Ajker Patrika

ফরেন পলিসির নিবন্ধ /প্রেক্ষাপট ভারত-মিয়ানমার: সীমান্তে শক্ত বেড়া দিলেই কি ভালো প্রতিবেশী পাওয়া যায়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ভারতের মণিপুর রাজ্যের মোরেহ এলাকায় সীমান্ত বেড়ার কাছে এক ভারতীয় নারী। ছবি: এএফপি
ভারতের মণিপুর রাজ্যের মোরেহ এলাকায় সীমান্ত বেড়ার কাছে এক ভারতীয় নারী। ছবি: এএফপি

ভারতের মিজোরামকে মিয়ানমারের চিন রাজ্য থেকে আলাদা করেছে তিয়াউ নদী। এই নদীর দুই ধার দুই দেশের মানুষেরই সাধারণ বিনোদনের একটি কেন্দ্র। মিজোরামে মাদক বিক্রি নিষিদ্ধ হওয়ায় ভারতের লোকজন শুকনো মৌসুমে প্রায়ই নদী পাড়ি দিয়ে গাড়িতে গান বাজাতে বাজাতে মিয়ানমারে অ্যালকোহল কিনতে যায়। কেবল মিজোরাম নয়, নাগাল্যান্ডের লংওয়া গ্রামের প্রধানের বাড়িটি দুই দেশের সীমান্তের মাঝ বরাবর।

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে প্রস্তাবিত ১ হাজার মাইল দীর্ঘ বেড়া সেখানকার সাপ্তাহিক আয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অভিবাসন, ঐতিহাসিক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ব্যাহত করার হুমকি দিচ্ছে। এসবই করা হচ্ছে নিরাপত্তার নামে। ভারত সরকার মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা ছাড়াই এই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাদের যুক্তি, এই বেড়া চোরাচালান, বিদ্রোহ এবং অবৈধ অভিবাসন সমস্যা কমাবে। একই অজুহাতে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ সীমান্তের বেশির ভাগ অংশেই বেড়া দিয়েছে।

তবে এই সীমান্ত বেড়ার সমস্যা কেবল ভারতেরই নয়, এটি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত থেকে শুরু করে ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে বেড়া তৈরির ক্রমবর্ধমান প্রবণতারই প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে বিশ্বে সীমান্ত প্রাচীরের বৃহত্তম অংশ এশিয়ায়। বিশ্বের মোট সীমান্ত বেড়ার ৫৬ শতাংশই এই অঞ্চলে। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর থেকে বিশ্বব্যাপী সীমান্ত প্রাচীর ও বেড়ার সংখ্যা ছয় গুণ বেড়েছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে যেখানে মাত্র এক ডজন সীমান্ত প্রাচীর ছিল, সেখানে বর্তমানে এটি অন্তত ৭৪ টিতে দাঁড়িয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে সীমান্ত বেড়ার মোট দৈর্ঘ্য ২০১৪ সালে ছিল ১৯৫ মাইল। সেখান থেকে ২০২২ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২০০ মাইলের বেশি। বর্তমানে বিশ্বের প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন এমন দেশে বাস করে, যেখানে তাদের সীমান্তে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছে।

ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদ, অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ এবং ৯ / ১১ পরবর্তী সময়ে সীমান্ত সুরক্ষিত করার প্রবণতাই এই বেড়া বৃদ্ধির কারণ। পাশাপাশি এটি এখন অর্থ উপার্জনেরও একটি পথ তৈরি করেছে। নজরদারি প্রযুক্তি, নির্মাণ চুক্তি এবং বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পকেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢুকে যাচ্ছে স্রেফ সীমান্ত সংক্রান্ত নিরাপত্তা ইস্যুতে দেশগুলোর ব্যয়ের কারণে।

২০২৫ সালের বৈশ্বিক সীমান্ত নিরাপত্তা বাজারের মূল্য ৪৯ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২৯ সালের মধ্যে এটি ৬৩ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিয়ানমার সীমান্তে ভারতের বেড়া দেওয়ার উদ্যোগ বৈশ্বিক সীমান্ত অবকাঠামো বৃদ্ধির একটি অংশ। এটি সীমান্ত ব্যবস্থাপনার প্রধান হাতিয়ার হিসেবে সরাসরি প্রতিরোধ ও অপরপক্ষকে আলাদা করে রাখার দিকে বৃহত্তর নীতিগত পরিবর্তের প্রতিফলন।

কিন্তু সীমান্ত বেড়া কি আসলেই কার্যকর? বিশ্বজুড়ে চোরাচালান এবং বেড়া নির্মাণের ওপর গবেষণা, পাশাপাশি ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তে বসবাসকারী চোরাকারবারি, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা গেছে—এই বেড়ার আসলে নেতিবাচক দিকই বেশি। এগুলো অপরাধের গতিপথ পরিবর্তন করে, সীমান্ত সংলগ্ন জনপদকে অস্থিতিশীল করে তোলে এমনকি আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্কের ওপরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

ভারত সরকারের মতে, বেড়া নির্মাণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার, অবৈধ কার্যকলাপ দমন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের একটি বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এর মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অস্ত্র, মাদক এবং নকল পণ্যের চলাচলও কমবে। মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের কারণে সেখানকার মানুষ সহিংসতা থেকে বাঁচতে মিজোরামে চলে আসছে। এই জন-চলাচলের সঙ্গে মিজোরাম-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাচালানের অর্থনীতিও ফুলেফেঁপে উঠেছে।

ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে একটি মাত্র সীমান্ত পারাপারে ২৭৭ মিলিয়ন ডলারের বেশি মাদক জব্দ করা হয়েছে। যেগুলোর বেশির ভাগই হেরোইন ও মেথামফেটামিন। তবে তাদের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সীমান্ত পারাপারে এই মাদক পাচারের মাত্র ৫ শতাংশ জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর রাজ্য জাতিগত সংঘাতের কবলে থাকায় এবং মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত হওয়ায় অস্ত্র চোরাচালানও বাড়ছে।

অবৈধ পণ্য, মাদক এবং অস্ত্রের এই ব্যাপক প্রবাহের কারণে অনেকেই মনে করেন কাঁটাতারের বেড়া কার্যকর সমাধান। বিশেষ করে, ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীরা এই পাহাড়ি, অরক্ষিত সীমান্তে টহল দিতে ক্লান্ত। ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যবর্তী সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনী বিদ্রোহ দমনের মূল দায়িত্ব পালনের কারণে এমনিতেই চাপে থাকে। চোরাচালান দমনের দায়িত্বকে তারা প্রায়শই বাড়তি বোঝা মনে করে। তবে অনেকেই স্বীকার করেছেন, শুধু অরক্ষিত সীমান্তই নয়, বরং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে দুর্নীতির ব্যাপকতাও এই অবৈধ ব্যবসাকে আরও সহজ করে তুলেছে।

ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে রাষ্ট্র বনাম চোরাকারবারির সাধারণ ধারণার বাইরেও একটি জটিল ও প্রায়শই সহজীবী সম্পর্ক বিদ্যমান। এটি বৈধ ও অবৈধ উভয় পণ্যের চাহিদার দ্বারা চালিত। অনেকেই এই পণ্য চলাচলের সুবিধা নিয়ে অর্থোপার্জন করে থাকে। এমনকি কেউ কেউ ঘুষ সংগ্রহের সুবিধার জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে সরকারি পদও কিনে থাকে। ফলে, সীমান্তে বেড়া দিলেই এই দুর্নীতি দূর হবে না। বরং এর ফলে কারা সুবিধা পাবে আর কারা পাবে না, কেবল সেই সমীকরণ পরিবর্তিত হবে।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে চোরাচালান নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, মাদক ও অন্যান্য পণ্যের চোরাচালান প্রায়শই রাষ্ট্রীয় হর্তাকর্তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। তবে দেশভেদে এর আনুষ্ঠানিকতা ও প্রয়োগের মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিছু চোরাচালান পথকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ মৌন অনুমোদন দিয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ চোরাচালানকারীদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক চুক্তির ওপর নির্ভর করে। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের আয় বাড়াতে ও অস্থির অঞ্চলগুলোতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়।

একইভাবে, উত্তর আফ্রিকায় রাষ্ট্রগুলো প্রায়শই নির্দিষ্ট কিছু চোরাচালান কার্যকলাপ মেনে নিচ্ছে। তারা বিভিন্ন অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বৃহৎ চোরাচালান অর্থনীতিকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে বোঝা যায় যে, বেড়ার মতো সীমান্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলোকে ব্যাহত করে না, বরং সেগুলো পুনর্বিন্যাস করে। এর ফলে, আরও সংগঠিত ও সুসংযুক্ত ‘খেলোয়াড়দের’ ক্ষমতা সুসংহত হতে পারে। অন্যদিকে, ছোট ও কম সম্পদশালী অংশগ্রহণকারীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।

আর হয়তো সে কারণেই (সাক্ষাৎকারে) ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের এক সুপ্রতিষ্ঠিত চোরাকারবারিকে বেড়া তাদের বিভিন্ন বড় আকারের কার্যক্রমে কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়নি। সীমান্ত এলাকায় অভিযান তদারককারী ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য, ‘কোটি কোটি টাকা উপার্জনকারী বড় চোরাকারবারিদের ক্ষেত্রে কাঁটাতারের বেড়ার মতো তুচ্ছ জিনিস কোনো বাধাই তৈরি করতে পারবে না।’

তবে ছোটখাটো অনানুষ্ঠানিক ব্যবসায়ীদের জন্য এটি ভিন্ন ব্যাপার হতে পারে। ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের এক ছোট চোরাকারবারি জোর দিয়ে বলেছেন, ‘ছোট ব্যবসায়ীদের জন্য, বেড়া না থাকা সব সময়ই ভালো।’ অন্য এক স্থানীয় ব্যবসায়ী ব্যাখ্যা করেছেন, ‘স্থানীয়রা সব সময় তাদের ব্যবসা অনানুষ্ঠানিকভাবেই করবে।’ সীমান্ত অঞ্চলে গভীর সাংস্কৃতিক এবং আত্মীয়তার বন্ধনের কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেছেন, একটি বেড়ার কারণে ‘সামাজিক বন্ধন ভেঙে যাবে। তারপর, অর্থনৈতিকভাবেও।’ ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা বেশি আশাবাদী, তারা সরকারের কাছ থেকে কিছুটা বাস্তববাদিতা আশা করেন। এক সীমান্ত ব্যবসায়ী বলেন, ‘তারা (সরকার) বোঝে যে ছোট ব্যবসায়ীদের টিকে থাকতে হবে’, যা থেকে বোঝা যায় যে, প্রস্তাবিত বেড়া সত্ত্বেও তিনি কিছুটা অস্পষ্টতা, আলোচনা এবং বোঝাপড়া অব্যাহত থাকার আশা করছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বজুড়ে সীমান্ত অবকাঠামো বাড়ছে। বিভিন্ন দেশ ও সীমান্তের গবেষণা থেকে জানা গেছে, কাঁটাতারের বেড়ার মতো অবকাঠামো চোরাচালানের খরচ বাড়িয়ে দেয়। এই খরচ হয়—পণ্য সামগ্রী বেড়ার ওপার থেকে আনার প্রযুক্তিগত ব্যয়, অথবা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে এটি পারাপার করার ব্যয়ে।

অস্ত্র বা মাদক ব্যবসায় জড়িত উচ্চ পুঁজির চোরাচালান নেটওয়ার্কগুলোর জন্য এই ব্যয় সামলানো তুলনামূলকভাবে সহজ। এটি তাদের বিশেষীকরণ বা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য উৎসাহিত করতে পারে। অন্যদিকে, সীমান্ত অঞ্চলের ছোটখাটো চোরাচালানিরা—যারা সাধারণত বৈধ পণ্য ও খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা করে—তাদের জন্য এই কাঁটাতারের বেড়া এক অসাধ্য বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

ঐতিহাসিকভাবে, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো মধ্যে পণ্য, মানুষ এবং ধারণা—যার মধ্যে হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের মতো ধর্মও অন্তর্ভুক্ত—আদান-প্রদান প্রাচীনকাল থেকেই বিদ্যমান। এখন, নরেন্দ্র মোদির সরকারের শুরু করা ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে, কৌশলগত অংশীদারত্ব বাড়াতে এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়কে উৎসাহিত করতে চাইছে। এই প্রেক্ষাপটে, কাঁটাতারের বেড়ার ধারণা যা স্থানীয় সম্প্রদায়গুলোকে নানা মাত্রিকভাবে বিভক্ত করে এবং আঞ্চলিক সংহতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা বেশ বিভ্রান্তিকর। যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে, বেড়া সীমান্তকে নিরাপদ করবে এবং এর ফলে আরও আনুষ্ঠানিক বা বৈধ বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।

সীমান্তে বৈধ পণ্যের ব্যবসা করা কিছু ব্যবসায়ী এর সঙ্গে একমত। এক ব্যবসায়ী আশা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আমরা প্রথমে হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হব, কিন্তু দিন শেষে বেড়া বৈধ ব্যবসাকে উৎসাহিত করবে।’ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘এই বেড়া মাদক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে এবং একই সঙ্গে বৈধ ব্যবসাকে চলতে দেবে।’ কিন্তু ইতিহাস ও বাস্তবতা তা বলে না।

অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে এখন মূল আলোচনার ইস্যু হয়ে আছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের ২০ শতাংশ ভূমি ছাড়ের বিষয়টি। ছবি: সংগৃহীত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।

উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।

প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।

পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।

পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।

কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।

দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।

শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।

কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।

উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।

ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।

রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।

দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।

দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।

লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।

জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।

তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।

রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি
মার্ক জাকারবার্গ, জেফ বেজোস ও ইলন মাস্ক সহ বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের কয়েকজন। ছবি: এএফপি

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।

সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।

বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।

উদ্ভাবন কি থেমে যাবে

অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।

যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো

গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।

বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে

ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে

গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।

চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব

বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।

আল-জাজিরা অবলম্বনে

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১: ২০
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।

তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।

অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।

তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।

তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।

এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।

এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৯: ৪৫
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠককে ঘিরে দিল্লিতে শুরু হয়েছে কূটনৈতিক প্রস্তুতি। চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের চাপ এবং জ্বালানির বাজারে অস্থিরতার মধ্যেই এই শীর্ষ সম্মেলন হতে যাচ্ছে। অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা এবং জ্বালানি—এই তিনটি খাত আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে বলে দুই দেশই নিশ্চিত করেছে।

রাষ্ট্রীয় সফরে বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতে পৌঁছে পরদিন শুক্রবার মোদির সঙ্গে বৈঠকে বসবেন পুতিন। এই বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা ছাড়াও নতুন কয়েকটি আন্তদপ্তর ও বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব ধরে রাখতে ভারতের নীতির জন্য এই বৈঠক একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাশিয়া থেকে ডিসকাউন্টে ভারতের তেল কেনা দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটনকে অসন্তুষ্ট করে আসছে। এই অসন্তুষ্টি থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন, যা মোট শুল্ককে ৫০ শতাংশে উন্নীত করেছে। তবে ভারত বলছে, তারা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার বিরোধী নয়, কিন্তু ১৪০ কোটি মানুষের জ্বালানি চাহিদা মেটাতেই বাধ্য হয়ে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা হচ্ছে। নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ‘রসনেফত’ ও ‘লুকওইল’ এর মতো রাশিয়ার কিছু কোম্পানি থেকে ভারত তেল কিনবে না বলে জানিয়েছে। তবে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রুশ সরবরাহকারীদের সঙ্গে বাণিজ্য চালু থাকবে।

পুতিনের এই সফরে দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হবে। ভারত রাশিয়ায় ওষুধ, কৃষিপণ্য ও টেক্সটাইল রপ্তানি বাড়াতে চায় এবং পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের অনুরোধ জানাবে। এ ছাড়া সার সরবরাহের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি এবং রাশিয়ায় ভারতীয় দক্ষ জনশক্তির নিরাপদ ও নিয়মিত অভিবাসন নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সমুদ্র পরিবহন, স্বাস্থ্যসেবা ও গণমাধ্যম সহযোগিতা বিষয়ক নথিপত্র চূড়ান্তের কাজও চলছে।

বুধবার এই বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইনডিপেনডেন্টের এক নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে, জ্বালানি সহযোগিতাই পুতিন-মোদি আলোচনার বড় অংশ দখল করবে। ভারতের ফার ইস্টে বিনিয়োগ, রাশিয়ার সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক প্রকল্প এবং কুদানকুলাম প্রকল্পের সম্প্রসারণ নিয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনা হবে। স্থানীয়ভাবে যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং তৃতীয় দেশে যৌথ পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়নের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখা হবে।

প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এই সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০১৮ সালের ৫.৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তির আওতায় ভারতের হাতে ইতিমধ্যে রাশিয়ার তিনটি এস-৪০০ স্কোয়াড্রন এসেছে। যুদ্ধজনিত কারণে বাকিগুলোর সরবরাহে যুদ্ধজনিত বিলম্ব হচ্ছে। ভারত এই সরবরাহ দ্রুত নিশ্চিত করতে চাপ দেবে। পাশাপাশি আরও এস-৪০০ কেনার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া হয়নি, যদিও বৈঠক থেকে কোনো ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা কম। রুশ নির্মিত এসইউ-৩০ এমকেআই যুদ্ধবিমান আপগ্রেড, অস্ত্র সরবরাহ দ্রুততর করা এবং যৌথ সামরিক মহড়ায় সমন্বয় জোরদার করার বিষয়েও আলোচনা হবে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত বহুজাতিক অস্ত্র সরবরাহকারীদের দিকে নজর বাড়ালেও রাশিয়া এখনো তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা অংশীদার। পুতিনের সফরকে সেই সম্পর্কটি আরও দৃঢ় করার বড় সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত