ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যানটিন। সেখানে বসে খাচ্ছেন একজন। অনেকেই তাঁকে নিয়ে নানা কথা বলছেন। পরে জানা যায়, এই ব্যক্তির নাম তোফাজ্জল। অভিযোগ, মোবাইল চোর সন্দেহে গত বুধবার রাতে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন ঢাবির ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। খাওয়ার আগে ও পরে তোফাজ্জলকে দফায় দফায় পেটানো হয়। আর পরিবারের অভিযোগ, তোফাজ্জলকে হত্যার আগে ফোন করে তাঁর পরিবারের কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করা হয়।
একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি)। মৃত্যুর আগে বুধবার বিকেল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কয়েক দফায় মারধরের শিকার হয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ নেতা শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তোফাজ্জলের হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর জাবিতে শামীম হত্যা, শিক্ষকের বাসায় হামলা এবং গত ১৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করেছে। এ ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার আটজনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামে। একসময় কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। বুধবার রাতে হলের অতিথিকক্ষে কয়েক ঘণ্টা দফায় দফায় মারধরে তোফাজ্জলের মৃত্যু হয়। রাত ১২টার দিকে কয়েক শিক্ষার্থী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেকের) নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনার একাধিক ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এর একটিতে দেখা যায়, তোফাজ্জল মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী সোফায় বসে আছেন। আরেক ছবিতে দেখা যায়, তোফাজ্জলের হাত মেঝেতে রেখে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পেটানো হচ্ছে।
ঢামেক হাসপাতালের মর্গে তোফাজ্জলকে শনাক্ত করেন তাঁর বন্ধু মো. বেলাল গাজী। তিনি বলেন, ৩ থেকে ৪ বছর হলো তোফাজ্জলের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশেও থাকতেন।
এই হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি ফজলুল হক মুসলিম হলে প্রভোস্টের সঙ্গে কথা বলে সিসি ক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহের জন্য বলেছি। সেগুলো দেখে কারা দোষী, তা শনাক্ত করা হবে।’
এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন ও দুঃখ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ছাড়া ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের সুপারভাইজর মোহাম্মদ আমানুল্লাহ। এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনার জেরে গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীরা হলেন জালাল মিয়া, মোহাম্মদ সুমন, মোত্তাকিন সাকিন, আহসান উল্লাহ, ওয়াজিবুল আলম এবং আল হোসাইন সাজ্জাদ। সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র। তাঁদের মধ্যে জালাল মিয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন। আন্দোলন চলাকালে তিনি হল শাখা ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।
যা ঘটেছে জাবিতে
১৫ জুলাই রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ক্যাম্পাস শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে মারধর করা হয়।
বুধবার বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটকসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছিলেন শামীম মোল্লা। খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী সেখানে গিয়ে তাঁকে মারধর করেন। এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, লাঠি হাতে তাঁকে মারছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আহসান লাবিব। এ সময় লাথি দিতে দেখা যায় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আতিককে। আহসান লাবিব বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম একজন সমন্বয়ক। ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তাঁকে এ পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
এদিকে শামীমকে মারধরের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম উপস্থিত হয়। একপর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সহায়তায় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে আসা হয়। সেখানে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আবার দফায় দফায় তাঁকে মারধর করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘আমি যখন সবাইকে আটকাতে যাব, তখন আমাকে আহসান লাবিব আটকে রাখে। শামীম যখন পানি খেতে চায়, তখন আমি তাকে পানি দিতে গেলে আমার হাত থেকে পানির বোতল ফেলে দেওয়া হয়।’
এদিকে নিরাপত্তা শাখার কার্যালয়ের ভিডিও ফুটেজ থেকে পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন সাঈদ হোসেন ভুঁইয়া, রাজু আহমেদ, রাজন হাসান, হামিদুল্লাহ সালমান এবং এম এন সোহাগ। সবাই ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
সাঈদ হোসেন ভুঁইয়া ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া রাজু আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও রাজন হাসান একই বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, হামিদুল্লাহ সালমান ইংরেজি ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও এম এন সোহাগ কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা মারধরের ঘটনা অস্বীকার করেছেন।
এদিকে বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত দফায় দফায় মারধরের পর শামীকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে চিকিৎসক সেলিমুজ্জামান সেলিম বলেন, হাসপাতালে তাঁকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল।
দুই লাখ টাকা দাবি
পাথরঘাটা (বরগুনা) প্রতিনিধি জানান, তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামে। একসময় কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পরে তিনি ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন।
গতকাল ওই বাড়িতে গেলে তোফাজ্জলের বড় ভাই নাসিরের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, ‘ভোররাতে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে ফোন আসে আমার কাছে। ফোনটা ধরার পরই অন্য প্রান্ত থেকে এক লোক তোফাজ্জল কী হয়, সে কথা জানতে চান। সে দেবর, এ কথা বলার পরই ওই লোক বলেন, সে (তোফাজ্জল) চুরি করে ধরা পড়েছে। তাকে বাঁচাতে হলে ২ লাখ টাকা দিতে হবে।’
এদিকে যে নাম্বার থেকে শরীফা আক্তারকে কল দেওয়া হয়েছিল, সেই নাম্বারে কল দিয়ে বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ট্রুকলার অ্যাপ থেকে জানা যায়, ‘মাফি জুনিয়র আইএনএফএস’। পরে ওই মোবাইল নাম্বার যাচাই ও ফজলুল হক মুসলিম হলের একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই নাম্বারটি ব্যবহার করেন মুসফিরাত রহমান মাফি। তিনি ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে