Alexa
বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩

সেকশন

epaper
 

বাংলাদেশ নামকরণের পক্ষে ও বিপক্ষে

ভবিষ্যতের বাংলাকে বাংলাদেশ নামকরণ নিয়ে মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল। পাকিস্তানপন্থীদের কাছ থেকে নয়, তারা তো তখন অপ্রাসঙ্গিকই হয়ে গিয়েছিল; স্বাধীনতাপন্থীদের কাছ থেকেই। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ নামকরণে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অবিচার করা হবে।

আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৩, ১৪:৩৭

বাংলাদেশ নামকরণের পক্ষে ও বিপক্ষে পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের পার্থক্যটা অবশ্য অনেক পুরোনো, কিন্তু পূর্ববঙ্গের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান হওয়াটা শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকে লাহোর প্রস্তাব গ্রহণের পর থেকে। কলকাতায় তরুণ মুসলিম সাহিত্যসেবীদের উৎসাহে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয় ১৯৪২ সালে। কলকাতা শহরে তাঁরা একটি সাহিত্য সম্মেলনও করে, যাতে স্বতন্ত্র পাকিস্তানবাদী সাহিত্য সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের কয়েকজন মিলে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান ওই বছরই। ‘পাকিস্তান’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকাও তারা প্রকাশ শুরু করে।

দৈনিক আজাদ ও মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকা পাকিস্তান এবং এর পূর্বাঞ্চলে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা জোরেশোরে বলত। আজাদ-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভের ওপরে একটি মানচিত্রও ছাপা হতো, ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে দুটি পাকিস্তান দেখিয়ে। তবে পাকিস্তানের জন্মের পরে কিছুদিন পূর্ব পাকিস্তান নয়, সর্বত্র পাকিস্তান নামের জয়জয়কার চলতে থাকে। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিল তমদ্দুন মজলিশ সংগঠনটি, (এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর) তারাও নিজেদের নাম রেখেছিল ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিশ’। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরে এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক ছাত্রসংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন তারও নাম প্রথমে ছিল ‘পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’, পরে অক্টোবরে এসে সংশোধন করে নাম করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’। তবে ১৪ আগস্টের সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি কাগজপত্রে পূর্ববঙ্গ যে পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেছে তা নয়, আইনসভার নাম পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদই ছিল; দাপ্তরিক কাগজপত্রেও প্রথমে পূর্ববঙ্গই লেখা হতো। তরুণ নাজির আহমদের লেখা পাকিস্তানবিষয়ক যে গানটি রেডিওতে গাওয়া হতো এবং যেটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, তাতে পশ্চিমের ‘ধূসর মরু সাহারা’র পাশে ‘পূর্ব বাংলার শ্যামলিমা’র গুণ-বন্দনাও করা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ববঙ্গ পুরোপুরি পূর্ব পাকিস্তানের পোশাক পরে ১৯৫৬ সালে, সংবিধান প্রণয়নের সময়ে। পাকিস্তানের অন্তর্গত সেই পূর্ব পাকিস্তান যখন স্বাধীনতার অভিমুখে এগোচ্ছিল, স্বভাবতই তখন প্রশ্ন উঠেছিল এর নতুন নাম কী হবে? ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীর এক অনুষ্ঠানে পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ হবে বলে উল্লেখ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’-এর এক ইশতেহার পাঠ করা হয়, যাতে স্বাধীন পূর্ববঙ্গের নাম কী হবে, সেটা নিশ্চিত হয়ে যায়। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনরা যে তাঁদের স্বপ্নের পূর্ববঙ্গের নাম ‘বাংলাদেশ’ হবে ঠিক করেছিলেন, সেটাও আমরা লক্ষ করেছি।

ভবিষ্যতের বাংলাকে বাংলাদেশ নামকরণ নিয়ে অবশ্য মৃদু গুঞ্জন উঠেছিল। পাকিস্তানপন্থীদের কাছ থেকে নয়, তারা তো তখন অপ্রাসঙ্গিকই হয়ে গিয়েছিল; স্বাধীনতাপন্থীদের কাছ থেকেই। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশ নামকরণে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ বাংলাদেশ তো কেবল পূর্ববঙ্গের নয়, পশ্চিমবঙ্গেরও। আপত্তিটা ছিল জাতীয়তাবাদের উগ্রতার প্রকাশ নিয়েও। এই আপত্তি কিন্তু একাত্তরের মার্চে যাঁরা ‘স্বাধীনতার’ ইশতেহার পড়েছিলেন তাঁরাও, ১৬ মাস পরে ১৯৭২ সালে ২১ জুলাই তারিখে, ওই পল্টন ময়দানেই তুলেছিলেন। তখন তাঁরা অবশ্য বিদ্রোহী হয়েছিলেন। একাত্তরে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাজাহান সিরাজ ছিলেন স্বাধীনতার ইশতেহারের পাঠক, স্বাধীনতা যখন সদ্য অর্জিত হয়েছে, তখন তিনিই ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবেই তাঁর সম্পাদকীয় রিপোর্টে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘জাতীয়তাবাদ বলতে যেখানে বাঙালির বাঙালিত্বই বোঝায়, সেখানে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জন্য কী ব্যবস্থা?’ একাত্তরে পঠিত স্বাধীনতার ইশতেহারের একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছিল। বাহাত্তরে পঠিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টে ওই প্রস্তাবকেই বুঝি-বা ‘অপ্রিয়’ সত্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সেটা এসেছিল এভাবে, ‘এ দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতা কোনো আন্দোলনের জন্ম বা নেতৃত্ব দেয়নি; বরং জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘‘নেতা’’ সৃষ্টি হয়েছে।’ উল্লেখ্য, একাত্তরে তারা স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনের লক্ষ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করেছিল, ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম ‘‘বাংলাদেশ’’ গঠন করে’, ‘পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি’ সৃষ্টি করাকে। বাহাত্তরে এসে, বিদ্রোহীবেশে, ‘পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের জন্য কী ব্যবস্থা’—এ প্রশ্নটি ‘বিদ্রোহী’রা তুলেছিলেন বটে, কিন্তু সেটিকে যে তাঁরা খুব একটা গুরুত্ব দিয়েছেন, তা নয়। অনেক বছর পরে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ওই বিদ্রোহীদের দলনেতা সিরাজুল আলম খান বলেছেন, ‘আজকে পৃথিবীব্যাপী বাঙালিরা ছড়িয়ে আছে। কম-বেশি সব দেশেই আমাদের অবস্থান রয়েছে। কিন্তু বাঙালির দেশ একটিই—সে হলো বাঙালির এই ‘‘জাতি রাষ্ট্র’’ বাংলাদেশ।’ বলা বাহুল্য, বাংলাদেশ একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাই বলে এটি যে একটি জাতিরাষ্ট্র তা নয়; বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর ওই যে দাবি, ‘বাঙালির দেশ একটিই—বাংলাদেশ’, ওই দাবি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মোটেই সন্তুষ্ট করে না; বরং যখন এটা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়েছে যে হিন্দি বলয়ের কেন্দ্রীয় শাসনে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বেশ ভালোভাবেই বিপন্ন এবং আত্মরক্ষার আবশ্যকতাতে অধুনা যখন তাঁরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতেও বাধ্য হচ্ছেন। মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গের যে বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে মনেপ্রাণে সমর্থন জানিয়েছেন, যতভাবে পারা যায় তাকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের কাউকে কাউকে বলতে শোনা গেছে যে পূর্ববঙ্গের মানুষকে বাংলাদেশ নামটা নিয়ে নেওয়ার দরুন তাঁরা বঞ্চিত বোধ করেছেন। ঢাকায় সফরে এসে কেউ কেউ সেটা বলেছেনও। পরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রস্তাব গৃহীত হয় যে পশ্চিমবঙ্গের নাম বাংলা (ইংরেজিতে বেঙ্গল) করা হোক; সেই প্রস্তাব কেন্দ্রীয় বিধায়কেরা মানতে রাজি হননি। যুদ্ধের একেবারে শুরুর দিকে তাজউদ্দীন আহমদ যখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দিল্লিতে সাক্ষাৎ করেন, তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন যে ‘বাংলাদেশ’ বলতে তাঁরা পূর্ববঙ্গকেই বোঝেন, তার বেশি নয়। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত জাতীয় পতাকায় লালবৃত্তের ভেতরে যে বাংলাদেশের মানচিত্রটি রাখা ছিল, সেই তথ্যের উল্লেখ তাঁর বক্তব্যকে জোরদার করেছিল। রাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’ দেওয়ার ব্যাপারে পূর্ববঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশেরও যে আপত্তি ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একাত্তরের যুদ্ধে পূর্বাপর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ডা. কালিদাস বৈদ্যের এক লেখায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়েই তাঁর বক্তব্য ছিল এ রকমের: ‘ভারতের খেয়ে-পরে ও ভারতের সাহায্যের সব রকমের আশ্বাস পেয়ে তাঁরা (অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের মানুষেরা) তাঁদের দেশের নাম বাংলাদেশ ঘোষণা করল। সে নামের স্বীকৃতিও ভারত সরকার দিল। একটা অংশ হয়ে গেল সম্পূর্ণ। কেননা, পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়েই প্রকৃত বাংলাদেশ। [...] এই বাংলাদেশের নামের স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও বাস্তবপক্ষে কাগজে-কলমে তারা পশ্চিমবঙ্গকে বিনা যুদ্ধে কেড়ে নিল। আর বাংলা ভাষায় একমাত্র অধিকারী তারাই হলো।’

লাহোর প্রস্তাবের থাকা না-থাকার বিষয়টি স্মরণ করা যেতে পারে। যুক্তফ্রন্টের একুশ দফা এবং শেখ মুজিবের ছয় দফায় লাহোর প্রস্তাব ভালোভাবেই উপস্থিত; ভাসানী ন্যাপের চৌদ্দ দফার ভেতরেও লাহোর প্রস্তাবের স্বায়ত্তশাসনের ধারণা কার্যকর। ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঘোষিত সংগ্রামী ছাত্রসমাজের এগারো দফায় কিন্তু লাহোর প্রস্তাবের কথা আর আসেনি। ওই সময়ে সামরিক সরকারের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত ছাত্ররা লাহোর প্রস্তাবকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করানো আর প্রয়োজন মনে করেননি। তা ছাড়া, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটাকেই হয়তোবা তাঁদের কাছে যুক্তিযুক্তই মনে হয়নি; তাঁদের আকাঙ্ক্ষা তখন স্বাধীনতার। এ ক্ষেত্রে অধিক যাঁরা অগ্রসর তাঁদের স্বপ্ন সমাজতন্ত্রের, তাঁদের পক্ষে লাহোর প্রস্তাব আরও বেশি অপ্রাসঙ্গিক।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    সুষম সার বিষয়ে কতটা সচেতন কৃষক

    ফুকুওকার ফ্লাইট থেকে ফরিদগঞ্জের মাইক

    অযৌক্তিক প্রত্যাশার বলি

    ‘নিশ্চয়ই পার্ট চাইতে এসেছে!’

    বিশুদ্ধ পানি নেই যেখানে

    সাকিব হতে পারতেন রোল মডেল

    স্বর্ণের দাম এক লাফে সাড়ে ৭ হাজার টাকা বাড়ানোর পর কমল ১১০০

    ভাস্কর শামীম শিকদার আর নেই

    ১২ দফা নিয়ে আলোচনার আশ্বাস

    র‍্যাপার ব্যাড বানির বিরুদ্ধে ৪০ মিলিয়ন ডলারের মামলা করল তাঁর প্রাক্তন

    সিঙ্গারের ফ্রি এসি ক্লিনিং সার্ভিস আবারও চালু 

    বাঁশখালীতে হরিণ শিকারের পর জবাই, ৫ জনের কারাদণ্ড