নদীর নাম পুরাতন ধলেশ্বরী। স্থানীয়রা আদর করে ডাকে ছোট নদী। হাঁটু পানি ডিঙিয়েই নদী পারাপার চলে। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’। একসময় আকাশে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম শব্দ আর পানির তোড়ে ঘুম ভাঙত নদীতীরবর্তী মানুষের। বণিকদের বড় বড় জাহাজ চলত। পালতোলা নৌকার ঝাঁক, নৌকাবাইচ, মাছ ধরা, শিশুদের উদ্দাম ঝাঁপাঝাঁপি। গৃহবধূর মাটির কলসে পানি নেওয়ার চিরায়ত সেই দৃশ্য।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পুরাতন ধলেশ্বরী নদী নিয়ে এমন সব স্মৃতিই রোমন্থন করলেন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়। সবার প্রিয় ছোট নদীর বড় দুঃখের কথা জানালেন তিনি। গতিপথ পরিবর্তন, সেতু-বাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন এবং সংযুক্ত খালের উৎসমুখ দখলের কবলে পড়ায় স্মৃতিবিজড়িত নদীটি হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কায়। বর্ষাকালেও এখন আর দুই কূল ছাপিয়ে বয়ে চলে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, নাগরপুরের যমুনা থেকে ধলেশ্বরীর উৎপত্তি। ঘিওর ও সাটুরিয়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদীতে বর্ষা ছাড়া বাকি সময় নৌকা চলাচলের মতো পানিও থাকে না। এই ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে পুরাতন ধলেশ্বরীর আয়তন ২৬ কিলোমিটার, যা মূল যমুনা থেকে শুরু হয়ে ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় শেষ হয়েছে। ঘিওর সদর, বালিয়াখোড়া ও বানিয়াজুরী ইউনিয়নের কমপক্ষে ২০টি গ্রাম ঘেঁষে বয়ে গেছে ধলেশ্বরী। এর বিভিন্ন বাঁকে হাট-বাজার, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন সংস্থা গড়ে উঠেছে।
‘বছর দশেক আগেও নদীটি ছিল খরস্রোতা। বর্ষাকালে ভরে উঠত কানায় কানায়। বৈশাখে পানি কম থাকায় গরু আর ঘোড়ার গাড়ি যাওয়া-আসা করত। শরৎকালে নদীর কূলজুড়ে ফুটে থাকত কাশফুল। ছোট্ট এই নদী ঘিরে কত না স্বপ্ন আর স্মৃতি জড়িয়ে আছে নদীপাড়ের অধিবাসীদের।’ -এভাবেই বলছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।
নদীর বুকে ভাসানো রঙিন সাম্পান নৌকা, পালতোলা নৌকায় বইঠা হাতে মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান, নদীতে লঞ্চ বা ট্রলারের পেছনে জলের বুকে ভেসে ওঠা শত শত শিকারি পাখির ছোটাছুটি। একসময় এ সবই দেখেছেন নদীপাড়ের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী নায়েব উদ্দিন।
‘একবার এ নদী থেকে সাড়ে ১২ কেজি ওজনের এক বোয়াল শিকার করেছিলাম বড়শি দিয়ে। অনেক মাছ থাকত তখন। সবই অতীত।’ -এ কথা বলার সময় বড় বড় হয়ে আসছিল নায়েব উদ্দিনের চোখ, যেন মাছ ধরার সেই সময়টা চোখের সামনে দেখছেন।
বিয়ের সময় বাবার বাড়ি থেকে এই নদীপথেই নৌকায় শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন বাটরাকান্দি গ্রামের গৃহবধূ সাজেদা বেগম। এরপর কেটে গেছে ৫০ বছর। ‘বর্ষাকালে বাবার বাড়ি থেকে আত্মীয়স্বজন আসত। নদীপানে চেয়ে থাকতাম। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে কত কথা, কত স্মৃতি।’
মানিকগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও নদী ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। নদী হারিয়ে গেলে নদীর আপন সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।’
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন জানান, ধলেশ্বরী নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে জলবায়ু ট্রাস্ট এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে কয়েকটি প্রকল্প দাখিল করা হয়েছে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে