আবু তাহের খান
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন থেকেই বিভিন্ন মহল সরকারের কাছে নানা দাবিদাওয়া উত্থাপন করে আসছে। এসব দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ রাষ্ট্রীয় দপ্তর, রাজপথ ইত্যাদি ঘেরাওয়ের একটি প্রবণতাও বেশ জোরেশোরেই লক্ষ করা যাচ্ছে এবং এ ধরনের ঘেরাওয়ের মাধ্যমে কিছু কিছু দাবিদাওয়া ইতিমধ্যে তারা আদায়ও করে নিয়েছে। এ দাবিদাওয়াগুলো তারা এমন ভাষা ও আঙ্গিকে উপস্থাপন করছে যে মনে হয় যেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল এসব পূরণ বা আদায়। ভাবটা এমন, যেন আগের স্বৈরাচারী সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এত দিন এইচএসসিতে অটোপাস কিংবা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিদানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো আটকে ছিল! অধিকন্তু তারা এমন একটি ভান করছে যেন এসব দাবিদাওয়া পূরণ হলেই দেশ থেকে চিরতরে ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি ঘটে যাবে। মোটকথা, চতুর্দিক থেকে ওঠা এসব দাবিদাওয়াকে তারা অনেকটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও চেতনার সমার্থক বানিয়ে ফেলছে—যা শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, গর্হিত ধূর্ততাও। আসলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকারকে অনেকটা ব্ল্যাকমেল করেই তারা এসব আদায়ের চেষ্টা করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই কতিপয় হীন প্রকৃতির ছেলেমেয়ে মিলে সচিবালয় ঘেরাও করে বলল, তারা চলমান এইচএসসি পরীক্ষার বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আর পরীক্ষায় বসতে রাজি নয়, তারা চায় অটোপাস। যেই দাবি, সেই কাজ। সাবেক সরকারের দোসর সুবিধাবাদী চতুর আমলারা নিজেদের নতুন সরকারের পক্ষের লোকজন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ওই ধূর্ত ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ ধরে নিয়ে মুহূর্তেই তাদের অটোপাসদানের দাবি মেনে নিলেন। এমনকি এ বিষয়ে তাঁরা শিক্ষা উপদেষ্টার কাছ থেকেও কোনো অনুমতি বা পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা একাধিকবার প্রকাশ্যে তাঁর অসন্তুষ্টি ও সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ আরও অনেকেই অটোপাসের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু চতুর আমলারা সে সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্রও সরে আসেননি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করা হয়নি ওই শিক্ষার্থীরা তাদের সমর্থনপুষ্ট কি না। এদিকে এইচএসসির অটোপাসের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর ওই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আবার শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করল তাদের মনেরমতো করে ফলাফল দেওয়ার জন্য, যদিও এখন পর্যন্ত সে দাবি মানা হয়নি। তবে একপর্যায়ে তা মেনে নেওয়া হলে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রায় একই অবস্থা আমলাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও। কোনোই সন্দেহ নেই যে বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক কারণে বহুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যেটি ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই পাল্টাপাল্টিভাবে হয়ে আসছে—যা শুধু গর্হিতই নয়, চরম অপেশাদারত্বসুলভ আচরণও বটে। ১৫ বছরে যাঁরা এরূপ কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও নীতিমালা (ক্রাইটেরিয়া) অনুসরণপূর্বক এর বিহিত হওয়া জরুরি বলে মনে করি। কিন্তু সেটি না করে চর দখলের মতো করে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রং বদলে ফেলাদেরসহ সবাইকে রাতারাতি ও হরেদরে পদোন্নতি দিয়ে দেওয়া হলো, সেটি সত্যি বিস্ময়কর ও হতাশাব্যঞ্জক। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নানা কেলেঙ্কারিপূর্ণ ঘটনায় বুঁদ হয়ে থাকা আমলাতন্ত্রের গায়ে আরেক দফা নতুন কালিমা যুক্ত হলো বৈকি!
আনসার সদস্যরা তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করতে গিয়ে এতটাই মারমুখী হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-সমন্বয়কদেরও রেহাই দেননি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীদের আন্দোলন ঐরূপ মারমুখী না হলেও সেটির প্রভাব ও মাত্রাও নিছক কম ছিল না। একইভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীতকরণের দাবিতে আন্দোলনকারীরা রাজপথকে এতটাই প্রকম্পিত করে তুলেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে উল্লিখিত বয়সসীমা ইতিমধ্যে ৩২ বছরে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও আন্দোলনকারীরা বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন। এখন বলুন, ওই দাবিগুলোর কোনটি শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত? আসলে এগুলোর সবই হচ্ছে পরিস্থিতিকে ব্ল্যাকমেল করে সুবিধা আদায়ের হীন কৌশল, যার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।
সর্বশেষ পর্যায়ে আন্দোলন চলছিল ঢাকার সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে। উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে দেশে ইতিমধ্যে ১৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় শুধু বেশিই নয়, শিক্ষাকে চরম মানহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার এক হীনতাপূর্ণ ব্যবস্থাও বটে। মোটকথা, দেশে এই মুহূর্তে এ-জাতীয় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এতটুকু কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে দেশে আরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, তাহলে সেটি তো করতে হবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাইপূর্বক। কিন্তু তাই বলে কলেজকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হবে? কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তো সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ভিন্নতর প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর একটি খুবই বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় সরকারের আমলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের মাধ্যমে দেশে উচ্চশিক্ষার মানকে এতটাই নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে যে সেখান থেকে এখন বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় ব্ল্যাকমেলিং আন্দোলনের চাপে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে তা হবে আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত।
ওপরে যেসব দাবিদাওয়ার কথা উল্লেখ করা হলো, তার বাইরেও আরও অনেক শ্রেণিগোষ্ঠীর লোকেরা মাঝেমধ্যেই তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করে রাখছেন, যাদের মধ্যে দৈনিক বা চুক্তিভিত্তিক বা আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের রাজস্ব বাজেটের আওতায় নিয়মিতকরণের দাবি অন্যতম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ-জাতীয় নিয়মিতকরণ কতটা যৌক্তিক? অভিজ্ঞতা থেকে বলি, উল্লিখিত এসব অস্থায়ী কর্মচারীর অধিকাংশই নিয়োগ পেয়েছেন প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অথবা কোনো পদ ছাড়াই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষায় কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য খণ্ডকালীন ভিত্তিতে; এবং সেসব চাকরির শর্ত মেনে নিয়েই তাঁরা চাকরিতে যোগদান করেছেন। এমন নয় যে সরকার নিয়োগপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে তাঁদের নিয়মিতকরণ থেকে বিরত থাকছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন, সরকার তার রাজস্ব বাজেটের প্রায় ৪৩ শতাংশই বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে ব্যয় করছে, যা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অবহনযোগ্যও। আর বেতন-ভাতার এই বিশাল বোঝা বস্তুত এ দেশের সাধারণ মানুষের করের পয়সা দিয়েই মেটাতে হচ্ছে। অতএব নিয়োগপত্রের শর্তের বাইরে গিয়ে কাউকে রাজস্ব বাজেটের আওতায় স্থানান্তর করা একেবারেই সমীচীন নয় বলে মনে করি। কিন্তু এরপরও যাঁরা এ দাবি তুলছেন, তাঁরা বস্তুত সরকারকে ব্ল্যাকমেল করে নিজেদের সুবিধা হাসিলের চেষ্টা করছেন মাত্র।
সব মিলিয়ে বলব, বিভিন্ন মহলের এসব দাবিদাওয়া পূরণ অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এই সরকার এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, খাতভিত্তিক সংস্কারকাজ এগিয়ে নেওয়া ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, যার প্রকারান্তরিক লক্ষ্য হচ্ছে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। বিভিন্ন মহল কর্তৃক রাজপথ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করে দাবিদাওয়া আদায়ের যেসব প্রচেষ্টা চলছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব বস্তুত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের। এমতাবস্থায় এখনই এসব দাবিদাওয়া তোলার মানে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা এবং সুযোগ বুঝে অহেতুক তাদের চাপে ফেলা। কারণ, এ কাজগুলোর কোনোটিই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। অন্যদিকে এসব ঘেরাওয়ের মাধ্যমে তারা যেসব জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন, সেগুলোও নিন্দনীয়। আর এসবের প্রকারান্তরিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অতএব আন্দোলনকারীদের প্রতি অনুরোধ, অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করুন, যাতে তারা এমন একটি সরকার উপহার দিতে পারে, যারা এসে এ দাবিদাওয়াগুলো সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করার সুযোগ পায়।
লেখক: সাবেক পরিচালক বিসিক
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরদিন থেকেই বিভিন্ন মহল সরকারের কাছে নানা দাবিদাওয়া উত্থাপন করে আসছে। এসব দাবিদাওয়া আদায়ের কৌশল হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, সচিবালয়, শিক্ষা বোর্ডসহ রাষ্ট্রীয় দপ্তর, রাজপথ ইত্যাদি ঘেরাওয়ের একটি প্রবণতাও বেশ জোরেশোরেই লক্ষ করা যাচ্ছে এবং এ ধরনের ঘেরাওয়ের মাধ্যমে কিছু কিছু দাবিদাওয়া ইতিমধ্যে তারা আদায়ও করে নিয়েছে। এ দাবিদাওয়াগুলো তারা এমন ভাষা ও আঙ্গিকে উপস্থাপন করছে যে মনে হয় যেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল এসব পূরণ বা আদায়। ভাবটা এমন, যেন আগের স্বৈরাচারী সরকারের স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই এত দিন এইচএসসিতে অটোপাস কিংবা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পদোন্নতিদানসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো আটকে ছিল! অধিকন্তু তারা এমন একটি ভান করছে যেন এসব দাবিদাওয়া পূরণ হলেই দেশ থেকে চিরতরে ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি ঘটে যাবে। মোটকথা, চতুর্দিক থেকে ওঠা এসব দাবিদাওয়াকে তারা অনেকটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও চেতনার সমার্থক বানিয়ে ফেলছে—যা শুধু দুর্ভাগ্যজনকই নয়, গর্হিত ধূর্ততাও। আসলে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সরকারকে অনেকটা ব্ল্যাকমেল করেই তারা এসব আদায়ের চেষ্টা করছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই কতিপয় হীন প্রকৃতির ছেলেমেয়ে মিলে সচিবালয় ঘেরাও করে বলল, তারা চলমান এইচএসসি পরীক্ষার বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আর পরীক্ষায় বসতে রাজি নয়, তারা চায় অটোপাস। যেই দাবি, সেই কাজ। সাবেক সরকারের দোসর সুবিধাবাদী চতুর আমলারা নিজেদের নতুন সরকারের পক্ষের লোকজন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য ওই ধূর্ত ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অংশ ধরে নিয়ে মুহূর্তেই তাদের অটোপাসদানের দাবি মেনে নিলেন। এমনকি এ বিষয়ে তাঁরা শিক্ষা উপদেষ্টার কাছ থেকেও কোনো অনুমতি বা পরামর্শ গ্রহণ করেননি। এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা একাধিকবার প্রকাশ্যে তাঁর অসন্তুষ্টি ও সিদ্ধান্তটি সঠিক হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরাসহ আরও অনেকেই অটোপাসের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু চতুর আমলারা সে সিদ্ধান্ত থেকে বিন্দুমাত্রও সরে আসেননি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকেও আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করা হয়নি ওই শিক্ষার্থীরা তাদের সমর্থনপুষ্ট কি না। এদিকে এইচএসসির অটোপাসের ফল প্রকাশিত হওয়ার পর ওই শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আবার শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করল তাদের মনেরমতো করে ফলাফল দেওয়ার জন্য, যদিও এখন পর্যন্ত সে দাবি মানা হয়নি। তবে একপর্যায়ে তা মেনে নেওয়া হলে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
প্রায় একই অবস্থা আমলাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও। কোনোই সন্দেহ নেই যে বিগত ১৫ বছরে রাজনৈতিক কারণে বহুসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যেটি ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই পাল্টাপাল্টিভাবে হয়ে আসছে—যা শুধু গর্হিতই নয়, চরম অপেশাদারত্বসুলভ আচরণও বটে। ১৫ বছরে যাঁরা এরূপ কারণে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ও নীতিমালা (ক্রাইটেরিয়া) অনুসরণপূর্বক এর বিহিত হওয়া জরুরি বলে মনে করি। কিন্তু সেটি না করে চর দখলের মতো করে যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ও সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রং বদলে ফেলাদেরসহ সবাইকে রাতারাতি ও হরেদরে পদোন্নতি দিয়ে দেওয়া হলো, সেটি সত্যি বিস্ময়কর ও হতাশাব্যঞ্জক। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে নানা কেলেঙ্কারিপূর্ণ ঘটনায় বুঁদ হয়ে থাকা আমলাতন্ত্রের গায়ে আরেক দফা নতুন কালিমা যুক্ত হলো বৈকি!
আনসার সদস্যরা তাঁদের চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করতে গিয়ে এতটাই মারমুখী হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-সমন্বয়কদেরও রেহাই দেননি। পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মচারীদের আন্দোলন ঐরূপ মারমুখী না হলেও সেটির প্রভাব ও মাত্রাও নিছক কম ছিল না। একইভাবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছরে উন্নীতকরণের দাবিতে আন্দোলনকারীরা রাজপথকে এতটাই প্রকম্পিত করে তুলেছিলেন যে শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। সাবেক সচিব আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ওই কমিটির প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে উল্লিখিত বয়সসীমা ইতিমধ্যে ৩২ বছরে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও আন্দোলনকারীরা বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন। এখন বলুন, ওই দাবিগুলোর কোনটি শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত? আসলে এগুলোর সবই হচ্ছে পরিস্থিতিকে ব্ল্যাকমেল করে সুবিধা আদায়ের হীন কৌশল, যার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই।
সর্বশেষ পর্যায়ে আন্দোলন চলছিল ঢাকার সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে। উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে দেশে ইতিমধ্যে ১৬৩টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় শুধু বেশিই নয়, শিক্ষাকে চরম মানহীনতার দিকে ঠেলে দেওয়ার এক হীনতাপূর্ণ ব্যবস্থাও বটে। মোটকথা, দেশে এই মুহূর্তে এ-জাতীয় আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের এতটুকু কোনো প্রয়োজন নেই। তারপরও যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে দেশে আরও নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে, তাহলে সেটি তো করতে হবে যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাইপূর্বক। কিন্তু তাই বলে কলেজকে কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হবে? কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তো সম্পূর্ণ আলাদা ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন ভিন্নতর প্রতিষ্ঠান। সে ক্ষেত্রে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর একটি খুবই বড় ধরনের ভুল সিদ্ধান্ত। অতীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় সরকারের আমলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীতকরণের মাধ্যমে দেশে উচ্চশিক্ষার মানকে এতটাই নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে যে সেখান থেকে এখন বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় ব্ল্যাকমেলিং আন্দোলনের চাপে সাত কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে তা হবে আরেকটি ভুল সিদ্ধান্ত।
ওপরে যেসব দাবিদাওয়ার কথা উল্লেখ করা হলো, তার বাইরেও আরও অনেক শ্রেণিগোষ্ঠীর লোকেরা মাঝেমধ্যেই তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করে রাখছেন, যাদের মধ্যে দৈনিক বা চুক্তিভিত্তিক বা আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের রাজস্ব বাজেটের আওতায় নিয়মিতকরণের দাবি অন্যতম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ-জাতীয় নিয়মিতকরণ কতটা যৌক্তিক? অভিজ্ঞতা থেকে বলি, উল্লিখিত এসব অস্থায়ী কর্মচারীর অধিকাংশই নিয়োগ পেয়েছেন প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অথবা কোনো পদ ছাড়াই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আকাঙ্ক্ষায় কিংবা সাময়িক সময়ের জন্য খণ্ডকালীন ভিত্তিতে; এবং সেসব চাকরির শর্ত মেনে নিয়েই তাঁরা চাকরিতে যোগদান করেছেন। এমন নয় যে সরকার নিয়োগপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে তাঁদের নিয়মিতকরণ থেকে বিরত থাকছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা প্রয়োজন, সরকার তার রাজস্ব বাজেটের প্রায় ৪৩ শতাংশই বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে ব্যয় করছে, যা শুধু অযৌক্তিকই নয়, অবহনযোগ্যও। আর বেতন-ভাতার এই বিশাল বোঝা বস্তুত এ দেশের সাধারণ মানুষের করের পয়সা দিয়েই মেটাতে হচ্ছে। অতএব নিয়োগপত্রের শর্তের বাইরে গিয়ে কাউকে রাজস্ব বাজেটের আওতায় স্থানান্তর করা একেবারেই সমীচীন নয় বলে মনে করি। কিন্তু এরপরও যাঁরা এ দাবি তুলছেন, তাঁরা বস্তুত সরকারকে ব্ল্যাকমেল করে নিজেদের সুবিধা হাসিলের চেষ্টা করছেন মাত্র।
সব মিলিয়ে বলব, বিভিন্ন মহলের এসব দাবিদাওয়া পূরণ অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এই সরকার এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, খাতভিত্তিক সংস্কারকাজ এগিয়ে নেওয়া ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, যার প্রকারান্তরিক লক্ষ্য হচ্ছে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। বিভিন্ন মহল কর্তৃক রাজপথ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঘেরাও করে দাবিদাওয়া আদায়ের যেসব প্রচেষ্টা চলছে, সেগুলোর যৌক্তিকতা যাচাই করে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব বস্তুত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের। এমতাবস্থায় এখনই এসব দাবিদাওয়া তোলার মানে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা এবং সুযোগ বুঝে অহেতুক তাদের চাপে ফেলা। কারণ, এ কাজগুলোর কোনোটিই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। অন্যদিকে এসব ঘেরাওয়ের মাধ্যমে তারা যেসব জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছেন, সেগুলোও নিন্দনীয়। আর এসবের প্রকারান্তরিক প্রভাব দেশের অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অতএব আন্দোলনকারীদের প্রতি অনুরোধ, অন্তর্বর্তী সরকারকে সহায়তা করুন, যাতে তারা এমন একটি সরকার উপহার দিতে পারে, যারা এসে এ দাবিদাওয়াগুলো সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করার সুযোগ পায়।
লেখক: সাবেক পরিচালক বিসিক
আমার এক বন্ধু বহু বছর আগে দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে একটা বড় ধরনের ত্রুটি আবিষ্কার করেছিলেন। ত্রুটিটি কমবেশি সব কবি-গীতিকারই করেছেন। দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে প্রকৃতির যে বর্ণনা থাকে সেইভাবে মানুষের কথা থাকে না। যে সংগীতে আবার মানুষের কথা থাকে, তাকে গণসংগীত আখ্যা দেওয়া হয়।
৯ ঘণ্টা আগেকয়েক দিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানিয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সড়ক ও সেতু খাতে ৫১ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত কেউই দেশ ও জাতির স্বার্থের দিকটি মাথায় রেখে এক টাকার কাজকে ন
৯ ঘণ্টা আগেবাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দ হলো ময়নাতদন্ত। বিশেষ করে চিকিৎসা-আইন-আদালতের পরিভাষায় কমবেশি আমরা সবাই শব্দটির প্রয়োগ দেখতে পাই। আমরা ময়নাতদন্তের ইংরেজি পোস্টমর্টেম শব্দটির সঙ্গেও পরিচিত।
৯ ঘণ্টা আগেশুধু যেন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন না, রাজনীতিটাই পরিবর্তিত রূপে জেল্লা দেখাচ্ছে। আমরা এমন একটি অন্তর্বর্তী সরকার পেয়েছি, যেখানে উপদেষ্টাদের অধিকাংশ সরাসরি আগে রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না বরং রাজনীতির অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। সেই তাঁদের কাছেই দেশের মানুষের যত আশা, যত দাবি।
১০ ঘণ্টা আগে