বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খবরটি এতটুকু গুরুত্ব না পেলেও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম শুধু ফলাও করে প্রচার করেই থেমে থাকেনি, প্রভাবশালী এক মার্কিন সংবাদপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে দুনিয়াকাঁপানো সংবাদ হিসেবে। সংবাদটি হলো, চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরান কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। এমন এক সময়ে সমঝোতাটি হলো, যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের (কার্যত ন্যাটো-রাশিয়া ছায়াযুদ্ধ) প্রভাবে সারা বিশ্বের মানুষ এক মারাত্মক সংকটকাল পাড়ি দিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দুনিয়ার কাছে সংবাদটির গুরুত্ব আদৌ এ কারণে নয়। তাদের মাথাব্যথাটা অন্য কারণে। কয়েক দশকের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ দুটি কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে একমত হয়েছে এমন এক দেশের মধ্যস্থতায়, এতকাল ওই অঞ্চলে যে দেশটির ভূমিকা ছিল একেবারেই গৌণ।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধ সম্প্রতি অনেকটা নাটকীয় মোড় নিয়েছে। ইউক্রেনের বাখমুত পতনের ক্ষণ গণনায় ব্যস্ত খোদ পশ্চিমা সমরবিদ ও রাজনীতিকেরা। এমন পরিস্থিতিতে গত শুক্রবার ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে দুই দেশের (সৌদি আরব ও ইরান) আলোচনায় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে। বাস্তবে আলোচনা হয়েছে তিন দেশের মধ্যে। চীন ছিল মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায়। আর এ বিষয়টিই যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার বড় কারণ। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রভাব
বিস্তার করে আছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে তাদের নাকের ডগায় চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদির কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ঐকমত্যে পৌঁছানোর বিষয়টি মার্কিন কর্মকর্তাদের অস্বস্তিতে ফেলবে—এটাই স্বাভাবিক।
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে হওয়া চুক্তিতে চীনের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিই ওয়াশিংটনের জন্য উদ্বেগের। ঘটনাটি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক কাভারেজ পাওয়ারও এটাই মূল কারণ। রয়টার্সের প্রতিবেদন মতে, বেইজিংয়ে চার দিনের গোপন আলোচনার পর মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এই চুক্তি হয়েছে।
বেইজিংয়ে বৈঠক শেষে সমঝোতার বিষয়ে ঘোষণা দেন সৌদি আরবের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মুসাদ বিন মোহাম্মদ আল আইবান এবং ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান আলী শামখানি। ওই সময় তাঁদের সঙ্গে ছিলেন চীনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির সেন্ট্রাল ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিশনের পরিচালক ওয়াং ই। সেদিনই সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তিন দেশের আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে সৌদি আরব ও ইরান। ইরানের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আইআরএনএর প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরব ও ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধানেরা চীনে এক বৈঠকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে উভয় দেশে পুনরায় দূতাবাস চালু করা হবে। ওই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিশ্বনেতারা। তবে ‘সতর্ক ভাষায়’ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন ও ইরানের বৈরী দেশ যুক্তরাষ্ট্র। শুক্রবারই হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অবগত আছে। আমরা ইয়েমেনে যুদ্ধের অবসান এবং মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমানোর যেকোনো প্রয়াসকে স্বাগত জানাই। ওই অঞ্চলে সফরে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বছর এ বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছিলেন।’ হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জন করবি ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘সতর্ক ভাষায়’ স্বাগত জানালেও এই চুক্তি টিকবে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন। জন কিরবি বলেছেন, ‘ইরান তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করবে কি না, সেটা দেখতে হবে।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, বেশির ভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের মধ্যস্থতায় ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতা ওয়াশিংটনে মারাত্মক অস্বস্তি তৈরি করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টারাও একান্ত আলোচনায় বলছেন, এই সমঝোতা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ভূমিকা ক্ষুণ্ন হওয়ার ইঙ্গিতবহ। মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
হোয়াইট হাউসের বিবৃতির সূত্র ধরে এখানে বলা প্রয়োজন, ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত আছে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনী। সৌদি-ইরান চুক্তি কার্যকর হলে তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচির লাগাম টানার পাশাপাশি ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।
১৯৭৯ সালে ইরানে শাহের শাসন উচ্ছেদ করে খোমেনির নেতৃত্বে নতুন ইসলামি রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ২০১৫ সাল পর্যন্ত পুরোপুরি শত্রুতার পর্যায়ে ছিল। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ঘিরে দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সম্পর্ক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পর্যায়ে উপনীত হয়। ইরান বারবার বলে আসছে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে। তা সত্ত্বেও পারমাণবিক বোমা তৈরির অজুহাত তুলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ কঠোরতর করে। সেই সঙ্গে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় তাদের সঙ্গে আলোচনাও অব্যাহত রাখে। এর আগে সাদ্দাম জামানায় ইরাকের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন বারবার অভিযোগ তুলছিল যে দেশটির কাছে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র আছে। ওই অজুহাতে তারা ইরাকে আগ্রাসনও চালায়। কিন্তু সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ইরাকে তেমন কিছুর হদিস বের করতে পারেনি ইঙ্গ-মার্কিন সেনারা।
বেইজিং থেকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন প্রথম এল, সেটি ওয়াশিংটনে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং শঙ্কা তৈরি করে। এর মূল কারণ অবশ্য ইরান-সৌদি আরব সমঝোতা নয়, তাদের অস্বস্তি এবং শঙ্কার মূল কারণ এই সমঝোতায় চীনের ভূমিকা। মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে সব ধরনের সংঘাতে রেফারির ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের সেই প্রভাব বলয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন যেভাবে ঢুকে পড়ছে, সেটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য মারাত্মক শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে কিছুদিন ধরে মারাত্মক টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের এই ভূমিকাকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন একাধিপত্যের প্রতি আরেকটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে গণ্য করছেন কেউ কেউ। যুক্তরাষ্ট্রেরই একজন সাবেক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো জেফরি ফেল্টম্যানের ভাষায়, বেইজিংয়ের এই ভূমিকাকে বাইডেন প্রশাসনের ‘গালে চপেটাঘাত’ হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব রাজনীতিতে এটা চীনের ক্ষমতায় আসার প্রমাণ।
বহু বছর ধরেই চীনের পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম ঘোষিত স্তম্ভ ছিল ‘অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের পররাষ্ট্রনীতিতে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘাতে তাদের সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করতে দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ড্যানিয়েল রাসেল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ইরান এবং সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ওয়াশিংটনের জন্য সেটির অনেক তাৎপর্য রয়েছে। তিনি বলেন, যে সংঘাতে চীন কোনো পক্ষ নয়, সেখানে
নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এভাবে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। এ ধরনের মধ্যস্থতায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্ব বলয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণুতার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, ‘কোনো লুকোছাপা না করে বেইজিং যে বার্তাটা এখানে দিতে চাইছে তা হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক শক্তির বিপরীতে চীন এক উদীয়মান ও শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে উপস্থিত হতে চাইছে।’
ওয়াশিংটনভিত্তিক নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ডিফেন্স অব ডেমোক্রেসির প্রধান নির্বাহী মার্ক ডুবউয়িৎস নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, এই ঘটনা (ইরান-সৌদি সমঝোতা) ‘আমেরিকান স্বার্থের জন্য হানিকর, হানিকর, হানিকর’। তিনি আরও বলেন, এর থেকে এটা স্পষ্ট যে সৌদিরা আর ওয়াশিংটনের ওপর আস্থা রাখছে না।
আজাদুর রহমান চন্দন, সাংবাদিক
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে