মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচারকেও এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের প্রায় ১০ মাস পর গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা ছিল বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রমের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বিষয়। আদালতের কার্যক্রমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য একটি দিক ছিল আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বক্তব্য। তাঁর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। যত কিছুই হোক এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সকলেরই কাম্য। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না হলে বাংলাদেশ যে কতটা পিছিয়ে যাবে সেটা ভাবনারও বাইরে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত ও বিচার কেমন হবে— তা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। চিফ প্রসিকিউটরের পেশাগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে অতীতে যে সংশ্লিষ্টতা সেটি বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্নগুলোকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। শুনানি শুরুর আগে সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তার এই সূচনা বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, যেগুলো এই মামলার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত গতিপথ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে সবচেয়ে খটকা লেগেছে তাঁর একটি মন্তব্যে— তিনি বলেছেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।’
টেলিভিশনে যখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তখন দেখা যাচ্ছিল তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন। তাঁর মানে তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি সহকারে এই বক্তব্য লিখেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি বলতেন, এই বিচার কোনো অতীতের প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। বরং রাজনৈতিক ও পেশাগত দিক থেকে তাঁর অতীতের সংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে সন্দেহ, সেটির প্রতি একটি শক্ত বার্তা হতে পারতো। কিন্তু তিনি ‘কেবল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্যটির সোজাসাপ্টা অর্থ হয়, এটি শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়।
একজন আইনজীবী হিসেবে মামলার শুনানির সূচনা বক্তব্যে এ ধরনের মন্তব্য অনেকগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, কারণ এরই মধ্যে অন্য একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রশ্ন আইনজীবী থেকে শুরু করে মামলার পর্যবেক্ষকরাও তুলেছেন। প্রশ্নটি উঠেছে জামায়াতে ইসলামী নেতা এটি এম আজহারুল ইসলামকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদণ্ড থেকে খালাস দেয়ার মামলায়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ থাকলেও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার যথাযথ না থাকার কারণে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ঠিক একইভাবে ৫ আগস্টের পর মানতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেভাবে হচ্ছে, সেটাও যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া অভিযোগ করেছেন, প্রসিকিউটর নিয়োগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুালে বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম, আজহারুল ইসলামের পক্ষেও আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি। আজহারুলের মামলায় তিনি সরাসরি আপিল বিভাগের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তার নেতৃত্বাধীন প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের পক্ষে আপিল বিভাগে লড়েছেন। এই ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত হয়েছে বলে মনে করেন বার্গম্যান ও জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।
জনাব আজহারুলকে খালাস দেয়ার অনেক আগেই ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল। সেই নিবন্ধে আইনজীবী শাহদীন মালিকসহ অনেকে প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী। অবশ্য চিফ প্রসিকিউটরের অফিস থেকে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই ধরনের অপরাধে বা একই দলের বা গোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ডিফেন্স করেছেন বলে একজন আইনজীবী সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো ব্যক্তির প্রসিকিউশন করতে পারবেন না, এমন কোনো আইনগত বাধানিষেধ পৃথিবীর কোথাও নেই।
যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক দর্শন আছে। সেটি হলো, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সব ধরনের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যথাযথভাবে রক্ষা করা। কারণ ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, কোনো নিরাপরাধ মানুষ কিংবা কেউ যেন ক্ষোভ, রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে শাস্তি না পান। অর্থাৎ আগে থেকে যেন এমন সন্দেহের উদ্রেক না হয় যাতে বিচারের ফলাফল অনুমান করা যায়। এটাকে বলা হয় অনিশ্চয়তা। এ অনিশ্চয়তা না থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, মানে তাদেরকে জোর করে দণ্ড দেয়া হবে কী হবে না এমন অনিশ্চয়তা না থাকলে বিষয়টি হয়ে পড়বে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ প্রবাদের মতো। যেমন, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিরোধী মতগুলোকে দমনের জন্য বহু মামলা করা হয়েছিল। খোদ এখনকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছিল, যেগুলোর মেরিট বা ভিত্তি নেই বললেই চলে। আবার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল— এটি সত্যি। কিন্তু যেভাবে নিতান্তই গায়ের জোরে অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া বিগত সরকারের আমলে ছিল, সেটি থেকে এমন ধারণা হয়েছিল— বিচার প্রক্রিয়া যাই হোক শাস্তি অবধারিত। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া হবে— এমন সন্দেহ থাকলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমনটাই স্বাভাবিক।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। অতীতের যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর বিচার যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ, তাই অতীতের আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন পরিস্থিতে চিফ প্রসিকিউটর যখন আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা’, তখন সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এখনও আইসিটিতে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধের অনেকগুলো মামলা চলমান আছে। বলা ভালো, সেগুলো এখন হিমাগারে চলে গেছে। খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন তোলা কি খুব অমূলক হবে যে, যারা আগে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তারা এখন রাষ্ট্র বা বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ায় পাশার দান পুরো উল্টে গেছে? এটা তো সত্যি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আগের আমলে বিচার প্রক্রিয়া যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের উচিত বিদ্যমান মামলাগুলোর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
কিন্তু বর্তমানে আইসিটির প্রসিকিউশন টিমের যে রেকর্ড তাতে আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে যেতে পারে, ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর, সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়।’ চিফ প্রসিকিউটর আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।’ কিন্তু তাঁর অতীত ট্র্যাক রেকর্ড আর ‘কেবল’ জুড়ে দেয়া বাক্যটি এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সন্দেহটি আরো বাড়ে যখন শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরের দেয়া বক্তব্য আমরা শুনি। শুনানিতে শেখ হাসিনাকে একজন ‘নিষ্ঠুর শাসক’ উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। হাসিনা টিকে থাকলে তাঁরাও (আওয়ামী লীগের নেতা ও সে সময়ের মন্ত্রী) টিকে থাকবেন এ মানসিকতা ছিল তাদের। সে হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের প্রাণভ্রোমরা। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আর আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তা বাস্তবায়ন করেছেন।’
এছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরাই হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর। এত স্পর্শকাতর একটি মামলায় এমন ঢালাওভাবে অভিযোগ আনার অর্থ হলো প্রসিকিউশন মামলাটির তদন্ত ও উপস্থাপন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না।
মেট্রো রেলে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া এক সমন্বয়কের মন্তব্য গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছিল। ‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না’— বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম।
এমন বক্তব্যের জন্য সংগঠন থেকে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা এটাকে বিপ্লব বলছি বা গণঅভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এটা কোনো সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয়নি, আইন মেনে হয়নি। আইন যদি মানতে যেতাম, তাহলে কিন্তু এই বিপ্লবগুলো হতো না। যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না। এখানে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পৃথিবীর সকল বিপ্লবই সংবিধান বা নিয়মের বাইরে যেয়ে হয়েছে। এ কারণে আইনের বাইরে যেয়ে বা সাংবাধানিক পদ শূন্য হবে এরকম কথা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কতটা যৌক্তিক সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রসিকিউশন চিফ আর সমন্বয়কের বক্তব্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। দুজনই কিন্তু জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য লড়ছেন। একজন আদালতে, আরেকজন রাজপথে। এমন সাংঘর্ষিক বক্তব্য অবশ্যই এই বিচার প্রক্রিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলবে। সেখানে যতই নিরপেক্ষতার দাবি করা হোক না কেন প্রসিকিউশন টিমের অতীত টেনে এনে তাঁদের ‘প্রতিশোধপরায়ণতা সম্পর্কে ধারণাকে’ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যদি আগুন দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের সমর্থনে পর্যাপ্ত ও অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা না যায়, অথবা যদি প্রমাণগুলো পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
যদি বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে হয়, অর্থাৎ যদি মনে হয় যে ক্ষমতার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠবে। এক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগপত্রে জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ‘সমন্বিত নির্মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন ও আন্দোলনকারীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে ‘সিস্টেমেটিক’ অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না।
অভিযোগের শুনানিতে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। আন্তর্জাতিক মানের বিচারের জন্য তদন্ত, প্রসিকিউশন, বিচার— সবকিছু আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত। ডেভিড বার্গম্যানের একটি নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল গত বছরের ২৪ অক্টোবর। সেখানে তিনি আইসিটিতে নিয়োগকৃত বিচারকদের সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেগুলো বেশ যৌক্তিক যদি আমরা জুলাই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক মানের বিচার চাই। বার্গম্যান বলছেন, এই আদালতের বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।
আবার এই আদালতের বেশিরভাগ বিচারক বেশ কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও, এর কার্যপদ্ধতি এবং বিচারিক মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকে বা অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
শুরু থেকেই অনেকে বলছিলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়াই ভাল। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করলে যদিও তার রায় পেতে সময় বেশি লাগতো, কিন্তু প্রক্রিয়াটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতো, যেটি বিচারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে তুলতো। এমনকি আইসিসি যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতো, তাহলে সেটির রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটে, তাহলে রায়ের কোনো পরিবর্তন করা যেতো না।
‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’— এই নীতিবাক্যটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তবে, এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে হলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। এই অবস্থায় একটি উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল বিষয়।
এই ট্রাইব্যুনালের আগে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হলেও এর এখতিয়ার ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক দেখা গেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধরন এবং তার আইনি প্রক্রিয়া এই ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যতের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও প্রভাব ফেলবে। আদালতের বিচার কাজ সরাসরি সম্প্রচার করে, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে হয়তো এক পক্ষের বাহবা পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে পারে না। যদি ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে না পারে তাহলে আইনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। দেশটির জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। [সিন্ডিকেটেড কনটেন্ট হিসেবে ডয়চে ভেলে থেকে প্রকাশিত]
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সংঘটিত আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের বিচারকেও এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। জুলাই আন্দোলনের প্রায় ১০ মাস পর গত ১ জুন শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়।
পুরো প্রক্রিয়াটি ডিজিটাল মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা ছিল বাংলাদেশের বিচারিক কার্যক্রমের ইতিহাসে অভূতপূর্ব বিষয়। আদালতের কার্যক্রমের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচ্য একটি দিক ছিল আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের বক্তব্য। তাঁর বক্তব্য থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেবল একটি আইনি প্রক্রিয়া নয়, বরং এর সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাব রয়েছে। যত কিছুই হোক এ হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচার সকলেরই কাম্য। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার না হলে বাংলাদেশ যে কতটা পিছিয়ে যাবে সেটা ভাবনারও বাইরে।
জুলাই হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত ও বিচার কেমন হবে— তা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। চিফ প্রসিকিউটরের পেশাগত ও রাজনৈতিক দিক থেকে অতীতে যে সংশ্লিষ্টতা সেটি বিবেচনায় নিলে এই প্রশ্নগুলোকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি। কারণ বাংলাদেশে শোষণ, নিপীড়ন, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হলে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জুলাই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারের কোনো বিকল্প নেই।
জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ডসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করে প্রসিকিউশন। শুনানি শুরুর আগে সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম। তার এই সূচনা বক্তব্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আছে, যেগুলো এই মামলার গুরুত্ব এবং ভবিষ্যত গতিপথ বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে। তবে সবচেয়ে খটকা লেগেছে তাঁর একটি মন্তব্যে— তিনি বলেছেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা।’
টেলিভিশনে যখন সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, তখন দেখা যাচ্ছিল তিনি লিখিত বক্তব্য পড়ছিলেন। তাঁর মানে তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি সহকারে এই বক্তব্য লিখেছেন। সেক্ষেত্রে তিনি যদি বলতেন, এই বিচার কোনো অতীতের প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা, তাহলে কোনো প্রশ্ন উঠতো না। বরং রাজনৈতিক ও পেশাগত দিক থেকে তাঁর অতীতের সংশ্লিষ্টতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মনে যে সন্দেহ, সেটির প্রতি একটি শক্ত বার্তা হতে পারতো। কিন্তু তিনি ‘কেবল’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। তার মুখ থেকে নিঃসৃত বাক্যটির সোজাসাপ্টা অর্থ হয়, এটি শুধু অতীতের প্রতিশোধ নয়।
একজন আইনজীবী হিসেবে মামলার শুনানির সূচনা বক্তব্যে এ ধরনের মন্তব্য অনেকগুলো প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক, কারণ এরই মধ্যে অন্য একটি মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের দ্বন্দ্বের অভিযোগ উঠেছে। এ প্রশ্ন আইনজীবী থেকে শুরু করে মামলার পর্যবেক্ষকরাও তুলেছেন। প্রশ্নটি উঠেছে জামায়াতে ইসলামী নেতা এটি এম আজহারুল ইসলামকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদণ্ড থেকে খালাস দেয়ার মামলায়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যুদ্ধাপরাধের মামলায় যারা দণ্ডিত হয়েছিলেন, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ থাকলেও তদন্ত ও বিচারপ্রক্রিয়ার যথাযথ না থাকার কারণে তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ঠিক একইভাবে ৫ আগস্টের পর মানতাবিরোধী অপরাধের বিচার যেভাবে হচ্ছে, সেটাও যথাযথ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যরিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া অভিযোগ করেছেন, প্রসিকিউটর নিয়োগে স্বার্থের দ্বন্দ্ব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, অতীতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুালে বিচারাধীন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন তাজুল ইসলাম, আজহারুল ইসলামের পক্ষেও আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন তিনি। আজহারুলের মামলায় তিনি সরাসরি আপিল বিভাগের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তার নেতৃত্বাধীন প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের পক্ষে আপিল বিভাগে লড়েছেন। এই ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত হয়েছে বলে মনে করেন বার্গম্যান ও জ্যোর্তিময় বড়ুয়া।
জনাব আজহারুলকে খালাস দেয়ার অনেক আগেই ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই প্রশ্নটি তোলা হয়েছিল। সেই নিবন্ধে আইনজীবী শাহদীন মালিকসহ অনেকে প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলোর বাদী হিসেবে থাকেন চিফ প্রসিকিউটর। এ কারণে আজহারুলের রিভিউ শুনানিতে তাজুল ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণ না করলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তিনি এখন এই মামলার বাদী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের যে মামলাগুলোতে তিনি বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ছিলেন, চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি হয়ে গেছেন বাদীপক্ষের প্রধান আইনজীবী। অবশ্য চিফ প্রসিকিউটরের অফিস থেকে এ সংক্রান্ত একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, একই ধরনের অপরাধে বা একই দলের বা গোষ্ঠীর কোনো ব্যক্তির পক্ষে ডিফেন্স করেছেন বলে একজন আইনজীবী সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো ব্যক্তির প্রসিকিউশন করতে পারবেন না, এমন কোনো আইনগত বাধানিষেধ পৃথিবীর কোথাও নেই।
যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে একটি আন্তর্জাতিক দর্শন আছে। সেটি হলো, বিচারিক প্রক্রিয়ায় সব ধরনের নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতা যথাযথভাবে রক্ষা করা। কারণ ফৌজদারি মামলার বিচারের ক্ষেত্রে দেখা হয়, কোনো নিরাপরাধ মানুষ কিংবা কেউ যেন ক্ষোভ, রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে শাস্তি না পান। অর্থাৎ আগে থেকে যেন এমন সন্দেহের উদ্রেক না হয় যাতে বিচারের ফলাফল অনুমান করা যায়। এটাকে বলা হয় অনিশ্চয়তা। এ অনিশ্চয়তা না থাকলে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হবেন, নাকি নির্দোষ প্রমাণিত হবেন, মানে তাদেরকে জোর করে দণ্ড দেয়া হবে কী হবে না এমন অনিশ্চয়তা না থাকলে বিষয়টি হয়ে পড়বে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ প্রবাদের মতো। যেমন, বিগত আওয়ামী লীগ আমলে বিরোধী মতগুলোকে দমনের জন্য বহু মামলা করা হয়েছিল। খোদ এখনকার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা করা হয়েছিল, যেগুলোর মেরিট বা ভিত্তি নেই বললেই চলে। আবার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল— এটি সত্যি। কিন্তু যেভাবে নিতান্তই গায়ের জোরে অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়ার প্রক্রিয়া বিগত সরকারের আমলে ছিল, সেটি থেকে এমন ধারণা হয়েছিল— বিচার প্রক্রিয়া যাই হোক শাস্তি অবধারিত। বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও অভিযুক্তদের শাস্তি দেয়া হবে— এমন সন্দেহ থাকলে সেখানে ন্যায়বিচার প্রশ্নবিদ্ধ হবে এমনটাই স্বাভাবিক।
আইসিটিতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা মামলাটি ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম আসামি শেখ হাসিনা গং’ মামলা হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। অতীতের যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর বিচার যেহেতু প্রশ্নবিদ্ধ, তাই অতীতের আসামি পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এমন পরিস্থিতে চিফ প্রসিকিউটর যখন আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা’, তখন সন্দেহ আরো বাড়িয়ে দেয়। এখানে আরো একটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত। এখনও আইসিটিতে বিগত সরকারের আমলে দায়ের করা যুদ্ধাপরাধের অনেকগুলো মামলা চলমান আছে। বলা ভালো, সেগুলো এখন হিমাগারে চলে গেছে। খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন তোলা কি খুব অমূলক হবে যে, যারা আগে বিবাদী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন তারা এখন রাষ্ট্র বা বাদীপক্ষের আইনজীবী হওয়ায় পাশার দান পুরো উল্টে গেছে? এটা তো সত্যি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বহু ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছিল, যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। আগের আমলে বিচার প্রক্রিয়া যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাহলে বর্তমান সরকারের উচিত বিদ্যমান মামলাগুলোর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।
কিন্তু বর্তমানে আইসিটির প্রসিকিউশন টিমের যে রেকর্ড তাতে আব্দুল আলীমের সেই বিখ্যাত লাইনগুলো মনে পড়ে যেতে পারে, ‘তুমি হাকিম হইয়া হুকুম কর পুলিশ হইয়া ধর, সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়।’ চিফ প্রসিকিউটর আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করতে চাই, একটি সভ্য সমাজ, যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে, সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না। যে দেশে বিচার থাকবে, সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না, কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।’ কিন্তু তাঁর অতীত ট্র্যাক রেকর্ড আর ‘কেবল’ জুড়ে দেয়া বাক্যটি এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সন্দেহটি আরো বাড়ে যখন শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটরের দেয়া বক্তব্য আমরা শুনি। শুনানিতে শেখ হাসিনাকে একজন ‘নিষ্ঠুর শাসক’ উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফ্যাসিস্ট শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা। শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের নিউক্লিয়াস। হাসিনা টিকে থাকলে তাঁরাও (আওয়ামী লীগের নেতা ও সে সময়ের মন্ত্রী) টিকে থাকবেন এ মানসিকতা ছিল তাদের। সে হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন অপরাধের প্রাণভ্রোমরা। তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আর আসাদুজ্জামান খান কামাল ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন তা বাস্তবায়ন করেছেন।’
এছাড়া রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলোতে আওয়ামী লীগ সরকারের লোকেরাই হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টার অভিযোগ করেন চিফ প্রসিকিউটর। এত স্পর্শকাতর একটি মামলায় এমন ঢালাওভাবে অভিযোগ আনার অর্থ হলো প্রসিকিউশন মামলাটির তদন্ত ও উপস্থাপন গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে না।
মেট্রো রেলে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেয়া এক সমন্বয়কের মন্তব্য গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে বেশ হই চই ফেলে দিয়েছিল। ‘যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না’— বেসরকারি টেলিভিশন ডিবিসির ‘প্রযত্নে বাংলাদেশ’ টকশোতে অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম।
এমন বক্তব্যের জন্য সংগঠন থেকে তাকে শোকজও করা হয়েছিল। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘আমরা এটাকে বিপ্লব বলছি বা গণঅভ্যুত্থান, যাই বলি না কেন, এটা কোনো সাংবিধানিক নিয়ম মেনে হয়নি, আইন মেনে হয়নি। আইন যদি মানতে যেতাম, তাহলে কিন্তু এই বিপ্লবগুলো হতো না। যদি মেট্রোরেলে আগুন না দেওয়া হতো, যদি পুলিশদের না মারা হতো তাহলে এই বিপ্লবটা এত সহজে অর্জিত হতো না। ফ্যাসিবাদের পতন নিশ্চিত করা যেত না। এখানে কিন্তু নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে, পৃথিবীর সকল বিপ্লবই সংবিধান বা নিয়মের বাইরে যেয়ে হয়েছে। এ কারণে আইনের বাইরে যেয়ে বা সাংবাধানিক পদ শূন্য হবে এরকম কথা বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রে কতটা যৌক্তিক সেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে না।’
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, প্রসিকিউশন চিফ আর সমন্বয়কের বক্তব্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। দুজনই কিন্তু জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য লড়ছেন। একজন আদালতে, আরেকজন রাজপথে। এমন সাংঘর্ষিক বক্তব্য অবশ্যই এই বিচার প্রক্রিয়ার দিকে আঙ্গুল তুলবে। সেখানে যতই নিরপেক্ষতার দাবি করা হোক না কেন প্রসিকিউশন টিমের অতীত টেনে এনে তাঁদের ‘প্রতিশোধপরায়ণতা সম্পর্কে ধারণাকে’ অমূলক বলে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। যদি আগুন দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগের সমর্থনে পর্যাপ্ত ও অকাট্য প্রমাণ উপস্থাপন করা না যায়, অথবা যদি প্রমাণগুলো পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
যদি বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত বলে মনে হয়, অর্থাৎ যদি মনে হয় যে ক্ষমতার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এই অভিযোগ আনা হয়েছে এবং বিচারিক সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তাহলে এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠবে। এক্ষেত্রে, ট্রাইব্যুনালের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে। অভিযোগপত্রে জুলাই হত্যাকাণ্ডকে ‘সমন্বিত নির্মূল পরিকল্পনা’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা ‘ব্যাপক’ ও ‘পদ্ধতিগত’ ছিল। কিন্তু প্রসিকিউশন ও আন্দোলনকারীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়ে ‘সিস্টেমেটিক’ অপরাধ প্রমাণ করা যাবে না।
অভিযোগের শুনানিতে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন’, ‘রোম স্ট্যাটিউট অব দি আইসিসি’ এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য। আন্তর্জাতিক মানের বিচারের জন্য তদন্ত, প্রসিকিউশন, বিচার— সবকিছু আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত। ডেভিড বার্গম্যানের একটি নিবন্ধ দৈনিক প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছিল গত বছরের ২৪ অক্টোবর। সেখানে তিনি আইসিটিতে নিয়োগকৃত বিচারকদের সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেগুলো বেশ যৌক্তিক যদি আমরা জুলাই হত্যাকাণ্ডের আন্তর্জাতিক মানের বিচার চাই। বার্গম্যান বলছেন, এই আদালতের বিচারকদের কারোরই কর্মজীবনে কোনো মামলায় আন্তর্জাতিক আইনের নীতি প্রয়োগ করার কোনো অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। আলোচ্য বিচারের সঙ্গে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং তাকে ঘিরে থাকা জটিল আইন জড়িত। তাই এই অভিজ্ঞতা বিচারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যোগ্যতা বলে মনে হয়।
আবার এই আদালতের বেশিরভাগ বিচারক বেশ কয়েক বছরে কোনো ধরনের ফৌজদারি মামলার বিচারক ছিলেন না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল হলেও, এর কার্যপদ্ধতি এবং বিচারিক মান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ন্যায়বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যদি প্রক্রিয়াগত ত্রুটি থাকে বা অভিযুক্তের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এই বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক মহলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
শুরু থেকেই অনেকে বলছিলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে হওয়াই ভাল। এমনকি জাতিসংঘের প্রতিবেদনেও তা বলা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা করলে যদিও তার রায় পেতে সময় বেশি লাগতো, কিন্তু প্রক্রিয়াটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যেতো, যেটি বিচারের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বাড়িয়ে তুলতো। এমনকি আইসিসি যদি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতো, তাহলে সেটির রাজনৈতিক প্রভাব অনেক ব্যাপক হতো। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ভবিষ্যতে যদি বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল ঘটে, তাহলে রায়ের কোনো পরিবর্তন করা যেতো না।
‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না’— এই নীতিবাক্যটি গণতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি। তবে, এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে হলে বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জুলাই আন্দোলনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটাই অস্থিতিশীল। এই অবস্থায় একটি উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের নিঃসন্দেহে একটি সংবেদনশীল বিষয়।
এই ট্রাইব্যুনালের আগে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হলেও এর এখতিয়ার ও কার্যকারিতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্ক দেখা গেছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ধরন এবং তার আইনি প্রক্রিয়া এই ট্রাইব্যুনালের ভবিষ্যতের কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপরও প্রভাব ফেলবে। আদালতের বিচার কাজ সরাসরি সম্প্রচার করে, রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে হয়তো এক পক্ষের বাহবা পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু সেটি কোনোভাবেই বিচারের মানদণ্ড নিশ্চিত করতে পারে না। যদি ট্রাইব্যুনাল স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করতে না পারে তাহলে আইনের চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ। দেশটির জাতীয় ঐক্য এবং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ওপর ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়বেই। [সিন্ডিকেটেড কনটেন্ট হিসেবে ডয়চে ভেলে থেকে প্রকাশিত]
লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
১০ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
১০ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসম্পাদকীয়

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন ববির অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মামুনুর রহমান। ঘটনার শিকার ছাত্রী ৫ অক্টোবর অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যানকে দেওয়া অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘গত ১৬ সেপ্টেম্বর মামুন স্যারের নির্দেশে বিকেল সাড়ে ৪টায় থিসিসের প্রশ্নপত্র তৈরির জন্য তাঁর কাছে যাই। সেখানে স্যারের পক্ষ থেকে অপ্রাসঙ্গিক এবং অনৈতিক আচরণের সম্মুখীন হই। আমাকে হুমকি দেন, বিভাগের কোর্সগুলোতে তিনি পরীক্ষক হিসেবে আছেন। সুতরাং অনেক কিছু করতে পারেন।’ ২০২৩ সাল থেকে ওই শিক্ষক তাঁকে বিরক্ত করছেন। এ জন্য তিনি মানসিক ট্রমায় আছেন। এদিকে বিভাগীয় চেয়ারম্যান অপূর্ব রায়কে ওই ছাত্রী লিখিত অভিযোগ দিলে তিনি মুখ খুলতে বারণ করেছেন।
একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ডিগ্রি অর্জনের স্থান নয়, বরং তা বিবেক ও নীতি-নৈতিকতা অর্জনের জায়গা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস করানোর নামে একজন ছাত্রীকে যে ধরনের অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে, তা লজ্জাজনক তো বটেই, উচ্চশিক্ষার নীতিনৈতিকতার বিরুদ্ধে অবস্থানও। আশঙ্কার বিষয় হলো, ওই ছাত্রী আড়াই মাস আগে লিখিত অভিযোগ দিলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ব্যাপারটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং তদন্তের নামে কালক্ষেপণ করার যে অভিযোগ উঠেছে, তা বিভাগের সদিচ্ছাকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
ভুক্তভোগী ছাত্রীর ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষক তাঁকে একাডেমিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করার হুমকিও দিয়েছেন। একজন শিক্ষক যখন নিজের পদমর্যাদাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীকে ‘পরীক্ষক’ হওয়ার ভয় দেখান, তখন তা সরাসরি ক্ষমতার অপব্যবহার। দুই বছর ধরে একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক ট্রমার মধ্যে রাখা কোনোভাবেই সাধারণ ঘটনা নয়। যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠে এবং বিভাগ তা আড়ালের চেষ্টা করে, তাহলে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ বোধ করবেন কোথায়?
আমরা মনে করি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী সুপ্রিম কোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোরভাবে সেটি পালন করতে হবে। পাশাপাশি অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ ও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটির মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। তদন্ত চলাকালে অভিযুক্ত শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দিতে হবে, যাতে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন। এ ছাড়া ভুক্তভোগী ছাত্রীর একাডেমিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা ও স্নেহের। কিন্তু সেই সম্পর্কের আড়ালে লালসা ও হুমকির সংস্কৃতি গড়ে উঠলে সেই বিদ্যাপীঠ তার গৌরব হারায়। আমাদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুততম সময়ে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
১০ জুন ২০২৫
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
১০ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
১০ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল, যুদ্ধক্ষেত্রের প্রথম সারির সেই সহযোদ্ধারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। শত্রুতাও দেখা দিয়েছে পারস্পরিক।
যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে খালেদ মোশাররফের ছিল অতুলনীয় সাহসী এক বিদ্রোহ। আর দেশবাসীর একটি অত্যন্ত সংকটময় ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্তে জিয়াউর রহমান বেতারে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর ভীষণ রকমের প্রয়োজনীয় যে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন, ইতিহাসে তা লেখা রয়েছে। যুদ্ধের কিছুদিন পরেই কিন্তু দেখা গেল, খালেদ মোশাররফ শিকার হয়েছেন অবিশ্বাস্য রকমের নির্মম এক হত্যাকাণ্ডের।
আবুল মঞ্জুর, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধ করেছেন। তবে মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, যুদ্ধের যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, যাঁর বিরুদ্ধে উল্টো গুঞ্জন ছিল পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার। মঞ্জুর হত্যা নিয়ে মামলা একটা হয়েছিল, কিন্তু বিচার হয়নি।
যুদ্ধ করবেন বলে পাকিস্তান থেকে ছুটে এলেন আবু তাহের; যুদ্ধ করলেনও, যুদ্ধে একটি পা হারালেন। যুদ্ধশেষে তিনি তৎপর হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর ভেতর বিপ্লবী কর্মে; পরিণামে তাঁকে অভিযুক্ত হতে হলো সেনাবাহিনীর অফিসার ও তাঁদের পরিজনদের হত্যার প্ররোচনাদানকারী হিসেবে।
এম এ জলিল যুদ্ধ করেছেন দেশের ভেতরে থেকেই; যুদ্ধের পরে তিনি গ্রেপ্তার হলেন ভারতীয় বাহিনীর কিছু সদস্যের লুণ্ঠন তৎপরতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। জিয়াউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ সামরিক অফিসার ছিলেন, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে যুদ্ধে নেমেছিলেন। যুদ্ধশেষে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন সরকারের নীতি সঠিক নয় বলে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন এবং চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দিলেন সর্বহারা পার্টিতে।
সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এসব ঘটনায় বোঝাই যাচ্ছিল, রাষ্ট্র স্থিতিশীলতা পায়নি। যুদ্ধের সময় কেউ দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি, স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সামরিক শাসন আসবে। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিত ও অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটেছে। একবার নয়, কয়েকবার। তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এই যে দেশ স্বাধীন হলেও রাষ্ট্রের চরিত্র বদলায়নি। কথা উঠেছিল বাংলাদেশের জন্য কোনো সামরিক বাহিনী থাকার আদৌ দরকার আছে কি না, তা নিয়েই। থাকলেও সেটা কেমন ধরনের এবং কোন মাত্রার হবে, সেটা নিয়েও। কিন্তু সে বিষয়ে ভাববার সময় পাওয়া যায়নি। নতুন শাসকদের উদ্বেগ ছিল পুরোনো ব্যবস্থাকে আপৎকালীন বন্দোবস্ত হিসেবে হলেও চালু রাখা যায় কি না, তা নিয়ে। সেটা সম্ভব হয়েছিল এবং সেটা করতে গিয়ে পুরোনো আইনকানুন, আদালত, আমলাতন্ত্র—সবই চালু থাকল।
সামরিক বাহিনীও আগের ধরনেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হলো। ফলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া এবং না নেওয়া—এই দুই ভাগের ভেতর নীরব ভুল-বোঝাবুঝি তৈরি হলো। গঠিত রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে নিয়মিত সামরিক বাহিনীর একটি দ্বন্দ্বও দেখা দিল। সংবিধান প্রণীত হলো, কিন্তু দেখা গেল, তাতে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অস্তিত্বের স্বীকৃতি নেই। বাংলাদেশকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বের কথা ভুলে তাকে জাতিরাষ্ট্র হিসেবেই বিবেচনা করা হলো। অনেকটা পাকিস্তানি কায়দাতেই।
যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল, যুদ্ধের পরে সেটা প্রকট হলো এবং তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে প্রধানমন্ত্রিত্ব, পরে মন্ত্রিত্ব থেকেই অপসারিত হলেন। অব্যবস্থাপনার দরুন দেশে দুর্ভিক্ষের মতো একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেল। তাতে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়; আর বেসরকারি হিসাবে অনেক বেশি। চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড, পরীক্ষায় নকল, সম্পদ লুণ্ঠন—এসব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হবে, এমন আশা ছিল সর্বজনীন। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমাগত দূরে সরে যেতে থাকল। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, এমন যুদ্ধাপরাধীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলো। অবস্থা সামাল দেওয়ার জন্য ১৯৭৪ সালের শেষ দিকে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল। অল্প পরে ১৯৭৫-এর শুরুতে এল একদলীয় শাসন। কিন্তু তাতে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটল না। শুরুতে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী, আর সেটা ছিল সরকারের জন্য বিরাট এক মূলধন। কিন্তু সময় যতই এগোতে থাকল, সরকারের জনবিচ্ছিন্নতা ততই বাড়তে থাকল।
সবচেয়ে মর্মান্তিক এবং একেবারেই অবিশ্বাস্য যে ঘটনা ঘটল, সেটি হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সপরিবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের নেতৃত্বে এটা ঘটল। সরাসরি না হলেও ঘটনার পেছনে যে আমেরিকার সমর্থন ছিল, এই ধারণা অন্যায্য নয়। ক্ষমতায় এলেন আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ; তিনি যে মার্কিনপন্থী ছিলেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমেরিকা বাংলাদেশের অভ্যুদয় সমর্থন করেনি, তবে মেনে নিয়েছিল এবং চেষ্টা করেছিল নিজের প্রভাববলয়ের ভেতরে তাকে দ্রুত নিয়ে আসতে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জায়গায় মোশতাকের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে আমেরিকার জন্য সন্তুষ্ট হওয়ার কারণ ছিল। মোশতাক সরকারের চারিত্রিক ঝোঁকটা কোন দিকে, তা বোঝা গিয়েছিল ক্ষমতা দখলের সঙ্গে সঙ্গেই, তারা যখন ‘জয় বাংলা’র জায়গায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ নিয়ে এল, বাংলাদেশ বেতারের নাম দিল রেডিও বাংলাদেশ, রেডিও পাকিস্তানের আদলে, তখনই।
মোশতাকের সেই ‘বিপ্লব’ অবশ্য টেকসই প্রমাণিত হয়নি, তিন মাস হতে না হতেই তিনি এবং তাঁর ‘সূর্য-সন্তানেরা’ উৎখাত হয়েছেন। তবে ব্যাপার সুবিধার নয় দেখে জেলখানায় লোক পাঠিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের বন্দী চার শীর্ষ নেতাকে হত্যা করিয়েছেন। তারপরে ক্যু, পাল্টা ক্যু ঘটেছে।
তারপরে এরশাদ। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। পরে ‘গণতন্ত্রে’র প্রত্যাবর্তন। মাঝখানে ছদ্মবেশী সেনাশাসন। এরপরে ভোটারবিহীন নির্বাচন। সবকিছুই হলো, কিন্তু রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে। অধরাই থাকল ‘সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ’। আজও তাই বিজয়ের চুয়ান্ন বছরে সাধারণ মানুষ রহস্যাবৃত স্বাধীনতাকেই খোঁজে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
১০ জুন ২০২৫
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
১০ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেআসিফ

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ। সংবাদপত্রের ভাষায় এটি একটি ‘কালো অধ্যায়’, যা জাতিকেই স্তব্ধ ও মর্মাহত করে দিয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিশাল আর্কাইভ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি দগ্ধ হয়েছে সাত দশকের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট ও উদীচী।
এই প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ইমারত নয়, এগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সাক্ষী। ছায়ানটের প্রাচীন বই, সংগীতচর্চার দলিল, সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ—সবই ছাই হয়ে গেছে। উদীচীর সংগ্রহে থাকা গণসংগীত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দলিল, নাট্যচর্চার নথি ও আর্কাইভও ধ্বংসের মুখে পড়েছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সংরক্ষিত ফাইলগুলো ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। এসব নথির অনেকগুলোই হয়তো কখনো ডিজিটাল ফরম্যাটে সংরক্ষিত হয়নি। ফলে যে ক্ষতির মুখোমুখি আমরা হয়েছি, তা শুধু বস্তুগত নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডারের অপূরণীয় ক্ষতি।
এই ঘটনাকে যদি বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তাহলে আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংসের স্মৃতি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ছিল হারানো জ্ঞানের প্রতীক। প্রাচীন বিশ্বের অন্যতম বিস্ময় ছিল আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে প্রতিষ্ঠিত এই গ্রন্থাগারে কয়েক লাখ পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থ সংরক্ষিত ছিল বলা হয়। গ্রিক, মিসরীয়, ভারতীয়, ব্যাবিলনীয়, চীনা—বিভিন্ন সভ্যতার জ্ঞান সেখানে একত্র হয়েছিল। কিন্তু অগ্নিকাণ্ড ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় সেই গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে মানবসভ্যতা কয়েক হাজার বছরের জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, চিকিৎসা—অসংখ্য ক্ষেত্রেই আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। ইতিহাসবিদেরা বলেন, যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার টিকে থাকত, তবে মানবসভ্যতা হয়তো আরও কয়েক শতাব্দী আগে আধুনিকতায় পৌঁছাত। আজ বাংলাদেশে যা ঘটছে, তার মাত্রাগত হেরফের থাকতে পারে, তবে স্বরূপ সেই একই—জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর কুঠারাঘাত।
এই উদাহরণ আমাদের শেখায় যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির ভান্ডার শুধু কাগজে বা বস্তুতে সীমাবদ্ধ থাকলে তা বিপদের মুখে পড়ে। অগ্নিকাণ্ড, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ—সবই মুহূর্তে সেই ভান্ডারকে ধ্বংস করতে পারে। ফলে বাংলাদেশে আরও কতগুলো গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু রয়েছে। সে ব্যাপারে সতর্ক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের নথি শুধু সংবাদপত্রের ইতিহাস নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দলিল। এগুলোতে রয়েছে মানুষের সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, সাহিত্য ও শিল্পের খবর। ছায়ানটের বই ও নথি আমাদের সংগীতচর্চার ধারাবাহিকতা, রবীন্দ্রসংগীত ও নজরুলসংগীত সংরক্ষণের ইতিহাস বহন করত। উদীচী; যা গণসংগীত, নাটক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারক, তার নথিপত্র হারানো মানে আমাদের সাংস্কৃতিক স্মৃতির এক বড় অংশ মুছে যাওয়া।
উদীচীর আর্কাইভে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণসংগীতের দলিল, গণ-আন্দোলনের গান, নাট্যচর্চার স্ক্রিপ্ট এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাস। এগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি নয়, বরং বাংলাদেশের গণসংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ক্ষতি। ছায়ানট যেমন রবীন্দ্রসংগীতের ধারক, উদীচী তেমনি গণসংগীত ও নাট্যচর্চার ধারক। এই দুই প্রতিষ্ঠানের নথি ধ্বংস হওয়া মানে আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়া।
এই ক্ষতি শুধু বর্তমান প্রজন্মের নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও। তারা হয়তো আর জানতে পারবে না, কীভাবে একটি সমাজ তার সাংস্কৃতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল। যেমন আলেক্সান্দ্রিয়ার ধ্বংসের পরবর্তী প্রজন্মরা আর জানতে পারেনি প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পূর্ণ জ্ঞান। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নথি হারানো মানে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের শূন্যতা তৈরি হওয়া। আমরা এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে প্রযুক্তি আমাদের সেই সুরক্ষা দিতে পারে, যা আলেক্সান্দ্রিয়ার সময়ে অসম্ভব ছিল। আজকের পৃথিবীতে ‘তথ্য’ শুধু কাগজে সীমাবদ্ধ থাকা মানেই তাকে ঝুঁকির মুখে রাখা। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা এই ধরনের মানবসৃষ্ট নাশকতার হাত থেকে মূল্যবান সম্পদ রক্ষার একমাত্র পথ হলো ডিজিটাল রূপান্তর (ডিজিটাইজেশন)। যেমন—
ক্লাউড স্টোরেজ ও ডেটাবেইস: প্রতিটি বই, সংবাদপত্র ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাল স্ক্যান করে ক্লাউড সার্ভারে রাখা জরুরি।
আন্তর্জাতিক সংযোগ: আমাদের আর্কাইভগুলোকে আন্তর্জাতিক ডিজিটাল লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত করলে তা সারা বিশ্বের গবেষকদের কাছে যেমন পৌঁছাবে, তেমনি ভৌগোলিকভাবে কোনো এক জায়গায় ধ্বংস হলেও তার প্রতিলিপি অন্য কোথাও নিরাপদ থাকবে।
বাংলাদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো কাগজে নির্ভরশীল। ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরির উদ্যোগ সীমিত। ফলে অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনায় আমরা অমূল্য সম্পদ হারাই। এই ক্ষতি পূরণ করা যায় না। তাই এখনই আমাদের জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত ডিজিটাল সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু করা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র—সবাইকে এতে যুক্ত করতে হবে।
আলেক্সান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার ধ্বংস আমাদের শেখায়, জ্ঞান সংরক্ষণে অবহেলা মানে সভ্যতার পশ্চাৎপদতা। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডও একই সতর্কবার্তা বহন করছে। যদি আমরা এখনই ডিজিটাল সংরক্ষণে মনোযোগ না দিই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মতোই ইতিহাসের শূন্যতায় দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা হয়তো জানবে না আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন, সংগীতচর্চা, সংবাদপত্রের সংগ্রাম—সবই কেমন ছিল।
প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীর নথি হারানো শুধু একটি অশুভ শক্তির আস্ফালন প্রদর্শন করা নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক বিপর্যয়। প্রথম আলো বা ডেইলি স্টারের নথিপত্র শুধু কিছু কাগজের স্তূপ নয়; এতে ধরা আছে আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাস। ছায়ানট ও উদীচীর আর্কাইভ শুধু গানের সংকলন নয়; তা আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভিত্তি। এই নথিগুলো হারিয়ে যাওয়া মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করা। যেমনটা আলেক্সান্দ্রিয়ার পতনের পর পরবর্তী প্রজন্মগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়েছিল, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও হয়তো জানবে না কীভাবে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর সুরের সাধনায় একটি জাতি তার পরিচয় গড়ে তুলেছিল। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি শুধু নথি এবং গ্রন্থ সংরক্ষণে সহায়তা করবে না। এভাবেই আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানভান্ডার উপহার দিতে পারব।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
১০ জুন ২০২৫
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
১০ ঘণ্টা আগে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের...
১ দিন আগেদীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য।
আবু তাহের খান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান বলেছেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে—এ দাবি অবান্তর’ (সমকাল, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫)। ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত ‘মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ এবং একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ মন্তব্য করেন। আলোচনা সভার বিষয়বস্তু এবং এ বিষয়ে তাঁর দেওয়া বক্তব্যের ধরন থেকে প্রতীয়মান হচ্ছে যে এ ধরনের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্যই বস্তুত পরিকল্পিত শিরোনামের আওতায় পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ওই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘মুক্তচিন্তা’র নামে যে চিন্তার প্রকাশ তিনি আলোচনা সভায় ঘটালেন, তা কি মুক্তচিন্তা নাকি বিকৃত মিথ্যাচার? একজন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক হয়ে, তা তিনি যে রাজনৈতিক মতাদর্শের লোকই হোন না কেন, এ ধরনের বিকৃত মিথ্যাচারের আশ্রয় নেওয়া কি সঠিক হয়েছে?
একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড আজ বিশ্বস্বীকৃত ইতিহাসের অংশ। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এর বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। প্রায় একই সময়ে বিবিসি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘পাকিস্তানিদের দৃষ্টিতে একাত্তর’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তৎকালীন পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের জিওসি জেনারেল এ এ খান নিয়াজি এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর বক্তব্য থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাও ফরমান আলীই ছিলেন এ পরিকল্পনার মূল হোতা, যার বাস্তবায়নের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল এ এ খান নিয়াজির সেনাসদস্য এবং আলবদর ও আলশামসের সদস্যরা। উল্লেখ্য, সে সময় রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকাও পাওয়া গিয়েছিল। উল্লিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার লক্ষ্যে রাও ফরমান আলী অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় ধীরস্থিরভাবে ওই তালিকা প্রণয়ন করেছিলেন। আর ওই তালিকা অনুযায়ী বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে তুলে নিয়ে এসে হত্যা করার ব্যাপারে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা করেছিল তৎকালীন ইসলামি ছাত্রসংঘের কর্মীদের নিয়ে গঠিত আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।
বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোতেও সে সময় সবিস্তারে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। এ বিষয়ে ১৯৭১ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পৃষ্ঠার শীর্ষ সংবাদ ছিল ‘সোনার বাংলায় মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড’। আর ১৯ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়ও এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল ‘রক্তস্নাত বাংলাদেশ কাঁদো’। উল্লেখ্য, সে সময় দেশের সব পত্রিকাই সাদাকালো রঙে ছাপা হলেও দৈনিক পূর্বদেশ সেদিন বড় অঙ্কের আর্থিক ত্যাগ স্বীকার করে প্রথম পৃষ্ঠায় ৮ কলামে রঙিন শিরোনাম করেছিল রক্তের রঙে—লাল কালিতে। অন্যদিকে এ বিষয়ে বেতার সম্প্রচার তো ছিলই। বাংলাদেশ বেতারের ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রচারিত প্রায় প্রতিটি সংবাদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল, সে-সংক্রান্ত কিছু কিছু রেকর্ড এখনো বাংলাদেশ বেতারের আর্কাইভে পাওয়া যাবে বলে ধারণা করা যায়। ভয় হয়, এ প্রবন্ধে উল্লিখিত তথ্যসূত্রের কথা শুনে হত্যাকারীদের অনুগামীরা না আবার এসব রেকর্ডপত্র বিনষ্ট করার উদ্যোগ নিয়ে নেয়, যেমনটি সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা স্থানে নানা ক্ষেত্রে ঘটতে দেখা গেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড এবং এর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশেষত এর উপ-উপাচার্য ইতিহাসকে পাল্টে ফেলার ব্যাপারে এতটা লজ্জাবর্জিত ও বিবেকহীন হয়ে উঠলেন কেমন করে? চিন্তা ও মননে তিনি যত পশ্চাদমুখীই হোন না কেন, পেশাগত পরিচয়ে এখনো তো তিনি একজন শিক্ষক। আর একাত্তরের ওই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশই তো শিক্ষক ছিলেন। তো সেই সুবাদেও কি এ রকম বিকৃত মিথ্যাচারের সঙ্গে যুক্ত হতে আপনার বিবেক আপনাকে এতটুকু বাধা দেয়নি! এ ক্ষেত্রে কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে যে একজন শিক্ষক যদি বিকৃতি ও অসত্যাচারে যুক্ত হন, তাহলে তাঁর কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কী শিখবে এবং সেই ধারাবাহিকতায় এ জাতির ভবিষ্যৎই-বা কী? প্রায় একই সময়ে (৯ ডিসেম্বর ২০২৫) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান ইতিহাসের অন্যতম মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়াকে বললেন ‘মুরতাদ কাফির’। আর তাঁর ওই বক্তব্যের মাত্র পাঁচ দিন পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাস থেকেই নিশ্চিহ্ন করে দিতে উদ্যোগী হলেন।
অধ্যাপক মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান ও খন্দকার মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসানের রাজনৈতিক অভিভাবকেরা অবশ্য বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে অস্বীকার করেননি। তাঁরা এটিকে বলেছেন ‘দিল্লির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে (প্রাগুক্ত)। ওবায়দুল কাদেরের নির্লজ্জ ভারত তোষণমূলক বক্তব্যের যেমন নিন্দা করেছি ও করছি, তেমনি প্রত্যাখ্যান করছি তাঁদের এ তথাকথিত দিল্লি ষড়যন্ত্রের স্লোগানকেও। উল্লেখ্য, উপ-উপাচার্যের সঙ্গে মিলে একই দিনে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এ মন্তব্য করেন। আয়োজন ও মন্তব্যের ধরন থেকে মনে হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও অবলোপনের এ উদ্যোগটি তাঁরা পরিকল্পিতভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কেন? জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের কাছে বিনীতভাবে একটি প্রশ্ন রাখি, এ দেশকে কি আর কোনো দিন পাকিস্তানের অংশ করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অতীতের ভুলত্রুটি স্বীকার করে অনুতপ্ত হয়ে কেন আপনারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতে পারছেন না? এ দেশে অশান্তি ও অস্থিরতা বিরাজ করলে তা থেকে শুধু আপনাদের কেন, কারও পক্ষেই কি লাভবান হওয়ার কিছু আছে? অথচ দেখুন তো, নানা দল, মত ও পথের রাজনীতিকদের সৃষ্ট নানাবিধ অস্থিরতার কারণে এ দেশের সাধারণ মানুষ আজ কত কষ্ট পাচ্ছে। তাদের জীবন আজ নানা দুর্ভোগ ও অশান্তিতে কত দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষের এসব কষ্ট কি আপনাদের এতটুকুও স্পর্শ করে না? যদি করে, তাহলে অতীতের সব রাগ, ক্ষোভ ও জিঘাংসার কথা ভুলে গিয়ে সব ধরনের ধর্মীয় উগ্রতা ও সাম্প্রদায়িকতাকে বিসর্জন দিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যান। দেখবেন আপনারা সবাই ভালো আছেন।
পরিশেষে বলি, দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণভিত্তিক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে দেশের জন্ম, সে দেশের ইতিহাসকে তথ্যবিকৃতি ও অসত্যাচার দিয়ে মুছে ফেলা কখনোই এবং কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে বরং সেটিকে মেনে নিয়ে পারস্পরিক মমতা, সৌহার্দ্য ও সমন্বয়ের ভিত্তিতে কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা নিয়ে ভাবাটাই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই মুহূর্তের উত্তম কর্তব্য। আর আশা করছি, বিবেকের তাড়নায় তৈরি এ লেখার জন্য মব বা অন্য কোনোরূপ পীড়নের শিকার হব না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল হয়েছে। সেখানে চিফ প্রসিকিউটরের বক্তব্যের কিছু অংশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ও সমাধান খোঁজা জরুরি।
১০ জুন ২০২৫
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন নিপীড়ন এবং অনৈতিক প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। ছাত্রীর অভিযোগ, থিসিস (গবেষণাপত্র) করানোর নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ডেকে অনৈতিক প্রস্তাব দেন ওই শিক্ষক। এ নিয়ে আজকের পত্রিকায় ২৩ ডিসেম্বর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়।
৯ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের প্রস্তুতিবিহীন যুদ্ধে পূর্ববঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বিদ্রোহ করে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যুদ্ধ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন যুদ্ধে; কিন্তু যুদ্ধের পরে দেখা গেল...
১০ ঘণ্টা আগে
১৮ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিন এক গভীর ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সংবাদপত্র বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে একদল অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের হামলা ও অগ্নিসংযোগ কেবল গুটিকয়েক দালান কিংবা আসবাবের ওপর আঘাত নয়, বরং এটি আমাদের জাতীয় স্মৃতিশক্তির ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ।
১০ ঘণ্টা আগে