Ajker Patrika

বিতর্ক বিশৃঙ্খলা অনিশ্চয়তায় ঘেরা জনজীবন

অরুণ কর্মকার
বিতর্ক বিশৃঙ্খলা অনিশ্চয়তায় ঘেরা জনজীবন

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে অনেকের মতো আমাকেও মাঝেমধ্যে ব্যাংকে যেতে হয়। আগে কাজ সেরেই বেরিয়ে আসতাম। বসে কথাবার্তা বলা হতো কম। আজকাল ব্যাংকে গিয়ে প্রথমেই বসে সময় নিয়ে কথাবার্তা বলি। ব্যাংকের অবস্থা, দেশের আর্থিক খাতের অবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি, আরও অনেকে একই বিষয়ে জানতে চান। ব্যাংকের কর্মকর্তারা সবাইকে মোটামুটি ইতিবাচক ধারণা দিয়ে খুশি মনে বিদায় দেওয়ার চেষ্টা করেন।

কিন্তু কোনো সাংবাদিককে অত সহজে বিদায় করা সম্ভব হবে না জেনেই হয়তো কিছু কথা বলেন। পরিস্থিতির কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও করেন। হয়তো ব্যাংক ও আর্থিক খাতের কিছু মৌলিক বিষয় জানতেও চান। তাঁদের সেই কথাবার্তা ও ব্যাখ্যায় আশা-নিরাশার দোলাচল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অনিশ্চিত পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যায়।

গণমাধ্যমের এক খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোতে আর্থিক খাতের দুর্বলতা থাকলেও কোনো ব্যাংক বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি হয়নি।’ না হলেই ভালো। আমরা উপদেষ্টা মহোদয়ের কথায় আস্থা রাখি। কিন্তু ইতিমধ্যে যা হয়েছে এবং যা অব্যাহতভাবে হয়ে চলেছে, তাকে কি কোনোভাবেই ভালো বলা যায়?

যেমন ধরুন খেলাপি ঋণ। দেশের প্রতিটি ব্যাংকের, বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের খেলাপি ঋণ বাড়তে বাড়তে এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ কারণে আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা ‘মুডিস ইনভেস্টর সার্ভিস’ আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর ঋণমানকে স্থিতিশীল থেকে সম্প্রতি নেতিবাচক পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ফলে আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে দেশের ব্যাংকগুলো অনেক বেশি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হবে। আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর জন্য ঋণসীমা কমিয়েও দিতে পারে।

ডলার সংকট ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্যে যে ভাটার টান সৃষ্টি করেছে, তার কোনো সুরাহা এখনো হয়নি। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের যে পরিস্থিতি ও পূর্বাভাস, তাতে অদূর ভবিষ্যতে এর সুরাহা হওয়ার সম্ভাবনাও কম। এই সব সংকটের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোতে, বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে অব্যাহত রয়েছে আইনকানুন, বিধিবিধান ব্যত্যয়ের দীর্ঘদিনের প্রবণতা। বহুল আলোচিত সব অনিয়ম ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। ফলে ব্যাংকব্যবস্থার ওপর আমানতকারীদের আস্থাহীনতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক ব্যাংকে কমছে মেয়াদি আমানতের পরিমাণ। সর্বোপরি, ব্যাংক ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আরোপিত নানাবিধ শর্ত এই খাতের ওপর আরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে।

ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এই বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতির বিরূপ পরোক্ষ প্রভাব জনজীবনেও ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করেছে। শ্রেণি-পেশা, সামাজিক অবস্থান-নির্বিশেষে কেউ এ থেকে মুক্ত নন। এর পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্য একপ্রকার সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

আজকাল যেকোনো পরিবেশে, বাজার-ঘাট, বাস-লঞ্চ—সর্বত্র দ্রব্যমূল্য একটি গণ-আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। কোনোভাবে কেউ একজন দ্রব্যমূল্যের কথা তুললেই আশপাশের সবাই যেন সেই আলোচনায় যোগ দেওয়ার জন্য হামলে পড়ছে। কিছুদিন আগেও এমনটি দেখা যেত না। এর অর্থ হলো মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমেই কঠিনতর হয়ে উঠছে। মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে।

এই সপ্তাহান্তেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। এ কারণে নির্ধারিত ও নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে দুশ্চিন্তা আরও বেশি। কারণ, আমাদের দেশে রমজান মাসে নিত্যপণ্যের মূল্য উচ্চতম শিখরে উঠে যায়। এর পেছনে যাদের কারসাজি থাকে, তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চেয়ে পাপমুক্ত হতে চায়। কিন্তু হতে পারে কী? পারলেও সমাজে ছড়িয়ে পড়া এই পাপ তাদের পরিজনদেরও যে চিরকালের জন্য কলুষিত করে, এটা তাদের বোধগম্য হয় না।

পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য না বাড়ানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু কায়েমি স্বার্থ কি কোনো দিন এসব আহ্বানে সাড়া দিয়েছে? নাকি কোনো কথা শুনেছে? ফলে সাধারণ মানুষ একপ্রকার ভয়ের মধ্যে আছে দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নিয়ে।

এ বছর রমজানে সরকারের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা। এবারের আরও বিশেষত্ব হলো রমজানের সঙ্গে সঙ্গেই 
শুরু হচ্ছে গ্রীষ্মকাল এবং বোরো মৌসুম। ফলে এ বছর এই সময় দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা হবে সর্বোচ্চ। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, এই সময় বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা হবে ১৬ হাজার মেগাওয়াট, যা এখন পর্যন্ত দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি।

চাহিদা অনুযায়ী এই বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ পরিকল্পনা করে কাজ করছে। তবে কতটা কী করতে পারবে, সে বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগও নিশ্চিত নয়। গত মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, পবিত্র রমজান, গ্রীষ্ম ও সেচের এই মৌসুমে বিদ্যুতের লোডশেডিং কতটা হবে, তা বলা যাচ্ছে না। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেইন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এ বছর এই মৌসুমে বিদ্যুতের লোডশেডিং হবে খুবই কম। এর কোনটা সঠিক, তা সময় এলেই দেখা যাবে। তবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হচ্ছে, রমজানে সাহ্‌রি ও ইফতারের সময় কোনো লোডশেডিং 
করা যাবে না।

এ কথা সত্য যে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামের অস্থিরতা কমছে। সব ধরনের জ্বালানির দাম কমার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে সরকার এলএনজি আমদানি বাড়িয়েছে। এ মাসেই, আর কয়েক দিনের মধ্যে ভারতের নূমালিগড় থেকে বাংলাদেশের পার্বতীপুর পর্যন্ত স্থাপিত পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আমদানি শুরু হবে। এই ডিজেল উত্তরবঙ্গে বোরো চাষে সেচের জন্য ব্যবহার সাশ্রয়ী ও সহজ করে তুলবে।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোও এ সময় নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট পূর্ণ ক্ষমতায় চলবে। সেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট থেকে ৬০০ মেগাওয়াট পাওয়ার কথা। চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও দৈনিক ৪০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা। বড়পুকুরিয়া কেন্দ্রের প্রায় ৩০০ মেগাওয়াট তো রয়েছেই। সর্বোপরি ভারতের ঝাড়খন্ড থেকে আদানি গ্রুপের কেন্দ্র থেকেও দৈনিক অন্তত ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা, যা পরীক্ষামূলকভাবে সীমিত পরিমাণে আসতে শুরু করেছে। চলতি মাসের শেষ নাগাদ সেখান থেকে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যাবে বলে সরকার আশা করছে।

কয়লাভিত্তিক এই ৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের সঙ্গে তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার এবং গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলো থেকে ৬ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণে জ্বালানি তেল এবং এলএনজি আমদানি খাতে ডলারের সংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই কেবল ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এর পরের চ্যালেঞ্জ হবে পুরো মৌসুমে সঞ্চালন ও বিতরণব্যবস্থা সুষ্ঠু রাখা। এই সব চ্যালেঞ্জের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেও অনিশ্চয়তা রয়েছে।

এই যেসব অনিশ্চয়তা এবং বিশৃঙ্খলা এগুলো নিয়ে দেশজুড়ে চলছে তর্ক-বিতর্ক। সরকারের নীতি এবং কাজ এই তর্ক-বিতর্কের বিষয়। এ ছাড়া বিতর্ক চলছে রাজনীতির ক্ষেত্রে। ধারণা করা যায়, পবিত্র রমজান মাসে দেশের রাজনীতি তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ঘুরপাক খাবে। সব সময় তা-ই হয়। কারণ, এ সময় বিক্ষোভ সমাবেশের মতো কোনো কর্মসূচি পালন করা কঠিন।

তো সে তর্ক-বিতর্ক চলুক। তার মধ্য দিয়ে রাজনীতি শাণিত হয়ে উঠুক। নির্বাচনমুখী হোক। আর রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের বিশৃঙ্খলা, জনজীবনের অনিশ্চয়তাও রাজনৈতিক বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে উঠুক।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...