ে তোলেন তিনি।
পারসি বলেন, ‘আরব-পারস্য বিভাজন এবং সুন্নি-শিয়া বিভক্তি অতিক্রম করে ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। এতে তারা ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বদানের অবস্থান তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব সরকারগুলোকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেয়।’
১৯৮০—১৯৯০ এর দশকে ইরান ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে ইরান প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই ইরান এ ধরনের ভূমিকা নেয়।
সিআইএ—এর তথ্য অনুসারে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেও পর্দার আড়ালে দুপক্ষের সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এবং আট বছর ধরে চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল মনে করেছিল, খোমেনির ইসলামি ইরানের চেয়ে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকই তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। সে কারণেই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে, গোপনে ইরানে অস্ত্র সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতায় ইরানে অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল। এর বিনিময়ে লেবাননে বন্দী থাকা মার্কিনিদের মুক্ত করতে সহায়তা এবং নিকারাগুয়ায় মার্কিনপন্থী বিদ্রোহীদের অর্থ জোগানো হচ্ছিল। তখন ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য বৈরিতার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক অনেককেই বিস্মিত করে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এতটাই গোপন সহযোগিতা চলছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র বা যন্ত্রাংশ ইরানে পৌঁছে দিচ্ছে কিনা।
১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সিআইএর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘Israel and Iran: The ties that bind—অর্থাৎ ইসরায়েল ও ইরান: যে বন্ধনে তারা বাঁধা।’ এতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ধারণা, ইসরায়েল যে ইরানে অস্ত্র বিক্রি করছে, সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই চলছে এবং এখনো চলছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫০-এর দশকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে যে কৌশলগত হিসাব ছিল, সেই একই কারণে ইসরায়েল এখনো এই অস্ত্র বিক্রির প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছে, তারা চায় এই সহায়তা ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘতর করুক, যাতে ইরাকের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব সীমান্তেই আটকে থাকে। তবে তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সহায়তা দেবে না, কারণ এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ইরান এই তথ্য সিরিয়ার মতো ইসরায়েলবিরোধী দেশের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।’
সিআইএর ওই গোপন নথিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল বিশ্বাস করত—যুক্তরাষ্ট্র যতই প্রকাশ্যে ইরানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। ইসরায়েল মনে করত, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি এবং ইসরায়েল আশা করত, ভবিষ্যতে এই গোপন সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।
আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক শোনালেও, তখন ইসরায়েল সত্যিই বিশ্বাস করত, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিআইএ নথিতে বলা হয়, ‘তেল নিয়ে ইসরায়েলের চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে তারাও ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।’
তবে ইসরায়েল নিশ্চিত ছিল, তাদের এই সহায়তা পুরোপুরি গোপনই থাকবে। সিআইএ নথিতে লেখা হয়, ‘খোমেনি শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল সচেতন এবং তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষককে (যুক্তরাষ্ট্রকে) রাগানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে কারণে ইসরায়েল এমন মাত্রায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, যা আর অস্বীকার করার সুযোগ রাখবে না। মার্কিন উদ্বেগের কারণে ইসরায়েল অতীতে কখনো ইরানকে বড় ধরনের অস্ত্র—যেমন ট্যাংক বা বিমান বিক্রি করেনি।’
১৯৯০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েলের এই গোপন সম্পর্কের অবসান ঘটে। কারণ, সে সময়ই ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরান পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করলে, ইসরায়েল সন্দেহ করে এটি আসলে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রকল্প। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরদার করে। ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়ে ‘এক্সিস অব রেজিস্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন করেছে। এই জোট ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু মনে করে।
অন্যদিকে ইসরায়েলও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা ইরান সরকারবিরোধী এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালায়। তেহরানের ভাষায়, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ইউরোপভিত্তিক মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে), দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানকারী কুর্দি সশস্ত্র দলগুলো—যাদের ইরান ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করে।
২০২০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ‘শ্যাডো ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। ড্রোন হামলা, সাইবার যুদ্ধ এবং সমুদ্রপথে নাশকতা—সবই এই সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই ইসরায়েলও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে এবং ইরানি উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
চলতি বছরে এসে এই বৈরিতা আরও ঘনীভূত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু, তেহরানে ইসমাইল হানিয়া হত্যার পর। এরপর, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা করে ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে। এসব ঘটনার আলোকে গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চার চারটি যুদ্ধ লড়েছে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত সে সময় ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতেই জড়ায়নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ক্রমেই ইসরায়েলের বিষয়ে মনোভাব বদলাতে থাকে এবং একপর্যায়ে দুই দেশ চির শত্রুতে পরিণত হয়। আর যে আরব ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ছিল সেই আরব দেশগুলো এখন ইসরায়েলের একপ্রকার মিত্রে পরিণত হয়েছে।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার পথে আছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, কয়েক দশকের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একপ্রকার উল্টে গেছে। ইসরায়েলের এক সময়ের শত্রুরা এখন ‘বন্ধু’ হওয়ার পথে আর এক সময়ের বন্ধু এখন চিরশত্রু।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এ দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা আট দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই। আর ইরান বলছে, তারা শান্তপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই পরমাণু শক্তি চায়। তাদের অস্ত্র অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের ওপর হামলা চালায়। জবাবে ইরানও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। গত বছরও ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করেছিল ইসরায়েলে। তবে সেই সংঘাত ছিল সীমিত পরিসরে।
যাই হোক, আজকের দিনে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি। দেশ দুটি আজ যেমন চিরশত্রু, মাত্র কয়েক দশক আগেও তেমনটা ছিল না। তবে এই শত্রুতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস। একসময় দুই দেশের মধ্যে ছিল গোপন সহযোগিতা, কৌশলগত জোট ও পারস্পরিক স্বার্থের মিল। একসময় তারা বন্ধু ছিল, পরে গোপনে একে অপরের মিত্র হয়ে ওঠে, আর শেষে পরিণত হয় চিরশত্রুতে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সবচেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো দেশগুলোর একটি ইরান। এটি ইরানের দৃঢ় ইসরায়েলবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে প্রায়ই ‘চিরশত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। উভয় দেশ পরস্পরকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ইরান বৈরিতার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল লেবানন ও সিরিয়ায়ও মাঝে মাঝেই হামলা চালাচ্ছে। এ দুই দেশেই ইরানের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশারের পতনের পর এবং লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই প্রভাবে ভাটা পড়ে।
গত বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে এক বিস্ফোরণে হামাসের তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন। হামাস ও ইরান এটিকে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বৈরুতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সব সময় এমন বৈরিতামূলক ছিল না। একসময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা পর্যায়ে উঠানামা করেছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত শাসন করা পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক মোটেই বৈরী ছিল না। বরং, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তুরস্কের পরই ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ যে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ইরান ছিল তার ১১ সদস্যের একটি। এই কমিটিতে ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে এই অঞ্চলে বহু প্রজন্ম ধরে সহিংসতা চলতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এরিক কভিন্ডেসল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া একটি বিকল্প পরিকল্পনা দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন—যেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকবে, কিন্তু আরব ও ইহুদি অঞ্চলে বিভক্ত থাকবে ফিলিস্তিন। এটাই ছিল ইরানের আপসের প্রস্তাব। তারা চেয়েছিল প্রো-জায়নিস্ট পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী আরব-মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে।’
কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড দখল করে নিলে, ১৯৫০ সালে ইরান—তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনে—ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে।
কভিন্ডেসল্যান্ড জানান, সে সময় প্রায় ২ হাজার ইরানি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁদের সম্পত্তি ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে। এই সম্পদ রক্ষার জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেহরান। তবে এর পেছনে ছিল ইসরায়েলের তথাকথিত ‘পেরিফেরি নীতি।’ সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাই তিনি আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র—যেমন ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গেই সফল যোগাযোগ হয়।
এরপর, ১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণ করেন। এই তেলশিল্প তখন পুরোপুরি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ, তিনি একে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখতেন।
তবে ইতিহাসবিদ কভিন্ডেসল্যান্ড বলছেন, মোসাদ্দেকের কাছে মূল বিষয় ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো, রাজতন্ত্র দুর্বল করা ও আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ছিল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘গৌণ ক্ষতি।’
ইরানে তখন কিছুটা হলেও জায়নবাদবিরোধী চিন্তা ছড়িয়েছিল। প্রভাবশালী শিয়া আলেম নবাব সাফাভি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি ইসরায়েল ও জায়নিজমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে মোসাদ্দেকের কাছে মূল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে সমর্থন পাওয়া।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাহলভি পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপর ইসরায়েল তেহরানে একটি দূতাবাস খোলে। ১৯৭০-এর দশকে দুই দেশ দুই দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হয়। ইরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান তেল সরবরাহকারী। সে সময় ইসরায়েল হয়ে ইউরোপে তেল পাঠানোর জন্য ইরান একটি পাইপলাইনও নির্মাণ করে।
এই সম্পর্ক ছিল মূলত গোপন, যেন আরব রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ না হয়। কভিন্ডেসল্যান্ড বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানকে যতটা প্রয়োজন মনে করত, ইরান ততটা না। ইসরায়েল সব সময়ই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে শাহও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ইসরায়েলকে কাজে লাগাতে চাইতেন।’
ইরানের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাক গঠনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তা ছিল বলেও ইতিহাসবিদেরা জানান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়েছে, শাহের আমলে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানে অস্ত্র বিক্রি করত। নথিতে বলা হয়, ‘এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের নবগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা করে তোলে, আর পারস্পরিক বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইরান থেকে দরকারি তেল পাওয়া যেত, যার বিনিময়ে ইসরায়েল অস্ত্র ও কারিগরি সহায়তা দিত।’
সিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইরানের সমর্থনে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল। এর বদলে, ইরানও সম্ভবত ইরাকি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা তথ্য মোসাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত ৯০ হাজার ইহুদির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল। তবে শাহ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শে দেশ পরিচালনার ডাক দেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসরায়েল ছিল ‘ছোট শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্র ‘বড় শয়তান’। তিনি বলতেন, এই শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
তেহরান ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসরায়েলি দূতাবাসকে পরিণত করা হয় ফিলিস্তিনি দূতাবাসে। ইরানি নাগরিকদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোমেনি পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি জেরুজালেমের (যাকে আরবিতে বলা হয় আল-কুদস) মুক্তির দাবিতে প্রতিবছর ইরানে বড় বড় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, খোমেনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের নয়, ইসলামের একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইরান শুধু এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতেই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে—এমন ভিত্তি গড়ে তোলেন তিনি।
পারসি বলেন, ‘আরব-পারস্য বিভাজন এবং সুন্নি-শিয়া বিভক্তি অতিক্রম করে ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। এতে তারা ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বদানের অবস্থান তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব সরকারগুলোকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেয়।’
১৯৮০—১৯৯০ এর দশকে ইরান ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে ইরান প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই ইরান এ ধরনের ভূমিকা নেয়।
সিআইএ—এর তথ্য অনুসারে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেও পর্দার আড়ালে দুপক্ষের সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এবং আট বছর ধরে চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল মনে করেছিল, খোমেনির ইসলামি ইরানের চেয়ে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকই তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। সে কারণেই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে, গোপনে ইরানে অস্ত্র সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতায় ইরানে অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল। এর বিনিময়ে লেবাননে বন্দী থাকা মার্কিনিদের মুক্ত করতে সহায়তা এবং নিকারাগুয়ায় মার্কিনপন্থী বিদ্রোহীদের অর্থ জোগানো হচ্ছিল। তখন ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য বৈরিতার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক অনেককেই বিস্মিত করে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এতটাই গোপন সহযোগিতা চলছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র বা যন্ত্রাংশ ইরানে পৌঁছে দিচ্ছে কিনা।
১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সিআইএর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘Israel and Iran: The ties that bind—অর্থাৎ ইসরায়েল ও ইরান: যে বন্ধনে তারা বাঁধা।’ এতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ধারণা, ইসরায়েল যে ইরানে অস্ত্র বিক্রি করছে, সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই চলছে এবং এখনো চলছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫০-এর দশকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে যে কৌশলগত হিসাব ছিল, সেই একই কারণে ইসরায়েল এখনো এই অস্ত্র বিক্রির প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছে, তারা চায় এই সহায়তা ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘতর করুক, যাতে ইরাকের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব সীমান্তেই আটকে থাকে। তবে তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সহায়তা দেবে না, কারণ এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ইরান এই তথ্য সিরিয়ার মতো ইসরায়েলবিরোধী দেশের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।’
সিআইএর ওই গোপন নথিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল বিশ্বাস করত—যুক্তরাষ্ট্র যতই প্রকাশ্যে ইরানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। ইসরায়েল মনে করত, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি এবং ইসরায়েল আশা করত, ভবিষ্যতে এই গোপন সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।
আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক শোনালেও, তখন ইসরায়েল সত্যিই বিশ্বাস করত, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিআইএ নথিতে বলা হয়, ‘তেল নিয়ে ইসরায়েলের চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে তারাও ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।’
তবে ইসরায়েল নিশ্চিত ছিল, তাদের এই সহায়তা পুরোপুরি গোপনই থাকবে। সিআইএ নথিতে লেখা হয়, ‘খোমেনি শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল সচেতন এবং তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষককে (যুক্তরাষ্ট্রকে) রাগানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে কারণে ইসরায়েল এমন মাত্রায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, যা আর অস্বীকার করার সুযোগ রাখবে না। মার্কিন উদ্বেগের কারণে ইসরায়েল অতীতে কখনো ইরানকে বড় ধরনের অস্ত্র—যেমন ট্যাংক বা বিমান বিক্রি করেনি।’
১৯৯০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েলের এই গোপন সম্পর্কের অবসান ঘটে। কারণ, সে সময়ই ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরান পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করলে, ইসরায়েল সন্দেহ করে এটি আসলে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রকল্প। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরদার করে। ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়ে ‘এক্সিস অব রেজিস্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন করেছে। এই জোট ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু মনে করে।
অন্যদিকে ইসরায়েলও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা ইরান সরকারবিরোধী এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালায়। তেহরানের ভাষায়, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ইউরোপভিত্তিক মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে), দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানকারী কুর্দি সশস্ত্র দলগুলো—যাদের ইরান ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করে।
২০২০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ‘শ্যাডো ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। ড্রোন হামলা, সাইবার যুদ্ধ এবং সমুদ্রপথে নাশকতা—সবই এই সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই ইসরায়েলও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে এবং ইরানি উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
চলতি বছরে এসে এই বৈরিতা আরও ঘনীভূত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু, তেহরানে ইসমাইল হানিয়া হত্যার পর। এরপর, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা করে ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে। এসব ঘটনার আলোকে গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চার চারটি যুদ্ধ লড়েছে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত সে সময় ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতেই জড়ায়নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ক্রমেই ইসরায়েলের বিষয়ে মনোভাব বদলাতে থাকে এবং একপর্যায়ে দুই দেশ চির শত্রুতে পরিণত হয়। আর যে আরব ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ছিল সেই আরব দেশগুলো এখন ইসরায়েলের একপ্রকার মিত্রে পরিণত হয়েছে।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার পথে আছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, কয়েক দশকের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একপ্রকার উল্টে গেছে। ইসরায়েলের এক সময়ের শত্রুরা এখন ‘বন্ধু’ হওয়ার পথে আর এক সময়ের বন্ধু এখন চিরশত্রু।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস
আব্দুর রহমান

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এ দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা আট দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই। আর ইরান বলছে, তারা শান্তপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই পরমাণু শক্তি চায়। তাদের অস্ত্র অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের ওপর হামলা চালায়। জবাবে ইরানও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। গত বছরও ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করেছিল ইসরায়েলে। তবে সেই সংঘাত ছিল সীমিত পরিসরে।
যাই হোক, আজকের দিনে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি। দেশ দুটি আজ যেমন চিরশত্রু, মাত্র কয়েক দশক আগেও তেমনটা ছিল না। তবে এই শত্রুতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস। একসময় দুই দেশের মধ্যে ছিল গোপন সহযোগিতা, কৌশলগত জোট ও পারস্পরিক স্বার্থের মিল। একসময় তারা বন্ধু ছিল, পরে গোপনে একে অপরের মিত্র হয়ে ওঠে, আর শেষে পরিণত হয় চিরশত্রুতে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সবচেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো দেশগুলোর একটি ইরান। এটি ইরানের দৃঢ় ইসরায়েলবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে প্রায়ই ‘চিরশত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। উভয় দেশ পরস্পরকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ইরান বৈরিতার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল লেবানন ও সিরিয়ায়ও মাঝে মাঝেই হামলা চালাচ্ছে। এ দুই দেশেই ইরানের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশারের পতনের পর এবং লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই প্রভাবে ভাটা পড়ে।
গত বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে এক বিস্ফোরণে হামাসের তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন। হামাস ও ইরান এটিকে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বৈরুতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সব সময় এমন বৈরিতামূলক ছিল না। একসময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা পর্যায়ে উঠানামা করেছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত শাসন করা পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক মোটেই বৈরী ছিল না। বরং, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তুরস্কের পরই ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ যে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ইরান ছিল তার ১১ সদস্যের একটি। এই কমিটিতে ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে এই অঞ্চলে বহু প্রজন্ম ধরে সহিংসতা চলতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এরিক কভিন্ডেসল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া একটি বিকল্প পরিকল্পনা দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন—যেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকবে, কিন্তু আরব ও ইহুদি অঞ্চলে বিভক্ত থাকবে ফিলিস্তিন। এটাই ছিল ইরানের আপসের প্রস্তাব। তারা চেয়েছিল প্রো-জায়নিস্ট পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী আরব-মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে।’
কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড দখল করে নিলে, ১৯৫০ সালে ইরান—তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনে—ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে।
কভিন্ডেসল্যান্ড জানান, সে সময় প্রায় ২ হাজার ইরানি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁদের সম্পত্তি ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে। এই সম্পদ রক্ষার জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেহরান। তবে এর পেছনে ছিল ইসরায়েলের তথাকথিত ‘পেরিফেরি নীতি।’ সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাই তিনি আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র—যেমন ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গেই সফল যোগাযোগ হয়।
এরপর, ১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণ করেন। এই তেলশিল্প তখন পুরোপুরি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ, তিনি একে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখতেন।
তবে ইতিহাসবিদ কভিন্ডেসল্যান্ড বলছেন, মোসাদ্দেকের কাছে মূল বিষয় ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো, রাজতন্ত্র দুর্বল করা ও আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ছিল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘গৌণ ক্ষতি।’
ইরানে তখন কিছুটা হলেও জায়নবাদবিরোধী চিন্তা ছড়িয়েছিল। প্রভাবশালী শিয়া আলেম নবাব সাফাভি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি ইসরায়েল ও জায়নিজমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে মোসাদ্দেকের কাছে মূল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে সমর্থন পাওয়া।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাহলভি পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপর ইসরায়েল তেহরানে একটি দূতাবাস খোলে। ১৯৭০-এর দশকে দুই দেশ দুই দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হয়। ইরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান তেল সরবরাহকারী। সে সময় ইসরায়েল হয়ে ইউরোপে তেল পাঠানোর জন্য ইরান একটি পাইপলাইনও নির্মাণ করে।
এই সম্পর্ক ছিল মূলত গোপন, যেন আরব রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ না হয়। কভিন্ডেসল্যান্ড বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানকে যতটা প্রয়োজন মনে করত, ইরান ততটা না। ইসরায়েল সব সময়ই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে শাহও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ইসরায়েলকে কাজে লাগাতে চাইতেন।’
ইরানের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাক গঠনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তা ছিল বলেও ইতিহাসবিদেরা জানান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়েছে, শাহের আমলে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানে অস্ত্র বিক্রি করত। নথিতে বলা হয়, ‘এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের নবগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা করে তোলে, আর পারস্পরিক বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইরান থেকে দরকারি তেল পাওয়া যেত, যার বিনিময়ে ইসরায়েল অস্ত্র ও কারিগরি সহায়তা দিত।’
সিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইরানের সমর্থনে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল। এর বদলে, ইরানও সম্ভবত ইরাকি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা তথ্য মোসাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত ৯০ হাজার ইহুদির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল। তবে শাহ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শে দেশ পরিচালনার ডাক দেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসরায়েল ছিল ‘ছোট শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্র ‘বড় শয়তান’। তিনি বলতেন, এই শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
তেহরান ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসরায়েলি দূতাবাসকে পরিণত করা হয় ফিলিস্তিনি দূতাবাসে। ইরানি নাগরিকদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোমেনি পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি জেরুজালেমের (যাকে আরবিতে বলা হয় আল-কুদস) মুক্তির দাবিতে প্রতিবছর ইরানে বড় বড় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, খোমেনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের নয়, ইসলামের একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইরান শুধু এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতেই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে—এমন ভিত্তি গড়ে তোলেন তিনি।
পারসি বলেন, ‘আরব-পারস্য বিভাজন এবং সুন্নি-শিয়া বিভক্তি অতিক্রম করে ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। এতে তারা ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বদানের অবস্থান তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব সরকারগুলোকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেয়।’
১৯৮০—১৯৯০ এর দশকে ইরান ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে ইরান প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই ইরান এ ধরনের ভূমিকা নেয়।
সিআইএ—এর তথ্য অনুসারে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেও পর্দার আড়ালে দুপক্ষের সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এবং আট বছর ধরে চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল মনে করেছিল, খোমেনির ইসলামি ইরানের চেয়ে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকই তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। সে কারণেই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে, গোপনে ইরানে অস্ত্র সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতায় ইরানে অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল। এর বিনিময়ে লেবাননে বন্দী থাকা মার্কিনিদের মুক্ত করতে সহায়তা এবং নিকারাগুয়ায় মার্কিনপন্থী বিদ্রোহীদের অর্থ জোগানো হচ্ছিল। তখন ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য বৈরিতার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক অনেককেই বিস্মিত করে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এতটাই গোপন সহযোগিতা চলছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র বা যন্ত্রাংশ ইরানে পৌঁছে দিচ্ছে কিনা।
১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সিআইএর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘Israel and Iran: The ties that bind—অর্থাৎ ইসরায়েল ও ইরান: যে বন্ধনে তারা বাঁধা।’ এতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ধারণা, ইসরায়েল যে ইরানে অস্ত্র বিক্রি করছে, সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই চলছে এবং এখনো চলছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫০-এর দশকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে যে কৌশলগত হিসাব ছিল, সেই একই কারণে ইসরায়েল এখনো এই অস্ত্র বিক্রির প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছে, তারা চায় এই সহায়তা ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘতর করুক, যাতে ইরাকের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব সীমান্তেই আটকে থাকে। তবে তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সহায়তা দেবে না, কারণ এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ইরান এই তথ্য সিরিয়ার মতো ইসরায়েলবিরোধী দেশের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।’
সিআইএর ওই গোপন নথিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল বিশ্বাস করত—যুক্তরাষ্ট্র যতই প্রকাশ্যে ইরানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। ইসরায়েল মনে করত, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি এবং ইসরায়েল আশা করত, ভবিষ্যতে এই গোপন সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।
আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক শোনালেও, তখন ইসরায়েল সত্যিই বিশ্বাস করত, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিআইএ নথিতে বলা হয়, ‘তেল নিয়ে ইসরায়েলের চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে তারাও ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।’
তবে ইসরায়েল নিশ্চিত ছিল, তাদের এই সহায়তা পুরোপুরি গোপনই থাকবে। সিআইএ নথিতে লেখা হয়, ‘খোমেনি শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল সচেতন এবং তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষককে (যুক্তরাষ্ট্রকে) রাগানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে কারণে ইসরায়েল এমন মাত্রায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, যা আর অস্বীকার করার সুযোগ রাখবে না। মার্কিন উদ্বেগের কারণে ইসরায়েল অতীতে কখনো ইরানকে বড় ধরনের অস্ত্র—যেমন ট্যাংক বা বিমান বিক্রি করেনি।’
১৯৯০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েলের এই গোপন সম্পর্কের অবসান ঘটে। কারণ, সে সময়ই ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরান পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করলে, ইসরায়েল সন্দেহ করে এটি আসলে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রকল্প। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরদার করে। ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়ে ‘এক্সিস অব রেজিস্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন করেছে। এই জোট ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু মনে করে।
অন্যদিকে ইসরায়েলও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা ইরান সরকারবিরোধী এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালায়। তেহরানের ভাষায়, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ইউরোপভিত্তিক মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে), দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানকারী কুর্দি সশস্ত্র দলগুলো—যাদের ইরান ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করে।
২০২০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ‘শ্যাডো ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। ড্রোন হামলা, সাইবার যুদ্ধ এবং সমুদ্রপথে নাশকতা—সবই এই সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই ইসরায়েলও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে এবং ইরানি উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
চলতি বছরে এসে এই বৈরিতা আরও ঘনীভূত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু, তেহরানে ইসমাইল হানিয়া হত্যার পর। এরপর, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা করে ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে। এসব ঘটনার আলোকে গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চার চারটি যুদ্ধ লড়েছে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত সে সময় ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতেই জড়ায়নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ক্রমেই ইসরায়েলের বিষয়ে মনোভাব বদলাতে থাকে এবং একপর্যায়ে দুই দেশ চির শত্রুতে পরিণত হয়। আর যে আরব ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ছিল সেই আরব দেশগুলো এখন ইসরায়েলের একপ্রকার মিত্রে পরিণত হয়েছে।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার পথে আছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, কয়েক দশকের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একপ্রকার উল্টে গেছে। ইসরায়েলের এক সময়ের শত্রুরা এখন ‘বন্ধু’ হওয়ার পথে আর এক সময়ের বন্ধু এখন চিরশত্রু।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এ দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা আট দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি। যদিও কোনো প্রমাণ নেই। আর ইরান বলছে, তারা শান্তপূর্ণ ব্যবহারের জন্যই পরমাণু শক্তি চায়। তাদের অস্ত্র অর্জনের কোনো ইচ্ছা নেই।
ইসরায়েল গত ১৩ জুন ভোরে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানা এবং সামরিক কমান্ডারদের ওপর হামলা চালায়। জবাবে ইরানও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। গত বছরও ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল। এর জবাবে ইরানও পাল্টা হামলা করেছিল ইসরায়েলে। তবে সেই সংঘাত ছিল সীমিত পরিসরে।
যাই হোক, আজকের দিনে ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সবচেয়ে বৈরী ও উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি। দেশ দুটি আজ যেমন চিরশত্রু, মাত্র কয়েক দশক আগেও তেমনটা ছিল না। তবে এই শত্রুতার পেছনে লুকিয়ে আছে এক জটিল ইতিহাস। একসময় দুই দেশের মধ্যে ছিল গোপন সহযোগিতা, কৌশলগত জোট ও পারস্পরিক স্বার্থের মিল। একসময় তারা বন্ধু ছিল, পরে গোপনে একে অপরের মিত্র হয়ে ওঠে, আর শেষে পরিণত হয় চিরশত্রুতে।
গাজার ওপর ইসরায়েলের নির্মম আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বে সবচেয়ে কড়া ভাষায় প্রতিবাদ জানানো দেশগুলোর একটি ইরান। এটি ইরানের দৃঢ় ইসরায়েলবিরোধী পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে প্রায়ই ‘চিরশত্রু’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। উভয় দেশ পরস্পরকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে।
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে ইসরায়েল-ইরান বৈরিতার কেন্দ্রে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল লেবানন ও সিরিয়ায়ও মাঝে মাঝেই হামলা চালাচ্ছে। এ দুই দেশেই ইরানের প্রভাব ব্যাপক ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় বাশারের পতনের পর এবং লেবাননে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে হিজবুল্লাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এই প্রভাবে ভাটা পড়ে।
গত বছরের ৩১ জুলাই তেহরানে এক বিস্ফোরণে হামাসের তৎকালীন প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহত হন। হামাস ও ইরান এটিকে ইসরায়েলি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করে। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বৈরুতে নিহত হন হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ।
তবে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সব সময় এমন বৈরিতামূলক ছিল না। একসময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা পর্যায়ে উঠানামা করেছে। ১৯২৫ সাল থেকে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব পর্যন্ত শাসন করা পাহলভি রাজবংশের শাসনামলে ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক মোটেই বৈরী ছিল না। বরং, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর তুরস্কের পরই ইরান ছিল দ্বিতীয় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যারা ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘ যে বিশেষ কমিটি গঠন করে, ইরান ছিল তার ১১ সদস্যের একটি। এই কমিটিতে ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া—এই তিনটি দেশ জাতিসংঘের ফিলিস্তিন বিভাজন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। তাদের আশঙ্কা ছিল, এতে এই অঞ্চলে বহু প্রজন্ম ধরে সহিংসতা চলতে পারে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ এরিক কভিন্ডেসল্যান্ড আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইরান, ভারত ও যুগোস্লাভিয়া একটি বিকল্প পরিকল্পনা দেয়। তাদের প্রস্তাব ছিল একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন—যেখানে একটি পার্লামেন্ট থাকবে, কিন্তু আরব ও ইহুদি অঞ্চলে বিভক্ত থাকবে ফিলিস্তিন। এটাই ছিল ইরানের আপসের প্রস্তাব। তারা চেয়েছিল প্রো-জায়নিস্ট পশ্চিমা বিশ্ব ও প্রতিবেশী আরব-মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে।’
কিন্তু ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ইসরায়েল জাতিসংঘ নির্ধারিত সীমার চেয়েও বেশি ভূখণ্ড দখল করে নিলে, ১৯৫০ সালে ইরান—তৎকালীন সম্রাট মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনে—ইসরায়েলকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় জায়নিস্ট মিলিশিয়ারা ৭ লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ঘরবাড়ি থেকে জোর করে উৎখাত করে। এই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা ‘নাকবা’ বা ‘বিপর্যয়’ হিসেবে স্মরণ করে।
কভিন্ডেসল্যান্ড জানান, সে সময় প্রায় ২ হাজার ইরানি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে বসবাস করতেন এবং যুদ্ধের সময় তাঁদের সম্পত্তি ইসরায়েলি বাহিনী দখল করে। এই সম্পদ রক্ষার জন্যও ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল তেহরান। তবে এর পেছনে ছিল ইসরায়েলের তথাকথিত ‘পেরিফেরি নীতি।’ সে সময় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিওন মধ্যপ্রাচ্যে একঘরে অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজছিলেন। তাই তিনি আরব দেশগুলোর বাইরের রাষ্ট্র—যেমন ইরান, তুরস্ক, ইথিওপিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ইরান ও তুরস্কের সঙ্গেই সফল যোগাযোগ হয়।
এরপর, ১৯৫১ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ মোসাদ্দেক। তিনি দেশের তেলশিল্প জাতীয়করণ করেন। এই তেলশিল্প তখন পুরোপুরি ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মোসাদ্দেক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। কারণ, তিনি একে পশ্চিমা স্বার্থ রক্ষাকারী শক্তি হিসেবে দেখতেন।
তবে ইতিহাসবিদ কভিন্ডেসল্যান্ড বলছেন, মোসাদ্দেকের কাছে মূল বিষয় ছিল ব্রিটিশ তাড়ানো, রাজতন্ত্র দুর্বল করা ও আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ছিল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা ‘গৌণ ক্ষতি।’
ইরানে তখন কিছুটা হলেও জায়নবাদবিরোধী চিন্তা ছড়িয়েছিল। প্রভাবশালী শিয়া আলেম নবাব সাফাভি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তিনি ইসরায়েল ও জায়নিজমের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে মোসাদ্দেকের কাছে মূল লক্ষ্য ছিল আরব বিশ্বে সমর্থন পাওয়া।
১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সহায়তায় এক অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক সরকার পতনের পর রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। পাহলভি পরিবার পুনরায় ক্ষমতায় ফেরে এবং হয়ে ওঠে পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এরপর ইসরায়েল তেহরানে একটি দূতাবাস খোলে। ১৯৭০-এর দশকে দুই দেশ দুই দেশে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেয়। তেহরান-তেল আবিবের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও বিস্তৃত হয়। ইরান হয়ে ওঠে ইসরায়েলের প্রধান তেল সরবরাহকারী। সে সময় ইসরায়েল হয়ে ইউরোপে তেল পাঠানোর জন্য ইরান একটি পাইপলাইনও নির্মাণ করে।
এই সম্পর্ক ছিল মূলত গোপন, যেন আরব রাষ্ট্রগুলো ক্ষুব্ধ না হয়। কভিন্ডেসল্যান্ড বলেন, ‘ইসরায়েল ইরানকে যতটা প্রয়োজন মনে করত, ইরান ততটা না। ইসরায়েল সব সময়ই বেশি আগ্রহী ছিল। তবে শাহও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ইসরায়েলকে কাজে লাগাতে চাইতেন।’
ইরানের গোপন পুলিশ সংস্থা সাভাক গঠনে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সহায়তা ছিল বলেও ইতিহাসবিদেরা জানান। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর একটি নথিতে বলা হয়েছে, শাহের আমলে ইসরায়েল নিয়মিত ইরানে অস্ত্র বিক্রি করত। নথিতে বলা হয়, ‘এই অস্ত্র বিক্রি ইসরায়েলের নবগঠিত প্রতিরক্ষা শিল্পকে উল্লেখযোগ্যভাবে চাঙা করে তোলে, আর পারস্পরিক বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে ইরান থেকে দরকারি তেল পাওয়া যেত, যার বিনিময়ে ইসরায়েল অস্ত্র ও কারিগরি সহায়তা দিত।’
সিআইএর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েল ইরাকের কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি ইরানের সমর্থনে সহায়তা করতে আগ্রহী ছিল। এর বদলে, ইরানও সম্ভবত ইরাকি সেনাবাহিনী সম্পর্কে কিছু গোয়েন্দা তথ্য মোসাদের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। ওই নথিতে আরও বলা হয়েছে, ইরানে বসবাসরত ৯০ হাজার ইহুদির নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত করাও ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল। তবে শাহ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাননি। ১৯৭৯ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে শাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। ইরান ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ইসলামি আদর্শে দেশ পরিচালনার ডাক দেন। তাঁর দৃষ্টিতে ইসরায়েল ছিল ‘ছোট শয়তান’ আর যুক্তরাষ্ট্র ‘বড় শয়তান’। তিনি বলতেন, এই শক্তিগুলো বিশ্বজুড়ে নিপীড়নের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে।
তেহরান ইসরায়েলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। ইসরায়েলি দূতাবাসকে পরিণত করা হয় ফিলিস্তিনি দূতাবাসে। ইরানি নাগরিকদের জন্য ইসরায়েলে ভ্রমণ নিষিদ্ধ হয়। বিমান যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খোমেনি পবিত্র রমজানের শেষ শুক্রবারকে ‘আল-কুদস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দিনটি জেরুজালেমের (যাকে আরবিতে বলা হয় আল-কুদস) মুক্তির দাবিতে প্রতিবছর ইরানে বড় বড় র্যালি অনুষ্ঠিত হয়।
কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফটের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ত্রিতা পারসি বলেন, খোমেনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে আরব জাতীয়তাবাদের নয়, ইসলামের একটি বিষয় হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। এর মাধ্যমে ইরান শুধু এই ইস্যুতে সক্রিয় থাকতেই নয়, নেতৃত্বও দিতে পারে—এমন ভিত্তি গড়ে তোলেন তিনি।
পারসি বলেন, ‘আরব-পারস্য বিভাজন এবং সুন্নি-শিয়া বিভক্তি অতিক্রম করে ইরান ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয়। এতে তারা ইসলামি বিশ্বের নেতৃত্বদানের অবস্থান তৈরি করে এবং যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত আরব সরকারগুলোকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় ঠেলে দেয়।’
১৯৮০—১৯৯০ এর দশকে ইরান ইসরায়েলবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবির্ভূত হয়। লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং পরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে হামাসকে ইরান প্রশিক্ষণ, অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতেই ইরান এ ধরনের ভূমিকা নেয়।
সিআইএ—এর তথ্য অনুসারে, ইরান ও ইসরায়েল প্রকাশ্যে একে অপরের শত্রুতে পরিণত হলেও পর্দার আড়ালে দুপক্ষের সম্পর্ক বজায় ছিল। ১৯৮০ সালে শুরু হওয়া এবং আট বছর ধরে চলা ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইসরায়েল মনে করেছিল, খোমেনির ইসলামি ইরানের চেয়ে সাদ্দাম হোসেনের ইরাকই তাদের জন্য বেশি বিপজ্জনক। সে কারণেই ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিলে, গোপনে ইরানে অস্ত্র সরবরাহে জড়িয়ে পড়ে।
এই ঘটনা পরবর্তীতে ‘ইরান-কনট্রা কেলেঙ্কারি’ নামে ফাঁস হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, ইসরায়েলি মধ্যস্থতায় ইরানে অস্ত্র পাঠানো হচ্ছিল। এর বিনিময়ে লেবাননে বন্দী থাকা মার্কিনিদের মুক্ত করতে সহায়তা এবং নিকারাগুয়ায় মার্কিনপন্থী বিদ্রোহীদের অর্থ জোগানো হচ্ছিল। তখন ইরান-ইসরায়েলের প্রকাশ্য বৈরিতার কথা মাথায় রেখে এই সম্পর্ক অনেককেই বিস্মিত করে। ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে এতটাই গোপন সহযোগিতা চলছিল যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল—ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি অস্ত্র বা যন্ত্রাংশ ইরানে পৌঁছে দিচ্ছে কিনা।
১৯৮৫ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে সিআইএর এক প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘Israel and Iran: The ties that bind—অর্থাৎ ইসরায়েল ও ইরান: যে বন্ধনে তারা বাঁধা।’ এতে লেখা ছিল, ‘আমাদের ধারণা, ইসরায়েল যে ইরানে অস্ত্র বিক্রি করছে, সেটা ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকেই চলছে এবং এখনো চলছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘১৯৫০-এর দশকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে যে কৌশলগত হিসাব ছিল, সেই একই কারণে ইসরায়েল এখনো এই অস্ত্র বিক্রির প্রতি সহনশীল মনোভাব দেখাচ্ছে। ইসরায়েলিরা আমাদের বলেছে, তারা চায় এই সহায়তা ইরান-ইরাক যুদ্ধকে দীর্ঘতর করুক, যাতে ইরাকের বিশাল সামরিক শক্তি পূর্ব সীমান্তেই আটকে থাকে। তবে তারা সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রের গোয়েন্দা সহায়তা দেবে না, কারণ এতে ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে এবং ইরান এই তথ্য সিরিয়ার মতো ইসরায়েলবিরোধী দেশের সঙ্গে শেয়ার করতে পারে।’
সিআইএর ওই গোপন নথিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েল বিশ্বাস করত—যুক্তরাষ্ট্র যতই প্রকাশ্যে ইরানকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত উপসাগরীয় স্বার্থ রক্ষার জন্যই যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে হবে। ইসরায়েল মনে করত, ইরান উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত শক্তি এবং ইসরায়েল আশা করত, ভবিষ্যতে এই গোপন সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে।
আজকের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি অত্যন্ত আশ্চর্যজনক শোনালেও, তখন ইসরায়েল সত্যিই বিশ্বাস করত, তারা যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে। সিআইএ নথিতে বলা হয়, ‘তেল নিয়ে ইসরায়েলের চিন্তা এতটাই গভীর ছিল যে, তারা বিশ্বাস করত, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে, তাহলে তারাও ইরান থেকে তেল কিনতে পারবে।’
তবে ইসরায়েল নিশ্চিত ছিল, তাদের এই সহায়তা পুরোপুরি গোপনই থাকবে। সিআইএ নথিতে লেখা হয়, ‘খোমেনি শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তিমূলক মনোভাব সম্পর্কে ইসরায়েল সচেতন এবং তারা তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষককে (যুক্তরাষ্ট্রকে) রাগানোর ঝুঁকি নিতে চায় না। সে কারণে ইসরায়েল এমন মাত্রায় অস্ত্র বিক্রি করবে না, যা আর অস্বীকার করার সুযোগ রাখবে না। মার্কিন উদ্বেগের কারণে ইসরায়েল অতীতে কখনো ইরানকে বড় ধরনের অস্ত্র—যেমন ট্যাংক বা বিমান বিক্রি করেনি।’
১৯৯০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েলের এই গোপন সম্পর্কের অবসান ঘটে। কারণ, সে সময়ই ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে, যা ইসরায়েলের জন্য অস্তিত্বগত হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ইরান পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করলে, ইসরায়েল সন্দেহ করে এটি আসলে একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রকল্প। এরপর ইরান হিজবুল্লাহ, হামাস ও হুতিদের মতো ইসরায়েলবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তাদের সমর্থন আরও জোরদার করে। ইরান লেবানন, সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেনসহ বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও সশস্ত্র দলগুলো নিয়ে ‘এক্সিস অব রেজিস্যান্স’ বা ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ গঠন করেছে। এই জোট ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করে এবং ইসরায়েলকে প্রধান শত্রু মনে করে।
অন্যদিকে ইসরায়েলও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে সমর্থন দিচ্ছে, যারা ইরান সরকারবিরোধী এবং সশস্ত্র কার্যক্রম চালায়। তেহরানের ভাষায়, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে ইউরোপভিত্তিক মুজাহিদীন-ই-খালক (এমইকে), দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের সুন্নি জঙ্গি সংগঠনগুলো এবং ইরাকি কুর্দিস্তানে অবস্থানকারী কুর্দি সশস্ত্র দলগুলো—যাদের ইরান ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করে।
২০২০-এর দশকে ইরান-ইসরায়েল বিরোধ ‘শ্যাডো ওয়ার’ বা ছায়াযুদ্ধে রূপ নেয়। ড্রোন হামলা, সাইবার যুদ্ধ এবং সমুদ্রপথে নাশকতা—সবই এই সংঘাতের অংশ হয়ে ওঠে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব যত বেড়েছে, ততই ইসরায়েলও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে এবং ইরানি উপস্থিতি ঠেকাতে বিভিন্ন সামরিক অভিযান চালিয়েছে।
চলতি বছরে এসে এই বৈরিতা আরও ঘনীভূত হয় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির রহস্যজনক দুর্ঘটনায় পড়ে মৃত্যু, তেহরানে ইসমাইল হানিয়া হত্যার পর। এরপর, দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে হামলা করে ইসরায়েল বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) এক শীর্ষ কমান্ডারকে হত্যা করে। এসব ঘটনার আলোকে গাজা যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষিতে, ২০২৪ সালে ইরান ও ইসরায়েল একে অপরের ওপর সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আরব দেশগুলো যখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চার চারটি যুদ্ধ লড়েছে একুশ শতকের আগ পর্যন্ত সে সময় ইরান ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো সংঘাতেই জড়ায়নি। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের পর ইরান ক্রমেই ইসরায়েলের বিষয়ে মনোভাব বদলাতে থাকে এবং একপর্যায়ে দুই দেশ চির শত্রুতে পরিণত হয়। আর যে আরব ইসরায়েলের ঘোরতর শত্রু ছিল সেই আরব দেশগুলো এখন ইসরায়েলের একপ্রকার মিত্রে পরিণত হয়েছে।
সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, ওমান, কুয়েতসহ অনেকেই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে বা করার পথে আছে। সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের পতনের পর নতুন সরকার গোপনে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। অর্থাৎ, কয়েক দশকের ব্যবধানে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ একপ্রকার উল্টে গেছে। ইসরায়েলের এক সময়ের শত্রুরা এখন ‘বন্ধু’ হওয়ার পথে আর এক সময়ের বন্ধু এখন চিরশত্রু।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা ও ইকোনমিক টাইমস

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এই দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা ৮ দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি।
২১ জুন ২০২৫
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এই দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা ৮ দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি।
২১ জুন ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এই দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা ৮ দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি।
২১ জুন ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

বিগত কয়েক দশক ধরে ইরান-ইসরায়েল শত্রুতা ছিল অন্তরালে, কখনোই তেমন প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু ২০২৩ সালে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর এই দুই দেশ স্বল্প সময়ের মধ্যে তিন তিনবার সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ সংঘর্ষ টানা ৮ দিন ধরে চলছে। ইসরায়েলের দাবি, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি।
২১ জুন ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে