পাকিস্তানের মাটিতে সেই দেশের সঙ্গে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সিরিজ জয় এক অভূতপূর্ব ঘটনা। বহু বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করে অবলীলায় বাংলাদেশের ছেলেরা বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। অভূতপূর্ব আরও অনেক কারণে পাকিস্তান ছিল এক বৈষম্যমূলক রাষ্ট্র। জাতীয় অর্থনীতির একটা বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে জোগান দেওয়া হলেও বাজেটের সিংহভাগ ব্যয় করত পশ্চিম পাকিস্তান। ক্রিকেটেও তাই।
দেশভাগের পর পাকিস্তান নানা কারণেই একটা ক্রিকেট দল গঠন করতে পেরেছিল। আবদুল হাফিজ কারদার, হানিফ মোহাম্মদ, ফজল মাহমুদের মতো ক্রিকেটার সেখানে জন্ম নিয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের কোনো ক্রিকেটার সেখানে সুযোগ পেতেন না। নানা আন্দোলন ও সংগ্রামের পর পূর্ব পাকিস্তানের একজন ক্রিকেটার রকিবুল হাসান সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু ত্রয়োদশ খেলোয়াড় হিসেবে।আমার সহপাঠী সৈয়দপুরের অবাঙালি ক্রিকেটার নিয়াজ আহমেদের ভাগ্যেও তা-ই ঘটেছিল। সম্ভবত এরা খেলার সুযোগই পাননি।
স্বাধীন বাংলাদেশে ক্রিকেট দল গঠিত হওয়ার পর নানাভাবে তাদের জীবনে জয়-পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু পৃথিবীর সব দলকেই তারা এক বা একাধিকবার পরাজিত করেছে। এবারে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করে দিয়ে তাদের একটা চূড়ান্ত বিজয় ঘটল। সেই সঙ্গে পাকিস্তানের ক্রিকেটে যে এক বৈষম্যমূলক সংস্কৃতি ছিল, তা–ও প্রমাণিত হলো।
এবারে ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানির কারণে তেমন একটা উল্লাস দেখা যায়নি। কিন্তু যাঁরা সেইসব দিনের ইতিহাস জানেন, তাঁরা মনে মনে যে একটা তৃপ্তির আনন্দ পেয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। সঠিকভাবেই বাংলাদেশ ক্রিকেট দল বৈষম্যের জবাব দিয়েছে।
পাকিস্তানের ক্রিকেট ছিল একটা রাজনীতি। দেশে তখন সামরিক শাসন চলছে, দুই পাকিস্তানের জনগণই গণতান্ত্রিক অধিকার বঞ্চিত। কিন্তু ক্রিকেট চলেছে। কোনো সংকট হলেই ভারতের সঙ্গে একটা টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করা হতো। ক্রিকেটপ্রেমী জনগণ খেলার দিকে ঝুঁকে পড়লেই শাসকগোষ্ঠী নিশ্চিন্ত! সে রকম একটি খেলার সুযোগ পশ্চিম পাকিস্তান নিতে চেয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ মার্চ।
পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করা হলো যেদিন, সেদিনই খেলা ঢাকা স্টেডিয়ামে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ জনতা সেদিন খেলা হতে দেয়নি। অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল স্টেডিয়ামে। এমনই অনেক বৈষম্য, নিপীড়নের ইতিহাস আছে পাকিস্তানের। কিন্তু এবারের দুটি টেস্ট ম্যাচ সেসবের একটা জবাব হয়ে গেল।
যেকোনো শাসকগোষ্ঠীই জনগণকে বিভক্ত করে। এই বিভাজনের তত্ত্ব তারা পেয়েছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ তত্ত্বের ভিত্তিতে সবাই দেশ শাসন করে থাকে, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে। আমাদের একটাই দেশ, কোনো প্রদেশ নেই। কিন্তু পাকিস্তানে এখনো বেশ কয়েকটি প্রদেশ আছে। প্রদেশগুলোতে এখনো প্রবল বঞ্চনা। গত বন্যায় বা বিভিন্ন সময়ে শুধু বৈষম্য নয়, প্রবল বৈষম্য ধরা পড়ে সেখানে। অথচ পাকিস্তানের যে সম্পদ এবং হেরিটেজ ছিল তা দিয়ে তারা একটা বড় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদ গড়ে তুলতে পারত। একদিকে সামরিক শাসন, গণতন্ত্রহীনতা ও সীমাহীন বৈষম্য একটি দুর্বল রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে।
ক্রিকেটের বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক জান্তা তাঁকে সেখানে থাকতে দেয়নি। খেলার মাঠের নায়ক এখন কখনো কারাগারে, কখনো মিছিলে শোভা পাচ্ছেন। আমরাও এ রকমই একটি জটিল পরিস্থিতিতে আমাদের রাজনৈতিক জীবন যাপন করছি। সামরিক শাসন-পরবর্তী গত ১৫ বছরে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসন খুব একটা সুখের হয়নি। রাষ্ট্রের এবং রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক আচরণ চলেছে। ফলে দেশটিতেও ব্যাপক বৈষম্যের পাশাপাশি দুর্নীতি একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে আছে সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, পরিবহনে সিন্ডিকেট, সরকারি-বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট—সর্বত্রই সিন্ডিকেট।
একটা সময় এসেছে যখন টাকা এবং তদবির ছাড়া কোনো কাজই হয় না। দেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা দেউলিয়া। এ ছাড়া আছে বিভাজন এবং পারস্পরিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে কেউ হয়তো লাভবান হয় না, কিন্তু একে থামাতেও পারা যায় না।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার স্থিতিশীলতার কথা না ভেবে একের পর এক মামলা শুরু হয়েছে। যে মামলার আসামি আমাদের বিজয়ী দলের বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটারও। এত দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে সর্বত্র। নানা দাবি-দাওয়ায় বিপর্যস্ত প্রশাসন। যেহেতু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে ওঠেনি, তাই সব দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে।
বিগত সরকারগুলোও রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করেনি। রাষ্ট্রের কাঠামোতে যদি সুবিচারের কোনো ব্যবস্থা থাকত তাহলে এত দিনে এসব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রকে গ্রাস করেছে এবং ভেঙে দিয়েছে সমাজকে। তাই সমাজের যেসব ইতিবাচক অনুশাসন ছিল, তা–ও আর এখন নেই।
সমাজ ভাঙার প্রথম উপাদান শিক্ষা। সাম্প্রতিককালে ছাত্ররা শিক্ষকদের প্রতি যে আচরণ করছে, তাতেই স্পষ্ট হয়ে পড়ছে মূল্যবোধের ভয়াবহ সংকট। প্রযুক্তি ব্যবহারের স্বাধীনতাও আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের এক গুরুতর চিত্র দেখায়। তাদের ভাষা—প্রতিবাদের বা ভালোবাসার হোক, তার যে ব্যবহার আমরা দেখতে পাই তাতে সেসব দেখে নিজেদের অপমানিতই বোধ হয়। আমাদের শিল্পীদের মধ্যেও একটা বিভাজন শুরু হয়েছে, যার অস্ত্র হচ্ছে ফেসবুক। এতে অন্যকে বিড়ম্বনায় ফেলা ছাড়া আর কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবু চলছেই। একধরনের লোক আছে যারা সমাজে কষ্টের উৎপাদন করে থাকে, তারা সে রকম।
আমাদের অন্তহীন সমস্যা। তবু আমরা এর ইতিবাচক দিকটা দেখি না কেন? এই যে আমাদের ক্রিকেটাররা, যাদের পূর্বসূরিদের ওপর পাকিস্তান যে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে দীর্ঘদিন, তার একটা চমৎকার জবাব দিয়ে আমাদের গৌরবান্বিত করল, সেই স্মৃতিটুকু অমলিন থাকুক আমাদের হৃদয়ে।
এ কথা সত্য যে বাংলাদেশ হয়েছিল বলেই ক্রিকেট সংস্কৃতি, শিল্প-সংস্কৃতি এত দূর এগিয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের প্রতি আমাদের চির কৃতজ্ঞতা।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে