শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

সেকশন

 

সামাজিক মাধ্যম কি গতির মধ্যে দুর্গতি

যেকোনো গণমাধ্যমকে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে, তা পত্রিকা হোক, টিভি বা রেডিও হোক। একই সঙ্গে এসব গণমাধ্যম ও আজকাল দর্শক-শ্রোতা হারাচ্ছে। অনলাইনের জয়জয়কার অব্যাহত গতিতে চলছে, চলবেও।

আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩৪

সামাজিক মাধ্যমের অসতর্ক ব্যবহার বিশৃঙ্খল সমাজ তৈরি করছে। প্রতীকী ছবি: পেক্সেলস সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার যেভাবে বেড়েছে, ঠিক একইভাবে সামাজিক মাধ্যম নিয়ে জনগণের দুশ্চিন্তাও বেড়েছে। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অ্যালগরিদমের কাছে ব্যক্তিসত্তা ভুলে সর্বসাধারণ যেন ক্রীড়নক হয়ে পড়ছে।

সামাজিক মাধ্যম বা নিউ মিডিয়ার যে দোর্দণ্ড প্রতাপ, তা ভালো-মন্দের বিবেচনায় না রেখে ব্যবহারকারীদের মগ্নতা এবং তাদের এনগেজমেন্টের বিষয়টিকে আজ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা প্রয়োজন। সামাজিক মাধ্যম যেভাবে মানুষের মনোজগতের ওপর দখল নিয়েছে এবং গভীর প্রভাব ফেলছে, তাতে এখন যোগাযোগমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো কনটেন্টের বৈচিত্র্য ও ইন্টার‍্যাক্টিভ কনটেন্টের ওপর জোর দিচ্ছে। তাতে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা সফলতার মুখ দেখছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অ্যালগরিদম কম্পিউটারে নেট ব্যবহারকারীদের পছন্দ-অপছন্দকে শ্রেণিভুক্ত করে আজকাল ধাপে ধাপে নতুন চাহিদা তৈরি করে দেয়, তাদের পছন্দগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিন্যস্ত করে এগিয়ে দেয়। যেমন একজন নেট ব্যবহারকারী কোনো বিষয়ে কথা বলছে কিংবা মেসেজ দিচ্ছে, সেখানে ‘কি ওয়ার্ড’গুলো অনুসরণ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম সেই নেট ব্যবহারকারীকে সাজেশন দিচ্ছে। কোনো পণ্য বা কোনো সেবা তার লাগবে কি না, তা তুলে ধরছে। বন্ধু নির্বাচনে ব্যক্তিবিশেষের বৈশিষ্ট্য উপস্থাপন করে দিচ্ছে। নেট ব্যবহারকারীর মন বুঝে তাকে সহায়তা করছে।

গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক সাফল্য অবশ্যই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠতেই পারে যে রেডিও-টিভিসহ ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ওপর মানুষের যে ঝোঁক তৈরি হয়েছে, তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। ধীরে ধীরে এই সব মানুষ সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে নিজেদের সমর্পণ করে এক আলাদা ভুবনে নিমজ্জিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদমের ক্রীড়নক হয়ে সে তার নিজের কাজকর্ম ভুলে যাচ্ছে, নিজের কাজকর্মের দায়বদ্ধতার প্রতি উদাসীন হচ্ছে, পড়াশোনা বা পেশার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছে, ব্যক্তি-মান উন্নয়নের প্রতি খেয়াল করতে পাচ্ছে না, পরিবার কিংবা সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা হেলাফেলায় অস্বীকার করছে।

ব্যক্তিস্বাধীনতা ও নিজের অধিকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদমের দাসে পরিণত হচ্ছে। সমাজ ও দেশের প্রতি নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নের যে ভূমিকা, তা-ও কার্যকর করা যাচ্ছে না। সমাজ যেন বৃত্তাবস্থায় তার নিজের একটি বলয় তৈরি করে ফেলছে, যেখানে সময়ের গতিময়তায় নতুন নতুন সৃষ্টি এবং সৃজনশীলতার স্বাক্ষর না রেখে সে নিজেই একটি স্থবির সমাজব্যবস্থা তৈরি করছে। অবশ্য সবাই এই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেবে না। ব্যতিক্রম তো আছেই।

নিউ মিডিয়া বা সামাজিক মাধ্যম বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে তার অডিয়েন্সকে নানা ধরনের সার্ভিস দিচ্ছে। সেবা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টার সঙ্গে সন্তুষ্টি প্রদান করা এবং তার বিনিময়ে তার মূল্যমান আদায় করে ব্যবসা নিশ্চিত করছে। নারী-পুরুষের বিভিন্ন বয়স, পেশা, নেশা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন এসব প্রবণতা সার্বক্ষণিক ট্র্যাক করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদম কাজ করে এমন পর্যায়ে যাচ্ছে যে সামাজিক মাধ্যমে লেগে থাকা প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব কিংবা গোপনীয় আর কিছু অবশিষ্ট থাকছে না।

ব্যবহারকারীর মনের অভ্যন্তরে এসে এক জাদুকরী ডিমান্ড তৈরি করছে, যা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হিসেবে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে তাকে প্রলোভন দেখিয়ে সরবরাহ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর আগে মানুষের মনের কথা প্রকাশ কিংবা কারও সঙ্গে শেয়ার করার এত বেশি সুযোগ ছিল না। গণমাধ্যমে কনটেন্ট পরিবেশনকারী নির্দিষ্টসংখ্যক সাংবাদিক/লেখক/শিল্পীর মধ্যে তাঁদের যোগাযোগ সীমিত ছিল। সাংবাদিক তথা অন্যরা যা ভালো মনে করেন শুধু তা-ই উপস্থাপন করেন, কালে-ভদ্রে দু-একজন দর্শক-শ্রোতা-পাঠক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চিঠি লিখে বা ফোন করে তাঁদের মতামত জানান।

ইন্টারনেট এবং আধুনিক প্রযুক্তি সব সীমারেখা পেরিয়ে ‘মাল্টিডিরেকশনাল’ বার্তা প্রেরণ ও গ্রহণ করে। কোনো ব্যক্তি যেকোনো স্থান থেকে বিশ্বের অন্য যেকোনো প্রান্তে তার মনের কথা ব্যক্ত কিংবা মতপ্রকাশ করে চলেছে তার পরিচিত কিংবা অপরিচিত মানুষের কাছে। কখনো কখনো সেগুলো শুধু মতামত নয়, প্রেরণাদায়ক এবং সচেতনতামূলক কিংবা ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণমূলক। কখনো আবার নিরেট বিনোদনধর্মী। বিনোদন কিংবা নির্মল আনন্দ দেওয়ার জন্য সামাজিক মাধ্যম যথেষ্ট অবদান রাখছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও ব্যবহার নিশ্চিতভাবে মানুষকে সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।

শিক্ষামূলক ও গবেষণালব্ধ অনেক তথ্য খুব সহজে পাওয়া যাচ্ছে। এসবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ-প্রগতির ধারা যেমন অব্যাহত থাকে, তেমনি ব্যক্তিজীবনও অনেক কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়। এদিকে চ্যালেঞ্জ থেকে যায় যে একজন ব্যক্তি ইন্টারনেট ও প্রযুক্তির ব্যবহারে নিজেকে কীভাবে পরিচালনা করবে। অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের অপব্যবহার, প্রযুক্তির এ সম্ভাবনাকে হালকা বিনোদন কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন ব্যবহারের কারণে তার মেধা-মনন-সময় এই সবকিছুর অপব্যবহারই হয়। ব্যক্তিজীবনের নিয়ন্ত্রণ কিংবা শৃঙ্খলাবোধ পারিবারিক ও সামাজিক জীবনধারাকে হুমকির মুখোমুখি করে তোলে। দিনরাত্রির ব্যবধান চুকে যায়। মানবদেহের স্বাভাবিক কাজকর্ম ও গতিময়তা দিবারাত্রির নির্দিষ্টতায় চলার কথা। দিনে কাজকর্ম, রাতে ঘুম আবশ্যিক এক ধারাবাহিকতা। এর ব্যত্যয় হলে দেহমনে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।

আজকাল সামাজিক মাধ্যমের অধিক ও অসতর্ক ব্যবহার এক বিশৃঙ্খল সমাজ তৈরি করে চলছে। মানুষে মানুষে হানাহানি, অসামাজিক কার্যক্রমে অবাধ অংশগ্রহণ এবং স্বাস্থ্যহানি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে।

যেকোনো গণমাধ্যমকে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে, তা পত্রিকা হোক, টিভি বা রেডিও হোক। একই সঙ্গে এসব গণমাধ্যম ও আজকাল দর্শক-শ্রোতা হারাচ্ছে। অনলাইনের জয়জয়কার অব্যাহত গতিতে চলছে, চলবেও। তাহলে মুদ্রিত সংবাদপত্রের ভবিষ্যৎ কী? এশিয়ার দেশগুলোতে এখনো মুদ্রিত সংবাদপত্রের ব্যবহার বিদ্যমান, একই সঙ্গে অনলাইনে পাঠকের সংখ্যা অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সহাবস্থান হয়তো আরও কয়েক বছর চলবে। অডিয়েন্সের এই মিশ্র আচরণ হয়তো গণমাধ্যম পেশাজীবীদের নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবে। কর্মরত সাংবাদিকেরা কনটেন্ট তৈরিতে নতুন থেকে নতুনতর বিষয়াবলি ও আঙ্গিকগত পরিবর্তন নিয়ে আবির্ভূত হবেন। শুধু ঘটনা বা ইভেন্ট কভার করে সাংবাদিকদের আর দিন চলবে না।

যিনি যত নতুন বিষয়কে নতুন করে তুলে ধরতে পারবেন কিংবা বিনোদনধর্মী বিষয়-আশয়কে প্রাধান্য দিয়ে পাঠক আকর্ষণ করতে পারবেন, তাঁদের জন্যই ভবিষ্যৎ। সংবাদপত্র হয়তো পাঠকদের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এক অনন্যসাধারণ ফোরাম হয়ে গড়ে উঠবে। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক ও আদর্শিকভাবে পাঠক সাধারণ একত্র হয়ে কণ্ঠস্বর উচ্চকিত করবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অনেক ক্ষেত্রে জনগণের অনাগ্রহ এমন অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে বলে একটি ধারা গড়ে উঠতে পারে। এটি আমার একান্তই নিজস্ব ভাবনা।

ভবিষ্যৎই এর জবাব দেবে। আবার এই ধারার সঙ্গে সামাজিক মাধ্যমের গভীর মেলবন্ধনও তৈরি হতে পারে। প্রতিটি সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের আজকাল অনলাইন ও সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে গভীর প্রণয় বা ভাব লক্ষ করা যায়।

একই সঙ্গে প্রযুক্তির সম্ভাবনা এবং ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনাচার যদি দ্বন্দ্বে পরিণত হয়, সে ক্ষেত্রে আপসরফা কীভাবে সম্ভব। ব্যক্তিমানসে এই দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত আমাদের বিচারমূলক (জাজমেন্টাল) পরিস্থিতি তৈরি করছে। আমরা এত বেশি প্রভাবিত হচ্ছি যে আমাদের নিজস্ব চিন্তাচেতনার বৈশিষ্ট্য লোপ পেতে চলেছে। যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভর সংস্কৃতির প্রভাবে মানব মনের সৃজনশীল কিংবা উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে।

এদিকে যন্ত্র ও প্রযুক্তিনির্ভরতা বৃদ্ধি ব্যতীত হ্রাস পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ‘ফিরিয়ে দাও আমার এই অরণ্য’ বলে চিৎকার শুধু প্রতিধ্বনিত হবে, এর বেশি কিছু প্রত্যাশা করে লাভ কী? সামাজিক মাধ্যম যে গতিতে এগোচ্ছে এবং নেট ব্যবহারকারীদের নেশাগ্রস্ত করে তুলছে, তাতে এর বিস্তার নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।

মানবজীবনের আচার-আচরণে কতখানি সময় প্রযুক্তি আর কতখানি সময় এর ব্যতিরেকে চলতে পারে, তার কোনো আদর্শিক মাপকাঠি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি।তবে এই দুটোর ভারসাম্য রক্ষা করে তার আদর্শিক সংমিশ্রণ মানবজীবনে জরুরি হয়ে পড়েছে। গতিময়তায়ও একরকম সংযম প্রয়োজন।

লেখক: সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    পঠিতসর্বশেষ

    এলাকার খবর

     
     

    বিজেপির অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্ন পূরণ হবে কি

    জ্বালানি-সংকট: সাময়িক সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত

    কয়েক ছত্র

    অলস দুপুরে কৃষকের আড্ডায়

    জীবন অগাধ

    বুদ্ধদেবের ফলস্টাফ

    গোড়ায় গলদ

    সিটি নির্বাচনে বিএনপির হার্ডলাইন কিসের ইঙ্গিত

    শ্যামপুর থেকে মাদক মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আটক

    সিটি নির্বাচন

    রাজশাহীতে কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার অভিযোগ

    খুলনা সিটি নির্বাচন: আ.লীগের বিরুদ্ধে মধুর অভিযোগ মুখে মুখে, বলছে প্রতিপক্ষরা 

    ইন্টারনেট ব্যবহারই ৮৬ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যার কারণ: সমীক্ষা

    ভাত দেওয়ার নাম নাই, কিল মারার গোঁসাই: পরিকল্পনামন্ত্রী

    রায়পুরে ছাত্রলীগের এক পক্ষের আনন্দ মিছিলে আরেক পক্ষের হামলার অভিযোগ