আজকের পত্রিকা: আপনি এবার কত দিন পর দেশে এলেন?
সেলিম জাহান: এবার বছরখানেক পর দেশে এসেছি।
আজকের পত্রিকা: এক বছরে দেশে বিশেষ কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছেন?
সেলিম জাহান: এক বছরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ করছি। যেমন আবাসন প্রকল্প এবং অনেক জায়গায় ইমারত ওঠা বেড়ে গেছে। অর্থনৈতিক গতিময়তা আরও বেড়েছে। ভৌত অবকাঠামো বিস্তৃততর হচ্ছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমার কিছু শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। মানুষে মানুষে দুই ধরনের সম্পর্ক থাকে। যেমন ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও আত্মার সম্পর্ক। একটা সময় আমরা যখন বড় হয়েছি, তখন তো মানুষে মানুষে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলই, সেই সঙ্গে একটা আত্মার সম্পর্কও ছিল পাড়ার মানুষ এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে। আমার কাছে এবার যেটা মনে হয়েছে, সেটা হলো, বাংলাদেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে ভীষণভাবে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। সবকিছু যেন শুধু নিজেকে নিয়ে। নিজের চাকরি, নিজের উন্নতি, নিজের প্রচার। পরিবারের মধ্যে, সমাজের মধ্যে, আত্মিক সম্পর্ক যেন শিথিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন পরস্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি।একসময় মানুষের সাফল্য আমরা পরিমাপ করতাম নানা নির্ণায়কে—জ্ঞানে, মননে তাঁর স্থান কোথায়, মানুষের জন্য তিনি কী করেছেন, সমাজকে তিনি কী দিয়েছেন।
এখন আমার মনে হয় যে মানুষের সাফল্য আমরা পরিমাপ করি তাঁর বিত্ত আর ক্ষমতা দিয়ে। ক্ষমতা আর অর্থ দিয়ে যখন মানুষের সাফল্য নির্ণয় করা হয়, তখন মানুষের মানবিক মূল্যবোধের জায়গাটা পেছনে পড়ে যায়। আমরা যে যেখানে থাকি না কেন, মানুষের প্রতি মানুষের একটা শ্রদ্ধার বোধ থাকা দরকার। এতে একটা সহনশীলতা জন্ম নেয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জন্ম নেয় এবং পরমতসহিষ্ণুতা জন্ম নেয়। আমার মনে হয়, এগুলো সমাজ থেকে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: এই যে আপনি বললেন মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি হলো অর্থ। কেন এ ঘটনাটা ঘটল? এর পেছনের কারণ কী?
সেলিম জাহান: একটা কারণ হলো নিশ্চিতভাবে বিশ্বায়ন। বাইরে কত চাকচিক্যময় জগৎ। বাইরের যতগুলো জিনিস আছে, সেগুলো আমাকে পেতে হবে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এতে আত্মকেন্দ্রিকতা বেড়েছে। আমি আমার প্রচারের মাধ্যমে অন্যের মতকে কোণঠাসা করে যত ওপরে যেতে পারব, তত আমার নিজের জন্য ভালো। দ্বিতীয় কারণটা আমার কাছে মনে হয়, অসমতা। নিশ্চিতভাবে দারিদ্র্যের হার কমেছে। এটা আমাদের জন্য উদ্যাপন করার মতো সাফল্য, কিন্তু সেই সঙ্গে সমাজে অসমতা বেড়েছে। এ বিষয়টা আমি শুধু আয় বা সম্পদের অসমতা দিয়ে বিচার করি না। আমি মনে করি, সুযোগের অসমতাটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেমন শিক্ষায়। আমাদের এখানে তিন-চার ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এখন যে প্রকৃষ্ট শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী পড়তে পারছে অর্থ ব্যয় করে, তার যে সুযোগ এবং সাধারণ গ্রামের একটা বিদ্যালয়ে যে শিক্ষার্থী পড়ছে, তার যে সুযোগ, সেটা কিন্তু এক রকম নয়। কোভিডের সময় আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। যখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছি, তখন দেখেছি যে রাজধানীকেন্দ্রিক সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটা যত সহজে করা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোর জন্য ততটা সহজ ছিল না। এই অসমতা বাড়ার ফলে আমার মনে হয় অন্যের প্রতি সহনশীলতা এবং একজন দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতাবোধ আমাদের সমাজ থেকে
চলে যাচ্ছে।
আজকের পত্রিকা: মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা ও বৈষম্যহীনতা। তাহলে এই বিচ্যুতিটা কীভাবে হলো? আবার ওই জায়গায় ফিরে আসার পথটা কী?
সেলিম জাহান: আমার মনে হয় এই বিচ্যুতিটা ঘটল প্রথমে যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয় তখন। আমাদের সংবিধানের চারটি মূল নীতি ছিল—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এখানে আমি একটা পাদটীকা যোগ করতে চাই, বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র কিন্তু চীন বা রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের মতো ছিল না। তিনি এ প্রসঙ্গে সামাজিক ন্যায্যতার কথা বলেছেন। এরপর আমরা দেখলাম, আমাদের জাতীয় নীতিগুলোকে দলিত করা হলো। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অধিকারের অসমতা এল, দলছুটের রাজনীতি শুরু হলো।
দৃশমানতা এবং দায়বদ্ধতা নষ্ট হয়ে গেল। তারপর আমরা বললাম, রাষ্ট্রের একটা রাষ্ট্রীয় ধর্ম থাকবে এবং সেটা হবে ইসলাম। সেটা যদি হয় তাহলে যারা অমুসলিম, তাদের অধিকার, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলো। মানুষের একটি বিশ্বাসভিত্তিক ধর্ম থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রের মতো নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠানের বিশ্বাসভিত্তিক ধর্ম থাকতে পারে না। রাষ্ট্রের আসল ধর্ম হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সব নাগরিকের নিরাপত্তার বিধান।
আমার মনে হয় বিচ্যুতিটা সেখান থেকেই শুরু হয়েছে। বিচ্যুতিটা কিন্তু ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা যদি আমি বলি, বঙ্গবন্ধু কিন্তু বলেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে প্রতিটি মানুষের ধর্ম পালন তার নিজস্ব ব্যাপার। সেটা তিনি তাঁর নিজের জীবনে পালন করবেন। এই ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে আমরা যখন সরে এলাম, তখন খুব স্বাভাবিকভাবে যে ধরনের সংখ্যালঘুই হোক, তাদের লাঞ্ছনা এবং উৎখাত করা ন্যায্য হয়ে গেল। এ কারণে গণতন্ত্রের বিষয়টা দাঁড়াল ঠিক সময়ে ভোট হলো কি না, ভোটে কারা দাঁড়াচ্ছে, কত সংখ্যক লোক ভোটে অংশগ্রহণ করল, কিন্তু সরদার ফজলুল করিমের একটা কথা আমার কাছে খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞা নেই। গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করাই হচ্ছে গণতন্ত্র।’ এই সংগ্রাম করার জন্য ক্ষেত্রটি রাষ্ট্র নাগরিকদের দেবে, সেটা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে হোক, ধর্মের ব্যবহার করার কথাই বলুন—সবই কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করার কথা। একটা রাষ্ট্রের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, সেটাকে একটা গণতান্ত্রিক উপায়ে এবং প্রত্যেকের কথা শোনার মাধ্যমে একটা সুরাহা করার যে পদ্ধতি, সেটাই আমরা ভুলে গেলাম। সেটা ভোলার ফলে যেটা হলো, আমরা সেগুলো অন্যভাবে সুরাহা করতে চেষ্টা করলাম। ফলে সংঘর্ষ, সংঘাত, সন্ত্রাস আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এসব থেকে উত্তরণের জন্য পারস্পরিক আলোচনা এবং সংবিধানের সেই চার নীতিকে ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত দরকার। আমাদের সচেতনতা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ঠিক রেখে চার নীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হতে পারে। এ জন্য নাগরিক, আইনবিদদের নিয়ে আলোচনাটা হওয়া দরকার।
আজকের পত্রিকা: একধরনের উন্নয়ন বাংলাদেশে হচ্ছে। বিদেশিরা এটাকে বিস্ময় বলছেন। কিন্তু বৈষম্যের ক্ষেত্রেও তো একটা বিস্ময় তৈরি হয়েছে। এই বিপরীতমুখী দুটি প্রবণতার কারণে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হওয়ার কোনো আশঙ্কা কি আপনি মনে করেন?
সেলিম জাহান: আমার মনে হয়, প্রগতি ও উন্নয়নের মধ্যে একটি বিভাজন থাকা দরকার। আমি বলি যে একটা প্রগতি এবং অন্যটা হলো উন্নয়ন। দারিদ্র্য কমে গেছে, মাথাপিছু আয় বাড়ছে, জাতীয় আয় বাড়ছে—এগুলো হলো প্রগতি ও অর্জন। উন্নয়ন তখনই হবে, যখন অসমতা কমে যাবে, মানুষ পরস্পরকে শাণিত করবে, পারস্পরিক সহানুভূতিশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ, পরমতসহিষ্ণুতা বেড়ে যাবে। আমাদের প্রগতি হয়েছে অনেক, কিন্তু আমাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানান জায়গায় ব্যর্থতা, গলদ ও ফাঁকও রয়ে গেছে। বর্তমানে অসমতা বাড়ছে, কিন্তু একেবারে দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের জীবনেও নানান অর্জন হচ্ছে। তাদের আয়ও বাড়ছে। সে জন্য এখানে খুব একটা দ্বন্দ্ব ও নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে না। সেই সঙ্গে নানান শ্রেণির মানুষের জন্য বিভাজিত বাজার রয়েছে। বিত্তবানদের জন্য এক লাখ টাকার শাড়ি কেনার যেমন ব্যবস্থা আছে, তেমনি দরিদ্র মানুষদের জন্য ২০০ টাকা দামের শাড়ি কেনার ব্যবস্থাও আছে। এ রকম একটা ব্যাপার আছে বলে আমার কাছে মনে হয় মানুষের মধ্যে অসমতা সহনীয় অবস্থায় আছে। কোনোভাবে একটা ভারসাম্য আমাদের আছে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সেলিম জাহান: আপনাদেরও ধন্যবাদ।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে