জমে উঠছে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। একদিকে বিজেপি মনোনীত আদিবাসী নারী প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু। অন্যদিকে বিরোধী ১৮টি দলের সম্মিলিত প্রার্থী সাবেক অর্থ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা। জটিল প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচনে অঙ্কের হিসাবে বিজেপি অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে। কারণ মোট ভোটারের ৪৯ শতাংশই সরাসরি তাদের জোটে রয়েছেন। এ ছাড়া ওডিশার ঘরের মেয়ে দ্রৌপদীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সেখানকার শাসক দল বিজেডি। এমনকি মহারাষ্ট্রে শিবসেনার ভাঙনও তাঁর জয়কে অনেকটাই নিশ্চিত করবে। বিরোধীদের কাছে এই নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বিরোধী ঐক্যের সুযোগ এনে দিয়েছে এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
সেই সুযোগকে কতটা কাজে লাগাতে পারে তারা।
ভারতীয় রাজনীতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দলের প্রতি আস্থা দিন দিন কমছে। এক দলের টিকিটে ভোটে জিতে অন্য দলে চলে যাওয়াটা এখন জলভাত। ক্ষমতার স্বাদ পেতে নীতি-আদর্শ থেকে চোখ সরিয়ে দলবদলই হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দস্তুর। রাজ্যে রাজ্যে এ ছবিটাই বেশি করে ধরা পড়ছে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দলের প্রতি আস্থা না রেখে শত্রুশিবিরে হাত মিলিয়ে নিজের দলকে বহুবার বিপদে ফেলেছেন, এমন উদাহরণের অভাব নেই। দলের হুইপ না মানাটাই যেন দস্তুর হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক কালে রাজ্যসভার ভোটে এমনটাই দেখা গেছে আসাম, হরিয়ানা, রাজস্থান বা পাঞ্জাবে। মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশে দলবদলের কারণে শাসক জোটই পাল্টে গেল। ভোট-পরবর্তী সময়ে দলবদল প্রমাণ করে নেতাদের নিজেদের দল বা নীতি-আদর্শের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই। ক্ষমতার আলিন্দই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। তাই ভারতে এখন বেশ জনপ্রিয় ক্রস ভোটিং। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও এই ক্রস ভোটিংয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
সেই সঙ্গে রয়েছে বিরোধী জোটে ফাটল ধরার আশঙ্কা।
২০২৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিরোধী পক্ষের কারও একার শক্তিতে বিজেপিকে হারানো অসম্ভব, এই দেয়াললিখন ভারতীয় রাজনীতির কারবারিরা খুব ভালো করেই পড়ে নিয়েছেন। তাই বিজেপিকে হারাতে জোট অপরিহার্য। কিন্তু বিরোধীরা মোটেই ঐক্যবদ্ধ নন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস সম্পর্কে অনেকেরই অ্যালার্জি রয়ে গেছে। অথচ কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিরোধী ঐক্য অসম্ভব। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি (আপ), পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেস, তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি (টিআরএস), অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জগনমোহনের ওয়াইএসআর কংগ্রেস থেকে শুরু করে একাধিক দল কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে সমদূরত্ব মেনে চলতে চায়। কারণ কংগ্রেসের বিরোধিতা করে এবং কংগ্রেস থেকে এদের জন্ম। আর কংগ্রেসের দুর্বলতার সুযোগে তাঁদের অনেকেরই লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীর আসন। তাই বিরোধী জোট বাঁধার আগেই ভেঙে গেছে বারবার।
ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের উত্তরসূরি নির্বাচিত হবেন ১৮ জুলাই। জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গোটা দেশের জাতীয় সংসদ ও রাজ্যগুলোর বিধানসভার সদস্যরা ভোট দেবেন। জাতীয় সংসদের সব ভোটারের ভোটের মান সমান। তবে রাজ্যগুলোর ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ভোটের মান রয়েছে। জনসংখ্যা ও বিধানসভার সদস্যসংখ্যার ওপর নির্ভর করে বিধায়কদের ভোটের মান। এই জটিল প্রক্রিয়ার ভোটে নির্বাচিত হতে হবে রাষ্ট্রপতিকে। অতীতে বহুবার রাষ্ট্রপতি অনেকটা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেও এবার কিন্তু হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। বিরোধীদের প্রার্থী যশোবন্ত সিনহার মতে, এবার দুটি আদর্শের লড়াই হচ্ছে। একপক্ষ ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই করছে। অন্যদের হাতিয়ার সাম্প্রদায়িক শক্তি। তাই তিনি দেশবাসীকে অখণ্ডতার স্বার্থে বিবেক ভোটদানের অনুরোধ করেন। অন্যদিকে, বিজেপির প্রার্থীর ভরসা মোদি সরকারের উন্নয়নমূলক প্রচার।
ভারতের রাষ্ট্রপতি পদটি অরাজনৈতিক। শপথ নেওয়ার পর তিনি রাজনীতির ঊর্ধ্বে চলে যান। কিন্তু ভোট হয় ষোলো আনা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। আবার অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেও সরকার ও বিরোধীপক্ষ রাষ্ট্রপতি হিসেবে মেনে নিয়েছে। যেমন বিজেপি প্রার্থী ড. এ পি জে আবদুল কালামকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বামেরা বাদ দিয়ে প্রায় সব দলই সমর্থন করেছিল। তুখোড় রাজনীতিবিদ তথা সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকেও নির্বাচিত হতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বিজেপির শক্তিতেই জয়লাভ করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হওয়ার আগে তাঁর তেমন পরিচিতি ছিল না। এর আগে প্রতিভা পাতিলকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চমক দিয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। এবার দ্রৌপদীকে দাঁড় করিয়ে আরও বড় চমক দিল বিজেপি। ঝাড়খন্ডের রাজ্যপাল দ্রৌপদী প্রচারের অনেকটা আড়ালে থেকেই কাজ করেছেন। ওডিশার সাধারণ আদিবাসী পরিবার থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে উত্তরণ, বিজেপির বড় চমক। তাঁদের এই মাস্টার স্ট্রোক বিরোধীদের ঐক্যের সম্ভাবনাকে অনেকটাই টলিয়ে দিয়েছে।
বিরোধী জোটের অন্যতম প্রবক্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে দোটানায় রয়েছেন। শাসকগোষ্ঠী উপজাতি নারীকে প্রার্থী করবে জানলে তাঁকে সমর্থনের কথা বিরোধীরা বিবেচনা করত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। ফলে শুরু হয়েছে বিরোধী ঐক্যে ফাটল। কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরীর মতে, বিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে বিজেপির সুবিধা করে দেওয়াই তৃণমূলের ধর্ম। বামেরা বিরোধী প্রার্থীকে সমর্থন করেছে। কিন্তু যশোবন্ত সিনহার অতীত ভাবাচ্ছে তাঁদেরও। কারণ, একসময় জয়প্রকাশ নারায়ণের সমাজবাদী আন্দোলনের কারণে সরকারি আমলার চাকরি ছাড়লেও পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপি সরকারের অর্থ ও প্রতিরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রী হন। পরে অবশ্য বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন তিনি; অর্থাৎ দলবদলে সিদ্ধহস্ত বিরোধীদের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। কিন্তু তিনি ছাড়া আর তেমন প্রার্থী তাঁদের হাতে ছিল না। এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার, ন্যাশনাল কনফারেন্সের ফারুক আবদুল্লাহ, মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্র গোপালকৃষ্ণ গান্ধী প্রার্থী হতে রাজি হননি। অগত্যা যশোবন্ত।
যশোবন্তের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের এ নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে বিরোধীদের জোট। যে ১৮ দল এখনো এক জোট হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রচার চালাচ্ছে, তারা কী নিজেদের জোটবদ্ধ রাখতে পারবে? কংগ্রেস, সিপিএম, তৃণমূল, এনসিপি, সপা, ডিএমকে থেকে শুরু করে পাঁচমিশালি দলের এই মিতালি শক্তিশালী হলে ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারকে।
তাই বিরোধী জোটকে ছত্রভঙ্গ করা অবশ্যই তাদের রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে রয়েছে। এখন দেখার, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও তাঁদের সেই কৌশল সফল হয় কি না। ক্রস ভোটিং বা হোটেল পলিটিকস তো রয়েছেই, সঙ্গে যদি জোট ভাঙার খেলাও সফল হয়, তবে সাধারণ নির্বাচনের আগেই বিরোধীদের অনেকটা দাবিয়ে রাখতে সক্ষম হবে বিজেপি।
তাই এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ২১ জুলাই ভোট গণনার দিকে তাকিয়ে থাকবে গোটা দেশ। ২৫ জুলাই নতুন রাষ্ট্রপতির শপথ। সাধারণ নির্বাচনে সুনির্দিষ্ট জনমত প্রতিফলিত না হলে, অর্থাৎ ভোটে কোনো দল বা জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে, রাষ্ট্রপতির ভূমিকাই কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক থেকেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে