রুশা চৌধুরী
এমন একটা সময় ছিল, গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে আলোর মানুষ হেঁটে যেতেন কেউ, ঘাসের ওপর পা দিয়ে, সঙ্গে আরও মানুষ। চোখে থাকত ভালোবাসার কথামালা—‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’, বুকের ভেতর আগুন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ আর কণ্ঠে সেই প্রিয় সুর, যা হৃদয়ের অদৃশ্য তন্ত্রী থেকে বেজে উঠত, ‘আমি কি ভুলিতে পারি’।
এমন সুর মনে হয় তাঁরা স্বপ্ন থেকে পেয়েছিলেন, ছোটবেলায় তাই মনে হতো। কবে প্রথম শুনেছিলাম মনে নেই। মনে হয় জন্ম থেকেই এ আমার সুর, আমার কথা!
সেই সব দিনের স্পষ্ট ছবি একটুও ঝাপসা না, খালি পায়ে দল বেঁধে শহীদ মিনারে যাওয়া, আমাদের মা-বাবারা গিয়েছেন অনেকবার, আমি মনে হয় এক বা দুইবার!
তখনো ঘাস ছিল এই শহরে। সেই ঘাসের ওপরে পা ফেললে সমস্ত শরীর এমনকি মানুষের আত্মাও পবিত্র হয়ে উঠত।
মানুষগুলোর মনে বেজে উঠত, ‘ও আমার বাংলা ভাষা, এ আমার দুঃখ ভুলানো বুক জুড়ানো লক্ষ মনের আশা’। চোখমুখে যে জ্যোতি ঝলকে উঠত, তাতে স্পষ্ট বোঝা যেত এই জাতি মাথা নোয়াবার নয়। সাদা শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি বা সাদা শার্ট যে পরতেই হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অনেকের বুকেই কালো ব্যাজ, কণ্ঠে সেই আশ্চর্য সুন্দর গান! যেন এক স্বপ্নের দিকে যাত্রা। সেই অদ্ভুত স্বপ্নযাত্রার নাম ছিল, ‘প্রভাতফেরি’।
ছিল বলছি কারণ আজ আর প্রভাতফেরি হয় না, ভোরের আলোকে সঙ্গে নিয়ে আর আমরা ভাষাকে, ভাষাশহীদদের কাছে শ্রদ্ধা জানাতে যাই না! কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অধোবদন হই, বুকের মাঝে গুমরে ওঠেন আলতাফ মাহমুদ—
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’...
সেই রক্ত কিন্তু ঝরেছিল দুপুরের লাল পলাশকে সাক্ষী রেখে। তাই হয়তো আজ পলাশেরা প্রাণপণ করে গাজীউল হকের সঙ্গে কণ্ঠ খুলে বলতে চায়, ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। কিন্তু ভুলতে হয় তাঁদের।
আমাদের সত্তায় আজ সমস্ত শহীদ, সুরের জাদুকর, কথার কারিগরেরা শুধু সাদা-কালো পোশাকে ঢাকা মূর্তি যেন! তাই আমরা সকালের সূর্যের বদলে রাতকে বেছে নিয়ে সুখে আছি। রাতের অন্ধকারে আমরা যাই আলোর পথযাত্রীদের কাছে, আমাদের কণ্ঠ তখন উচ্চারণে ভুল করে ফেলে, ‘ও আলোর পথযাত্রী তিমির রাত্রি এখানে থেমো না’।
আমাদের সন্তানেরা ভোররাতে উঠে সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া বোঝে না, ‘প্রভাতফেরি’ তাদের কাছে ঠাকুরমার ঝুলিও না, সে যেন হ্যারি পটারের গল্প। সেই গল্প থেকে কালো কাপড়, লাল ফুল, ফেলে আসা নিয়ম রক্ষার গান বেরোলেও প্রাণ কেমন যেন হারিয়ে গেছে।
মাত্র বাহাত্তর বছরেই হারিয়ে গেল প্রভাতফেরি, ডাইনোসরদের হারাতেও এর থেকে বেশি সময় লেগেছিল, তেলাপোকারা তো আজও বেঁচে আছে। আমরা পারলাম না এমন চমৎকার একটা স্বপ্নদৃশ্য সত্যি করে রাখতে।
রাত ১২টায় শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করে দুপুরের পরেই ক্লান্ত মানুষ উৎসবের আনন্দে খাওয়া-দাওয়া, অক্লান্ত ভেঁপু-বাঁশির তারস্বরে সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায় মন্দ্র সুরে গাওয়া সেই গান, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়’...
আজ আমাদের কোনো শিকল নেই, তবু কেন আমরা আমাদের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি না? আসল সত্য কি তাহলে ‘ভুলে যাওয়া’?
যদি আমরা সেই সময় জন্মাতাম তাহলে এই দেশে কি বাংলা ভাষা বাঁচত? আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কালজয়ী কবিতা লেখা সেই কবিতাকে অমরাবতীর সুর দিয়ে অমর করবার মতো মন বা মনন তো আমাদের নেই! থাকলে কি আমরা রাতের আঁধারে আলতাফ মাহমুদের মতো আলোর মানুষের সুর গাইতাম—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’?
যে প্রাণময় স্মৃতি নিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম তা আবার ফিরিয়ে আনতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় নিজের সন্তান, বন্ধু, স্বজন, সহযাত্রীদের হাত ধরে আবার আমরা ভোরের আলোকে সাক্ষী করে শহীদ মিনারে যাই। মানুষের স্বার্থ আর বাস্তবতা তার ইচ্ছে, তার স্বাধীনতা এমনকি তার ভালোবাসার থেকেও বড় হতে পারে। যাদের জীবনে বায়ান্ন আছে, একাত্তর আছে, তাদের জন্য এই লজ্জিত সত্য ভুলে যাওয়া, ভুলে থাকা ভীষণ বেদনাময়।
এমন একটা সময় ছিল, গলায় হারমোনিয়াম নিয়ে আলোর মানুষ হেঁটে যেতেন কেউ, ঘাসের ওপর পা দিয়ে, সঙ্গে আরও মানুষ। চোখে থাকত ভালোবাসার কথামালা—‘আকাশ ভরা সূর্য তারা বিশ্ব ভরা প্রাণ’, বুকের ভেতর আগুন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়’ আর কণ্ঠে সেই প্রিয় সুর, যা হৃদয়ের অদৃশ্য তন্ত্রী থেকে বেজে উঠত, ‘আমি কি ভুলিতে পারি’।
এমন সুর মনে হয় তাঁরা স্বপ্ন থেকে পেয়েছিলেন, ছোটবেলায় তাই মনে হতো। কবে প্রথম শুনেছিলাম মনে নেই। মনে হয় জন্ম থেকেই এ আমার সুর, আমার কথা!
সেই সব দিনের স্পষ্ট ছবি একটুও ঝাপসা না, খালি পায়ে দল বেঁধে শহীদ মিনারে যাওয়া, আমাদের মা-বাবারা গিয়েছেন অনেকবার, আমি মনে হয় এক বা দুইবার!
তখনো ঘাস ছিল এই শহরে। সেই ঘাসের ওপরে পা ফেললে সমস্ত শরীর এমনকি মানুষের আত্মাও পবিত্র হয়ে উঠত।
মানুষগুলোর মনে বেজে উঠত, ‘ও আমার বাংলা ভাষা, এ আমার দুঃখ ভুলানো বুক জুড়ানো লক্ষ মনের আশা’। চোখমুখে যে জ্যোতি ঝলকে উঠত, তাতে স্পষ্ট বোঝা যেত এই জাতি মাথা নোয়াবার নয়। সাদা শাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি বা সাদা শার্ট যে পরতেই হবে তার কোনো বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অনেকের বুকেই কালো ব্যাজ, কণ্ঠে সেই আশ্চর্য সুন্দর গান! যেন এক স্বপ্নের দিকে যাত্রা। সেই অদ্ভুত স্বপ্নযাত্রার নাম ছিল, ‘প্রভাতফেরি’।
ছিল বলছি কারণ আজ আর প্রভাতফেরি হয় না, ভোরের আলোকে সঙ্গে নিয়ে আর আমরা ভাষাকে, ভাষাশহীদদের কাছে শ্রদ্ধা জানাতে যাই না! কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অধোবদন হই, বুকের মাঝে গুমরে ওঠেন আলতাফ মাহমুদ—
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি’...
সেই রক্ত কিন্তু ঝরেছিল দুপুরের লাল পলাশকে সাক্ষী রেখে। তাই হয়তো আজ পলাশেরা প্রাণপণ করে গাজীউল হকের সঙ্গে কণ্ঠ খুলে বলতে চায়, ‘ভুলব না ভুলব না ভুলব না এ একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। কিন্তু ভুলতে হয় তাঁদের।
আমাদের সত্তায় আজ সমস্ত শহীদ, সুরের জাদুকর, কথার কারিগরেরা শুধু সাদা-কালো পোশাকে ঢাকা মূর্তি যেন! তাই আমরা সকালের সূর্যের বদলে রাতকে বেছে নিয়ে সুখে আছি। রাতের অন্ধকারে আমরা যাই আলোর পথযাত্রীদের কাছে, আমাদের কণ্ঠ তখন উচ্চারণে ভুল করে ফেলে, ‘ও আলোর পথযাত্রী তিমির রাত্রি এখানে থেমো না’।
আমাদের সন্তানেরা ভোররাতে উঠে সূর্যকে সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে যাওয়া বোঝে না, ‘প্রভাতফেরি’ তাদের কাছে ঠাকুরমার ঝুলিও না, সে যেন হ্যারি পটারের গল্প। সেই গল্প থেকে কালো কাপড়, লাল ফুল, ফেলে আসা নিয়ম রক্ষার গান বেরোলেও প্রাণ কেমন যেন হারিয়ে গেছে।
মাত্র বাহাত্তর বছরেই হারিয়ে গেল প্রভাতফেরি, ডাইনোসরদের হারাতেও এর থেকে বেশি সময় লেগেছিল, তেলাপোকারা তো আজও বেঁচে আছে। আমরা পারলাম না এমন চমৎকার একটা স্বপ্নদৃশ্য সত্যি করে রাখতে।
রাত ১২টায় শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু করে দুপুরের পরেই ক্লান্ত মানুষ উৎসবের আনন্দে খাওয়া-দাওয়া, অক্লান্ত ভেঁপু-বাঁশির তারস্বরে সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যায় মন্দ্র সুরে গাওয়া সেই গান, ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়ওরা কথায় কথায় শিকল পরায় আমার হাতে পায়’...
আজ আমাদের কোনো শিকল নেই, তবু কেন আমরা আমাদের সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি না? আসল সত্য কি তাহলে ‘ভুলে যাওয়া’?
যদি আমরা সেই সময় জন্মাতাম তাহলে এই দেশে কি বাংলা ভাষা বাঁচত? আহত হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কালজয়ী কবিতা লেখা সেই কবিতাকে অমরাবতীর সুর দিয়ে অমর করবার মতো মন বা মনন তো আমাদের নেই! থাকলে কি আমরা রাতের আঁধারে আলতাফ মাহমুদের মতো আলোর মানুষের সুর গাইতাম—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি’?
যে প্রাণময় স্মৃতি নিয়ে আমরা বেড়ে উঠেছিলাম তা আবার ফিরিয়ে আনতে ভীষণ ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে হয় নিজের সন্তান, বন্ধু, স্বজন, সহযাত্রীদের হাত ধরে আবার আমরা ভোরের আলোকে সাক্ষী করে শহীদ মিনারে যাই। মানুষের স্বার্থ আর বাস্তবতা তার ইচ্ছে, তার স্বাধীনতা এমনকি তার ভালোবাসার থেকেও বড় হতে পারে। যাদের জীবনে বায়ান্ন আছে, একাত্তর আছে, তাদের জন্য এই লজ্জিত সত্য ভুলে যাওয়া, ভুলে থাকা ভীষণ বেদনাময়।
ভাষা নিয়ে কিছু বলতে গেলে সে সময়ের সমাজ নিয়েও কথা বলতে হয়। কীভাবে বাংলা ভাষা জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সকলের ভাষা হয়ে উঠল, কীভাবে রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে দেশের জনগণ বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রস্তুত হলো, তার পটভূমি জানা দরকার।
৫ ঘণ্টা আগেআটচল্লিশ থেকে বায়ান্ন এবং বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি এক মুখ্য গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্লোগানগুলো ছিল কখনো গানের ভাষায়, কখনো রাজপথের রুদ্র বাক্যে—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’ অথবা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। কৃষক লাঙল চালাতে চালাতে থমকে দাঁড়ায়, ‘কী ব্যাপার, মুখের ভাষা কাইড়া...
১ দিন আগে‘সাড়ে ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬৩ লাখই বেকার। আর এই বেকারদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই শিক্ষিত বেকার। এই ৮৭ শতাংশের মধ্য থেকে ২১ শতাংশ আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েও কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নয়।
১ দিন আগেময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ফুল দিয়ে বরণ করা নিয়ে যে ‘স্নেহের’ আদান-প্রদান হয়েছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। ফুলের শুভেচ্ছা দেওয়া থেকে শুরু করে ছাত্রদল ও শিবির কর্মীদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা দেশের ক্যাম্পাস রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করল! যদিও কেউ আহত হননি...
১ দিন আগে