দীর্ঘ দুটি নতুন খাল খননের মাধ্যমে তিস্তায় আবারও পানি প্রত্যাহার করতে যাচ্ছে ভারত। তিস্তার এই একতরফা পানি প্রত্যাহারের অশুভ পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত। পরিকল্পনা অনুযায়ী গজলডোবা ব্যারাজ থেকে ৩২ কিলোমিটারের একটি দীর্ঘ খাল খনন করা হবে, যা তিস্তা এবং একই সঙ্গে জলঢাকা নদীর পানি কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবান্ধা পর্যন্ত নিয়ে যাবে। অপর খালটির দৈর্ঘ্য হবে ১৫ কিলোমিটার। এ খালটি তিস্তার বাঁ তীর থেকে খনন করে নিয়ে যাওয়া হবে। স্থানীয় কৃষিকাজে সহায়তার জন্য ৪ মার্চ থেকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের অধীনে এই দুটি খাল খননের কাজ শুরু করেছে ভারত। এই খাল খননের জন্য প্রায় এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। খাল খননের ফলে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং জলপাইগুড়ি জেলার লক্ষাধিক হেক্টর কৃষিজমি সেচের আওতায় আনতে সাহায্য করবে। ভারতের এই খাল খননের সিদ্ধান্তে আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে চলেছে তিস্তার পানিচুক্তি। ফলে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশে পানিপ্রবাহ আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
খাল কেটে শুধু পানি প্রত্যাহার নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার দার্জিলিং এলাকায় ‘বড়া রঙ্গিত’ নদীতে তিস্তা ড্যাম প্রকল্প-১ ও ২ স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ দুটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে যৌথভাবে ৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। যে বড়া রঙ্গিত নদীতে এই প্রকল্প দুটো নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই নদীটি তিস্তা নদীর যে অংশ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, সেই অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে এই দুটি প্রকল্প শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীতে পানির প্রবাহ আরও কমিয়ে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাতে বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। ভারত বছরের পর বছর তিস্তার পানিচুক্তি হবে, হচ্ছে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসা সত্ত্বেও, নীরবে,
নিঃশব্দে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজটিও পাশাপাশি এগিয়ে নিয়ে গেছে। খাল খননের জন্য যে বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন, সেই পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ এত সহজ ও স্বল্প সময়ের বিষয় নয়। তারা নিশ্চয়ই জমি অধিগ্রহণের কাজটি অনেক আগে থেকেই শুরু করেছে।
এ কারণেই হয়তো গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় তিস্তা চুক্তি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বন্ধুত্বের প্রতিদান যদি এই হয়, তাহলে পারস্পরিক আস্থার জায়গাটি থাকে কোথায়? ভারতের এ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশের মানুষকে আহত
করেছে নিঃসন্দেহে।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই দেনদরবার হয়ে আসছে। ২০১১ সালে চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সব আয়োজন সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। তার পর থেকেই এই চুক্তির ব্যাপারে ভারত টালবাহানা করে আসছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের অসহযোগিতার জন্য চুক্তি করা যাচ্ছে না বলে পাশ কাটিয়ে যায়। ভারতের এমন প্রবণতা বা কূটকৌশল অনেক আগে থেকেই লক্ষ করা গেছে।
দু-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। আমাদের দেশের উদারনীতির সুযোগে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অবাধ প্রচারব্যবস্থা চালু আছে। আমাদের দেশে ভারতের চ্যানেলগুলোর অবাধ প্রচারের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল ওপারে প্রচারের সুযোগ পাচ্ছে না। তারা বলে বেড়ায়, ভারতে বাংলাদেশের চ্যানেল প্রচারে সরকারের কোনো আপত্তি নেই; বরং আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও ওখানকার কেব্ল অপারেটরদের অসহযোগিতার জন্য তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের চ্যানেল মালিকপক্ষ তাদের কেব্ল অপারেটরদের সন্তুষ্ট করতে পারলে ভারতে প্রচারের প্রবেশাধিকার পাবে। এর জন্য আমাদের চ্যানেলগুলোকে তাদের অপারেটরদের বার্ষিক দুই থেকে তিন কোটি টাকা চাঁদা দিতে হবে। অথচ ভারতের শতাধিক চ্যানেল চালু থাকলেও এ জন্য তারা এক কানাকড়িও আমাদের কেব্ল অপারেটরদের দেয় না; বরং তাদের পে-চ্যানেলগুলোর জন্য আমাদের বার্ষিক ন্যূনতম দুই হাজার কোটি টাকা দিতে হয়।
আরও একটু পুরোনো দিনে যদি ফিরে যাই—বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের মে মাসে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি স্বাক্ষরের কত বছর পর তিনবিঘা করিডর ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার বাংলাদেশি নাগরিকেরা? চুক্তির পরপর চুক্তি অনুযায়ী আমাদের সংসদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে একই বছরের নভেম্বরে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতের কাছে হস্তান্তর করলেও ভারত সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করতে থাকে। তারা খুব কায়দা করে সম্পাদিত চুক্তির বিপক্ষে ভারতীয় দুটি উগ্র সংগঠনের জন্ম দেয়। সংগঠন দুটি হলো ‘ভারতীয় কুচলীবাড়ি সংগ্রাম সমিতি’ এবং ‘তিনবিঘা সংগ্রাম সমিতি’।
রাজনৈতিকভাবে ভারতীয় প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় এ সংগঠন দুটি চুক্তির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেয় এবং তিনবিঘা করিডর হস্তান্তর না করার জন্য আন্দোলন শুরু করে। আদালতে মামলার পর একে ‘বিচারিক বিষয়’ বলে ভারত চুক্তিটি সংসদে পাস না করে ঝুলিয়ে রাখে এবং বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ভোগায়। অতঃপর ১৯৯২ সালে আংশিক, পরে ২০১১ সালে তিনবিঘা করিডর সম্পূর্ণ খুলে দেওয়া হয়। তিস্তার চুক্তি নিয়েও একই অবস্থা, তবে ভিন্নরূপে। ‘পশ্চিমবঙ্গকে খেপিয়ে তিস্তার চুক্তি করা যাবে না’। অতএব এই চুক্তি আজও আলোর মুখ দেখেনি।
শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি আটকে রাখলেও বর্ষাকালে হঠাৎ পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে বড় বড় বন্যার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই অমানবিক আচরণের প্রতিবাদও আমরা দেখতে কিংবা শুনতে পাই না। রংপুর অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষ তিস্তার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। অথচ ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয় তিস্তাপারের মানুষকে। বর্ষায় আবার বন্যার পানির স্রোতে ভেসে যায় তাদের বাড়ি-ঘর, জমির ফসল, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি। বর্ষা মৌসুমের এই পানি ধরে রাখতে চীন সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণের কথা আমরা শুনে আসছি, তার বাস্তবায়নেরও কোনো লক্ষণ চোখে পড়ছে না। শোনা যায়, ভারতের আপত্তিতে এই মহাপরিকল্পনা বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নিজের এবং রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থ ও কল্যাণের জন্য যেকোনো কিছু করার অধিকার রাখে। সে বিষয়ে অন্য কারও আপত্তি ধোপে টেকে না। তাই বলে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে দেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে হেলাফেলা করা সাজে না। চীনের সহযোগিতায় তিস্তার এই মহাপরিকল্পনা তিস্তাপারের মানুষের মনে আশা জাগাচ্ছে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশের সীমানা থেকে শুরু করে তিস্তা-যমুনার মিলনস্থল পর্যন্ত, মোট ১১৫ কিলোমিটার খনন করে নদীর প্রস্থ ৭০০ থেকে ১ হাজার মিটারে সীমাবদ্ধ করা হবে। নদীর মাঝখানের গভীরতা বাড়ানো হবে ১০ মিটার। নদীর দুই পাড়ে ১০২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ করা হবে। নদীর খননকাজের মাটি ভরাট করে, দুই পাড়ে ১৭০ বর্গকিলোমিটার ভূমি উদ্ধার করে চাষাবাদের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা হবে এবং প্রতিবছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন হবে বলে আশা করা যাচ্ছ। পাশাপাশি নদীর দুই তীর বরাবর ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনের আন্তজেলা সড়ক নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি বর্ষাকালে ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দিলে তীব্র বেগে ধাবিত বিপুল উদ্বৃত্ত পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে নদীর উভয় পাশের এলাকার চাষযোগ্য জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা হবে। ফলে প্রায় ৬ লাখ হেক্টর জমি এই সেচব্যবস্থার আওতায় আসবে।
ভারত যে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি করবে না, তা এখন ধরেই নেওয়া যায়। চুক্তি করা তো দূরে থাক, উল্টো তিস্তার পানি প্রত্যাহারের নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। এ দেশের জনগণ ভারতের প্রতিশ্রুতিতে এত দিন অপেক্ষা করেছে। আর অপেক্ষা নয়। বাংলাদেশকে বিকল্প ব্যবস্থা নিতেই হবে। দেশের স্বার্থে, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সব বাধা অতিক্রম করে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য যেকোনো ব্যবস্থায় জনগণের সহযোগিতা পাওয়া যাবে। মনে রাখতে হবে, জনগণের শক্তি হলো সবচেয়ে বড় শক্তি। জনগণ যদি পাশে থাকে, তাহলে কোনো বাধাই বাধা নয়; বরং জনগণের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে যেকোনো অসাধ্য কাজ সহজেই করা সম্ভব। সঠিক সিদ্ধান্তে যদি অটল থাকা যায়, তাহলে তিস্তাপারের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃস্বপ্নের রাত একদিন কাটবেই।
লেখাটি শেষ করার পর সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি খবর নজরে এল, আমাদের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক তিস্তার পানি প্রত্যাহার বিষয়টি ‘অত্যন্ত উদ্বেগের’
বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে যৌথ নদী কমিশনের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে ভারতের কাছে বাংলাদেশ তথ্য চাইবে বলে মন্ত্রী জানিয়েছেন। আমাদের কথা হলো, চিঠি-চালাচালির মধ্যেই যেন তিস্তার পানি সমস্যা আটকে না থাকে। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী, দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত নদীর পানি কোনো দেশ যে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করতে পারে না, এটা ভারতকে বোঝানোর জন্য যা যা করণীয় তার সবই বাংলাদেশকে করতে হবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও কলামিস্ট
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে