Ajker Patrika

কৃত্রিম রক্ত তৈরির কতটা কাছে বিজ্ঞানীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন জোর কদমে। প্রতীকী ছবি
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত উৎপাদনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন জোর কদমে। প্রতীকী ছবি

বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম রক্ত উৎপাদনের গবেষণা চালাচ্ছেন, যাতে রক্তের ঘাটতি মোকাবিলা করা এবং নিরাপদ ট্রান্সফিউশন অর্থাৎ রক্ত দান নিশ্চিত করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর লাখো মানুষ রক্তের অভাবে মারা যায়। রক্ত শরীরের জন্য অক্সিজেন পরিবহন ও বর্জ্য অপসারণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে।

কৃত্রিম রক্ত তৈরির ক্ষেত্রে ২০২২ সালে এক বড় অগ্রগতি অর্জিত হয়। সে বছর বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে তৈরি রক্ত প্রথমবারের মতো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ব্যবহার করেন। বিশেষ করে, বিরল রক্তের গ্রুপের রোগীদের জন্য এই ট্রায়াল চালানো হয়। গবেষকেরা জরুরি চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার এবং ট্রান্সফিউশনের জন্য কৃত্রিম রক্ত তৈরির কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন।

কৃত্রিম রক্ত দুই ধরনের—‘ল্যাব-গ্রোথ ব্লাড’ ও ‘সিনথেটিক ব্লাড’। সিনথেটিক ব্লাড সম্পূর্ণভাবে মানুষের কোষবিহীন অর্থাৎ এটি মানব শরীরের কোনো কোষের মতো নয় এবং এটি অক্সিজেন পরিবহনের মাধ্যমে রক্তকণিকার ভূমিকা অনুকরণ করে। এটি মূলত জরুরি চিকিৎসা ও সামরিক ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে, যেখানে রক্তের ধরন মেলানো কঠিন।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ‘এরিথ্রোমার’ নামক এক বিশ্বজনীন সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘সিনথেটিক ব্লাড’ প্রকল্পে ৪৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। এই সিনথেটিক ব্লাড শীতলীকরণ ছাড়াই স্থিতিশীল থাকে। তবে এই বিষয়ে গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। সিনথেটিক ব্লাডের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে গবেষণা এখনো চলমান।

অন্যদিকে, ল্যাব-গ্রোথ ব্লাড হলো—নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মানুষের শরীরের কোষ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন মেডিসিনের অধ্যাপক সেড্রিক গেভার্ট বলেন, ‘একবার বাজারে আসরে, পরীক্ষাগারে তৈরি রক্তকোষ নির্দিষ্ট কিছু রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা আরও বৃদ্ধি করতে পারে।’ উদাহরণ হিসেবে সেড্রিক গেভার্ট বলেন, ল্যাব-গ্রোথ প্লাটিলেট শরীরে আঘাতপ্রাপ্ত রোগীদের রক্তপাত বন্ধ করতে কার্যকর হতে পারে।

এই প্রক্রিয়াটি শুরু হয় হেমাটোপয়েটিক স্টেম সেলে। এটি লোহিত ও শ্বেত রক্তকণিকা এবং প্লাটিলেট তৈরি করে। এই স্টেম সেলগুলো অস্থিমজ্জা বা দাতার রক্ত থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং ল্যাবে কোষ বিকাশে সহায়ক উপাদানের সংস্পর্শে আনা হয়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এগুলো পরিপক্ব লোহিত রক্তকণিকায় পরিণত হয় এবং স্বাভাবিক রক্তকণিকার মতো কাজ করে।

বিজ্ঞানীরা স্টেম সেলে ‘জিন এডিট’ করে অর্থাৎ, জিনে পরিবর্তন এনে রক্ত উৎপাদন বাড়াতে এবং রক্তের গ্রুপ নির্ধারক চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন। এটি ভবিষ্যতে সর্বজনীন রক্তদাতার রক্ত তৈরির পথ সুগম করতে পারে। তবে ল্যাব-গ্রোথ ও সিনথেটিক ব্লাড এখনো গবেষণা ও উন্নয়ন পর্যায়ে আছে। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ল্যাব-গ্রোথ লোহিত রক্তকণিকা মানবদেহে প্রতিস্থাপন করা হয় এবং এর নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।

কৃত্রিম রক্ত তৈরিতে অন্যতম বড় বাধা খরচ। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা (ডারপা) জানায়, এক ইউনিট ল্যাব-গ্রোথ রক্ত উৎপাদনে ৯০ হাজার ডলারের বেশি খরচ হয়। উন্নত প্রযুক্তির ফলে এই ব্যয় কমে এখন প্রতি ইউনিট ৫ হাজার ডলারের নিচে এসেছে। কিন্তু তাও অনেক বেশি। কারণ, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাসপাতালগুলোতে যারা এক ইউনিট করে লোহিত রক্তকণিকা দান করেছেন তাদের গড়ে ২১৫ ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল।

২০২২ সালে জাপানে এক গবেষণায় ‘হিমোগ্লোবিন ভেসিকল’ বা ‘হিমোগ্লোবিন থলি’ পরীক্ষা করা হয়। এটি কৃত্রিম রক্তকণিকার মতো অক্সিজেন বহন করে। ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী ১২ জন সুস্থ পুরুষকে বিভিন্ন মাত্রার ইনজেকশন দেওয়া হয়। কয়েকজনের সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, যেমন জ্বর ও চর্মরোগ দেখা দিলেও তা দ্রুত সেরে যায়। তবে রক্তচাপসহ গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন দেখা যায়নি।

বাণিজ্যিক উৎপাদনেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। যার মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—বৃহৎ পরিসরে নিরাপদ ও কার্যকর উৎপাদন। নিয়ন্ত্রক সংস্থার শ্রেণিবিভাগ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। গেভার্ট বলেন, ‘এটি যেকোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য এক নতুন ধরনের পণ্য, অর্থাৎ আমরা অজানা ক্ষেত্রে প্রবেশ করছি।’

যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এবং ইউরোপিয়ান মেডিসিনস এজেন্সি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, ল্যাব-গ্রোথ রক্তকে কোন শ্রেণিতে ফেলা হবে—‘সেল থেরাপি’ নাকি ‘ওষুধ’ হিসেবে। সিদ্ধান্ত যাই হোক না কে, বিষয়টি এই রক্তের অনুমোদন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।

ল্যাব-গ্রোথ রক্ত বিরল ব্লাড গ্রুপের জন্য পরিবর্তন করে নেওয়া যায়। সিনথেটিক রক্তে যেহেতু কোনো কোষ নেই ফলে এটি বিশেষ কোনো ব্লাড গ্রুপের ওপর নির্ভর করে না। আর তাই এটি সম্ভাব্যভাবে সর্বজনীন ট্রান্সফিউশনের বিকল্প হতে পারে। এ, বি এবং ও গ্রুপ এবং রেসাস ব্লাড গ্রুপের বাইরেও বিজ্ঞানীরা ৩৬টি ভিন্ন ব্লাড গ্রুপ সিস্টেম চিহ্নিত করেছেন, যেখানে ৬ শতাধিক অনন্য অ্যান্টিজেন আছে। বিরল ব্লাড গ্রুপের ক্ষেত্রে সাধারণ অ্যান্টিজেন অনুপস্থিত থাকে বা বিশেষ অ্যান্টিজেন থাকে, যা দাতার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন করে তোলে।

বিরল রক্তের ধরন অঞ্চল ও জাতিগোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, ‘Bombay blood’ যা ‘ও’ ব্লাড গ্রুপের একটি বিরল উপপ্রকরণ। এটি বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে মাত্র এক বা তারও কম মানুষের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে এটি ভারত, ইরান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তুলনামূলক বেশি।

বিশ্বজুড়ে রক্তের ঘাটতি মেটাতে কৃত্রিম রক্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর গড়ে ১১ দশমিক ৮৫ কোটি ইউনিট দান করা রক্ত রক্তদান সংগ্রহ করা হয়, যার ৪০ শতাংশই আসে উচ্চ আয়ের দেশগুলো থেকে, যদিও এসব দেশের জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য গড়ে ২ হাজার ইউনিট রক্তের প্রয়োজন। তবে সাব-সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও ওশেনিয়ায় চরম ঘাটতি আছে রক্ত প্রাপ্যতার।

রক্ত প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে গ্রামীণ এলাকাগুলো বিশেষভাবে পিছিয়ে, যেখানে ৭৫ শতাংশ রোগী রক্ত পায় না। এটি মূলত মজুত ও বিতরণ ব্যবস্থার সমস্যা, সরবরাহের নয়। অনেক অঞ্চলে ব্লাড ব্যাংক কয়েক ঘণ্টার দূরত্বে থাকায় চিকিৎসকদের জীবন রক্ষাকারী অস্ত্রোপচার স্থগিত বা বাতিল করতে হয়।

গেভার্ট কৃত্রিম রক্তের সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, ‘ল্যাবে উৎপাদিত রক্তের অন্যতম প্রধান সুবিধা হলো এর মূল্য সংকটময় পরিস্থিতিতে, যেমন—মহামারি, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যখন হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যায় তখন।’ যাই হোক, গবেষণায় অগ্রগতি হলেও কৃত্রিম রক্ত এখনো উন্নয়নের পর্যায়েই আছে। বাণিজ্যিকভাবে কার্যকর হতে গবেষণা, ব্যয় হ্রাস ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

জোট বেঁধে শিকার ধরতে ছুটছে কিলার হোয়েল ও ডলফিন, বিস্মিত বিজ্ঞানীরা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬: ৪০
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন। ছবি: ইউবিসি

ব্রিটিশ কলম্বিয়ার উপকূলে একদিন। স্যামন মাছের ঝাঁক পড়িমড়ি করে ছুটতে দেখা গেল। তাদের পিছেই চোখে পড়ল কিলার হোয়েল নামে পরিচিত অরকা ও হোয়াইট–সাইডেড ডলফিনের দলকে। তাও আবার একসঙ্গে! এই দুই শিকারী প্রাণীকে জোটবেঁধে স্যামন শিকারে ছুটতে দেখে যারপরনাই বিস্মিত বিজ্ঞানীরা। শিকার একই হওয়ায় দুই শিকারী জোট বেঁধেছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এ নিয়ে একটি গবেষণাও প্রকাশিত হয়েছে। সায়েন্টিফিক রিপোর্টস সাময়িকীতে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, এই দুই শিকারি প্রাণীর মধ্যে হয়তো একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।

গবেষকেরা বলছেন, ‘কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া উপকূলে প্যাসিফিক হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন ও নর্দার্ন রেসিডেন্ট কিলার হোয়েলের মধ্যে এ ধরনের একটি রহস্যজনক সম্পর্ক দেখা যায়, যেখানে এই দুই সিটাসিয়ান প্রজাতিকে প্রায়ই একে অপরের কয়েক মিটারের মধ্যেই দেখা যায়।’

ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লাইবনিজ ইনস্টিটিউট ও হাকাই ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কাজ করা বিজ্ঞানীরা ড্রোন ভিডিও ও শব্দগত রেকর্ডিং সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে জানান, এই প্রথম অরকা ও ডলফিনের এভাবে খাদ্য চাহিদা পূরণে যৌথভাবে কাজ করতে দেখা গেল।

গবেষণার প্রধান লেখক সারা ফরচুন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘স্যামন শিকারের পারদর্শিতায় শীর্ষস্থানে রয়েছে এই তিমিগুলো। তারা অত্যন্ত দক্ষ ও বিশেষায়িত শিকারি। মনে হচ্ছিল ডলফিনগুলো তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। অরকাদের এভাবে ডলফিনের অনুসরণ করতে দেখা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত আর ভীষণ রোমাঞ্চকর।’

দুই শিকারির মধ্যে সদ্য গড়ে ওঠা এই সম্পর্কের কারণ নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। একটি সম্ভাবনা হলো ক্লেপ্টোপ্যারাসিটিজম, যেখানে ডলফিনেরা অরকার শিকার ছিনিয়ে নিতে পারে।

আরেকটি ব্যাখ্যা হতে পারে, ডলফিনেরা স্তন্যপায়ীভোজী ট্রানসিয়েন্ট কিলার হোয়েল এবং কিছুটা কম মাত্রায় বড় হাঙরের হাত থেকে সুরক্ষা পেতে এই সম্পর্ক গড়ে তুলছে।

তবে সারা ফরচুনের মতে, যদি ডলফিনেরা পরজীবীর মতো আচরণ করত, তাহলে সদ্য ধরা শিকার নিয়ে সাধারণত অত্যন্ত রক্ষণশীল কিলার হোয়েলেরা এতটা শান্ত থাকত না, যেমনটি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে। এতে গবেষকদের সামনে সবচেয়ে জোরালো ব্যাখ্যাটি উঠে এসেছে, এই দুই শিকারি আসলে পরস্পরকে সহযোগিতা করছে।

সারা ফরচুন আরও বলেন, ‘অরকাগুলো নিজেদের অবস্থান এমনভাবে নিচ্ছিল, যেন তারা ডলফিনদের অনুসরণ করছে। ফলে ডলফিনদেরই নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখা যাচ্ছিল। বিষয়টি আমাদের আরও গভীরভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং আসলে কী ঘটছে তা বোঝার চেষ্টা করতে আগ্রহী করে তোলে।’

এই সহযোগিতা নিয়ে রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে, কারণ নর্দার্ন রেসিডেন্ট অরকারা মূলত স্যামন শিকারে বিশেষজ্ঞ আর হোয়াইট–সাইডেড ডলফিন সাধারণত হেরিং ও অ্যাঙ্কোভির মতো ছোট মাছ খেয়ে থাকে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

ফ্রান্সে সমুদ্রতলে কিংবদন্তির শহর, ৭০০০ বছর আগের বিশাল প্রাচীরের সন্ধান

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
সমুদ্রতলে ৭ হাজার বছর ধরে টিকে আছে এক বিশাল পাথুরে দেয়াল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
সমুদ্রতলে ৭ হাজার বছর ধরে টিকে আছে এক বিশাল পাথুরে দেয়াল। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

ফ্রান্সের ব্রিতানি উপকূলের কাছে সমুদ্রের গভীরে এক বিশাল পাথরের প্রাচীরের সন্ধান মিলেছে। এই প্রাচীন প্রায় ৭ হাজার বছর আগে—অর্থাৎ ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফরাসি সামুদ্রিক প্রত্নতাত্ত্বিকেরা ধারণা করছেন, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধির কারণে যে প্রস্তর যুগের সমাজ এই এলাকা থেকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল, এই আবিষ্কার হয়তো সেই সমাজেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। সেখানে তলিয়ে যাওয়া শহরের প্রচলিত কিংবদন্তির নিদর্শনও হতে পারে এই প্রাচীর।

১২০ মিটার দীর্ঘ এই প্রাচীর ফ্রান্সের জলসীমায় পাওয়া সমুদ্রতলের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, এটি হয়তো মাছ ধরার জন্য এক ধরনের ফাঁদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, অথবা সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান জলস্তর থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাঁধ হিসেবে নির্মিত হয়েছিল।

প্রাচীরটি ব্রিতানির পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ইলে দে সঁ-এর উপকূলে আবিষ্কৃত হয়েছে। সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের চিহ্ন এখনো বহন করছে এই প্রাচীর। বর্তমানে প্রাচীরটি প্রায় নয় মিটার গভীরে ডুবে আছে। দ্বীপটি আগের আকারের তুলনায় অনেকটাই ছোট হয়ে গেছে, সমুদ্রের পানিস্তর বৃদ্ধির এটি বড় প্রমাণ।

প্রাচীরটির গড় প্রস্থ প্রায় ২০ মিটার এবং উচ্চতা দুই মিটার। নিয়মিত ব্যবধানে ডুবুরিরা এর মধ্যে বড় গ্রানাইট পাথর বা মনোলিথ-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো দুটি সমান্তরাল রেখায় প্রাচীরের ওপরে উঁচু হয়ে আছে। মনে করা হচ্ছে, এই মনোলিথগুলোই প্রাচীরের মূল ভিত্তি হিসেবে শিলাস্তরের ওপর স্থাপন করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে স্ল্যাব ও ছোট পাথর দিয়ে তাদের ঘিরে প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। যদি মাছ ধরার ফাঁদ হিসেবে ব্যবহারের অনুমানটি সঠিক হয়, তাহলে বলা যায়, মনোলিথগুলোতে জোয়ারের পানি নেমে যাওয়ার সময় মাছ ধরার জাল বেঁধে রাখা হতো।

প্রাচীরটির মোট ভর প্রায় ৩ হাজার ৩০০ টন। প্রত্নতাত্ত্বিক ইভান পাইয়ার বলেন, এই বিশাল নির্মাণ একটি সুসংগঠিত সমাজের কাজ হতে পারে। মূলত শিকারি-সংগ্রাহক (হান্টার গ্যাদারার) জনগোষ্ঠী এটি নির্মাণ করেছে, যারা সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় স্থিতিশীল জীবনযাপন শুরু করেছিল। অথবা, এটি ছিল ৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এই অঞ্চলে আসা নব্যপ্রস্তর যুগের জনগোষ্ঠীর নির্মাণ।

পাইয়ারের মতে, মনোলিথগুলো নব্যপ্রস্তর যুগের বিখ্যাত মেনহিরগুলোর চেয়েও প্রাচীন। ফলে এটি পাথর উত্তোলন, কাটা এবং পরিবহনের জ্ঞান তৎকালীন শিকারি-সংগ্রাহক সমাজ থেকে পরবর্তী নব্যপ্রস্তর যুগের কৃষকদের কাছে স্থানান্তরিত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়।

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব নটিক্যাল আর্কিওলজিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এই আবিষ্কার স্থানীয় ব্রেটোন কিংবদন্তিগুলোর উৎস হতে পারে। যেমন, ব্রিতানির উপকূলে অবস্থিত বে অব দোয়ারনেনেজ-এর আশপাশে ডুবে যাওয়া শহর ইশ (Ys)-এর কিংবদন্তি। গবেষকদের মতে, একটি অত্যন্ত সুসংগঠিত সমাজ দ্বারা গঠিত অঞ্চলের বিলুপ্তি মানুষের স্মৃতিতে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। সমুদ্রের জলস্তর দ্রুত বৃদ্ধির ফলে মাছ ধরার কাঠামো, প্রতিরক্ষামূলক কাজ এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনাগুলো সম্ভবত স্থানীয় মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ ফেলেছিল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

পূর্বের ধারণারও সাড়ে ৩ লাখ বছর আগে মানুষের আগুন জ্বালানোর প্রমাণ মিলল

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
প্রতীকী ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
প্রতীকী ছবি: দ্য গার্ডিয়ান

এত দিন ধরে বিজ্ঞানীরা মেনে এসেছেন প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মানুষ আগুন তৈরি বা ব্যবহার করতে শিখেছিল। কিন্তু নতুন একটি আবিষ্কার সেই ধারণা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সাফোক অঞ্চলের বার্নহাম এলাকায় পাওয়া প্রমাণ বলছে, মানুষ প্রায় ৪ লাখ বছর আগে আগুন তৈরি করত—অর্থাৎ পূর্ব ধারণার তুলনায় প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার বছর আগেই মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছিল।

গবেষকদের পাওয়া প্রমাণগুলোর মধ্যে রয়েছে পোড়া মাটি, আগুনে ফেটে যাওয়া হাতকুঠার এবং দুটি লৌহ সালফাইড (পাইরাইট) খণ্ড, যা ফ্লিন্টের সঙ্গে আঘাত করলে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইরাইট ওই এলাকায় প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায় না, অর্থাৎ দূর অঞ্চল থেকে এটি সংগ্রহ করা হয়েছিল আগুন জ্বালানোর উদ্দেশ্যে।

ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রত্নতাত্ত্বিক ড. রব ডেভিস বলেন, ‘মানব ইতিহাসে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও তৈরি করার ক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঁক। এটি শুধু আমাদের বাঁচতে সাহায্য করেনি, বরং সামাজিক যোগাযোগ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, শিকার প্রতিরোধ এবং ভাষার বিকাশেও ভূমিকা রেখেছে।’

গবেষকদের ধারণা, এই আগুন সৃষ্টি করেছিল সম্ভবত প্রাচীন নিয়ানডারথাল প্রজাতির মানুষ। কারণ ‘হোমো সেপিয়েন্স’ তথা বর্তমান মানুষের প্রজাতি তখনো আফ্রিকার বাইরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেনি।

এই আবিষ্কারটি মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আগুনের ভূমিকা আরও গভীর ও বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করেছে। গবেষক দলটির আরেক সদস্য প্রফেসর ক্রিস স্ট্রিঙ্গার বলেন, ‘এটি শুধু একটি আগুনের চিহ্ন নয়—এটি প্রমাণ করে আগুন ছিল তাদের জীবনযাপনের কেন্দ্রবিন্দু—খাবার ভাগাভাগি, গল্প বলা, মিথ তৈরির জায়গা।’

গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আবিষ্কার মানব সভ্যতার শুরুর কাহিনি বদলে দিতে পারে এবং আরও পুরোনো আগুন ব্যবহারের প্রমাণ খুঁজে পাওয়ারও পথ খুলে দিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

২০০ শিশুর জন্মের পর জানা গেল দাতার শুক্রাণুতে ছিল ক্যানসারের জিন

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­
একজন দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে অন্তত ১৯৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। ছবি: বিবিসি
একজন দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে অন্তত ১৯৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। ছবি: বিবিসি

‘স্পার্ম ডোনার’ বা শুক্রাণুদাতার ধারণাটি বিশ্বে নতুন নয়। অনেক পরিবারই শুক্রাণুদাতার সাহায্য নিয়ে বাবা-মা হয়েছেন। আবার অনেকে নিজ উদ্যোগে হাসপাতালগুলোতে শুক্রাণু দান করে থাকেন, যাতে এর মাধ্যমে কোথাও কোনো একটি পরিবার সন্তানের মুখ দেখতে পায়।

এমনই একজন দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে অন্তত ১৯৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। তবে ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ওই ব্যক্তির দেহে ছিল এমন এক জিনগত মিউটেশন যার কারণে ক্যানসারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। শুক্রাণুদাতা এ বিষয়টি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন। এক অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে জানা গেছে।

একজন দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে অন্তত ১৯৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। ছবি: বিবিসি
একজন দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে ইউরোপজুড়ে অন্তত ১৯৭টি শিশুর জন্ম হয়েছে। ছবি: বিবিসি

ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে বিবিসিসহ মোট ১৪টি সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম এই অনুসন্ধান পরিচালনা করেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই দাতার শুক্রাণু যুক্তরাজ্যের কোনো ক্লিনিকে সরবরাহ করা হয়নি। তবে ডেনমার্কে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার অংশ হিসেবে ব্রিটেনের অল্পসংখ্যক পরিবার ওই দাতার শুক্রাণু ব্যবহার করেছেন বলে বিবিসি জানিয়েছে। ওই পরিবারগুলোকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে।

ওই ব্যক্তির শুক্রাণু থেকে জন্ম হওয়া কিছু শিশু এরইমধ্যে মারা গিয়েছে। আর যারা উত্তরাধিকারসূত্রে এ মিউটেশন পেয়েছে, তাদের খুব কম সংখ্যকই আজীবন ক্যানসার এড়াতে সক্ষম হবে।

শুক্রাণু সরবরাহকারী ডেনমার্কের ‘ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক’ জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রতি তাদের গভীর সহমর্মিতা রয়েছে। কিছু দেশে একই দাতার শুক্রাণু দিয়ে অস্বাভাবিকভাবে বেশি সংখ্যক শিশুর জন্ম দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছে স্পার্ম ব্যাংকটি।

একজন বেনামি দাতার কাছ থেকে এসেছিল এই শুক্রাণুগুলো। পড়াশোনার খরচ জোগাতে ২০০৫ সাল থেকে তিনি শুক্রাণু দান করা শুরু করেন। প্রায় ১৭ বছর ধরে তাঁর শুক্রাণুর মাধ্যমে নারীরা মা হয়েছেন।

প্রায় ১৭ বছর ধরে এক দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে নারীরা মা হয়েছেন। ছবি: ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক
প্রায় ১৭ বছর ধরে এক দাতার শুক্রাণুর মাধ্যমে নারীরা মা হয়েছেন। ছবি: ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক

বিবিসি জানায়, শুক্রাণু দানের জন্য প্রয়োজনীয় সব স্ক্রিনিং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। তাঁকে শারীরিকভাবে সুস্থও ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ওই ব্যক্তি মায়ের গর্ভে থাকাকালেই তাঁর দেহের কিছু কোষের ডিএনএ-তে এই মিউটেশন ঘটে।

এই মিউটেশন তাঁর শরীরের টিপি ৫৩ (TP 53) জিনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা শরীরের কোষকে ক্যানসারগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দাতার দেহের বেশির ভাগ কোষে বিপজ্জনক টিপি ৫৩ মিউটেশন নেই, তবে তাঁর সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ শুক্রাণুতে এ মিউটেশন থাকতে পারে।

যেসব শুক্রাণুতে মিউটেশন আছে, সেগুলো ব্যবহার করে জন্ম নেওয়া যে কোনো সন্তানের দেহের প্রতিটি কোষেই এ জিনগত ত্রুটি থাকবে। এটি লি-ফ্রাউমেনি সিনড্রোম নামে পরিচিত।

এ অবস্থায় ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৯০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে শৈশব থেকেই ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে এবং পরবর্তী সময়ে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।

লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের ক্যানসার জেনেটিসিস্ট অধ্যাপক ক্লেয়ার টার্নবুল বিবিসিকে বলেন, ‘এটি এক ভয়াবহ খবর। একটি পরিবারের জন্য এই খবর অত্যন্ত কষ্টকর। আজীবন এ ঝুঁকি বয়ে নিয়ে বাঁচতে হয়, এটি নিঃসন্দেহে বেশ বড় ধাক্কা।’

এই সিনড্রোমে আক্রান্তদের প্রতি বছর পুরো শরীর ও মস্তিষ্কের এমআরআই স্ক্যানের পাশাপাশি পেটের আলট্রাসাউন্ড করাতে হয়, যাতে কোনো টিউমার থাকলে দ্রুত শনাক্ত করা যায়। ঝুঁকি কমাতে স্তন অপসারণের পথও বেছে নেন অনেক নারী।

ওই শুক্রাণুদাতা নিজে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা এ সংক্রান্ত কোনো সমস্যায় ভুগছেন না বলে জানিয়েছে ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক। তারা আরও জানায়, এ ধরনের মিউটেশন জেনেটিক স্ক্রিনিংয়ে আগাম ধরা যায় না। সমস্যাটি শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই দাতাকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে ব্লক’ করা হয়েছে।

শুক্রাণুদানের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে ক্যানসার ধরা পড়া নিয়ে এ বছর ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান জেনেটিকসের সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন চিকিৎসকেরা। তারা জানান, ওই সম্মেলনের আগ পর্যন্ত ওই দাতার শুক্রাণু থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে ৬৭ জনকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। যাদের মধ্যে ২৩ জনের দেহে বিপজ্জনক ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ শিশুর এরইমধ্যে ক্যানসার নির্ণয় হয়েছিল।

বিবিসি জানায়, স্বাধীন তথ্য অধিকার আইনের আবেদনের ভিত্তিতে প্রাপ্ত নথি এবং চিকিৎসক ও রোগীদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেছে, ওই দাতার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া সন্তানের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

অনুসন্ধান বলছে, সংখ্যাটি কমপক্ষে ১৯৭ জন। তবে এটিই চূড়ান্ত হিসাব নয়, কারণ সব দেশের তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। এদের মধ্যে ঠিক কতজন শিশু ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করা ওই মিউটেশনটি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে সেটি এখনো অজানা।

ফ্রান্সের রোয়াঁ ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ক্যানসার জেনেটিসিস্ট ড. এডউইগ ক্যাসপার এই অনুসন্ধানের প্রাথমিক তথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এমন বহু শিশু রয়েছে, যাদের ইতিমধ্যেই ক্যানসার দেখা দিয়েছে। এমনকি কিছু শিশুর সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ধরনের ক্যানসার হয়েছে এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন খুব অল্প বয়সেই মারা গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একজন শুক্রাণুদাতার মাধ্যমে সর্বোচ্চ কতটি শিশুর জন্ম দেওয়া যাবে তার সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া দরকার। আমি বলছি না, যেসব দাতার জিনোম পরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু যদি কারও কোনো ত্রুটি থাকে তাহলে জিনগত রোগ ছড়িয়ে পড়ার অস্বাভাবিক উদাহরণ তৈরি হবে। তেমনই এক ঘটনার সাক্ষী হলাম আমরা। ইউরোপে প্রত্যেক পুরুষের তো ৭৫টি সন্তান থাকে না!’

১৪ বছর আগে বেলজিয়ামে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার মাধ্যমে ওই দাতার শুক্রাণু ব্যবহার করে সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন ফ্রান্সের এক ‘সিংগেল মাদার’ সেলিন (ছদ্মনাম)। তাঁর সন্তানের দেহেও মিউটেশনটি পাওয়া গেছে। তিনি জানান, বেলজিয়ামের যে ফার্টিলিটি ক্লিনিকে তিনি চিকিৎসা নিয়েছিলেন সেখান থেকে একদিন ফোন করে তাঁর মেয়েকে দ্রুত স্ক্রিনিং করতে বলা হয়।

সেলিন বলেন, ‘দাতার প্রতি আমার একটুও ক্ষোভ নেই।’ তবে এটি সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য যে তাঁকে এমন শুক্রাণু দেওয়া হয়েছিল ঠিকমতো পরীক্ষিত ছিল না, নিরাপদ ছিল না এবং ঝুঁকি বহন করছিল।

এই ক্যানসারের চিন্তা সারাজীবনই তাড়া করে বেড়াবে বলে মনে করেন সেলিন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না কখন, জানি না কোন ধরনের বা কয়টি। তবে আমি বুঝতে পারছি সম্ভাবনা খুব বেশি। আর যখনই এটা হবে, আমরা লড়ব। আর যদি বারবার লড়তে হয়, আমরা প্রতিবার লড়াই করব।’

১৪টি সরকারি সম্প্রচার মাধ্যমের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ওই দাতার শুক্রাণু ১৪টি দেশের ৬৭টি ফার্টিলিটি ক্লিনিকে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে শুক্রাণুটি যুক্তরাজ্যের কোনো ক্লিনিকে বিক্রি করা হয়নি।

তবে এই অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে ডেনমার্কের কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্যের হিউম্যান ফার্টিলাইজেশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি অথরিটি (এইচএফইএ)-কে জানিয়েছে, ব্রিটিশ নারীরা ডেনমার্কে গিয়ে ওই দাতার শুক্রাণু ব্যবহার করে ফার্টিলিটি চিকিৎসা নিয়েছেন। আর ওই নারীদের এ বিষয়ে জানানো হয়েছে।

এইচএফইএ-এর প্রধান নির্বাহী পিটার থম্পসন জানিয়েছেন, ‘খুব অল্পসংখ্যক নারী এতে প্রভাবিত হয়েছেন এবং তাদেরকে চিকিৎসা দেওয়া ডেনমার্কের ক্লিনিক থেকে দাতার বিষয়টি জানানো হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জানি না, যুক্তরাজ্যের কোনো নারী অন্য দেশে গিয়ে এ সংক্রান্ত চিকিৎসা নিয়েছিলেন কিনা, যেখানে ওই দাতার শুক্রাণু সরবরাহ করা হয়েছিল।’

ওই দাতার পরিচয় প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিবিসিসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলো। তারা বলছে, তিনি সৎ মনোভাবের সঙ্গে দান করেছিলেন এবং যুক্তরাজ্যের পরিচিত সব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, এক দাতার শুক্রাণু কতবার ব্যবহার করা যেতে পারে এ নিয়ে কোনো বৈশ্বিক আইন নেই। তবে পৃথক পৃথকভাবে দেশগুলো নিজেদের সীমা নির্ধারণ করে থাকে।

কিছু দেশে ‘দুর্ভাগ্যবশত’ এই সীমা লঙ্ঘন হয়েছে বলে স্বীকার করেছে ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক। তারা জানায়, এ নিয়ে ডেনমার্ক ও বেলজিয়ামের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

বিবিসির প্রতিবেদনে জানা যায়, বেলজিয়ামে একজন শুক্রাণুদাতা সাধারণত ছয়টি পরিবারকে শুক্রাণু দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ৩৮ জন ভিন্ন নারী ওই দাতার মাধ্যমে ৫৩টি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন।

অধ্যাপক অ্যালান পেসি শেফিল্ড স্পার্ম ব্যাংক পরিচালনা করতেন। বর্তমানে তিনি ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অব বায়োলজি, মেডিসিন অ্যান্ড হেলথের ডেপুটি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, দেশগুলো বড় আন্তর্জাতিক স্পার্ম ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যুক্তরাজ্যের অর্ধেক শুক্রাণু এখন আমদানি করা হয়।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের বড় আন্তর্জাতিক স্পার্ম ব্যাংক থেকে আমদানি করতে হয়, যারা একই সঙ্গে এটি অন্যান্য দেশেও বিক্রি করে, কারণ এভাবেই তারা অর্থ উপার্জন করে। এখান থেকেই সমস্যা শুরু হয়, কারণ একজনের স্পার্ম কতবার ব্যবহার করা যাবে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক আইন নেই।’

অধ্যাপক অ্যালান পেসি শেফিল্ড জানান, শুক্রাণুতে ক্যানসারের ঝুঁকি থাকার ঘটনা সবার জন্যই ভয়ঙ্কর। শুক্রাণুকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ করা সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, ‘সব কিছু স্ক্রিন করা সম্ভব নয়। বর্তমান স্ক্রিনিং ব্যবস্থায় যারা শুক্রাণুদাতা হতে আবেদন করে, আমরা মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশকে গ্রহণ করি। তাই যদি আরও কঠোর করি, তবে আর কোনো শুক্রাণুদাতা বাকি থাকবে না।’

সম্প্রতি ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব হিউম্যান রিপ্রোডাকশন অ্যান্ড এমব্রায়োলজি প্রতি দাতার জন্য সীমা ৫০টি পরিবার পর্যন্ত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে তারা বলেছে, এতে বিরল জিনগত রোগ উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়ার ঝুঁকি কমবে না। বরং এটি সেই শিশুদের কল্যাণের জন্য ভালো হবে, যারা জানবে তারা শত শত অর্ধ-ভাইবোনের (হাফ-সিবলিংস) মধ্যে একজন।

বন্ধ্যাত্ব ও জিনগত সমস্যায় আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করা স্বতন্ত্র দাতব্য সংস্থা প্রোগ্রেস এডুকেশনাল ট্রাস্টের পরিচালক সারাহ নর্ক্রস বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী একই দাতার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া পরিবারের সংখ্যা কমানোর জন্য আরও কাজ করা প্রয়োজন। আমরা সম্পূর্ণরূপে জানি না, এই শত শত অর্ধ-ভাইবোন থাকা সামাজিক ও মানসিকভাবে কী প্রভাব ফেলবে। তবে এটি মানসিক আঘাতও সৃষ্টি করতে পারে।’

তবে ইউরোপিয়ান স্পার্ম ব্যাংক বলছে, এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে এটাও মনে রাখতে হবে যে দান করা শুক্রাণু ছাড়া হাজার হাজার নারী ও দম্পতির সন্তান হওয়ার সুযোগ নেই।

তারা বলছে, তবে শুক্রাণুদাতাদের চিকিৎসাগত নির্দেশিকার ভিত্তিতে স্ক্রিনিং নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দাতার শুক্রাণুর সাহায্যে সন্তান নেওয়া তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হবে।’

সারাহ নর্ক্রস বলেন, যদি আপনি শুক্রাণুদাতার মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুদের সংখ্যা বিবেচনা করেন, তাহলে এই ধরনের ঘটনা অত্যন্ত বিরল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত