Ajker Patrika

জাতীয় ঐক্য: কতটা কাছে, কতটা দূরে

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
জাতীয় ঐক্য: কতটা কাছে, কতটা দূরে

শুধু নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই নয়; পরেও দেশের রাজনীতিতে বিরোধ, অনৈক্য, এমনকি সংঘাত-সংঘর্ষ দেখে দেখে বড় হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তরুণদের অনেকেই দেশের রাজনীতি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করছে, অনেকে দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার অনেকে দেশে যে যার মতো করে সুখ খোঁজার চেষ্টা করছে—কেউ পারছে, কেউ পারছে না, কেউ বড়লোক হয়ে উঠছে, কেউ কোনো রকমে দিনাতিপাত করছে, কেউ নানা বিশ্বাস, অবিশ্বাস, আশাবাদ নিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। অথচ ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রশ্ন এলে অনেকেই এর উত্তর যার যার মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু সবাই যে সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ববাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ কোনো ধারণা নিয়ে দেশের তাবৎ সমস্যা সম্পর্কে উত্তর দিতে পারছে, তেমনটি জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। কারণ এসব জটিল বিষয়ের উত্তর খুব সোজা নয়, আবার মনগড়াভাবে দিলেও হওয়ার নয়। কিন্তু আমরা তো হরহামেশাই যাদের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়ার আশা করি, তারাই তো আজ এক কথা, কাল অন্য কথা, এ দল এক কথা, ও দল অন্য কথা, এ বিশেষজ্ঞ এক কথা, অন্য বিশেষজ্ঞ ভিন্ন কথা বলেন। তাহলে সঠিক জবাব বা কারণ জানা হবে কীভাবে?

বিভ্রান্তির বালুচরে অনেকেই আটকে পড়ে আছে। চিন্তার দিক থেকে অনেকেই এগোতেই পারছে না। ব্যাখ্যার নামে নানা অপব্যাখ্যায় বিশ্বাস, আস্থা ও ধারণার জগৎকে এতটাই অস্বচ্ছ ও সংকীর্ণ করে ফেলেছে যে আমাদের দেশ, সমাজ ও বিশ্ববাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। এই বাস্তবতা নিয়ে ১৭-১৮ কোটি মানুষের একটি দেশকে দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়তো ইউটোপীয় চিন্তা বলেই মনে হতে পারে; জাতীয় ঐক্যের প্রত্যাশা করা গেলেও বাস্তবটা মনে হয় বহু বহু দূরের বিষয় হয়ে গেছে।

প্রায়শই আমরা বলে থাকি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধের কারণেই দেশের রাজনীতিতে এমন অস্থিরতা বিরাজ করছে। কথাটি দৃশ্যত সত্য, কিন্তু ভেতরের কারণটা আমরা ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বৈশ্বিক বাস্তবতা দিয়ে যতক্ষণ না বোঝার চেষ্টা করব, ততক্ষণ মূল সমস্যাকে দেখার ধারেকাছে যাওয়ার কোনো সুযোগ দেখি না। প্রায়ই অনেকে বলে থাকেন, আমাদের একটি জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। প্রত্যাশাটা খুবই সংগত, কিন্তু এর বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, কীভাবে সম্ভব, তার উত্তরে বোধহয় এখন বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন প্রশ্নের মুখে আমাদের পড়তে হবে। সেই সব প্রশ্নের জবাব কি আমাদের জানা আছে বা আমরা কি সেগুলোর সমাধান খুঁজে পাব? হারিয়ে যাওয়া কোনো বস্তু খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে প্রায় পাঁচ দশক ধরে দূরে ঠেলে রেখে এখন আমরা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার যে প্রত্যাশা করছি, সেটি পূরণ করা মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার চেয়েও কঠিন বললে খুব বেশি অত্যুক্তি করা হবে না। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষকে একবার যদি মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়, তাহলে সবাই এমন সব দূর অজানায় ধাবিত হতে থাকে যে সেখান থেকে আর ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ কাজ নয়।

এবার ভাবুন তো, ১৯৭১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি। তখন একটা বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য ঘটেছিল। তার পরও সমাজের একটি অংশ স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, একটি অংশ নীরব ছিল, আরেকটি অংশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তিতে ছিল। একটি দেশের স্বাধীনতা নিয়েই যদি জাতীয় ঐক্যের মধ্যে এমন ছোট ছোট বিভাজন, বিরোধিতা, সমর্থনহীনতা, বিভ্রান্তি ও নীরবতা বিরাজ করতে পারে, তাহলে প্রাপ্ত স্বাধীন রাষ্ট্র নিয়ে আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর পথচলাটা কতখানি বিভাজিত এবং জাতীয় ঐক্যবিরোধী অবস্থানে চলে যেতে পারে, তা একবার গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত।

