এক বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত রাজায় রাজায় যে লড়াই আরম্ভ হয়েছিল, তা থামার কোনো লক্ষণ দেখছি না। উলুখাগড়ার এখন আর প্রাণান্ত নয়, উলুখাগড়ার মূল উৎপাটন চলছে। উলুখাগড়ার নেতা, উপনেতা ও পাতি নেতারা এখনো বুঝতে সক্ষম হয়নি যে এটা রাজাদের খেলা,
তারা সমূলে বিনাশ হয়ে যাবে।
আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন, আমি রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কথা বলছি। এক বছর ১৫ দিন যাবৎ তুমুল লড়াই চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বাহিনীদের মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তি ন্যাটো জোটের অনুমান ছিল কিছুদিনের মধ্যেই রাশিয়া তার সব শক্তি নিঃশেষ করে ফেলবে আর তাদের জয় অপরিহার্য হয়ে যাবে। আপনাদের সবার মনে আছে, এক সপ্তাহ আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, রাশিয়ার গোলাবারুদ শেষের পথে এবং রাশিয়ান বাহিনী আত্মসমর্পণ করল বলে। এমন ভাবসাব দেখাল যেন ইউক্রেনে তারা জিতে গেছে। এ রকম কথা বলার পরে গত চার দিন আগে রাশিয়া বাখমুত শহর দখল করে নিল। বাখমুত হলো ৯০ হাজার লোকসংখ্যা-অধ্যুষিত ছোট্ট শহর। কিন্তু কৌশলগত কারণে এ শহরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ উভয় পক্ষের জন্য। ইউক্রেন যদি পূর্ব ইউরোপ দখলে রাখতে চায় তাহলে এ শহরটি হলো তার প্রবেশদ্বার। রাশিয়া যদি তার সরাসরি ভূখণ্ড থেকে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সড়কপথে যোগাযোগ স্থাপন করতে চায়, তাহলে এ শহরটি তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
এখন রাশিয়া এ শহরটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে তার ওয়াগনার বাহিনী দ্বারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পেলাম এই শহর থেকে ইউক্রেনের সৈন্যদের মৃতদেহ ট্রাকে করে তাদের মূল ভূখণ্ডে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এই দৃশ্য দেখে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়বে অবশ্যই।
ইউক্রেনের পার্শ্ববর্তী একটি রাশিয়ান ছোট শহরে ইউক্রেনীয় বাহিনী আক্রমণ করেছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া ৯ মার্চ শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুতগামী হাইপারসনিক কিনজাল মিসাইল আক্রমণ করেছে কিয়েভ, খারকিভ, ওডেসা, জাপোরোঝিয়াসহ অন্যান্য শহরে। এসব শহর এখন বিদ্যুৎ ও পানিবিহীন অবস্থায় আছে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে। বাখমুতের ৯০ হাজার বাসিন্দার মধ্যে এখন সেখানে আছে মাত্র পাঁচ হাজার। এই পাঁচ হাজার অধিবাসীর অবস্থা খুবই বিপজ্জনক। তারাও চাইছে শহরটি ছেড়ে যেতে, কিন্তু কোনো করিডর পাচ্ছে না।
কিছুদিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্নেল, যিনি এখন ব্যাংককে আছেন, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, কয়েক দশক ধরে রাশিয়াকে ভাঙার পরিকল্পনা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো অজুহাত পাচ্ছিল না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন সময় একটি কৌশলগত ক্ষেত্র পেয়ে গেল, এই ইউক্রেনকে সামনে রেখে তার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার। এখনো সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এই যুদ্ধে রাশিয়াকে হারানো সম্ভব কি? আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি কোনোক্রমেই রাশিয়া এখান থেকে পিছপা হবে না, এটা রাশিয়ার অস্তিত্বের প্রশ্ন। ইউক্রেন ও ন্যাটো জোট এটা কেন বুঝতে পারছে না, তা সাধারণ বোদ্ধাদের বোধগম্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঠিকই বুঝতে পেরেছে এই যুদ্ধে রাশিয়া পরাজিত হবে না, তাই সে মাঝেমধ্যে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলে। সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর প্রচণ্ড বেগে আঘাত হানে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করছে। রাশিয়াকে দুর্বল করছে আর গোটা পশ্চিম ইউরোপকে তার অনুগত রাষ্ট্রে পরিণত করছে।
কিছুদিন আগে সুইজারল্যান্ডের একটি পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পোপ বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়া একা দায়ী নয়, আরও কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এর জন্য দায়ী। এ কথার অর্থ দাঁড়ায়, এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ অবশ্যই এর জন্য দায়ী। পোপ আরও বলেছেন, তিনি যেকোনো মধ্যস্থতার জন্য প্রস্তুত আছেন। আমার তো মনে হয় এখনই উপযুক্ত সময়, উভয় পক্ষ পোপকে সামনে রেখে ন্যাটো জোট ও রাশিয়া আলোচনা চালিয়ে যেতে পারে। এ কথা মনে রেখে যে এই যুদ্ধে কেউই জিতবে না!
অবস্থা দেখে মনে হয় রাশিয়া এখন শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ গতিসম্পন্ন সুপারসনিক কিনজাল মিসাইল ব্যবহার করছে। যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো আরও উসকানি দেয়, রাশিয়ার ওপর আরও স্যাংশন আরোপ করে, তাহলে এর পরিণতি কী হবে, সেটা বুঝতে পারছে না।
এ রকম যদি উসকানির পর উসকানি এবং স্যাংশনের পর স্যাংশন দিতে থাকে, তাহলে রাশিয়া একসময় তার নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য হবে। এই নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করার আগের নমুনা এই সুপারসনিক কিনজাল মিসাইল। এখন সবার মনে প্রশ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি সত্যি সত্যি চায় রাশিয়া নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করুক?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা উদ্দেশ্য আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সে নিউক্লিয়ার বোমা ব্যবহার করেছিল জাপানে, যার কারণে তারা সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত নিন্দিত। এর বদলা হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কৌশলে রাশিয়াকে দিয়ে এই অস্ত্র ব্যবহার করাবে ইউক্রেনে। এটা অনুধাবন করা স্বাভাবিক নয় কি?
বিশ্বের আপামর শান্তিকামী মানুষের এক জোট হয়ে বলা উচিত, সবাই আপনারা আলোচনায় বসেন, যুদ্ধ কোনো দিন কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। বন্ধ হোক এ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ।
এখনো ইউক্রেনে প্রায় ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী রাশিয়ান বংশোদ্ভূত। অতএব এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ ভাই ভাইকে বিনাশ করার সমান মনে হয়। আমার ধারণা, রাশিয়া এখনো সহ্য করে যাচ্ছে, তার নিজের ভাইদের ওপরে, স্বজাতিদের ওপরে নিউক্লিয়ার অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইছে না।
তবে যদি দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন কিন্তু কিছু করার উপায় থাকবে না। এটা পশ্চিমারা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, পৃথিবীর সব মানুষের জন্য তত তাড়াতাড়ি মঙ্গল বয়ে আনবে।
আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে