Ajker Patrika

একাত্তরের স্মৃতিকথনে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষরা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৫, ০৮: ২০
রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারী। ছবি: ড. গোলাম নবী কাজী/ফ্লিকার
রাও ফরমান আলী ও খাদিম হোসেন রাজা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারী। ছবি: ড. গোলাম নবী কাজী/ফ্লিকার

একাত্তরের যুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সেনাধ্যক্ষদের আত্মকথনগুলো বেশ উপভোগ্য। এরা সবাই আত্মপক্ষ সমর্থন করেছেন এবং দোষ চাপিয়েছেন অন্যের ঘাড়ে। হামিদুর রহমান কমিশন প্রধান অপরাধী হিসেবে ইয়াহিয়া খানকে চিহ্নিত করেছে বটে, তবে সর্বাধিক নিন্দা জানিয়েছে নিয়াজিকে। অদক্ষতা, কাপুরুষতা, লাম্পট্য, পান-চোরাচালানে সংযুক্তি, কোনো কিছুরই অভাব দেখা যায়নি এই মহাবীরের কাজকর্মে। কিন্তু তিনিই আবার অন্যদের দুষেছেন তাঁদের ব্যর্থতার জন্য।

‘বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামে একটি বই লিখে তিনি পিন্ডিওয়ালাদের তো বটেই, রণাঙ্গনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাদের বিরুদ্ধেও খারাপ খারাপ কথা বলেছেন। বলেছেন যে ‘২৫ মার্চ টিক্কা অহেতুক রক্তপাত ঘটিয়েছেন, এক রাত্রেই ৫০ হাজার মানুষ মেরে ফেলেছেন এবং নিজের আয়ত্তাধীন সব শক্তিকে এমনভাবে লেলিয়ে দিয়েছেন যেন নিজের দেশের বিপথে-পরিচালিত ও বিপথগামী মানুষদের সঙ্গে নয়, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইতে নেমেছেন।’

নিয়াজি জানাচ্ছেন যে টিক্কাকে লোকে চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, জেনারেল ডায়ার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছে। ২০০২ সালে উর্দু ‘ডাইজেস্ট’ নামের একটি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাও ফরমান আলী সম্পর্কে তিনি অভিযোগ করেন যে ওই সেনা অফিসারটি ভারতীয়দের দেওয়া শর্তে দ্রুত আত্মসমর্পণ করে বাঙালিদের হাত থেকে বাঁচতে চাইছিলেন, কারণ ২৫ মার্চের অভিযানে জড়িত থাকার দরুন বাঙালিরা তাঁকে ভীষণ ঘৃণা করত।

নিয়াজি কোন ধরনের মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে খাদিম হোসেন রাজার সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। সিদ্দিক সালিকের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে ওই সেনাপতিটির বীরত্বের প্রমাণ। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই নিয়াজি মাটির নিচে তৈরি তাঁর হেডকোয়ার্টার্সে আশ্রয় নেন। ৪ ডিসেম্বর গুজব রটে গিয়েছিল যে পাকিস্তানি বাহিনী অমৃতসর দখল করে নিয়েছে। এই গুজব শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজি তাঁর চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে কুস্তিগিরের মতো নর্তনকুর্দন শুরু করেন। দ্রুত গভর্নরকে ফোন করে তিনি শুভ সংবাদটি জানালেন। পরে ওটি যখন গুজব বলে প্রমাণিত হলো, তখন সেই যে চুপসে গেলেন আর সতেজ হতে পারলেন না!

তবে ৭ ডিসেম্বর তাঁকে একবার আত্মপ্রকাশ করতে হয়েছিল, কেননা গভর্নর ডা. এম এ মালিক তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গভর্নমেন্ট হাউসে। সেখানে গিয়ে নিয়াজি কোনো কথা বলছেন না দেখে মালিক সাহেব তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করেন। আর তখনই ঘটে মস্ত এক ঘটনা। জেনারেল সাহেবের নাদুসনুদুস দেহটি কেঁপে কেঁপে উঠল এবং তিনি কান্নায় ভেঙে পড়লেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতো ফোঁপাতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময়ে একজন বাঙালি ওয়েটার ট্রেতে করে কফি ও স্ন্যাকস সাজিয়ে নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়ে। ‘কুকুরের মতো গর্জন’ করে তাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হলো। ওয়েটারটি বের হয়ে এল ঠিকই, কিন্তু সে তার বাঙালি সহকর্মীদের জানাতে ভুল করল না যে সাহেবরা সবাই মিলে কান্নাকাটি করছেন।

১২ তারিখে নিয়াজি আবার বের হন, এবার তিনি সামরিক হাসপাতালে যান। সেখানে ছয়জন নার্স তাঁর কাছে কোনোমতে এসে বলতে সক্ষম হয় যে তারা মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচার ব্যবস্থা চায়। জেনারেল সাহেব তাদের আশ্বস্ত করে বলেন যে ভয়ের কোনো কারণ নেই, কেননা খুব বড় রকমের সাহায্য (অর্থাৎ চীনারা) রওনা হয়ে গেছে। আর সাহায্য যদি না-ই আসে তাহলেও চিন্তা নেই: ‘মুক্তিবাহিনীর হাতে তোমাদের আমরা কিছুতেই পড়তে দেব না, তার আগে আমরাই তোমাদের মেরে ফেলব।’ ওই যাত্রাতেই সাংবাদিকেরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলেন; তাঁদের কাছে তিনি দম্ভভরে বলেন, ‘ঢাকার পতন ঘটবে আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে।’ বলে নিজের বুক নিজেই চাপড়ে দিয়েছিলেন। সিদ্দিক সালিক জানাচ্ছেন যে ১৬ তারিখে খুব সকালে আহত মেজর জেনারেল রহিম ও আরও কয়েকজন যখন তিনটি হেলিকপ্টারে করে বার্মায় পাড়ি দিলেন, তখন তাতে নার্সদের নেওয়া গেল না, কারণ তাদেরকে তাদের হোস্টেল থেকে ‘সংগ্রহ করা’ সম্ভব হয়নি।

সিদ্দিক সালিকের বইটি তথ্যে সমৃদ্ধ। তাঁর দেওয়া একটি তথ্য তো বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। সেটি হলো ২৫ মার্চ রাতের। গণহত্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি বেতারে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করা স্বাধীনতার একটি ঘোষণা শোনা গিয়েছিল। এই তথ্যকে কেউ কেউ স্বাধীনতা ঘোষণার অকাট্য প্রমাণ বলে ধরে নিয়েছিলেন, অন্যরা প্রশ্ন তুলেছেন অন্য কেউ যা শুনল না তিনি কী করে তা শুনলেন? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে তথ্যটা তাঁর নিজের দেওয়া নয়, একজন বিদেশি সাংবাদিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি মাত্র, এবং সে উৎসটি তিনি পাদটীকাতে উল্লেখও করেছেন, সেই সঙ্গে পরের প্যারাতেই তিনি জানাচ্ছেন যে ‘বেতার বার্তাটা আমি নিজে শুনিনি, আমি তখন কেবল রকেট-লঞ্চারের ভয়ংকর ভয়ংকর সব শব্দ শুনছিলাম। অন্যকিছু শোনা সম্ভব ছিল না।’ প্রশ্ন থাকে, নিজে যদি না-ই শুনে থাকেন তাহলে ওই তথ্য সরবরাহের কি কোনো প্রয়োজন ছিল? হ্যাঁ, ছিল। প্রয়োজন ছিল এটা বোঝাবার জন্য যে পাকিস্তানিরা সময়মতো আক্রমণ না করলে তারা নির্ঘাৎ আক্রান্ত হতো; আওয়ামী লীগ সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল, স্বাধীনতার রেকর্ড করা একটি ঘোষণাসহ।

গভর্নমেন্ট হাউসে কুকুরের মতো গর্জন করে উঠেছিলেন যে সেনাকর্তারা, কিছুদিন পরেই সারমেয়দের যে অপর স্বভাব, লেজ গুটিয়ে পলায়ন, সেটিই তাঁদের করতে হয়েছে। সিদ্দিক সালিকের লেখায় অবশ্য আরেকটি কুকুরের কথা আছে, সেটি বাস্তবিক কুকুর, কিন্তু প্রতীকের রূপে মূর্তিমান। পঁচিশ তারিখের রাত্রি পোহানোর পর ছাব্বিশ তারিখের অতি প্রত্যুষের ঘটনা। টিক্কা খান সারা রাত ধরে সোফায় বসে অপারেশনের খবরাখবর নিয়ে ভোর ৫টায় সন্তোষের সঙ্গে নিজের অফিসে গেছেন, কিছুক্ষণ পর রুমালে চশমা মুছতে মুছতে তিনি দৃশ্যমান হয়েছেন এবং চারদিকে তাকিয়ে বলেছেন, ‘কোথাও তো কেউ নেই দেখছি।’

সিদ্দিক সালিক পাশেই ছিলেন। জেনারেলের স্বগতোক্তি শুনে নিজেও আশপাশে তাকিয়ে দেখেছেন, ঘটনা সত্যি, কেউ নেই, তবে একটি কুকুরকে দেখা গেল পেছনের দুই পায়ের নিচে লেজটি গুঁজে শহরের দিকে চলে যাচ্ছে, চুপিচুপি। যেন সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধি!

সেভাবেই দেখেছিলেন তিনি, বিবরণ পাঠে তা-ই মনে হয়। কিন্তু হায়, বোঝেননি যে ৯ মাস পরে তাঁদের নিজেদেরও ওই একই দশা হবে; আর কেউ না দেখুক, ইতিহাস দেখবে। এবং দেখেছেও। আর কুকুর তো তখন ডাকতই। সন্ধ্যার পর, কারফিউ থাকুক আর না-ই থাকুক, মানুষ বের হতো না, তবে কুকুরদের ছিল অবাধ স্বাধীনতা।

যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ১৫ জন পদস্থ আমলা এসেছিলেন, প্রশাসন চালু রাখার জন্য। তাঁদের একজন হাসান জহীর। তিনিও একটি বই লিখেছেন, নাম দিয়েছেন ‘দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান: দি রাইজ অ্যান্ড রিয়ালাইজেশন অব বেঙ্গলি মুসলিম ন্যাশনালিজম’। দৃষ্টিভঙ্গিটা অস্পষ্ট নয়, বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মানতে প্রস্তুত নন, সঙ্গে মুসলিমের উপাদান যোগ করে স্বাদের কটুত্ব দূর করতে চাইছেন। হাসান জহীর তাঁর নিজের একটি বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের মিশন এসেছিল ঢাকায়; আপ্যায়নের জন্য গভর্নমেন্ট হাউসে ডিনারের আয়োজন করেছিলেন গভর্নর টিক্কা খান। তখন বাইরে প্রথমে শোনা গেল বোমার আওয়াজ, পরে মেশিনগানের এবং সেই সঙ্গে কুকুরের। বোমা ছুড়ছিল বাঙালিরা, মেশিনগান পাঞ্জাবিদের; আর কুকুর? পাঞ্জাবিরা তো কুকুর আনেনি সঙ্গে করে। কুকুরগুলো নিশ্চয়ই বাংলাদেশেরই, চিৎকার করে তারা কী বলছিল? বলছিল কি যে ডাকাত পড়েছে? তা ডাকাত পড়েছিল বইকি। অমন ডাকাত কেউ কখনো দেখেনি।

তবে শাসকশ্রেণির প্রতিনিধিরা অনিচ্ছাসত্ত্বে হলেও অনেক সত্য স্বীকার করেছেন। তাঁদের ভেতর বাস্তববাদী যাঁরা, তাঁরা ভয় পেয়েছেন নিজেদের পরিণতির কথা ভেবে। সিদ্দিক লিখেছেন, ডিসেম্বরের ৮-৯ তারিখের দিকে ‘কাঁধে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধাতু বহনকারী’ দুজন অফিসার তাঁকে একা পেয়ে বলেছিলেন, ‘জেনারেল নিয়াজির কাছে তো তোমার যাতায়াত আছে, তাঁকে গিয়ে বলো না কেন বাস্তববাদী হতে? নইলে আমরা সবাই কুকুরের মতো মারা পড়ব।’ সালিক অবশ্য সেই বাণী বহন করে নিয়ে যেতে সাহস করেননি। তবে কুকুরেরা যে নানারূপে ঘোরাঘুরি করছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কর্তাব্যক্তিরা সর্বত্র ঘৃণা দেখতে পাচ্ছিলেন। খাদিম হোসেন পূর্ববঙ্গে প্রথম আসেন ১৯৬৮ সালে। সংক্ষিপ্ত সেই অবস্থানে তিনি বিস্ময় ও দুঃখের সঙ্গে দেখেন বাঙালিরা অবাঙালিদের সহ্য করতে পারছে না। ‘শালা পাঞ্জাবি’, ‘শালা বিহারি’ এসব বলছে। অবাঙালিদের কাছে জিনিসপত্র পর্যন্ত বিক্রি করছে না। তখনই তাঁর মনে হয়েছে যে নিজ দেশে তিনি পরবাসী হয়ে যাচ্ছেন।

পাকিস্তানিরা হিসাব করে দেখতে পাচ্ছিল যে পূর্ববঙ্গে তাদের নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআর মিলিয়ে সৈন্য হবে ২৫ হাজার; তাদের দিয়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখবে কীভাবে? সৈন্য ও সরঞ্জাম বাড়ানো হচ্ছিল, কিন্তু কতটা বাড়ানো যাবে? বাঙালি ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, কোনো বাহিনীর ওপরই নির্ভর করার উপায় ছিল না। তাদের শঙ্কা ছিল যে নিয়মিত বাহিনী ও ইপিআরের সদস্যরা হুকুম দিলে শুনবে না, বাঙালিদের তারা গুলি করে মারতে চাইবে না এবং শেখ মুজিব যদি ডাক দেন তবে তারা বিদ্রোহ করবে। অসহযোগের সময় বেসামরিক প্রশাসন আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী চলছিল, এমনকি সেনাছাউনির বেসামরিক কর্মচারীরাও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে আগের মতো সহযোগিতা করছিল না। জ্বালানি, খাদ্য ও চলাফেরার রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতেই ইয়াহিয়ার নির্দেশে খাদিম হোসেন ও ফরমান আলী দুজনে মিলে হামলার একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন, নাম দেন ‘অপারেশন সার্চলাইট’। কাজটা করতে হয়েছে অত্যন্ত গোপনে। পরিকল্পনাটির মুখবন্ধে বলা হচ্ছে, ‘অ্যাজ আওয়ামী লীগ হ্যাজ ওয়াইডস্প্রেড সাপোর্ট ইভেন অ্যামাংস্ট দ্য ইস্ট পাকিস্তানি এলিমেন্টস ইন দ্য আর্মি, দ্য অপারেশন হ্যাজ টু বি লঞ্চড উইথ গ্রেট কানিংনেস, সারপ্রাইজ, ডিসেপশন অ্যান্ড স্পিড কম্বাইন্ড উইথ শক অ্যাকশন।’ (সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের ব্যাপক সমর্থন আছে। তাই অভিযানটি অত্যন্ত সুচিন্তিত কৌশলে পরিচালনা করতে হবে, যাতে দ্রুততার সঙ্গে প্রচণ্ড আঘাত করে শত্রুপক্ষকে সম্পূর্ণ হতবাক ও পর্যুদস্ত করা যাবে।)

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

সম্পাদকীয়
খুলনার এক গোলমেলে ব্যাপার

খুলনার ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এনসিপির এক শ্রমিকনেতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছে। গুলিটি তাঁর বাঁ কানের চামড়া ভেদ করে বের হয়ে গেছে। তিনি এখন শঙ্কামুক্ত। গুলি লাগার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। কোনো গুপ্তঘাতক নেতাদের টার্গেট করে হত্যা পরিকল্পনায় নেমেছে কি না, সে রকম ভাবনারও জন্ম হয়। অনেকে কানের পাশ দিয়ে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাকে সদ্য প্রয়াত ইনকিলাব মঞ্চ নেতা ওসমান হাদিকে করা গুলির সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। কিন্তু পুলিশ যখন তাদের তদন্ত শুরু করল, তখন দেখা গেল, এ এক রহস্যজনক ব্যাপার! এই ঘটনার সঙ্গে মদ, নারী, ইয়াবাসহ অনেক কিছুই জড়িত বলে ধারণা পুলিশের।

গোলমেলে বলার একটা কারণ হলো, যেহেতু গুলির আঘাত এসেছে এনসিপি নেতার ওপর, তাই কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক নেতারা দোষারোপের রাজনীতি শুরু করে দিয়েছিলেন। এনসিপির খুলনা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী এই গুলির ঘটনার জন্য সরাসরি আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বসলেন। তিনি বললেন, মোতালেব গাড়ি থেকে নামার পর তাঁকে টেনেহিঁচড়ে একটি চায়ের দোকানে নিয়ে মারধর করার পর গুলি করা হয়। এনসিপির খুলনা মহানগরের সংগঠক বললেন, বিগত দিনে খুলনায় অহরহ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। আর এ সবই সন্ত্রাসী গ্রুপ আওয়ামী নেতাদের আশীর্বাদপুষ্ট।

বর্তমান বাস্তবতায় যেকোনো ঘটনাতেই ‘কেষ্টা ব্যাটা’কে খোঁজা কতটা যৌক্তিক, সে বিষয়ে কোনো প্রশ্ন কেন কোনো সচেতন রাজনৈতিক কর্মীর মাথায় আসবে না, সেটা বোধগম্য নয়। আওয়ামী লীগ দৃশ্যপটে আছে কি নেই, দলটি খুলনায় কাজির কিতাবের গরু কি না, সে বিষয়ে এনসিপির কারও মনে কোনো সন্দেহ জাগবে না কেন? আওয়ামী লীগ আমলে যেমন সব দোষ বিএনপি এবং জামায়াতকে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকত সরকার, তেমনি এখন যেকোনো অঘটন ঘটলেই বলা নেই কওয়া নেই, আওয়ামী লীগের দিকে ছুটে যায় সন্দেহের তির। মুশকিল হলো, সত্যিকারের ঘটনা উদ্‌ঘাটিত না হলে সাধারণ মানুষও একসময় দোষারোপের রাজনীতির মর্মকথা বুঝে যায়। তখন তাদের বেকুব ভেবে বিভ্রান্ত করা যায় না।

এই গোলমেলে ব্যাপারে পুলিশ কী বলছে? পুলিশ একটা কাজের কাজ করেছে। রাজনীতিবিদেরা যখন আওয়ামী লীগের ওপর দোষ দিয়ে ঘটনাটিকে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন পুলিশ খোঁজ নিয়েছে সিসিটিভির। আর তাতেই এই গোলমেলে ঘটনার কুয়াশা ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। ফুটেজে দেখা গেল, কোনো চায়ের দোকান থেকে নয়, মোতালেব বের হচ্ছেন একটি বাড়ি থেকে। তাঁর কানে রয়েছে হাত। অর্থাৎ গুলিটি লেগেছে ওই বাড়িতেই। কেএমপির উপপুলিশ কমিশনার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, রোববার দিবাগত রাতে মোতালেব শিকদার এখানে এসেছিলেন এবং এখানে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়, এর সঙ্গে আবার এক তরুণীর সংশ্লিষ্টতা আছে। তাঁকেও ধরেছে পুলিশ।

এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। অসামাজিক কর্মকাণ্ডকে যেন রাজনৈতিক রং লাগাতে দেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখা দরকার।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

অরুণ কর্মকার
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা
দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। ছবি: আজকের পত্রিকা

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে সন্ত্রাসীরা যে নজিরবিহীন নৃশংস হামলা করেছে, তার সূত্র ধরেই শুরু করতে হচ্ছে। ঘটনার পূর্বাপর সবাই এখন জানেন। তাই সংক্ষেপে শুধু একটি বিষয় উল্লেখ করব। হামলার আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠার পরই প্রথম আলোর পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু পায়নি। বরং প্রথম আলো অফিসের আশপাশে আগে থেকেই রুটিন দায়িত্ব হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যেসব সদস্য অবস্থান করছিলেন, তাঁরাও সরে যান। আর ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তো প্রকাশ্য সভায়ই বলেছেন, প্রথম আলো অফিসে হামলা শুরুর পরই তিনি সরকারের সব সংস্থা ও ব্যক্তির কাছে তাঁর প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার জন্য সাহায্য চেয়েও পাননি। তিনি আরও বলেছেন, দেশে মতপ্রকাশ তো দূরের কথা, বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীর অধিকাংশের সঙ্গে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের সম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সরকারের কাজকর্মে পত্রিকা দুটির সমর্থন এবং গঠনমূলক সমালোচনার কথাও সবার জানা। তারপরও তাদেরই যখন এহেন অসহায় অবস্থা, তখন অন্য সবার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিটা যে কী, তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সে পরিস্থিতি এককথায় বোঝাতে গেলে বলতে হয়, দেশে জননিরাপত্তা পরিস্থিতি একেবারেই নাজুক। এই পরিস্থিতিতে পিটিয়ে-পুড়িয়ে হত্যা, গলা কেটে-গুলি করে খুন এবং ছায়ানট-উদীচীর মতো প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন লাগানোর মতো সহিংস কর্মকাণ্ড আকছার চলতে পারছে। বিশিষ্ট সম্পাদক নূরুল কবীরের মতো জনপ্রিয়, পরিচিত ব্যক্তিরাও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন।

এসব ঘটনার পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে আছে। সরকার নিশ্চয়ই দেশের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের পাশেও আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের পাশে যেমন আছে, তেমনিভাবে জনগণের পাশে থাকলে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব হবে কি না। বিষয়টি আরেকটু স্পষ্ট করার জন্য আরও দুজনের দুটি প্রণিধানযোগ্য বক্তব্য উল্লেখ করা প্রয়োজন।

এক. জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, এই হামলার সঙ্গে সরকারের একটা অংশের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। নাহিদ ইসলাম শুধু জুলাই অভ্যুত্থানের প্রধান সংগঠকদের অন্যতমই নন, তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাও ছিলেন। এই সরকারের তরিকা এবং এর ভেতর-বাইরে তিনি ভালোই জানেন। কাজেই তাঁর এই কথাটি অন্য পাঁচটা রাজনৈতিক বক্তৃতার মতো নয়। এখন কথা হলো, সরকারের ভেতরেই যখন এমন শক্তি ঘাপটি মেরে আছে, তখন তারা তো ইচ্ছা করলে নির্বাচনেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে। এবং সেটা তারা করবে বলেও বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা, তাদের ভিন্ন অ্যাজেন্ডা রয়েছে।

দুই. ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এস এন মো. নজরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সে অনুযায়ী তিনি প্রথম আলো-ডেইলি স্টারে হামলার প্রসঙ্গে বলেছেন, কারওয়ান বাজারের যে পরিস্থিতি ছিল, সেখানে পুলিশ অ্যাকশনে গেলে গুলি হতো, দুই-চারজন মারা যেতেন। এরপর পুলিশের ওপর পাল্টা আক্রমণ হতো। সে কারণেই তাঁরা সেখানে অ্যাকশনে যেতে পারেননি। এর ফলে কোনো মানুষ হতাহত হয়নি। এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। তা ছাড়া এই বক্তব্যের মধ্যে কয়েকটি গূঢ় বার্তা লুকিয়ে আছে।

প্রথমত, পুলিশ এমন কোনো পরিস্থিতিতে অ্যাকশনে যাবে না যেখানে তাদেরকে গুলি করতে হতে পারে। যেখানে তাদের গুলিতে মানুষ মারা যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনকি, সেখানে যদি আক্রমণকারীদের হাতে আক্রান্ত মানুষের মারা যাওয়ার এবং কোনো মানুষের বা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবু পুলিশ অ্যাকশনে যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের পুরো সময়কাল আমরা এই সত্য অনুধাবন করছি। পুলিশ তথা সরকারের এই ভূমিকার কারণ হতে পারে এই যে জুলাই অভ্যুত্থানের পর দেশে এমন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, মানুষকে গুলি করে কেবল স্বৈরাচার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার তো স্বৈরাচার হতে পারে না। তারা চুপচাপ সাধারণ মানুষের নিগ্রহ, খুন, লুটপাট এসব দেখতে পারে। কাজেই পুলিশ কীভাবে অ্যাকশনে যাবে! কীভাবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হামলার হাত থেকে বাঁচতে সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাবেন! এসব ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবখানা বোধ হয় এই যে, আমরা আর কদিন। এই কটা দিন কোনোক্রমে চোখমুখ বন্ধ করে কাটিয়ে যেতে পারলেই হয়। কিন্তু ইতিহাসের দায় শোধের যে বিষয় সবার ক্ষেত্রেই থেকে যায়, সে কথাও কি ভোলা উচিত!

তৃতীয়ত, পুলিশ অ্যাকশনে গেলে পুলিশের ওপরও আক্রমণ হতো। এই আশঙ্কাটাও শতভাগ সত্য। অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকার ফলে সন্ত্রাসীরা যে পুলিশ-মিলিটারি কিছুই মানে না, সে তো আমরা বারবার দেখছি। তাহলে পুলিশ কেন আক্রান্ত মানুষ কিংবা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরা বিপদে পড়বে। আর শেষ পর্যন্ত তো পুলিশের ওপরই দোষ চাপানো হয়। কাজেই এহেন পরিস্থিতিতে গা বাঁচিয়ে চলাই শ্রেয়। কিন্তু কথা হলো, এই পরিস্থিতি চলতে দিয়ে নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যাবে তো? নির্বাচনের সময়ও তো কোনো কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই কাজ করতে পারে। এমনকি, নির্বাচন বিঘ্নিত করার জন্য নতুন কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সংগঠিতও হতে পারে। তখন গুলি করার নির্দেশ দিলেও তো অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরাচারের কাতারে পড়ে যাবে। আর তখনো যে পুলিশ সরকারের বা নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মেনে অ্যাকশনে যাবে, তারই-বা নিশ্চয়তা কী?

কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেই নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গত মঙ্গলবার নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন সব রিটার্নিং কর্মকর্তা বা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপার (এসপি), সব রেঞ্জের ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার, আঞ্চলিক ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা। সেখানে তাঁরা রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচন অফিস, সব নির্বাচন কর্মকর্তা, ভোটকেন্দ্র—সকল পর্যায়ে নিরাপত্তা নিয়ে সবাই দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তারা তাঁদের ও জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের নিরাপত্তা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তার বিষয়ও বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলেছেন। অনেক জেলা-উপজেলায় নির্বাচন অফিসগুলো সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তাঁরা। কিছু এলাকার ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী সামগ্রী নিয়ে যেতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) দায়িত্ব দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তো আছেই। প্রকৃতপক্ষে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো মানুষই নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছে না। সবাই নিজের এবং পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে মানুষের পাশে থাকবে, কীভাবেই-বা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করবে, সেটিই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

হাসান আলী 
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই
প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। ছবি: এআই

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে প্রবীণ বয়সে সেই গুরুত্ব আরও গভীর ও সূক্ষ্ম হয়ে ওঠে। কর্মজীবন শেষ, সন্তানেরা নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, শরীর ক্রমেই দুর্বল—এই বাস্তবতায় প্রবীণের জীবনে যে সম্পর্কটি নিঃশর্তভাবে পাশে থাকে, তা হলো বন্ধুত্ব। পরিবার দায়িত্বে আবদ্ধ, আত্মীয়রা দূরত্বে—কিন্তু বন্ধু থাকে অনুভবের কাছাকাছি।

প্রবীণ বয়সে সবচেয়ে বড় শত্রু একাকিত্ব। ঘরের ভেতর থেকেও মানুষ একা হয়ে যেতে পারে। কথা বলার মানুষ থাকে না, দিনের অভিজ্ঞতা ভাগ করার কেউ থাকে না। এই নীরবতার মধ্যে একজন বন্ধুর ফোনকল, বিকেলের আড্ডা বা একসঙ্গে হাঁটতে বের হওয়া—সবই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বন্ধু মানে কেবল হাসি নয়, বন্ধু মানে নিজের মতো করে কথা বলার স্বাধীনতা।

পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক অনেক সময় দায়িত্ব আর প্রত্যাশায় বাঁধা। সন্তানেরা বাবা-মাকে ভালোবাসে ঠিকই, কিন্তু সব কথা বলা যায় না। নিজের ভয়, হতাশা, মৃত্যুচিন্তা কিংবা ব্যর্থতার অনুভূতি—এই বিষয়গুলো সন্তানদের সামনে প্রকাশ করতে প্রবীণেরা সংকোচ বোধ করেন। কিন্তু একজন বন্ধু সেই জায়গা, যেখানে কোনো বিচার নেই, আছে কেবল শোনা আর বোঝা। বন্ধুর কাছে কান্নাও নিরাপদ।

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব মানে স্মৃতির ভাগাভাগি। একই সময়ের মানুষ, একই সমাজ, একই লড়াই—এই মিলগুলো বন্ধুত্বকে গভীর করে তোলে। একসঙ্গে বসে পুরোনো দিনের গল্প করলে কেবল স্মৃতি নয়, নিজেদের অস্তিত্বও নতুন করে আবিষ্কার হয়। ‘আমি ছিলাম, আমি করেছি’—এই অনুভূতি আত্মসম্মান জাগিয়ে তোলে, যা বার্ধক্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

মনোবিজ্ঞানের মতে, প্রবীণ বয়সে ভালো বন্ধুত্ব ডিমেনশিয়া ও বিষণ্নতার ঝুঁকি কমায়। কারণ, কথা বলা, হাসা, মতবিনিময়—সবই মস্তিষ্ককে সক্রিয় রাখে। একজন প্রবীণ যখন বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, তখন তাঁর মনও সচল থাকে, জীবনের প্রতি আগ্রহ কমে না। বন্ধুত্ব মানে শুধু সময় কাটানো নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা।

বন্ধু না থাকলে প্রবীণেরা অনেক সময় নিজেদের বোঝা মনে করেন। মনে হয় তাঁরা শুধু অন্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে সেই ধারণা ভেঙে যায়। তখন তাঁরা আবার একজন মানুষ—যার গল্প আছে, মতামত আছে, রসিকতা আছে। বন্ধুত্ব প্রবীণকে ‘রোগী’ থেকে আবার ‘মানুষ’ বানিয়ে তোলে।

আমাদের সমাজে প্রবীণদের বন্ধুত্বকে অনেক সময় তুচ্ছ করা হয়। বলা হয়, ‘এই বয়সে আবার বন্ধু!’ অথচ এই বয়সেই বন্ধুত্ব সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, তখন জীবনের অধিকাংশ দরজা বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধুত্বই একমাত্র জানালা দিয়ে আলো ঢোকে। প্রবীণদের বন্ধুত্ব মানে জীবনের শেষ অধ্যায়ে মানবিক উষ্ণতা।

বিশেষ করে যাঁরা একা থাকেন, জীবনসঙ্গী হারিয়েছেন, সন্তানেরা দূরে—তাঁদের জন্য বন্ধুই পরিবার। প্রয়োজনে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, বাজার করা বা শুধু পাশে বসে থাকা—বন্ধু এই কাজগুলো নীরবে করে যায়। কোনো রক্তের সম্পর্ক না হয়েও বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে রক্তের চেয়েও ঘনিষ্ঠ।

প্রবীণদের বন্ধুত্ব তরুণদের জন্যও একটি শিক্ষা। এখানে প্রতিযোগিতা নেই, আছে সহমর্মিতা। এখানে লাভ-ক্ষতি নেই, আছে সময় দেওয়া। প্রবীণ বন্ধুরা একে অপরকে ব্যবহার করেন না, তাঁরা একে অপরকে থাকতে দেন। এই থাকার মধ্যেই নিহিত আছে মানবিকতার সৌন্দর্য।

আপনি নিশ্চয়ই দেখেছেন—যাঁদের ভালো বন্ধু আছে, তাঁদের চোখে আলোর ঝিলিক থাকে। শরীর ভাঙলেও মন ভাঙে না। আর যাঁরা একা, তাঁদের চোখে ক্লান্তি। তাই প্রবীণকল্যাণ মানে শুধু ওষুধ বা খাবার নয়—বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করাও।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্ব হলো জীবনের শেষ প্রদীপ। এই প্রদীপ জ্বলে থাকলে অন্ধকার ভয়ের নয়। বয়স বাড়ে, শরীর ঝরে—কিন্তু বন্ধুত্ব থাকলে মন সব সময় তরুণ থাকে। আর তরুণ মনই তো আসল জীবন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

সাদিয়া সুলতানা রিমি
সংকট, সম্ভাবনার  সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছে, যে সংকট কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। সহিংসতা, আতঙ্ক, গুজব ও অনিশ্চয়তা জনজীবনে এমন এক অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে যুক্তি ও সংযম প্রায়ই আবেগের কাছে হার মানছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্র ও সমাজের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে শোক, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেও শান্ত থাকা যায়, কীভাবে উত্তেজনার মুহূর্তে দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করা যায়। ইতিহাস আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, সংকটের সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।

এই অস্থির সময়ের কেন্দ্রে রয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারির যোদ্ধা শরিফ ওসমান হাদির নির্মম হত্যাকাণ্ড। আততায়ীর গুলিতে আহত হয়ে টানা সাত দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই শেষে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির জন্যই গভীর শোকের কারণ। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠ, যে কণ্ঠ অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্বপ্ন দেখিয়েছিল; তরুণদের মাঝে জাগিয়ে তুলেছিল আশা, সাহস ও প্রতিবাদের ভাষা। সেই কণ্ঠ আজ নীরব। আর এই নীরবতা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক যাত্রার ওপর এক গভীর প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।

একজন নাগরিকের প্রাণহানি কখনোই ‘স্বাভাবিক ঘটনা’ হতে পারে না। বিশেষত, যখন সেই নাগরিক একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠেন। হাদির হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই হত্যার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের ন্যূনতম কর্তব্য। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতির উদ্দেশে ভাষণ, রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা এবং পরিবারটির দায়িত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত এই দায়বদ্ধতারই একটি বার্তা দেয়। তবে ঘোষণা ও আশ্বাসের বাইরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—আইনের শাসনের বাস্তব প্রয়োগ। বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে না পারলে এমন হত্যাকাণ্ড ভবিষ্যতেও পুনরাবৃত্তি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।

কিন্তু শোক ও ক্ষোভের প্রকাশ যখন সহিংসতায় রূপ নেয়, তখন তা নিজ উদ্দেশ্যকেই নস্যাৎ করে। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় এবং দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান মানে কেবল ইট-পাথরের ভবন নয়; এগুলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এবং সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরের প্রতীক। এসব প্রতিষ্ঠানে হামলা মানে গণতন্ত্রের শিরায় আঘাত করা। মতবিরোধ, ক্ষোভ কিংবা রাজনৈতিক অবস্থান যা-ই থাকুক না কেন সহিংসতা কখনোই ন্যায্যতা পায় না।

বিশেষ করে, নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরকে ‘আওয়ামী দোসর’ আখ্যা দিয়ে নাজেহাল করার ঘটনা আমাদের আরও সতর্ক করে। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অপশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ভূমিকা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। মতভিন্নতার কারণে কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলার এই প্রবণতা সমাজকে বিভক্ত করে, যুক্তিকে হত্যা করে এবং শেষ পর্যন্ত সহিংসতার পথ প্রশস্ত করে। আজ যদি আমরা যুক্তির বদলে লেবেলিংকে বেছে নিই, তবে কাল আর কেউই নিরাপদ থাকবে না।

এই অস্থিরতার পেছনে গুজব ও উসকানিমূলক বক্তব্য বড় ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাচাইহীন তথ্য, আবেগতাড়িত পোস্ট ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মুহূর্তের মধ্যে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে দিচ্ছে। ডিজিটাল যুগে দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের মানে শুধু ভোট দেওয়া নয়; বরং তথ্য যাচাই করা, সংযত ভাষা ব্যবহার করা এবং উসকানিমূলক কনটেন্ট থেকে বিরত থাকা। এক একটি ভুয়া পোস্ট এক একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ—যা পুরো সমাজকে দগ্ধ করতে পারে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোরতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনও সমান জরুরি। স্বচ্ছতা, নিয়মিত তথ্য প্রদান এবং ন্যায়সংগত পদক্ষেপই পারে পরিস্থিতি শান্ত করতে। পুলিশি তৎপরতা যদি একপক্ষীয় বা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে তা উত্তেজনা কমানোর বদলে বাড়িয়ে দেবে। তাই শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি সংলাপ, ব্যাখ্যা ও আস্থার রাজনীতি জরুরি।

একই সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও প্রভাবশালী নাগরিকদেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। উসকানি নয়, সংলাপ; প্রতিহিংসা নয়, সহনশীলতা—এই নীতিই হতে হবে পথনির্দেশক। দেশ নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। এই সময়ে প্রতিটি দলের ধৈর্য ধরার পরীক্ষা চলছে। নেতারা যদি দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, কর্মীদের সংযত না করেন, তাহলে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাবে। এমনকি বহুকাঙ্ক্ষিত নির্বাচনও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে।

নির্বাচন শুধু ক্ষমতা বদলের প্রক্রিয়া নয়; এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার প্রতীক। অস্থিতিশীলতা সেই ধারাবাহিকতাকে ভেঙে দেয়। শরিফ ওসমান হাদির স্বপ্ন ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের অধিকার নিশ্চিত হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকবে অক্ষুণ্ন। তাঁর স্মৃতির প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে সহিংসতা নয়, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেই শক্তিশালী করতে হবে।

বিশেষ করে তরুণসমাজের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাদির কণ্ঠ যে তরুণদের অনুপ্রাণিত করেছিল, আজ তাদেরই সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে দেশের ভবিষ্যৎ তাদের হাতেই। ধ্বংস নয়, গঠন; ঘৃণা নয়, যুক্তি—এই দর্শনই পারে দেশকে অস্থিরতা থেকে রক্ষা করতে। আবেগের বশে নেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ধ্বংস করতে পারে।

বাংলাদেশ আজ সংকট, সম্ভাবনা ও সংগ্রামের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে শোক, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তা; অন্যদিকে রয়েছে গণতান্ত্রিক উত্তরণের সম্ভাবনা। কোন পথ বেছে নেওয়া হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের সামষ্টিক প্রজ্ঞা ও সংযমের ওপর। শান্ত থাকা কোনো দুর্বলতা নয় বরং সংকটের মুহূর্তে শান্ত থাকতে পারাই সবচেয়ে বড় শক্তি। আজ সেই শক্তিরই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। যদি আমরা এই শক্তিকে ধারণ করতে পারি, তবে হাদির রক্ত বৃথা যাবে না; বরং তা হয়ে উঠবে একটি ন্যায়ভিত্তিক, সহনশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে এক কঠিন কিন্তু আশাব্যঞ্জক সংগ্রামের প্রেরণা।

শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত