রাজিউল হাসান, ঢাকা

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:
রাজিউল হাসান, ঢাকা

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে। তবে এবার যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সঙ্গে কেবল ২০১৪ সালেরই তুলনা চলে। যদিও ওই সময় ইউক্রেন ছিল উত্তাল, দেশটির রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ সবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। এবার ইউক্রেনের ভেতরে তেমন পরিস্থিতি না থাকলেও টান টান উত্তেজনা চারদিকে। ইউক্রেনবাসী ও পশ্চিমা বিশ্বের মনে আতঙ্ক, এই বুঝি গর্জে উঠল ট্যাংক, বেজে উঠল যুদ্ধের দামামা।
রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে এরই মধ্যে লাখো সেনার সমাবেশ ঘটিয়েছে মস্কো। ট্যাংক, সাঁজোয়া যানসহ সামরিক সব সরঞ্জামই মোতায়েন করা হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, আরও সেনা, সামরিক সরঞ্জাম পথে রয়েছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কথার লড়াই তুঙ্গে। এর মধ্যেই পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে কিছু ‘অসম্ভব’ দাবিনামা পেশ করেছে রাশিয়া। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন জেগেছে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন কি তাহলে ইউক্রেনে আরেকটি অভিযান চালাবেন? কবে শুরু হতে পারে এই অভিযান? ইউক্রেন আক্রমণ করে তাঁর লাভ কী? ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণই-বা কী?
প্রথমে জেনে নেওয়া যাক, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে রাশিয়া কী দাবি জানিয়েছে। রাশিয়া গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোকে ওই দাবির খসড়া পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার তা প্রকাশ হয়েছে। এর থেকে জানা গেছে, ইউক্রেনসহ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করার দাবি জানিয়েছে রাশিয়া। মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন বন্ধের এবং প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে মস্কো। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান এমন অঞ্চলে পাঠানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়েছে রাশিয়া, যেখান থেকে একে অপরের ওপর সরাসরি আক্রমণ করা যায়। একই সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে ন্যাটোর সামরিক মহড়া বন্ধেরও দাবি জানানো হয়েছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের ইতিহাস
ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণ খুঁজতে হলে ১ হাজার ২০০ বছর আগে যেতে হবে। ইতিহাসবিদদের তথ্যমতে, ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় ডনিপার নদীর তীরে নবম শতকে গড়ে ওঠে কিয়েভান রাস নামের একটি পরাশক্তি। মধ্যযুগের এই পরাশক্তি এক সময় ইউরোপের পূর্বাঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করত। ১৩ শতকে মোঙ্গলদের অভিযানে এই সাম্রাজ্যের পতনের পর জন্ম হয় ইউক্রেন, রাশিয়া ও বেলারুশের। তবে ১৭ শতকের মাঝামাঝি ইউক্রেন আবার রাশিয়ার মধ্যে হারিয়ে যেতে শুরু করে। রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের জন্ম ১৯১৮ সালে। তবে এর চার বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মের মাধ্যমে আবারও এক হয় ইউক্রেন-রাশিয়া। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর দুই রাষ্ট্র আবারও আলাদা হয়।
তবে ইতিহাস, ভূরাজনীতি, ভাষা ও সংস্কৃতির দিক থেকে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অনেক মিল থাকায় তারা আলাদা হয়েও কখনো সেভাবে আলাদা থাকতে পারেনি। ইউক্রেনের বাসিন্দাদের অনেকেরই ভাষা রুশ। দেশটির মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ এই ভাষায় কথা বলে। যদিও ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভাষা ইউক্রেনীয়। দেশটিতে এই ভাষায় কথা বলে প্রায় ৬৮ শতাংশ।
সংকটের রাজনৈতিক কারণ
ইউক্রেন সংকটের পেছনে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির অভিলাষ। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে ইউক্রেনের সম্পর্কের সূত্রপাত ১৯৯৪ সালে। ২০০৮ সালে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে আবেদন করে। বিষয়টি মোটেই ভালোভাবে নেয়নি রাশিয়া। ২০১০ সালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মস্কোপন্থী ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। এর পর ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়ার পথ থমকে যায়। বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশত্যাগ করেন ইয়ানুকোভিচ। এর পরপরই ঝটিকা অভিযান চালিয়ে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিতে থাকে রুশ বাহিনী। তারই ধারাবাহিকতায় গত সাত বছর ধরে সেখানে সংঘাত চলছে।
পরবর্তীতে ইউক্রেন আবার ন্যাটোভুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। গত জুনে ব্রাসেলস সম্মেলনে ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করতে আবারও সম্মত হন পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা। এরপরই শুরু হয় রাশিয়ার সামরিক তৎপরতা এবং পশ্চিমা নেতাদের সঙ্গে কথার যুদ্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্তির ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশের নারাজি বিবেচনার বিষয়বস্তু নয়।
এই সংকটের পেছনে ন্যাটোর সম্প্রসারণই একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি অব ওয়ারের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, রাশিয়া এবার হয়তো ইউক্রেনের কাছ থেকে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত ডনেটস্ক এলাকা ছিনিয়ে নিতে পারে। এই এলাকা দখলে নিলেই রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ক্রিমিয়া স্থলপথে যুক্ত হয়ে যাবে। পাশাপাশি নর্থ-ক্রিমিয়া ক্যানেল নিয়ন্ত্রণে নিতে হলে রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত খেরসন অঞ্চলও নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা এখন নিম্নগামী। ২০১৪ সালেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর পুতিনের জনপ্রিয়তা এক লাফে ৯০ শতাংশে উঠে যায় তখন। এ ছাড়া পুতিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চান। এর আগেও ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করেছেন তিনি। গত বসন্তের ঘটনাই এর সর্বশেষ উদাহরণ। ইউক্রেন সীমান্তে সেনা মোতায়েন করল রাশিয়া। জুনেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের প্রথম সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর গত ৭ ডিসেম্বর দুই ঘণ্টাব্যাপী দুই নেতা ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনা করেন।
পুতিন বাইডেনকে আবারও সামনে চান। গত সপ্তাহে রুশ সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত এক ভিডিওতে পুতিনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাদের (পুতিন ও বাইডেন) আবারও সাক্ষাৎ হবে নিশ্চিত। আমি চাই সেটা।’
এ ছাড়া রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনকে আলাদা করে দেখেনি। এটিও সংকটের একটি বড় কারণ। তার ওপর রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সম্প্রতি এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর দুর্দশা নিয়ে কথা বলেছেন। এর আগে গত জুলাইয়ে ক্রেমলিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক দীর্ঘ নিবন্ধে তিনি রাশিয়া ও ইউক্রেনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে দুই দেশের জনগোষ্ঠীকে ‘এক জাতি’ হিসেবে মন্তব্য করেন।
সংকটের অর্থনৈতিক কারণ
পুতিন বরাবরই রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক কমিটিতে (ইএসিএ) ইউক্রেনকে চেয়েছেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকটি রাষ্ট্রকে নিয়ে মস্কোর নেতৃত্বাধীন এই মুক্তবাণিজ্য জোটের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়নকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রথম ধাপ এটি।
প্রায় সাড়ে চার কোটি জনগোষ্ঠীর দেশ ইউক্রেনের রয়েছে ব্যাপক কৃষি ও শিল্প উৎপাদন। রাশিয়া স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাষ্ট্রকে নিজের মুক্তবাণিজ্য জোটে চায়। কিন্তু কিয়েভ বারবারই সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক আলেক্সে কুশচ অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী পল ক্রুগম্যানের তত্ত্বের উল্লেখ করে বলেন, স্বনির্ভর পর্যাপ্ত সরবরাহের বাজার গড়তে হলে ২৫ কোটির জনগোষ্ঠী প্রয়োজন। কাজেই রাশিয়ার ওই মুক্তবাণিজ্য জোটে ইউক্রেন ও উজবেকিস্তানকে (সাড়ে তিন কোটি জনসংখ্যা) প্রয়োজন। এ কারণেই এই দুই দেশকে ঘিরে এমন ভূরাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তের বর্তমান পরিস্থিতি
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে শত শত ট্যাংক, স্বল্পপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করেছে রাশিয়া। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে ওই সীমান্তে ১ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়ে গেছে। জানুয়ারির শেষ নাগাদ সেখানে ১ লাখ ৭৫ হাজারের মতো সেনা মোতায়েন করা হতে পারে।
গত বসন্তেও ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্তে ট্যাংক ও অন্যান্য ভারী সমরাস্ত্রসহ ১ লাখ ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছিল রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে পুতিনের বৈঠকের আগে-পরে কিছু সেনা অবশ্য প্রত্যাহার করা হয়। তবে সিংহভাগই থেকে যায় সীমান্তে।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজিকার বরাত দিয়ে গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেন সীমান্তে থেকে যাওয়া সেনা ও সামরিক সরঞ্জামের সিংহভাগই রুশ সেনাবাহিনীর ৪১তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির। সেনাবাহিনীর এই ইউনিটের সদর দপ্তর ওই সীমান্ত থেকে ২ হাজার মাইল দূরে নভসিবিরস্ক এলাকায়। এই ইউনিটের কিছু সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সম্প্রতি বেলারুশ সীমান্তের কাছে স্মোলেনস্ক শহরে স্থানান্তর করা হয়েছে। এদিকে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান ও রকেট আর্টিলারিসহ প্রথম গার্ডস ট্যাংক আর্মির একাংশ স্থানান্তর করা হয়েছে ইউক্রেন সীমান্তের কাছে পগোনভ প্রশিক্ষণ এলাকায়। সম্প্রতি ৪৯ তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মি ক্রিমিয়ার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে।
কৃত্রিম উপগ্রহের তোলা ছবি বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ক্রিমিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে সম্প্রতি ৫৮তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির সামরিক সরঞ্জাম ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া অষ্টম ও ২০তম কম্বাইন্ড আর্মস আর্মির বেশ কিছু ইউনিটও ইউক্রেন সীমান্তের কাছে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউক্রেনের ডনেটস্ক ও লুহানস্ক এলাকায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে হাজারো রুশ সেনা মিশে আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কবে এবং কেমন হতে পারে রুশ হামলা
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তাঁরা এখনই ইউক্রেন-রাশিয়ার সংঘাতের আশঙ্কা করছেন না। কারণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয় ইউক্রেন সংকটের সঙ্গে জড়িত। তবে সবকিছু গাণিতিক হিসাবে হয় না। অন্তত পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য তো বলছে, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমনকি নতুন বছরের গোড়াতেই, অর্থাৎ জানুয়ারি পার হওয়ার আগেই আরেকটি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সাক্ষী হতে পারে বিশ্ব।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকফও সম্প্রতি বলেছেন, পরিস্থিতি বলছে, জানুয়ারির শেষ নাগাদ রাশিয়ার যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর তথ্যও একই ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিআইএর পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেছেন, পুতিন এমনভাবে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সীমান্তে স্থাপন করছেন, যেন ঝটিকা অভিযান চালিয়েই উদ্দেশ্য হাসিল করা যায়।
বিবিসি জানায়, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী সের্গেই রিয়াবকফ সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, এখনই আলোচনা শুরু না হলে পরিস্থিতি হয়তো ১৯৬২ সালের কিউবা ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের দিকেই নিয়ে যাবে সব পক্ষকে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক যুদ্ধে প্রায় জড়িয়েই গিয়েছিল।
এর আগে ডিসেম্বরের গোড়ার দিকে রাশিয়ার ফেডারেশন কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যক্তি ভ্লাদিমির জাবারফ বলেছেন, ‘ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় এখন রুশ পাসপোর্টধারী ৫ লাখ ইউক্রেনীয় রয়েছেন। বিদ্রোহী নেতারা যদি সহযোগিতা চান, আমাদের পক্ষে তা উপেক্ষা করা কঠিন হবে।’
কেমন হবে রুশ হামলা
গার্ডিয়ান জানায়, ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা গত নভেম্বরে একটি মানচিত্র প্রকাশ করে। এর থেকে জানা গেছে, পূর্ব দিক থেকে রুশ সেনারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে প্রবেশ করছে। ক্রিমিয়া থেকেও মাঝেমধ্যে আক্রমণ দাগাচ্ছে তারা। এ ক্ষেত্রে ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় অবস্থানরত রুশ সেনারা এই আক্রমণে সহযোগিতা করছে। এ ছাড়া বেলারুশ থেকেও রুশ সেনারা ইউক্রেনে প্রবেশ করছে।
ট্রান্সনিস্ত্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে মলডোভার অংশ হলেও ছোট্ট ভূখণ্ডটি মলডোভার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইউক্রেনের যে পাশে রাশিয়া, ঠিক তার উল্টো পাশে মলডোভার অবস্থান। এর পর রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড, বেলারুশ ও রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সীমান্ত। ইউক্রেনের বাকি সীমান্তজুড়ে কৃষ্ণ সাগর।
নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কিরিলো বুদানফ চলতি মাসের গোড়ার দিকে বলেছেন, রাশিয়া যদি পুরোদমে আক্রমণ করে বসে, তা ঠেকানোর সামর্থ্য ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর নেই।
পশ্চিমাদের মনোভাব
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানায়, রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে দাবিনামা প্রকাশের পর গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, ‘ইউরোপীয় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে আমরা গত ২০ বছর ধরেই আলোচনা করছি। কখনো এ আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে, কখনো আলোচনা আটকে গেছে। তবে আমরা আলোচনার জন্য সব সময়ই প্রস্তুত।’
তবে এর আগে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জেন সাকি বলেছেন, ‘আমাদের ইউরোপীয় মিত্রদের বাদ রেখে কোনো আলোচনা হবে না।’
এর আগে ইউক্রেন ইস্যুতে বড় অর্থনীতির সাত দেশের জোট জি-৭ হুঁশিয়ারি দিয়েছিল। দেশগুলোর নেতারা বলেছিলেন, ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়াকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।
তবে রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি আর দাবিনামা পেশের পর পশ্চিমাদের মনোভাবে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিবিসি গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে জানায়, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে যুক্তরাজ্য ও তার মিত্র দেশগুলো সেনা না পাঠানোর সম্ভাবনাই বেশি। স্পেক্টেটর সাময়িকীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন, ‘ইউক্রেন ন্যাটো সদস্য নয়। কাজেই রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করতে ইউক্রেনে কেউ সেনা পাঠাবে বলে মনে হয় না। এ কারণেই আমরা কূটনৈতিকভাবে পুতিনকে বলার চেষ্টা করছি, এ কাজ (ইউক্রেন আক্রমণ) করবেন না।’
বিবিসির এক বিশ্লেষণে বলা হয়, রাশিয়ার দাবিদাওয়ার খসড়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো স্বাক্ষর করবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়। মস্কোও খুব ভালো করে জানে, তারা যা দাবি করেছে, তা পশ্চিমারা পূরণ করবে না। হতে পারে এই দাবি আসলে আলোচনারই একটি কৌশল। পুতিন হয়তো রুশ জনগণকে বোঝাতে চাইছেন, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার উত্তেজনা মস্কোর দোষে নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়াভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএনএর রাশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাইকেল কফম্যান আল-জাজিরাকে বলেন, ‘কোথাও বড় একটা সমস্যা আছে। রাজনৈতিক দিকটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।’ লন্ডনের কিংস কলেজের রুশ রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক স্যাম গ্রিনের মতে, রাশিয়ার দাবি আসলে কোনো চুক্তি সম্পাদনের জন্য নয়। এটি এক ধরনের ঘোষণাই। তবে তা যে যুদ্ধে জড়ানোর জন্য, তাও নয়। হয়তো ওয়াশিংটন ও অন্যদের আতঙ্কে রাখতে এ ধরনের পদক্ষেপ।
আক্রমণ করলে রাশিয়ার পরিণতি কী হবে
২০১৪ সালে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া নেমে এসেছিল রাশিয়ার ওপর। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। তবে এই নিষেধাজ্ঞার চেয়েও রাশিয়ার বড় মাথাব্যথা নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন। বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে জার্মানিতে রাশিয়ার গ্যাস পৌঁছানোর কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ করতে হবে না রাশিয়াকে। ফলে ইউক্রেনের ওপর সামরিক চাপ আরও বাড়াতে পারবে রাশিয়া। এ কারণেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছে ইউক্রেন।
এদিকে জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোও হুমকি দিয়েছে, রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে নর্ড স্ট্রিম-২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের কথা মস্কোকে ভুলে যেতে হবে।
সংকটের সমাধান কী
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইউএসএ টুডের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়। ন্যাটো বেশ আগে থেকেই বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডের মতো ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র ও ন্যাটোর সদস্যগুলোকে সহযোগিতা করে আসছে।
অনেকেই মনে করছেন, ইউক্রেন ও জর্জিয়াকে একই সূত্রে গাঁথলে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোর পথ থেকে সরে আসবে। কিন্তু আদতে তা হবে না। কারণ এই রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে রাশিয়ার অবস্থান সব সময়ই স্পর্শকাতর। এই দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার ইতিহাস, জনগণ, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। কাজেই ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করে কিছুতেই যুদ্ধ এড়ানো সম্ভব নয়।
ন্যাটোর পরিসর বৃদ্ধিও কোনো যৌক্তিক সমাধান নয়। কাজেই ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং ইউরোপের পূর্বাঞ্চলীয় অন্যান্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়েই আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। আলোচনা এমনভাবে চালাতে হবে যেন, রাশিয়াও ওই রাষ্ট্রগুলোর সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে একমত হয়। এ ক্ষেত্রে কেবল পুতিন-বাইডেন নয়, তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর নেতাদেরও আলোচনায় বসতে হবে। সেই আলোচনা থেকে একেবারেই নতুন, বড় ও অপেক্ষাকৃত ভালো কোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যা সব পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক হবে।
আরও পড়ুন:

ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
১ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগে
জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

রুশদের মতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেন তাদের শর্তগুলো মানতে চাইছে না, সেটাই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে কিয়েভ এবং তার অধিকাংশ ইউরোপীয় মিত্রদের বক্তব্য, এই যুদ্ধবিরতির চুক্তির পথে প্রধান বাধা হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মস্কোয় যান। সেখানে পুতিনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যা চলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে। এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ এই বৈঠককে ‘খুবই কাজের এবং গঠনমূলক’ বললেও স্বীকার করেন যে, ‘সামনে অনেক পথ বাকি।’ তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা হলো ‘মূল প্রশ্ন।’ তবে তিনি এটাও মেনে নেন যে, ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হয়নি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার অবস্থানকে একেবারেই হাস্যকর মনে করছেন। কারণ, মস্কোই ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের ধারণা, ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে লাগাতার বোমা হামলা চলার কারণে পুতিনের আসলে শান্তিতে কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ভিজিটিং ফেলো ও রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, আমেরিকান এবং ক্রেমলিনের মধ্যে যা ঘটছে, তা নিয়ে তাদের ধারণা মূলত আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবের মূল ধারণা হিসেবে আমেরিকানরা ভূখণ্ড বিনিময়ের যে চেষ্টা করেছিল, তাতে পুতিনের বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো পাল্টে দিতে আগ্রহী।’
রাশিয়ার অনেকে ক্রেমলিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন এবং অনেকটা একই ভাষায় কথা বলেন। মস্কোভিত্তিক থিংক ট্যাংক ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্পার্টাক বারানভস্কির মতামত রুশ সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কিয়েভ সরকারের ক্রমাগত নাশকতা, তথ্য বিকৃত করা এবং অনিবার্যকে বিলম্বিত করার চেষ্টা আলোচনা প্রক্রিয়াকে অনেক জটিল করে তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ প্রথমে মিনস্ক চুক্তি কার্যকর করতে রাজি হয়নি এবং পরে ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া প্রাথমিক শান্তি চুক্তির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে। এমন এক ভরসা করার অযোগ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে গঠনমূলক আলাপ চালানো সত্যিই কঠিন।’
মিনস্ক চুক্তি ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সই হওয়া একাধিক চুক্তিমালা, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের দনবাসে চলা যুদ্ধ থামানো, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল। ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বেলারুশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই শান্তি আনতে পারেনি।
যদিও মস্কোয় সর্বশেষ বৈঠকে কী আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হয়নি, তবু রাশিয়ায় সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শেষ হয়তো কাছাকাছি। সেন্ট পিটার্সবার্গের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী তাতিয়ানা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দোষ দেন। তবে তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য করছেন।
তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র ট্রাম্পকেই কিছুটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে। যিনি কিনা আবার স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ উন্মাদ। তাহলে বুঝুন দুনিয়ার কী হাল হয়েছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি সবার জন্যই আরও খারাপ। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে স্পষ্টতই রাশিয়ার পাল্লা ভারী, যা আমেরিকান জেনারেলরাও ভালোই বোঝেন।’
গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা করেন, রুশ সৈন্যরা অবশেষে পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে। এর ফলে দুই বছরের অবরোধের অবসান ঘটেছে। ইউক্রেন শহর পতনের কথা অস্বীকার করলেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রুশদের অগ্রযাত্রা থামাতে তাদের সেনারা বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে যায়নি, সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে। ওই এলাকা একটি নিরপেক্ষ নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হবে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকস, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বা রুশ-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
এর বিনিময়ে, রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা আর কোনো ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করবে না এবং এই প্রতিশ্রুতি তাদের আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও আছে। গত সপ্তাহে পুতিন স্বীকার করেন যে এই পরিকল্পনা ‘ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘যদি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তাদের দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে যায়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব। যদি না যায়, তবে আমরা সামরিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ করব।’
সূত্র মারফত জানা যায়, গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনীয় মধ্যস্থতাকারীরা তাদের আমেরিকান প্রতিপক্ষকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে—কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী রুশ অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত নয়, বরং তার শর্তগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত।’
মঙ্গলবার বৈঠকের আগে, পুতিন ইউরোপকে হুমকি দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি সতর্ক করে দেন যে রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, ‘তবে ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।’
বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘পুতিন এর জন্যই প্রস্তুতি নেবেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালের আগে তিনি বলেছিলেন যে—রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে না, যা বিপরীতটাই ইঙ্গিত করেছিল।’ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকার পরও ইনোজেমতসেভ এবং বারানভস্কি দুজনেই একমত যে রাশিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘এতটা তীব্রতায় বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মোটেও কোনো সমস্যা নয়।’
তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধের শুরুতে যত সমস্যা ছিল, এখন তার চেয়ে কম। কারণ, শুরুতে আমরা দেখেছি তাদের লোক জড়ো করতে হয়েছিল; এখন তারা বেশ ভালো বেতন দেয় এবং (নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা) ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, তাদের অস্ত্রের সমস্যা ছিল এবং ভাষ্যকাররা লিখেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে তাদের শেল ফুরিয়ে যাবে। বাস্তবে, এখন যুদ্ধের আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে।’
ইনোজেমতসেভ মনে করেন, এখন ‘আমেরিকানরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—হয় এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, না হয় ইউক্রেনের প্রতি সব রকম সমর্থন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই বার্তা এখন কিয়েভকে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ইউক্রেনীয়দের কোনো না কোনোভাবে রাজি করানো হবে...ইউক্রেনীয়রা জানে যে ইউরোপ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। অর্থাৎ, যদি এখন আমেরিকানরা এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে দাঁড়ায়, তবে ইউরোপের কাছে বছরের পর বছর ধরে এই কারণকে সমর্থন করার মতো অর্থ বা সংকল্প কোনোটাই থাকবে না।’
ইনোজেমতসেভ উল্লেখ করেন, একটি চুক্তি হলেও তা ইউক্রেনের স্বার্থে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর জন্য ৬ লাখ সৈন্য এবং অন্তত কয়েক বছরের জন্য একটি বিরতি নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাস্তবে এটিই সমস্যার সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘পুতিন সব সময়ই একটি হুমকি হয়ে থাকবেন এবং তাই পশ্চিমের প্রধান কাজ হলো (৭৩ বছর বয়সী) পুতিনকে উতরে যাওয়া। যদি তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লড়াইয়ে বিরতি আসে, তবে এটি তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছে যাবে, যা স্বভাবতই তাঁকে কম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’
এ ছাড়া, যেকোনো সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রুশ অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। তবে ইনোজেমতসেভ ও বুদ্রাইৎস্কিস সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জীবন ২০২২ সালের আগের মতো স্বাভাবিক হবে। তাঁদের অনুমান, সমাজ প্রবলভাবে সামরিক এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘শান্তি আসতে পারে না। এমন এক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ফেরা সম্ভব নয় যেখানে পূর্ণাঙ্গ দমনমূলক সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের উপযোগী এই সমস্ত ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে, কারণ আমাদের আর কোনো সরাসরি বাহ্যিক হুমকি নেই।’
তাঁর মতে, ‘এটাই রাশিয়ার পুতিন রেজিমের নকশা। তাঁর ক্ষমতা এভাবেই সাজানো হয়েছে যে, এখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলবে, যেখানে রুশ অভিজাতরা পতাকার নিচে একত্রিত থাকবে, দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলবে...এগুলো কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চালু করা কিছু অসাধারণ ব্যবস্থা নয়, বরং এভাবেই তিনি শাসন চালিয়ে যাবেন।’
তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেন, ইউরোপ, বাল্টিক রাষ্ট্র বা ‘যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো রূপে যুদ্ধ’ হলো পুতিন ২০২২ সালের পরে রাশিয়ায় যে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘সুতরাং, এই রেজিম টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলতে থাকবে।’
কিছু রুশ নাগরিক ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতির জন্য নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মস্কোর গণমাধ্যম সের্গেই কালেনিক বলেন, ‘আমেরিকা যত দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার না করবে, তত দিন যুদ্ধ শেষ হবে না।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

রুশদের মতে যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইউক্রেন তাদের শর্তগুলো মানতে চাইছে না, সেটাই শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায়। অন্যদিকে কিয়েভ এবং তার অধিকাংশ ইউরোপীয় মিত্রদের বক্তব্য, এই যুদ্ধবিরতির চুক্তির পথে প্রধান বাধা হলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। মঙ্গলবার, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল মস্কোয় যান। সেখানে পুতিনের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়, যা চলে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে। এই দলে ছিলেন আমেরিকার বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার।
পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ এই বৈঠককে ‘খুবই কাজের এবং গঠনমূলক’ বললেও স্বীকার করেন যে, ‘সামনে অনেক পথ বাকি।’ তিনি বলেন, ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা হলো ‘মূল প্রশ্ন।’ তবে তিনি এটাও মেনে নেন যে, ভূখণ্ড সংক্রান্ত প্রশ্নে কোনো সমঝোতা হয়নি।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা রাশিয়ার অবস্থানকে একেবারেই হাস্যকর মনে করছেন। কারণ, মস্কোই ২০২২ সালে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ শুরু করে। তাদের ধারণা, ইউক্রেনীয় শহরগুলোতে লাগাতার বোমা হামলা চলার কারণে পুতিনের আসলে শান্তিতে কোনো প্রকৃত আগ্রহ নেই।
আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের ভিজিটিং ফেলো ও রুশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইলিয়া বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘যেমনটা প্রত্যাশা করা গিয়েছিল, এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। কারণ, আমেরিকান এবং ক্রেমলিনের মধ্যে যা ঘটছে, তা নিয়ে তাদের ধারণা মূলত আলাদা।’ তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রস্তাবের মূল ধারণা হিসেবে আমেরিকানরা ভূখণ্ড বিনিময়ের যে চেষ্টা করেছিল, তাতে পুতিনের বিশেষ আগ্রহ নেই। তিনি আসলে পূর্ব ইউরোপের সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামো পাল্টে দিতে আগ্রহী।’
রাশিয়ার অনেকে ক্রেমলিনের বক্তব্যকেই সমর্থন করেন এবং অনেকটা একই ভাষায় কথা বলেন। মস্কোভিত্তিক থিংক ট্যাংক ডিগোরিয়া এক্সপার্ট ক্লাবের সদস্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্পার্টাক বারানভস্কির মতামত রুশ সরকারের সঙ্গে মিলে যায়। তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে কিয়েভ সরকারের ক্রমাগত নাশকতা, তথ্য বিকৃত করা এবং অনিবার্যকে বিলম্বিত করার চেষ্টা আলোচনা প্রক্রিয়াকে অনেক জটিল করে তুলেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইউক্রেনীয় পক্ষ প্রথমে মিনস্ক চুক্তি কার্যকর করতে রাজি হয়নি এবং পরে ইস্তাম্বুলে আলোচনা হওয়া প্রাথমিক শান্তি চুক্তির শর্তগুলো প্রত্যাখ্যান করে। এমন এক ভরসা করার অযোগ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে গঠনমূলক আলাপ চালানো সত্যিই কঠিন।’
মিনস্ক চুক্তি ছিল ২০১৪ ও ২০১৫ সালে সই হওয়া একাধিক চুক্তিমালা, যার উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের দনবাসে চলা যুদ্ধ থামানো, যেখানে রুশ সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কিয়েভ সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছিল। ২০২২ সালের পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণের পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের মধ্যে বেলারুশ ও তুরস্কে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই শান্তি আনতে পারেনি।
যদিও মস্কোয় সর্বশেষ বৈঠকে কী আলোচিত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য ফাঁস হয়নি, তবু রাশিয়ায় সামান্য হলেও একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে যে, যুদ্ধের শেষ হয়তো কাছাকাছি। সেন্ট পিটার্সবার্গের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী তাতিয়ানা এই যুদ্ধের জন্য রাশিয়াকেই দোষ দেন। তবে তিনি মনে করেন, ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররাই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করতে বাধ্য করছেন।
তিনি আক্ষেপ করে প্রশ্ন করেন, ‘এই পরিস্থিতিতে যখন একমাত্র ট্রাম্পকেই কিছুটা বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন বলে মনে হচ্ছে। যিনি কিনা আবার স্বভাবগতভাবেই সম্পূর্ণ উন্মাদ। তাহলে বুঝুন দুনিয়ার কী হাল হয়েছে?’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন পরিস্থিতি সবার জন্যই আরও খারাপ। একটা সিদ্ধান্ত তো নিতেই হবে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে স্পষ্টতই রাশিয়ার পাল্লা ভারী, যা আমেরিকান জেনারেলরাও ভালোই বোঝেন।’
গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ ঘোষণা করেন, রুশ সৈন্যরা অবশেষে পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে। এর ফলে দুই বছরের অবরোধের অবসান ঘটেছে। ইউক্রেন শহর পতনের কথা অস্বীকার করলেও, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অঞ্চলে রুশদের অগ্রযাত্রা থামাতে তাদের সেনারা বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
প্রস্তাবিত চুক্তির শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে—ইউক্রেনকে দনবাস অঞ্চলের যেসব অংশ এখনো রাশিয়ার দখলে যায়নি, সেখান থেকে সেনা সরাতে হবে। ওই এলাকা একটি নিরপেক্ষ নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল হবে, তবে আন্তর্জাতিকভাবে তা রাশিয়ার ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃত হবে। একই সঙ্গে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক পিপলস রিপাবলিকস, যা ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া বা রুশ-সমর্থিতদের নিয়ন্ত্রণে, সেগুলোকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে মেনে নিতে হবে। ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর সংখ্যা ৬ লাখের মধ্যে সীমিত রাখতে হবে এবং ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগদানের সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হবে, তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
এর বিনিময়ে, রাশিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তারা আর কোনো ইউরোপীয় দেশ আক্রমণ করবে না এবং এই প্রতিশ্রুতি তাদের আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়া, যুদ্ধাপরাধের জন্য সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাবও আছে। গত সপ্তাহে পুতিন স্বীকার করেন যে এই পরিকল্পনা ‘ভবিষ্যতের চুক্তির ভিত্তি হতে পারে।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘যদি ইউক্রেনীয় সৈন্যরা তাদের দখল করা এলাকাগুলো ছেড়ে যায়, তবে আমরা যুদ্ধ থামাব। যদি না যায়, তবে আমরা সামরিকভাবেই আমাদের লক্ষ্য পূরণ করব।’
সূত্র মারফত জানা যায়, গত সপ্তাহান্তে ইউক্রেনীয় মধ্যস্থতাকারীরা তাদের আমেরিকান প্রতিপক্ষকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে—কোনো ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
ওয়াশিংটন ডিসিতে বসবাসকারী রুশ অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত নয়, বরং তার শর্তগুলো পূরণ হওয়া পর্যন্ত।’
মঙ্গলবার বৈঠকের আগে, পুতিন ইউরোপকে হুমকি দিয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি সতর্ক করে দেন যে রাশিয়া ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে না, ‘তবে ইউরোপ যদি চায় এবং শুরু করে, আমরা এই মুহূর্তেই প্রস্তুত।’
বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘পুতিন এর জন্যই প্রস্তুতি নেবেন, ঠিক যেমন ২০২২ সালের আগে তিনি বলেছিলেন যে—রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে যাচ্ছে না, যা বিপরীতটাই ইঙ্গিত করেছিল।’ দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা থাকার পরও ইনোজেমতসেভ এবং বারানভস্কি দুজনেই একমত যে রাশিয়া অনির্দিষ্টকাল ধরে তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সক্ষম। ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘এতটা তীব্রতায় বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মোটেও কোনো সমস্যা নয়।’
তাঁর ভাষায়, ‘যুদ্ধের শুরুতে যত সমস্যা ছিল, এখন তার চেয়ে কম। কারণ, শুরুতে আমরা দেখেছি তাদের লোক জড়ো করতে হয়েছিল; এখন তারা বেশ ভালো বেতন দেয় এবং (নতুন স্বেচ্ছাসেবকেরা) ক্রমাগত তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া, তাদের অস্ত্রের সমস্যা ছিল এবং ভাষ্যকাররা লিখেছিলেন যে তিন মাসের মধ্যে তাদের শেল ফুরিয়ে যাবে। বাস্তবে, এখন যুদ্ধের আগের চেয়েও বেশি সক্রিয়ভাবে অস্ত্র উৎপাদন হচ্ছে।’
ইনোজেমতসেভ মনে করেন, এখন ‘আমেরিকানরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে—হয় এই যুদ্ধ শেষ করতে হবে, না হয় ইউক্রেনের প্রতি সব রকম সমর্থন সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই বার্তা এখন কিয়েভকে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। আর তাই, ইউক্রেনীয়দের কোনো না কোনোভাবে রাজি করানো হবে...ইউক্রেনীয়রা জানে যে ইউরোপ তাদের রক্ষা করতে পারবে না। অর্থাৎ, যদি এখন আমেরিকানরা এই প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে দাঁড়ায়, তবে ইউরোপের কাছে বছরের পর বছর ধরে এই কারণকে সমর্থন করার মতো অর্থ বা সংকল্প কোনোটাই থাকবে না।’
ইনোজেমতসেভ উল্লেখ করেন, একটি চুক্তি হলেও তা ইউক্রেনের স্বার্থে আসতে পারে। তিনি বলেন, ‘যদি তারা নিজেদের সেনাবাহিনীর জন্য ৬ লাখ সৈন্য এবং অন্তত কয়েক বছরের জন্য একটি বিরতি নিশ্চিত করতে পারে, তবে বাস্তবে এটিই সমস্যার সমাধান।’ তিনি বলেন, ‘পুতিন সব সময়ই একটি হুমকি হয়ে থাকবেন এবং তাই পশ্চিমের প্রধান কাজ হলো (৭৩ বছর বয়সী) পুতিনকে উতরে যাওয়া। যদি তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য লড়াইয়ে বিরতি আসে, তবে এটি তার জীবনের শেষের দিকে পৌঁছে যাবে, যা স্বভাবতই তাঁকে কম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করবে।’
এ ছাড়া, যেকোনো সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার রুশ অর্থনীতির জন্য উপকারী হবে। তবে ইনোজেমতসেভ ও বুদ্রাইৎস্কিস সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, জীবন ২০২২ সালের আগের মতো স্বাভাবিক হবে। তাঁদের অনুমান, সমাজ প্রবলভাবে সামরিক এবং কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বুদ্রাইৎস্কিস বলেন, ‘শান্তি আসতে পারে না। এমন এক স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও ফেরা সম্ভব নয় যেখানে পূর্ণাঙ্গ দমনমূলক সর্বাত্মক একনায়কতন্ত্রের উপযোগী এই সমস্ত ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে, কারণ আমাদের আর কোনো সরাসরি বাহ্যিক হুমকি নেই।’
তাঁর মতে, ‘এটাই রাশিয়ার পুতিন রেজিমের নকশা। তাঁর ক্ষমতা এভাবেই সাজানো হয়েছে যে, এখানে এক অন্তহীন যুদ্ধ চলবে, যেখানে রুশ অভিজাতরা পতাকার নিচে একত্রিত থাকবে, দেশের অভ্যন্তরে যে কোনো ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চলবে...এগুলো কেবল সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চালু করা কিছু অসাধারণ ব্যবস্থা নয়, বরং এভাবেই তিনি শাসন চালিয়ে যাবেন।’
তিনি আরও যোগ করেন, ইউক্রেন, ইউরোপ, বাল্টিক রাষ্ট্র বা ‘যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো রূপে যুদ্ধ’ হলো পুতিন ২০২২ সালের পরে রাশিয়ায় যে ‘স্বাভাবিকতা’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার অবিচ্ছেদ্য চালিকাশক্তি। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, ‘সুতরাং, এই রেজিম টিকে থাকার জন্য বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধ চলতে থাকবে।’
কিছু রুশ নাগরিক ইতিমধ্যেই দীর্ঘস্থায়ী পরিস্থিতির জন্য নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন। মস্কোর গণমাধ্যম সের্গেই কালেনিক বলেন, ‘আমেরিকা যত দিন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তাদের দখলদার সৈন্য প্রত্যাহার না করবে, তত দিন যুদ্ধ শেষ হবে না।’
আল–জাজিরা থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগে
জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।
প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।
পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।
পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।
কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।
দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।
শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।
কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।
উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।
ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।
রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।
দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।
দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।
জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।
রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
উশাকভ মূলত ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্কের সম্পূর্ণ এলাকার ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ দাবির কথাই বলেছিলেন। পুতিন ইউক্রেনে হাজার হাজার সৈন্য পাঠানোর প্রায় ৪ বছর পরও এবং দোনেৎস্কে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের এক দশকেরও বেশি সময় পর অঞ্চলটির কিছু অংশ এখনো ইউক্রেনের হাতে আছে।
প্রায় সব দেশই দোনেৎস্ককে ইউক্রেনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু এটি ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের চারটি অঞ্চলের মধ্যে একটি, যা মস্কো ২০২২ সালে একটি গণভোটের পর সংযুক্ত করার কথা ঘোষণা করে। কিয়েভ ও পশ্চিমা দেশগুলো সেই গণভোটকে ‘প্রহসন’ বলে বাতিল করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ফক্স নিউজকে বলেছিলেন, যুদ্ধটি এখন দোনেৎস্কের সেই ২০ শতাংশ বা ৫ হাজার বর্গকিলোমিটারের এলাকা নিয়ে, যা রাশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে না কিন্তু চায়।
পুতিন ২০২২ সালে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠানোর সময় বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য হলো ‘গত আট বছর ধরে যারা ভয়ভীতি ও গণহত্যার শিকার হয়েছেন...সেই মানুষগুলোকে রক্ষা করা।’ ইউক্রেন এবং তার মিত্ররা বলেছিল, পুতিনের এই দাবি ঔপনিবেশিক ধাঁচের এবং এলাকা দখলের জন্য একটি মিথ্যা অজুহাত মাত্র।
পুতিনের এই দাবি মূলত দোনেৎস্ক এবং লুহানস্ক অঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের লড়াইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে, যারা ২০১৪ সালে ইউক্রেনীয় সরকারি নিয়ন্ত্রণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিছু এলাকা দখল করেছিল। পূর্ব ইউক্রেনে এর পরের সংঘর্ষে উভয় পক্ষই শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেছিল। মস্কো এই অঞ্চলের বিশাল রুশভাষী জনসংখ্যাকে উদ্ধৃত করে বলেছিল যে,২০২২ সালে হস্তক্ষেপ করা তাদের নৈতিক কর্তব্য।
কিয়েভ বলেছিল, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় ছিল না এবং তারাও বিচ্ছিন্নতাবাদী বাহিনীর বিরুদ্ধে শহর ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গোলাবর্ষণের অভিযোগ এনেছিল। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে ২০২২ সালের শুরু পর্যন্ত ইউক্রেনীয় সরকারি বাহিনী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সংঘাতে উভয় পক্ষে ৩ হাজার ১০৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং ৯ হাজার বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছিলেন।
দোনেৎস্কের বাকি যে অংশটি রাশিয়া চায়, তার মধ্যে রয়েছে স্লোভিয়ানস্ক এবং ক্রামাতোরস্ক—দুটি ‘দুর্গনগরী’ যা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এই শহরগুলো ইউক্রেনের বাকি অঞ্চল রক্ষার জন্য কিয়েভের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দোনেৎস্কের পশ্চিমের ভূমি অনেকটাই সমতল এবং বিশাল খোলা মাঠ; যা রাশিয়াকে দোনেৎস্কের বাইরে অগ্রসর হতে এবং দিনিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পর্যন্ত এলাকা দখল করার পথ সহজ করে দেবে।
শহরগুলো পরিখা, ট্যাংক-বিধ্বংসী বাধা, বাংকার এবং মাইনক্ষেত্রসহ অত্যন্ত সুরক্ষিত প্রতিরক্ষা লাইনের অংশ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, গণভোট ছাড়া দোনেৎস্কের বাকি অংশ রাশিয়ার হাতে তুলে দেওয়া অবৈধ হবে এবং তা ভবিষ্যতে ইউক্রেনের গভীরে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে একটি পথ খুলে দেবে।
কিয়েভের আশঙ্কা, যদি তারা দোনেৎস্কের বাকি অংশ ছেড়ে দেয়, তবে রাশিয়া আবার অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হবে এবং একসময় দোনেৎস্ক ব্যবহার করে পশ্চিম দিকে আক্রমণ চালাবে।
উভয় পক্ষই দোনেৎস্ককে কেন্দ্র করে যুদ্ধে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং প্রচুর অর্থ ও সরঞ্জাম ব্যয় করেছে। এর মধ্যে বাখমুত শহরের লড়াইও রয়েছে। যেখানে রাশিয়া হাজার হাজার দণ্ডিত অপরাধীকে ভাড়াটে সৈন্যে পরিণত করে রণক্ষেত্রে নামিয়েছিল। এ কারণে, দোনেৎস্ক উভয় দেশের জনমানসে আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে কারও পক্ষে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করা কঠিন।
ইউক্রেন চায় না যে, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে জয় করতে ব্যর্থ হওয়া ভূখণ্ডকে উপহার হিসেবে পাক এবং জেলেনস্কি বলেছেন, যে যুদ্ধ রাশিয়া শুরু করেছে, তার জন্য তাদের পুরস্কৃত করা উচিত নয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার অক্টোবর মাসে বলেছিল, রাশিয়ার অগ্রগতির হার দেখে মনে হয় না যে তারা খুব শিগগিরই দোনেৎস্কের বাকি অংশ দখল করতে চলেছে। তবে ‘রাশিয়ার অগ্রগতির একটি অপরিবর্তনীয় হার ধরে নিলে’ তারা ২০২৭ সালের আগস্টের মধ্যে তা নিতে পারে।
রাশিয়ার কমান্ডাররা অবশ্য আরও বেশি আশাবাদী। জেনারেল স্টাফের প্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভ রোববার পুতিনকে বলেছেন, মস্কোর বাহিনী পুরো ফ্রন্ট লাইন বরাবর অগ্রসর হচ্ছে এবং দনবাসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য কাজ করছে।
দোনেৎস্ক বন্দর, রেলপথ এবং অন্যান্য ভারী শিল্পের কেন্দ্র। এটি একসময় ইউক্রেনের কয়লা, পরিশোধিত ইস্পাত, কোক, ঢালাই লোহা এবং ইস্পাত উৎপাদনের অর্ধেকেরও বেশি সরবরাহ করত, তবে যুদ্ধের কারণে অনেক খনি ও কারখানা ধ্বংস হয়ে গেছে। এ ছাড়া, দোনেৎস্কে বিরল মৃত্তিকা, টাইটানিয়াম এবং জিরকোনিয়াম রয়েছে—যা এটিকে নিয়ন্ত্রণকারী পক্ষের জন্য আয়ের উৎস।
দোনেৎস্কের ভাগ্য পুতিন এবং জেলেনস্কি উভয়ের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে প্রভাবিত করতে পারে। পুতিন নিজেকে জাতিগত রুশদের রক্ষক হিসেবে তুলে ধরেছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। পুরো দোনেৎস্ককে সুরক্ষিত করা এই বক্তব্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু। জেলেনস্কি ২০১৯ সালে পূর্ব ইউক্রেনের যুদ্ধ অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন। ২০২২ সাল থেকে তিনি অনেক বড়, বৈরী প্রতিবেশীর মুখে অস্ত্র এবং সংখ্যায় কম ইউক্রেনের এক দৃঢ় রক্ষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
লড়াই না করে দোনেৎস্ক ছেড়ে দেওয়া—যেখানে অন্তত আড়াই লাখ ইউক্রেনীয় বাস করে—ইউক্রেনীয়দের কাছে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখা হতে পারে, যাদের অনেকেই যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজন হারিয়েছেন। কিয়েভ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সোসিওলজির সাম্প্রতিক এক জরিপ অনুসারে, ইউক্রেনীয়দের একটি সংকীর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এখনো আঞ্চলিক ছাড়ের বিরোধিতা করে।
জেলেনস্কিসহ ইউক্রেনের কর্মকর্তারা যেকোনো শান্তি চুক্তির অধীনে কিয়েভের নিয়ন্ত্রণে থাকা ভূমি ছাড়ার সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করেছেন। জেলেনস্কি বলেন, তাঁর ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো ম্যান্ডেট নেই এবং রাষ্ট্রের ভূমি ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো কেনা-বেচা করা যায় না। ইউক্রেনের সংবিধান অনুসারে, আঞ্চলিক পরিবর্তন অবশ্যই একটি গণভোটের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে, যা ইউক্রেনের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ, অন্তত ৩০ লাখ ইউক্রেনীয় ভোটারের স্বাক্ষর থাকলে আয়োজন করা যেতে পারে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই গণভোটের বিষয়টির সমালোচনা করেছেন এবং তিনি বলেছিলেন, ‘কিছু ভূমি অদল-বদল হবে।’ এখন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা মূলত এই দোনেৎস্কের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে সেটাই নিয়েই থমকে আছে।
রয়টার্স থেকে পরিমার্জিত

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
১ ঘণ্টা আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগে
জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।
উদ্ভাবন কি থেমে যাবে
অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।
যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।
বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে
ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে
গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।
চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব
বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
আল-জাজিরা অবলম্বনে

বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
সম্প্রতি টেসলার মালিক ইলন মাস্ক গত নভেম্বরে এমন এক পে-অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, যা তাঁকে একজন ট্রিলিয়ন ডলারের মালিকে পরিণত করতে পারে। তিনি ইতিমধ্যেই বিশ্বের শীর্ষ ধনী। যদি তিনি প্রস্তাবিত পূর্ণ প্যাকেজটি পান, তাহলে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হবেন। ফোর্বসের হিসেবে বর্তমানে বিশ্বের ৩ হাজার ২৮ জন বিলিয়নিয়ার আছেন। তাঁদের মোট সম্পদ প্রায় ১৬.১ ট্রিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে পৃথিবীতে এখনো প্রায় ৮৩ কোটি ১০ লাখ মানুষ দৈনিক তিন ডলারের নিচে আয় করে চরম দারিদ্র্যে দিন কাটান।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বের এই বিপুল সম্পদ বৈষম্য শুধু অর্থনীতিকে নয়, রাজনীতি, মিডিয়া ও চিন্তাকেও প্রভাবিত করে। অনেকেই মনে করেন, বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ ও ক্ষমতা বিশ্বব্যবস্থাকে ‘অতি ধনীদের স্বার্থে’ পুনর্গঠন করছে। আবার অন্য একটি মত বলছে, বিলিয়নিয়ারেরা না থাকলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও অগ্রগতি থমকে যাবে। কারণ বৃহৎ বিনিয়োগই গড়ে তোলে নতুন সমাধান।
উদ্ভাবন কি থেমে যাবে
অ্যাডাম স্মিথ ইনস্টিটিউটের ম্যাক্সওয়েল মার্লোর মতে, বিলিয়নিয়ারদের বিলোপ করা হলে পশ্চিমা অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তাঁর দাবি, অধিকাংশ বিলিয়নিয়ার তাঁদের সম্পদের মালিক হয়েছেন সমাজের চাহিদামতো পণ্য ও প্রযুক্তি তৈরি করে। তাঁদের সম্পদ মূলত কোম্পানির শেয়ার, মেধাস্বত্ব অথবা সম্পত্তি—যা দিনে দিনে ওঠানামা করে। তাঁর মতে, এই ধনী ব্যক্তিদের প্রণোদনাই উদ্ভাবনে গতি আনে; তা না থাকলে উন্নয়ন থেমে যাবে।
যদি ন্যায্যভাবে সম্পদ বণ্টিত হতো
গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ট্যাক্স জাস্টিসের ডেরেজে আলেমায়েহুর মতে, শুধু বিলিয়নিয়ার কর আরোপ নয়—প্রশ্ন হচ্ছে, সেই কর কোথায় যাবে। দক্ষিণ বিশ্বের শ্রম ও সম্পদ থেকেই যে বিপুল সম্পদ তৈরি হয়, তাই তার ন্যায্য অংশ দক্ষিণেই ফিরে আসা উচিত। তিনি বলেন, বৈষম্য কমাতে শুধু অর্থ হস্তান্তর নয়, বৈশ্বিক আর্থিক কাঠামো পুনর্গঠন জরুরি; নইলে বৈষম্য আরও গভীর হবে।
বিধিনিষেধ কি বদলাতে হবে
ডেনিসন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফাদেল কাবুব বলেন, বিলিয়নিয়ারেরা আসলে ব্যর্থ নীতির ফল। সিস্টেম যেভাবে সাজানো, তাতে সম্পদ একদিকে কেন্দ্রীভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তাঁর মতে, বিলিয়নিয়ার শ্রেণিকে বিলোপ করতে হলে আধুনিক অ্যান্টি ট্রাস্ট ও কঠোর বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
মিডিয়ার ওপর প্রভাব কমবে
গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেস ফ্রিডম্যান মনে করেন, বিলিয়নিয়ারেরা পুরো মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম কিনে ফেলতে সক্ষম হওয়ায় তথ্যপ্রবাহ তাঁদের স্বার্থেই নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন—বেজোস বা ইলন মাস্কের গণমাধ্যম মালিকানা এই অঙ্গনের স্বাধীনতাকে দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই বিলিয়নিয়ার প্রভাব সীমিত হলে তথ্যের উৎসও আরও স্বাধীন হতে পারে।
চরম সম্পদ কি সত্যিই বিলোপ করা সম্ভব
বিশ্ব ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবের লুকাস শ্যানসেলের মতে, ইতিহাসে এর নজির আছে। উদাহরণস্বরূপ—রকেফেলারের একচেটিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে দেওয়া, কিংবা রুজভেল্টের সময় সর্বোচ্চ করহার ৯৪ শতাংশে উন্নীত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পানামা পেপারসের মতো ফাঁস যেমন দুর্দান্ত স্বচ্ছতা তৈরি করেছে, তেমনি তা পরিবর্তনের সুযোগও তৈরি করছে। তিনি মনে করেন, ধনীদের ওপর কর আরোপের মতো ধারণা এখন আর ‘যদি’ নয়, বরং ‘কখন’ করা হবে—এ প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে।
আল-জাজিরা অবলম্বনে

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
১ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে।
২ দিন আগেআজকের পত্রিকা ডেস্ক

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।
তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।
তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।
এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর গত অক্টোবরে দেশটির প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সানায়ে তাকাইচি। এরপরই তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত হন জাপানের নতুন ‘আয়রন লেডি’ বা লৌহমানবী’ হিসেবে। এই পরিচয়টিকে তাকাইচি নিজেও গর্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচারের অনুরাগী এই রক্ষণশীল নেতা ঘরোয়া অর্থনীতি থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা—সব ক্ষেত্রেই শক্ত অবস্থানের বার্তা দিয়েছেন।
তাকাইচির রাজনৈতিক পরিচয়ের মূল কেন্দ্রে রয়েছে ‘নিপ্পন কেইগি’ নামে জাপানের সবচেয়ে প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। এই সংগঠন জাপানের সংবিধানের যুদ্ধবিরোধী ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল, শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গঠন এবং ঐতিহ্যবাদী মূল্যবোধে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে। পূর্বসুরী শিনজো আবের মতো তাই তাকাইচিও জাপানকে স্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চান, যেখানে গোয়েন্দা সংস্থা, আধুনিক সেনাবাহিনী এবং কঠোর নিরাপত্তা আইন থাকবে।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে তিনি জাতীয় শিল্পকে শক্তিশালী করা, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো এবং রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একই সঙ্গে কঠোর অভিবাসন নীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের প্রচারও তাঁকে ডানপন্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় করেছে। তবে এই অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার সঙ্গে গেঁথে গেছে—বিশেষ করে, তাইওয়ান ইস্যুতে তাঁর অবস্থানের কারণে।
তাকাইচি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব দেখাচ্ছেন। বেইজিংকে তিনি কৌশলগত হুমকি হিসেবে দেখেন এবং প্রতিরোধমূলক সামরিক ও কূটনৈতিক পদক্ষেপের পক্ষে জোর দিচ্ছেন। এরই অংশ হিসেবে অক্টোবরের শেষ দিকে তাঁর ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাক্ষাৎ দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন সোনালি যুগে প্রবেশ করানোর আভাস দেয়। জাপান প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপির কমপক্ষে ২ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আর যুক্তরাষ্ট্র বিরল ধাতুর সরবরাহ নিশ্চিতকরণসহ অর্থনৈতিক সহায়তার ঘোষণা দেয়।
তবে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো তাইওয়ানের সঙ্গে তাকাইচির ঘনিষ্ঠতা। তিনি তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট লাই চিং-তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা চীনের কাছে স্পষ্ট উত্তেজনাকর পদক্ষেপ হিসেবে ধরা পড়েছে। আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয় যখন তাকাইচি প্রকাশ্যে বলেন, তাইওয়ানের নিরাপত্তা জাপানের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এমনকি তাইওয়ানে চীনা হামলার ক্ষেত্রে জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
এ ক্ষেত্রে চীনের প্রতিক্রিয়াও ছিল কঠোর ও দ্রুত। তারা তাকাইচির বিরুদ্ধে ‘পুরোনো সামরিকতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করার’ অভিযোগ তোলে, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে এবং জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাঠায়। পাশাপাশি সামুদ্রিক এলাকায় কোস্টগার্ডের টহল বাড়ায় চীন, জাপানি সামুদ্রিক পণ্যে সীমাবদ্ধতা আরোপের হুমকি দেয় এবং উত্তেজনাপূর্ণ নানা বিবৃতি দেয়।
এদিকে জাপানও পশ্চিম সীমান্তের ইয়োনাগুনি দ্বীপে বিমান প্রতিরক্ষা ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও একই দ্বীপে সামরিক অবকাঠামো শক্তিশালী করছে। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি তাকাইচিকে উত্তেজনা না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ আগামী এপ্রিলে তিনি বেইজিং সফর করতে চান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাকাইচির নেতৃত্বে জাপান নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করেছে। তাঁর দৃঢ় অবস্থান দেশকে হয় পুনরুত্থানের পথে নেবে—নয়তো চীন–তাইওয়ান উত্তেজনার কেন্দ্রে ঠেলে দেবে। ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তিনি কোন পথে হাঁটবেন তার ওপর।

২০১৪ সালে বিশ্বকে বাকরুদ্ধ করে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রাশিয়া। ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ডটি দখলে নিতে রুশ বাহিনীর সময় লেগেছিল মাত্র ১ মাস ৬ দিন। এর পর পেরিয়ে গেছে সাত বছর। রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে কখনো উত্তেজনা বেড়েছে, কখনো কমেছে।
২০ ডিসেম্বর ২০২১
ভ্লাদিস্লাভ ইনোজেমতসেভ বলেন, ‘পুতিন ভালোভাবেই জানেন যে ইউক্রেনের হাতে সময় ফুরিয়ে আসছে। তাই, পুতিন সবকিছু নিয়ে খুব আত্মবিশ্বাসী। তাঁর হাতে সময় আছে। তিনি এক বা দুই বছর ধরে লড়তে পারেন। সমস্যাটা বরং পশ্চিমের (এবং তাদের লড়াইয়ের ইচ্ছার)। তাই, হ্যাঁ, তিনি দেরি করতে প্রস্তুত—ইউক্রেন ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেও
১ ঘণ্টা আগে
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতদের মধ্যে ইউক্রেন শান্তি চুক্তি নিয়ে আলোচনা হলেও প্রকাশ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউরি উশাকভ, এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে অমীমাংসিত ‘আঞ্চলিক সমস্যাই’ মূল বাধা। আর এই অঞ্চল আর কোনোটিই নয়, দোনেৎস্ক।
১ দিন আগে
বিশ্বজুড়ে দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন উঠে আসছে—‘যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ সীমিত করা হয়, অথবা এই শ্রেণিটিকেই সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়, তবে কী ঘটবে?’ পশ্চিমা দেশগুলোতে চরম ধনী বা বিলিয়নিয়ারদের সংখ্যা ও প্রভাব বাড়তে থাকায় এখন এই প্রশ্ন আরও জোরালো হয়েছে।
২ দিন আগে