Ajker Patrika

রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’: ত্রিমুখী সম্পর্কের অস্থির ও জটিল সময়

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
থ্রি-বডি প্রবলেম নেটফ্লিক্স সিরিজের দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট
থ্রি-বডি প্রবলেম নেটফ্লিক্স সিরিজের দৃশ্য। ছবি: স্ক্রিনশট

পদার্থবিদ্যার এক জটিল ধারণা ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’। সহজভাবে এটিকে ‘ত্রিমুখী সমস্যা’ও বলা যেতে পারে। তিনটি মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষীয় মিথস্ক্রিয়া এক অনিশ্চিত অপরিমাপযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি করে— এটি বোঝাতেই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়। এই ধারণাটি এখন রাজনীতির ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনটি প্রধান পক্ষ যেমন—ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থা—পরস্পর যখন এমনভাবে মিথস্ক্রিয়া করে যা অস্থির এবং অননুমেয় ফলাফলের জন্ম দেয়, সেই পরিস্থিতিকেই রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বলা হয়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব, অনাস্থা, মিত্র পরিবর্তন এবং পারস্পরিক প্রভাব এই পরিস্থিতি তৈরি করে।

রাজনীতিতে থ্রি-বডি প্রবলেম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, পদার্থবিদ্যার সমস্যাটির মতোই, এখানে কোনো একক পক্ষ অন্যদের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে একটা অস্থির রাজনৈতিক গতিশীলতা তৈরি হয়।

কোনো এক উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রতিটি পক্ষ স্বল্পমেয়াদি স্বার্থের ভিত্তিতে মিত্র খুঁজতে থাকে, জোটবদ্ধ হয় বা বিরোধিতা করে। তখন এই ধরনের মৈত্রী বা জোট হয় খুবই অস্থির। পক্ষগুলোর এমন আচরণ পুরো ব্যবস্থাকেই অস্থিতিশীল করে তোলে।

এখানে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, প্রতিটি পক্ষের সিদ্ধান্ত অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়শই অপ্রত্যাশিত পরিণতি বা ফিডব্যাক লুপ তৈরি করে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। একের পর এক ইস্যু বদল হতে থাকে।

দ্বি-পক্ষীয় ব্যবস্থা (যেমন দুই-দলীয় রাজনীতি) সংঘাতের একপর্যায়ে স্থিতাবস্থা অর্জন করে। উভয়পক্ষ পারস্পরিক স্বার্থ বিবেচনায় সমঝোতায় পৌঁছায়। কিন্তু থ্রি-বডি প্রবলেম বা ত্রিমুখী ব্যবস্থায় খুব কমই অনুমানযোগ্য ভারসাম্য তৈরি হয়। স্বার্থগুলো বহুমাত্রিক হওয়ার হওয়ার কারণে স্থির ভারসাম্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

একই ভাবে এ বছর রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বাজারের পারস্পরিক ক্রিয়া শেয়ারবাজার, বন্ড, কমোডিটি ও মুদ্রার গতিপথ অনুমান করা ট্রেডার ও বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়েও কঠিন করে তুলেছে।

‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ শব্দবন্ধটি চীনা ঔপন্যাসিক লিউ সিক্সিনের উপন্যাস ‘দ্য থ্রি-বডি প্রবলেম’ থেকে গণমাধ্যমে পরিচিতি পেয়েছে। সর্বশেষ এই উপন্যাস অবলম্বনে ২০২৪ সালে সিরিজ মুক্তি দিয়েছে নেটফ্লিক্স। এই সিরিজ রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিয়েছে।

এই উপন্যাসের উপজীব্য চীনে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কাল। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে রাজনৈতিক চরমপন্থা এবং সরকারি সেন্সরশিপ। নেটফ্লিক্সের নির্মাতারা আধুনিক রাজনীতির সঙ্গেও এর সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন।

লিউ সিক্সিনের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং এর নেটফ্লিক্স সংস্করণে ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ সমস্যাটিকে ‘রাজনৈতিক ও অস্তিত্ববাদী’ বিষয়বস্তুর রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

উপন্যাসটিতে তুলে ধরা হয়েছে, একটি তিন-নক্ষত্র ব্যবস্থায় গ্রহের বিশৃঙ্খল কক্ষপথের কারণে কীভাবে ত্রিসোলারান সভ্যতা অস্তিত্বের হুমকিতে পড়ে। এটিকে মানবজাতির ‘রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার’ সমান্তরাল বলা হচ্ছে। উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে ভয়, আদর্শ (আইডলজি) এবং টিকে থাকার তাগিদ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে চালিত করে। উপন্যাসে মানবজাতির বিভিন্ন দল ত্রিসোলারানদের পক্ষে বা বিপক্ষে জোটবদ্ধ হয়। ত্রিসোলারান আক্রমণের হুমকি ফুটিয়ে তোলে কীভাবে ‘বহিরাগত চাপ’ (যেমন জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক সংঘাত) জাতিগুলোকে ‘অস্থির জোট বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ ঠেলে দেয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই থ্রি-বডি প্রবলেম বুঝতে পারাটা সহজ। যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া সম্পর্কের মতো ত্রিমুখী কূটনীতি প্রায়শই ‘থ্রি-বডি’ গতিমুখ প্রদর্শন করে। প্রতিটি দেশের পদক্ষেপ (যেমন বাণিজ্য চুক্তি, নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক অবস্থান) অন্যদের ওপর প্রভাব ফেলে। এই পারস্পরিক প্রভাব প্রায়ই অস্থিরতা তৈরি করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিক্সনের চীন সফর (১৯৭২) যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন-চীন ত্রিভুজ ভেঙে দিয়েছিল। এই সফর নতুন হিসাব-নিকাশের জন্ম দেয়।

বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে এই তিনটি শক্তি বাণিজ্য যুদ্ধ, সামরিক উত্তেজনা এবং কূটনৈতিক কৌশলের মধ্যে দিয়ে চলছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রচেষ্টা (যেমন, চীনকে প্রতিহত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোট) এমন এক পরিবর্তনশীল গতিশীলতা তৈরি করেছে যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ট্রিপল এন্টেন্ট (ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য) বনাম ট্রিপল অ্যালায়েন্স (জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, ইতালি) ‘থ্রি-বডি’র মতো জটিলতা প্রদর্শন করেছিল। যেখানে পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং কৌশলগত প্রয়োজনের কারণে জোটগুলো পরিবর্তিত হয়েছিল।

ইউক্রেন সংঘাত এর একটি উদাহরণ: রাশিয়া, ন্যাটো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে) এবং চীন একটি ত্রিমুখী গতিশীলতা তৈরি করেছে, যেখানে প্রতিটি পক্ষের পদক্ষেপ (নিষেধাজ্ঞা, জ্বালানি চুক্তি, বা সামরিক সাহায্য) অপ্রত্যাশিতভাবে প্রভাব ফেলে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-চীন-ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্রিভুজ ‘থ্রি-বডি’ বৈশিষ্ট্য দেখাচ্ছে। বাণিজ্য বিরোধ, জলবায়ু আলোচনা এবং প্রযুক্তিগত মান (যেমন এআই রেগুলেশন) প্রতিটি পক্ষকে সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে বাধ্য করছে, যেখানে কোনো স্থিতিশীল সংহতি নেই। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪-২৫ সালে ইইউ’র ডিজিটাল সার্বভৌমত্বের ওপর জোর (যেমন জিডিপিআর প্রয়োগ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনকে অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের কৌশল সমন্বয় করতে বাধ্য করছে।

এ ছাড়া বহু-দলীয় গণতন্ত্রে, তিনটি প্রভাবশালী দল বা উপদল অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ: ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কংগ্রেস, বিজেপি এবং আম আদমি পার্টি (এএপি) বা তৃণমূল কংগ্রেসের (টিএমসি) মতো আঞ্চলিক দলগুলো একটি জটিল অবস্থা তৈরি করেছে। নির্বাচনী ফলাফল এবং আঞ্চলিক স্বার্থের ভিত্তিতে জোটগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে। বিজেপির বিপরীতে ইন্ডিয়া জোট কার্যকর না হওয়া এর একটি মোক্ষম দৃষ্টান্ত।

অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে রক্ষণশীল, বামপন্থী, উদার গণতান্ত্রিক দলগুলোর মধ্যে জোট গঠন অত্যন্ত জটিল হয়ে পড়ে। কোনো একক দল প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে না। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সাময়িক জোটগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতা পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন, ২০১০ সালে যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের পর লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা যখন কনজারভেটিভদের সঙ্গে জোট বাঁধার সিদ্ধান্ত নিয়ে তখন ব্রিটেনের রাজনীতি এক নতুন মোড় নিয়েছিল।

বাংলাদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে অস্থিরতা চলছে, সেখানেও এই থ্রি-বডি প্রবলেম অনেকখানি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক পক্ষগুলো পরস্পর বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক জোট এখনো নিশ্চিত নয়। বিভিন্ন ইস্যুতে বহু মেরু অবস্থান দেখা যাচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় জোটের আভাস মিলছে। কিন্তু পরক্ষণেই সেগুলো সাময়িক বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ ও লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট করতে পারছে না। পারস্পরিক প্রভাব অর্থাৎ কোনো একটি দলের তাৎক্ষণিক অবস্থান অন্যদের সিদ্ধান্তেও যেভাবে প্রভাব ফেলছে তাতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

এ ধরনের পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে, যদি দলের অভ্যন্তরে প্রতিদ্বন্দ্বী উপদল থাকে। মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল এবং পপুলিস্ট (জনতুষ্টিবাদী)—এমন দ্বন্দ্ব অভ্যন্তরীণ অচলাবস্থা বা অস্থির নীতি পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ২০২০ সালের মার্কিন ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির কথা স্মরণ করতে পারি। ওই সময় বার্নি স্যান্ডার্সের প্রগতিশীল, জো বাইডেনের মধ্যপন্থী এবং এলিজাবেথ ওয়ারেনের মিশ্র উপদলের মধ্যে উত্তেজনা ঐক্যের পথকে জটিল করে তুলেছিল।

অতীত ও সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে দেখা যায়, রাজনীতির ‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ বহু-পক্ষীয় ব্যবস্থায় স্থিতিশীল শাসন বা কূটনীতি কঠিন করে তোলে। ত্রিমুখী মিথস্ক্রিয়াগুলো সহজ সমাধানকে বারবার প্রতিহত করে। এর জন্য পক্ষগুলোর মধ্যে অবিরাম আলোচনা এবং অভিযোজনের প্রয়োজন হয়। আলোচনাই উদ্ভাবনের (যেমন, সৃজনশীল জোট) দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে যদি ভুলভাবে পরিচালিত হয় তবে অচলাবস্থা বা সংঘাতের কারণও হতে পারে।

তাহলে এই ধরনের জটিলতার সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে? ভূরাজনৈতিক তো বটেই যে কোনো সম্পর্কে মিত্রতার প্রথম শর্ত হলো হলো প্রতিপক্ষের আচরণ ‘অনুমানযোগ্য’ হওয়া। ক্ষুদ্র ও স্বল্পমেয়াদি স্বার্থে যদি কোনো পক্ষ অস্থির ও প্রতারণামূলক আচরণ করতে থাকে তাহলে সমঝোতা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে স্বল্পমেয়াদি জোট গঠনও কার্যকর হতে পারে। সংসদীয় জোটের ক্ষেত্রে এটি অনেক সময় স্থিতিশীলতা দেয়।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ চতুর্থ পক্ষ আলোচনার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা কমাতে পারে। সে ক্ষেত্রেও পক্ষগুলোর মধ্যে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতা জরুরি।

এসব ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে পদক্ষেপ নেওয়া এড়িয়ে যাওয়া উচিত। সমঝোতার শর্ত তৈরির সুযোগ দিতে অন্যদের অভিপ্রায় প্রকাশ করার জন্য অপেক্ষা করতে হতে পারে।

‘থ্রি-বডি প্রবলেম’ এখন রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী রূপক। দুই-এর বেশি শক্তি যদি বিরোধে লিপ্ত হয় তাহলে ফলাফল প্রায়শই বিশৃঙ্খল ও অস্থির হয়। নীতি নির্ধারকেরা হয়তো এটি বোঝেন, কিন্তু নানা অনুঘটক ও শক্তি এখানে অস্থিরতা জিইয়ে রাখার পেছনে সক্রিয় থাকতে পারে। এই ধরনের অস্থিরতার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি এড়াতে এবং কার্যকরভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সম্ভাব্য বিপদ এড়াতে ছাড় দেওয়ার মানসিক নিয়ে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

কোন স্বার্থে মুসলিমপ্রধান সোমালিল্যান্ডকে সবার আগে স্বীকৃতি দিল ইসরায়েল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫: ৩০
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত
হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূ-রাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। ছবি: সংগৃহীত

২৬ ডিসেম্বর বিশ্বের প্রথম জাতিসংঘ সদস্যদেশ হিসেবে সোমালিল্যান্ডকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্তকে ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ডস’-এর একটি সাহসী সম্প্রসারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হর্ন অব আফ্রিকার এই স্বঘোষিত স্বাধীন মুসলিমপ্রধান ভূখণ্ডটির প্রতি ইসরায়েলের এই গভীর আগ্রহ নিছক কোনো কূটনৈতিক সৌজন্য নয়; বরং এর পেছনে রয়েছে কয়েক দশকের সুদূরপ্রসারী কৌশলগত পরিকল্পনা, নিরাপত্তাঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

সোমালিল্যান্ডের অবস্থান এডেন উপসাগরের তীরে, যা সরাসরি ইয়েমেনের উল্টো দিকে এবং বাব আল-মানদেব প্রণালির ঠিক পাশেই অবস্থিত। বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জলপথের বাণিজ্য এই পথেই পরিচালিত হয়।

২০২৩ সাল থেকে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে ইসরায়েলি সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলোতে নিয়মিত হামলা চালিয়ে আসছে। সোমালিল্যান্ডের উপকূলরেখা থেকে হুতিদের মূল ঘাঁটি হোদেইদাহর দূরত্ব ৩০০ থেকে ৫০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ বা সম্মুখ প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে কাজ করবে।

ইসরায়েলি থিংকট্যাংক (আইএনএসএস)-এর মতে, সোমালিল্যান্ডে গোয়েন্দা ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে ইরান থেকে ইয়েমেনে আসা অস্ত্র চোরাচালান এবং হুতিদের গতিবিধির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখা সম্ভব হবে। এমনকি সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থায়নে নির্মিত বারবেরা বন্দর ইসরায়েলি নৌ টহল বা ড্রোন অপারেশনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারে।

হর্ন অব আফ্রিকায় ইসরায়েলের এই প্রবেশ মূলত তার আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আধিপত্য কমানোর একটি পাল্টা কৌশল। তুরস্ক ইতিমধ্যে সোমালিয়ার মোগাদিশুতে বিশাল সামরিক ঘাঁটি এবং বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, সোমালিল্যান্ডের সঙ্গে জোরালো মৈত্রী এই অঞ্চলে তুরস্কের একক আধিপত্যে ভারসাম্য বজায় রাখবে।

এ ছাড়া ইসরায়েল সব সময় নিজের সীমানার বাইরে মিত্র দেশগুলোতে নিজের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। সোমালিল্যান্ডের মতো একটি স্থিতিশীল এবং পশ্চিমাপন্থী প্রশাসনের সঙ্গে বন্ধুত্ব ইসরায়েলকে লোহিত সাগরের নিরাপত্তা বলয়ে একক কর্তৃত্ব দেবে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডারও আগ্রহের মূলে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সোমালিল্যান্ড কেবল একটি কৌশলগত বন্দর নয়, বরং এটি সম্পদের একটি অব্যবহৃত খনি।

সোমালিল্যান্ডে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল, গ্যাস এবং বিরল মৃত্তিকা খনিজ মজুত থাকার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের উচ্চ প্রযুক্তি এবং অস্ত্র তৈরির কারখানায় এই কাঁচামালগুলো অত্যন্ত জরুরি।

ইসরায়েল ইতিমধ্যে কৃষি ক্ষেত্রে লবণাক্ত পানি পরিশোধন, উন্নত সেচব্যবস্থা এবং সাইবার নিরাপত্তা খাতে বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সোমালিল্যান্ডের জন্য এই অংশীদারত্ব হবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চাবিকাঠি।

তবে এতে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ইসরায়েলের এই স্বীকৃতি যেমন সোমালিল্যান্ডের জন্য বৈধতার দ্বার উন্মোচন করেছে, তেমনি এটি আঞ্চলিক উত্তেজনারও জন্ম দিয়েছে।

সোমালিয়া এই পদক্ষেপকে তাদের অখণ্ডতার ওপর ‘সরাসরি আক্রমণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) এবং আরব লিগ এই স্বীকৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং সতর্ক করেছে যে এটি আফ্রিকা মহাদেশে নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।

পশ্চিমা বিশ্বও ইসরায়েলের এই পদক্ষেপে দ্বিধাগ্রস্ত। মার্কিন সিনেটর টেড ক্রুজ সোমালিল্যান্ডকে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে সমর্থন করলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনই এই পথে হাঁটবে না, বরং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে।

সর্বোপরি ইসরায়েলের জন্য সোমালিল্যান্ড একটি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদি মিত্র, যারা সন্ত্রাসবাদ দমনে ইসরায়েলের সমমনা বলেই মনে করা হয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে ইসরায়েল লোহিত সাগরে নিজের নৌ-শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায়। তবে এই পদক্ষেপ যদি ইথিওপিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোকে সোমালিল্যান্ডকে স্বীকৃতি দিতে উৎসাহিত করবে। তবে এর ফলে হর্ন অব আফ্রিকার মানচিত্র এবং ভূরাজনীতি চিরতরে বদলে যেতে পারে। এটি যেমন একটি নতুন সামরিক ও অর্থনৈতিক অক্ষের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তেমনি আঞ্চলিক সংঘাতের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, রয়টার্স, আল জাজিরা এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কোন আইএসকে আঘাত করল মার্কিন বাহিনী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে আইএস আস্তানা লক্ষ্য করে মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

বড়দিনের রাতে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে মার্কিন বাহিনীর বিমান হামলা বিশ্বজুড়ে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএসকে। মধ্যপ্রাচ্যে পরাজয়ের পর গোষ্ঠীটি এখন আফ্রিকায় তাদের জাল বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন, নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের লক্ষ্য করে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানোর কারণে তিনি এ হামলার নির্দেশ দিয়েছেন।

ইসলামিক স্টেট কী

ইসলামিক স্টেট (যাকে আইএসআইএস বা দায়েশ নামেও ডাকা হয়) একটি সুন্নি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ইরাক ও সিরিয়ায় উত্থান ঘটিয়ে তারা একসময় ‘খিলাফত’ ঘোষণা করেছিল। এরপর ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল অংশ তাদের দখলে ছিল। তখন তারা কঠোর শরিয়াহ আইন জারি করে এবং প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতা চালিয়ে বিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়।

পরে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানের মুখে ইরাকের মসুল ও সিরিয়ার রাক্কায় তাদের পতন ঘটে। তবে সংগঠনটি পুরোপুরি নির্মূল না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে তারা কোথায় সক্রিয়

মধ্যপ্রাচ্যের মূল ভূখণ্ড হারানোর পর আইএস এখন মূলত স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন সেলের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বর্তমানে নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, কঙ্গো এবং সাহেল অঞ্চলে আইএস অত্যন্ত শক্তিশালী। নাইজেরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘আইএসডব্লিউএপি’ এবং উত্তর-পশ্চিমে বিভিন্ন অনুসারী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে।

এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ‘আইএস-খোরাসান’ নামে তারা সক্রিয়। এ ছাড়া ফিলিপাইনের মিন্দানাও অঞ্চলেও তাদের অনুসারী রয়েছে। জাতিসংঘ মনে করে, বর্তমানে তাদের অন্তত ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য রয়েছে।

লক্ষ্য ও বর্তমান কৌশল

আইএসের মূল লক্ষ্য তাদের চরমপন্থী মতাদর্শ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া। তবে সরাসরি যুদ্ধের বদলে তারা এখন কিছু নতুন কৌশল নিয়েছে। যেমন, অ্যাফিলিয়েট নেটওয়ার্ক—নিজেরা সরাসরি যুক্ত না হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীকে নিজেদের ‘শাখা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে প্রভাব বিস্তার করা। লোন উলফ অ্যাটাক—সংঘবদ্ধ হামলার পরিবর্তে একজন বা দুই ব্যক্তির সমন্বয়ে বড় ধরনের হামলা। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই বিচে ইহুদিদের এক অনুষ্ঠানে বন্দুক হামলার পেছনে আইএসের এই কৌশল ছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অনলাইন প্রচারণা—টেলিগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আতঙ্ক ছড়ানো এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ করা।

মার্কিন সামরিক বাহিনীর মতে, আইএসের বর্তমান বিশ্ব নেতা হলেন আবদুলকাদির মুমিন। তিনি বর্তমানে আইএসের সোমালিয়া শাখার প্রধান।

আইএসের সাম্প্রতিক কিছু বড় হামলা

কঙ্গোতে চলতি বছরের গত অক্টোবরে একটি গির্জায় নৈশকালীন প্রার্থনার সময় হামলায় ৪৩ জন নিহত হয়, যার দায় স্বীকার করে আইএস। গত ফেব্রুয়ারিতে সোমালিয়ায় একাধিক সামরিক ঘাঁটিতে আত্মঘাতী গাড়িবোমা হামলা চালায় আইএস। চলতি মাসে সিরিয়ায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন দোভাষী নিহত হন, যার নেপথ্যে আইএসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনার পর চলতি সপ্তাহে সিরিয়ায় আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনী।

নাইজেরিয়ায় মার্কিন হামলা এটাই প্রমাণ করে যে, আইএস এখন আর কেবল মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়। বিশেষ করে, সাহেল ও পশ্চিম আফ্রিকায় তাদের ক্রমবর্ধমান শক্তি বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য নতুন এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রয়টার্স থেকে সংক্ষেপে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

নাইজেরিয়ায় কেন হামলা চালাল মার্কিন বাহিনী, খ্রিষ্টান নিপীড়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক কী

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি

নাইজেরিয়ার সরকার খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন ঠেকাতে ব্যর্থ—এমন অভিযোগে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার পর অবশেষে বড়দিনের রাতে (২৫ ডিসেম্বর) পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিতে বিমান হামলা চালিয়েছে মার্কিন বাহিনী। সরাসরি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে নাইজেরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় সোকোটো রাজ্যে এ হামলা চালানো হয়।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন আইএস জঙ্গিদের একাধিক আস্তানা লক্ষ্য করে এসব হামলা চালায়। হামলায় মার্কিন নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ থেকে টমাহক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছিল। এসব হামলায় একাধিক আইএস জঙ্গি নিহত ও তাঁদের আস্তানা ধ্বংস হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সঠিক সংখ্যা এখনো জানানো হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসনের সাম্প্রতিক বিদেশি সামরিক হস্তক্ষেপগুলোর সর্বশেষ উদাহরণ নাইজেরিয়ায় হামলা। অথচ ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, এই হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল নাইজেরিয়ায় বসবাসরত খ্রিষ্টানদের ওপর চলমান হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। তাঁর মতে, আইএস জঙ্গিরা পরিকল্পিতভাবে খ্রিষ্টানদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। হামলার ঘোষণা দিয়ে ট্রাম্প তাঁর ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে লিখেছিলেন, ‘আমি আগেই এই সন্ত্রাসীদের সতর্ক করেছিলাম, তারা যদি খ্রিষ্টানদের হত্যা বন্ধ না করে, তবে তাদের চড়ম মূল্য দিতে হবে। আজ রাতে (বড়দিন) ঠিক তা-ই ঘটেছে।’

গত অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নাইজেরিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ‘খ্রিষ্টান গণহত্যার’ শামিল বলে অভিহিত করেছিলেন।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এপিকে জানান, নাইজেরিয়া সরকারের অনুমোদন নিয়ে দেশটির সঙ্গে সমন্বয় করেই এসব হামলা চালানো হয়েছে। নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই সহযোগিতার মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান ও কৌশলগত সমন্বয় ছিল।

কেন নাইজেরিয়ায় হামলা চালাল ট্রাম্প প্রশাসন

অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী রাজনীতিক গোষ্ঠীগুলো নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগ তুলছে। গত সেপ্টেম্বরে রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ কিছু নাইজেরীয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানান। তিনি দাবি করেন, যারা ‘ইসলামপন্থী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর মাধ্যমে খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা সহজতর করছে’, তাদের নিষিদ্ধ করা উচিত।

তবে বর্তমানে বিষয়টি মার্কিন ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান মহলে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ডানপন্থী ও ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টানরাই ট্রাম্পের বড় সমর্থক। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের সমর্থকদের তুষ্ট করতে এবং বিশ্বজুড়ে ‘খ্রিষ্টানদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে নিজেকে জাহির করতেই ট্রাম্প এই ত্বরিত সামরিক পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা আইনের আওতায় নাইজেরিয়াকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন ট্রাম্প। বেশ কিছু মার্কিন আইনপ্রণেতা ও রক্ষণশীল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর লাগাতার লবিংয়ের পর এই সিদ্ধান্ত আসে। এর কিছুদিন পরই তিনি নাইজেরিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশ দেন। সে সময় ট্রাম্প বলেন, নাইজেরিয়া সরকার যদি খ্রিষ্টান হত্যাকাণ্ড বন্ধ না করে, তবে তিনি ‘গানস-এ-ব্লেজিং’ অর্থাৎ পূর্ণ শক্তি নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন।

নাইজেরিয়ায় কি আসলেই খ্রিষ্টানদের ওপর নিপীড়ন চলছে

নাইজেরিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। দেশটির জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ মুসলমান, ৪৫ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যরা আফ্রিকার ঐতিহ্যগত কিছু ধর্মে বিশ্বাসী। খ্রিষ্টানদের ওপর সহিংসতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মনোযোগ পেলেও বহু বিশ্লেষকের মতে, বিষয়টি কেবল ধর্মীয় নিপীড়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এর পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে, যাযাবর মুসলিম পশুপালক ও খ্রিষ্টান কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘর্ষ মূলত চারণভূমি ও পানির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। তবে ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন এটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে, যাজকদের অপহরণের ঘটনা ধর্মীয় বিদ্বেষের চেয়ে অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যেই বেশি ঘটে, কারণ, তাঁরা প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং তাঁদের অনুসারী বা প্রতিষ্ঠান দ্রুত মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করতে পারে।

নাইজেরিয়া সরকারের অবস্থান

ট্রাম্প প্রশাসনের হামলার পর নাইজেরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইএস-নিধনে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু খ্রিষ্টান নিপীড়নের বিষয়টির সঙ্গে মার্কিন অভিযানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলেনি।

এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, খ্রিষ্টান, মুসলমান কিংবা অন্য কোনো সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের সহিংসতাই নাইজেরিয়ার মূল্যবোধ এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি অবমাননা।

নাইজেরিয়ার বাস্তবতাও আসলে এমন। দীর্ঘদিন ধরে দেশটি নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দেশটিতে হাজারো মানুষ নিহত এবং শত শত মানুষ অপহৃত হয়েছে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২০০৯ সাল থেকে বোকো হারাম ও ইসলামিক স্টেট ওয়েস্ট আফ্রিকা প্রভিন্স (আইএসডব্লিউএপি) বিদ্রোহ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কয়েক দশক ধরে কয়েক হাজার মানুষ নিহত এবং লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সশস্ত্র অপরাধী চক্র, যাদের সাধারণত ‘ডাকাত’ বলা হয়, তারাও গণ-অপহরণ ও হামলা চালাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মুসলমান ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়কেই প্রভাবিত করছে।

এর আগে ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে নাইজেরিয়ার সরকার বিষয়টি স্বীকার করে বলেছিল, দেশটিতে কেবল খ্রিষ্টান নয়—বিভিন্ন ধর্মের মানুষই চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

গত মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট বোলা আহমেদ তিনুবু বলেন, নাইজেরিয়াকে ধর্মীয়ভাবে অসহিষ্ণু দেশ হিসেবে চিত্রিত করা বাস্তবতার প্রতিফলন নয়। তিনি বলেন, ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহনশীলতা আমাদের সম্মিলিত পরিচয়ের একটি মূল ভিত্তি এবং এটি সব সময়ই থাকবে। নাইজেরিয়া এমন একটি দেশ, যেখানে সংবিধান সব ধর্মের নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।’

এদিকে, ‘অন্তহীন যুদ্ধ’ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও নাইজেরিয়ায় ট্রাম্পের নতুন সামরিক হস্তক্ষেপ আফ্রিকার ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অনেকে বলছেন, ‘খ্রিষ্টান নিপীড়ন’ আসলে ট্রাম্পের অজুহাত; তাঁর লক্ষ্য নাইজেরিয়ার তেলের খনি।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন জগতপতি বর্মা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট ধীরে ধীরে একটি আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনায় রূপ নিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া অবস্থান এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। এই প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিয়ো লুলা দা সিলভা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে সতর্ক করেছেন। তাঁর মতে, এই সতর্কতা শুধু ভেনেজুয়েলাকে ঘিরে নয়—পুরো দক্ষিণ আমেরিকার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার প্রশ্নও তুলে ধরছে।

ভেনেজুয়েলার সংকটের মূল কারণ দেশটির দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিতর্কিত নির্বাচন, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের একটি অংশ কর্তৃত্ববাদী ও অগণতান্ত্রিক বলে মনে করে। এর জবাবে ওয়াশিংটন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার মূল লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা দেশটির আয়ের প্রধান উৎস।

ভেনেজুয়েলা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুতের অধিকারী। ফলে তাদের তেল শুধু অর্থনীতি নয়, কূটনীতিরও কেন্দ্রে অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভেনেজুয়েলার তেল বিক্রির পথ বন্ধ করতে পারলে মাদুরো সরকার দুর্বল হবে। এই লক্ষ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির নিষেধাজ্ঞাভুক্ত তেল ট্যাংকারগুলোকে অবরোধের মতো কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে মার্কিন বাহিনী। তবে এই পদক্ষেপকে সরাসরি যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন দক্ষিণ আমেরিকার অনেক নেতা।

ব্রাজিল ও মেক্সিকোর মতো লাতিন শক্তিগুলো এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ আমেরিকার ইতিহাস বহিঃশক্তির সামরিক হস্তক্ষেপের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভরা। ফকল্যান্ড যুদ্ধের চার দশক পর আবারও কোনো অন্য মহাদেশীয় শক্তির সামরিক উপস্থিতি এই মহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে—এমন আশঙ্কাই তিনি প্রকাশ করেছেন।

এদিকে রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলার সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়ার ক্ষেত্রে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলার কৌশল, আর চীনের জন্য এটি তেল ও ঋণনির্ভর অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্ন। ফলে ভেনেজুয়েলা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র বনাম রাশিয়া–চীন প্রভাব বিস্তারের আরেকটি ময়দানে পরিণত হচ্ছে।

‘মার্কোসুর’ সম্মেলনে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যে যৌথ অবস্থান নিয়েছে, তা এই বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তারা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার কথা বলেছে, তবে স্পষ্টভাবে সামরিক পথ প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের মতে, সংকটের সমাধান হতে পারে কেবল সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ কূটনীতির মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে ভেনেজুয়েলার সংকট এখন আর একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। তেল, আদর্শিক দ্বন্দ্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াই—সবকিছু মিলিয়ে এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক স্পর্শকাতর সংঘাতক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত