নিউজিল্যান্ড দুনিয়ার একেবারে এক প্রান্তের নিঃসঙ্গ একটি দেশ। জাপানকে সূর্যোদয়ের দেশ বলি আমরা। অথচ সিডনিতে সূর্য ওঠে টোকিওর দুই ঘণ্টা আগে। আর নিউজিল্যান্ডে? সিডনিরও দুই ঘণ্টা আগেই সূর্য হাজির। এই দেশে মানুষের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য।
খোদ রাজধানী ঢাকাতেই থাকেন ২ কোটির মতো মানুষ। আর প্রাকৃতিক লীলাভূমি অসাধারণ বিশাল নিউজিল্যান্ডে বাস করেন মাত্র ৫০ লাখের বেশি কিছু মানুষ। এ দেশে গবাদিপশুর সংখ্যা মানুষের চেয়ে বেশি বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে নিউজিল্যান্ডের গুঁড়ো দুধ ও খাঁটি দুধের বিজ্ঞাপন দেখে বড় হয়েছি আমরা। কৌতুক করে বলা হয়, সব দেশেই ঠান্ডা ও গরম পানির জন্য দুটি আলাদা বোতাম থাকলেও নিউজিল্যান্ডে থাকে তিনটা। একটায় ঠান্ডা পানি, একটায় গরম পানি, অন্যটা নাকি গরুর দুধের পাইপ!
মোটামুটি নির্ভেজাল ঠান্ডা দেশ। বিশ্ব অশান্তি, যুদ্ধ—এসব থেকে দূরে থাকা একটি দেশ। আমেরিকার মিত্র হলেও নিউজিল্যান্ড কোনো যুদ্ধে পার্টনার বনতে রাজি হয়নি।
মূলত রাগবি, ক্রিকেট ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি—এই তিন কারণে জনপ্রিয় এমন নীরব দেশও একবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছিল।
ক্রাইস্টচার্চের এক মসজিদে হামলা চালিয়ে মুসল্লিদের জান নেওয়া বর্বরের হাত থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিল আমাদের ক্রিকেটাররা। টাইগাররা তখন খেলতে গিয়েছিল সে দেশে। সে ঘটনার পর তাঁদের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন যে ভূমিকা রেখেছিলেন,
তা ছিল অতুলনীয়। মুসলিম বিধিসম্মত পোশাক পরিধানসহ নানাভাবে তিনি আক্রান্তের পাশে দাঁড়িয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
মহামারি কোভিডের ভয়াবহ অবস্থা সামাল
দিয়েছেন জেসিন্ডা। তাঁর করোনাকালীন সহায়তা ও বলিষ্ঠতা প্রশংসিত হয়েছিল সারা পৃথিবীতে। ১৭ বছর বয়সে রাজনীতিতে জড়িয়ে যাওয়া জেসিন্ডার বয়স এখন মাত্র ৪২।
এতক্ষণ যে যে কারণে তাঁর তারিফ করলাম, তা পছন্দ হলেও এখন যা বলব তা শুনলে আপনার কথিত পবিত্রতা লাফ দিয়ে উঠতে পারে কিন্তু। তিনিই একমাত্র, যিনি সন্তানের পাশে থাকার জন্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সন্তানের পিতাকে এখনো বিয়ে করেননি জেসিন্ডা। ক্লার্ক গেইফোর্ডের সঙ্গে ২০১৩ সাল থেকে একসঙ্গে থাকছেন। এখন তিনি মনে করেন তাঁদের বিয়ে করার সময় হয়েছে। বিবাহপূর্ব অথবা বিয়ে না করেও যে ভালোবাসা বা যৌনতা হয়, সেটা আমাদের সমাজে তলে তলে চললেও এঁদের মতো স্বীকার বা সন্তান নেওয়ার সততা নেই।
যে কারণে লেখা, জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা জেসিন্ডা মাত্র ৪২ বছর বয়সে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দুনিয়া জোড়া সম্মান, দেশে নন্দিত ও অপ্রতিরোধ্য হওয়ার পরও বলেছেন, তাঁর যা দেওয়ার তিনি দিয়েছেন। এখন অন্য কেউ আরও ভালো কিছু দিতে পারবে। এটাও বলেছেন, যে যা-ই কারণ খুঁজে বেড়াক, তিনি ক্ষমতার কাচের স্বর্গ থেকে মাটিতে নেমে পারিবারিক জীবন যাপন করতে চান। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়িয়েছেন। আর এই সরে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি যা বলেছেন, ‘আমি মানুষ, রাজনীতিবিদেরাও মানুষ। আমরা যতক্ষণ পারি ততক্ষণ আমাদের সর্বস্ব দিই, তারপর সময় আসে। আমার জন্য এটা হচ্ছে সময়।’
ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয় বা পদ ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেও গৌরব ও বিজয় থাকে, সেটা আমাদের উপমহাদেশ জানে না। জানলেও মানে না।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্নকে স্যালুট। তাঁর না থাকা হয়তো থাকার অধিক বলেই এরা এমন গণতান্ত্রিক। এমন সময়মতো থাকা ও ছেড়ে দেওয়ার নজির থাকলে আমাদের রাজনীতি এত ঝামেলায় পড়ত না। মানুষও আস্থা হারাত না।
জেসিন্ডা এখানে প্রতীক মাত্র। উন্নত বিশ্ব নামে পরিচিত দেশের সরকারপ্রধান যখন ইচ্ছা সরে দাঁড়াতে জানেন। কিছুদিন আগে বিলেতের ঘটনার কথা মনে করুন। একের পর এক প্রধানমন্ত্রী বদলের পর সেই দেশের সরকারপ্রধান হয়ে গেলেন ঋষি সুনাক। এটা কি চাট্টিখানি কথা? যে দেশ ভারতবর্ষকে ২০০ বছর শাসন করে গেছে, যাদের সূর্য অস্ত যায় না বলে প্রবাদ চালু ছিল, তাদের দেশের তখ্তে বসেছেন এক অশ্বেতাঙ্গ। তা-ও ভারতীয়! এমন প্রথা ভাঙা সরকারপ্রধানের পদে আসা-যাওয়া সাধারণ ঘটনা।
আমি ২৬ বছর ধরে সিডনিতে বসবাস করি। একজন বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। এত বছরে কতবার যে সরকারপ্রধান এলেন আর গেলেন, তা লিখে বলা মুশকিল। এবার যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে লেবারের কাছে লিবারেলের পতন ছিল অনিবার্য।
সেটা বড় কথা নয়, পরাজয়ের আঁচ পাওয়ার পরপরই বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন চূড়ান্ত ফলাফলের আগেই বেরিয়ে এসেছিলেন সরকারি বাসভবন থেকে। উদ্দেশ্য, পার্টি অফিসে গিয়ে পরাজয় বরণ করা। শব্দটি পরাজয় স্বীকার বলিনি। বলেছি পরাজয় বরণ। কারণ তাঁরাই পারেন হার বরণ করে নিতে। সেই হার পরে মণিহার হয়েই ফিরে আসে গণতন্ত্রে, যা আমাদের সরকারি-বিরোধী কোনো দলই মানে না। আমাদের দেশে জেসিন্ডা হয়ে লাভও নেই। নিউজিল্যান্ডে মৌলবাদ নেই। নেই অনাধুনিক অন্ধ মনের লাখ লাখ মানুষ। যাদের উদ্দেশ্য একটাই—নিজ দেশের স্বাধীনতা আর মুক্তবুদ্ধির বিরোধিতা। আমাদের সমাজে শেখ হাসিনার বিকল্প কোথায়? নেই বলেই তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার স্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিবিরোধী অপশক্তি। তিনি জেসিন্ডা হতে চাইলেও প্রগতি তা হতে দিতে পারবে? তাহলে তো তাঁর ধড়ে মাথাই রাখবে না মৌলবাদ।
জেসিন্ডা অর্ডেনের আরেকটা বিশেষ গুণের কথা বলে শেষ করব। তিনি একজন মা। পুরোনো সব মায়ের অস্তিত্ব আজকের দুনিয়ায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে। নতুন মায়েরা সন্তানকে চাইল্ড কেয়ারে রাখতে বাধ্য হন। প্রতিযোগিতামূলক এই পৃথিবীতে স্বামী-স্ত্রী দুজন কাজ না করলে সংসার চালানো কঠিন। প্রান্তিক শ্রেণির মায়েদের জীবন তো দুর্বিষহ। তাঁরা পোশাকশিল্পসহ নানা খাতে কঠিন পরিশ্রম করে দিন যাপন করেন। তাঁদের কারও কি সন্তানকে সেভাবে দেখভাল করা সম্ভব? তাহলে তাঁরা বিকল্প পথে ছেলেমেয়েকে অন্যদের হাতে তুলে দিয়ে বড় করবেন এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে জেসিন্ডা একজন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর দেশের অর্থনীতিও চমৎকার। এ দেশে আসার জন্য নানা দেশের মানুষ এক পা বাড়িয়ে থাকে। সেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি তাঁর সরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সন্তান মানুষ করার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। আর সব কারণ মুখ্য না গৌণ, সেই তর্কে যাব না। কিন্তু এ কথা বলে তিনি সেই সব মায়ের পরিচয় দিলেন, যাঁরা না থাকলে দুনিয়া অন্ধকার। যাঁরা ছিলেন এবং আছেন বলেই পৃথিবী এত সুন্দর।
জেসিন্ডা আরডার্ন নিউজিল্যান্ডকে সংবাদ শিরোনামে নিয়ে এসেছেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের চেয়েও যে চলে যাওয়ার খবর বড় হতে পারে, সেটাই প্রমাণ করলেন তিনি। তাঁকে জানাই অভিনন্দন। ইতিহাসে তাঁর শাসনামলের ভালো-মন্দের পাশাপাশি এ ঘটনাও লেখা থাকবে। মনে রাখবে ইতিহাস ও সময়।
লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে