বাগেরহাটের মোল্লাহাটে চোর সন্দেহে এক ব্যক্তিকে নির্যাতনের ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ বুধবার সকালে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর বড় ভাই বাদী হয়ে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৩-৪ জনকে আসামি করে মোল্লাহাট থানায় মামলা দায়ের করেন। এর আগে ওই ব্যক্তিকে নির্যাতনের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভুক্তভোগী ওই ব্যাক্তির নাম মনিরুজ্জামান (৪২)। তিনি উপজেলার পূর্ব দারিয়ালা গ্রামের প্রয়াত ইসলাম শেখের ছেলে। ভূমিহীন হওয়াতে গাংনী মাতারচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে সরকারের দেওয়া একটি ঘরে থাকেন তিনি।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন—মোল্লাহাট উপজেলার ঘোষগাতি এলাকার হেকমত শেখের ছেলে আরিফুল শেখ (২৬), আব্দুল হালিম শেখের ছেলে আব্দুল গনি শেখ (৩৫), আহমদ শেখের ছেলে আলমাস শেখ (২৭), নগরকান্দি এলাকার সিদ্দিক শেখের ছেলে মাহমুদ শেখ (২৮), লায়েক শেখের ছেলে আকাশ শেখ (২৭)। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে সোপর্দের প্রস্তুতি চলছে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার মোল্লাহাট উপজেলা পশু হাসপাতালে ছাগলের চিকিৎসা করে বাড়ি ফিরছিলেন দিনমজুর শেখ মনিরুজ্জামান। তিনি ঘোষগাতি এলাকায় মোবারকের দোকানের সামনে পৌঁছালে কিছু লোক তাঁর পথ আটকে বেধড়ক মারধর করে। লোহার রড ও বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাঁকে গুরুতর আহত করে। মনিরুজ্জামান চিৎকার করলে তাঁদের নির্যাতনের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। নির্যাতনকারীরা মারধর ও মনিরুজ্জামানের চিৎকারের ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তীতে নির্যাতনের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করে দেন। এ নির্যাতনের দুটি ভিডিও রয়েছে ফেসবুকে।
ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মনিরুজ্জামানকে ভ্যান থেকে নামিয়ে ছাগল চোর আখ্যা দিয়ে একটি গামছা দিয়ে দুই হাত বাঁধছেন এক ব্যক্তি। পরে আরও কয়েকজন এসে লাঠি দিয়ে মারতে মারতে তাঁকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেন। এ সময় মনিরুজ্জামান বারবার কাঁদতে কাঁদতে ‘আমি চোর না’ বলে আকুতি জানাতে থাকেন। কেউ তাঁর কথা না শুনে মারতে থাকেন। পরে কয়েকজন এসে তাঁর পাও বেঁধে দেয়।
অপর একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, মনিরুজ্জামানকে আরও নির্মমভাবে আঘাত করা হচ্ছে। বাঁধা অবস্থায় হাত, পা ও পিঠে আঘাত করতে করতে একজন হাঁপিয়ে গেলে আরেকজন এসে পেটাচ্ছেন। মার খেতে খেতে মনিরুজ্জামান জ্ঞান হারিয়ে ফেরার পরও তাঁকে মারতে থাকেন নির্যাতনকারীরা। পরে জ্ঞান ফিরলে কয়েকজন জড়ো হয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তখন ছাগল চুরির পাশাপাশি এলাকায় গরুর চুরির ঘটনায়ও তাঁকে অভিযুক্ত করতে শোনা যায়।
আহত শেখ মনিরুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘একটা ছাগলের বাচ্চা নিয়ে আমি আর আমার এক চাচা জাহিদ গেছিলাম মোল্লাহাট পশু হাসপাতালে।
সেখান থেকে ট্রিটমেন্ট করায়ে ফিরে যাওয়ার সময় ছাগলের মালিক জাহিদ চাচাকে রানিং (ভ্যান চলন্ত) অবস্থায় একটা বাড়ি দেয়। ওই বাজারের ওখানে কয়েকজন আগে থেকে দাঁড়ানো ছিল। পরে আরও লোক জড়ো হয়। বাড়ি দিলে সে (জাহিদ) দৌড় দেয়। তখন তাঁরা বলে সে চুরি করে নিয়ে পলাচ্ছে। পরে লোকজন জড়ো হয়ে আমারে মারধর করে।’
মনিরুজ্জামান আরও বলেন, ‘আমি কাজ করি। আমাকে মিথ্যা চোরের অভিযোগ দিয়ে প্রচুর মারিছে। মারতি মারতি অনেকগুলো লাঠি ভাঙিছে আমার গায়। আমি জ্ঞান হারায় ফেলে ছিলাম। সেখানে লোক ছিল প্রচুর, প্রায় ৪০-৫০ জন। কিন্তু মারছে তিন চারজনে। সবাইরে চিনি না। আমি বারে বারে হাতে পায়ে ধরে বলিছি, আমারে মারার আগে একটু যাচাই করে নেও। আমি চোর না, কেউ কোনো কতাই শুনি নি। আমারে শুধু শুধু মারিছে।’
মোল্লাহাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) নাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গণপিটুনির শিকার এক ব্যক্তিকে গত শনিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর শরীরজুড়ে আঘাতের চিহ্ন আছে। তবে কোথাও ক্ষত নেই, সবই ব্লাংক উইপেনের (লাঠিজাতীয় কিছু) আঘাত। উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার তাঁকে গোপালগঞ্জ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে।’
এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলা পুলিশের মিডিয়া সেলের প্রধান সমন্বয়কারী পুলিশ পরিদর্শক এস এম আশরাফুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দিনমজুরকে নির্যাতনের মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে