দেশীয় চলচ্চিত্র নিয়ে সংস্কার আলাপ

বিধান রিবেরু
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১০: ০২
গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছিলেন দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীরা। ছবি: আজকের পত্রিকা

৩৬ জুলাই বা ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংস্কারের আহ্বান শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। সব ক্ষেত্রে। চলচ্চিত্রাঙ্গনেও এই সংস্কারের জোয়ার এসে লেগেছে। জোয়ারের আগে মূলধারার চলচ্চিত্রের লোকজন নানাভাবে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে। অভ্যুত্থান শুরুর পর তাঁদের মনে হয়েছে ভবিষ্যৎ বুঝি অন্ধকারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তাই আলো আসার প্রত্যাশায় ছিলেন। কিন্তু পট পরিবর্তনে সেই আলোর প্রত্যাশীরা বুঝতে পারলেন তাঁদের অনুমান ভুল ছিল। তবে এদের ভেতরেই কেউ কেউ যাঁরা মনে করেছেন আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে এবং যাঁরা আওয়ামীবিরোধী ছিলেন, তাঁরা গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেন, তা-ও জুলাইয়ের একেবারে অন্তিমে, বলতে গেলে ১ আগস্ট থেকে।

ওই দিন টেলিভিশন নাটক ও স্বাধীন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টরা জড়ো হন প্রথমে সংসদ ভবনের সামনে। প্রবল বৃষ্টি ও পুলিশি বাধার মুখে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে, কিছু অংশ ফার্মগেটের সিনেমা হলের সামনে এসে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ান। এ সময় শিল্প ও সংস্কৃতি অঙ্গনের আরও অনেকেই তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। পরদিন ২ আগস্ট ছিল আসলে সবার রাস্তায় বেরিয়ে পড়ার দিন। আগের দিন সহশিল্পীদের দেখে পরদিন আরও অনেক শিল্পী নেমে আসেন রাজপথে, তাঁদের সবার গন্তব্য হয় শহীদ মিনার। তো ৫ আগস্টের পর এই আন্দোলনে সক্রিয় নির্মাতা ও শিল্পীরা আওয়াজ তুলতে শুরু করেন চলচ্চিত্র সংস্কারের।

অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন সংলাপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে সবাই সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুরু করলেন। চলচ্চিত্রের অগ্রযাত্রা কেমন হবে বাংলাদেশে, তা নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ মতামত আসতে শুরু করে। প্রথম বড় আয়োজনটি হয় জুলাই জনপরিসরের উদ্যোগে, শাহবাগে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে। সেখানে ‘কালচারাল পলিটিকস: উছিলা সিনেমা’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন। এরপর থেকেই স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা, চলচ্চিত্র শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নানা আয়োজন করতে শুরু করেন।

জাতীয় চলচ্চিত্র কমিশন গঠনের লক্ষ্যে একদিকে রূপরেখা প্রণয়ন কমিটি যেমন নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক করে, তেমনি চলচ্চিত্র সংস্কার রোডম্যাপ ঘোষণা করেও শুরু হয় সবার মতামতভিত্তিক একটি রূপরেখা প্রণয়নের কাজ। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট বা বিসিটিআইয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকেও আসে ‘সংকট উত্তরণে সংস্কার প্রস্তাব’। এফডিসির ভেতরে গঠিত হয় নতুন দুটি কমিটি: বৈষম্যবিরোধী চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটি ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন ফোরাম। এর ফাঁকেই এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভার মতো আরও অনেকেই ছোট ছোট আয়োজনে জাতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। ধীরে ধীরে দেখা গেল টেলিভিশনে কর্মরত বিনোদন সাংবাদিকদের সংগঠন টেজাবও একটি সেমিনারের আয়োজন করে, যাতে মূলধারার চলচ্চিত্রের অনেকেই অংশ নেন এবং মন খুলে আলাপ করেন। এসব আলাপে চলচ্চিত্রের সব ক্ষেত্রে হয় সংস্কার, নয় পরিবর্তন নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন সংশ্লিষ্টরা। চলচ্চিত্রের জন্য ই-টিকিটিং ও বক্স অফিস দরকার, এফডিসিকে ঢেলে সাজাতে হবে, চলচ্চিত্রে অনুদানের ক্ষেত্রে দুর্নীতি করা যাবে না, একে বৃত্তি হিসেবে গুণী নির্মাতাকে দিতে হবে, শিল্পী ও কলাকুশলীদের পেশার নিশ্চয়তা দিতে হবে ইতি ও আদি।

গণ-অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি যেহেতু ছিল তরুণেরা, তাই দেখা গেল তরুণ চলচ্চিত্রকর্মীরাই ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রের সার্টিফিকেশন বোর্ড, চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি, জাতীয় চলচ্চিত্র পরামর্শক কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে লাগলেন। এমনকি তথ্য মন্ত্রণালয়ের সার্চ কমিটিতেও স্থান পেলেন তরুণেরা। তবে বিভিন্ন কমিটি আগে যেমন আমলানির্ভর থাকত, এবারও তার চিত্র পরিবর্তন হলো না। এটা নিয়ে কমিটির বাইরে থাকা অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকি এফডিসির ভেতরে যে কমিটি ও ফোরাম গঠিত হলো, সেটির কার্যক্রম নিয়ে এফডিসিকেন্দ্রিক শিল্পীরাও সন্তুষ্ট নন বলে খবর বেরোল পত্রপত্রিকায়। তবে সবার ভেতর আকাঙ্ক্ষা, নতুন কিছু হবে, পুরোনো যা পরিত্যাজ্য তা ছুড়ে ফেলে মানুষ ভালো কিছু প্রতিষ্ঠা করবে।

আমাদের অজানা নয়, দুর্নীতিরও একটি অর্থনীতি থাকে। এই দুর্নীতি যখন হঠাৎ থেমে যায়, তখন অর্থের প্রবাহে ভাটা পড়ে। কর্মহীন হয়ে পড়েন অনেকে। আবার পটপরিবর্তনের পর অনেকেই হতবিহ্বল হয়ে যান, সন্দিহান হয়ে পড়েন বিনিয়োগে। বিগত সরকারের সঙ্গে সখ্য ছিল— এমন শিল্পী ও নির্মাতারা অস্বস্তিতে পড়েন। আর যদি কারও চলচ্চিত্রে বিগত সরকারসংশ্লিষ্ট কোনো কিছু থাকে, তাহলে ওসব কাজ এমনিতেই হিমঘরে প্রবেশ করে। এমনটাই চলে আসছে আমাদের দেশে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বানানো বায়োপিক ‘মুজিব: দ্য মেকিং অব আ নেশন’ চলচ্চিত্রে দেখবেন জিয়াউর রহমান নেই। আবার বিএনপির আমলে দেখবেন শেখ মুজিবুর রহমান নেই। আর এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শাসনামলে হয়তো দুই নেতার কেউই থাকবেন না।

আমাদের চলচ্চিত্র আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চার বাইরের কিছু নয়। আমরা সব সময়ই খণ্ডিত ইতিহাস চর্চা করে আসছি। সেটার প্রতিফলন ঘটে চলচ্চিত্রের ভেতরেও। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে, তখনই তাদের খুশি করার জন্য একদল নির্মাতা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করে দেন। বিশেষ করে দলীয় সরকারের আমলে এমনটা দেখেই এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত। চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে যে তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তাতে পুরোপুরি সত্য থাকে না। অর্ধসত্য মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। নির্মোহ জায়গা থেকে ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে, স্বাধীনভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রত্যাশা মনে হচ্ছে আরও বহুকাল অধরাই রয়ে যাবে এ দেশে।

দেড় দশক ধরে স্বৈরশাসন যখন চলছিল, তখন চলচ্চিত্র অঙ্গনে একধরনের চিত্র ছিল। অনেকেই জীবন-জীবিকার তাগিদে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ও সরকারের মতাদর্শের চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এমনকি অনেক মেধাবী নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীও সরকারপ্রধানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। কিন্তু বিপত্তিটা ঘটল গণ-অভ্যুত্থানের পর, তখন মানুষের দৃষ্টিতে সেই শিল্পীরা হয়ে গেলেন স্বৈরশাসকের দোসর। এসব শিল্পীকে নিয়ে অনেকেই কাজ করছিলেন। তাঁদেরও মাঝপথে কাজ থামিয়ে দিতে হয়েছে। ছোটখাটো চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করেন, তাঁরা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন। কাজেই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে স্বৈরশাসন দূর হয়েছে বটে, কিন্তু নতুন রকমের সংকটও তৈরি হয়েছে।

চলচ্চিত্র অঙ্গনের যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা সক্রিয়, তাঁরা নানাভাবে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে, কিন্তু সেটি তো আগামী দশ বছর বা কুড়ি বছরের প্রকল্প। আজ যাঁদের ঘরে বাজার নেই, সেসব শিল্পীর কী দশা হবে? অথবা যেসব প্রকল্পের কাজ চলছিল, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী? কাজেই অভ্যুত্থান-উত্তর বিভিন্ন কমিটির সভা-সমিতি-বৈঠকে একটি বিষয়ে খুব জোর দেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা হলো এই মুহূর্তে চলচ্চিত্রের উন্নয়নের জন্য আমাদের আশু করণীয়, অর্থাৎ স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা, এর পাশাপাশি থাকতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার ভেতর আলাপ হচ্ছে শিল্পীদের কেমন করে কাজে ফেরানো যায় এবং কীভাবে অস্থিরতা কমিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। চলচ্চিত্রবিষয়ক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিভিন্ন চলচ্চিত্রবিষয়ক কমিটি থেকে আমলানির্ভরতা কমানো এবং সেখানে সংস্কৃতিজনদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং তাঁদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ ন্যস্ত করা যায়। দ্রুত সময়ের ভেতর প্রেক্ষাগৃহে ই-টিকিটিং চালু ও একটি বক্স অফিস ব্যবস্থা শুরু করা, যাতে চলচ্চিত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা করতে পারেন এবং সরকারও যেন কর থেকে বঞ্চিত না হয়। পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর মওকুফের কথাও উঠছে।

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভেতর শুরুতেই রয়েছে একটি ফিল্ম কাউন্সিল গঠন করে, তার ভেতর প্রয়োজন অনুসারে একাধিক ফিল্ম কমিশন অন্তর্ভুক্ত করা। এতে করে পুরো ইন্ডাস্ট্রিতে যে অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে, তা দূর হবে। এফডিসিকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই প্রতিষ্ঠানটিই ফিল্ম কাউন্সিলের ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে একটি চলচ্চিত্র কেন্দ্র গড়ে তোলা হলে এখানে স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতারা নিজেদের সিনেমা দেখাতে পারবেন। পাশাপাশি চলচ্চিত্র উৎসবগুলোও একটি স্থায়ী ঠিকানা পাবে।

স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদের যে পরিকল্পনা উঠে আসছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে, তা বাস্তবায়ন কিন্তু সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকেও চলচ্চিত্রকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে, তাহলেই প্রত্যাশিত পরিবর্তনের দেখা মিলবে দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে।

বিধান রিবেরু, প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত