Ajker Patrika

সেনার পাশাপাশি সহায়তাও পাঠাচ্ছে রাশিয়া

বিজন সাহা
আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০২২, ১০: ৫৯
সেনার পাশাপাশি সহায়তাও পাঠাচ্ছে রাশিয়া

যুদ্ধের পাশাপাশি সব সময়ই কাজ করে হিউম্যানিটারিয়ান এইডস। রাশিয়া ইতিমধ্যে কয়েক হাজার টন সাহায্য পাঠিয়েছে। যখনই কোনো জনপদ রুশ সেনাদের অধীনে আসে, তারা প্রথমেই যারা দীর্ঘদিন খাদ্যাভাবে ভুগছে, সেখানকার সেই সব সাধারণ মানুষদের মধ্যে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বণ্টন করে। আর মানবতার কথা বলে মুখে ফেনা তোলা পশ্চিমা বিশ্ব অস্ত্র ছাড়া কী দিচ্ছে? এমনকি রাশিয়া যখন মানবিক করিডর খুলছে, তখন বিভিন্নভাবে সেখানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। 

আসলে একটু গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, এই যুদ্ধ শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় বাজার দখলের যুদ্ধ নয়, ব্রিটেনের ইইউ-বিরোধী যুদ্ধও। আসুন একটু পেছনে ফিরে তাকাই। নেপোলিয়নের ফ্রান্স প্রায় বিনা যুদ্ধে সমগ্র কন্টিনেন্টাল ইউরোপ দখল করে। ব্রিটেনের প্রধান শত্রু কে? নেপোলিয়ন। ১৮১২ সালে তাঁকে উসকে দেওয়া হয় রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ফলাফল সবার জানা। 

এভাবেই ব্রিটেন প্রথম ইইউ ধ্বংস করেছিল। হ্যাঁ, সেটা ছিল প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়ন–নেপোলিয়ন সেটাই করতে চেয়েছিলেন। এরপর ১৯৩৯-৪১ সালে হিটলার সমগ্র কন্টিনেন্টাল ইউরোপ প্রায় বিনা যুদ্ধে দখল করে দ্বিতীয় ইইউর জন্ম দেন। ১৯৪১ সালে জার্মানির রাশিয়া আক্রমণের পেছনে ছিল চার্চিলের প্ররোচনা। সেই যুদ্ধ যে শুধু রাশিয়ার সঙ্গে জার্মানির ছিল না, তার প্রমাণ আমরা পাব স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের ইতিহাস থেকে। সেখানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির পাশে যুদ্ধ করেছিল ইতালি, রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়ার কয়েক ব্যাটালিয়ন সৈন্য। ১৮১২ সালে ব্রিটেন ইউরোপের দুই প্রধান শক্তি ফ্রান্স ও রাশিয়াকে পরস্পর বিধ্বংসী যুদ্ধে নামিয়েছিল, ১৯৪১ সালে আবার ছিল ইউরোপের দুই প্রধান শক্তি জার্মানি ও রাশিয়া। এভাবেই ডিভাইড অ্যান্ড রুল মেথডে ব্রিটেন সারা বিশ্বকে পদানত করার চেষ্টা করেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেছে। তখন থেকেই সুযোগ খুঁজছে ইইউকে জব্দ করতে। এখন সে ইউক্রেনের হাত দিয়ে রাশিয়া ও ইইউকে নতুন যুদ্ধে নামিয়েছে। সঙ্গে পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। লাভ? একই সঙ্গে বহু যুগের শত্রু রাশিয়া ও কন্টিনেন্টাল ইউরোপকে দুর্বল করা। সে ক্ষেত্রে সে আবারও সফল। আবারও ডিভাইড অ্যান্ড রুল। 

ইদানীং অনেক কথা হচ্ছে বুচা নিয়ে, যেখানে নাকি রুশ সৈন্যরা নিরপরাধ মানুষদের হত্যা করেছে। সেখানে আমরা কী দেখি? ইস্তাম্বুলে একধরনের ঐকমত্যে আসার পরই ব্রিটেন ঘোষণা করে, তারা রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলবে না। একই সঙ্গে ইউক্রেনকে আদেশ দেয় তড়িঘড়ি করে কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর না করতে। এখন ভ্লাদিমির জেলেনস্কির নিরাপত্তার পুরোটাই ব্রিটিশ কমান্ডোর অধীনে। যদিও ৩০ মার্চ রুশ সৈন্য বুচা ত্যাগ করে এবং এরপর স্থানীয় মেয়র সব ঠিকঠাক আছে বলে ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী কয়েক দিন কোনো হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায় না। কয়েক দিন বাদে কোত্থেকে যেন সেখানে লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায় রাস্তার পাশে। রাশিয়া সেই লাশ কার, কবে, কীভাবে মারা গেল—এসব পরীক্ষার দাবি জানালেও পশ্চিমা বিশ্ব সেই দাবি উপেক্ষা করে। তাই সেটা যে প্রভোকেশন, রাশিয়াকে মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করার পাঁয়তারা, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সিরিয়ায় আমরা দেখেছি হোয়াইট হেলমেট কীভাবে ফেইক ভিডিও করে। ইউক্রেনও তার ব্যতিক্রম নয়। সবাই তো এক গুরুরই শিষ্য। এ ছাড়া ইউক্রেনে জেনেভা কনভেনশন ভঙ্গ করে যুদ্ধবন্দীদের হত্যার যে ভিডিও দেখানো হয়েছে, সেখানেও এমআই-৬-এর প্রিন্ট চোখে পড়ে। যখনই রাশিয়া এ সমস্ত খবর যে সত্য নয়, সেটা প্রমাণ করতে চাইছে; বিভিন্নভাবে তাকে সেটা করতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘে পর্যন্ত এ নিয়ে শুনানি স্থগিত রাখা হয়েছে। কারণ, ঘটনার সত্য-মিথ্যা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। উদ্দেশ্য একটাই—রাশিয়াকে বিশ্বের মানুষের কাছে হেয় করা। গোয়েবলস বলেছিল, কোনো মিথ্যা যদি বারবার বলা হয়, সেটা সত্যে পরিণত হয়। এরা তো সেই গোয়েবলসেরই উত্তরসূরি। 

আজ পাকিস্তানে ইমরান খান সরকারের পতন হলো। কেন? তিনি আমেরিকার কথামতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার হননি। তাও ভালো। এর চেয়ে খারাপ অবস্থাও হতে পারত। সালভাদর আলিয়েন্দে, শেখ মুজিবুর রহমান—কত নেতাই তো মার্কিন ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘মানবিক’ রাজনীতির শিকার হয়ে পৃথিবী ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ডমিনিক স্ট্রাউস-কান জনপ্রিয় ও সম্ভাবনাময় হওয়ার পরও নির্বাচনে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারেননি। আবার প্রায় অজ্ঞাত এমানুয়েল মাখো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। এ এক প্যারাডক্স। গণতন্ত্রের মক্কা এই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব রাজনীতিতে যেকোনো স্বৈরাচারকেও হার মানায়। হ্যাঁ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র স্বৈরাচার। কোনো দেশে স্বৈরাচারী শাসক যেমন জনগণের মুখ বন্ধ করে নিজের খেয়াল-খুশিমতো দেশ চালায়, যুক্তরাষ্ট্রও পৃথিবীর সব দেশের মুখ বন্ধ করে তাদের জাতীয় স্বার্থকে পদদলিত করে নিজের ইচ্ছাকে তাদের ওপর চাপিয়ে দেয়। আর যদি কেউ তা না মানে, তাহলে হয় সে দেশে সরকারের পতন ঘটে, সরকারপ্রধান প্রাণ হারান অথবা দেশটার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। 

এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সাবেক জেনারেল ব্ল্যাক সি, কালিনিনগ্রাদ, ভ্লাদিভোস্তক—এসব জায়গায় ন্যাটোর সামরিক তৎপরতা বাড়াতে বলছেন। এটা যে পারমাণবিক যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে, সে কথা কি এরা ভাবেন? যদিও এখনো যুদ্ধ হচ্ছে রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে, তবে সেটা হচ্ছে ইউক্রেনকে মধ্যে রেখে। এখানে ন্যাটোর প্রশিক্ষক, ছুটিতে থাকা সৈনিক—এ সবই আছে, আছে ন্যাটোর অস্ত্র, তবু সরাসরি ন্যাটো ও রাশিয়ার যুদ্ধ নয় এটি। অনেকের ধারণা, মারিউপোলের আজোভ স্টিলে ফ্রান্সের এক জেনারেল আটকা পড়েছেন। তাঁকে মুক্ত করে আনার জন্যই ইমানুয়েল মাখোঁ বারবার পুতিনকে ফোন করছেন। কী হবে যদি সত্যিই সেই যুদ্ধ লাগে? যুক্তরাষ্ট্র কি ভাবছে বরাবরের মতো সে এবারও রেহাই পাবে সাগরের ওপারে বসে? আর যদি হঠাৎ এটা পারমাণবিক যুদ্ধে পরিণত হয়, যদি সাগর থেকে কয়েকটি বোমা যুক্তরাষ্ট্রে পড়ে, বড় বড় শহরে বা ইয়েলো স্টোন বা ওসব স্পর্শকাতর জায়গায় গিয়ে কোনো বোমা পড়ে, তাহলে প্রাণ-প্রকৃতির কী হবে? 

উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালের বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষ হারিয়ে সোভিয়েত জনগণ সত্যিকার অর্থেই ছিল শান্তিপ্রিয়। তাই যখন আশির দশকে অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তারা সেটা লুফে নিয়েছিল। তাদের আশা ছিল—যুক্তরাষ্ট্র তাদের বন্ধু হবে। কিন্তু কী পেল তারা? নব্বইয়ের দশকের অরাজকতা। কারচুপিতে ভরা রাজনীতি, হতাশা, দারিদ্র্য; আর সবচেয়ে বড় কথা জাতীয় লাঞ্ছনা, অবমাননা। আর তাইতো তারা ঘুরে দাঁড়াল। আজ এখানে আগের মতো আর আমেরিকা-প্রেম নেই। ফলে মানুষ এখন জাতীয় মর্যাদা রক্ষা করতে চরম যুদ্ধে নামতেও প্রস্তুত। অন্তত লোকজনের সঙ্গে কথা বললে সেটাই মনে হয়। তারাও বলে, রাশিয়াই যদি না থাকে, সেই বিশ্ব দিয়ে আমাদের কী হবে। সত্যিকার অর্থেই পৃথিবী এক বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সব যুদ্ধই শেষ হয় সাধারণত শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে। তবে এবার সেটা হতে পারে পারস্পরিক ধ্বংসের মধ্য দিয়ে। তবে শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে হলেও বিশ্ব আর আগের মতো থাকবে না। ডলার আর একমাত্র কারেন্সি থাকবে না। সেটা আমেরিকার অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। আমেরিকা লাগামহীনভাবে ডলার ছাপিয়ে সেই বাবলে (bubble) নিজেই ডুবে যেতে পারে। ইউরোপ হবে আরও অস্থির। একে তো জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে সেখানকার পণ্য আগের মতো কমপিটেটিভ থাকবে না। তার ওপর সামাজিক অস্থিরতার কারণে সেখানকার পুঁজি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতে পারে। এই অঙ্ক অনেকের মতে ট্রিলিয়ন হতে পারে। 

ইউরোপের কী হবে
সে ক্ষেত্রে ইউরোপের সুখের দিন শেষ। হতে পারে রাশিয়া, চীন, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিজেদের মতো করে চলবে। এতে যোগ দেবে আফ্রিকা, আরব দেশগুলো ও লাতিন আমেরিকা। আরব বসন্তের কথা সৌদি আরব, আরব আমিরাত ভোলেনি। এর ওপর আছেন জামাল খাশোগি। তাই তো দেখি বাইডেনের ডাকে সাড়া না দিয়ে চীনের সঙ্গে ইউয়ানের মাধ্যমে বাণিজ্য করতে চাইছে সৌদি আরব। ইউরোপে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি পূর্বের অবস্থান হারাবে। সেই স্থান দখল করার চেষ্টা করবে পোল্যান্ড। এর কারণ হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে জার্মানির পক্ষে সামরিক শক্তি হয়ে ওঠাটা অনেক কঠিন। সেখানে অনেক বাধা। সেদিক থেকে পোল্যান্ড মুক্ত। 

জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে এত বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরও দুই দেশের মানুষ পরস্পরের বন্ধু হতে পেরেছিল। পোল্যান্ড সব সময়ই ছিল রুশবিরোধী। আর এটি ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার আরও কাছে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি থেকে তাদের সামরিক ঘাঁটির এক বিরাট অংশ পোল্যান্ডে স্থানান্তরিত করতে আগ্রহী। এমনকি পারমাণবিক অস্ত্রও। জাপানও সামরিকভাবে শক্তিশালী হবে বলে অনেকের ধারণা। জাপানের ঐতিহাসিক পটভূমি, সামুরাই, হারিকিরি—এসব সে কথাই বলে। তবে ইউরোপের দেশগুলো যতটা এক্সপোজড, জাপান ততটা নয়। এ দেশ ইকোনোমিক্যালি ও টেকনোলজিক্যালি অনেক উন্নত। তাই ইসরায়েলের মতো সেও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম। সেখানে একটাই বাধা—হিরোশিমা ও নাগাসাকির স্মৃতি। 

এক কথায় আমরা আবার এক নতুন যুগের দোরগোড়ায়। এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের চেয়েও ব্যাপকভাবে নাড়া দেবে বিশ্বকে। সেই ভূমিকম্পে কে টিকে থাকবে, আর কে হারিয়ে যাবে, সেটা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারে। বাইবেলে সডোম ও গোমেরা নামে প্রাচুর্যপূর্ণ দুই শহরের গল্প আছে, যারা নাকি বিলাস ও ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ভোগবাদী বিশ্বে আমরা কি সেই চিত্রই দেখছি না। মানব সমাজ কি প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজে লিপ্ত হয়ে নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না? অনেক দিন থেকেই ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো (ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা) ও জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড নিজেদের এক্সক্লুসিভ ক্লাবের সদস্য ভাবে। এবার হয়তো সেটাই হবে—অফিশিয়ালি। বিশ্ব দুই ভিন্ন ক্যাম্পে বাস করবে। পশ্চিমা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র তার মোড়লগিরি আগের মতোই করে যাবে, বাকি অংশে থাকবে একাধিক কেন্দ্র, যার পুরোধা হবে চীন, রাশিয়া ও ভারত। 

পশ্চিমা বিশ্ব নেমেছে অল আউট যুদ্ধে আর তাই তো খেলোয়াড়, শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা অভিনেত্রী, সাংবাদিক—কেউ বাদ যাচ্ছে না। এরা রাশিয়াকে একঘরে করে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। ইতিহাস বলে জিন্নাহর ব্রাহ্মণ পিতামহকে মাছের ব্যবসা করার দায়ে একঘরে করে গ্রাম্য সমাজ। তারা আশ্রয় পায় ইসলামে। পরবর্তী ইতিহাস ভারত বিভাগ। যদিও পাকিস্তান সৃষ্টি ইসলাম বা মানবজাতির জন্য কতটা সুফল বয়ে এনেছে, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ, তবুও কথা হলো কাউকে অন্যায়ভাবে কোণঠাসা করার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে। 

ন্যাটো কার জন্য
অনেক সময় মনে হয় ন্যাটো আসলে কার দরকার। ওয়ারশ জোট পতনের পর এর যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, করছেন। মৌখিক প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও ন্যাটোর প্রসারণ রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করেছে। তাকে বাধ্য করেছে নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবতে। ফলে ইউরোপের নিরাপত্তা বাড়েনি, কমেছে। কারণ অস্ত্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র উত্তেজনা কমায় না, বাড়ায়। তা ছাড়া সৃষ্টিকালে ন্যাটো আত্মরক্ষাকারী জোট হলেও সে আর এখন তা নেই। সার্বিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ার ঘটনা একে আক্রমণকারী জোট হিসেবেই প্রমাণ করে। তাহলে কেন এই জোট? উত্তর—যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রির জন্য। ফলে ইউরোপের দেশগুলো বাধ্য হচ্ছে নিজেদের নিরাপত্তা বাজেট বাড়াতে; আর শর্ত অনুযায়ী মূলত মার্কিন অস্ত্র কিনতে। রাশিয়ায় ভয় দেখিয়ে ইউরোপে মোতায়েন করা হচ্ছে মার্কিন সেনা। এতে করে ইউরোপ আমেরিকার ওপর আরও বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। রাশিয়াকেও বন্দুকের মুখে রেখে বশ মানানোর চেষ্টা করা যাচ্ছে। আর এখানেই বেজেছে গোল। রাশিয়া ঘুরে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে এখন ইউক্রেনের মাধ্যমে এবং পরে ইউরোপের হাত দিয়ে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে। সেটি আর হবে বলে মনে হয় না। বর্তমান টেকনোলজির যুগে এমনকি ইউরোপ থেকে রাশিয়া আক্রমণ করার পরও শত শত নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আমেরিকায় গিয়ে পড়বে। এই আশঙ্কাই এখন পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে মার্কিন আগ্রাসী নীতি থেকে। 

রাশিয়া ও পশ্চিমা নেতাদের কথাবার্তা খেয়াল করলে দেখবেন, রাশিয়া যতটা শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যা সমাধানে প্রস্তুত, পশ্চিম ততটা নয়। কথায় কথায় তারা রাশিয়া, রাশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসের কথা বলে। কিন্তু পশ্চিমের অর্থনীতি ধ্বংসের বাস্তব চাবিকাঠি রাশিয়ার হাতে থাকার পরও সে সেটা করছে না, এ নিয়ে হুমকি দিচ্ছে না। কেউ কি ভেবেছিল বিশ্ব রাশিয়ার ওপর এতটা নির্ভরশীল? যত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে ইউরোপের মানুষ তত বেশি বিপদে পড়ছে। এরই মধ্যে ইউরোপের কোথাও কোথাও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে দেখি সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ ও নতুন রাশিয়ার প্রথম দিনগুলোর অবস্থা। দুই বোতলের বেশি সূর্যমুখী তেল দিচ্ছে না। আমলারা বলছেন, শরীরে তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রিতে নামিয়া আনতে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এটা সম্ভব ছিল, ইউরোপের মানুষ কি মানবে সেই নির্দেশ? তবে এভাবে চলতে থাকলে তাকে অন্যভাবে ভাবতে হতে পারে। মিনস্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়া ইতিমধ্যেই বলেছে, তারা আর ইঁদুর-বিড়াল খেলতে রাজি নয়। এখন কোনো ইউক্রেন শহর দখল করার পর তারা আর সরে আসবে না, যাতে বুচার মতো কোনো প্রভোকেশন কেউ না করতে পারে। 

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ সেনা উপস্থিতিযেসব এলাকা মুক্ত হচ্ছে, সেখানে স্থানীয় লোকদের নিয়ে প্রশাসন গড়ে তোলা হচ্ছে। আসলে পুরোনো প্রশাসনে বান্দেরার অনুসারীরা এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে, তাদের আর বিশ্বাস করা ঠিক হবে না বলে মনে করছে রাশিয়া। নতুন বাস্তবতায় নতুন করে ভাবতে হবে। তবে সেটাও কি তেমন ফলপ্রসূ হবে? আজ ক্রিমাতোরস্ক রেল স্টেশনে অপেক্ষারত সাধারণ মানুষের ওপর মিসাইল পড়ল ক্যাসেট বোম নিয়ে। সেটা করেছে ‘তোচকা’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে, যা ইউক্রেন ছাড়া কেউ ব্যবহার করে না। অথচ ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্ব দোষ চাপাচ্ছে রাশিয়ার ঘাড়ে। কারণ তারা চায়, এভাবে রাশিয়ার সব প্রয়াসকে হেয় করতে, মানুষের চোখে এদের ছোট করতে। 

মজার ব্যাপার হলো বোমা আর টুইটারে কিয়েভের নেতাদের পোস্ট আসে প্রায় একই সঙ্গে। তাতেই বোঝা যায়, টেক্সট আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব এটা দেখবে না। তাদের দরকার এই অছিলায় ইউক্রেনে আরও আরও অস্ত্র সরবরাহ করা। যদি ইউক্রেনের মানুষের জীবন রক্ষাই তাদের এজেন্ডায় থাকত, তারা অস্ত্র নয়, খাদ্য পাঠাত। 

রুশ হাইকমান্ড জানাচ্ছে যে, ইউক্রেন খারকভের কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে প্রায় ১২০ টন ব্লিচিং পাউডারসহ গোডাউন বিস্ফোরক দিয়ে ভরে রেখেছে। এর অর্থ যদি ওরা সেখানে বিস্ফোরণ ঘটায়, দোষ যাবে রাশিয়ার ঘাড়ে। ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হবে, সেটা অকল্পনীয়। শুধু কি তাই? এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউরোপ আরও অস্ত্র পাঠাবে ইউক্রেনে। কিন্তু সমস্যা হলো, তারা কি কখনো থামতে পারবে? নাকি ন্যাটো ও রাশিয়ার মধ্যে একমাত্র সরাসরি যুদ্ধ দিয়েই এই সমস্যার সমাধান হবে? কেউ কি ভেবে দেখেছে এর ফলাফল? এটা অনেকটা যেকোনো মূল্যে যুদ্ধটাকে চালিয়ে যাওয়ার পণ বলে মনে হয়। আসলে ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব এখন আর কেউ অপরাধী খোঁজে না, প্রয়োজনমতো কারও ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়। 

আবার স্মরণ করা যেতে পারে কলিন পাওয়েলের কথা। সিরিয়ায় বিভিন্ন নাটক করা হয়েছে। মৃত শিশু বেঁচে উঠেছে নতুন কোনো রোলে অভিনয় করার জন্য। ইউক্রেনে একই মহিলা কখনো বোমা হামলায় আহত বৃদ্ধা, অসীম সাহসী ইউক্রেন সেনা, আবার মারিউপোলের হাসপাতালে গর্ভবতী মহিলা। কী মালয়েশিয়ার বিমান এম এইচ ১৭, কী জাপারোঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কী ক্রামাতোরস্ক—পশ্চিমা বিশ্ব কোনো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণের ধার না ধরে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করে। ফলে আইন বা বিচার ব্যবস্থাকেই হেয় করা হচ্ছে। 

শুধু কি তাই। সাংবাদিকতা আজ আসলে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার মেশিন হয়ে গেছে। ফলে সাংবাদিকতা ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই সাংবাদিকতা একদিন ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া আক্রমণকে জায়েজ করেছে। এদের কারণেই ইউরোপের মানুষ বান্দেরার অনুসারীদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ এদের অনেকেই মনেপ্রাণে ফ্যাসিবাদকে ঘৃণা করে। সত্যকে বিকৃতভাবে প্রকাশ করে এরা শুধু সত্যের অবমাননা করছে না, মানুষকেও মিথ্যেবাদী হতে শেখাচ্ছে, মানুষের মানবতাবোধ ভূলুণ্ঠিত করছে। কারণ মানবিক আদর্শ আর যাই হোক, ফ্যাসিবাদকে সমর্থন করতে পারে না। সেদিন এক বন্ধুকে দেখলাম ফেসবুকে লিখেছে দেশে এখন যে কেউ তার প্রতিপক্ষকে শেষ করতে পারবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। একটু খেয়াল করলে দেখবেন পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ—এসব দেশে যে ঘটনা ঘটে, সেটা ইউরোপ আমেরিকার কোনো দেশের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া অভিযোগ আনারই স্থানীয় রূপ। এসব দেশে যেমন কেউ ঘটনার সত্যতা প্রমাণের জন্য অপেক্ষা না করে কাউকে দোষী বানিয়ে ঘরদোর পোড়ায়, হত্যা করে বা ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে পুলিশের হাজতে ঢোকায়, একইভাবে পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অপছন্দের যেকোনো দেশ বা সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করে সেই দেশ ধ্বংস করার সব রকম প্রচেষ্টা চালায়। বাংলাদেশ যদি আধুনিক মৌলবাদী দেশ হয়, পশ্চিমা বিশ্ব আজ অত্যাধুনিক নিওলিবারেল মৌলবাদী দেশপুঞ্জ। এসব দেশে মধ্যযুগীয় ডাইনি পোড়ানো এখন শুধু সময়ের ব্যাপার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘কোম্পানির লোকেরাই আমার ভাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে’

আমি লজ্জিত, নিজেকে মাটিতে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে—ফেসবুকে প্রেস সচিব

তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ

গণমাধ্যমে হামলা ও ময়মনসিংহে নৃশংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না, সরকারের বিবৃতি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

সংযোগ সড়কহীন সেতু

সম্পাদকীয়
সংযোগ সড়কহীন সেতু

সংযোগ সড়ক না থাকলে সেতু নির্মাণ করলে তা এলাকার জনগণের কোনো কাজে আসে না। এ রকম একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় সেরার খালের ওপর। কোটি টাকার বেশি বরাদ্দে সেতুটি নির্মাণ করা হয় বছরখানেক আগে। কিন্তু সংযোগ সড়ক নির্মাণ না করায় ঝুঁকি নিয়ে মই বেয়ে সেতু পারাপার করতে হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এতে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়েছেন বৃদ্ধ, নারী ও স্কুলগামী শিশুরা। সংযোগ সড়ক না থাকায় স্থানীয় বাসিন্দারা টাকা তুলে মইয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আবার মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কয়েকজন গুরুতর দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে।

সংবাদ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ কোটি ৭ লাখ টাকা। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৪ ফুট প্রস্থের সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায় মিথুন এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বক্তব্যটি আরও কৌতূহল উদ্দীপক। প্রকল্পের ঠিকাদারের দাবি, মাটি না পাওয়ায় তাঁরা সংযোগ সড়ক নির্মাণ করতে পারেননি।

অতীতেও আমাদের দেশে এ রকম অসংখ্য সেতুর হদিস পাওয়া গেছে। যেখানে কোনো জনবসতি বা রাস্তা নেই, সেখানে সেতু তৈরি করার অনেক নজির রয়েছে। যাঁরা এসব সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পাচ্ছেন তাঁরা জনগণের কথা যে ভাবেন না, সেটা স্পষ্ট। সেতুর নামে যেখানে খুশি সেখানে একটি কাঠামো দাঁড় করিয়ে জনগণের করের টাকা কীভাবে নিজেদের পকেটে ঢোকানো যায়, তাঁরা সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকেন। অথচ দেশের অনেক জায়গায় সেতুর প্রয়োজন হলেও সেসব জায়গায় সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর চলে গেলেও কারও কোনো দুশ্চিন্তা হয় না। ফলে বাধ্য হয়েই ওই সব এলাকার জনগণকে বাঁশের সাঁকো, কাঠের সেতু কিংবা নৌকায় করে ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে দেখা যায়। আবার সংস্কারের অভাবে অনেক সেতু জরাজীর্ণ ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। প্রায়ই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।

দেশের মানুষের যোগাযোগের কথা চিন্তা করে সরকারি উদ্যোগে অনেক সেতুই নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব সেতু আদৌ জনগণের কল্যাণে আসছে কি না, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের যেন কোনো ভাবনা নেই। তবে সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী যে নিজেদের লাভের জন্য এ ধরনের অপকর্ম করছে, তা ব্যাখ্যা না করলেও চলে।

সেতু নির্মাণের নামে জনগণের অর্থের অপচয় বন্ধ করতে হবে। সেতু নির্মাণ করতে হবে প্রকৃত অর্থেই জনগণের কথা মাথায় রেখে। আর যে সেতু নির্মাণ করে এলাকাবাসীর কোনো কাজে আসে না, উল্টো দুর্ভোগ সৃষ্টি করে, তা নির্মাণের কোনো প্রয়োজন নেই। এখন সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদারকে বাধ্য করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অবহেলার দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘কোম্পানির লোকেরাই আমার ভাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে’

আমি লজ্জিত, নিজেকে মাটিতে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে—ফেসবুকে প্রেস সচিব

তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ

গণমাধ্যমে হামলা ও ময়মনসিংহে নৃশংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না, সরকারের বিবৃতি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

জাহীদ রেজা নূর
এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলেই প্রথমে আমার মনে পড়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রচলিত কৌতুকগুলোর কথা। ছিল লৌহশাসন, অথচ সেই শাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসত দমফাটানো কৌতুক। সে সময়ের কৌতুকের একটাই বলি এখানে। একজন ভোটারকে টেলিভিশনের এক কর্মী প্রশ্ন করায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি ভোট দিয়েছি। একজন প্রার্থী ছিলেন, তাঁকেই উৎসবমুখর পরিবেশে আমরা বেছে নিয়েছি!’

ভোটারের ভোটের স্বাধীনতা বলতে এ রকম একটি আবহই বিরাজ করত সেখানে। আমাদের দেশে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে হচ্ছে নির্বাচন। নানা রাজনৈতিক মতাবলম্বী দল অংশ নেবে নির্বাচনে। ফলে, আমাদের নির্বাচন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একপেশে হবে না। তাই তা নিয়ে কৌতুক করার সুযোগই থাকবে না নিশ্চয়ই।

রাশিয়ায় নির্বাচন নিয়ে ইদানীং নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম হচ্ছে। একটু হালকা চালে সে কৌতুকগুলো বলে আমাদের দেশের নির্বাচনের ব্যাপারে কিছু কথা বলব। সেগুলো অবশ্য কৌতুককর হবে না।

রাশিয়ার মানুষ নিজেদেরই প্রশ্ন করে, ‘আমাদের দেশে নির্বাচন আর লটারির মধ্যে পার্থক্য কী?’ নিজেকে এই প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ ভেবে নিজেই উত্তর দেয়, ‘লটারিতে অন্তত ভিন্ন ফল হওয়ার একটা সুযোগ থাকে।’

আরেকটি প্রশ্ন-উত্তর:

— রাশিয়ায় নির্বাচন সব সময় ‘সৎ’ভাবে হয় কেন?

— কারণ ভোট শুরু হওয়ার আগেই সবাই জানে ফল কী হবে।

পরের কৌতুকটা রাজনীতির একটা মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছে। কোন দেশের জন্য তা কার্যকর, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু প্রশ্ন যেমন, উত্তরও তেমন:

— নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি আর রূপকথার মধ্যে পার্থক্য কী?

— রূপকথায় শেষ পর্যন্ত ভালোই জেতে।

স্বৈরাচারী নির্বাচনে কীভাবে প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, তা নিয়ে কৌতুকে বলা হচ্ছে:

নির্বাচনে একজনই প্রার্থী ছিল। তবু

ব্যালট পেপারে দুইটা অপশন ছিল: ‘পক্ষে’ আর ‘খুবই পক্ষে’।

রাশিয়াকে সরিয়ে রাখা যাক। জর্জ অরওয়েলের নামে একটা উদ্ধৃতি ঘুরে বেড়ায় অন্তর্জালে। তিনি বলেছেন, ‘যারা ব্যর্থ লোক, চোর, বিশ্বাসঘাতক ও প্রতারকদের পক্ষে ভোট দেয়, তারা তাদের শিকার নয়—তারা তাদের সহযোগী।’

কিন্তু জর্জ অরওয়েল এ রকম কথা কোথাও বলেছেন, এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেউ না কেউ এ রকম কিছু বলে তা অরওয়েলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন। অরওয়েল বলে থাকুন আর না-ই থাকুন, কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল কাছাকাছি এ ধরনের কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন মার্কিন উদ্ভাবক, ভিডিও গেম ডিজাইনার, প্রকৌশলী রালফ বেয়ার বলেছিলেন, ‘শৈশবের প্রধান সুবিধা হলো অজ্ঞানতা। তুমি এখনো জানো না যে পৃথিবীটি চালায় প্রতারক, চোর, মিথ্যাবাদী, বিশ্বাসঘাতক, খুনি এবং দুষ্টজনেরা।’

একটু ভিন্নভাবে মেক্সিকোর বিপ্লবের নেতা এমিলিয়ানো সাপাতা বলেছিলেন, ‘আমি চোর এবং খুনিকে ক্ষমা করতে পারি, কিন্তু বিশ্বাসঘাতককে কখনো না।’

এ রকম অনেক কথাই আছে যেগুলো শুনতে ভালো লাগে। বিশ্বাসও হয়। কিন্তু সৎ মানুষের খোঁজ করতে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে।

এই জায়গায় এসেই আমাদের একটু সতর্ক হতে হয়। কৌতুক থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে হয়। আমাদের দেশে ভালো নির্বাচন একেবারে হয়নি, তা নয়। কিন্তু রাজনীতির মাঠে দিনের পর দিন সংসদে যাওয়ার জন্য যে মানুষগুলো প্রস্তুত হয়েছেন এবং নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কালোটাকার মালিক। এভাবে কথাটা বললে অবশ্য সেটাও হয়ে ওঠে কৌতুক। বরং বলা যায়, কালোটাকা ছাড়া নির্বাচন করা খুবই কঠিন, আর তাতে জেতা প্রায় অসম্ভব।

কালোটাকার মালিকদের কথা বললে আবার আমাকে নস্টালজিয়া পেয়ে বসে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আমি রাশিয়ায় ছিলাম। দশকের শুরুতেই ধরাশায়ী হয়েছিল কমিউনিস্ট শাসন। সারা বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোয় তখন চলছিল ভাঙন। পশ্চিমা বিশ্বের মদদ ছিল তাতে, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের স্থবিরতা এবং স্বৈরাচারও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পতনের জন্য অনেকাংশে দায়ী—এ কথা না বললে সত্যের অপলাপ হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের পর একটা সময় এসেছিল, যখন হঠাৎ করেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল নব্য রুশরা। এই নব্য রুশদের কেউ বেরিয়ে এসেছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে, কেউ তাদের ছাত্রসংগঠন কমসোমল থেকে, কেউ পার্টি না করলেও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা জমিয়ে পুঁজির পাহাড়ে উঠে বসে পড়েছিল। এই নব্য রুশরা ‘জাতে’ উঠতে চাইত। তারা সে সময়ের বিলাসবহুল ‘মার্সিডিস ৬০০’ গাড়ি কিনত, সেটাই চালাত। এ রকম গাড়ি দেখলেই বোঝা যেত, এই লোক নির্ঘাত নব্য রুশ। তারা গলায় পরত মোটা সোনার চেইন। আর শরীরে জড়াত গাঢ় গোলাপি জ্যাকেট। এক পুরুষে অভিজাত হওয়ার খায়েশ মেটাতে

চাইত তারা। তাদের নিয়ে একটা কৌতুক বলে নেওয়া যাক।

দুই নব্য রুশের দেখা হয়েছে মস্কোতে। প্রথমজনের নিখুঁত স্যুটের সঙ্গে একটি মানানসই টাই দেখে দ্বিতীয় নব্য রুশ প্রশ্ন করছে, ‘এই টাই তুমি কোথায় কিনেছ? কত দিয়ে কিনেছ?’

প্রথম নব্য রুশ বলল, ‘টাইটা আমি কিনেছি প্যারিস থেকে, ১০০০ ডলার পড়েছে দাম।’

চুক চুক করে দ্বিতীয়জন বলল, ‘আরে! কী বোকা তুমি! লন্ডনে কিনলে এই একই টাই তুমি ২০০০ ডলারে কিনতে পারতে!’

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। নতুন গোঁফ উঠলে যেমন বারবার আয়নার সামনে দাঁড়ায় সদ্য তরুণ, তেমনি নব্য ক্ষমতার স্বাদ পেলে নব্য রাজনীতিবিদেরাও এমন সব কাণ্ড করতে থাকেন, যা অনেক কৌতুকের জন্ম দেয়।

বলে রাখা ভালো, সেই নব্য রুশরা এখন ইতিহাস। তারা বর্তমানে অচল। তাই তাদের নিয়ে নতুন কোনো কৌতুক তৈরি হয় না।

২. নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে একটু হালকা আলাপ করে নিলাম। রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠছে পরিস্থিতি, এ অবস্থায় মানসিক চাপ নেওয়া ঠিক হবে না। নির্বাচন পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে, নির্বাচিত দল ক্ষমতা হাতে নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, অর্থনীতিতে গতি আনা, জনমনে নিরাপত্তা দেওয়ার কাজগুলো তারা করবে নিশ্চয়ই। এর জন্য সবচেয়ে আগে দরকার নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিকভাবে দেশ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

ভালো নির্বাচন করতে হলে ভোটারদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তাঁরা ভয়ভীতি ছাড়াই ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন। প্রত্যেকে সমান সুযোগ পাবেন, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে তাঁর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। কোনো শক্তি ভোটারকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা থাকছে কি না। এগুলো খুবই জরুরি প্রশ্ন। দেশের মানুষকে বিভাজিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হলে দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে।

ভোটকেন্দ্রে ও তার আশপাশের এলাকার পরিবেশও অনেক কথা বলে দেবে। এবারের নির্বাচনের দিকে বিশ্ববাসীর নজর থাকবে। গায়ের জোরে কিংবা কৌশল করে কেউ যদি নির্বাচনী রায় ছিনতাই করতে চায়, তাহলে সেই নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

নজর রাখতে হবে প্রশাসনের দিকে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি দলনিরপেক্ষ আচরণ না করে, কিংবা কোনো না কোনো দলের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তাহলে সে নির্বাচন একেবারেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সব দলের প্রতি নির্বাচনী বিধির একই রকম প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

বিরোধী মতের কণ্ঠ রোধ করার কথা আগের জামানায় যেমন শোনা গেছে, এই জামানায়ও শোনা যায়। ফলে সব দলের জন্য সমান প্রচারের সুযোগ, সভা-সমাবেশ, পোস্টার ইত্যাদির ব্যাপারে নির্দেশনা থাকতে হবে, যেন সবাই নির্ভয়ে তার কাজটা করতে পারে।

নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ও কার্যকর থাকবে, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ভোট গ্রহণ, গণনা ও ফল ঘোষণায় স্বচ্ছতা না থাকলে পরবর্তীকালে নির্বাচন কমিশনের সদস্যদেরই তার জবাবদিহি করতে হবে। নিকট-অতীতে এই অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর নয়। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে, তাদের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, কাউকে ছাড় না দেওয়া।

নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় আসুক। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন হোক, ক্ষমতার রদবদল হোক সাংবিধানিকভাবে। আবার নির্বাচন হোক, সবাই তাতে যুক্ত হোক, উৎসবমুখর পরিবেশে সবাই নির্বাচনী প্রচারণা চালাক, ভোটার নির্ভয়ে তাঁর রায় প্রদান করুন। ফিরে আসুক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এবং সেই সঙ্গে মহান মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিক নির্বাচিত সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটাক্ষ করার প্রবণতা বন্ধ হোক।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘কোম্পানির লোকেরাই আমার ভাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে’

আমি লজ্জিত, নিজেকে মাটিতে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে—ফেসবুকে প্রেস সচিব

তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ

গণমাধ্যমে হামলা ও ময়মনসিংহে নৃশংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না, সরকারের বিবৃতি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

শোয়েব সাম্য সিদ্দিক
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি
বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। ফাইল ছবি

২০২৫ সালে বাজারে ঢুকলেই যে চাপ লাগে, তা শুধু দামের নয়, মানুষের দৈনন্দিন লড়াইয়ের অনুভূতিও। আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, গম, সয়াবিন তেল, ডাল, চিনিসহ প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম ২০২৩ সালের তুলনায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ কমেছে। এফএওর খাদ্যমূল্য সূচক ২০২৪ সালে টানা ১২ মাস কমেছে এবং ২০২৫ সালেও সেই ধারা চলছে। কিন্তু বাংলাদেশে একই সময়ে মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম স্থির হয়নি বরং অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেড়েছে। এই অদ্ভুত বৈপরীত্যই আমাদের বাজারব্যবস্থার গভীর সমস্যার দিকগুলো তুলে ধরে।

এই প্রশ্ন আমার কাছে অর্থনীতির শুষ্ক বিশ্লেষণ নয়, এটি মানুষের প্রতিদিনের সংগ্রামের বাস্তব গল্প। বাজারে যাওয়ার আগে মানুষ ভাবে আজ কি একটু স্বস্তি মিলবে? মাছ, চাল, ডাল, তেল—এসবের দাম গত পাঁচ বছরে যে মাত্রায় বেড়েছে, তা কেবল সংখ্যা নয়, তা মানুষের জীবনমানের ক্ষয়, উদ্বেগ এবং অনিশ্চয়তার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববাজারে দাম কমলেও আমাদের দেশে কেন কমছে না—এই সাধারণ প্রশ্নটাই এখন নীতিনির্ধারণের সবচেয়ে জরুরি আলোচ্য হওয়া উচিত।

আমার পর্যবেক্ষণে প্রধান সমস্যা শুরু হয় আমদানি ও সরবরাহব্যবস্থার অদক্ষতা দিয়ে। যেসব দেশে বৈশ্বিক মূল্যহ্রাস দ্রুত বাজারে প্রতিফলিত হয়, সেখানে কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় গড়ে দুই থেকে পাঁচ দিন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশে একই কাজ সম্পন্ন করতে গড়ে ১০ থেকে ১২ দিন লাগে। বন্দরে অতিরিক্ত অপেক্ষা, ডেমারেজ চার্জ, শিপিং বিলম্ব এবং কাগজপত্রের জটিলতা যোগ হতে হতে আমদানি করা পণ্যের খরচ বাড়তেই থাকে। ফলে বিদেশে দাম কমলেও দেশে খুচরা পর্যায়ে সেই সুবিধা ভোক্তার সামনে পৌঁছায় না।

দ্বিতীয় সমস্যা টাকার অবমূল্যায়ন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টাকার মান ২০২৩ সালের তুলনায় প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম ২০২৪ থেকে ২০২৫ সময়ে প্রায় ১৪ শতাংশ কমলেও বাংলাদেশে তেলের দাম কমেনি। কারণ, আমদানি মূল্য ডলারে নির্ধারিত হয়। টাকার অবমূল্যায়ন বৈশ্বিক মূল্যহ্রাসকে দেশের বাজারে প্রায় নিষ্ফল করে দেয়।

তৃতীয় সমস্যা প্রতিযোগিতাহীন বাজার। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ দেখিয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সময়ে চাল, তেল, চিনি, ডালসহ প্রধান পণ্যের বাজার কিছুসংখ্যক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাজারে নতুন আমদানিকারক বা পরিবেশকদের প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলে মূল্যহ্রাসের চাপ তৈরি হয় না। প্রতিযোগিতা না থাকলে দাম কমার বদলে একই থাকে। আমার মতে, এই বাজারসংকোচনই মূলধারার ভোক্তামূল্যকে দীর্ঘমেয়াদি অস্থির অবস্থায় আটকে রাখে।

চতুর্থ বড় সমস্যা তদারকি দুর্বলতা। ভোক্তা অধিদপ্তর বা প্রশাসনের হঠাৎ অভিযান বাজারে সাময়িক প্রভাব ফেলে, কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে সব আগের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ, একটি স্থায়ী, তথ্যভিত্তিক, নিয়মচালিত তদারকি ব্যবস্থা নেই। প্রতিটি বাজারে মূল্য পরিবর্তনের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ এবং কড়াকড়িভাবে প্রয়োগ করতে না পারলে সিন্ডিকেটের পক্ষে কৃত্রিম মূল্য নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা সহজ হয়ে পড়ে।

পঞ্চমত, তথ্যের অস্বচ্ছতা। বিবিএস, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং টিসিবির মূল্যতথ্য একই সময়ে এক নয়। কোন জেলায় কত স্টক আছে, আমদানি করা পণ্য বন্দরে কোথায় আছে, কোন ব্যবসায়ী কতটুকু মজুত রেখেছে—এসব তথ্যের কেন্দ্রীয় ড্যাশবোর্ড বাংলাদেশে নেই। ফলে নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় অনুমানভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তথ্যহীনতা বাজারের স্বচ্ছতাকে দুর্বল করে এবং সিন্ডিকেটকে সুবিধা দেয়।

অনেকে বলবেন, শুধু অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়; রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সুয়েজ খাল-সংকট, পরিবহন ব্যয় ও বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাও প্রভাব ফেলে। সেটি সত্য। তবে ২০২৪ ও ২০২৫ সালে যখন খাদ্যমূল্য বিশ্বব্যাপী টানা নিম্নমুখী, তখন দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ এই সুবিধা ভোক্তার কাছে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ পারেনি, কারণ অভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল এবং নীতি সমন্বয় অনুপস্থিত।

২০২৫ সালে বাংলাদেশের ভোক্তারা কিছু মৌলিক পণ্যের জন্য এখনো আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ মূল্য দিচ্ছেন। সিপিডি জানিয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্ববাজারে চিনির গড় দাম কেজিতে ৫০ থেকে ৬০ টাকা হলেও বাংলাদেশে সেটি ছিল ১৩০ থেকে ১৬০ টাকা। সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১০৫ থেকে ১১৫ টাকা কেজি থাকলেও বাংলাদেশে একই সময়ে ১৫০ থেকে ১৬৫ টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা মানুষের জীবনযাত্রাকে চরম অনিরাপদ করে তুলছে। আমার নিজের পর্যবেক্ষণ বলে, মধ্যবিত্তের মাস শেষে ঘাটতি স্থায়ী রূপ নিয়েছে, নিম্নবিত্তের খাদ্য গ্রহণ কমেছে, আর দরিদ্র মানুষের হাতে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার সামর্থ্য কমে গেছে।

আমার মতে সমাধান সুস্পষ্ট, বাস্তবসম্মত এবং তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়নযোগ্য। কাস্টমস ও আমদানি প্রক্রিয়ার পূর্ণাঙ্গ ডিজিটালাইজেশন জরুরি, কারণ বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হয় বন্দরের অকার্যকারিতা ও কাগজপত্রের জটিলতা থেকে। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় যদি বর্তমান ১০ থেকে ১২ দিন থেকে কমিয়ে ৪৮ ঘণ্টায় আনা যায়, তবে আমদানি করা পণ্যের মোট ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ডিজিটাল ট্র্যাকিং, অটোমেটেড ডকুমেন্ট যাচাই এবং ঝামেলামুক্ত অনলাইন অনুমোদনব্যবস্থা চালু করলে পণ্যের প্রবাহ দ্রুত হবে, মজুত ব্যয় কমবে এবং খুচরা বাজারে দাম স্বাভাবিকভাবে নেমে আসবে। একইভাবে বাজারে নতুন আমদানিকারক ও পরিবেশকের প্রবেশ সহজ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান বাজারকাঠামোতে কিছু গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে এবং নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি লাইসেন্স, এলসি বা বিতরণ নেটওয়ার্ক তৈরি করতে গিয়ে নানা বাধার মুখে পড়েন। এই বাধা দূর করতে পারলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দাম কমার স্বাভাবিক চাপ তৈরি হবে, যেটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ ইতিমধ্যে সফলভাবে বাস্তবায়ন করেছে। পাশাপাশি একটি কেন্দ্রীয় মূল্যতথ্য ড্যাশবোর্ড তৈরি করা জরুরি, কারণ কোথায় কত স্টক আছে, কোন পণ্য কখন বন্দরে এসেছে বা ছাড় হয়েছে এবং কোন স্তরে দাম বাড়ছে বা কমছে—এসব তথ্য বর্তমানে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় নীতি গ্রহণে বিলম্ব হয়। একক ড্যাশবোর্ডে আমদানি থেকে খুচরা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ রিয়েল-টাইমে দেখা গেলে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেওয়া সম্ভব হবে, অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি শনাক্ত করা সহজ হবে এবং বাজারে কারসাজির সুযোগ কমে যাবে। পাশাপাশি ভোক্তা অধিদপ্তরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্থায়ী, পেশাদার ও তথ্যনির্ভর তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ, ডেটা অ্যানালিটিকস ব্যবহার, ক্ষমতায়ন এবং বড় ব্যবসা-গোষ্ঠীর অনিয়ম শনাক্তের পর দ্রুত শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। এমন স্থায়ী নজরদারি নিশ্চিত করা গেলে কোনো সিন্ডিকেট দীর্ঘ সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না এবং দাম স্বাভাবিকভাবেই নেমে আসবে।

সবশেষে বলতে হয়, বাজার কেবল অর্থনীতির হিসাব নয়, এটি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, নিম্নবিত্তের অপূর্ণতা এবং দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন লড়াই, সবকিছু মিলেই বাজারকে মানবিকভাবে বুঝতে হবে। নীতি যদি মানুষের মুখের আহার না বোঝে, তবে সেই নীতি অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখতে পারে না। বিশ্ববাজারে দাম কমছে, কিন্তু বাংলাদেশে কমছে না। এটি বাজারের সমস্যা নয়, নীতির সমস্যা। আমরা চাইলে এই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে মানুষের কষ্ট কমবে, বাজার ঠিক হবে এবং অর্থনীতি আরও স্থিতিশীল পথে ফিরবে। এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘কোম্পানির লোকেরাই আমার ভাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে’

আমি লজ্জিত, নিজেকে মাটিতে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে—ফেসবুকে প্রেস সচিব

তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ

গণমাধ্যমে হামলা ও ময়মনসিংহে নৃশংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না, সরকারের বিবৃতি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

যা করণীয়

সম্পাদকীয়
যা করণীয়

বিজয় দিবস পার হলো। আরও একটি বিজয়ের আনন্দ যুক্ত হলো স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের মনে। যদিও এই বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধপক্ষের নানা প্রচারণার দেখা পাওয়া গেছে, কিন্তু দেশের মানুষ তাতে খুব বেশি বিভ্রান্ত হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখন পর্যন্ত এতটাই সজীব যে, ইচ্ছে করলেই এই ইতিহাসকে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা যাবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যারা প্রশ্ন তোলে, তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। অতি সুকৌশলে এমন সব প্রশ্নের জন্ম দেওয়া হয়, যার উত্তর তারা নিজেরা জানলেও সে উত্তরকে আড়ালে রেখে নতুন বয়ান তৈরির ধূর্ততাও পরিলক্ষিত হয়। সম্প্রতি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায় পাকিস্তানি হানাদার ও আলবদর, আলশামসের কাঁধ থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই কাজটি মূলত তারাই করতে চাইছে, যারা একাত্তরের পরাজয়ের গ্লানি এখনো হজম করে উঠতে পারেনি। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে বাংলাদেশের সূত্রের কাছে না গেলেও চলবে। আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরকারী পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজি এবং সে সময়ের ভয়ংকর দানব হয়ে ওঠা রাও ফরমান আলী তাদের বইগুলোয় একে অপরকে দোষারোপ করতে গিয়ে নিজেদের ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস করে দিয়েছেন। নিয়াজির অফিসের সামনে রাও ফরমান আলী দেখেছেন কাদালেপা মাইক্রোবাস, রাও ফরমান আলীর ডায়েরিতে দেখা গেছে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। কেউ কেউ রাও ফরমান আলীকে অনুরোধ করে সেই তালিকা থেকে বুদ্ধিজীবীদের নাম কাটিয়েছেন বলেও প্রমাণ আছে। এই যখন অবস্থা, তখন বাংলাদেশে বসে বাংলাদেশেরই শিক্ষিত কোনো মানুষ একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে না বলে মত প্রকাশ করলে তা সত্যের অপলাপই হয়। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার ন্যক্কারজনক প্রয়াস হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যোগ্য।

বাংলা ও বাঙালির বীরত্বগাথাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলার এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা জরুরি। দেশের ক্ষমতা যার হাতে থাকে, সে-ই নিজের ইচ্ছেমতো ইতিহাস রচনা করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায়, ইতিহাসের সত্যগুলো প্রকাশিত হবেই। স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে আসা স্বাধীনতার সময়টিতে কার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়, কার ওপর দেশবাসী রেখেছিল আস্থা, পাকিস্তানিদের চালানো অপারেশন সার্চলাইট, সার্চ অ্যান্ড ডেস্ট্রয় এবং বুদ্ধিজীবী হত্যার বর্ণনা পাওয়া কঠিন কোনো কাজ নয়। বাঙালির এই জনযুদ্ধকে খাটো করে দেখানো কিংবা পাকিস্তানি বাহিনীর মহিমাকীর্তন কোনো ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে পারবে না। সব পক্ষের উচিত, ইতিহাসের সত্যকে আড়াল না করে নতুন করে জীবন গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা।

আমাদের দেশ একটা অস্থির সময় পার করছে। এই সময়টিতে পুরো জাতির ঐক্য প্রয়োজন। কিন্তু গণ-আন্দোলনে বিজয়ী পক্ষ এত বেশি বিভক্ত হয়ে রয়েছে যে তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে জাতীয় সব অঙ্গনে স্থিতিশীলতা আসবে—এমন আশা এখন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পাচ্ছে না। ন্যূনতম কিছু বিষয়ে একমত হতে হলে জাতিকে সামগ্রিকভাবেই দেখতে হবে। সেদিকেই হতে হবে দেশের যাত্রা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

‘কোম্পানির লোকেরাই আমার ভাইকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছে’

আমি লজ্জিত, নিজেকে মাটিতে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে—ফেসবুকে প্রেস সচিব

তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার সম্পাদকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ফোনালাপ

গণমাধ্যমে হামলা ও ময়মনসিংহে নৃশংসতায় জড়িতদের ছাড় দেওয়া হবে না, সরকারের বিবৃতি

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত