আব্দুর রহমান

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক
আব্দুর রহমান

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক

‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!’
কাজী নজরুল ইসলামের এই লাইন দুটি খুব বেশি পরিচিত না হলেও, অনেকেই হয়তো তাঁর ‘বকরীদ’—শীর্ষক কবিতাটি পড়ে থাকবেন। এখানে নজরুলের আহ্বানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট, ঈদের চাঁদ যখন উঠেছে, তখন লজ্জায় মুখ লুকিয়ে থাকা কী কারণে?
কিন্তু বাংলাদেশে আমরা যখন ঈদের উৎসবের কথা বলি, তখন আমরা কী উদ্যাপন করব আর কী উদ্যাপন করব না তা নিয়ে নানা মত আছে গুণীজন মহলে। বিশেষ করে, আমরা ঈদের উৎসবে বাঙালির মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ বা সাংস্কৃতিক উপাদান হাজির করব কি না বা বাঙালির জীবনে মুসলিম সংস্কৃতির উপাদান গ্রহণ করব কি না—তা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকি। লজ্জা বোধ করি, নিজের ধর্মীয় ও জাতিগত সাংস্কৃতিক উপাদানকে গ্রহণ করা নিয়ে।
ধর্মের দোহাই বনাম সংস্কৃতির উপাদান—এই দুইয়ে আমাদের ঈদের আনন্দ উদ্যাপন বিভক্ত। কিন্তু, ধর্ম আর জাতিগত সংস্কৃতিকে আলাদা করে দেখাটা আমার কাছে সমস্যাজনক মনে হয়। হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে যখন বাংলা ভূখণ্ডে ইসলাম আসে, তখন প্রথম দিকে হয়তো বাঙালি মুসলমানের দ্বৈত আত্মপরিচয় ছিল। কিন্তু তারপর ইসলাম আস্তে আস্তে বাঙালিত্বে আত্তীকৃত হয়ে গেছে এবং এই দুটোর মিশেলে তৈরি হয়েছে বাঙালি মুসলমান। ১২শ–১৩ শ বছর কম সময় নয়। এই সময়ে আত্তীকৃত হয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা না।
বাঙালি মুসলমান ইসলাম আসার পর তার পুরোনো পরিচয় ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নাই। আবার ইসলাম গ্রহণ করে বাঙালিয়ানা ফেলে দিয়েছে—এমনটাও ভাবার সুযোগ নাই। বাঙালি মুসলমান দুইটাকেই নিজের মতো করে একীভূত করেছে এবং বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে একটা একক ও অনন্য আত্মপরিচয়ে পরিণত করেছে, দ্বৈত পরিচয়ে নয়। তাই, এইখানে বাঙালি মুসলমান পরিচয়কে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার কোনো দরকার নেই।
যদি বাঙালি মুসলমানকে দ্বৈত সত্তায় ভাগ করার প্রয়োজন না পড়ে, তবে কেন বাঙালি মুসলমানের ঈদ উদ্যাপনে বাংলাদেশের মাটি থেকে উদ্ভূত জীবনাচরণ মিলতে পারবে না? আমরা মনে করি, এই প্রশ্নটা জরুরি। কারণ, আমরা জাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে যে বিভাজনের আলোচনা দেখতে পাই—যেখানে বাঙালি ও বাংলাদেশি মুসলমানকে আলাদা করে ফেলা হয়—সেটি আদতে আমাদের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে কেবলই সংঘাতের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয়।
যাই হোক, ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গেয়ে ফেলা হলো! কিন্তু, অবতরণিকায় এটুকু না বললেও চলছিল না। কারণ, চলতি বছর ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকায় ঈদ উদ্যাপনের সঙ্গে ঢাক-ঢোল, বাদ্য, আনন্দ মিছিল যুক্ত করা হয়েছে। অনেক বছর পরই এমনটা করা হয়েছে। ঢাকায় অন্তত গত এক দশকে এমন ঈদ আয়োজন কখনো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতে বোধ হয় বেশ বেগই পেতে হবে।
ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান। মুঘল আমলে ঢাকার ঈদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠান। বাদশাহদের ঈদ উদ্যাপনের চিত্র ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশাল আকারের হাতি আনা হতো এবং বাদশাহরা হাওদার ওপর রাখা রত্নখচিত শৈল্পিক কেদারায় আসীন হতেন।
হাতিযোগে বাদশাহ এবং পদব্রজে রাজকর্মচারীরা দিল্লির ঈদগাহের দিকে যাত্রা করতেন, যা ছিল এক রাজকীয় শোভাযাত্রা। এই জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য মুঘলদের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ছিল। তবে এই জাঁকজমকপূর্ণ উদ্যাপন মূলত মুঘল বাদশাহ, সুবেদার ও বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, সাধারণ মানুষ এতে তেমনভাবে অংশ নিতে পারত না।
কিন্তু ১৬০০ সালের পর সুবা বাংলার সুবাদার, নায়েবে নাজিম এবং অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তি আজকের ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ আদায় করতে আসতেন। ঢাকায় ঈদের মিছিল ছিল এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। মিছিলে সজ্জিত হাতি, ঘোড়া, পালকি এবং হাতে অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা অংশ নিত। এই মিছিল ঢাকার মানুষের জন্য বিশেষ আকর্ষণ ছিল, যা দেখার জন্য তারা রাস্তার দুপাশে ভিড় করত।
আজ অবশ্য দেশে হাতিশালা নেই। রাজরাজড়াদের দরবার, সেপাই–বরকন্দাজ নেই। নেই সেই আমলের ঐতিহ্যও। কিন্তু আমাদের জনমানুষের আনন্দের, উদ্যাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল মেলা। আনন্দ মিছিল। দীর্ঘদিন পর আমরা যেন ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে আনন্দ মিছিল দেখলাম। মেলাও আয়োজিত হতে দেখলাম। এটি আমাদের অতীত ইতিহাসকে জীবিত রাখার একটা দারুণ প্রচেষ্টা। সময়ের প্রয়োজনে আমাদের মেলা, মিছিল উদ্যাপনের উপকরণে পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু মূল যে ধারণা সেটিতে খুব একটা পরিবর্তন আসেনি। গ্রামাঞ্চলে এখনো সীমিত পরিসরে মেলা দেখা যায়।
তবে ঢাকার ঈদ উৎসবের ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ হলেও কালের প্রবাহে অনেক কিছুই হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা এখন সময়ের দাবি। এবার দীর্ঘদিন পর ঈদ আনন্দ শোভাযাত্রা হয়েছে ঢাকায়। ১৫টি ঘোড়ার গাড়ি ছিল এই শোভাযাত্রায়। এতে মুঘল আমলের আদলে বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করা হয়েছে। এই ঈদ শোভাযাত্রায় অংশ নেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজসহ সর্বস্তরের মানুষ। এটি আয়োজন করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্য মেলার মাঠের সামনে থেকে এই আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়। শোভাযাত্রাটি আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়ক দিয়ে খামারবাড়ি মোড় হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়।
কেবল মিছিল নয়, আগারগাঁওয়ের বাণিজ্যমেলায় স্থাপিত মাঠে ঈদের জামায়াতের আগে ও পরে দেখা গেল এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! যা আমি বিগত চার বছরের কোনো ঈদে দেখিনি। আগের ঈদগুলোতে মানুষের মধ্যে কেমন চাপা আবেগ, বেদনার উপস্থিতি ছিল। কী যেন নেই, কী যেন নেই। নিরাপত্তা, বিধিনিষেধের বাড়াবাড়িতে আগের ঈদগুলো যেন পরিণত হয়েছিল স্রেফ আনুষ্ঠানিকতায়। কিন্তু আজ দেখা গেল ভিন্ন চিত্র।
আগারগাঁওয়ের পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে আয়োজিত ঈদের জামাতে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপস্থিত থাকার পরও নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি। চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের সামনে রাখা পুলিশের এপিসিতে উঠে সাধারণ মানুষকে সেলফি তুলতে দেখা গেল। এমনকি উপদেষ্টা আসিফের নিরাপত্তার জন্য আসা সোয়াত টিমের সদস্যরাও হাসিমুখে ছবি তুললেন সাধারণ মানুষের সঙ্গে। বিপুল পুলিশ বা সেনা সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেল না। বরং লাখো মানুষের ঈদের জামাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতে হয়তো কয়েক শ পুলিশ ও সেনা সদস্য ছিলেন। এরপরও, পুলিশ সদস্যদের নির্ভার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেল। এ যেন এক নতুন ঈদ। নতুন সূর্যোদয়।
সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে দারুণ উচ্ছ্বাস দেখা গেছে। হাজারো মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঈদ আনন্দযাত্রায় অংশ নিয়েছেন। নেই কোনো মাইকিং, নেই কোনো নির্দেশনা। তবুও সু-শৃঙ্খলভাবে মিছিল হলো। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শেষও হলো।
মানুষের মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়বোধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার পার্থক্যের দেয়াল পাতলা হয়ে যাওয়া—এটাকে এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ অর্জন বলে মনে করি। দুর্নীতি, অপশাসন ও অন্যান্য কারণে যখন আমাদের ‘সোশ্যাল ফ্যাব্রিক’ বা ‘সামাজিক বন্ধন’ ছিঁড়ে গেছে বা এখনো যাচ্ছে, তখন এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। কারণ, এগুলো নতুন কোনো আবিষ্কার নয়, বরং আমাদের সমাজের ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ সময়ের’ আচরণের প্রতিচ্ছবি। আমাদের সমাজ বদলাবে—এটাই চিরন্তন সত্য। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখাটাও জরুরি। কারণ, তাতে শেকড় অক্ষুণ্ন রেখে নতুনত্বে উত্তরণ সহজ ও সমৃদ্ধ হয়, নবযুগ আরও প্রাণবন্ত হয়।
লেখক আজকের পত্রিকার সহ–সম্পাদক

একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ।
১৩ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে।
১৪ ঘণ্টা আগে
ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি।
১৪ ঘণ্টা আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
২ দিন আগেচিররঞ্জন সরকার

একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ। কিন্তু ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই দৃশ্য ফিকে হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় আয়োজন কাটছাঁট হয়েছে, সামাজিক উদ্যাপনও স্পষ্টভাবে কমে গেছে। অথচ ১৬ ডিসেম্বর কেবল একটি দিনের নাম নয়, এটি একটি জাতির জন্মঘোষণা। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা মানে শুধু রাষ্ট্র পাওয়া নয়, মানুষের মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতিশ্রুতি; লাখো শহীদের রক্ত আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা সেই বাংলাদেশ কোনো সমঝোতার ফল নয়, ছিল বঞ্চনা ও দমনের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ।
এই কারণেই বিজয় দিবসকে উপেক্ষা করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। একাত্তরের বিজয় ছাড়া আজকের বাংলাদেশ যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কথাও অর্থহীন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি, আর এ দেশের কিছু রাজাকার হানাদারদের সহযোগিতা করে যুদ্ধাপরাধ করেছে—এই সত্য ইতিহাসে অমোচনীয়। তাই বিজয় দিবস শুধু উৎসবের দিন নয়; এটি আত্মজিজ্ঞাসার দিন। প্রশ্ন একটাই: যে আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছিল, আমরা কি সেই আদর্শ রক্ষা করছি, নাকি স্মরণকে দায়হীন আনুষ্ঠানিকতায় নামিয়ে এনেছি? একটি জাতি টিকে থাকে তখনই, যখন সে নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সৎ থাকে।
২০২৫ সালের বিজয় দিবসে এসে এই আত্মসমালোচনাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের ক্ষমতাকাঠামো ও সমাজের প্রভাবশালী অংশে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় বা জনপরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্য, সিদ্ধান্ত ও আচরণে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিফলন খুব স্পষ্ট নয়। বরং একটি ইতিহাসবিমুখ প্রবণতা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে, যেখানে একাত্তরের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে অন্য এক পুরোনো মানসিকতাকে নতুন করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক দমনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত প্রতিবাদ। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মূল সমস্যা ছিল সেখানে মানুষ নাগরিক ছিল না, ছিল অনুগত প্রজা। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারকে সেখানে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সেই রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে আমাদের চিন্তা ও সমাজের কোনো মিল ছিল না বলেই আমরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। আজ যখন সেই একই ধরনের ভাবধারার প্রতিধ্বনি নতুন ভাষায়, নতুন মোড়কে ফিরে আসার আভাস দেয়, তখন উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য কোনো সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে তার গুরুত্ব খাটো করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়েই গণ-আন্দোলন হয়েছে, মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আত্মত্যাগ করেছে। সেগুলোর মূল্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের যুদ্ধ। সেটিই আমাদের রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। কোনো আন্দোলনই তার সমতুল্য হতে পারে না। এই পার্থক্য মুছে ফেলার চেষ্টা আসলে ইতিহাসের ভিত্তিকেই দুর্বল করে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান অবমাননা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্রূপ, তাঁদের ভাতা বা সম্মান নিয়ে কটাক্ষ, এমনকি তাঁদের আত্মত্যাগকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগের গল্প হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা বাড়ছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে, খেতাবপ্রাপ্ত আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আদালতে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কোথাও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা ও ন্যূনতম মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে ভুয়া সনদধারীরা সুবিধা ভোগ করছেন। এই বৈষম্য শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা মানে একটি জাতির নিজের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা। যে মানুষগুলো পরিবার, স্বপ্ন ও জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের প্রতি অসম্মান দেখালে সমাজ ধীরে ধীরে আত্মসম্মান হারায়। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সমাজের বড় অংশ নীরব থাকছে। হয়তো ক্লান্তি থেকে, হয়তো ভয় থেকে, কিংবা ইতিহাসকে ঝামেলার বিষয় মনে করে। কিন্তু এই নীরবতা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। ইতিহাস কখনো নীরবতার দায় ক্ষমা করে না।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে আদর্শিক শূন্যতার। সংবিধানের যে চারটি মূলনীতি একাত্তরের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছিল, সেগুলো আজ প্রশ্নের মুখে। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি জোরালো হচ্ছে, গণতন্ত্রের জায়গায় শক্তির রাজনীতি দৃশ্যমান, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে বৈষম্য প্রকট। এসব একসঙ্গে মিলেই রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
এখানে একটি বিষয় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা জরুরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো একক রাজনৈতিক দল, সরকার বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তি নয়। এটি কোনো ক্ষমতাসীন মতাদর্শের লাইসেন্সও নয়, আবার কোনো বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধ-যুক্তিও নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির সামষ্টিক নৈতিক অর্জন, যা রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। একে অস্বীকার করা মানে শুধু একটি ইতিহাসকে অস্বীকার করা নয়; মানে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই চেতনাকে নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, ব্যাখ্যার পার্থক্য স্বাভাবিক, এমনকি সমালোচনাও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তা অস্বীকার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, অস্বীকারের মধ্য দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, আর ইতিহাস মুছে গেলে সমাজ দিশাহীন হয়ে পড়ে।
যাঁরা বলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করলেই সমাজ বিভক্ত হয়, তাঁদের এই বক্তব্য আসলে বিভক্তির কারণ ও ফলাফলকে গুলিয়ে ফেলার শামিল। বিভক্তি তৈরি হয় সত্য উচ্চারণে নয়, বিভক্তি তৈরি হয় সত্য চাপা দিতে গিয়ে। ইতিহাসের বেদনাদায়ক অধ্যায় নিয়ে নীরবতা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে না; বরং অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিকৃত বয়ানের সুযোগ তৈরি করে। কোনো জাতি যদি নিজের জন্মকথা খোলাখুলি স্বীকার করতে না পারে, তবে সে জাতির ঐক্য হয় ভঙ্গুর, বাহ্যিক ও স্বার্থনির্ভর। প্রকৃত ঐক্য আসে ঐতিহাসিক সত্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে, ভুলে যাওয়ার অভিনয়ের মাধ্যমে নয়।
বিজয় দিবস তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এটি আমাদের সামনে একটি নৈতিক আয়না মেলে ধরে, যেখানে আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, আমরা কি সত্যিই সেই দেশের দিকে এগোচ্ছি, যে দেশের স্বপ্নে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী-পুরুষনির্বিশেষে মানুষ জীবন দিয়েছিল? রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি সেই মানবিকতা, সাম্য ও মর্যাদার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? নাকি আমরা এমন এক সমাজ নির্মাণ করছি, যেখানে ক্ষমতা ও সুবিধার হিসাব ইতিহাসের দায়কে ছাপিয়ে যাচ্ছে?
এই প্রশ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রসঙ্গে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের এমন একটি ইতিহাস দিতে পারছি, যেখানে তারা আত্মবিশ্বাস ও গর্ব নিয়ে বলতে পারবে, এই দেশ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, মানুষের মর্যাদার পক্ষে লড়েছিল? নাকি আমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছি, যেখানে জন্মকথা বলতে গিয়ে তাদের অস্বস্তি হবে, দ্বিধা হবে, কিংবা নীরব থাকাই নিরাপদ মনে হবে? একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কিছু হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই দেশ কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা বা প্রশাসনিক আপসের ফল নয়। এটি রক্ত, বেদনা ও আত্মত্যাগের ফল। একাত্তরের চেতনা কোনো জাদুঘরের প্রদর্শনী নয়, কোনো বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতার অংশও নয়। এটি একটি জীবন্ত নৈতিক কম্পাস, যা আমাদের বলে দেয় কোন পথে গেলে আমরা মানুষ হিসেবে উন্নত হব, আর কোন পথে গেলে ক্ষমতাশালী হলেও নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ব। সেই কম্পাস যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, আমরা হয়তো এগোতে থাকব, অর্থনৈতিক সূচক বাড়বে, অবকাঠামো দাঁড়াবে, কিন্তু জানব না আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি, কিংবা কী হারাচ্ছি।
বিজয় দিবসে তাই আমাদের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত এই চেতনাকে নতুন করে ধারণ করা। আবেগের আতিশয্যে নয়, প্রতিহিংসার ভাষায় নয়, বরং মানবিকতা, সংযম ও দৃঢ়তার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করতে, আবার ভিন্নমতের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতেও নয়। এই ভারসাম্যই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই শিক্ষা ভুলে না গেলে মুক্তিযুদ্ধ অতীত হয়েও ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ। কিন্তু ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই দৃশ্য ফিকে হয়ে এসেছে। রাষ্ট্রীয় আয়োজন কাটছাঁট হয়েছে, সামাজিক উদ্যাপনও স্পষ্টভাবে কমে গেছে। অথচ ১৬ ডিসেম্বর কেবল একটি দিনের নাম নয়, এটি একটি জাতির জন্মঘোষণা। এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতা মানে শুধু রাষ্ট্র পাওয়া নয়, মানুষের মর্যাদা, ন্যায়বিচার ও সমতার প্রতিশ্রুতি; লাখো শহীদের রক্ত আর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা সেই বাংলাদেশ কোনো সমঝোতার ফল নয়, ছিল বঞ্চনা ও দমনের বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ।
এই কারণেই বিজয় দিবসকে উপেক্ষা করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। একাত্তরের বিজয় ছাড়া আজকের বাংলাদেশ যেমন সম্ভব হতো না, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর কথাও অর্থহীন। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি, আর এ দেশের কিছু রাজাকার হানাদারদের সহযোগিতা করে যুদ্ধাপরাধ করেছে—এই সত্য ইতিহাসে অমোচনীয়। তাই বিজয় দিবস শুধু উৎসবের দিন নয়; এটি আত্মজিজ্ঞাসার দিন। প্রশ্ন একটাই: যে আদর্শের জন্য মানুষ জীবন দিয়েছিল, আমরা কি সেই আদর্শ রক্ষা করছি, নাকি স্মরণকে দায়হীন আনুষ্ঠানিকতায় নামিয়ে এনেছি? একটি জাতি টিকে থাকে তখনই, যখন সে নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সৎ থাকে।
২০২৫ সালের বিজয় দিবসে এসে এই আত্মসমালোচনাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে। কারণ ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের ক্ষমতাকাঠামো ও সমাজের প্রভাবশালী অংশে যে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, তা আমাদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। যাঁরা রাষ্ট্র পরিচালনায় বা জনপরিসরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্য, সিদ্ধান্ত ও আচরণে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার প্রতিফলন খুব স্পষ্ট নয়। বরং একটি ইতিহাসবিমুখ প্রবণতা ক্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে, যেখানে একাত্তরের আদর্শকে পাশ কাটিয়ে অন্য এক পুরোনো মানসিকতাকে নতুন করে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কোনো আকস্মিক ঘটনা ছিল না। এটি ছিল দীর্ঘদিনের বৈষম্য, নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক দমনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিসত্তার চূড়ান্ত প্রতিবাদ। পাকিস্তানি রাষ্ট্রকাঠামোর মূল সমস্যা ছিল সেখানে মানুষ নাগরিক ছিল না, ছিল অনুগত প্রজা। ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারকে সেখানে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সেই রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে আমাদের চিন্তা ও সমাজের কোনো মিল ছিল না বলেই আমরা অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। আজ যখন সেই একই ধরনের ভাবধারার প্রতিধ্বনি নতুন ভাষায়, নতুন মোড়কে ফিরে আসার আভাস দেয়, তখন উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অন্য কোনো সময়ের রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে তার গুরুত্ব খাটো করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়েই গণ-আন্দোলন হয়েছে, মানুষ রাস্তায় নেমেছে, আত্মত্যাগ করেছে। সেগুলোর মূল্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধ ছিল অস্তিত্বের যুদ্ধ। সেটিই আমাদের রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। কোনো আন্দোলনই তার সমতুল্য হতে পারে না। এই পার্থক্য মুছে ফেলার চেষ্টা আসলে ইতিহাসের ভিত্তিকেই দুর্বল করে।
সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিক হলো মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি ক্রমবর্ধমান অবমাননা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিদ্রূপ, তাঁদের ভাতা বা সম্মান নিয়ে কটাক্ষ, এমনকি তাঁদের আত্মত্যাগকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগের গল্প হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা বাড়ছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে, খেতাবপ্রাপ্ত আহত মুক্তিযোদ্ধাকে আদালতে অপমানজনক মন্তব্যের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কোথাও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা ও ন্যূনতম মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অথচ প্রভাবশালী মহলের আশ্রয়ে ভুয়া সনদধারীরা সুবিধা ভোগ করছেন। এই বৈষম্য শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি একটি নৈতিক বিপর্যয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা মানে একটি জাতির নিজের আত্মত্যাগকে অস্বীকার করা। যে মানুষগুলো পরিবার, স্বপ্ন ও জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, তাঁদের প্রতি অসম্মান দেখালে সমাজ ধীরে ধীরে আত্মসম্মান হারায়। আরও ভয়াবহ বিষয় হলো, এসব ঘটনার বিরুদ্ধে সমাজের বড় অংশ নীরব থাকছে। হয়তো ক্লান্তি থেকে, হয়তো ভয় থেকে, কিংবা ইতিহাসকে ঝামেলার বিষয় মনে করে। কিন্তু এই নীরবতা ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। ইতিহাস কখনো নীরবতার দায় ক্ষমা করে না।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে আদর্শিক শূন্যতার। সংবিধানের যে চারটি মূলনীতি একাত্তরের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছিল, সেগুলো আজ প্রশ্নের মুখে। ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি জোরালো হচ্ছে, গণতন্ত্রের জায়গায় শক্তির রাজনীতি দৃশ্যমান, সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নে বৈষম্য প্রকট। এসব একসঙ্গে মিলেই রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।
এখানে একটি বিষয় দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা জরুরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোনো একক রাজনৈতিক দল, সরকার বা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মালিকানাধীন সম্পত্তি নয়। এটি কোনো ক্ষমতাসীন মতাদর্শের লাইসেন্সও নয়, আবার কোনো বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধ-যুক্তিও নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো একটি জাতির সামষ্টিক নৈতিক অর্জন, যা রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। একে অস্বীকার করা মানে শুধু একটি ইতিহাসকে অস্বীকার করা নয়; মানে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা। এই চেতনাকে নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, ব্যাখ্যার পার্থক্য স্বাভাবিক, এমনকি সমালোচনাও গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু তা অস্বীকার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, অস্বীকারের মধ্য দিয়ে ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, আর ইতিহাস মুছে গেলে সমাজ দিশাহীন হয়ে পড়ে।
যাঁরা বলেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করলেই সমাজ বিভক্ত হয়, তাঁদের এই বক্তব্য আসলে বিভক্তির কারণ ও ফলাফলকে গুলিয়ে ফেলার শামিল। বিভক্তি তৈরি হয় সত্য উচ্চারণে নয়, বিভক্তি তৈরি হয় সত্য চাপা দিতে গিয়ে। ইতিহাসের বেদনাদায়ক অধ্যায় নিয়ে নীরবতা সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে না; বরং অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিকৃত বয়ানের সুযোগ তৈরি করে। কোনো জাতি যদি নিজের জন্মকথা খোলাখুলি স্বীকার করতে না পারে, তবে সে জাতির ঐক্য হয় ভঙ্গুর, বাহ্যিক ও স্বার্থনির্ভর। প্রকৃত ঐক্য আসে ঐতিহাসিক সত্য মেনে নেওয়ার মাধ্যমে, ভুলে যাওয়ার অভিনয়ের মাধ্যমে নয়।
বিজয় দিবস তাই নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিনে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। এটি আমাদের সামনে একটি নৈতিক আয়না মেলে ধরে, যেখানে আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করি, আমরা কি সত্যিই সেই দেশের দিকে এগোচ্ছি, যে দেশের স্বপ্নে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক, নারী-পুরুষনির্বিশেষে মানুষ জীবন দিয়েছিল? রাষ্ট্রীয় নীতি, সামাজিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কি সেই মানবিকতা, সাম্য ও মর্যাদার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে? নাকি আমরা এমন এক সমাজ নির্মাণ করছি, যেখানে ক্ষমতা ও সুবিধার হিসাব ইতিহাসের দায়কে ছাপিয়ে যাচ্ছে?
এই প্রশ্ন আরও তীব্র হয়ে ওঠে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রসঙ্গে। আমরা কি আমাদের সন্তানদের এমন একটি ইতিহাস দিতে পারছি, যেখানে তারা আত্মবিশ্বাস ও গর্ব নিয়ে বলতে পারবে, এই দেশ অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল, মানুষের মর্যাদার পক্ষে লড়েছিল? নাকি আমরা এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করছি, যেখানে জন্মকথা বলতে গিয়ে তাদের অস্বস্তি হবে, দ্বিধা হবে, কিংবা নীরব থাকাই নিরাপদ মনে হবে? একটি জাতির জন্য এর চেয়ে বড় ব্যর্থতা আর কিছু হতে পারে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই দেশ কোনো রাজনৈতিক সমঝোতা বা প্রশাসনিক আপসের ফল নয়। এটি রক্ত, বেদনা ও আত্মত্যাগের ফল। একাত্তরের চেতনা কোনো জাদুঘরের প্রদর্শনী নয়, কোনো বার্ষিক আনুষ্ঠানিকতার অংশও নয়। এটি একটি জীবন্ত নৈতিক কম্পাস, যা আমাদের বলে দেয় কোন পথে গেলে আমরা মানুষ হিসেবে উন্নত হব, আর কোন পথে গেলে ক্ষমতাশালী হলেও নৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ব। সেই কম্পাস যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, আমরা হয়তো এগোতে থাকব, অর্থনৈতিক সূচক বাড়বে, অবকাঠামো দাঁড়াবে, কিন্তু জানব না আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি, কিংবা কী হারাচ্ছি।
বিজয় দিবসে তাই আমাদের সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত এই চেতনাকে নতুন করে ধারণ করা। আবেগের আতিশয্যে নয়, প্রতিহিংসার ভাষায় নয়, বরং মানবিকতা, সংযম ও দৃঢ়তার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের শিখিয়েছে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করতে, আবার ভিন্নমতের মানুষকে নিশ্চিহ্ন করতেও নয়। এই ভারসাম্যই ছিল একাত্তরের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেই শিক্ষা ভুলে না গেলে মুক্তিযুদ্ধ অতীত হয়েও ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
৩১ মার্চ ২০২৫
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে।
১৪ ঘণ্টা আগে
ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি।
১৪ ঘণ্টা আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
২ দিন আগেসিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছেন। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নন, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তাঁরা প্রস্তুত থেকেছেন। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করেন; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাঁদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থীদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছেন যে স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে—এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।
একাত্তরের পরে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না, তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানত তারা যে জনগণ পুরোনো আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুলল সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি, তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
আলবদর, রাজাকাররা ফিরে এসেছে, অধিক শক্তিমত্তায়। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, চব্বিশের রেজিম পরিবর্তনে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণী বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে, রাজাকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারও জন্য খুব কাছের, কারও জন্য ততটা কাছের নয়; ব্যবধান এইটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলত তাহলে এরা প্রশ্রয় পেত না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে দুই কারণে। এক. জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়িত্বের অভিপ্রায়ে। দুই. নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে, তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ভরসায়।
বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিত তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছেন। এখনো গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে।
একাত্তরে আমরা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে যাওয়া খেত, মৃতপ্রায় গাছপালা—এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকব—এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি; যদি ঘটত তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত বিজয় সম্ভব হতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুতগতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি—যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে ৯ মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনো করছে।
গ্রাম রইল সেখানেই, যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরোনো জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এল। এল দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল।
গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দুটি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারির। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে—এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই দুটি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাঙ্ক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দুটি যে বিদায় করে দেওয়া হলো, সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্পকিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছেন, অন্য কিছু বুঝতে চাননি। তাঁরা জনগণের লোক নন, জনগণের আদর্শ তাঁদের নয়। তাঁদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তাঁরা তাঁদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সংগত কারণে তাঁরাও তো সরিয়ে দেওয়া মূলনীতি দুটি ফেরত আনেননি। ফেরত আনা পরের কথা, তাঁরা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তোবা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারও কারও হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে।
মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। বর্তমান আমলেও তদ্রূপ। এই দূরত্ব আগামী দিনে বাড়বে না, বরং কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?
রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রতিটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এল না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরও স্পষ্ট, আরও প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।
মুক্তি না আসার কারণটি হচ্ছে এই যে সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে—এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।
না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি, সেটা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডান দিকের নয়, বাম দিকের।
বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করেন সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মুক্তি চান। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কীভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে।
মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে। কিন্তু পুঁজিবাদের সর্বাত্মক বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বুর্জোয়া পাওয়া যায়নি, লুণ্ঠনকারী বুর্জোয়ারাই কর্তৃত্ব করেছেন। এরা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত নন, তাই বিশ্ব পুঁজিবাদের আগ্রাসনের মুখে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে বিক্রি করতেও তাঁরা প্রস্তুত থেকেছেন। লুণ্ঠনকারীরা সেটাই করেন; মুফতে-পাওয়া সম্পত্তির প্রতি তাঁদের কোনো মায়া, মমতা থাকে না। বাম উগ্রপন্থীদের কেউ কেউ আবার বলতে চেয়েছেন যে স্বাধীনতা আসেনি, রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে মাত্র। এসব বিচ্ছেদ ও বিভ্রান্তির কারণে জনগণের পক্ষে দাঁড়াবে—এমন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি বিকশিত হতে পারেনি।
একাত্তরের পরে যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েছিলেন, তাঁদের নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব ছিল। তাঁদের দলীয় তরুণদের একাংশ দেখছিল তারা ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে পারছে না, অপরাংশের তুলনায় তারা সুবিচার পাচ্ছে না। হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে তারা বের হয়ে এসে নতুন সংগঠন গড়েছে, নাম দিয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। তাদেরও যেহেতু শক্তি সঞ্চয় করা প্রয়োজন ছিল এবং এই শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতার কাছ থেকে পাবে বলে আশা করা যাচ্ছিল না, তাই তারা জনগণের কাছে গেল। জানত তারা যে জনগণ পুরোনো আওয়াজে আর সাড়া দেবে না। তাই নতুন রণধ্বনি তুলল সমাজতন্ত্রের এবং হাজার হাজার তরুণ, যারা সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখছিল, যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছে, কিন্তু মুক্তির পথ দেখতে পায়নি, তারা তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছে, যোগ দিয়েছে ওই দলে। ওই দলের ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ এখনো সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে, কিন্তু মূল দলসহ বাদবাকিরা ভিন্ন ভিন্ন রূপে ও মাত্রায় বিলীন হয়ে গেছে।
আলবদর, রাজাকাররা ফিরে এসেছে, অধিক শক্তিমত্তায়। মৌলবাদ শক্তিশালী হয়েছে। এর মূল কারণ ওই একটাই, চব্বিশের রেজিম পরিবর্তনে সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসেনি। সমাজ একটা ধাক্কা খেয়েছে, সে নড়ে উঠেছে, কিন্তু এমনভাবে আধুনিক হয়নি যে রাজাকার ও মৌলবাদ অতীতের প্রাণী বলে চিহ্নিত হবে, পরিণত হবে এক দুঃস্বপ্নের স্মৃতিতে। ক্ষমতায় যারা যাতায়াত করে, রাজাকার ও মৌলবাদ তাদের কাছে যথার্থ অর্থে দূরের নয়। কারও জন্য খুব কাছের, কারও জন্য ততটা কাছের নয়; ব্যবধান এইটুকুই, সেটা মাত্রাগত, গুণগত নয়। সমাজে বৈপ্লবিক রূপান্তরের চেষ্টা যদি চলত তাহলে এরা প্রশ্রয় পেত না। শাসকশ্রেণি ধর্মকে ব্যবহার করে চলেছে দুই কারণে। এক. জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে তাদের নিজেদের ক্ষমতাকে স্থায়িত্বের অভিপ্রায়ে। দুই. নিজেরাই যেসব অন্যায় করছে, তার দরুন তৈরি অপরাধবোধ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার ভরসায়।
বাংলাদেশের জন্য গ্রামই ছিল ভরসা। আন্দোলনে গ্রাম না এলে জয় আসেনি। বিপদের সময় গ্রাম যদি আশ্রয় না দিত তবে বিপদ ভয়াবহ হতো। গ্রামেই রয়েছে উৎপাদক শক্তি। গ্রামবাসীর শ্রমে তৈরি উদ্বৃত্ত মূল্য লুণ্ঠন করেই ধনীরা ধনী হয়েছেন। এখনো গ্রাম কাজে লাগছে বিদেশ থেকে সাহায্য, ঋণ, দান ইত্যাদি এনে তার সিংহভাগ আত্মসাৎ করার অজুহাত ও অবলম্বন হিসেবে।
একাত্তরে আমরা গ্রামে গেছি। বাড়িঘর, মজা পুকুর, হারিয়ে যাওয়া খেত, মৃতপ্রায় গাছপালা—এসবের খোঁজখবর করেছি। শহর তখন চলে গেছে শত্রুর কবলে, যাকগে, আমরা গ্রামেই থাকব—এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। শহরের পতন ঘটেছে সর্বাগ্রে, গ্রামের ঘটেনি; যদি ঘটত তাহলে আমাদের পক্ষে অত দ্রুত বিজয় সম্ভব হতো না।
কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র গ্রামে যারা গিয়েছিল তারা যত দ্রুতগতিতে গেছে তার চেয়ে দ্রুতগতিতে ফেরত চলে এসেছে। পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া বাড়িঘর, কারখানা, অফিস, পদ, গাড়ি—যে যেটা পেরেছে লুণ্ঠন করেছে। পাকিস্তানিরা অব্যাহতভাবে লুণ্ঠন করেছিল ২৪ বছর, বিশেষ করে ৯ মাসে তাদের তৎপরতা সীমাহীন হয়ে পড়েছিল, তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল সবকিছু। স্বাধীনতার পরে সুবিধাভোগীরা শোধ নিয়েছে। লুটপাট করেছে স্বাধীনভাবে। এখনো করছে।
গ্রাম রইল সেখানেই, যেখানে ছিল। বস্তুত খারাপই হলো তার অবস্থা। পাকিস্তানিরা হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সব করেছে। ঘর পুড়িয়েছে, ফসল জ্বালিয়েছে। স্বাধীনতার পরে গ্রামবাসী পুরোনো জীবন ফিরে পায়নি। অবকাঠামো গিয়েছিল ভেঙে। বন্যা এল। এল দুর্ভিক্ষ। বিপুলসংখ্যক মানুষ একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়ল।
গ্রাম এখন ধেয়ে আসছে শহরের দিকে। আশ্রয়দাতা হিসেবে নয়, আসছে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে। তার হাত দুটি মুক্তিযোদ্ধার নয়, হাত তার ভিখারির। ফলে শহর এখন বিপন্ন মনে করছে নিজেকে। ভাবছে আবার তার পতন ঘটবে—এবার পাকিস্তানিদের হাতে নয়, গরিব বাংলাদেশিদের হাতে। মনে হচ্ছে আবারও একটা মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন হবে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই দুটি দাবি এসেছিল মুক্তির জাগ্রত আকাঙ্ক্ষা থেকেই। পাকিস্তান আমলে তৈরি সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত বিভাজনকে নাকচ করে দিতে চেয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। মূলনীতি দুটি যে বিদায় করে দেওয়া হলো, সেটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, স্বাভাবিক ঘটনা বটে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ, আমাদের ইতিহাসের একমাত্র জনযুদ্ধ। জনযুদ্ধে জনতার জয় হয়েছিল। কিন্তু বিজয়ী জনতা ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছিল ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে, ক্ষমতা আগের মতোই চলে যাচ্ছিল অল্পকিছু মানুষের হাতে। পঁচাত্তরের নৃশংস পটপরিবর্তনের পর নতুন যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরা শুধু ক্ষমতাই বুঝেছেন, অন্য কিছু বুঝতে চাননি। তাঁরা জনগণের লোক নন, জনগণের আদর্শ তাঁদের নয়। তাঁদের আদর্শে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের স্থান ছিল না। তাঁরা তাঁদের আদর্শকে জনগণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারপর ক্ষমতার হস্তান্তর ঘটেছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই যাঁরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচয় দিলেও, মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করেছেন, সেটা বলা যাবে না। সংগত কারণে তাঁরাও তো সরিয়ে দেওয়া মূলনীতি দুটি ফেরত আনেননি। ফেরত আনা পরের কথা, তাঁরা সাংবিধানিক বৈধতাও দিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে। এই উদাসীনতা তাৎপর্যহীন নয়। বাস্তবতা বদলে গেছে। জনগণ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা এখন অতীতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হয়তোবা অতীতের স্মৃতিতেই পরিণত হবে, কারও কারও হয়তো মনে এমন আশা রয়েছে।
মূল সত্যটা হচ্ছে এই যে জনগণের কাছে ক্ষমতা নেই, ক্ষমতা থেকে তারা অনেক দূরে। সামরিক সরকারের আমলে দূরে ছিল, নির্বাচিত সরকারের আমলেও সেই দূরেই রয়ে গেছে। বর্তমান আমলেও তদ্রূপ। এই দূরত্ব আগামী দিনে বাড়বে না, বরং কমে আসবে, এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে কি? তা তো বলা যাবে না। জনগণের ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচি কই? কর্মসংস্থানের উদ্যোগ কোথায়?
রাষ্ট্রক্ষমতায় যে বড় পরিবর্তন এসেছে, সেগুলো এমনি এমনি ঘটেনি, বিত্তবানদের কারণেও ঘটেনি। প্রতিটির পেছনেই জনগণ ছিল। ১৯৪৬-এ সাধারণ মানুষ ভোট দিয়েছে। ১৯৭১-এ সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাতেই রাষ্ট্র বদলেছে। ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা ছিল অপূর্ণ; ওই স্বাধীনতায় মুক্তি এল না। উল্টো মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়ল। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ভিন্ন প্রকারের, তার সামনে মুক্তির লক্ষ্যটা ছিল আরও স্পষ্ট, আরও প্রত্যক্ষ। কিন্তু এই স্বাধীনতা তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে কি? মুক্তি এসেছে কি মানুষের? সে তো মনে হয় অনেক দূরের ব্যাপার।
মুক্তি না আসার কারণটি হচ্ছে এই যে সংগ্রাম জনগণই করেছে এটা ঠিক, কিন্তু নেতৃত্ব তাদের হাতে ছিল না। জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ কী? জনগণ তো ব্যক্তি নয়, এক নয়, তারা বহু, অসংখ্য, কে নেতা হবে কাকে ফেলে? জনগণের হাতে নেতৃত্ব থাকার অর্থ হলো জনগণের স্বার্থ দেখবে—এমন সংগঠনের হাতে নেতৃত্ব থাকা। স্বার্থটাই আসল কথা। আওয়াজ উঠতে পারে নানাবিধ, আওয়াজ মানুষকে উদ্বুদ্ধও করে নানাভাবে, কিন্তু ধ্বনি যথেষ্ট নয়, কার স্বার্থে ধ্বনি উঠেছে সেটাই জরুরি।
না, তেমন যুদ্ধ ঘটবে না। কেননা, মুক্তিযুদ্ধ তো চলছেই কোনো না কোনোভাবে। মানুষ যে মুক্ত হয়নি, সেটা কারও কাছেই অস্পষ্ট নয়। ওই যুদ্ধকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা শাসকশ্রেণির দল করবে না। তার জন্য বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন হবে। ডান দিকের নয়, বাম দিকের।
বলা হয়, গণতন্ত্রের মানে হচ্ছে সংখ্যাগুরুর শাসন। কিন্তু আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা, অর্থাৎ ধনীরা শাসন করেন সংখ্যাগুরুকে, অর্থাৎ গরিবকে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থা চলা উচিত নয়। এটা চলবেও না। এই জন্য যে সংখ্যাগুরু সচেতন ও বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মুক্তি চান। পরিবর্তন একটা ঘটবেই। প্রশ্ন হলো, কবে এবং কীভাবে। স্বাধীনতা ওই বড় পরিবর্তনের জন্যই প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা নিজেই দুর্বল হয়ে পড়বে যদি জাতীয় মুক্তি না আসে।
মুক্তির প্রশ্নটি এখন আর আঞ্চলিক নয়। দ্বন্দ্ব এখন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের নয়, প্রশ্নটি এখন শ্রেণিগত, দ্বন্দ্ব এখন বাঙালি ধনীর সঙ্গে বাঙালি গরিবের। বিষয়টা এমন পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশ পেত না বাংলাদেশ যদি স্বাধীন না হতো। স্বাধীনতা আমাদের খুবই জরুরি ছিল, সমষ্টিগত অগ্রগতির পথে প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হিসেবে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
৩১ মার্চ ২০২৫
একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ।
১৩ ঘণ্টা আগে
ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি।
১৪ ঘণ্টা আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
২ দিন আগেসম্পাদকীয়

ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় আজকের দিনে। ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে; তবু ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এত বড় অর্জন আর দ্বিতীয়টি হয় না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা গৌরবের। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই সব শহীদের আত্মদানের কথা, যাঁদের রক্ত দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মানুষ এত বছরেও স্বস্তি পায়নি। যারা যখনই এ দেশকে শাসন করতে চেয়েছে বা করেছে, তাদের অসৎ, অসাধু, দুর্নীতিবাজ আচরণ জনগণকে স্বস্তি দিতে পারেনি। যার যার মতো করে তারা দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সাজাতে চেয়েছে। ফলে মত-দ্বিমতের জালে বারবার আটকা পড়েছে সেই ইতিহাস। তবে সেই সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো যে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং চেতনায় ধারণ করতে হবে। অগ্রজদের দায়িত্ব এই চেতনা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া—বিকৃত করে নয় বরং সঠিক ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে। এই জানানোটা যেন আবার যান্ত্রিক কিংবা শুধু কেতাবি না হয়। মা-বাবা বা যেকোনো অভিভাবক তাঁদের কথা, কাজ, আচরণে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশ করবেন, তখনই একটি পরিবারের নতুন প্রজন্ম সেই চেতনাকে ধারণ করতে শিখবে, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সত্যিকারের স্বাদ পাবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে যে দেশটি বাঙালি জাতি গড়েছিল, সেই দেশে কোনো দুর্নীতি, অসততা, অপরাধ, বৈষম্য থাকবে না বলেই তো শপথ নেওয়া হয়েছিল। বিজয়ের ৫৪ বছরেও যাঁরা প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাবের খাতা খুলে বসেন, তাঁরা হয়তো দেনার হিসাবটা করেন না। তবে তাঁরাও এ বিষয়ে সহমত হবেন যে ওই সব শপথ পূরণ করতে পারেনি কোনো রাজনৈতিক দলই। বরং সবাই মিলে শপথ ভঙ্গই করেছে। কোন আমলে হয়নি দুর্নীতি, খুনখারাবি, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ?
অথচ সবাই মিলেই গড়ে তোলা যেত একটি আদর্শ সমাজ। যে সমাজে কোনো নেতা প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হতেন না, কোনো শিশু বা বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করা হতো না, কারও বাড়িতে ঢুকে তাকে খুন করা হতো না। সেই সমাজ শতভাগ গড়া না গেলেও অন্তত অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা অসম্ভব কিছু নয়।
‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়’—এই সত্য বুকে ধারণ করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া কি এতটাই কঠিন? জাতিকে বিভাজিত করে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ বানিয়ে শান্তি আনা যায় না, এ কথা সবার মনে রাখা উচিত।
সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় আজকের দিনে। ৫৪ বছর পেরিয়ে গেছে; তবু ভুলে যাওয়ার কোনো কারণ নেই যে বাঙালি জাতির ইতিহাসে এত বড় অর্জন আর দ্বিতীয়টি হয় না। লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা গৌরবের। আজ আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই সব শহীদের আত্মদানের কথা, যাঁদের রক্ত দিয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
দেশ স্বাধীন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মানুষ এত বছরেও স্বস্তি পায়নি। যারা যখনই এ দেশকে শাসন করতে চেয়েছে বা করেছে, তাদের অসৎ, অসাধু, দুর্নীতিবাজ আচরণ জনগণকে স্বস্তি দিতে পারেনি। যার যার মতো করে তারা দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে সাজাতে চেয়েছে। ফলে মত-দ্বিমতের জালে বারবার আটকা পড়েছে সেই ইতিহাস। তবে সেই সময়কার পত্রপত্রিকাগুলো যে মুক্তিযুদ্ধের অকাট্য দলিল, এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এই ইতিহাস নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং চেতনায় ধারণ করতে হবে। অগ্রজদের দায়িত্ব এই চেতনা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া—বিকৃত করে নয় বরং সঠিক ইতিহাস জানানোর মাধ্যমে। এই জানানোটা যেন আবার যান্ত্রিক কিংবা শুধু কেতাবি না হয়। মা-বাবা বা যেকোনো অভিভাবক তাঁদের কথা, কাজ, আচরণে যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রকাশ করবেন, তখনই একটি পরিবারের নতুন প্রজন্ম সেই চেতনাকে ধারণ করতে শিখবে, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সত্যিকারের স্বাদ পাবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে যে দেশটি বাঙালি জাতি গড়েছিল, সেই দেশে কোনো দুর্নীতি, অসততা, অপরাধ, বৈষম্য থাকবে না বলেই তো শপথ নেওয়া হয়েছিল। বিজয়ের ৫৪ বছরেও যাঁরা প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাবের খাতা খুলে বসেন, তাঁরা হয়তো দেনার হিসাবটা করেন না। তবে তাঁরাও এ বিষয়ে সহমত হবেন যে ওই সব শপথ পূরণ করতে পারেনি কোনো রাজনৈতিক দলই। বরং সবাই মিলে শপথ ভঙ্গই করেছে। কোন আমলে হয়নি দুর্নীতি, খুনখারাবি, ছিনতাই, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ?
অথচ সবাই মিলেই গড়ে তোলা যেত একটি আদর্শ সমাজ। যে সমাজে কোনো নেতা প্রকাশ্যে গুলিবিদ্ধ হতেন না, কোনো শিশু বা বৃদ্ধাকে ধর্ষণ করা হতো না, কারও বাড়িতে ঢুকে তাকে খুন করা হতো না। সেই সমাজ শতভাগ গড়া না গেলেও অন্তত অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা অসম্ভব কিছু নয়।
‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়’—এই সত্য বুকে ধারণ করে বৈষম্যহীন সমাজ গড়া কি এতটাই কঠিন? জাতিকে বিভাজিত করে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ বানিয়ে শান্তি আনা যায় না, এ কথা সবার মনে রাখা উচিত।
সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।

ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
৩১ মার্চ ২০২৫
একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ।
১৩ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে।
১৪ ঘণ্টা আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
২ দিন আগে
ড. রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তাঁর গবেষণার বিষয় ঢাকা শহরের ‘হিজড়া’ সম্প্রদায়। লিঙ্গবৈচিত্র্যসহ সামাজিক নৃবিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণা পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর গবেষণামূলক বই ‘নারী সত্তার অন্বেষণে’। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে একটি মহলের বিতর্কিত কথাবার্তা এবং জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা।
মাসুদ রানা

বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।
বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটাক্ষ করছেন কেউ কেউ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এমনকি মূল ধারার গণমাধ্যমেও তাঁদের এই কীর্তি করতে দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনি কী বলবেন?
প্রথমত, কারা এরা—সেই প্রশ্নটা জরুরি আমাদের জন্য। কারণ আমরা এমন একটা সময় পার করছি, যেখানে আসলে ওই অর্থে অথরিটি বা বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা নেই, যেখান থেকে ভাবনা উৎপাদন হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রের অপরাপর প্রতিষ্ঠানগুলোর মতো দুর্বল হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রটিও দুর্বল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই সুযোগে কিছু মানুষ তাঁদের নিজস্ব চিন্তা এবং যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভ উৎপাদন করতে চান, তাঁরা সেই সুযোগের একধরনের সদ্ব্যবহার করছেন।
দ্বিতীয়ত, সাধারণত কোনো দেশের জন্ম হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের লোকজনের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি থাকা লাগে। মানে নিজ দেশের, নিজ স্বাধীনতার এবং যুদ্ধ বা বিদ্রোহকে ধারণ করতে পারা। দুঃখজনক হলো, বিজয়ের এত বছর পার হওয়ার পরেও ব্যক্তি-দল-মত-পথ-বর্ণ-শ্রেণিনির্বিশেষে আমাদের নিজেদের যে বিজয়ের ইতিহাস এবং নিজের অর্জনের ইতিহাস আছে, সেই ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে নানা সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কটাক্ষ করার যে স্পর্ধা, সেটাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে অথবা ক্ষমতার অদল-বদলে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেই প্রশ্রয়েরই একটা দানবীয় রূপ ৫৪ বছর পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন, যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মতো দুঃসাহস এবং স্পর্ধা দেখাতে পারছে।
কিছু মীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্ছে। এর পেছনে কোনো গূঢ় রহস্য আছে বলে মনে করেন কি?
এতে কোনো গূঢ় রহস্য নেই। তবে এটা একটা ঐতিহাসিক প্রকল্পের অংশ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, তার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ হয়ে ওঠার গল্পটা এ দেশীয় নয়। ১৯৭১ সালের আগে থেকে একটা বিশেষ মহল একটা ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানিদের ইতিহাসের বইপত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেখানকার বক্তব্য কিন্তু একই ছিল। এখন তারা যেসব বক্তব্য দিচ্ছে, আগেও তারা সেটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে একাত্তরের সময় প্রতিবেশী যে দেশটি আমাদের সহযোগিতা করেছে, দুঃখজনক হলেও সত্যি যে তাদের বিভিন্ন চলচ্চিত্রে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। এই উভয় পক্ষের প্রতি আমাদের দেশের কিছু কিছু রাজনৈতিক দল প্রভাবিত। আবার ২০২৪-এর এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পরেও তাদের অনেকের উদ্দেশ্য কিন্তু এখনো পাকিস্তানপন্থীদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করা।
গত সরকারের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ তোলা যায়, তারা ভারতীয়দের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে, একইভাবে বর্তমান যাদের অধীনে আমরা শাসিত হচ্ছি, তারাও বীরদর্পে তাদের (বিগত সরকারের) অনুসরণে পাকিস্তানিদের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠায় তৎপর।
এই সময়ে যে বা যারা এ ধরনের ন্যারেটিভ উৎপাদন করছে, তাদের বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকা খুব জরুরি। কারণ, আমাদের দেশটির একটা ইতিহাস আছে, সেটাই আমাদের শিকড়। এখন কেউ যদি শিকড় উৎপাটন করার চেষ্টা করে, সেটা গূঢ় রহস্য না, সেটা হলো একটা ঐতিহাসিক ষড়যন্ত্র। মূলত বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির নিমিত্তে ও অবাধ ক্ষমতাচর্চার লক্ষ্যে মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে তারা বারবার বিতর্ক তৈরির চেষ্টায় লিপ্ত হয়। বিতর্ক তৈরি করার মধ্য দিয়ে তারা তাদের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, যাতে করে আমরা তাদের নিয়ে কথা বলি এবং আমাদের যা করণীয়, সে বিষয়গুলোতে মনোযোগ না দিই।
মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস আছে। কিন্তু সেই ইতিহাসকে বিতর্কিত করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে। সরকার এ ব্যাপারে কেন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না?
যারা মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তো অন্তত একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার দরকার ছিল এ সরকারের পক্ষ থেকে। কারণ, এ মাসটা হলো বিজয়ের। সেটুকুও কিন্তু করা হয়নি। মূল কারণ আমরা মোটামুটি সবাই বুঝতে পারি। কারণ, এই সরকারের সঙ্গে যাঁরা স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিশ্বাস করেন—এমন লোকজন যেমন আছেন, তেমনি যাঁরা এ দেশের স্বাধীনতার অর্জনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দিতে চান না, সে রকম লোকজনও (সম্ভবত) খুব শক্তিশালীভাবে আছেন। সে কারণে সরকার এ ধরনের বিষয়ে একটা শক্তিশালী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
তাঁদের এত আস্ফালনের পরেও কি আপনি মনে করেন তাঁরা সফল হতে পারবেন?
একাত্তর সালের আগে থেকেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসীম শক্তি আছে। আসলে একাত্তর সালের যুদ্ধটা ছিল গণমানুষের। এ দেশটা যখনই অন্যায়ের মধ্য দিয়ে গেছে, তখনই কিন্তু গণমানুষ বীরদর্পে প্রাণ দিয়ে দেশকে রক্ষার শপথ নিয়ে নিজেকে বিসর্জন দিয়েছে। কাজেই এখন আস্ফালনটা দেখা যাচ্ছে এ কারণে যে বর্তমানে এখানে কোনো প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার নেই। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানগুলো এখন পঙ্গু। আবার আমরা একটা অসময়ের মধ্যে আছি। এই অসময়েই কিন্তু সবচেয়ে বেশি শত্রু-মিত্র, মীরজাফর, বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়। অন্ধকার সময়ে চেনা যায়, এ দেশকে কারা ধারণ করে এবং কারা এ দেশের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
আমি তো মনে করি, এই আস্ফালন আমাদের একটা যুগান্তকারী সুযোগ করে দিয়েছে। তার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। এবং কারা আমাদের স্বাধীনতার অর্জনের ইতিহাসকে বিকৃত করার চক্রান্তে শামিল হয়েছে।
এই চেনার সুযোগটা আমাদের জন্য মন্দের ভালো বলা যেতে পারে। তবে আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না, তারা জয়যুক্ত হবে। বাংলাদেশের জন্মের সংগ্রামের ইতিহাস, লাখ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতার অর্জন—সেই আস্থা ও বিশ্বাস যতক্ষণ এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে থাকবে, যতক্ষণ এ দেশের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে; তার যদি গুটিকয়েকও হয়, তাহলেও আমি মনে করি, এই অপশক্তি অবশ্যই পরাজিত হবে। এই মুক্তিযুদ্ধকে যদি কোনো রাজনৈতিক দল তার নিজের বলে দাবি করে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হবে, এটা কোনো একক দলের অর্জন না। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধকে যদি কেউ শুধু প্রতিরোধযুদ্ধ বা যুদ্ধটা সেভাবে আমাদের যুদ্ধ ছিল না—এ রকম বয়ান প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাহলে সে বয়ানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ কড়ায়-গন্ডায় উপযুক্ত শিক্ষা দিতে প্রস্তুত বলে আমি বিশ্বাস করি।
আগামী জাতীয় নির্বাচন ইনক্লুসিভ এবং ভালো নির্বাচনের প্রত্যাশা করতে পারি কি?
ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হয়। আমরা আর কোনোভাবেই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের মতো অগণতান্ত্রিক কোনো নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করি না। আমি মনে করি, এ দেশের মানুষের যথেষ্ট পরিমাণ বিবেক-বিবেচনা বোধ আছে। তাঁরা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা রাখেন যে কাকে নির্বাচিত করবেন আর কাকে করবেন না।
সে ক্ষেত্রে যদি অযাচিতভাবে আইনের অনুসরণ না করে অথবা ক্ষমতাবলে এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ করা সম্ভব না, সেটা আর যা-ই হোক ইনক্লুসিভ নির্বাচন হবে না। সে ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, যিনি বা যাঁরা জুলাই এবং একাত্তরের হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত, ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের বাদ দিয়ে যাঁরা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করেন এবং সর্বোপরি অন্য কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে শুধু বাংলাদেশের হয়ে কাজ করতে চান, তাঁদের সবাইকে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া উচিত।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার পরেই ভোল পাল্টে ফেলে। নতুনভাবে নির্বাচিত কোন সরকারের সে রকম হওয়ার আশঙ্কা কতটুকু?
এটা নির্ভর করবে আগামী নির্বাচনটা কীভাবে হচ্ছে। কারণ নির্বাচনে যদি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয় অর্থাৎ যেখানে জনগণের মতামতের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকে, তাহলে ভয়াবহতার শঙ্কা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি দেওয়া ও রাখার কোনো মানে দাঁড়ায় না।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রার্থীরা যেভাবে প্রচার-প্রচারণা করে নানা ধরনের অযৌক্তিক প্রতিশ্রুতি দেওয়া শুরু করেছেন, তাতে যৌক্তিকভাবে সেসব দেওয়ার সুযোগ নেই। এতে প্রমাণ হয় যে তাঁরা আসলে নির্বাচনের জন্যই প্রতিশ্রুতিগুলো দিচ্ছেন। কোনো প্রার্থী এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন যেমন আমরা সবাই জানি, একটা শিশু জন্ম নিচ্ছে ঋণের বোঝা নিয়ে। সেখানে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় খাতে ভর্তুকি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এগুলো সম্পূর্ণভাবে বিভ্রান্তিমূলক প্রতিশ্রুতি। এভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যদি তাঁরা ক্ষমতায় যান, তাঁরা তো সেসব রাখতে পারবেন না। তাঁরা মূলত প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য তা দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় যাওয়াটাই হলো তাঁদের মূল লক্ষ্য।
জুলাই আন্দোলনের পরেও আমরা যদি এসব থেকে বের হতে না পারি, তাহলে তো সমস্যা থেকে যাবে। ক্ষমতার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এ দেশকে সেবামূলক রাষ্ট্রে পরিণত করা। আমি ক্ষমতায় যাব এ জন্য না যে আমার পেশি বা প্রশাসনিক শক্তি আছে। আমি ক্ষমতায় যাব এ কারণে যে জনগণ যেন বিশ্বাস করেন আমি তাঁদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারব।
যখন আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এ জায়গায় চিন্তা করতে শুরু করবে, তখন একটা পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না এবং দেখাও যাচ্ছে না।
সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

ঢাকার ঈদ উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বহু শতাব্দীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতির এক বর্ণিল প্রতিচ্ছবি। মুঘল আমল থেকে শুরু করে আধুনিক সময় পর্যন্ত এই উৎসবের রূপ ও রীতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও এর মূল চেতনা আজও বহমান।
৩১ মার্চ ২০২৫
একসময় ১৬ ডিসেম্বর ও ২৬ মার্চ ছিল সর্বজনীন উদ্যাপনের দিন। দেশাত্মবোধক গান, কুচকাওয়াজ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে মুখর থাকত দেশ; লাল-সবুজে ঢেকে যেত রাজপথ, শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় ফুলে ফুলে ভরে উঠত স্মৃতিসৌধ।
১৩ ঘণ্টা আগে
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের পরে প্রত্যাশিত ছিল যে সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যে দেশপ্রেমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হবেন। তাঁরা তা হননি। বরং বিভাজন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। একাংশ ক্ষমতাসীনদের মধ্যে জাতীয় বুর্জোয়াদের খুঁজতে চেষ্টা করেছে এবং আশা করেছে তথাকথিত এই বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিপ্লব সংঘটিত করবে।
১৪ ঘণ্টা আগে
ফিবছর একই মহিমায় ফিরে আসে আজকের দিনটা—১৬ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই দিনেই আমরা চূড়ান্ত বিজয় লাভ করেছি।
১৪ ঘণ্টা আগে