Ajker Patrika

উদ্যোক্তা উন্নয়নে সমস্যা কোথায়

আবু তাহের খান 
উদ্যোক্তা উন্নয়নে সমস্যা কোথায়

অন্তর্বর্তী সরকার প্রসঙ্গে এ পর্যন্ত যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে, নিঃসন্দেহে সেটি ‘সংস্কার’। আর এ সংস্কারের আওতায় যে বিষয়গুলো সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত বলে সাধারণভাবে অভিমত ব্যক্ত হতে দেখা গেছে, তার মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতেই ছিল জনগণকে সেবাদানকারী আমলানিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানসমূহের কাঠামো ও কর্মকাণ্ডের পুনর্গঠন, পুনর্বিন্যাস ও চর্চার ধরনে পরিবর্তন আনার দাবি। প্রকাশিত তথ্যমতে, এ বিষয়ে গঠিত কমিশনগুলো ইতিমধ্যে আমলানিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানাবিধ সংস্কার-প্রস্তাব প্রণয়নের কাজ প্রায় সম্পন্ন করে এনেছে। কয়েকটি কমিশন তাদের প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দিয়েছে এবং বাকিরাও শিগগিরই জমা দেবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তাদের সেসব সংস্কার প্রস্তাবে অন্য অনেক কিছু থাকলেও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর অতিকেন্দ্রায়ণ এবং ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ঘনীভূতকরণের অবসানকল্পে তেমন গভীরতাপূর্ণ কোনো করণীয় সুপারিশ করা হয়েছে বা হচ্ছে বলে জানা যায় না।

বাংলাদেশে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের সম্ভাবনা ও প্রয়োজনীয়তার নিরিখে মোটা দাগের কিছু সমস্যা সামনে রেখে এ লেখাটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হলো। সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে: এক. বাংলাদেশে এই মুহূর্তে যাদের সম্ভাব্য উদ্যোক্তা হিসেবে গণ্য করা যায়, তাদের সিংহভাগেরই অবস্থান হচ্ছে আধা-গ্রাম বা মফস্বল শহর। কিন্তু এতৎসংক্রান্ত কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহায়তার অধিকাংশই ঘনীভূত হয়ে আছে রাজধানী ও তার বাইরের বড় শহরগুলোতে। আর এসব ক্ষেত্রে নীতি ও সিদ্ধান্ত প্রণয়নের বিষয়টি তো প্রায় পুরোপুরিই সচিবালয় বা রাজধানীকেন্দ্রিক। এ অবস্থায় দেশে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমকে জোরদার করার জন্য দেশের ভৌগোলিক কেন্দ্রে অর্থাৎ রাজধানীতে বসে এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করে যত ভালো ভালো কথাই বলা হোক না কেন, বাস্তবে সেসব ফলপ্রসূ হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই। আর এ অবস্থা বিরাজমান থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষের তাত্ত্বিক বক্তৃতায় শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যত পরামর্শই দিন না কেন, তাতে ওইসব পরামর্শ শ্রবণকারীদের মধ্য থেকে কতজন শেষ পর্যন্ত উদ্যোক্তা হয়ে উঠবেন, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা যে সম্প্রতি কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তৃতায় তাঁদের উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানালেন, সে আহ্বানেরও কোনো প্রভাব বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের ওপর পড়বে বলে মনে হয় না। কারণ, দেশের চলমান অতিকেন্দ্রায়িত উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায়, আমলাতান্ত্রিক স্বার্থে গত দেড় দশকে যা আরও অধিক কেন্দ্রীভূত হয়েছে, সেটি বলতে গেলে অনেকটাই অসম্ভব।

দুই. উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় বর্তমানে উদ্যোক্তাদের যেসব সেবাসহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে, তার অধিকাংশই দেওয়া হচ্ছে অত্যন্ত অপেশাদারি আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যবহার করে। এর মধ্যকার একটি বড় অংশই আবার দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সদস্যদের মাধ্যমে, যাঁদের প্রশাসনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে নানামাত্রিক জ্ঞান থাকলেও উদ্যোক্তাবৃত্তির বিষয়ে বিশেষায়িত কোনো জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে এ ধরনের সহায়তা নিয়ে উদ্যোক্তারা কতটুকু লাভবান হচ্ছেন বা হতে পারছেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তদুপরি এ অবস্থা আরও অধিক করুণ হয়ে উঠেছে যখন এ অপেশাদার লোকদেরকেই দিনে দিনে আরও অধিক হারে উদ্যোক্তা উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়ন, কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং একই সঙ্গে তা তত্ত্বাবধান ও পরিধারণের দায়িত্ব প্রদান করা হচ্ছে। অর্থাৎ উদ্যোক্তা উন্নয়নের লক্ষ্যে আনুষঙ্গিক সেবাসহায়তা প্রদানের কাজটি ক্রমেই আরও বেশি করে সচিবালয়ের বদ্ধ প্রকোষ্ঠে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, যার মাত্রা গত দেড় দশকে শুধু বাড়েইনি, অনেকটা ভয়ংকরও হয়ে উঠেছে।

তিন. দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রম বোঝেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের কার্যকর সহায়তাদানে সক্ষম—এরূপ প্রচুরসংখ্যক নেতা-কর্মী থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের স্বার্থ ও খবরদারির কারণে কখনোই তাঁদের সে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্যকে যথাযথ পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের আওতায় ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা করা হয়নি কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের সদস্যদের সুবিধা ভাগাভাগির আয়োজনকে নিষ্কণ্টক রাখার প্রয়োজনে। অথচ উদ্যোক্তা উন্নয়নের বুঝজ্ঞানসম্পন্ন উল্লিখিত নেতা-কর্মীদের এ কাজে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে কাজটি ইতিমধ্যে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারত।

চার. উদ্যোক্তা উন্নয়নের কাজে সবচেয়ে কার্যকর সহায়তাদানে সক্ষম যে স্থানীয় সরকার, সেটিকে কখনোই এ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড ও কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত করা হয়নি। অথচ দেশের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে তাঁদের এ কাজে টেকসই পন্থায় দাঁড় করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই স্থানীয় সরকারের চেয়ে উত্তম কোনো বিকল্প নেই। বস্তুত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে এ ধরনের দায়িত্ব পালনের জন্যই সংবিধানে স্থানীয় সরকারের বিধান রাখা হয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভারতেও উদ্যোক্তা উন্নয়নসংক্রান্ত কাজগুলো স্থানীয় সরকারের কাজেরই অংশ।

ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশের নবীন উদ্যোক্তা ও তাঁদের কর্মীদের মধ্যে কারিগরি ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে উদ্যোক্তা উন্নয়নের জাতীয়ভিত্তিক দায়িত্বে নিয়োজিত বিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বিআরডিবি, কর্মসংস্থান ব্যাংক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান যে ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে, প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল এবং সেগুলোর মানও অত্যন্ত নিচু। সে ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও অন্য বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে গড়ে ওঠা প্রশিক্ষিত জনবল এ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সম্পূরক সহায়তা প্রদানে সক্ষম হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেসবের অধিকাংশই মানহীন ও অত্যন্ত পশ্চাৎপদ আঙ্গিকের এবং সর্বশেষ বাজার-চাহিদার সঙ্গেও এগুলো সংগতিপূর্ণ নয়। এমতাবস্থায়, দেশে ব্যাপক সংখ্যায় গুণগত মানসম্পন্ন উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে হলে প্রচলিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের ব্যাপকায়নই শুধু নয়, এসবের আধুনিকায়নও অত্যন্ত জরুরি। আর তা করতে হলে উদ্যোক্তা উন্নয়নসংশ্লিষ্ট উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের দক্ষতা ও সামর্থ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি সর্বশেষ বাজার-চাহিদা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ধারার সঙ্গে এগুলোকে সংগতিপূর্ণ ও মানসম্পন্ন করে তুলতে হবে। কিন্তু সেটি না করে উদ্যোক্তাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা উন্নয়নের নামে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে রেখে আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ে যেভাবে একের পর এক প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, সেগুলোকে স্বেচ্ছাচারিতা বললেও কম বলা হয়।

উদ্যোক্তাদের ইক্যুইটি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় ২০০০ সালে গঠন করা হয় ‘ইক্যুইটি অ্যান্ড এন্ট্রাপ্রেনিওরশিপ তহবিল’ (ইইএফ)। নাম শুনে আপাতদৃষ্টে এটিকে শুধু একটি আনুষ্ঠানিক পুঁজি তহবিল বলে মনে হলেও বাস্তবে এ তহবিল ব্যবহার করে শিল্পকারখানা গড়ে তোলার মতো কাজগুলোও করা হয়েছে। আর তা করতে গিয়ে এ তহবিলের মাধ্যমে যা যা করা হয়েছে, তার অনেকটাই আসলে স্রেফ লুটপাট। উল্লিখিত তহবিলের আওতায় অতি সহজ শর্তে বিতরণ করা ওইসব ঋণের সিংহভাগই কখনো ফেরত আসেনি এবং ভবিষ্যতে আসার সম্ভাবনাও নেই। আর যাঁরা এসব ঋণ নিয়েছেন, তাঁরা তা ফেরত না দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই সে অনুযায়ী আবেদন-সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রে প্রয়োজনীয় ফাঁকফোকর রেখে তা প্রস্তুত করেছেন। যতটুকু জানা যায়, ইইএফের অবস্থা এখন খুবই করুণ এবং আইসিবির মাধ্যমে এখন এর শেষকৃত্য সম্পন্নের কাজ এগিয়ে চলছে। পৃথিবীর কোথায় আছে যে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি উদ্যোক্তা উন্নয়ন তথা উদ্যোক্তাকে ঋণদানের কাজ করেছে বা করছে? বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় এ ধরনের যুক্তিহীন ও সম্ভাবনাবিহীন কার্যক্রম কীভাবে দীর্ঘ এত বছর ধরে অব্যাহত থাকল, তা একটি গুরুতর প্রশ্ন বৈকি!

সাম্প্রতিক সময়ে সম্পূর্ণ অপেশাদারি, অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচারমূলক সিদ্ধান্তের আওতায় আমলাতন্ত্রের শীর্ষ পর্যায়ে গড়ে ওঠা যেসব প্রতিষ্ঠানের কারণে দেশের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কার্যক্রম ক্রমান্বয়ে উদ্যোক্তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল বা যাচ্ছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের অতিনিয়ন্ত্রণের হাত থেকে উদ্যোক্তাদের মুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের উদ্যোক্তাসেবা কার্যক্রমকে অতিকেন্দ্রায়ণের ধারা থেকে ক্রমান্বয়ে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে আসতে হবে, যাতে সেখান থেকে নতুন নতুন উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসতে পারেন, যাঁদের মাধ্যমে নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং এ প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কার্যক্রম দ্বারা দেশের অর্থনীতিও সামগ্রিকভাবে লাভবান হবে। আর এটি করা গেলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বর্তমানে যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে তার অনেকটাই সম্পন্ন হয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

হেলিকপ্টারে নেওয়ার অবস্থায় নেই, দ্রুত নিকটবর্তী হাসপাতালে তামিম

উসকানিতে প্রভাবিত না হতে বললেন সেনাপ্রধান

বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরের বিরুদ্ধে ৪৭ ব্রিটিশ এমপিকে ‘সন্দেহজনক’ ই-মেইল

অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, পালানোকালে আটক ৫ পুলিশ সদস্য

১৭ বছরে ভোটার চান ড. ইউনূস, এনসিপির প্রস্তাব ১৬ বছর: যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত