Ajker Patrika
সাক্ষাৎকার

যখন-তখন অপ্রয়োজনে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি

অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম।

অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের-বিএমইউ (সাবেক পিজি হাসপাতাল) ভাইস চ্যান্সেলর। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্যের (একাডেমিক) দায়িত্ব পালন করেছেন। যে গতিতে পৃথিবী থেকে কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক নিঃশেষ হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যতের চিকিৎসাব্যবস্থার পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এবং এখান থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

মাসুদ রানা

বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট সংক্রামক রোগ তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত আছে, তার বেশির ভাগই এখন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এর কারণ কী?

বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিবায়োটিক-রেজিস্ট্যান্ট অথবা ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আমরা যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকি, সেটা গুরুতর মাত্রায় প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এটার জন্য সকল পর্যায়ই দায়ী। যেকোনো রোগ হওয়ার সময় প্রাথমিক পর্যায়ে দেখা যায়, আমরা যখন-তখন যেকোনো অসুখে অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি। কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষ করে ভাইরাস ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের ফার্মেসিগুলোতে অহরহ অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা হচ্ছে। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করার নিয়ম থাকলেও, তা মানা হচ্ছে না। প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি হচ্ছে। আর একটা বিষয়, প্রেসক্রিপশনের মাধ্যমেও এটা হচ্ছে। ডাক্তারদেরও প্রেসক্রাইব করার ক্ষেত্রে সচেতনতার অভাব আছে। কখন, কী প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হবে, কোন ধরনের রোগী এটা ব্যবহার করতে পারবে—এসব নির্ণয়ে চিকিৎসকদের প্রেসক্রাইব করার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা দেখা যায়। সেই জায়গায় আমাদের সংশোধন হওয়া খুব দরকার।

এ কারণে অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার এবং যথাযথভাবে এটা ব্যবহার না করা মানে পুরোমাত্রার ডোজ ব্যবহার বা না খাওয়ার কারণে এর কার্যকারিতা নেই। ফলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস অতিমাত্রায় প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। একসময় দেখা যায় যে, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না।

ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের বিক্রি ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?

সারা বিশ্বে কোথাও ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা বা বিক্রি করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশে আইন অনুযায়ী ফার্মেসিগুলোতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করার বিধান আছে, সেটা কোথাও মানা হয় না। ফার্মেসিগুলো সেলসম্যান দিয়ে চালানো হচ্ছে। যাদের ওষুধবিজ্ঞান বিষয়ে কোনো জ্ঞান নেই। সেই জ্ঞান না থাকার কারণে তাদের মধ্যে কোনো বোধ বা সচেতনতা কাজ করে না। তাঁদের উপলব্ধিই হয় না যে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বিক্রি করা যায় না। এটা আইনবিরোধী এবং স্বাস্থ্যবিরোধী কর্মকাণ্ড।

আবার বেশির ভাগ ফার্মেসির মালিকের কাছে শুধু ব্যবসা এবং লাভ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে জরুরি বিষয়, আইনটাও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আমাদের দেশে অনেক ফার্মেসির দোকান আছে এবং অন্যদিকে হাজার হাজার ফার্মাসিস্ট বেকার হয়ে বসে আছেন। এ রকম বেকার ফার্মাসিস্টদের চাকরি দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার। সেটা করা হচ্ছে না। দেশের সব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্টদের নিয়োগের ব্যবস্থা কার্যকর করা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধ করতে পারি।

অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা থাকছে না, এ অবস্থায় নতুনভাবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করা যাচ্ছে না কেন?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একদিকে ব্যাকটেরিয়ার রেজিট্যান্স হবে, অন্যদিকে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হতে থাকবে। সেটা হলে তো কোনো সমস্যা ছিল না। যে পরিমাণ ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে উঠছে, সে পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি বা আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ হলো, আসলে চিকিৎসাবিজ্ঞান এটার সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। আর যত সহজে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তত সহজে অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা যায় না। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা হেরে যাচ্ছি।

রেজিস্ট্যান্সের কারণে সার্জারি, কেমোথেরাপি, অঙ্গ প্রতিস্থাপন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এবং ডোজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট গাইডলাইন পালন করা উচিত সবারই। যাঁরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) ভর্তি থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোন সময়ে, কোন অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে, সেটা ওই হাসপাতালের অতীতে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার যে পরিসংখ্যান এবং অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের যে প্যাটার্ন, সেটা অনুসরণ করে প্রয়োগ করতে হবে। এ জন্য সারা দেশের সব হাসপাতালের একটা গাইডলাইন থাকা দরকার। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু আমাদের গাইডলাইন নেই, সেহেতু আমরা নির্দিষ্ট রোগীর জন্য সেটা দিয়ে থাকি। সে জন্য হাসপাতালগুলোতে কোনো রোগী ভর্তি হলে, তাকে বেশি মাত্রার, অ্যাডভান্স এবং রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। আবার কেমোথেরাপি বা অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা যাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম—সেই ধরনের রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। কোন সময়ে এবং কোন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হবে সেটা হাসপাতালগুলো নির্দিষ্ট করলে, এতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগও কমবে, খরচ কমবে এবং অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্সও কমবে। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রে সেসবের কোনোটাই মানা হয় না।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় বাংলাদেশে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে কি?

এটাও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স মোকাবিলায় আমাদের জাতীয় কর্মপরিকল্পনা আছে। যেটা এখন আংশিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে। তবে যে ব্যাপক মাত্রার সমস্যা হিসেবে আমরা ভুক্তভোগী, সে রকমভাবে সেটা পর্যাপ্ত নয়। যেমন আমাদের হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, ইনফেকশন কন্ট্রোল সিস্টেম এবং গাইডলাইনের বিষয়গুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এটা দ্রুত কার্যকর করা প্রয়োজন।

২০২৩ সালের এক জরিপ মতে, পরীক্ষাগারে নিশ্চিত হওয়া ছয়টির মধ্যে একটি সংক্রামক রোগ অ্যান্টিবায়োটিকে সারানো যাচ্ছে না। রক্ত, অন্ত্র, মূত্রনালি এবং যৌন সংক্রমণের মতো সাধারণ সংক্রামক রোগে ৪০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর। বোঝা যাচ্ছে পরিস্থিতি ভয়াবহ। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?

এখান থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি শুধু যে কারণে ইনফেকশন হয়, সে কারণগুলো খুঁজে বের করা। সব হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগের একটা পরিসংখ্যান থাকা দরকার। যেমন কোন ইনফেকশনের জন্য কোন অ্যান্টিবায়োটিকটা কার্যকর, সেটা সুনির্দিষ্ট করা। এরপর শুরুতে অতিমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়া এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের যে বিভিন্ন পর্যায় আছে, সেগুলোকে অনুসরণ করে আগে প্রাথমিক পর্যায়ের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া এবং গাইডলাইন মেনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে এটা কার্যকর হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে।

এখন কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, অতিমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কাজ করছে না, কিন্তু পুরোনো দিনের অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ভালো কাজ করছে। এগুলো কম ব্যবহারের কারণে ভালো কাজ করছে। সে কারণে আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ধরন নিশ্চিত হওয়া, নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুসরণ করা গেলে আমরা এখান থেকে মুক্তি পেতে পারি।

যাঁরা নিম্ন আয়ের মানুষ, তাঁরা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন না। তাঁরা বাধ্য হয়ে ফার্মেসিতে যান। আর ফার্মেসির লোকেরা হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। এখান থেকে কীভাবে রক্ষা পেতে পারি?

গরিব মানুষের জন্য আমাদের সরকারি আয়োজন আছে। আমাদের দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে কম খরচে চিকিৎসা পাওয়া যায়। বাস্তবতা হচ্ছে, তাঁরা সেখানে যাচ্ছেন না। তবে প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া বন্ধ করা গেলে, এগুলো কোনো সমস্যা হিসেবে থাকবে না।

আইন কার্যকর এবং অসচেতনতার ব্যাপার আছে। সে ক্ষেত্রে কী করণীয়?

সচেতনতার পাশাপাশি আইন কার্যকর করতে হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, দেশের সব ফার্মেসিতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

সামগ্রিকভাবে এ থেকে রক্ষা পেতে আপনার কোনো পরামর্শ আছে?

স্বাস্থ্য শুধু মানুষের একার বিষয় নয়। এটাকে এখন বলা হয় ‘ওয়ান হেলথ’। ওয়ান হেলথের মধ্যে প্রাণী থেকে শুরু করে হাঁস, মুরগি, গরু-ছাগল, গাছপালা—সবকিছুই এটার মধ্যে যুক্ত। পৃথিবীর সবকিছু এমনকি পৃথিবীর বাইরের বিষয়গুলোও এর সঙ্গে যুক্ত। এটার জন্য আমাদের সবকিছুকে আনতে হবে। ধরুন, কেউ যদি মুরগিকে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়, তাহলে সেটা মুরগিটাকে ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী করছে, সেটা আবার মানুষকে সংক্রামিত করছে। একইভাবে গরুকে যদি সেটা দেওয়া হয়, সেটাও গরুকে ব্যাকটেরিয়া-প্রতিরোধী করবে। সে কারণে সেটা মানুষকেও সংক্রামিত করতে বাধ্য।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘ওয়ান হেলথ’কে সামগ্রিকভাবে কার্যকর করে ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল সিস্টেমকে সব হাসপাতালে কার্যকর করতে হবে। এটা ব্যয়বহুল হলেও সামগ্রিকভাবে চিকিৎসার অর্থ ব্যয় কমে যাবে। আর দেশের সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার গাইডলাইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ফার্মেসিগুলোতে রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমরা এখান থেকে রক্ষা পাব।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা—জনসংখ্যার তীব্র সংকটে ইউক্রেন

বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি শিক্ষার্থী ভর্তি স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়

ভোটের মাঠে: টাঙ্গাইলে নির্বাচনী উত্তাপ

গোপালগঞ্জে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ, ছাত্রীর আত্মহত্যা

খালেদা জিয়াকে নিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স রওনা হবে শুক্রবার দুপুরে

এলাকার খবর
Loading...

পাঠকের আগ্রহ