অনেকেই বলে থাকেন, সত্তরের নির্বাচনে ৭৫ শতাংশ মানুষ পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। বাকি ২৫ শতাংশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। স্বায়ত্তশাসন নিয়েই যেখানে এমন বিভ্রান্তি ও বিভাজন পাকিস্তান রাষ্ট্রে সত্তর সালে দেখতে হয়েছিল, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সেটি কমিয়ে আনার জন্য রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও মানুষের মনোজাগতিক পরিবর্তন ঘটানোর জন্য একটি পরিকল্পিত ধারাবাহিক বিকাশ ও উত্তরণের রাষ্ট্রীয় পথচলার সময় অতিবাহিত করা ছাড়া এটি অর্জন করা মোটেও সম্ভব ছিল না। ১৯৭০ সালে যে ২৫ শতাংশ মানুষ স্বায়ত্তশাসনের বিরোধিতা করছিল, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের হয়তো একটি অংশের পরিস্থিতি ও বাস্তবতাবোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আবার যে ৭৫ শতাংশ মানুষ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, তারা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সবাই স্বাধীনতার সক্রিয় সমর্থক ছিল কি না, তার উত্তর পাওয়া একটি জটিল বিষয়।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ঐক্যটা বাস্তবতার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। যেটুকু দূরত্ব ভেতরে ছিল, সেটি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারাবাহিক বিকাশের মাধ্যমেই কেবল ভেতর থেকে ধীরে ধীরে তৈরি হতে পারত, সেটিই বিজ্ঞানসম্মত উপায়। কিন্তু আমাদের জাতীয় ইতিহাস ভয়ানক এক রাজনৈতিক দুঃখজনক ট্র্যাজেডির ভেতর দিয়ে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছর পর থেকে গতিপথ বহুধাবিভক্তির মধ্যে বিলীন হতে থাকে। এ যেন ব্ল্যাক হোলের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া এক অদৃশ্য শক্তির ভেতরে ঢুকে পড়া। ১৯৭২ সালে আমাদের জাতীয় ঐক্য নানা দুর্বলতার মধ্যেও অনেকটা কাছাকাছি ছিল। বঙ্গবন্ধু জাতি-রাষ্ট্র গঠনের যে সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রটিকে আধুনিক চরিত্রদানের জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেটি আমাদের জন্য ছিল একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।

আমাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রবোধের বিশাল ঘাটতি নিয়েই সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেটি আমাদের মনোজগতে ভীষণভাবে গেঁথেও ছিল। সেই সব বিশ্বাস, অবিশ্বাস, অন্ধত্ব আর রাজনীতির নামে নানা বিশ্বাসের অবস্থানকে বর্জন কিংবা ত্যাগ করে ’৭২-পরবর্তী সময় থেকে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জটি ছিল অনেক জটিল ও কঠিন। বাস্তব সম্ভাবনা কেবল সে পথেই অর্জন করার ছিল। ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ড আমাদের সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরিয়ে নেয়। অন্ধবিশ্বাস, কুৎসা, অপপ্রচার আর সাম্প্রদায়িকতায় নিক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যে চরিত্রদান করা হলো, সেটি আর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পথে থাকেনি। বরং সাম্প্রদায়িক, বিভাজিত এক পশ্চাৎপদ সমাজ ও বিভাজিত রাজনীতির রাষ্ট্রচরিত্রে হারিয়ে যাওয়ার পথেই টেনে নিয়ে গেল।

সেই পথে জাতি গঠনের শিক্ষানীতি কার্যকর হলো না। শিক্ষাব্যবস্থাকে নানা ধারা-উপধারায় এমনভাবে পরিচালিত হতে সুযোগ করে দেওয়া হলো যেখানে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানচিন্তা, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সংস্কৃতির অত্যাবশ্যকীয় জটিল চিন্তাগুলো পরিত্যাজ্য হলো। মানুষকে অন্ধবিশ্বাস আর বিভাজিত জাতি সম্প্রদায়ে বেড়ে ওঠার এক অবৈজ্ঞানিক ভাবাদর্শে বুঁদ হয়ে থাকার অবস্থান নিশ্চিত করা হলো। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি অসাম্প্রদায়িকতাকে দূর দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো, বিভ্রান্ত করা হলো এটি পশ্চিমা সংস্কৃতি, ধর্মের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ বলে। এমন বিশ্বাস আর প্রচারের চক্রের আবর্তে গোটা জাতি দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকায় আধুনিক জাতি বিশ্ববাস্তবতা, সম্প্রদায়গত অবস্থান এবং নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক রূপদানের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ অনেকটাই দুর্বল কিংবা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেই বোধ, সচেতনতা, রাজনীতিতে ফিরে আসার উপায় কী? গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই তো সাম্প্রদায়িকতায় দুষ্ট যুক্তি, মানবতা, আধুনিকতা, জ্ঞানবিজ্ঞান ও মানবদক্ষতার গুরুত্ব হারিয়ে বসে আছে।

’৭৫-পরবর্তী রাজনীতি মূলত শক্তি অর্জন করেছিল অপরাজনীতিকে রাজনীতির মাঠে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এই রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, শিক্ষানীতি, কল্যাণবাদী রাষ্ট্রচিন্তা কোনো কালেই এই দেশে প্রতিষ্ঠিত করার অবশিষ্ট বজায় রাখেনি। আওয়ামী লীগ ১৯৮১ সালে পুনরুজ্জীবিত হলেও এর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের দর্শন হালে পানি পাচ্ছিল না। ১৯৯৬ সালের পর থেকে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনতে গিয়ে প্রকৃত বিভাজিত চিত্রটি স্পষ্ট হয়ে গেল। ’৭৫-পরবর্তী অপশক্তি ২০০১-০৬ সালে অসাম্প্রদায়িকতা এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার কিছুই বাকি রাখেনি। রাজনীতির বিভাজন সেই সময়ে আরও প্রকট ও দূরের বিষয় হয়ে গেল। ২০০৯ সালের পর সেটি অনেকটাই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল।

শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা, অসাম্প্রদায়িকতাকে ফিরিয়ে আনতে না দেওয়া, যেখানে রাজনীতির মাঠে এখন বড় দৃশ্যমান বিষয় সেখানে জাতীয় ঐক্য গঠনের চিন্তা কল্পবিলাস আর বিলাপের বিষয় হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, এসব পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত কাছাকাছি অবস্থানে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটি আরও দূরেই কেবল সরে যেতে থাকবে।

লেখক: অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