Ajker Patrika

যুদ্ধংদেহী ক্রিকেট: খেলার মান-অপমান

অজয় দাশগুপ্ত
খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই—এসব মনভোলানো কথা এখন অচল। ছবি: এএফপি
খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই—এসব মনভোলানো কথা এখন অচল। ছবি: এএফপি

বলা হতো খেলার রাজা ক্রিকেট আর রাজার খেলা পোলো। ক্রিকেট খেলার রাজা ছিল একসময়। এখন আর আছে বলে মনে হয় না। উপমহাদেশের বাইরে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা বাদে আর কোথাও ক্রিকেট চলে না। মানুষ ক্রিকেট জানে না বোঝেও না। আমাদের এই সিডনি শহরে মাঠে হাজার হাজার দর্শক দেখে আপনি যদি মনে করেন ক্রিকেট এ দেশের এক নম্বর খেলা, তাহলে ভুল করবেন। এখনো তার অবস্থান তিন বা চার নম্বরে। ক্রিকেট এ দেশে সবার খেলা নয়। যারা বোঝে জানে বা পছন্দ করে তারা ছাড়া উন্মাদনার জন্য কেউ মাঠে ভিড় বাড়ায় না।

কথাগুলো বললাম এই কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত—এই তিন দেশে ক্রিকেট খেলা এখন যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের আগুনে টগবগ করে ফোটা মানুষগুলো ভুলে যায় তাদের নামধাম-পরিচয় বা অবস্থান। বন্ধু থেকে দুশমন, দুশমন থেকে শত্রুতে পরিণত করা খেলার দরকার কতটা? এই প্রশ্ন এখন জরুরি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষত যখন আমাদের দেশের অস্তিত্ব আর পরিচয় নিয়ে তৈরি হচ্ছে গভীর সংকট। খেলার সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক নেই—এসব মনভোলানো কথা এখন অচল। এশিয়া কাপে আমরা যা দেখলাম তার সারকথা হচ্ছে, খেলা আর খেলার জায়গায় নেই। খেলা পুরোই রাজনীতির দখলে।

ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়েরা করমর্দন করেননি। একে অপরকে আউট করার পর দেহভঙ্গি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা যুদ্ধের কথা ভোলেননি। বিমান ভূপাতিত করার ভঙ্গি আর যাই হোক পারস্পরিক ভালোবাসা বা সৌন্দর্যের কথা বলে না। সবশেষে ট্রফিও নিতে পারেনি বিজয়ী দল। তারা যেমন তা নেয়নি, যিনি দেওয়ার তিনিও সেটা নিয়ে চলে গেছেন। এত বৈরিতা কি মানুষের মনে সহজভাবে খেলা দেখার আনন্দ বজায় রাখতে পারে? না তা সম্ভব?

এখন এমন এক পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যেখানে খেলা আর খেলা নেই। আমরা জেতা খেলা বহুবার হেরেছি। আবার হারা খেলাও জিতেছি। এটাই খেলার সৌন্দর্য। তবে মানা না-মানার বিষয়টা এখন এমন স্তরে, যেখানে বিবাদ বা কলহ ছাড়া কেউ কাউকে মানছে না। না-মানার জন্য মিডিয়া, আচরণ আর পরিবেশ দায়ী। সামাজিক মিডিয়া এখন এমন এক ভূমিকায়, যেখানে তার নিয়ন্ত্রণ জরুরি হলেও সেটা সম্ভবপর হচ্ছে না। কী হচ্ছে এখানে? দেশে-দেশে জাতিতে-জাতিতে এত বিবাদ বা কলহের কারণ কিন্তু আগেও ছিল। সেটা উসকে দেওয়ার মিডিয়া বা মাধ্যম ছিল না তখন। যার যা খুশি বলতে পারা বা লিখতে পারার মুশকিল এখন প্রকাশ্য।

আগে বলি আমি নিজে ক্রিকেটপাগল মানুষ। একসময় ক্রিকেট খেলা এবং দেখা দুটোই ছিল পছন্দের শীর্ষে। তখন এই খেলাটি ছিল ক্লাসিক। বলছি না এখন নেই, কিন্তু জৌলুশ বাড়লেও তার সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে নানাভাবে। পাঁচ দিনের ক্রিকেট ক্লান্তিকর ছিল বৈকি। সে ক্লান্তির ভেতর যে নিয়মানুবর্তিতা বা ধৈর্য, সেটা উধাও এখন। যে খেলোয়াড় পাঁচ দিন মাঠে থাকেন বা খেলেন, তাঁর জীবনে কিছু নিয়ম এমনিতেই কাজ করতে শুরু করে। তিনি জানেন কীভাবে সবুর করতে হয়। এরপর ক্রিকেটে ওয়ানডের শুরু। সেটাও মন্দ না। একটা খেলায় জয়-পরাজয় থাকা জরুরি। তা না হলে মানুষ খেলা দেখতে যাবে কী কারণে? সেটা ফিরিয়ে এনেছিল ওয়ানডে। ওয়ানডেতে এখনো শিল্প বা কৌশল কাজ করে। কিন্তু বাণিজ্য বা করপোরেট সেখানেও আঘাত হানল। তার মনে হলো মানুষকে আরও একটু পাগলাটে করে তোলা দরকার। তাদের ভেতর আরও জোশ আরও উত্তেজনা মানেই আরও টিকিট বিক্রি। আরও উপার্জন। আরও বিজ্ঞাপন, আরও স্পনসর, আরও জুয়া। তার হাত ধরে এল টি-টোয়েন্টি। যখন থেকে এই খেলার শুরু তখন থেকে কেউ আর ব্যাট হাতে দৃষ্টিনন্দন ভঙ্গিতে মাঠে নামেন না। যেমন ধরুন এম এস ধোনি। তাঁকে আমার কখনো ভালো লাগেনি। শুরু থেকেই মনে হতো যুদ্ধ করতে নামছেন। আর ভঙ্গিও মারাত্মক। কী দেখলাম আমরা? যেকোনো উপায়ে একটি বলকে মাঠ টপকে বাইরে পাঠানোই যেন খেলা। সেটা ভালোভাবে শিল্প মানে পাঠানো হোক বা গায়ের জোরে মারা হোক। শচীন-লারাদের সেসব ধ্রুপদি শটগুলো হারিয়ে গাভাস্কারের মতো বড় খেলোয়াড়ও বলতে শুরু করলেন এর নাম হেলিকপ্টার শট।

পচে যাওয়ার আর কী বাকি আছে? বলছিলাম আমাদের খেলার কথা। প্রতিবার খেলার আগে আমরা দেশপ্রেমের নামে যেভাবে জেগে উঠি তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই জেগে ওঠাটা কি সব কাজে সবকিছুতে হতে পারে না? দেশপ্রেম মানে কি ক্রিকেটে জিতে আসা? যে খেলা আমাদের হিন্দু-মুসলিম, বাঙালি-ভারতীয়-পাকিস্তানিতে বিভক্ত করে, তার জন্য জান দেওয়া মানুষ ভুলে যায় সমাজে কত অনাচার আর কত ধরনের অনিয়ম।

বাংলাদেশের সমাজ আর জনজীবনে এমনিতেই সমস্যার অন্ত নেই। একনায়কতান্ত্রিকতার অবসানের পর যে শান্তি আর শৃঙ্খলা ফিরে আসার কথা, তা আসেনি। ভালোয় ভালোয় শারদীয় উৎসব শেষ হওয়ায় মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। কিন্তু এই ক্রিকেট যে এখন বিষফোড়া, সেটা ভুললেও চলবে না। এশিয়া কাপে জয়-পরাজয়ের আনন্দ ম্লান করে দিয়েছে ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি। প্রশ্নটা খুব সহজ, বাংলাদেশের বাঙালি প্রায় ৮০ বছর পরও এই দুই দেশের কথা ভুলতে পারল না কেন? কেন তাদের নামে তারুণ্যের এই উন্মাদনা?

খেলাধুলা মানসিক ও শারীরিক বিকাশের অংশ—এসব যাঁরা বলতেন, তাঁদের জমানা শেষ। এগুলো এখন কথার কথা। মূলত খেলাই হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পারস্পরিক বৈরিতা দেখানোর প্ল্যাটফর্ম। এ কথা ভুললে চলবে না উপমহাদেশের ক্রিকেট এখন মৈত্রীর পরিবর্তে বিভেদের হাতিয়ার হয়ে উঠতে চাইছে। যে অপস্রোতে কর্তা নামে পরিচিত বিশেষজ্ঞরাও পথ হারাচ্ছেন।

উপায় কি ক্রিকেট বন্ধ করে দেওয়া? উত্তর হবে—না। বরং যে ম্যাচ বা যে খেলা যুদ্ধের আবহ তৈরি করে, তাকে প্রশমিত করা, তার যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করাই হবে কাজের কাজ। সেটা মিডিয়া পারে, পারে সুশীল সমাজ, পারে ক্রিকেট বোদ্ধা আর সমর্থকেরা। তাঁরা যদি সস্তা জনপ্রিয়তা আর ব্যবসার লোভে যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব চালু রাখতে চান, তাহলে ক্রিকেট খেলার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে। একসময় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবে। খেলার রাজা ক্রিকেটের মান-অপমান সমঝে চলার সময় এসে গেছে। মানুষকে ভালো থাকতে দিন। উপভোগ করতে দিন। এর বাইরে বাকি সবই বানোয়াট।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আশরাফুলের লাশ ঘরে রেখেই শারীরিক সম্পর্ক করেন জরেজ ও শামীমা: র‍্যাব

বিহারে ইতিহাস গড়ে বিজেপি জোটের বিপুল জয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও মহাজোটের ভরাডুবি

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, গাংনীতে তোলপাড়

শেরপুর-২ আসনে এনসিপির মনোনয়নপত্র নিলেন জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ

পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রচার, আরএমপি কমিশনারকে আদালতে তলব

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

দ্বিমতের অবসান কিংবা ঐকমত্যের সোনার হরিণ

অরুণ কর্মকার
রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকেছে। ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকেছে। ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উদ্যোগ ও পদক্ষেপই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বিমতের অবসান ঘটাতে পারল না। জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলো একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবে মাঠে নেমেছিল। তারা ঐক্যবদ্ধ শক্তি হিসেবেই অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থেকে গণতন্ত্রের নতুন পথ তৈরির যুগপৎ ঘোষণা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। এরপর তারাই পর্যায়ক্রমে নিজেদের মধ্যে দ্বিমতের এক অমোচনীয় দূরত্ব সৃষ্টি করল। অবশ্য তাদের কারও কারও দাবি অনুযায়ী, এই দূরত্ব ও দ্বিমত সৃষ্টির জন্য দায়ী অন্তর্বর্তী সরকার। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণের মধ্যেও তারা সেই দায়ের উপাদান দেখেছে। ফলে দ্বিমতের অবসান যেমন হলো না, তেমনি ঐকমত্য কমিশন গঠন করে দীর্ঘদিনের অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ার যে উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নিয়েছিল, তা-ও অধরা এক সোনার হরিণ হয়েই রইল।

বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ দেওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষরের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরে সেটি গেজেট আকারেও প্রকাশিত হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়টি ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর মৌলিক দাবিগুলোর একটি। কিন্তু সেটি যখন আইনানুগভাবে সম্পন্ন হলো, তখন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাকে অভিহিত করল জাতির দুর্ভাগ্য বলে। কারণ, সেটি আইনি ভিত্তি পেয়েছে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে। তাদের দাবি ছিল, আদেশটি জারি করতে হবে প্রধান উপদেষ্টাকে।

কিন্তু তা যে সম্ভব নয়, সেটা তারা বুঝতে চায়নি জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটে। যদিও এখন সে কথা বলে কোনো লাভ নেই। জুলাই অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন থেকে শুরু করে সবই তো হয়েছে দেশের বিদ্যমান সংবিধান অনুসারে। সুতরাং এনসিপি যা চায় তা পেতে হলে তাদেরকে আরেকটি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করতে হবে, যা দেশে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাবে। এটা না হওয়া পর্যন্ত তাদের সব সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংসদ, সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন প্রভৃতির মধ্য দিয়ে গিয়ে সাংবিধানিক সংস্কারের পথেই হাঁটতে হবে। জনগণের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ছাড়া এর অন্যথা হওয়ার নয়।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের বিষয়ে এনসিপি অবশ্য আর কোনো মৌলিক প্রশ্ন তোলেনি। তবে জুলাই অভ্যুত্থানের অপর দুই নিয়ামক শক্তি বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী তুলেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নিজের সই করা জুলাই জাতীয় সনদ লঙ্ঘন করেছেন। তবে রাতে সে জায়গা থেকে সরে গিয়ে এটাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। গত ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে জুলাই জাতীয় সনদ প্রধান উপদেষ্টা নিজে স্বাক্ষর করেছেন, সেটা তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে লঙ্ঘন করেছেন। কীভাবে? প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, জাতির সামনে তা উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে ১৮০ দিনের মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করবেন। সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

সালাহউদ্দিন আহমদের আপত্তি এখানেই। তিনি বলেন, জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষে পিআর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ‘নোট অব ডিসেন্টের’ মাধ্যমে মীমাংসিত। এটি নতুন করে আরোপ করার কোনো সুযোগ নেই (যা প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে করেছেন)। এ ছাড়া ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’ নামে যে বডি, সেটি জাতীয় সংসদের কোনো পর্যায়ে গঠনের বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার বিষয়ই ছিল না। এটা সম্পূর্ণ নতুন ধারণা। এই পর্যায়ে এসে বিএনপি এই নতুন ধারণাটিকে কীভাবে দেখবে, সেটা অবশ্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। সেটি জানা বা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার অভিযোগ করেছেন, জনগণের অভিপ্রায় ও গণদাবিকে উপেক্ষা করে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোটের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণায় জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। সংবিধান সংস্কার এবং অন্যান্য সংস্কার বিষয়ে যে ৪৮টি প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, সেগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতিকে জানাতে হবে। গণভোটে জনগণকে কিসে ‘হ্যাঁ’ আর কিসে ‘না’ বলতে হবে, সেটি নির্বাচনের আগেই জানতে হবে উল্লেখ করে মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ভোটারদের গণভোটের বিষয়ে স্টাডি করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে গণভোটের বিষয়ে বিস্তারিত ওয়েবসাইটে দিতে হবে। ভোটাররা সেই বিষয়ে জানার পরই গণভোটে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ মতামত দেবেন। কিন্তু একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট হলে একজন ভোটারকে গণভোট দিতে হবে আবার প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনের ভোটও দিতে হবে। সেই সুযোগ না দিয়ে দুটি ভোট একসঙ্গে দেওয়ার ঘোষণায় একটা সংকট তৈরি হলো। এই সংকট নিরসনের জন্যই জামায়াতসহ আটটি রাজনৈতিক দল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেওয়ার যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, তা অব্যাহত রাখা হবে বলেও জানানো হয়। এর অর্থ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার দ্বিমত ও অনৈক্যের বিন্দুমাত্রও নিরসন হওয়ার লক্ষণ নেই।

গণভোটে চারটি বিষয়, প্রশ্ন একটি!

এদিকে, গণভোটে প্রশ্ন-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে জনপরিসরে যে আলোচনা চলছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে তারও নিরসন হয়নি। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছেন, চারটি বিষয়ে অনুষ্ঠিত হবে গণভোট। গণভোটের দিন এই চারটি বিষয়ের ওপর একটিমাত্র প্রশ্নে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জনগণ মতামত জানাবেন। চারটি বিষয়ে একটি প্রশ্নে হ্যাঁ কিংবা না বলতে হবে, বিষয়টা ভাবতেই কেমন যেন বেখাপ্পা লাগছে। তো কী হবে সেই চারটি বিষয় ও একমাত্র প্রশ্নটি! প্রধান উপদেষ্টা নিম্নোক্তভাবে তা পাঠ করে শুনিয়েছেন।

‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?

ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।

খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।

গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধি বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে যে ৩০টি প্রস্তাবে জুলাই জাতীয় সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দলগুলো বাধ্য থাকবে।

ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।

এই চারটির প্রথম বিষয়টি ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় মীমাংসা হয়েছে। কিন্তু অন্য তিনটি বিষয়ের মধ্যে তো ৩০টির বেশি বিষয় রয়েছে! কাজেই এ বিষয়ে হ্যাঁ কিংবা না বলতে হলে বিষয়গুলো ভোটারদের জানতে হবে, যা শিক্ষাগত যোগ্যতার বিবেচনায়ও অসম্ভবই বটে। তা ছাড়া, এগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতিবাচকতা প্রবল। সুতরাং ফলাফল অজ্ঞাত।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আশরাফুলের লাশ ঘরে রেখেই শারীরিক সম্পর্ক করেন জরেজ ও শামীমা: র‍্যাব

বিহারে ইতিহাস গড়ে বিজেপি জোটের বিপুল জয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও মহাজোটের ভরাডুবি

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, গাংনীতে তোলপাড়

শেরপুর-২ আসনে এনসিপির মনোনয়নপত্র নিলেন জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ

পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রচার, আরএমপি কমিশনারকে আদালতে তলব

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

হাসান আজিজুল হকের শৈল্পিক মর্যাদাবোধ

সৌভিক রেজা
হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১)
হাসান আজিজুল হক (২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-১৫ নভেম্বর ২০২১)

হাসান আজিজুল হক প্রয়াত হয়েছেন খুব বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। কিন্তু এরই মধ্যে টের পাওয়া যায় যে তাঁকে নিয়ে পাঠকদের, বিশেষভাবে তরুণ পাঠকদের আগ্রহের টানে বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছে। কারণগুলো খুব যে অযৌক্তিক, সেটা বলাও আমাদের উদ্দেশ্য নয়। সবকিছু মেনে নিয়েও লেখক হাসান আজিজুল হকের শৈল্পিক সামর্থ্যের দিকটিকে তো আমরা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারি না। বাংলাদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস হাসান আজিজুল হকদের বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়, সে চেষ্টা যেন কখনো আমাদের না করতে হয়! কেননা, আমাদের সেই হাসান, যিনি তাঁর লেখক-জীবনের একেবারে শুরু থেকে এমন কোনো মুহূর্ত যায়নি যখন তিনি দেশের সর্বজনকে নিয়ে ভাবেননি, তাদের দুঃখ-দুর্দশায় বিচলিত বোধ করেননি।

২.

সাহিত্যের জগতে লেখকদের প্রবল প্রতাপের পাশাপাশি তাঁদের প্রস্তুতির নানা কথাও আমরা শুনতে পাই। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য-পরিক্রমায় যেকোনো নিবিষ্ট পাঠকই এটি উপলব্ধি করতে পারবেন যে, আমাদের সাহিত্যে এতটা প্রস্তুতি নিয়ে হাসানের মতো খুব বেশি লেখক আসেননি। অনেকেরই কাছে এটি নিছক আবেগে ভর দিয়ে বলা কথা মনে হতে পারে। কিন্তু দার্শনিক রুশো প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম আমাদের জানিয়েছেন, ‘মানুষের আবেগকে যুক্তি দিয়ে সব সময় বোঝা যায় না। আবেগকে বুঝতে আবেগের গভীরে যেতে হয়।’ হাসানের শৈল্পিক সামর্থ্যের কথা আমরা বলেছি। কী বোঝায় এই কথা দিয়ে? একজন লেখকের শৈল্পিক সামর্থ্য বিচারের মাপকাঠিইবা কী? চেখভ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, এই লেখক সারা জীবন একধরনের সংগ্রাম করে গেলেন। কিসের সংগ্রাম? শৈল্পিক জীবনযাপনের জন্য সংগ্রাম।

হাসানের সংগ্রাম ঠিক সেই শিল্পিত জীবনের পক্ষে আর কদর্যতার বিরুদ্ধেই। সাধারণ মানুষের জীবন-ধারণ, তাদের সংগ্রামের পরাজয়, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, হতাশা—এসব নিয়েই হাসানের সাহিত্যের জগৎ নির্মিত হয়েছে। প্রবলভাবে রাজনীতিসচেতন ছিলেন হাসান, তিনি একই সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সত্তাকে সার্থকভাবে মিলিয়ে দিতে পারতেন তাঁর শৈল্পিক সত্তার সঙ্গে। জীবনের এই দিকটাতে হাসান কখনোই আপস করেননি। করেননি তার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই যে, হাসান চেতনার গভীর থেকেই মনে করতেন, শিল্পের প্রধান কাজ হচ্ছে পাঠকগোষ্ঠীকে নানাভাবে ‘প্রভাবিত করা, আঘাত করা’ এবং ‘কোনো সমগ্রতায়’ পাঠককে পৌঁছে দেওয়া। এর পাশাপাশি তাকে শৈল্পিক ‘সত্যের বিচ্ছুরণ দেখিয়ে দেওয়া’। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, ‘শিল্পকলা শিল্পিতকে ডিঙিয়ে আপনার স্বাতন্ত্র্যকেই মুখ্য করে তোলে। কেননা, তার মধ্যেও আছে সৃষ্টির প্রেরণা।’ সেইসব উপলব্ধিকে হাসান কখনোই অস্বীকার করেননি।

৩.

বুদ্ধদেব বসু তাঁর একটি প্রবন্ধে অকপটে স্বীকার করেছিলেন, ‘যৌবনে...মানুষের যত রকম অবস্থা আছে, তার মধ্যে নিঃসঙ্গতাকেই তখন সবচেয়ে বেশি ভয় পেতুম।’ তাঁর মতে, ‘শুধু সঙ্গীহীনতাকেই নিঃসঙ্গতা বলে না, মনকে নিবিষ্ট করার উপায়ের অভাবকেই বলে নিঃসঙ্গতা।’ হাসান আজিজুল হকও আরও অনেকেরই মতো এই নিঃসঙ্গতাকে সম্ভবত ভয় পেতেন। সব সময়ই জনমানুষের মধ্যে থাকতে চাইতেন। এইভাবেই হয়তো জীবনের উত্তাপ সংগ্রহ করে নিতেন, গুরুত্ব দিয়েছিলেন সমকালকেও। কেননা, তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে হাসানের মনে হয়েছে, ‘সমকালের জন্যে কোনো মায়া বা স্বপ্ন রচনা করা কথাসাহিত্যের একটা কাজ হতে পারে। তবে দূর অতীত কিংবা দূর ভবিষ্যৎকে নিয়ে স্বপ্ন তৈরি করা যতটা সহজ, বর্তমানকে নিয়ে ততটা নয়। কারণ, বর্তমান তিক্ত এবং সাধারণত বর্ণহীন।’ সেই তিক্ত এবং বর্ণহীন বর্তমানের ওপর ভর দিয়েই হাসান তাঁর কথাসাহিত্যের জগৎটাকে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। নিশ্চিতভাবেই একটানা পরিশ্রম এবং কষ্টের কাজ ছিল এটি; কিন্তু সাহিত্যিকের কর্তব্য তো সেই কঠিনকেই শিল্পের অবয়ব দেওয়া, যা হাসানের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। এখানেই হাসান আজিজুল হকের সামর্থ্যের চিহ্ন, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করবার উপায় থাকে না। তাঁর ‘সাক্ষাৎকার’ গল্পের শেষাংশে এসে চরিত্রের স্বগতোক্তি আমাদের পাঠ করতে হয়—‘মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষের কাছে প্রার্থনা জানাইব—কারণ মানুষেই মানুষের গা ঘেঁসিয়া থাকে—যদিও ঐ দেখা যায় না।’ এখানেই কথাগুলো শেষ হতে পারত, কিন্তু হয় না।

আইনস্টাইন শুধুই একজন বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, সেই সঙ্গে একজন মানুষ হিসেবেও ‘ইতিহাসের অভিজ্ঞতা, সৌন্দর্য এবং ঐক্যের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে যেসব আদর্শের জন্ম হয়েছে’, তাতে আস্থা রাখতেন। লেখক হিসেবে হাসান আজিজুল হককে সেই আস্থায় পরিণত হতে দেখতে পাওয়া যায়। যে কারণে তাঁর ওই গল্পের চরিত্র একদম শেষ বাক্যে এসে বলেছিলেন, ‘কোথাও কিছু পাই নাই বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সবকিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছুই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।’ একজন লেখক তাঁর কাহিনির নবায়নে শিল্পিত ব্যাপ্তিতে কতটা দক্ষ হয়ে উঠতে পারেন, সেটি হাসান আজিজুল হক আমাদের দেখিয়ে দিলেন! তাঁর কথাসাহিত্যের মানুষদের তিনি সব সময়ই এই মর্যাদাবোধে, সহিষ্ণুতায়, ভালোবাসায় আমৃত্যু অভিসিঞ্চিত করে গিয়েছেন। ১৫ নভেম্বর হাসান আজিজুল হকের প্রয়াণ দিবস। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আশরাফুলের লাশ ঘরে রেখেই শারীরিক সম্পর্ক করেন জরেজ ও শামীমা: র‍্যাব

বিহারে ইতিহাস গড়ে বিজেপি জোটের বিপুল জয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও মহাজোটের ভরাডুবি

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, গাংনীতে তোলপাড়

শেরপুর-২ আসনে এনসিপির মনোনয়নপত্র নিলেন জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ

পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রচার, আরএমপি কমিশনারকে আদালতে তলব

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

শিক্ষকদের আন্দোলন ও কিছু প্রসঙ্গ

মামুনুর রশীদ
শিক্ষাগুরুদের আন্দোলন দমন করতে পুলিশকেও সক্রিয় হতে দেখা গেছে।
শিক্ষাগুরুদের আন্দোলন দমন করতে পুলিশকেও সক্রিয় হতে দেখা গেছে।

সম্প্রতি শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে ঢাকার রাজপথে শিক্ষকদের দুর্বার আন্দোলন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। শত শত ছাত্রের শিক্ষাগুরুদের আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশকেও সক্রিয় হতে দেখা গেছে। আন্দোলনটি বেতন-ভাতা ও সম্মানের জন্য। মূলত বেতন-ভাতাটিই মুখ্য। আমরা যাঁরা গত শতাব্দীর পঞ্চাশ এবং ষাট দশকের ছাত্র, তাঁরা দেখেছি অধিকাংশ শিক্ষক এক অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে এই মহান কাজটির সঙ্গে যুক্ত আছেন। সেই সময়ই আমাদের পাঠ্যপুস্তকে তালেব মাস্টার কবিতাটি পড়তে হতো।

প্রাথমিকের কিছু স্কুল সরকারীকরণ হলেও সেসবের বেতন হতো অনিয়মিত। অনেক দিন পর পর বেতন পেতেন শিক্ষকেরা। কিন্তু শিক্ষকদের সম্মান ছিল। একধরনের ব্রত নিয়ে তাঁরা কাজ করতেন। আবার কিছু মানুষ সম্পন্ন পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেও এই পেশায় আসতেন। কিন্তু শিক্ষক তাঁর কর্তব্যে অবহেলা করতেন না, শিক্ষাকে যতটা সম্ভব আনন্দময় করার চেষ্টা করতেন। সমাজের ন্যায়-অন্যায়ের পাহারাদারও ছিলেন তাঁরা।

কালক্রমে যখন অর্থই সামাজিক মর্যাদার মানদণ্ড হয়ে দাঁড়াল, তখন থেকেই শিক্ষকের সম্মানেও ভাটা পড়ল। সরকারি অফিসের পিয়ন এবং শিক্ষকের বেতন একই স্কেলে এসে পড়ল। এই অপমান নিয়েও তাঁরা কাজ করে গেছেন। কোনো এক আমলা-মন্ত্রীর সদিচ্ছায় বেতন-ভাতা একটু বাড়ল। উচ্চশিক্ষিত তরুণদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসার জন্য একটু চেষ্টা-চরিত্রও হলো। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনে একটা আমলাতন্ত্রও চাপিয়ে দেওয়া হলো, যেখানে শিক্ষকেরা নেই। থানা থেকে জেলা পর্যন্ত সরকারি নিয়োগের মাধ্যমে কিছু কর্মকর্তা নিয়োগ করা হলো, যাঁরা কখনোই শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।

অবমাননাকর এই ব্যবস্থা শিক্ষকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি প্রবলভাবে ঢুকে যাওয়ার কারণও এটি। রাজনৈতিক দলের সদস্যরাও এই ব্যবস্থায় স্কুল ম্যানেজমেন্টে একটা স্থায়ী আসন পেয়ে গেলেন। আমাদের শাসকগোষ্ঠী শিক্ষার বিষয়ে কখনো মনোযোগী ছিল না। মেধাবী ছাত্রদের প্রাথমিক শিক্ষায় আকর্ষণ করার কোনো চেষ্টাই করেনি। শিক্ষার বিষয়ে সব মনোযোগ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক, যেখান থেকে কলেজ পর্যন্ত তার বিস্তৃতি। দলীয় রাজনীতির বৃত্তে নিয়ে আসার এক মরণপণ সংগ্রাম সেখানে। অথচ কিছু শিক্ষাবিদ (!) যাঁরা সরকার কর্তৃক মনোনীত দলীয় আনুগত্যের কারণেই তাঁরা নিয়োগ পান। তাঁদের তৈরি সিলেবাসও পাঠ্যক্রমে যুক্ত হয়। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনও সেখানে অবহেলিত। ক্ষতবিক্ষত সংবিধানের মতোই পাঠ্যক্রমও রাজনৈতিক দলের অভিলাষেই নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শিক্ষকদের মধ্যেও একটা রাজনৈতিক মেরুকরণ হতে থাকে।

আমি আজ থেকে ৪০ বছর আগে জাপানে গিয়েছিলাম। সেখানে প্রাথমিক স্কুলগুলো দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। লেখাপড়ার মধ্যে সৃজনশীল মাধ্যম যেমন সংগীত, কাব্য, নাটক, ছবি আঁকা—এসব ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞানের কঠিন সূত্রগুলোও সৃজনশীল মাধ্যমের দ্বারা বোঝানো হয়। স্কুলগুলোতে নিয়মিত ক্রীড়ার অনুশীলনও হয়ে থাকে। শিক্ষকেরা সম্মানজনক বেতন-ভাতা ও পদোন্নতি পেয়ে থাকেন এবং সব সময় শিক্ষাবিষয়ক সব সিদ্ধান্ত শিক্ষকেরাই নিয়ে থাকেন।

তার আগে এবং পরেও অনেক দেশের স্কুলগুলোতেও অনুরূপ ব্যবস্থা দেখেছি। আমাদের দেশেও প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে একই রকমভাবে সৃজনশীল মাধ্যমগুলো ব্যবহারের জন্য পিটিআই বা টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ব্যবস্থা থাকলেও মাঠপর্যায়ে এসবের ব্যবহার কোনো কার্যকর অবস্থায় যেতে পারেনি। জাপান থেকে ফিরে এসে এই ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে বিভিন্ন দুয়ারে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ইউনিসেফ সাড়া দিল, তা-ও একজন বড় কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। প্রাইমারি অধিদপ্তরের সঙ্গে ইউনিসেফ এই প্রকল্পটি গ্রহণ করে। ৬৪ জেলায় কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষণটি দেওয়া হয়। প্রাথমিক শিক্ষক এবং সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রহণ সেখানে নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে বিষয়টি উত্থাপিত করা হয়নি। কিছু আর্থিক বিষয় ছিল বলে দুর্নীতিও ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে ঢুকে গেছে নানা স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা। ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়; ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা এবং আরও একধরনের শিক্ষা হয়ে থাকল ক্যাডেট কলেজ। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেই একধরনের পশ্চিমা আমলের শ্রেণিবিন্যাস করা হলো। কিন্তু কোটি কোটি শিক্ষার্থী শিক্ষার প্রবেশদ্বারেই থেকে গেল অবহেলিত।

প্রাথমিক শিক্ষায় উন্নত দেশে নারী শিক্ষকদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন এবং সে ব্যবস্থাও সেখানে আছে। আর এরই মধ্যে শিক্ষায় অভিশাপ হিসেবে এসেছে কোচিং। অল্পবিত্তের মানুষের সন্তানসন্ততিদের যতই মেধা থাকুক না কেন, তাদের স্বপ্ন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার ব্যবস্থা। স্কুলে লেখাপড়া হচ্ছে না, কোচিং সেন্টারে রমরমা ব্যবসার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক আছেন, যাঁরা এই ব্যবস্থায় পা দেননি, কিন্তু তাঁরা একঘরে।

শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতেই হবে এবং সরকারি শ্রেণিবিন্যাসের একটা জায়গায় নিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। ব্যবস্থাটাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষকতা মানে একটা চাকরি শুধু নয়, একটা মহান পেশার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার কাজটিও তাঁদের করতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিভাবক, ভালো শিক্ষক, জনগণ, এমনকি ছাত্রদেরও অনেক অভিযোগের পাহাড় জমেছে। দেশের বিদ্যমান অপরাজনীতির অংশ হিসেবে শিক্ষকেরাও যেন ব্যবহৃত না হন, সে ব্যাপারেও সচেতন থাকা জরুরি। শাসকগোষ্ঠী এবং সচেতন জনগণকেও বিষয়টি এক বড় সমস্যা হিসেবে দেখা প্রয়োজন।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আশরাফুলের লাশ ঘরে রেখেই শারীরিক সম্পর্ক করেন জরেজ ও শামীমা: র‍্যাব

বিহারে ইতিহাস গড়ে বিজেপি জোটের বিপুল জয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও মহাজোটের ভরাডুবি

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, গাংনীতে তোলপাড়

শেরপুর-২ আসনে এনসিপির মনোনয়নপত্র নিলেন জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ

পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রচার, আরএমপি কমিশনারকে আদালতে তলব

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত

বেকার আলাপে গড্ডলিকা প্রবাহ

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি।

বিধান রিবেরু
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।
ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশে ঘটনার তো শেষ নেই! খোদ রাজধানীর ভেতরে এক মাসের ব্যবধানে তেজগাঁও ও কাকরাইলে দুটি গির্জায় ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হলো, মোহাম্মদপুরে মিশনারি বিদ্যালয় সেন্ট যোসেফ স্কুলে বোমা মারা হলো, কিন্তু এগুলোর পেছনে কারা রয়েছে, কারা হামলা চালাল, সেটার সুরাহা প্রশাসন তো করতে পারেইনি, বিষয়গুলো নিয়ে সরকারে থাকা দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে উদ্বেগও প্রকাশ করতে দেখিনি। অথচ অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকেই দেখি ফেসবুকে নানা বিষয়ে অনর্থক, অত্যন্ত কুরুচিকর, আজেবাজে পোস্ট দিয়ে যাচ্ছেন, যেটা তাঁদের পদ ও মর্যাদার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটাই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে কাদা ছোড়াছুড়ির সংস্কৃতি। আর সেখানে ফেসবুক ও ইউটিউব হয়ে দাঁড়িয়েছে সেসব করার ও দেখার এক উৎকৃষ্ট মঞ্চ।

কোনো রাষ্ট্রে যখন দায়িত্বশীল লোকজনের কাছ থেকে অত্যন্ত হালকা ও নিম্নস্তরের পোস্ট উৎপাদন করা হয়, তখন তার সমর্থনে কিংবা বিপক্ষে একদল মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। অনেকে বুঝে, অনেকে না বুঝে সেসব ঠুনকো পোস্ট নিয়ে তর্কবিতর্ক জুড়ে দেয়। এটা যেন রুটি ছুড়ে দিয়ে সারমেয়দের ব্যতিব্যস্ত করে দেওয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে দামি লোকদের সস্তা পোস্ট নিয়ে এই যে অগভীর ও চিন্তাহীন কথাবার্তার প্লাবন শুরু হয়, এটাকে বলা যায় ‘অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা’, অথবা জনগণের অলস মস্তিষ্ককে শয়তানের কারখানায় পরিণত করা। জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার হলে বলতেন ‘আইডল টক’, জার্মান ভাষায় ‘গেরিদা’। তো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বেকার আলাপ ছুড়ে দিয়ে, তাতে ব্যস্ত করে দিয়ে গোটা জাতিকে যে গড্ডলে পরিণত করা হয়, সে সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবগত। কারণ, গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে নিজের আর কষ্ট করে সাঁতার কাটতে হয় না। স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার কাটতে সাহস ও প্রস্তুতি প্রয়োজন। কিন্তু অনুকূলে সাঁতার কেটে, অন্য গড্ডলদের সঙ্গে মিলেমিশে অজস্র সব আবর্জনা উৎপাদন করা সহজতর কাজ। মুশকিল হলো, এসব আবর্জনা কোন ডাস্টবিনে ফেলা হবে, সেটাই মানুষ বুঝতে পারছে না। আবর্জনার স্তূপের কারণে সজীব ও সুস্থ চারা গাছ যেমন জন্মাতে পারে না, তেমনি বেকার আলাপের তোড়ে গভীর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাও জন্ম নিতে পারছে না। ফলে সমাজে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সবাই অশ্বডিম্ব প্রসব করে চলেছে। কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—সব নিম্নগামী হতে হতে পাতালে প্রবেশ করেছে।

আমরা প্রথমে ধীরে ধীরে একটি চিন্তাহীন, অসংবেদনশীল ও উগ্র সমাজ তৈরি করেছি। এরপর তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার আয়োজন করে, বিদেশিদের দাওয়াত দিয়ে কাঁঠাল খাওয়াচ্ছি। মাথার ওপর যে বিরাট মেজবানি খাওয়াদাওয়া চলছে, সেটা আমরা টের পাচ্ছি না, কারণ আমরা এরই ভেতর গড্ডলে পরিণত হয়েছি। তার ওপর বিচরণক্ষেত্র হিসেবে দেওয়া হয়েছে ফেসবুক কিংবা ইউটিউবকে। সেখানে দেখবেন রাতদিন ভিউ-ব্যবসায়ীরা বনে যাচ্ছেন ইতিহাসবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ইতি ও আদি। অবশ্য এই ভিড়ের ভেতর যে দু-একজন প্রকৃত যোগ্য লোক নেই, তা নয়। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে দেখা যায়, ছদ্মবেশী ভিউ-ব্যবসায়ীরা উল্টাপাল্টা বেকার আলাপ করছেন এবং সেসব নিয়ে ফেসবুক গরম করে ফেলছে দেশের মানুষ।

অবশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থাকাতে একটি উপকারও হয়েছে। এর মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে আসলে কারা অলস বা বেকার আলাপ পছন্দ করে, কাদের চিন্তা অস্বচ্ছ কিংবা কাদের ভাবনা কতটা নোংরা। যেমন সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়ে হামলার কথা জানিয়ে প্রতিবাদ প্রকাশ করলে, উল্টো বলা হয়, উন্নত দেশে নাগরিকত্ব পাওয়ার ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। এদের ভাবখানা এমন যে উন্নত দেশগুলো গন্ডায় গন্ডায় লোক নেওয়ার জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। কেউ একজন সংখ্যালঘু কার্ড টেবিলে ফেললেই ওনারা তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাবে! আর সংখ্যালঘুদের এ দেশ থেকে তাড়াতে পারলে ওই বিশেষ শ্রেণি যেন বিশেষ আরাম পায়। এর পেছনে জমিজমা হাতিয়ে নেওয়ার অচেতন ভাবনা যে নেই, সেটি হলফ করে বলা যায় না।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ থেকে ধীরে ধীরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমছে কেন? এই প্রশ্ন করার বদলে উল্টো বলা হয়, সংখ্যালঘুরা নাকি এ দেশকে নিজেদের দেশ মনে করে না। এ ধরনের অত্যন্ত আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ কথা সমাজে প্রচলিত আছে। এবং এসব চিন্তার খরিদ্দার শুধু অল্পশিক্ষিত মানুষ নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা পর্যন্ত এসব চিন্তা পোষণ করেন এবং সেই মোতাবেক সাম্প্রদায়িক আচরণ করেন। অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে গেলে প্রাত্যহিক চর্চার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এই চর্চা সমাজের শিক্ষিত অংশটি শুরু করবে এবং সবার মাঝে ছড়িয়ে দেবে, সেটাই প্রত্যাশিত, কিন্তু আমরা তা হতে দেখছি না।

শুরুতে যে হামলার ঘটনার কথা বললাম, সেগুলো নিয়ে গণমাধ্যমগুলোও উদাসীন থেকেছে। তারাও একে গুরুত্ব দিতে নারাজ। গণমাধ্যমেও সংখ্যালঘুর প্রতি সামাজিক মনোভঙ্গি প্রতিফলিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি সংখ্যালঘু ধারণায় বিশ্বাস করি না, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র যখন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—তুমি সংখ্যালঘু—তখন আসলে আপনি না ভেবে পারবেন না। এত যে সংবিধান সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কোথাও তো এই বড় বড় নতুন সংবিধান বিশেষজ্ঞদের বলতে শুনলাম না, সংবিধানে কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। রাষ্ট্র কোনো ধর্মের হতে পারে না। রাষ্ট্র হবে সব ধর্ম ও সব জাতিগোষ্ঠীর মানুষের। দেশে তো জাতিগতভাবে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও সংখ্যালঘু। তাদের ব্যাপারেও তো একই রকম অবহেলা ও অবজ্ঞা নজরে পড়ে।

একে তো ইদানীং রাস্তাঘাটে চলাচলই হয়ে পড়েছে অত্যন্ত বিপজ্জনক। পানের পিক থেকে শুরু করে নির্মাণাধীন ভবনের ইট কিংবা মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড, যেকোনো জিনিস যেকোনো সময় মানুষের মাথায় এসে পড়তে পারে এবং আপনি প্রাণ হারাতে পারেন। তার ভেতর এখন যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সকাল-বিকেল বাসে আগুন, গাড়িতে আগুন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে ততই যেন আমরা নাগরিক নিরাপত্তা হারাতে দেখছি।

একদিকে সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতার ভেতর আছে, অপর দিকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও নাগরিকেরা ভীষণ রকমভাবে বঞ্চিত ও অনিরাপদ। ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে, প্রতিদিন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে। তারপরও দেখবেন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বেকার আলাপ করে সমাজে শুধু নিরর্থক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছেন তা নয়, প্রতিবেশী দেশকেও খেপিয়ে তুলছেন। হাইডেগার বেঁচে থাকলে এ ধরনের আলাপকে বলতেন উসকানিমূলক প্রলাপ। সরকারের দায়িত্বে থাকা মানে দেশের মানুষের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া। কেবল তা-ই নয়, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং একই সঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তিকে ঊর্ধ্বে তুলে রাখা। অথচ পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ করছি, এসব পদে বসে থাকা মানুষেরা নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে একের পর এক মিথ্যাচার শুধু না, প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। এ থেকে বোঝা যায়, হয় তাঁরা গভীর চিন্তা করতে অক্ষম, নয়তো গভীরভাবে চিন্তা করেই দেশের ভেতর ও বাইরে একধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চান। গড্ডলকে ব্যস্ত রাখাই যেন তাঁদের একমাত্র কর্তব্য। যেন গড্ডলেরা মানুষের মতো চিন্তা করতে না পারে। যেন তাঁদের ভুলত্রুটিগুলো নিয়ে মানুষ কার্যকর আলাপ করতে না পারে।

আমাদের দেশের পুরো কর্মকাণ্ড পাখির দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের সৃষ্টি করবে, কারণ, আমাদের দেশের মানুষের যেটা অত্যন্ত প্রয়োজন, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলো পূরণ করা, সেগুলোই আমরা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পারিনি। সরকারি হাসপাতালে উঁকি দিলেই এই কথার কিছুটা সত্যতা মিলবে। ফুটপাতের দিকে তাকালেও বোঝা যাবে ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কতটুকু আমরা পাই। একটি দেশে যে ব্যাপক বৈষম্য, অনিয়ম ও বঞ্চনা রয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষকে অচেতন করে রাখা যাচ্ছে, এর পেছনের কারণ একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তাদের গড্ডলে পরিণত করা হয়েছে। এই গড্ডলকে রাজনৈতিক ফায়দা আদায়ের জন্য শুধু ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবহৃত গড্ডল কবে মানুষ হয়ে উঠবে, তা একমাত্র ওই গড্ডলই জানে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র গবেষক

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আশরাফুলের লাশ ঘরে রেখেই শারীরিক সম্পর্ক করেন জরেজ ও শামীমা: র‍্যাব

বিহারে ইতিহাস গড়ে বিজেপি জোটের বিপুল জয়, সর্বোচ্চ ভোট পেয়েও মহাজোটের ভরাডুবি

প্রধান শিক্ষক ও ছাত্রীর অশ্লীল ভিডিও ভাইরাল, গাংনীতে তোলপাড়

শেরপুর-২ আসনে এনসিপির মনোনয়নপত্র নিলেন জুলাই যোদ্ধা খোকন চন্দ্র বর্মণ

পুলিশি হেফাজতে থাকা আসামির বক্তব্য প্রচার, আরএমপি কমিশনারকে আদালতে তলব

এলাকার খবর
Loading...

সম্পর্কিত