Alexa
শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০২৩

সেকশন

epaper
 

‘বাহাদুরদের’ গ্রাসে বাহাদুর শাহ পার্ক

ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ককে ঘিরে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর খবর এসেছে। পার্কটির অভ্যন্তরে খাবারের দোকান বসানোর জন্য বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ডার হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান এসব নির্মাণকাজ করছে।

আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৩০

বাহাদুর শাহ পার্কের নতুন নামফলক। ছবি: লেখক তাদের ‘বাহাদুর’ আখ্যায়িত না করে পারছি না। বাহাদুর না হলে প্রচলিত আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত একটি সরকারি সম্পত্তি ইজারা নিয়ে বাণিজ্য করার চিন্তা তারা করল কী করে! বলছিলাম পুরান ঢাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্কের কথা। প্রায় তিন শ বছরের পুরোনো এ পার্কটিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইজারা দিয়েছে একটি বেসরকারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে। তা নিয়ে শুরু হয়েছে হইচই। আন্দোলনে নেমেছেন পুরান ঢাকার বাসীরা। তাঁরা সংবাদ সম্মেলন, সভা-সমাবেশ করছেন। তবে পার্ক দখল করে রেস্তোরাঁ নির্মাণে ভাটা পড়েনি এতটুকু।

বাহাদুর শাহ পার্কের রয়েছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। আদি ঢাকার নাভিস্থল হিসেবে পরিচিত এ পার্কটি একসময় ছিল একটি খোলা ময়দান।এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ‘ঢাকা কোষ’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, আঠারো শতকের শেষের দিকে আর্মেনীয় ব্যবসায়ীরা এখানে একটি ক্লাবঘর নির্মাণ করেছিল। তারা এখানে বিলিয়ার্ড খেলত। বিলিয়ার্ডের সাদা বল অনেকটা মুরগির ডিমের মতো দেখতে বিধায় স্থানীয় লোকেরা এ ঘরকে বলত ‘আন্ডাঘর’। লোকমুখে কালক্রমে সেটি হয়ে যায় ‘আন্টাঘর’। আর খোলা মাঠটি পরিচিতি পায় আন্টাঘরের ময়দান নামে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আর্মেনীয়দের অবস্থা খারাপ হয়ে গেলে তারা ওই ক্লাবঘরটিকে ইংরেজদের কাছে বিক্রি করে দেয়। ঘরটি সংস্কার না করায় তা একসময় ভেঙে পড়ে এবং জায়গাটি খোলা ময়দানে পরিণত হয়। একসময় জায়গাটি গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ হয়ে পার্কের রূপ ধারণ করে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের এক শ বছর পরে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমান সিপাহিদের সেই মহাবিদ্রোহ বিশ্ব ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হিসেবে স্থান পেয়েছে। কিন্তু সিপাহিদের সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। মুক্তিকামী শত শত সিপাহিকে ফাঁসি দিয়েছিল ইংরেজ শাসকেরা। ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহিদের মধ্যে ১১ জনকে এই পার্কে জনসমক্ষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে তাদের মরদেহ পার্কের গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।

সিপাহি বিদ্রোহের পর ওই বছরই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এক ডিক্রি বলে ব্রিটেনের রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার নিয়ে নেন। রানির হাতে ভারতবর্ষের শাসনভার হস্তান্তরের ঘোষণা এই পার্কেই সমবেত জনতার সামনে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে পার্কটির নাম রাখা হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫৮ সালে সিপাহি বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই বিদ্রোহে শহীদ সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার জন্য নির্মাণ করা হয় একটি সৌধ। সেই সঙ্গে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের নাম অনুসারে রাখা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

উল্লেখ্য, ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহে সমর্থনদানের ‘অপরাধে’ ইংরেজ শাসকেরা সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে গ্রেপ্তার করে বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে (বর্তমান মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াঙ্গুন) নির্বাসিত করে। সেখানেই কবি-সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ইন্তেকাল করেন। বলা বাহুল্য, শুধু ঢাকা নগরীর একটি উদ্যান হিসেবে নয়, ভারতবর্ষ তথা বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবেও বাহাদুর শাহ পার্ক বহন করছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

বাহাদুর শাহ পার্ক ছিল একসময় পুরান ঢাকাবাসীর নিত্যদিনের বিচরণভূমি। পার্কটির চতুর্দিক দিয়ে রাস্তা থাকায় যাতায়াত খুব সহজ। আর এর ফলে পার্কটিকে একটি দ্বীপের মতো মনে হয়। ঐতিহাসিক জেমস টেলরের বর্ণনায়, ‘কয়েকটি রাস্তার মাঝে এক টুকরো খালি জায়গা, যার মাঝে রয়েছে বৃত্তাকার একটি বাগান’ (সূত্র: ঢাকা কোষ, এশিয়াটিক সোসাইটি, বাংলাদেশ)। মুক্তবায়ু সেবনের জন্য অনেকেই পার্কটিতে ভিড় জমান। স্বাস্থ্যসচেতন নগরবাসীর অনেকে সকাল-বিকেল এই পার্কে ভ্রমণের জন্য আসেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পৌর করপোরেশন একটি টেলিভিশন সেট স্থাপন করেছিল পার্কটিতে। যাদের ঘরে টিভি নেই, তারা এখানে এসে ভিড় জমাত সন্ধ্যার পরে। ওই সময় পার্কটি ছিল সবুজ অরণ্য। উঁচু উঁচু বৃক্ষের পাশাপাশি হরেক রকমের ফুলগাছ ও লতাগুল্মে পরিপূর্ণ ছিল পার্কটি।

প্রাচীর ঘেঁষে এবং আড়াআড়ি ছিল কয়েকটি হাঁটার পথ। বিকেল-সন্ধ্যায় ফেরিওয়ালা, চিনেবাদাম আর ফুচকা-চটপটিওয়ালাদের হাঁকডাকে সরগরম থাকত পার্কটি।

বছরখানেক আগে অনেক স্মৃতিবিজড়িত সেই পার্কে গিয়েছিলাম। প্রবেশ করতেই প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেলাম। এ কোন বাহাদুর শাহ পার্ক! গাছ, লতাগুল্ম, ফুলের বদলে এ যে কংক্রিটের এক মরূদ্যান! পার্কজুড়ে সাদা পাথরের বেঞ্চাকৃতির বেষ্টনী। মাঝখানের গোলাকৃতির 
যে চত্বরটিতে আগে ছিল সবুজ দূর্বাঘাসের গালিচা, সেখানে বিছানো রয়েছে সাদা রঙের নুড়িপাথর।

পার্কের উত্তর প্রান্ত ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা চার স্তম্ভের ওপর নির্মিত সুউচ্চ স্মৃতিসৌধটির এখন হতশ্রী দশা। আগে এর বাইরে ছিল লাল এবং ভেতরের দিকটা ছিল সাদা রঙের। সৌধটির একেবারে শীর্ষদেশে লাল জমিনের ওপর কালো হরফে লেখা ছিল ‘১৮৫৭ সালের শহীদ স্মরণে’। এখন সে সৌধটি সম্পূর্ণ সাদা রং ধারণ করেছে এবং ‘১৮৫৭ সালের শহীদ স্মরণে’ কথাটি নেই! এখন সৌধটি দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না ওই স্থাপনাটি কবে, কেন নির্মিত হয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক-স্থাপনার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের এমন উদাসীনতা মেনে নেওয়া যায় না। সৌধটির দক্ষিণ পাশে একটি বড়সড় কালো পাথরের ওপর চোখ পড়তেই আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। পাথরটিতে লেখা রয়েছে ‘বাহাদুর শাহ পার্ক, শুভ উদ্বোধন করেন মোহাম্মদ সাঈদ খোকন, মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।’ তারিখ লেখা আছে ১১ মার্চ, ২০২০। এটা যিনি পড়বেন, তার মনে হবে পার্কটি বোধকরি মেয়র সাঈদ খোকনের আমলে স্থাপিত হয়েছে। না হলে তিনি এই পার্কের উদ্বোধন করলেন কীভাবে? হতে পারে মেয়র সাহেব (সাবেক) পার্কটির সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প সম্পন্ন করেছেন। তাই বলে কি ‘বাহাদুর শাহ পার্ক উদ্বোধন’ কথাটি লেখা যায়?

ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ককে ঘিরে সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর খবর এসেছে। পার্কটির অভ্যন্তরে খাবারের দোকান বসানোর জন্য বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে ডার হোল্ডিংস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান এসব নির্মাণকাজ করছে। এর প্রতিবাদে এলাকাবাসী আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁরা সভা-সমাবেশও করছেন। গত ৩০ জানুয়ারি আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন এ লিজ দিতে গিয়ে দেশের প্রচলিত প্রত্ন আইন লঙ্ঘন করেছে। কেননা, প্রত্ন আইন, ২০১৫-তে বলা হয়েছে, খাসজমিতে কোনো প্রত্নসম্পদ থাকলে তা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ছাড়া অন্য কোনো সংস্থার কাছে লিজ দেওয়া যাবে না। অভিযোগ উঠেছে, ডিএসসিসির মেয়র ফজলে নূর তাপসের রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানটি বাহাদুর শাহ পার্ক লিজ নিয়েছে। আর সে জন্যই এলাকাবাসীর প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেই লিজ বাতিল করা হচ্ছে না। ইজারাদার প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক রাজীব চৌধুরী বলেছেন, পার্ক ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেনি। আর মেয়র তাপস লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব বিস্তারের কথা অস্বীকার করে বলেছেন, এটা ঠিক নয়। লিজ দেওয়া হয় উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। লক্ষণীয় হলো, মেয়র এবং লিজগ্রহীতা প্রভাব খাটানোর কথা অস্বীকার করলেও লিজের কথা অস্বীকার করেননি। অথচ মূল প্রশ্ন উন্মুক্ত পার্ক লিজ দেওয়া নিয়েই। তারা যে একটি বেআইনি কাজ করেছেন, এটা তো পরিষ্কার। এ বিষয়ে গত ৩১ জানুয়ারি আজকের পত্রিকার সম্পাদকীয়তে যথার্থই মন্তব্য করা হয়েছে, ‘একমাত্র লোভী এবং ইতিহাসবিস্মৃত মানুষেরাই এ রকম অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করতে পারে’। দুর্ভাগ্য আমাদের, লোভী এবং ইতিহাসবিস্মৃতরাই এখন ক্ষমতাধর।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    পঠিতসর্বশেষ

    এলাকার খবর

     
     

    নতুন শিক্ষাক্রমে ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন ছিল

    হিরো আলম যেভাবে সুপারহিরো হয়ে উঠছে

    ওষুধের দাম বৃদ্ধি ঠেকান

    নিরপেক্ষ বিচারক

    ধন্যবাদ এবং প্রত্যাখ্যান

    রুচির দুর্ভিক্ষ: বড় বিতর্ক!

    নাটোরে আওয়ামী লীগ–বিএনপির পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, শহরজুড়ে উত্তেজনা 

    বিএনপির ইফতারে সাংবাদিকদের মারধর, আওয়ামী লীগকে দুষলেন ফখরুল

    ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিতের আহ্বান জাতিসংঘের

    টাকা নেউক, বিকালে ডাক্তার পাইছি: সেবাগ্রহীতা

    বাজারে যাওয়ার পথে নিখোঁজ, গলার সঙ্গে হাঁটু বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার

    কার্ড ছাড়া টিসিবির পণ্য না দেওয়ায় ইউপি সদস্যসহ ৩ জনকে মারধর