আজকের পত্রিকা ডেস্ক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন আদর্শবাদী আবহ তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়টাতে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকে সংগঠনের অভিজ্ঞ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রধান শক্তি আসলে বক্তৃতার মঞ্চে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রকাশ্যে তিরস্কার ও লজ্জা দেওয়ার ক্ষমতা।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচানো। আজও এই উক্তিই সংগঠনের মূল মিশনকে ধারণ করে।
বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও সংযত স্বভাবের হলেও মাঝে মাঝে তিনিও সরাসরি কথা বলেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলের গাজা উপত্যকা অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষা ছিল অস্বাভাবিক কঠোর ও কূটনৈতিকভাবে ‘অভদ্র’। তিনি বলেন, ‘আমরা বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ দেখছি। মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নাটকীয় বাধা তৈরি হচ্ছে। সত্য হলো—এ ধরনের ঘটনা নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে একেবারেই সহনীয় নয়।’
কিন্তু মনে হচ্ছে, বিশ্ব আর তা শুনছে না। ইউক্রেন, গাজা ও সুদানে চলমান যুদ্ধগুলো দেখাচ্ছে যে—জাতিসংঘ সনদে প্রতিশ্রুত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বর্তমান ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি এখন প্রায় দর্শকের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে শক্তির আধিপত্য বা গায়ের জোরই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক প্রধান ও কফি আনানের আমলে উপমহাসচিব লর্ড মার্ক ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘গুতেরেস অবশ্যই সাহসী কিছু কথা বলেন। কিন্তু তাঁকে এখন মূল খেলোয়াড় নয়, একেবারেই বাইরে থাকা মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কফির সময়ে ব্রিফিং রুম সাংবাদিকে ভরা থাকত। এখন সেটি যেন এক শোকাগার।’
জাতিসংঘকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। মার্কিন রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে শ্লথ করার হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছে এবং গ্লোবাল সাউথ ও প্রগতিশীল মহলের পক্ষে সংস্থাটি পক্ষপাতী বলে অভিযুক্ত করেছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, অনেক সময় জাতিসংঘ পশ্চিমা স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থাটিতে ৪০ হাজারের বেশি কর্মচারী রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটি ক্রমেই এক জটিল আমলাতান্ত্রিক দৈত্যে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বনেতারা একত্র হচ্ছেন। ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েই যেন প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপও সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, জাতিসংঘ মানুষকে একত্র করার ক্ষমতা হারিয়েছে।’
জাতিসংঘের সংকটের কেন্দ্রে মূলত নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব এই পরিষদের ওপর। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ জাতীয় সীমান্তের অখণ্ডতার ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। কারণ, সেখানে রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এই পাঁচ দেশ ভেটোর ক্ষমতা রাখে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা নীতি জাতিসংঘের মূল মূল্যবোধ ও নীতিকে নানাভাবে উপেক্ষা ও ক্ষুণ্ন করছে।
১৯৯০-এর দশকে কফি আনানের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন নাদের মুসাভিজাদেহ। তিনি বলেছেন, ৮০ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ ভেতর ও বাইরে থেকে দুই দিকের সংকটে পড়েছে। ভেতরের সংকট হলো, ২০ বছরের কর্তৃত্ব, সক্ষমতা ও প্রভাবের অবক্ষয়—বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও সংঘাতপীড়িত মানুষের ক্ষেত্রে। বাইরের সংকট হলো মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপত্তা পরিষদের ৫০ বছর অদৃশ্য থাকা অচলাবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূমিকা—যেন জাতিসংঘ একেবারেই গুরুত্বহীন, বরং কখনো কখনো সরাসরি বাধা।
মুসাভিজাদেহ আরও বলেন, বাইরে থেকে জাতিসংঘের সামনে তৃতীয় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের প্রভাবশালী দেশগুলো এবং ইউরোপ ও কানাডার মতো প্রচলিত সমর্থকেরা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে নতুন অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে উন্নয়ন ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। তাঁর ভাষায়, জাতিসংঘের জন্য এই তিনমুখী সংকটই অস্তিত্ব সংকট।
এমন এক কঠিন প্রেক্ষাপটে ৮০তম জন্মদিনে জাতিসংঘ সচিবালয় সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে ‘ইউএন ৮০’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এর প্রস্তাবনায় রয়েছে—সংস্থার অসংখ্য দপ্তর ও কর্মসূচিকে একীভূত করা এবং বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট। জাতিসংঘের সমর্থকেরা এই সংকটকে একধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের আশা, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে আরও ছোট, কার্যকর ও প্রতিষ্ঠাতাদের মূল মূল্যবোধ রক্ষায় নিবেদিত একটি সংস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
তবে বাতাসে আরও এক অন্ধকার আশঙ্কাও ভেসে বেড়াচ্ছে—প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে গঠিত দুর্ভাগা ‘লিগ অব ন্যাশনস’-এর মতো দশা হতে পারে জাতিসংঘের। যে সংগঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ বলেন, জাতিসংঘ এখন অপ্রাসঙ্গিকতার দোরগোড়ায়। এটাই এর বিপদ। স্বপ্ন হয়তো বেঁচে আছে, কিন্তু কেউ খবর দেখে আর বলে না—আজ জাতিসংঘে কী হলো?
কাগ নিজেই প্রশ্ন করেন, এটাকে কি বাঁচানো সম্ভব? উত্তরে তিনিই বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে ইচ্ছাশক্তির ওপর। আর বিষয়টা অতীতের জাতিসংঘকে ফিরিয়ে আনার নয়; বরং একেবারেই ভিন্ন কাঠামো আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
জাতিসংঘের কাঠামোতে যেকোনো বড় ধরনের সংস্কার করতে হলে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে। তবে জাতিসংঘের ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে এই সংগঠন সৃষ্টির নকশা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রধান অর্থদাতাও তারা। তবে একই সঙ্গে জাতিসংঘের বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় সেগুলো উপেক্ষা করেছে দেশটি। এমন এক সময়েই জাতিসংঘের সদর দপ্তরের আঙিনায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার এ সময়ে সংস্থাটির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভয়াবহ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘জাতিসংঘের অস্তিত্বজুড়ে আমেরিকার দ্বিচারিতার ইতিহাস রয়ে গেছে। তবু আমেরিকা সব সময় এটিকে অর্থ জুগিয়েছে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি জাতিসংঘের নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করেছে, যদিও অনেক সময় সেটা ভাঁওতা ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি আরও বলেন, কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছে। আর ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট ধারণা প্ররোচিত চুক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ককে ভাঙনের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালেও দুজন নিয়মিত কথা বলতেন। এমনকি আনানের বিদায়ী ভোজও আয়োজন করেছিলেন বুশ। এ বিষয়ে বুশের আমলে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জন বোল্টন বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না ট্রাম্প কখনো গুতেরেসের সঙ্গে কথা বলেন, শুধু নিউইয়র্কে বক্তৃতা দিতে গেলে ছাড়া।’ বোল্টন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য ও রিপাবলিকান নেতারা চান, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাক। এ বছরই রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে জাতিসংঘবিরোধী ২০টিরও বেশি প্রস্তাব তুলেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—যেসব দেশ জাতিসংঘে যত ভোট হয়, তার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের কম বার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসঙ্গে ভোট দিয়েছে বা দেয়, তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ রাখা হোক। এ ছাড়া জাতিসংঘ থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়া ও নিউইয়র্ক সদর দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও আছে এসব প্রস্তাবে।
আরেকটি বড় টানাপোড়েন হলো ইসরায়েল। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের দীর্ঘদিনের অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয় এটি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক উইলিয়াম গ্রান্ট বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘকে প্রতিপক্ষ মনে করে, এমনকি সচিবালয়কেও। আর অনেক সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ তো আছেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাজ ছিল ইসরায়েলকে রক্ষা করা ও আক্রমণ ঠেকানো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলের ২৩ মাসব্যাপী যুদ্ধ এবং এতে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে বৈশ্বিক ক্ষোভ আরও বেড়েছে। হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক পিটার রাফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘবিরোধী সেই সমালোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, জাতিসংঘ যদি নিজেকে গুছিয়ে নিতে না পারে, তবে এর পরিণতি হবে অন্য অনেক সংগঠনের মতোই—আস্থা হারিয়ে একসময় শূন্যতায় পরিণত হওয়া। তবে রিপাবলিকান প্রশাসনগুলো সাধারণত জাতিসংঘ নিয়ে অভিযোগ তুললেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনে না। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিন কার্কপ্যাট্রিক একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে বের হতে চাইলে পারে, কিন্তু ঝামেলাটা নেওয়ার মতো মূল্যবান নয়।
জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের সমালোচক বোল্টনও একমত। তাঁর মতে, বেরিয়ে যাওয়া নয়, বরং সংস্থাটিকে সংস্কার করা ভালো। যেসব সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে পড়েছে বা মূল লক্ষ্য ছাড়িয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে সংস্থাটিকে ছোট করা উচিত। ট্রাম্প ও তাঁর দল মাঝেমধ্যে জাতিসংঘের আদর্শকে সম্মান জানান। ফেব্রুয়ারিতেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি জাতিসংঘের ‘অসাধারণ সম্ভাবনায়’ বিশ্বাস করেন। তবে এটাও যোগ করেছিলেন, তাঁর প্রশাসনের সবাই সে মতের নয়।
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইউজিন কন্তোরোভিচ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘ সংস্কারে আগ্রহ দেখাবে না। বরং তারা জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং অর্থায়নও কমাবে। তাদের দৃষ্টিতে জাতিসংঘের অনেক কাজ—বিশেষ করে সহায়তা কার্যক্রম—সহজেই অন্য কোনো আঞ্চলিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো জাতিসংঘের সদস্য আছে, সেটা কেবল ‘আমলাতান্ত্রিক জড়তার’ কারণে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশের অগ্রাধিকার এখন নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। কারণ, ভেটো ক্ষমতা থাকা পাঁচ দেশের কাঠামোটি এখনো ১৯৪৫ সালের বাস্তবতা বহন করছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ও অন্য উদীয়মান শক্তিগুলো জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ে আসন দাবি করছে।
তবে কূটনীতিকেরা স্বীকার করছেন, আপাতত এই কাঠামো অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ কাকে উন্নীত করা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে জাতিসংঘের এজেন্ডা ও কার্যক্রম সংস্কারের দিকে, যদিও এখানেও লক্ষ্যকে ঘিরে তীব্র মতভেদ রয়েছে। মূল ভিন্নতা হলো—কেউ বলছে শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মানবিক উদ্যোগ কমাতে হবে। আবার কেউ জোর দিচ্ছে টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈষম্য হ্রাসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার ওপর, তবে এগুলো সহজ উপায়ে বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে।
জাতিসংঘের নীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন ৮০ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান গাই রাইডার বলেন, সচিবালয়ের অবস্থান পরিষ্কার—জাতিসংঘকে অবশ্যই তার মূল তিনটি স্তম্ভে অটল থাকতে হবে: শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার। তাঁর ভাষায়, ‘একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
গাই রাইডার স্বীকার করেছেন, জাতিসংঘ এখন ‘অসংখ্য খণ্ড খণ্ড দ্বীপের সমষ্টি’ এবং ‘খুব জটিল একটি ব্যবস্থা।’ তবে তাঁর মতে, গুতেরেস এখন সংকটময় সময়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—‘কীভাবে জাতিসংঘ আরও ভালো করতে পারে, সেটি নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখার।’
এমন সময়ে জাতিসংঘ দ্বিমুখী আর্থিক সংকটেও পড়েছে। যার ফলে কর্মী ও কর্মসূচি উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ছাঁটাই চলছে। দুই প্রধান দাতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপুল পরিমাণ বকেয়া গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি সাহায্যে ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন, অন্য দাতারাও সেই পথে হাঁটছেন।
২০২৬ সালে কিছু সংস্থায় ২০ শতাংশ কর্মী কমানোর ডাক দিয়েছেন গুতেরেস। সচিবালয়ও ১৫ শতাংশ বাজেট ও প্রায় ১৯ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, এতে অসংখ্য প্রাণ হুমকির মুখে পড়বে। তবে গোপনে অনেক জাতিসংঘ কর্মীও স্বীকার করেন, বহু সংস্থা ফোলানো আর অদক্ষভাবে পরিচালিত।
এ অন্ধকার বাস্তবতায় জাতিসংঘের পুরোনো মিত্ররা পুনরুজ্জীবনের পথ খুঁজছে। জাতিসংঘের অনড় সমর্থক নরওয়ে মেক্সিকোকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট গড়ছে, যার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ যেন তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধ ধরে রাখে, কিন্তু মিশনকে সহজ করে। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্ত আইদে বলেন, ‘এই আর্থিক সংকটকে আমাদের সুযোগে পরিণত করতে হবে—সংহত করতে হবে, কর্মসূচি কমাতে হবে। কঠিন ভালোবাসা দেখাতে হবে। অনেক সময় বড় সংস্কার ছোট সংস্কারের চেয়ে সহজ হয়।’
গ্লোবাল সাউথের কূটনীতিকেরা জোর দিয়ে বলছেন, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘ কমাতে পারে না। তবে কিছু সাবেক কর্মকর্তা ও ইউরোপীয় মিত্ররা ইঙ্গিত করছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সঠিক যে জাতিসংঘকে কিছু মানবিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী কাগ বলেন, ‘অন্যরা জাতিসংঘের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে। আপনি ধরে নিতে পারেন না যে, জাতিসংঘ সব সময় থাকবে। জাতিসংঘকে সবকিছু করতে হবে না। এটি ছোট হতে পারে, বেছে কাজ করতে পারে। বৈশ্বিক নীতিমালা তৈরি করতে পারবে, কিন্তু প্রতিটি কাজে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে না।’
২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্টিন গ্রিফিথস আরও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ‘ইউএন ৮০ মূলত কার্যকারিতা খোঁজার চেষ্টা করছে, প্রকৃত সংস্কার নয়। কাটছাঁট সামলাতে হবে, কিন্তু এর সঙ্গে ভিশন থাকতে হবে—জাতিসংঘ আসলে কী হতে চায়। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি গাজায় ইসরায়েলি হামলার মানবিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সরব ছিলেন।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘এটা তহবিলের সমস্যা নয়, প্রাসঙ্গিকতার সমস্যা। সঠিক মানুষকে বিশ্ব সংকটে সম্পৃক্ত করা দরকার—মধ্যস্থতায়, কূটনৈতিক সক্রিয়তায়।’
এই জটিল পরিস্থিতিতে আগামী বছরে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুতেরেস ও তাঁর পূর্বসূরি বান কি মুন গত দুই দশক ধরে বাড়তে থাকা মহাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলেছেন, তবে অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মতে তাঁরা ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক।
সিগ্রিড কাগ মনে করেন, জাতিসংঘের আরও ‘সক্রিয় কূটনীতিক’ দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘জাতিসংঘ এতটাই নীরব হয়ে গেছে যে অনেক সময় বোঝাই যায় না, তারা কোনো একটি ইস্যুতে জড়িত আছে।’ তবে ইতিহাস বলছে, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী শক্তিগুলো এমন হস্তক্ষেপকারী কাউকে সমর্থন দেবে না।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘর সংস্কারের বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক চলছে। ম্যালক-ব্রাউন উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ানোয় চীন ও গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান শক্তিগুলো নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে চাইছে। আর স্থবির নিরাপত্তা পরিষদের বিপরীতে সাধারণ পরিষদে নতুন এনার্জি তৈরি হয়েছে। তাঁর কল্পনায়, আরও ছোট ও কেন্দ্রভিত্তিক জাতিসংঘ এখনো বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কোনো ভ্রমে নেই। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক দিক থেকেই জাতিসংঘ চলমান এক মৃতদেহ বা জম্বি। এটি কখনো পুরোপুরি পড়েও যায় না, আবার জীবিতও না।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন আদর্শবাদী আবহ তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়টাতে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকে সংগঠনের অভিজ্ঞ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রধান শক্তি আসলে বক্তৃতার মঞ্চে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রকাশ্যে তিরস্কার ও লজ্জা দেওয়ার ক্ষমতা।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচানো। আজও এই উক্তিই সংগঠনের মূল মিশনকে ধারণ করে।
বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও সংযত স্বভাবের হলেও মাঝে মাঝে তিনিও সরাসরি কথা বলেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলের গাজা উপত্যকা অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষা ছিল অস্বাভাবিক কঠোর ও কূটনৈতিকভাবে ‘অভদ্র’। তিনি বলেন, ‘আমরা বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ দেখছি। মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নাটকীয় বাধা তৈরি হচ্ছে। সত্য হলো—এ ধরনের ঘটনা নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে একেবারেই সহনীয় নয়।’
কিন্তু মনে হচ্ছে, বিশ্ব আর তা শুনছে না। ইউক্রেন, গাজা ও সুদানে চলমান যুদ্ধগুলো দেখাচ্ছে যে—জাতিসংঘ সনদে প্রতিশ্রুত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বর্তমান ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি এখন প্রায় দর্শকের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে শক্তির আধিপত্য বা গায়ের জোরই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক প্রধান ও কফি আনানের আমলে উপমহাসচিব লর্ড মার্ক ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘গুতেরেস অবশ্যই সাহসী কিছু কথা বলেন। কিন্তু তাঁকে এখন মূল খেলোয়াড় নয়, একেবারেই বাইরে থাকা মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কফির সময়ে ব্রিফিং রুম সাংবাদিকে ভরা থাকত। এখন সেটি যেন এক শোকাগার।’
জাতিসংঘকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। মার্কিন রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে শ্লথ করার হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছে এবং গ্লোবাল সাউথ ও প্রগতিশীল মহলের পক্ষে সংস্থাটি পক্ষপাতী বলে অভিযুক্ত করেছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, অনেক সময় জাতিসংঘ পশ্চিমা স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থাটিতে ৪০ হাজারের বেশি কর্মচারী রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটি ক্রমেই এক জটিল আমলাতান্ত্রিক দৈত্যে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বনেতারা একত্র হচ্ছেন। ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েই যেন প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপও সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, জাতিসংঘ মানুষকে একত্র করার ক্ষমতা হারিয়েছে।’
জাতিসংঘের সংকটের কেন্দ্রে মূলত নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব এই পরিষদের ওপর। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ জাতীয় সীমান্তের অখণ্ডতার ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। কারণ, সেখানে রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এই পাঁচ দেশ ভেটোর ক্ষমতা রাখে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা নীতি জাতিসংঘের মূল মূল্যবোধ ও নীতিকে নানাভাবে উপেক্ষা ও ক্ষুণ্ন করছে।
১৯৯০-এর দশকে কফি আনানের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন নাদের মুসাভিজাদেহ। তিনি বলেছেন, ৮০ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ ভেতর ও বাইরে থেকে দুই দিকের সংকটে পড়েছে। ভেতরের সংকট হলো, ২০ বছরের কর্তৃত্ব, সক্ষমতা ও প্রভাবের অবক্ষয়—বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও সংঘাতপীড়িত মানুষের ক্ষেত্রে। বাইরের সংকট হলো মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপত্তা পরিষদের ৫০ বছর অদৃশ্য থাকা অচলাবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূমিকা—যেন জাতিসংঘ একেবারেই গুরুত্বহীন, বরং কখনো কখনো সরাসরি বাধা।
মুসাভিজাদেহ আরও বলেন, বাইরে থেকে জাতিসংঘের সামনে তৃতীয় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের প্রভাবশালী দেশগুলো এবং ইউরোপ ও কানাডার মতো প্রচলিত সমর্থকেরা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে নতুন অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে উন্নয়ন ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। তাঁর ভাষায়, জাতিসংঘের জন্য এই তিনমুখী সংকটই অস্তিত্ব সংকট।
এমন এক কঠিন প্রেক্ষাপটে ৮০তম জন্মদিনে জাতিসংঘ সচিবালয় সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে ‘ইউএন ৮০’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এর প্রস্তাবনায় রয়েছে—সংস্থার অসংখ্য দপ্তর ও কর্মসূচিকে একীভূত করা এবং বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট। জাতিসংঘের সমর্থকেরা এই সংকটকে একধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের আশা, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে আরও ছোট, কার্যকর ও প্রতিষ্ঠাতাদের মূল মূল্যবোধ রক্ষায় নিবেদিত একটি সংস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
তবে বাতাসে আরও এক অন্ধকার আশঙ্কাও ভেসে বেড়াচ্ছে—প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে গঠিত দুর্ভাগা ‘লিগ অব ন্যাশনস’-এর মতো দশা হতে পারে জাতিসংঘের। যে সংগঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ বলেন, জাতিসংঘ এখন অপ্রাসঙ্গিকতার দোরগোড়ায়। এটাই এর বিপদ। স্বপ্ন হয়তো বেঁচে আছে, কিন্তু কেউ খবর দেখে আর বলে না—আজ জাতিসংঘে কী হলো?
কাগ নিজেই প্রশ্ন করেন, এটাকে কি বাঁচানো সম্ভব? উত্তরে তিনিই বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে ইচ্ছাশক্তির ওপর। আর বিষয়টা অতীতের জাতিসংঘকে ফিরিয়ে আনার নয়; বরং একেবারেই ভিন্ন কাঠামো আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
জাতিসংঘের কাঠামোতে যেকোনো বড় ধরনের সংস্কার করতে হলে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে। তবে জাতিসংঘের ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে এই সংগঠন সৃষ্টির নকশা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রধান অর্থদাতাও তারা। তবে একই সঙ্গে জাতিসংঘের বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় সেগুলো উপেক্ষা করেছে দেশটি। এমন এক সময়েই জাতিসংঘের সদর দপ্তরের আঙিনায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার এ সময়ে সংস্থাটির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভয়াবহ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘জাতিসংঘের অস্তিত্বজুড়ে আমেরিকার দ্বিচারিতার ইতিহাস রয়ে গেছে। তবু আমেরিকা সব সময় এটিকে অর্থ জুগিয়েছে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি জাতিসংঘের নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করেছে, যদিও অনেক সময় সেটা ভাঁওতা ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি আরও বলেন, কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছে। আর ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট ধারণা প্ররোচিত চুক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ককে ভাঙনের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালেও দুজন নিয়মিত কথা বলতেন। এমনকি আনানের বিদায়ী ভোজও আয়োজন করেছিলেন বুশ। এ বিষয়ে বুশের আমলে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জন বোল্টন বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না ট্রাম্প কখনো গুতেরেসের সঙ্গে কথা বলেন, শুধু নিউইয়র্কে বক্তৃতা দিতে গেলে ছাড়া।’ বোল্টন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য ও রিপাবলিকান নেতারা চান, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাক। এ বছরই রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে জাতিসংঘবিরোধী ২০টিরও বেশি প্রস্তাব তুলেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—যেসব দেশ জাতিসংঘে যত ভোট হয়, তার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের কম বার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসঙ্গে ভোট দিয়েছে বা দেয়, তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ রাখা হোক। এ ছাড়া জাতিসংঘ থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়া ও নিউইয়র্ক সদর দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও আছে এসব প্রস্তাবে।
আরেকটি বড় টানাপোড়েন হলো ইসরায়েল। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের দীর্ঘদিনের অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয় এটি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক উইলিয়াম গ্রান্ট বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘকে প্রতিপক্ষ মনে করে, এমনকি সচিবালয়কেও। আর অনেক সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ তো আছেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাজ ছিল ইসরায়েলকে রক্ষা করা ও আক্রমণ ঠেকানো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলের ২৩ মাসব্যাপী যুদ্ধ এবং এতে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে বৈশ্বিক ক্ষোভ আরও বেড়েছে। হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক পিটার রাফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘবিরোধী সেই সমালোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, জাতিসংঘ যদি নিজেকে গুছিয়ে নিতে না পারে, তবে এর পরিণতি হবে অন্য অনেক সংগঠনের মতোই—আস্থা হারিয়ে একসময় শূন্যতায় পরিণত হওয়া। তবে রিপাবলিকান প্রশাসনগুলো সাধারণত জাতিসংঘ নিয়ে অভিযোগ তুললেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনে না। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিন কার্কপ্যাট্রিক একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে বের হতে চাইলে পারে, কিন্তু ঝামেলাটা নেওয়ার মতো মূল্যবান নয়।
জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের সমালোচক বোল্টনও একমত। তাঁর মতে, বেরিয়ে যাওয়া নয়, বরং সংস্থাটিকে সংস্কার করা ভালো। যেসব সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে পড়েছে বা মূল লক্ষ্য ছাড়িয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে সংস্থাটিকে ছোট করা উচিত। ট্রাম্প ও তাঁর দল মাঝেমধ্যে জাতিসংঘের আদর্শকে সম্মান জানান। ফেব্রুয়ারিতেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি জাতিসংঘের ‘অসাধারণ সম্ভাবনায়’ বিশ্বাস করেন। তবে এটাও যোগ করেছিলেন, তাঁর প্রশাসনের সবাই সে মতের নয়।
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইউজিন কন্তোরোভিচ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘ সংস্কারে আগ্রহ দেখাবে না। বরং তারা জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং অর্থায়নও কমাবে। তাদের দৃষ্টিতে জাতিসংঘের অনেক কাজ—বিশেষ করে সহায়তা কার্যক্রম—সহজেই অন্য কোনো আঞ্চলিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো জাতিসংঘের সদস্য আছে, সেটা কেবল ‘আমলাতান্ত্রিক জড়তার’ কারণে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশের অগ্রাধিকার এখন নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। কারণ, ভেটো ক্ষমতা থাকা পাঁচ দেশের কাঠামোটি এখনো ১৯৪৫ সালের বাস্তবতা বহন করছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ও অন্য উদীয়মান শক্তিগুলো জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ে আসন দাবি করছে।
তবে কূটনীতিকেরা স্বীকার করছেন, আপাতত এই কাঠামো অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ কাকে উন্নীত করা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে জাতিসংঘের এজেন্ডা ও কার্যক্রম সংস্কারের দিকে, যদিও এখানেও লক্ষ্যকে ঘিরে তীব্র মতভেদ রয়েছে। মূল ভিন্নতা হলো—কেউ বলছে শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মানবিক উদ্যোগ কমাতে হবে। আবার কেউ জোর দিচ্ছে টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈষম্য হ্রাসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার ওপর, তবে এগুলো সহজ উপায়ে বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে।
জাতিসংঘের নীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন ৮০ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান গাই রাইডার বলেন, সচিবালয়ের অবস্থান পরিষ্কার—জাতিসংঘকে অবশ্যই তার মূল তিনটি স্তম্ভে অটল থাকতে হবে: শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার। তাঁর ভাষায়, ‘একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
গাই রাইডার স্বীকার করেছেন, জাতিসংঘ এখন ‘অসংখ্য খণ্ড খণ্ড দ্বীপের সমষ্টি’ এবং ‘খুব জটিল একটি ব্যবস্থা।’ তবে তাঁর মতে, গুতেরেস এখন সংকটময় সময়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—‘কীভাবে জাতিসংঘ আরও ভালো করতে পারে, সেটি নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখার।’
এমন সময়ে জাতিসংঘ দ্বিমুখী আর্থিক সংকটেও পড়েছে। যার ফলে কর্মী ও কর্মসূচি উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ছাঁটাই চলছে। দুই প্রধান দাতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপুল পরিমাণ বকেয়া গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি সাহায্যে ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন, অন্য দাতারাও সেই পথে হাঁটছেন।
২০২৬ সালে কিছু সংস্থায় ২০ শতাংশ কর্মী কমানোর ডাক দিয়েছেন গুতেরেস। সচিবালয়ও ১৫ শতাংশ বাজেট ও প্রায় ১৯ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, এতে অসংখ্য প্রাণ হুমকির মুখে পড়বে। তবে গোপনে অনেক জাতিসংঘ কর্মীও স্বীকার করেন, বহু সংস্থা ফোলানো আর অদক্ষভাবে পরিচালিত।
এ অন্ধকার বাস্তবতায় জাতিসংঘের পুরোনো মিত্ররা পুনরুজ্জীবনের পথ খুঁজছে। জাতিসংঘের অনড় সমর্থক নরওয়ে মেক্সিকোকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট গড়ছে, যার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ যেন তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধ ধরে রাখে, কিন্তু মিশনকে সহজ করে। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্ত আইদে বলেন, ‘এই আর্থিক সংকটকে আমাদের সুযোগে পরিণত করতে হবে—সংহত করতে হবে, কর্মসূচি কমাতে হবে। কঠিন ভালোবাসা দেখাতে হবে। অনেক সময় বড় সংস্কার ছোট সংস্কারের চেয়ে সহজ হয়।’
গ্লোবাল সাউথের কূটনীতিকেরা জোর দিয়ে বলছেন, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘ কমাতে পারে না। তবে কিছু সাবেক কর্মকর্তা ও ইউরোপীয় মিত্ররা ইঙ্গিত করছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সঠিক যে জাতিসংঘকে কিছু মানবিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী কাগ বলেন, ‘অন্যরা জাতিসংঘের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে। আপনি ধরে নিতে পারেন না যে, জাতিসংঘ সব সময় থাকবে। জাতিসংঘকে সবকিছু করতে হবে না। এটি ছোট হতে পারে, বেছে কাজ করতে পারে। বৈশ্বিক নীতিমালা তৈরি করতে পারবে, কিন্তু প্রতিটি কাজে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে না।’
২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্টিন গ্রিফিথস আরও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ‘ইউএন ৮০ মূলত কার্যকারিতা খোঁজার চেষ্টা করছে, প্রকৃত সংস্কার নয়। কাটছাঁট সামলাতে হবে, কিন্তু এর সঙ্গে ভিশন থাকতে হবে—জাতিসংঘ আসলে কী হতে চায়। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি গাজায় ইসরায়েলি হামলার মানবিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সরব ছিলেন।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘এটা তহবিলের সমস্যা নয়, প্রাসঙ্গিকতার সমস্যা। সঠিক মানুষকে বিশ্ব সংকটে সম্পৃক্ত করা দরকার—মধ্যস্থতায়, কূটনৈতিক সক্রিয়তায়।’
এই জটিল পরিস্থিতিতে আগামী বছরে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুতেরেস ও তাঁর পূর্বসূরি বান কি মুন গত দুই দশক ধরে বাড়তে থাকা মহাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলেছেন, তবে অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মতে তাঁরা ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক।
সিগ্রিড কাগ মনে করেন, জাতিসংঘের আরও ‘সক্রিয় কূটনীতিক’ দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘জাতিসংঘ এতটাই নীরব হয়ে গেছে যে অনেক সময় বোঝাই যায় না, তারা কোনো একটি ইস্যুতে জড়িত আছে।’ তবে ইতিহাস বলছে, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী শক্তিগুলো এমন হস্তক্ষেপকারী কাউকে সমর্থন দেবে না।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘর সংস্কারের বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক চলছে। ম্যালক-ব্রাউন উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ানোয় চীন ও গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান শক্তিগুলো নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে চাইছে। আর স্থবির নিরাপত্তা পরিষদের বিপরীতে সাধারণ পরিষদে নতুন এনার্জি তৈরি হয়েছে। তাঁর কল্পনায়, আরও ছোট ও কেন্দ্রভিত্তিক জাতিসংঘ এখনো বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কোনো ভ্রমে নেই। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক দিক থেকেই জাতিসংঘ চলমান এক মৃতদেহ বা জম্বি। এটি কখনো পুরোপুরি পড়েও যায় না, আবার জীবিতও না।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান
আজকের পত্রিকা ডেস্ক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন আদর্শবাদী আবহ তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়টাতে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকে সংগঠনের অভিজ্ঞ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রধান শক্তি আসলে বক্তৃতার মঞ্চে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রকাশ্যে তিরস্কার ও লজ্জা দেওয়ার ক্ষমতা।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচানো। আজও এই উক্তিই সংগঠনের মূল মিশনকে ধারণ করে।
বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও সংযত স্বভাবের হলেও মাঝে মাঝে তিনিও সরাসরি কথা বলেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলের গাজা উপত্যকা অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষা ছিল অস্বাভাবিক কঠোর ও কূটনৈতিকভাবে ‘অভদ্র’। তিনি বলেন, ‘আমরা বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ দেখছি। মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নাটকীয় বাধা তৈরি হচ্ছে। সত্য হলো—এ ধরনের ঘটনা নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে একেবারেই সহনীয় নয়।’
কিন্তু মনে হচ্ছে, বিশ্ব আর তা শুনছে না। ইউক্রেন, গাজা ও সুদানে চলমান যুদ্ধগুলো দেখাচ্ছে যে—জাতিসংঘ সনদে প্রতিশ্রুত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বর্তমান ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি এখন প্রায় দর্শকের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে শক্তির আধিপত্য বা গায়ের জোরই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক প্রধান ও কফি আনানের আমলে উপমহাসচিব লর্ড মার্ক ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘গুতেরেস অবশ্যই সাহসী কিছু কথা বলেন। কিন্তু তাঁকে এখন মূল খেলোয়াড় নয়, একেবারেই বাইরে থাকা মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কফির সময়ে ব্রিফিং রুম সাংবাদিকে ভরা থাকত। এখন সেটি যেন এক শোকাগার।’
জাতিসংঘকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। মার্কিন রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে শ্লথ করার হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছে এবং গ্লোবাল সাউথ ও প্রগতিশীল মহলের পক্ষে সংস্থাটি পক্ষপাতী বলে অভিযুক্ত করেছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, অনেক সময় জাতিসংঘ পশ্চিমা স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থাটিতে ৪০ হাজারের বেশি কর্মচারী রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটি ক্রমেই এক জটিল আমলাতান্ত্রিক দৈত্যে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বনেতারা একত্র হচ্ছেন। ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েই যেন প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপও সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, জাতিসংঘ মানুষকে একত্র করার ক্ষমতা হারিয়েছে।’
জাতিসংঘের সংকটের কেন্দ্রে মূলত নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব এই পরিষদের ওপর। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ জাতীয় সীমান্তের অখণ্ডতার ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। কারণ, সেখানে রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এই পাঁচ দেশ ভেটোর ক্ষমতা রাখে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা নীতি জাতিসংঘের মূল মূল্যবোধ ও নীতিকে নানাভাবে উপেক্ষা ও ক্ষুণ্ন করছে।
১৯৯০-এর দশকে কফি আনানের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন নাদের মুসাভিজাদেহ। তিনি বলেছেন, ৮০ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ ভেতর ও বাইরে থেকে দুই দিকের সংকটে পড়েছে। ভেতরের সংকট হলো, ২০ বছরের কর্তৃত্ব, সক্ষমতা ও প্রভাবের অবক্ষয়—বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও সংঘাতপীড়িত মানুষের ক্ষেত্রে। বাইরের সংকট হলো মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপত্তা পরিষদের ৫০ বছর অদৃশ্য থাকা অচলাবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূমিকা—যেন জাতিসংঘ একেবারেই গুরুত্বহীন, বরং কখনো কখনো সরাসরি বাধা।
মুসাভিজাদেহ আরও বলেন, বাইরে থেকে জাতিসংঘের সামনে তৃতীয় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের প্রভাবশালী দেশগুলো এবং ইউরোপ ও কানাডার মতো প্রচলিত সমর্থকেরা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে নতুন অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে উন্নয়ন ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। তাঁর ভাষায়, জাতিসংঘের জন্য এই তিনমুখী সংকটই অস্তিত্ব সংকট।
এমন এক কঠিন প্রেক্ষাপটে ৮০তম জন্মদিনে জাতিসংঘ সচিবালয় সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে ‘ইউএন ৮০’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এর প্রস্তাবনায় রয়েছে—সংস্থার অসংখ্য দপ্তর ও কর্মসূচিকে একীভূত করা এবং বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট। জাতিসংঘের সমর্থকেরা এই সংকটকে একধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের আশা, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে আরও ছোট, কার্যকর ও প্রতিষ্ঠাতাদের মূল মূল্যবোধ রক্ষায় নিবেদিত একটি সংস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
তবে বাতাসে আরও এক অন্ধকার আশঙ্কাও ভেসে বেড়াচ্ছে—প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে গঠিত দুর্ভাগা ‘লিগ অব ন্যাশনস’-এর মতো দশা হতে পারে জাতিসংঘের। যে সংগঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ বলেন, জাতিসংঘ এখন অপ্রাসঙ্গিকতার দোরগোড়ায়। এটাই এর বিপদ। স্বপ্ন হয়তো বেঁচে আছে, কিন্তু কেউ খবর দেখে আর বলে না—আজ জাতিসংঘে কী হলো?
কাগ নিজেই প্রশ্ন করেন, এটাকে কি বাঁচানো সম্ভব? উত্তরে তিনিই বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে ইচ্ছাশক্তির ওপর। আর বিষয়টা অতীতের জাতিসংঘকে ফিরিয়ে আনার নয়; বরং একেবারেই ভিন্ন কাঠামো আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
জাতিসংঘের কাঠামোতে যেকোনো বড় ধরনের সংস্কার করতে হলে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে। তবে জাতিসংঘের ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে এই সংগঠন সৃষ্টির নকশা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রধান অর্থদাতাও তারা। তবে একই সঙ্গে জাতিসংঘের বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় সেগুলো উপেক্ষা করেছে দেশটি। এমন এক সময়েই জাতিসংঘের সদর দপ্তরের আঙিনায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার এ সময়ে সংস্থাটির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভয়াবহ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘জাতিসংঘের অস্তিত্বজুড়ে আমেরিকার দ্বিচারিতার ইতিহাস রয়ে গেছে। তবু আমেরিকা সব সময় এটিকে অর্থ জুগিয়েছে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি জাতিসংঘের নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করেছে, যদিও অনেক সময় সেটা ভাঁওতা ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি আরও বলেন, কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছে। আর ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট ধারণা প্ররোচিত চুক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ককে ভাঙনের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালেও দুজন নিয়মিত কথা বলতেন। এমনকি আনানের বিদায়ী ভোজও আয়োজন করেছিলেন বুশ। এ বিষয়ে বুশের আমলে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জন বোল্টন বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না ট্রাম্প কখনো গুতেরেসের সঙ্গে কথা বলেন, শুধু নিউইয়র্কে বক্তৃতা দিতে গেলে ছাড়া।’ বোল্টন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য ও রিপাবলিকান নেতারা চান, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাক। এ বছরই রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে জাতিসংঘবিরোধী ২০টিরও বেশি প্রস্তাব তুলেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—যেসব দেশ জাতিসংঘে যত ভোট হয়, তার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের কম বার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসঙ্গে ভোট দিয়েছে বা দেয়, তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ রাখা হোক। এ ছাড়া জাতিসংঘ থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়া ও নিউইয়র্ক সদর দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও আছে এসব প্রস্তাবে।
আরেকটি বড় টানাপোড়েন হলো ইসরায়েল। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের দীর্ঘদিনের অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয় এটি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক উইলিয়াম গ্রান্ট বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘকে প্রতিপক্ষ মনে করে, এমনকি সচিবালয়কেও। আর অনেক সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ তো আছেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাজ ছিল ইসরায়েলকে রক্ষা করা ও আক্রমণ ঠেকানো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলের ২৩ মাসব্যাপী যুদ্ধ এবং এতে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে বৈশ্বিক ক্ষোভ আরও বেড়েছে। হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক পিটার রাফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘবিরোধী সেই সমালোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, জাতিসংঘ যদি নিজেকে গুছিয়ে নিতে না পারে, তবে এর পরিণতি হবে অন্য অনেক সংগঠনের মতোই—আস্থা হারিয়ে একসময় শূন্যতায় পরিণত হওয়া। তবে রিপাবলিকান প্রশাসনগুলো সাধারণত জাতিসংঘ নিয়ে অভিযোগ তুললেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনে না। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিন কার্কপ্যাট্রিক একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে বের হতে চাইলে পারে, কিন্তু ঝামেলাটা নেওয়ার মতো মূল্যবান নয়।
জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের সমালোচক বোল্টনও একমত। তাঁর মতে, বেরিয়ে যাওয়া নয়, বরং সংস্থাটিকে সংস্কার করা ভালো। যেসব সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে পড়েছে বা মূল লক্ষ্য ছাড়িয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে সংস্থাটিকে ছোট করা উচিত। ট্রাম্প ও তাঁর দল মাঝেমধ্যে জাতিসংঘের আদর্শকে সম্মান জানান। ফেব্রুয়ারিতেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি জাতিসংঘের ‘অসাধারণ সম্ভাবনায়’ বিশ্বাস করেন। তবে এটাও যোগ করেছিলেন, তাঁর প্রশাসনের সবাই সে মতের নয়।
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইউজিন কন্তোরোভিচ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘ সংস্কারে আগ্রহ দেখাবে না। বরং তারা জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং অর্থায়নও কমাবে। তাদের দৃষ্টিতে জাতিসংঘের অনেক কাজ—বিশেষ করে সহায়তা কার্যক্রম—সহজেই অন্য কোনো আঞ্চলিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো জাতিসংঘের সদস্য আছে, সেটা কেবল ‘আমলাতান্ত্রিক জড়তার’ কারণে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশের অগ্রাধিকার এখন নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। কারণ, ভেটো ক্ষমতা থাকা পাঁচ দেশের কাঠামোটি এখনো ১৯৪৫ সালের বাস্তবতা বহন করছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ও অন্য উদীয়মান শক্তিগুলো জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ে আসন দাবি করছে।
তবে কূটনীতিকেরা স্বীকার করছেন, আপাতত এই কাঠামো অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ কাকে উন্নীত করা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে জাতিসংঘের এজেন্ডা ও কার্যক্রম সংস্কারের দিকে, যদিও এখানেও লক্ষ্যকে ঘিরে তীব্র মতভেদ রয়েছে। মূল ভিন্নতা হলো—কেউ বলছে শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মানবিক উদ্যোগ কমাতে হবে। আবার কেউ জোর দিচ্ছে টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈষম্য হ্রাসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার ওপর, তবে এগুলো সহজ উপায়ে বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে।
জাতিসংঘের নীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন ৮০ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান গাই রাইডার বলেন, সচিবালয়ের অবস্থান পরিষ্কার—জাতিসংঘকে অবশ্যই তার মূল তিনটি স্তম্ভে অটল থাকতে হবে: শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার। তাঁর ভাষায়, ‘একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
গাই রাইডার স্বীকার করেছেন, জাতিসংঘ এখন ‘অসংখ্য খণ্ড খণ্ড দ্বীপের সমষ্টি’ এবং ‘খুব জটিল একটি ব্যবস্থা।’ তবে তাঁর মতে, গুতেরেস এখন সংকটময় সময়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—‘কীভাবে জাতিসংঘ আরও ভালো করতে পারে, সেটি নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখার।’
এমন সময়ে জাতিসংঘ দ্বিমুখী আর্থিক সংকটেও পড়েছে। যার ফলে কর্মী ও কর্মসূচি উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ছাঁটাই চলছে। দুই প্রধান দাতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপুল পরিমাণ বকেয়া গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি সাহায্যে ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন, অন্য দাতারাও সেই পথে হাঁটছেন।
২০২৬ সালে কিছু সংস্থায় ২০ শতাংশ কর্মী কমানোর ডাক দিয়েছেন গুতেরেস। সচিবালয়ও ১৫ শতাংশ বাজেট ও প্রায় ১৯ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, এতে অসংখ্য প্রাণ হুমকির মুখে পড়বে। তবে গোপনে অনেক জাতিসংঘ কর্মীও স্বীকার করেন, বহু সংস্থা ফোলানো আর অদক্ষভাবে পরিচালিত।
এ অন্ধকার বাস্তবতায় জাতিসংঘের পুরোনো মিত্ররা পুনরুজ্জীবনের পথ খুঁজছে। জাতিসংঘের অনড় সমর্থক নরওয়ে মেক্সিকোকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট গড়ছে, যার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ যেন তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধ ধরে রাখে, কিন্তু মিশনকে সহজ করে। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্ত আইদে বলেন, ‘এই আর্থিক সংকটকে আমাদের সুযোগে পরিণত করতে হবে—সংহত করতে হবে, কর্মসূচি কমাতে হবে। কঠিন ভালোবাসা দেখাতে হবে। অনেক সময় বড় সংস্কার ছোট সংস্কারের চেয়ে সহজ হয়।’
গ্লোবাল সাউথের কূটনীতিকেরা জোর দিয়ে বলছেন, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘ কমাতে পারে না। তবে কিছু সাবেক কর্মকর্তা ও ইউরোপীয় মিত্ররা ইঙ্গিত করছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সঠিক যে জাতিসংঘকে কিছু মানবিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী কাগ বলেন, ‘অন্যরা জাতিসংঘের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে। আপনি ধরে নিতে পারেন না যে, জাতিসংঘ সব সময় থাকবে। জাতিসংঘকে সবকিছু করতে হবে না। এটি ছোট হতে পারে, বেছে কাজ করতে পারে। বৈশ্বিক নীতিমালা তৈরি করতে পারবে, কিন্তু প্রতিটি কাজে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে না।’
২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্টিন গ্রিফিথস আরও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ‘ইউএন ৮০ মূলত কার্যকারিতা খোঁজার চেষ্টা করছে, প্রকৃত সংস্কার নয়। কাটছাঁট সামলাতে হবে, কিন্তু এর সঙ্গে ভিশন থাকতে হবে—জাতিসংঘ আসলে কী হতে চায়। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি গাজায় ইসরায়েলি হামলার মানবিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সরব ছিলেন।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘এটা তহবিলের সমস্যা নয়, প্রাসঙ্গিকতার সমস্যা। সঠিক মানুষকে বিশ্ব সংকটে সম্পৃক্ত করা দরকার—মধ্যস্থতায়, কূটনৈতিক সক্রিয়তায়।’
এই জটিল পরিস্থিতিতে আগামী বছরে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুতেরেস ও তাঁর পূর্বসূরি বান কি মুন গত দুই দশক ধরে বাড়তে থাকা মহাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলেছেন, তবে অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মতে তাঁরা ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক।
সিগ্রিড কাগ মনে করেন, জাতিসংঘের আরও ‘সক্রিয় কূটনীতিক’ দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘জাতিসংঘ এতটাই নীরব হয়ে গেছে যে অনেক সময় বোঝাই যায় না, তারা কোনো একটি ইস্যুতে জড়িত আছে।’ তবে ইতিহাস বলছে, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী শক্তিগুলো এমন হস্তক্ষেপকারী কাউকে সমর্থন দেবে না।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘর সংস্কারের বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক চলছে। ম্যালক-ব্রাউন উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ানোয় চীন ও গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান শক্তিগুলো নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে চাইছে। আর স্থবির নিরাপত্তা পরিষদের বিপরীতে সাধারণ পরিষদে নতুন এনার্জি তৈরি হয়েছে। তাঁর কল্পনায়, আরও ছোট ও কেন্দ্রভিত্তিক জাতিসংঘ এখনো বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কোনো ভ্রমে নেই। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক দিক থেকেই জাতিসংঘ চলমান এক মৃতদেহ বা জম্বি। এটি কখনো পুরোপুরি পড়েও যায় না, আবার জীবিতও না।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে যখন আদর্শবাদী আবহ তুঙ্গে, ঠিক সেই সময়টাতে ১৯৪৫ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকে সংগঠনের অভিজ্ঞ নেতারা বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁদের প্রধান শক্তি আসলে বক্তৃতার মঞ্চে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে প্রকাশ্যে তিরস্কার ও লজ্জা দেওয়ার ক্ষমতা।
জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচানো। আজও এই উক্তিই সংগঠনের মূল মিশনকে ধারণ করে।
বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তুলনামূলকভাবে সতর্ক ও সংযত স্বভাবের হলেও মাঝে মাঝে তিনিও সরাসরি কথা বলেন। গত সপ্তাহে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলের গাজা উপত্যকা অভিযানের তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষা ছিল অস্বাভাবিক কঠোর ও কূটনৈতিকভাবে ‘অভদ্র’। তিনি বলেন, ‘আমরা বেসামরিক নাগরিকদের ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ দেখছি। মানবিক সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে নাটকীয় বাধা তৈরি হচ্ছে। সত্য হলো—এ ধরনের ঘটনা নৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে একেবারেই সহনীয় নয়।’
কিন্তু মনে হচ্ছে, বিশ্ব আর তা শুনছে না। ইউক্রেন, গাজা ও সুদানে চলমান যুদ্ধগুলো দেখাচ্ছে যে—জাতিসংঘ সনদে প্রতিশ্রুত বিশ্বব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বর্তমান ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, সংস্থাটি এখন প্রায় দর্শকের ভূমিকা পালন করছে—যেখানে শক্তির আধিপত্য বা গায়ের জোরই নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্ব।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সাবেক প্রধান ও কফি আনানের আমলে উপমহাসচিব লর্ড মার্ক ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘গুতেরেস অবশ্যই সাহসী কিছু কথা বলেন। কিন্তু তাঁকে এখন মূল খেলোয়াড় নয়, একেবারেই বাইরে থাকা মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কফির সময়ে ব্রিফিং রুম সাংবাদিকে ভরা থাকত। এখন সেটি যেন এক শোকাগার।’
জাতিসংঘকে ঘিরে সমালোচনা নতুন কিছু নয়। মার্কিন রক্ষণশীলরা দীর্ঘদিন ধরে এটিকে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিকে শ্লথ করার হাতিয়ার হিসেবে দেখে এসেছে এবং গ্লোবাল সাউথ ও প্রগতিশীল মহলের পক্ষে সংস্থাটি পক্ষপাতী বলে অভিযুক্ত করেছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো মনে করে, অনেক সময় জাতিসংঘ পশ্চিমা স্বার্থের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। সংস্থাটিতে ৪০ হাজারের বেশি কর্মচারী রয়েছেন। এই সংখ্যা সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে এটি ক্রমেই এক জটিল আমলাতান্ত্রিক দৈত্যে পরিণত হয়েছে।
চলতি সপ্তাহে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনে বিশ্বনেতারা একত্র হচ্ছেন। ৮০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতিসংঘের অস্তিত্ব নিয়েই যেন প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপও সমালোচনায় যোগ দিয়েছেন। চলতি মাসের শুরুতে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এটা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে, জাতিসংঘ মানুষকে একত্র করার ক্ষমতা হারিয়েছে।’
জাতিসংঘের সংকটের কেন্দ্রে মূলত নিরাপত্তা পরিষদের অচলাবস্থা। জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব এই পরিষদের ওপর। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ জাতীয় সীমান্তের অখণ্ডতার ধারণা ভেঙে দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। কারণ, সেখানে রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ব্রিটেন ও ফ্রান্স—এই পাঁচ দেশ ভেটোর ক্ষমতা রাখে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একতরফা নীতি জাতিসংঘের মূল মূল্যবোধ ও নীতিকে নানাভাবে উপেক্ষা ও ক্ষুণ্ন করছে।
১৯৯০-এর দশকে কফি আনানের ঘনিষ্ঠ সহকারী ছিলেন নাদের মুসাভিজাদেহ। তিনি বলেছেন, ৮০ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ ভেতর ও বাইরে থেকে দুই দিকের সংকটে পড়েছে। ভেতরের সংকট হলো, ২০ বছরের কর্তৃত্ব, সক্ষমতা ও প্রভাবের অবক্ষয়—বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও সংঘাতপীড়িত মানুষের ক্ষেত্রে। বাইরের সংকট হলো মহাশক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতার প্রত্যাবর্তন এবং নিরাপত্তা পরিষদের ৫০ বছর অদৃশ্য থাকা অচলাবস্থা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভূমিকা—যেন জাতিসংঘ একেবারেই গুরুত্বহীন, বরং কখনো কখনো সরাসরি বাধা।
মুসাভিজাদেহ আরও বলেন, বাইরে থেকে জাতিসংঘের সামনে তৃতীয় একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের প্রভাবশালী দেশগুলো এবং ইউরোপ ও কানাডার মতো প্রচলিত সমর্থকেরা জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে নতুন অংশীদারত্ব গড়ে তুলছে উন্নয়ন ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। তাঁর ভাষায়, জাতিসংঘের জন্য এই তিনমুখী সংকটই অস্তিত্ব সংকট।
এমন এক কঠিন প্রেক্ষাপটে ৮০তম জন্মদিনে জাতিসংঘ সচিবালয় সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে ‘ইউএন ৮০’ কর্মসূচির মাধ্যমে। এর প্রস্তাবনায় রয়েছে—সংস্থার অসংখ্য দপ্তর ও কর্মসূচিকে একীভূত করা এবং বাজেটে বড় ধরনের কাটছাঁট। জাতিসংঘের সমর্থকেরা এই সংকটকে একধরনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁদের আশা, এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে সংস্থাটিকে আরও ছোট, কার্যকর ও প্রতিষ্ঠাতাদের মূল মূল্যবোধ রক্ষায় নিবেদিত একটি সংস্থায় রূপান্তর করা সম্ভব হবে।
তবে বাতাসে আরও এক অন্ধকার আশঙ্কাও ভেসে বেড়াচ্ছে—প্রথম বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে গঠিত দুর্ভাগা ‘লিগ অব ন্যাশনস’-এর মতো দশা হতে পারে জাতিসংঘের। যে সংগঠন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রান্তিক হয়ে পড়েছিল। জাতিসংঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী সিগ্রিড কাগ বলেন, জাতিসংঘ এখন অপ্রাসঙ্গিকতার দোরগোড়ায়। এটাই এর বিপদ। স্বপ্ন হয়তো বেঁচে আছে, কিন্তু কেউ খবর দেখে আর বলে না—আজ জাতিসংঘে কী হলো?
কাগ নিজেই প্রশ্ন করেন, এটাকে কি বাঁচানো সম্ভব? উত্তরে তিনিই বলেন, হ্যাঁ। কিন্তু সেটা নির্ভর করছে ইচ্ছাশক্তির ওপর। আর বিষয়টা অতীতের জাতিসংঘকে ফিরিয়ে আনার নয়; বরং একেবারেই ভিন্ন কাঠামো আর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
জাতিসংঘের কাঠামোতে যেকোনো বড় ধরনের সংস্কার করতে হলে ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের সমর্থন লাগবে। তবে জাতিসংঘের ইতিহাসের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪৫ সালে এই সংগঠন সৃষ্টির নকশা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রধান অর্থদাতাও তারা। তবে একই সঙ্গে জাতিসংঘের বিধিনিষেধে বিরক্ত হয়ে অনেক সময় সেগুলো উপেক্ষা করেছে দেশটি। এমন এক সময়েই জাতিসংঘের সদর দপ্তরের আঙিনায় আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আবার এ সময়ে সংস্থাটির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভয়াবহ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ম্যালক-ব্রাউন বলেন, ‘জাতিসংঘের অস্তিত্বজুড়ে আমেরিকার দ্বিচারিতার ইতিহাস রয়ে গেছে। তবু আমেরিকা সব সময় এটিকে অর্থ জুগিয়েছে এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি জাতিসংঘের নীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করেছে, যদিও অনেক সময় সেটা ভাঁওতা ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি আরও বলেন, কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা কার্যত ভেঙে পড়েছে। আর ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট ধারণা প্ররোচিত চুক্তিকেন্দ্রিক কূটনীতি জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পর্ককে ভাঙনের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনানের সঙ্গে ইরাক যুদ্ধ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়ালেও দুজন নিয়মিত কথা বলতেন। এমনকি আনানের বিদায়ী ভোজও আয়োজন করেছিলেন বুশ। এ বিষয়ে বুশের আমলে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা জন বোল্টন বলেন, ‘আমার তো মনে হয় না ট্রাম্প কখনো গুতেরেসের সঙ্গে কথা বলেন, শুধু নিউইয়র্কে বক্তৃতা দিতে গেলে ছাড়া।’ বোল্টন ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।
ট্রাম্প প্রশাসনের অনেক সদস্য ও রিপাবলিকান নেতারা চান, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাক। এ বছরই রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে জাতিসংঘবিরোধী ২০টিরও বেশি প্রস্তাব তুলেছে। এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে—যেসব দেশ জাতিসংঘে যত ভোট হয়, তার মধ্যে অন্তত ৫০ শতাংশের কম বার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একসঙ্গে ভোট দিয়েছে বা দেয়, তাদের জন্য বিদেশি সহায়তা বন্ধ রাখা হোক। এ ছাড়া জাতিসংঘ থেকে সম্পূর্ণভাবে বেরিয়ে যাওয়া ও নিউইয়র্ক সদর দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার দাবিও আছে এসব প্রস্তাবে।
আরেকটি বড় টানাপোড়েন হলো ইসরায়েল। ওয়াশিংটনের সঙ্গে জাতিসংঘের সম্পর্কের দীর্ঘদিনের অন্যতম স্পর্শকাতর বিষয় এটি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক উইলিয়াম গ্রান্ট বলেন, ইসরায়েল জাতিসংঘকে প্রতিপক্ষ মনে করে, এমনকি সচিবালয়কেও। আর অনেক সদস্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ তো আছেই। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাজ ছিল ইসরায়েলকে রক্ষা করা ও আক্রমণ ঠেকানো।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর গাজায় ইসরায়েলের ২৩ মাসব্যাপী যুদ্ধ এবং এতে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক প্রাণহানির কারণে বৈশ্বিক ক্ষোভ আরও বেড়েছে। হাডসন ইনস্টিটিউটের গবেষক পিটার রাফ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘবিরোধী সেই সমালোচনাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, জাতিসংঘ যদি নিজেকে গুছিয়ে নিতে না পারে, তবে এর পরিণতি হবে অন্য অনেক সংগঠনের মতোই—আস্থা হারিয়ে একসময় শূন্যতায় পরিণত হওয়া। তবে রিপাবলিকান প্রশাসনগুলো সাধারণত জাতিসংঘ নিয়ে অভিযোগ তুললেও সম্পর্কের ক্ষেত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনে না। রোনাল্ড রিগ্যানের সময় জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জিন কার্কপ্যাট্রিক একবার বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ থেকে বের হতে চাইলে পারে, কিন্তু ঝামেলাটা নেওয়ার মতো মূল্যবান নয়।
জাতিসংঘের দীর্ঘদিনের সমালোচক বোল্টনও একমত। তাঁর মতে, বেরিয়ে যাওয়া নয়, বরং সংস্থাটিকে সংস্কার করা ভালো। যেসব সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাবিত হয়ে পড়েছে বা মূল লক্ষ্য ছাড়িয়েছে, সেগুলো বাদ দিয়ে সংস্থাটিকে ছোট করা উচিত। ট্রাম্প ও তাঁর দল মাঝেমধ্যে জাতিসংঘের আদর্শকে সম্মান জানান। ফেব্রুয়ারিতেই ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি জাতিসংঘের ‘অসাধারণ সম্ভাবনায়’ বিশ্বাস করেন। তবে এটাও যোগ করেছিলেন, তাঁর প্রশাসনের সবাই সে মতের নয়।
ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ইউজিন কন্তোরোভিচ বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন জাতিসংঘ সংস্কারে আগ্রহ দেখাবে না। বরং তারা জাতিসংঘ থেকে আরও দূরে সরে যাবে এবং অর্থায়নও কমাবে। তাদের দৃষ্টিতে জাতিসংঘের অনেক কাজ—বিশেষ করে সহায়তা কার্যক্রম—সহজেই অন্য কোনো আঞ্চলিক বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্পন্ন করা সম্ভব। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো জাতিসংঘের সদস্য আছে, সেটা কেবল ‘আমলাতান্ত্রিক জড়তার’ কারণে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অধিকাংশের অগ্রাধিকার এখন নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কার। কারণ, ভেটো ক্ষমতা থাকা পাঁচ দেশের কাঠামোটি এখনো ১৯৪৫ সালের বাস্তবতা বহন করছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, নাইজেরিয়া ও অন্য উদীয়মান শক্তিগুলো জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ে আসন দাবি করছে।
তবে কূটনীতিকেরা স্বীকার করছেন, আপাতত এই কাঠামো অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ কাকে উন্নীত করা হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে জাতিসংঘের এজেন্ডা ও কার্যক্রম সংস্কারের দিকে, যদিও এখানেও লক্ষ্যকে ঘিরে তীব্র মতভেদ রয়েছে। মূল ভিন্নতা হলো—কেউ বলছে শান্তি ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিয়ে মানবিক উদ্যোগ কমাতে হবে। আবার কেউ জোর দিচ্ছে টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও বৈষম্য হ্রাসে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার ওপর, তবে এগুলো সহজ উপায়ে বাস্তবায়নের পথ খুঁজতে হবে।
জাতিসংঘের নীতিবিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ও ইউএন ৮০ টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান গাই রাইডার বলেন, সচিবালয়ের অবস্থান পরিষ্কার—জাতিসংঘকে অবশ্যই তার মূল তিনটি স্তম্ভে অটল থাকতে হবে: শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন এবং মানবাধিকার। তাঁর ভাষায়, ‘একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’
গাই রাইডার স্বীকার করেছেন, জাতিসংঘ এখন ‘অসংখ্য খণ্ড খণ্ড দ্বীপের সমষ্টি’ এবং ‘খুব জটিল একটি ব্যবস্থা।’ তবে তাঁর মতে, গুতেরেস এখন সংকটময় সময়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ—‘কীভাবে জাতিসংঘ আরও ভালো করতে পারে, সেটি নিরপেক্ষভাবে খতিয়ে দেখার।’
এমন সময়ে জাতিসংঘ দ্বিমুখী আর্থিক সংকটেও পড়েছে। যার ফলে কর্মী ও কর্মসূচি উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ছাঁটাই চলছে। দুই প্রধান দাতা যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বিপুল পরিমাণ বকেয়া গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিদেশি সাহায্যে ব্যাপক কাটছাঁট করেছেন, অন্য দাতারাও সেই পথে হাঁটছেন।
২০২৬ সালে কিছু সংস্থায় ২০ শতাংশ কর্মী কমানোর ডাক দিয়েছেন গুতেরেস। সচিবালয়ও ১৫ শতাংশ বাজেট ও প্রায় ১৯ শতাংশ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। সাহায্য সংস্থাগুলো সতর্ক করছে, এতে অসংখ্য প্রাণ হুমকির মুখে পড়বে। তবে গোপনে অনেক জাতিসংঘ কর্মীও স্বীকার করেন, বহু সংস্থা ফোলানো আর অদক্ষভাবে পরিচালিত।
এ অন্ধকার বাস্তবতায় জাতিসংঘের পুরোনো মিত্ররা পুনরুজ্জীবনের পথ খুঁজছে। জাতিসংঘের অনড় সমর্থক নরওয়ে মেক্সিকোকে সঙ্গে নিয়ে একটি জোট গড়ছে, যার লক্ষ্য হলো জাতিসংঘ যেন তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূল্যবোধ ধরে রাখে, কিন্তু মিশনকে সহজ করে। নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসপেন বার্ত আইদে বলেন, ‘এই আর্থিক সংকটকে আমাদের সুযোগে পরিণত করতে হবে—সংহত করতে হবে, কর্মসূচি কমাতে হবে। কঠিন ভালোবাসা দেখাতে হবে। অনেক সময় বড় সংস্কার ছোট সংস্কারের চেয়ে সহজ হয়।’
গ্লোবাল সাউথের কূটনীতিকেরা জোর দিয়ে বলছেন, উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি জাতিসংঘ কমাতে পারে না। তবে কিছু সাবেক কর্মকর্তা ও ইউরোপীয় মিত্ররা ইঙ্গিত করছেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সঠিক যে জাতিসংঘকে কিছু মানবিক দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে হবে।
জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি এবং নেদারল্যান্ডসের সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী কাগ বলেন, ‘অন্যরা জাতিসংঘের দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারে। আপনি ধরে নিতে পারেন না যে, জাতিসংঘ সব সময় থাকবে। জাতিসংঘকে সবকিছু করতে হবে না। এটি ছোট হতে পারে, বেছে কাজ করতে পারে। বৈশ্বিক নীতিমালা তৈরি করতে পারবে, কিন্তু প্রতিটি কাজে সরাসরি যুক্ত থাকতে হবে না।’
২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম বিষয়ক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মার্টিন গ্রিফিথস আরও সাহসী দৃষ্টিভঙ্গির আহ্বান জানান। তাঁর মতে, ‘ইউএন ৮০ মূলত কার্যকারিতা খোঁজার চেষ্টা করছে, প্রকৃত সংস্কার নয়। কাটছাঁট সামলাতে হবে, কিন্তু এর সঙ্গে ভিশন থাকতে হবে—জাতিসংঘ আসলে কী হতে চায়। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি না।’ তিনি গাজায় ইসরায়েলি হামলার মানবিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে সরব ছিলেন।
মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, ‘এটা তহবিলের সমস্যা নয়, প্রাসঙ্গিকতার সমস্যা। সঠিক মানুষকে বিশ্ব সংকটে সম্পৃক্ত করা দরকার—মধ্যস্থতায়, কূটনৈতিক সক্রিয়তায়।’
এই জটিল পরিস্থিতিতে আগামী বছরে জাতিসংঘের পরবর্তী মহাসচিব নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গুতেরেস ও তাঁর পূর্বসূরি বান কি মুন গত দুই দশক ধরে বাড়তে থাকা মহাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা সামলেছেন, তবে অভ্যন্তরীণ সমালোচকদের মতে তাঁরা ঝুঁকি নিতে অনিচ্ছুক।
সিগ্রিড কাগ মনে করেন, জাতিসংঘের আরও ‘সক্রিয় কূটনীতিক’ দরকার। তাঁর ভাষায়, ‘জাতিসংঘ এতটাই নীরব হয়ে গেছে যে অনেক সময় বোঝাই যায় না, তারা কোনো একটি ইস্যুতে জড়িত আছে।’ তবে ইতিহাস বলছে, ভেটো ক্ষমতার অধিকারী শক্তিগুলো এমন হস্তক্ষেপকারী কাউকে সমর্থন দেবে না।
নিউইয়র্কে জাতিসংঘর সংস্কারের বিষয়ে প্রাণবন্ত বিতর্ক চলছে। ম্যালক-ব্রাউন উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়ানোয় চীন ও গ্লোবাল সাউথের উদীয়মান শক্তিগুলো নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে চাইছে। আর স্থবির নিরাপত্তা পরিষদের বিপরীতে সাধারণ পরিষদে নতুন এনার্জি তৈরি হয়েছে। তাঁর কল্পনায়, আরও ছোট ও কেন্দ্রভিত্তিক জাতিসংঘ এখনো বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে বর্তমান বাস্তবতা নিয়ে তিনি কোনো ভ্রমে নেই। তাঁর ভাষায়, ‘অনেক দিক থেকেই জাতিসংঘ চলমান এক মৃতদেহ বা জম্বি। এটি কখনো পুরোপুরি পড়েও যায় না, আবার জীবিতও না।’
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে অনুবাদ করেছেন আজকের পত্রিকার সহসম্পাদক আব্দুর রহমান

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।
ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।
ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।
এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।
‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।
সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

ভেনেজুয়েলার তেল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ—এমন মন্তব্য করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সহযোগী স্টিফেন মিলার।
গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে মিলার বলেন, ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প গড়ে উঠেছে ‘আমেরিকার শ্রম, উদ্ভাবন ও ঘামের’ ওপর আর সেটা রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়াকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের সবচেয়ে বড় ‘চুরি’ বলে অভিহিত করেন। মিলারের এই মন্তব্যের ঠিক এক দিন আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দেন—ভেনেজুয়েলায় প্রবেশ ও সেখান থেকে বের হওয়া সব তেলবাহী জাহাজের ওপর ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক অবরোধ’ আরোপ করা হচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার উপকূলের কাছাকাছি কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সেপ্টেম্বর থেকে মাদক পাচারের অভিযোগে বেশ কয়েকটি নৌযানে হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৯০ জন নিহত হয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করছে, এসব নৌকা যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণ মাদক পাচার করছিল এবং তা মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তবে এই অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা দেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোকেনসহ মাদক যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর প্রধান উৎস ভেনেজুয়েলা নয়। ফলে অনেকের মতে, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল নিয়ন্ত্রণ এবং নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতা থেকে সরানো।
মিলার কী বলেছেন
গতকাল বুধবার এক্সে দেওয়া পোস্টে স্টিফেন মিলার লেখেন, ‘আমেরিকার শ্রম, মেধা ও পরিশ্রমই ভেনেজুয়েলার তেলশিল্প সৃষ্টি করেছে। এই শিল্প জোরপূর্বক রাষ্ট্রায়ত্ত করা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদ ও সম্পত্তির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চুরি। আর সেই লুণ্ঠিত সম্পদ সন্ত্রাসবাদে অর্থ জোগাতে এবং আমাদের দেশের রাস্তায় খুনি, ভাড়াটে যোদ্ধা ও মাদক ছড়িয়ে দিতে ব্যবহৃত হয়েছে।’
মিলার তাঁর পোস্টে ট্রাম্পের আগের একটি বক্তব্যও যুক্ত করেন, যেখানে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের তেল, ভূমি ও অন্যান্য সম্পদ ‘চুরি’ করার অভিযোগ তোলেন। ওই পোস্টে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলার সরকারকে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন’ ঘোষণা করেন এবং দেশটির তেল ট্যাংকারগুলোর ওপর সম্পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দেন।
মিলার আরও বলেন, ভেনেজুয়েলা থেকে আসা অভিবাসীদের দ্রুত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো হবে এবং সব ‘চুরি হওয়া সম্পদ’ অবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলায় কী পরিমাণ তেল রয়েছে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলেই বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
২০২৩ সালের হিসাবে ভেনেজুয়েলার তেল মজুতের পরিমাণ প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল—যা বিশ্বে সর্বাধিক। তবে উৎপাদন ও রপ্তানি কমে যাওয়ায় দেশটি এখন তেল থেকে আগের মতো আয় করতে পারছে না।
অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সের (ওইসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ভেনেজুয়েলার অপরিশোধিত তেল রপ্তানির মূল্য ছিল মাত্র ৪ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে সৌদি আরব রপ্তানি করেছে ১৮১ বিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র ১২৫ বিলিয়ন ডলার ও রাশিয়া ১২২ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর দাবি করছে
২০ শতকের শুরুর দিকে ভেনেজুয়েলায় তেল অনুসন্ধান শুরু করে মার্কিন কোম্পানিগুলো। ১৯২২ সালে ভেনেজুয়েলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মারাকাইবো হ্রদ এলাকায় প্রথম বড় তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে রয়্যাল ডাচ শেল।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার তেল উত্তোলন ও উন্নয়নে বড় ধরনের বিনিয়োগ শুরু করে। স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের মতো কোম্পানিগুলো চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করে ভেনেজুয়েলাকে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ তেল সরবরাহকারীতে পরিণত করে।
১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ওপেক গঠনের সময় ভেনেজুয়েলা ছিল এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তবে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেজ তেলশিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করেন এবং পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা (পিডিভিএসএ) প্রতিষ্ঠা করেন।
পরে হুগো শাভেজ ক্ষমতায় এসে সব বিদেশি তেলসম্পদ জাতীয়করণ করেন। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া, অব্যবস্থাপনা ও বিনিয়োগের অভাবে তেল উৎপাদন ক্রমেই কমতে থাকে।
কবে থেকে নিষেধাজ্ঞা
২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম ভেনেজুয়েলার তেলশিল্পের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে নিকোলাস মাদুরোর শাসনামলে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দেশটি চীন, ভারত ও কিউবার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—যুক্তরাষ্ট্রের এমন দাবির কি কোনো আইনি ভিত্তি আছে
না, নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র তার ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক। এই নীতির নাম ‘স্থায়ী প্রাকৃতিক সম্পদে সার্বভৌম অধিকার’ (Permanent Sovereignty over Natural Resources)।
১৯৬২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের একটি প্রস্তাবে এই নীতি স্বীকৃতি পায়। সে অনুযায়ী, ভেনেজুয়েলার তেল সম্পূর্ণভাবে ভেনেজুয়েলারই। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ তেলের ওপর দাবি জানানো আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
তাহলে শেভরন কেন কাজ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও হিউস্টনভিত্তিক তেল কোম্পানি শেভরন ভেনেজুয়েলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত বিদেশি কোম্পানিগুলো ভেনেজুয়েলায় সরাসরি তেলক্ষেত্রের মালিক হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন পেট্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলার (পিডিভিএসএ) সঙ্গে যৌথভাবে তেল উৎপাদন করে এবং উৎপাদিত তেলের একটি অংশ পায়।
২০২২ সালে জো বাইডেন প্রশাসন শেভরনকে বিশেষ লাইসেন্স দেয়, যাতে তারা নিষেধাজ্ঞার বাইরে থেকে কাজ করতে পারে। চলতি বছর ট্রাম্প প্রশাসন সেই নিষেধাজ্ঞা ছাড় নবায়ন করেছে।
শেভরন দীর্ঘদিন ধরে ভেনেজুয়েলায় কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং সেখানে তাদের বিপুল সম্পদ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সরে গেলে সেই সম্পদ রাষ্ট্রের হাতে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে—যা অতীতে এক্সন, কারগিল ও হিলটনের মতো কোম্পানির ক্ষেত্রে ঘটেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন মূলত ঐতিহাসিকভাবে মার্কিন কোম্পানিগুলোর করা বিনিয়োগ ও পরে তা বাজেয়াপ্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে এই ‘মালিকানা’ দাবি করছে। তবে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় ও আন্তর্জাতিক আইনে কোনো দেশের সম্পদ অন্য দেশের মালিকানাধীন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এটি মূলত ভেনেজুয়েলায় শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন ও তেলের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটি ভূরাজনৈতিক কৌশল।
আল-জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা

জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে। সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত সমরাস্ত্রের ভান্ডার থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক ড্রোনের যুদ্ধক্ষেত্র—এই তিন দশকে ইউক্রেন ও চীনের সম্পর্ক এক অদ্ভুত ও জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে।
ইউক্রেনের সমরাস্ত্র ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় হলো ১৯৯৮ সালে চীনের কাছে সোভিয়েত আমলের ‘ভারিয়াগ’ রণতরি বিক্রি। ইউক্রেনের মাইকোলাইভ বন্দরে পড়ে থাকা এই বিশাল জাহাজটি বেইজিং কিনেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলারে। অবশ্য আজকের একটি আধুনিক যুদ্ধজাহাজের মূল্যের তুলনায় এটি অতি নগণ্য। বেইজিং তখন দাবি করেছিল, জাহাজটি একটি ভাসমান ক্যাসিনো ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু কয়েক বছর পরই বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, সেই পরিত্যক্ত ভারিয়াগই রূপান্তরিত হয়েছে চীনের প্রথম শক্তিশালী বিমানবাহী রণতরিতে, নাম তার ‘লিয়াওনিং’।
শুধু রণতরিই নয়, চীনের আধুনিক প্রতিরক্ষা শিল্পকে গড়ে তুলতে কিয়েভের কারিগরি সহায়তা ছিল অভাবনীয়। ইউক্রেন থেকে চীনে পাড়ি জমিয়েছে আরও অনেক প্রযুক্তি। এর মধ্যে রয়েছে: হেলিকপ্টার এবং শক্তিশালী ট্যাংক ইঞ্জিনের নকশা ও উৎপাদন প্রযুক্তি; চীনের নৌবাহিনীর গ্যাস টারবাইন এবং বিমানবিধ্বংসী রাডার ব্যবস্থার মূল কারিগরি জ্ঞান।
ইউক্রেন স্বীকার করেছে যে তারা একসময় অবৈধভাবে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম ছয়টি ‘কেএইচ-৫৫’ ক্রুজ মিসাইল বেইজিংয়ে পাঠিয়েছিল। এটি চীনের দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতাকে কয়েক দশক এগিয়ে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সম্পর্কের এই গতিপ্রকৃতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ ইউক্রেনীয় ড্রোন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি স্বীকার করছেন, যুদ্ধের ভাগ্য এখন বেইজিংয়ের হাতে। কিয়েভের ড্রোন যুদ্ধের অগ্রপথিক আন্দ্রেই প্রোনিন আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চীন চাইলে মাত্র এক দিনে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে। তারা শুধু আমাদের অথবা রুশদের কাছে ড্রোন যন্ত্রাংশ রপ্তানি বন্ধ করে দিলেই হলো।’
ইউক্রেনের আকাশে আজ যে লাখ লাখ ড্রোন উড়ছে, তার প্রতিটি উপাদানে চীনের ছাপ রয়েছে। ড্রোনের ফ্রেম, মোটর, ফ্লাইট কন্ট্রোলার, লিথিয়াম ব্যাটারি এবং নেভিগেশন মডিউল—সবই মূলত চীনা কারখানায় তৈরি।
‘স্নেক আইল্যান্ড’ নামক একটি সামরিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় ড্রোন শিল্প এখন পুরোপুরি চীনা আমদানির ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে নিওডিয়ামিয়াম ম্যাগনেট এবং থার্মাল সেন্সরের মতো জটিল কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের একচেটিয়া প্রভাব কিয়েভকে এক কঠিন রাজনৈতিক চাপে রেখেছে।
ইউক্রেনীয় নীতিনির্ধারকেরা মনে করেন, যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ পুনর্গঠনে চীনই হতে পারে সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের আমলে চীনের সঙ্গে যে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ শুরু হয়েছিল, কিয়েভ এখন তার আধুনিক সংস্করণ চাচ্ছে।
এ ছাড়া চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্পের জন্য ইউক্রেনের ভৌগোলিক অবস্থান অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ইউক্রেনকে উত্তর-পূর্ব চীন থেকে কাজাখস্তান ও ককেশাস হয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর প্রধান লজিস্টিক হাব বা ‘সেতুবন্ধনকারী দেশ’ হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বেইজিংয়ের।
তবে বিশ্লেষক ইগার তিশকেভিচের মতে, চীনকে ইউরোপীয় বাজারে উন্নততর প্রবেশের সুযোগ দিতে ইউক্রেনকে তার সোভিয়েত আমলের চওড়া রেললাইন বদলে পশ্চিমা মানদণ্ডের ন্যারো গেজ ট্র্যাকে রূপান্তর করতে হবে।
যুদ্ধের মধ্যেও চীন এখনো ইউক্রেনীয় ইস্পাত, ভোজ্যতেল এবং সয়াবিনের প্রধান ক্রেতা। এই বাণিজ্যই বর্তমানে ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে কোনোমতে সচল রেখেছে।
বিশ্লেষক অ্যালেক্সি কুশের মতে, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়া ইউক্রেনের জন্য একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে পারে। তিনি মনে করেন, ইউক্রেনের কূটনীতি কেবল পশ্চিমমুখী হলে চলবে না, বরং চীনসহ পুরো ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। সমরাস্ত্রের গোপন অতীত এবং ড্রোনের অনিশ্চিত বর্তমানকে পেছনে ফেলে, কিয়েভ এখন এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে ইউক্রেন হবে পূর্ব ও পশ্চিমের বাণিজ্যিক মিলনস্থল—যেখানে সীমান্ত দিয়ে বিদেশি সৈন্য নয়, বরং পণ্যবাহী জাহাজ ও ট্রেন চলাচল করবে।

জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
ইমরান খানকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে।
৯ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

চার বছর আগে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, সেই ইমরান খান আজ নিজ দেশেই ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। ৭৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেট কিংবদন্তি বর্তমানে রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে প্রতিদিন ২২ ঘণ্টা একা একটি সেলে রাখা হচ্ছে। সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে থাকা ওই কক্ষে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগও নেই। পরিবারের অভিযোগ, পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ইমরান খানের মনোবল ভেঙে দিতে চাইছে। ইমরান খানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘এটা মানসিক নির্যাতন। তাঁকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এসব করা হচ্ছে। কিন্তু আমার বাবা শক্ত মানুষ।’
ইমরান খানের প্রথম স্ত্রী জেমিমা গোল্ডস্মিথের দুই ছেলে কাসিম ও সুলাইমান। গত আড়াই বছর ধরে তাঁরা এক দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। চলতি সপ্তাহে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার নেয়। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে নিয়ে ইমরান খানের নির্দেশনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরই সরকার কারাগারে থাকা ইমরান খানের সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়। দুর্নীতির মামলায় দেওয়া ১৪ বছরের সাজার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক নতুন মামলা। ইমরানের পরিবারের আশঙ্কা—এই সংকট সমাধানের কোনো সহজ পথ নেই।
কাসিম বলেন, ‘বাবার বিরুদ্ধে ২০০টির বেশি মামলা আছে। একটি মামলা বাতিল হলে সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনটি নতুন মামলা দেওয়া হয়। এটা শুধু সময়ক্ষেপণের কৌশল।’
কারাগারের পরিস্থিতিও ভয়াবহ। সুলাইমান বলেন, ‘বাবাকে যে ছোট কক্ষে রাখা হয়েছে, সেটিকে “ডেথ সেল” বলা হয়। এখানে সাধারণত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের রাখা হয়। ওই বেশির ভাগ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। দেওয়া হয় না বই বা পড়ার কোনো উপকরণ।’
কাসিমের ভাষায়, ‘যে পানিতে তিনি গোসল করেন, সেটি খুবই নোংরা। ওই কারাগারে অন্তত এক ডজন বন্দী হেপাটাইটিসে মারা গেছে, আর তাঁরা সবাই ছিলেন পিটিআইয়ের সমর্থক।’
তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত বন্দীদের আলাদা রাখা হয়।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক অ্যালিস জিল এডওয়ার্ডসের এক প্রতিবেদনে ইমরান খানের সেলের চিত্র আরও ভয়াবহভাবে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কক্ষটি ছোট, বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, প্রাকৃতিক আলোর অভাব রয়েছে এবং চরম তাপমাত্রা ও পোকামাকড়ের উপদ্রবজনিত কারণে তিনি বমি বমি ভাব এবং ওজন হ্রাসের শিকার হচ্ছেন।

কিন্তু ইমরানের খানের মতো একজন মানুষের জীবনে এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো
পাকিস্তানের ইতিহাসে ইমরান খান শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীই নন, তিনি ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বেই পাকিস্তান একমাত্র ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতে। সেই আসরে খেলোয়াড়দের তিনি বলেছিলেন, ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়ো।’ প্রতীক হিসেবে বাঘ আঁকা টি-শার্টও পরেছিলেন তিনি।
মাঠের বাইরে ইমরান খানের জীবনও ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। নব্বইয়ের দশকে লন্ডনের ট্রাম্পস নাইটক্লাব থেকে শুরু করে গসিপ কলাম—সবখানেই ছিল তাঁর উপস্থিতি। মডেল মারি হেলভিন একবার বলেছিলেন, ‘ইমরানের মতো বিধ্বংসী পুরুষ আর কেউ ছিলেন না।’

১৯৯৫ সালে ২১ বছর বয়সী জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন ইমরান খান। বয়স ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য নিয়ে সমালোচনা থাকলেও জেমিমা তখন বলেছিলেন, ‘আমার জন্য ইমরান পাশ্চাত্যের রাতজাগা ও মদের জীবন ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।’
এরপর ২০০৪ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। তবে বিচ্ছেদ হলেও, বন্দী ইমরান খানের জন্য জেমিমার উদ্বেগ আজও রয়ে গেছে। সম্প্রতি তিনি ইলন মাস্ককে চিঠি দিয়ে অভিযোগ করেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স ইমরান খান-সংক্রান্ত পোস্ট গোপনে সীমিত করছে।
ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমরা বাবার সংস্পর্শে বড় হয়েছি। এখন বাবা নেই, এটা আমাদের জন্য খুব কষ্টের। আমাদের মায়ের জন্যও এটা কষ্টের।’

দুই ভাই আশা করছেন, এ বিষয়গুলো সামনে আনলে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যাবে। কিন্তু আসলেই কি ইমরান খানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আসবে? এমন প্রশ্ন অবান্তর নয়। কারণ, প্রায় আড়াই বছর থেকে কারাগারে থাকলেও কেউ ইমরান খানের খোঁজ নেয়নি।
অ্যাশেজের মতো বড় আয়োজন চললেও, ক্রিকেট বিশ্ব থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ নেই। আইসিসি হল অব ফেমে জায়গা পেয়েছেন ইমরান খান, কিন্তু সেখানেও নীরবতা। তবে অনেকেই মনে করেন, কথা বললে সরকার আরও কঠোর হতে পারে। ইমরানের ছেলে কাসিম বলেন, ‘প্রতিবার আমরা কিছু বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, গত ৫০ বছরে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রধানমন্ত্রীকেই কারাবরণ করতে হয়েছে। চ্যাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ মনে করেন, ইমরান খানের সামনে বর্তমানে দুটি পথ—হয় লন্ডনে নির্বাসন অথবা পাকিস্তানে গৃহবন্দিত্ব।
কিন্তু তাঁর ছেলেরা বলছেন, দুটোই অগ্রহণযোগ্য। কাসিমের মতে, ‘লন্ডনে গেলে বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন।’ আর সুলাইমান বলেন, ‘গৃহবন্দিত্ব মানে রাজনীতি থেকে নির্বাসন—বাবা সেটা মানবেন না।’
ওয়াশিংটনে গিয়ে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। সুলাইমান বলেন, ‘সেনাপ্রধান ও ট্রাম্পের সম্পর্ক এখন ভালো। ফলে আমাদের আশার জায়গা কম।’
শেষ বিকল্প হিসেবে পাকিস্তানে যাওয়ার কথাও ভাবছেন তাঁরা। কিন্তু সেটিও ঝুঁকিপূর্ণ। কাসিম বলেন, ‘পাকিস্তানে যাওয়ার পর আমাদের গ্রেপ্তার করা হলে হয়তো সেটাই বাবাকে কোনো সমঝোতায় যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু আমরা এ রকম কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে ভয়াবহ আশঙ্কা—তিনি ৭৩ বছরের একজন মানুষ। আমরা কি আর কখনো তাঁকে দেখতে পাব?’
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত

জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দাগ হ্যামারশোল্ড এই কৌশলের সবচেয়ে দক্ষ ব্যবহারকারী ছিলেন। ১৯৬১ সালে কঙ্গোতে শান্তি মিশনের সময় এক রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। কিন্তু তাঁর ভাষণগুলো বিশ্ববাসীর মনোযোগ কাড়ত। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘের লক্ষ্য মানবজাতিকে স্বর্গে পৌঁছে দেওয়া নয়, বরং নরক থেকে বাঁচান
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে।
২ দিন আগে
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অধিকাংশ তেল মজুত রয়েছে দেশটির পূর্বাঞ্চলের ওরিনোকো বেল্টে। প্রায় ৫৫ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চলে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল মজুত রয়েছে।
৫ দিন আগে
নব্বইয়ের দশকে যখন ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এক নব্য পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল, তখন তাদের কাছে চীনের চাহিদা ছিল শুধু আকরিক লোহা, শস্য আর সূর্যমুখী তেল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সমীকরণ আমূল বদলে গেছে।
৬ দিন আগে