
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক ‘ভোরের কাগজ’ ও ‘প্রথম আলো’র বার্তা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক ‘সমকাল’সহ একাধিক পত্রিকায় সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেনের সঙ্গে সমসাময়িক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিভুরঞ্জন সরকার।
বিভুরঞ্জন সরকার

আপনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রাজনৈতিকভাবে দেশ একটি ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে থাকলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে, নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে অনেক সংকট তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণ, খোলাখুলি ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন, সমান সুযোগের অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ—এগুলোই হচ্ছে সংকটের রূপ। ছাত্র-তরুণেরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গত বছর জুলাই-আগস্টে ত্বরিত ফুঁসে ওঠা রাজপথের রক্তাক্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এর পরই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়মশৃঙ্খলা এনে একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা সম্পর্কে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে, কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধের শক্তিগুলো, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য প্রকাশ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মারক আক্রান্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন যাতে আর না ফিরে আসে, সে জন্য অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় কিছু সংস্কার দরকার, তা সবাই মানে। কিন্তু সে অছিলায় সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার একটি লক্ষণীয় চেষ্টা একধরনের নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। এটা জটিলতা। এই পটভূমিতে দেশে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যা দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের কারণ। এসবের নিরসন ঘটিয়ে সমাজে শান্তি আনা, জাতীয় ঐক্য-সংহতি দৃঢ় করা বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ তো এখন কার্যত দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। বিএনপি কি শূন্যস্থান পূরণ করতে বা বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? জাতীয় পার্টি?
এই প্রশ্নে আমি কিছুটা কঠোর হব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি জনগণের প্রয়োজনে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল নয়। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল, যা তাঁরা ক্ষমতায় বসে বানিয়েছেন এবং পরিকৌশলী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি পোড় খেয়েছে, জনগণের কাতারে এসেছে। একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলটি বড় আকারেই রয়েছে। কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আশানুরূপ ফল পায়নি। ২০১৪ থেকে আমি একাধিকবার বলেছি, বিএনপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের পতন ঘটাতে না চেয়ে, বয়কট না করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট শুদ্ধ করার জন্য লড়াই করা। তাতে সার্বিকভাবেও দেশের রাজনীতির উপকার হতো। ছাত্রদের আন্দোলনসহ আরও নানা কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় এখন রাজনীতির মাঠ বিএনপির জন্যই অনুকূলে। তবে নিকট অতীতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার বিএনপিও। এখনো চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রভৃতি পরিহারসহ দলের পরিশীলন ছাড়া বিএনপি জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। দলে তুলনামূলকভাবে চিন্তাশীল নেতৃত্বের দরকার ও তুলনামূলক বিশুদ্ধ রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে দলটিকে।
জাতীয় পার্টি, এর প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা এরশাদের সময়ই কেবল ক্ষমতায় ছিল। পরে মূলত একটি ‘প্রক্সি পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরা কখনো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না। বরং একটি ‘বিকল্প নয়, বিকল্পের অংশীদার’ হিসেবেই তারা বেশি কাজ করে। বর্তমান রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সীমিতই থাকবে।
সব সময়ই তো বলা হয় তরুণেরাই পরিবর্তন আনে। তরুণেরাই ভরসা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা কেমন দেখছেন?
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তো তরুণদের দল। এনসিপি জন্ম নেওয়ার আগেই জুলাই আবহে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমি বলেছিলাম, তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। এঁরা বয়সে তরুণ ও মানসিকতায় আধুনিক হবেন। নীতি, কর্মসূচি, জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেবেন; স্লোগান, বুলি কপচানো ও নেতা বন্দনায় নয়। যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন সাধারণ স্বরগ্রামে, অহেতুক গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা করবেন না। গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে চলবেন এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে রাজনীতি করাকে মর্যাদাপূর্ণ ভাববেন।
এমন তরুণদের দল আমরা পাচ্ছি কি না বা এনসিপি তেমন দল হচ্ছে কি না, তা পাঠকেরা প্রতিদিনই তাদের দেখে যাচাই করতে পারেন। গলা ফুলিয়ে, হিংসা ছড়িয়ে বক্তৃতা করা, অজ্ঞাত উৎসের হিসাববহির্ভূত অর্থ ব্যয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা, গাড়ির বহর নিয়ে শক্তির মহড়া ইত্যাদি না হলে বুঝব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে।
আমাদের তরুণেরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ‘আই হেইট পলিটিকস’ শোনা যেত। কারণ, বছরের পর বছর তারা আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, সংঘাতপূর্ণ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেখেছে। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে তারা দুনিয়া দেখে, সেখানে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি পাওয়া যায়, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, প্রশ্ন তোলে। তরুণেরা এখন ‘নিউ পলিটিকস’ চায়, যেখানে নেতৃত্ব হবে বিশ্বাসযোগ্য, চিন্তাশীল এবং বাস্তবমুখী। কিন্তু আমি বিস্মিত যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সমবেত তরুণেরা শিক্ষিত, প্রতিভাবান, স্মার্ট কিন্তু কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমনকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের নৈকট্য দেখা যায়। তখন ভাবি, তরুণ মানেই তো ভালো, অগ্রসর চিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল ও ন্যায়যোদ্ধা নয়। এগুলো হচ্ছে তারুণ্যের ধর্ম। কিন্তু সব তরুণের মধ্যে তারুণ্য নেই। চোর-গুন্ডা-বদমাশ ও সন্ত্রাসীরা কি বয়সে তরুণ নয়? নজরুল যাদের আহ্বান করেন ‘চল চল চল...অরুণপ্রাতের তরুণদল’ বলে এবং রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেন ‘ওরে আমার সবুজ, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। তারা শুধু বয়সে তরুণ নয়, ধর্মে-মর্মে তরুণ। তাই তরুণ ও তারুণ্যে পার্থক্য আছে। তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়। তাই আমাদের দেশ ও সমাজের ব্যাপক সাধারণ তরুণদের মধ্যে এনসিপির আবেদন কতটুকু হবে, তা ওই দলের ভূমিকা ও কাজের ওপর নির্ভর করবে।
আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আশু গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব?
নিশ্চয়ই সম্ভব, কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে এটা চায়। তবে কয়েকটি কঠিন চ্যালেঞ্জও আছে। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার মতো পরাশক্তির কোনো একটি ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জল্পনা আছে, যদিও সংগত কারণে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে কোনো অস্থিতিশীলতা ঘটলে আমাদের নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে আমাদের নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এখনো এটা নিশ্চিত নয়।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, শুধু নিয়ম নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রথম ধাপেই আমাদের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। বিগত সরকারের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে সরকার ও প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া বর্তমানে সরকারের আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থককে সংগঠিত হওয়ার ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রাকে অংশগ্রহণমূলক করা ভালো। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও এই অধিকারগুলোর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
এবার দু-একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
পশ্চিমা জোট বলতে যদি আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা স্পষ্টত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বোঝাই, তাহলে এই দেশগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সারা দুনিয়ায় আধিপত্য তাদের কাম্য। আমরা তাত্ত্বিকভাবে বলি যে সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া তারা বাঁচতে পারে না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই আছে। চার বছর ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলার মধ্যেই এই মাসে ইরানে ইসরায়েল ও আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘটাল। ইসরায়েল প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অব্যাহত গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করার পর এখন তাদের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এইসব ঘটনায় এখন জাতিসংঘ কার্যত নিষ্ক্রিয় বা সভায় বসলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফিলিস্তিন ও ইরানে যা দেখা গেল, আমেরিকা ও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চলেছে। সর্বশেষ এই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে প্রতিটি ন্যাটো দেশ অস্ত্র খাতে ব্যয় ৫ শতাংশ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। এককথায় বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থে বিশ্বকে যুদ্ধে তাতিয়ে রাখাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পুরোটাই স্নায়ুযুদ্ধের কাল হলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লক ও পশ্চিমা ব্লকের শক্তির ভারসাম্য ছোট দেশগুলোকে একটা ভরসায় রেখেছিল। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেতার পেছনে সোভিয়েতের ভূমিকা একটি বড় উপাদান ছিল। সোভিয়েতের আহ্বানে তখন বিশ্বে পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আলোচনা হয়েছিল। এখন বড় শক্তিগুলো নিরস্ত্রীকরণ নয়, পারমাণবিক অস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার হাতে রাখতে চায়।
পরাশক্তিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরে আমেরিকা ভেবেছিল বিশ্ব এককেন্দ্রিক হবে। কিন্তু তা হলো না। বরং আমেরিকা একটু দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান প্রভৃতি শক্তিধর রাষ্ট্র আছে। দুই মহাশক্তির পরিবর্তে পৃথিবী শক্তিকেন্দ্রিক। এ রকম
অবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে। সুযোগ এই কারণে যে, একপেশে অবস্থানের পরিবর্তে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে আমরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুবিধা আদায় করতে পারি। চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, বড়দের দ্বন্দ্বে আমরা পড়ে যেতে পারি একপেশে সিদ্ধান্তে। ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই আমাদের স্বার্থানুকূল।
আপনার দৃষ্টিতে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের মূলে কী? এটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, না কৌশলগত সংঘাত? আমেরিকা কেন জড়াল?
খুব ভালো প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা এককথায় দেওয়া যায় না। এই সংঘাত ধর্মীয়ও বটে, কৌশলগতও বটে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার নিয়েও বটে।
দুটি রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক। ইহুদি রাষ্ট্রটির শাসকদের মধ্যে জায়নবাদীরা আছে। জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে ফ্যাসিবাদী ভাবধারা। তবে সব ইহুদি জায়নবাদী নয়। তাদের মধ্যে উদার আধুনিক মানুষ অনেক আছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সব সময় ধর্মগ্রন্থ ‘তোরাহ’ ব্যবহার করেন। যেমন ১২ জুন ইরান আক্রমণের নাম ‘জাগ্রত সিংহ অপারেশন’ ওল্ড টেস্টামেন্টভিত্তিক কাহিনি থেকে। তিনি আক্রমণের আগে জেরুজালেমে ওয়েস্ট ওয়ালে গিয়ে প্রার্থনা করেন। ওদিকে জাব্বাজোব্বা পরা আয়াতুল্লাহ শাসকেরা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপন্থী অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা এমন ধর্মান্ধ যে ২০২২ সালে মাহশা আমিনি নামে এক তরুণীর হিজাব সরে গিয়ে চুল বেরিয়ে পড়ায় নীতি-পুলিশ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে প্রতিবাদকারী শতাধিক কিশোরী-তরুণীকে মিছিলে গুলি করে মারা হয়। যুদ্ধে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত ক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। ইসরায়েল হচ্ছে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে থাকে। ইরান বড় আকারে পারমাণবিক গবেষণা করে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়, তা স্বীকার না করে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের কথা বলে। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। আলোচনায়ও বসেছে। এর আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফা আলোচনা ভেঙে দিয়েছিলেন। ইসরায়েল এবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে, কয়েকজন সেনাপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করে। ইরান কার্যকরভাবে ইসরায়েলে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারলে ইসরায়েলের ইজ্জত বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র শঠতাপূর্ণভাবে বি-টু যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে বড় হামলা করে। তার পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তিন রাষ্ট্রের দুই পক্ষের ১২ দিনের যুদ্ধ। সন্দেহ করা হয় যে ২০০৩ সালে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত ও ফাঁসি দেওয়ার মতো ঘটনা ইরানে ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফন্দি আঁটতে পারে।
এবার কে জিতল?
(হেসে) তিন পক্ষই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন ২৪ জুনেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানো অনেক পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা ইরানকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলের আরেকটি লক্ষ্য খামেনি সরকারের পতন ঘটেনি—সে সম্পর্কে নীরব। আর ইরান বলেছে, তারা উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। সর্বশেষ ২৬ জুন টিভিতে সম্প্রচারিত ভিডিও বার্তায় আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতকে ‘সজোরে চপেটাঘাত’ উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসরায়েল ধসে পড়েছে।’
বলাই যায়, ইসরায়েলি ‘সিংহ’ গর্জন মোতাবেক শিকার ধরতে পারেনি। ইউরোপে কিছুটা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে। তবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতার আয়ু কিছু বাড়তে পারে। ইরান ধারণার চেয়ে বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং খামেনির সরকার পড়ে যাওয়ার বিপরীতে জনমতের দিক থেকে কিছুটা সংহত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। আর আমেরিকা কিছুটা দুর্বল ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসাবে। তিন পক্ষই বড় যুদ্ধ চায়নি, সেখানেও জিতেছে।
এই ১২ দিনের উপসংহারহীন অসমাপ্ত যুদ্ধের আরেকটি দিক হলো চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত উত্থান। চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যে ফাটল ধরুক। তারা ইরানকে কিছুটা উসকানি বা কৌশলগত সহায়তা দিয়েছে বলে ধারণা। রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুত্ব বাড়াতে সক্রিয়।
ইরানে বড় আক্রমণ দেখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল।
তেমন আশঙ্কা দূরবর্তী বলেই মনে হয়। তবে স্থানিক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বা বলতে পারেন ‘প্রক্সিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ সম্ভব। দুটি বৈশ্বিক মেরু তৈরি হয়েছে: একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ন্যাটো ব্লক, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস।
এই দুই মেরুর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও তারা পরোক্ষে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন, সিরিয়া, ইয়েমেন, গাজা প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন তো যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের না, তথ্যেরও। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম, কূটনৈতিক মঞ্চ—সবই যুদ্ধে জড়িয়ে। থেমে নেই।
বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত? আমাদের কি নিরপেক্ষ থাকা উচিত, নাকি অবস্থান নিতে হবে?
দৃঢ় অবস্থান, আমরা যুদ্ধ চাই না। সাংবিধানিকভাবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে অবশ্যই ন্যায়-অন্যায় ও মানবাধিকারের প্রশ্নে গাজা যুদ্ধে ও ইরান আক্রমণে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করেছি আমরা। ইসরায়েলকে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দিইনি। আমাদের জনগণের একটি মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ আছে।
তবে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইরানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা আছে। আমরা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপসহীন।
আপনি দীর্ঘকাল ধরে দেশের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন। আজকের অবস্থানে দাঁড়িয়ে আপনি দেশের রাজনীতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রাজনৈতিকভাবে দেশ একটি ঘোরতর জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি দেশে থাকলেও, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হলেও নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে, নির্বাচনে নগ্ন কারচুপি করে আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় একচ্ছত্রভাবে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করে অনেক সংকট তৈরি করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক ভাঙন, রাষ্ট্রযন্ত্র দলীয়করণ, খোলাখুলি ব্যাপক দুর্নীতি, রাজনৈতিক দলের দুর্বৃত্তায়ন, সমান সুযোগের অভাবে নাগরিকদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ—এগুলোই হচ্ছে সংকটের রূপ। ছাত্র-তরুণেরা ভীষণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং গত বছর জুলাই-আগস্টে ত্বরিত ফুঁসে ওঠা রাজপথের রক্তাক্ত আন্দোলনে সরকারের পতন ঘটে যায়। কিন্তু এর পরই জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী নিয়মশৃঙ্খলা এনে একটি ভালো নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা সম্পর্কে শঙ্কা তৈরি হতে থাকে, কেননা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শের বিরুদ্ধের শক্তিগুলো, বিশেষত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাধান্য প্রকাশ পায় এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্মারক আক্রান্ত হতে থাকে। গণতন্ত্রকে সফল করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ের মতো কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসন যাতে আর না ফিরে আসে, সে জন্য অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকাঠামোয় কিছু সংস্কার দরকার, তা সবাই মানে। কিন্তু সে অছিলায় সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তনসহ রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে ফেলার একটি লক্ষণীয় চেষ্টা একধরনের নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করছে। এটা জটিলতা। এই পটভূমিতে দেশে অসহিষ্ণুতা, হিংস্রতা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা যা দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের কারণ। এসবের নিরসন ঘটিয়ে সমাজে শান্তি আনা, জাতীয় ঐক্য-সংহতি দৃঢ় করা বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ তো এখন কার্যত দৃশ্যপট থেকে অপসারিত। বিএনপি কি শূন্যস্থান পূরণ করতে বা বিকল্প শক্তি হয়ে উঠতে পারবে? জাতীয় পার্টি?
এই প্রশ্নে আমি কিছুটা কঠোর হব। বিএনপি ও জাতীয় পার্টি জনগণের প্রয়োজনে জনগণের মধ্য থেকে উঠে আসা দল নয়। সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল, যা তাঁরা ক্ষমতায় বসে বানিয়েছেন এবং পরিকৌশলী নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছেন। তবে সময়ের সঙ্গে রাজনীতি করে বিএনপি পোড় খেয়েছে, জনগণের কাতারে এসেছে। একাধিকবার দেশ পরিচালনা করেছে। প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে। ২০০৬ সাল থেকে ১৯ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও দলটি বড় আকারেই রয়েছে। কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত ও ভুল কৌশল এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার জন্য আশানুরূপ ফল পায়নি। ২০১৪ থেকে আমি একাধিকবার বলেছি, বিএনপির উচিত ছিল আওয়ামী লীগ সৃষ্ট প্রতিকূলতার মধ্যেও সরকারের পতন ঘটাতে না চেয়ে, বয়কট না করে নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভোট শুদ্ধ করার জন্য লড়াই করা। তাতে সার্বিকভাবেও দেশের রাজনীতির উপকার হতো। ছাত্রদের আন্দোলনসহ আরও নানা কারণে হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় এখন রাজনীতির মাঠ বিএনপির জন্যই অনুকূলে। তবে নিকট অতীতে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের অংশীদার বিএনপিও। এখনো চাঁদাবাজি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রভৃতি পরিহারসহ দলের পরিশীলন ছাড়া বিএনপি জনগণের স্বার্থে ভূমিকা পালন করতে পারবে না। দলে তুলনামূলকভাবে চিন্তাশীল নেতৃত্বের দরকার ও তুলনামূলক বিশুদ্ধ রাজনীতির পথে হাঁটতে হবে দলটিকে।
জাতীয় পার্টি, এর প্রতিষ্ঠাতা সামরিক নেতা এরশাদের সময়ই কেবল ক্ষমতায় ছিল। পরে মূলত একটি ‘প্রক্সি পার্টি’তে রূপান্তরিত হয়। ক্ষমতার রাজনীতিতে এরা কখনো সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় না। বরং একটি ‘বিকল্প নয়, বিকল্পের অংশীদার’ হিসেবেই তারা বেশি কাজ করে। বর্তমান রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির ভূমিকা সীমিতই থাকবে।
সব সময়ই তো বলা হয় তরুণেরাই পরিবর্তন আনে। তরুণেরাই ভরসা। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরে রাজনীতিতে তরুণদের ভূমিকা কেমন দেখছেন?
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি তো তরুণদের দল। এনসিপি জন্ম নেওয়ার আগেই জুলাই আবহে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আমি বলেছিলাম, তরুণদের একটি রাজনৈতিক দলকে আমরা স্বাগত জানাতে পারি। এঁরা বয়সে তরুণ ও মানসিকতায় আধুনিক হবেন। নীতি, কর্মসূচি, জ্ঞান ও ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেবেন; স্লোগান, বুলি কপচানো ও নেতা বন্দনায় নয়। যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন সাধারণ স্বরগ্রামে, অহেতুক গলার রগ ফুলিয়ে বক্তৃতা করবেন না। গণতন্ত্রের রীতিনীতি মেনে চলবেন এবং পার্লামেন্টে বিরোধী দলের আসনে বসে রাজনীতি করাকে মর্যাদাপূর্ণ ভাববেন।
এমন তরুণদের দল আমরা পাচ্ছি কি না বা এনসিপি তেমন দল হচ্ছে কি না, তা পাঠকেরা প্রতিদিনই তাদের দেখে যাচাই করতে পারেন। গলা ফুলিয়ে, হিংসা ছড়িয়ে বক্তৃতা করা, অজ্ঞাত উৎসের হিসাববহির্ভূত অর্থ ব্যয়, চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠা, গাড়ির বহর নিয়ে শক্তির মহড়া ইত্যাদি না হলে বুঝব রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে।
আমাদের তরুণেরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল। ‘আই হেইট পলিটিকস’ শোনা যেত। কারণ, বছরের পর বছর তারা আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, সংঘাতপূর্ণ, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেখেছে। অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে তারা দুনিয়া দেখে, সেখানে তাদের রাজনৈতিক উপস্থিতি পাওয়া যায়, তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে, প্রশ্ন তোলে। তরুণেরা এখন ‘নিউ পলিটিকস’ চায়, যেখানে নেতৃত্ব হবে বিশ্বাসযোগ্য, চিন্তাশীল এবং বাস্তবমুখী। কিন্তু আমি বিস্মিত যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা, জাতীয় নাগরিক পার্টিতে সমবেত তরুণেরা শিক্ষিত, প্রতিভাবান, স্মার্ট কিন্তু কেউ কেউ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এমনকি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত ও জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের নৈকট্য দেখা যায়। তখন ভাবি, তরুণ মানেই তো ভালো, অগ্রসর চিন্তার মানুষ, প্রগতিশীল ও ন্যায়যোদ্ধা নয়। এগুলো হচ্ছে তারুণ্যের ধর্ম। কিন্তু সব তরুণের মধ্যে তারুণ্য নেই। চোর-গুন্ডা-বদমাশ ও সন্ত্রাসীরা কি বয়সে তরুণ নয়? নজরুল যাদের আহ্বান করেন ‘চল চল চল...অরুণপ্রাতের তরুণদল’ বলে এবং রবীন্দ্রনাথ যাদের বলেন ‘ওরে আমার সবুজ, ওরে আমার কাঁচা, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’। তারা শুধু বয়সে তরুণ নয়, ধর্মে-মর্মে তরুণ। তাই তরুণ ও তারুণ্যে পার্থক্য আছে। তারুণ্যের ধর্মচ্যুত তরুণ আমাদের কাম্য নয়। তাই আমাদের দেশ ও সমাজের ব্যাপক সাধারণ তরুণদের মধ্যে এনসিপির আবেদন কতটুকু হবে, তা ওই দলের ভূমিকা ও কাজের ওপর নির্ভর করবে।
আপনি কি মনে করেন বাংলাদেশে আশু গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভব?
নিশ্চয়ই সম্ভব, কারণ জনগণ দৃঢ়ভাবে এটা চায়। তবে কয়েকটি কঠিন চ্যালেঞ্জও আছে। মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলকে ঘিরে আমেরিকার মতো পরাশক্তির কোনো একটি ভূ-রাজনৈতিক পরিকল্পনা আছে বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জল্পনা আছে, যদিও সংগত কারণে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এখানে কোনো অস্থিতিশীলতা ঘটলে আমাদের নির্বাচন ব্যাহত হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধের মধ্যে আমাদের নির্বাচন হওয়ার কথা। তবে এখনো এটা নিশ্চিত নয়।
মনে রাখতে হবে, গণতন্ত্র একটি সংস্কৃতি, শুধু নিয়ম নয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কারের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যে বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রথম ধাপেই আমাদের নির্বাচনকে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। বিগত সরকারের বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের বিচার অবশ্যই হতে হবে। তবে সরকার ও প্রশাসনের দায়ী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া বর্তমানে সরকারের আদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাখা আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী-সমর্থককে সংগঠিত হওয়ার ও মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রাকে অংশগ্রহণমূলক করা ভালো। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনও এই অধিকারগুলোর কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
এবার দু-একটি আন্তর্জাতিক বিষয়। চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা জোটের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
পশ্চিমা জোট বলতে যদি আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা স্পষ্টত ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে বোঝাই, তাহলে এই দেশগুলো হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী দেশ। সারা দুনিয়ায় আধিপত্য তাদের কাম্য। আমরা তাত্ত্বিকভাবে বলি যে সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য হচ্ছে যুদ্ধ। যুদ্ধ ছাড়া তারা বাঁচতে পারে না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও সারাক্ষণ কোথাও না কোথাও যুদ্ধ লেগেই আছে। চার বছর ধরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ চলার মধ্যেই এই মাসে ইরানে ইসরায়েল ও আমেরিকা আক্রমণ চালিয়ে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ ঘটাল। ইসরায়েল প্রায় দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় অব্যাহত গণহত্যা চালাচ্ছে। প্রায় ৬০ হাজার মানুষকে হত্যা করার পর এখন তাদের দুর্ভিক্ষে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছে। এইসব ঘটনায় এখন জাতিসংঘ কার্যত নিষ্ক্রিয় বা সভায় বসলেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না। ফিলিস্তিন ও ইরানে যা দেখা গেল, আমেরিকা ও ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে চলেছে। সর্বশেষ এই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপে প্রতিটি ন্যাটো দেশ অস্ত্র খাতে ব্যয় ৫ শতাংশ বাড়াতে সম্মত হয়েছে। এককথায় বৃহৎ শক্তিগুলোর স্বার্থে বিশ্বকে যুদ্ধে তাতিয়ে রাখাই হচ্ছে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ পুরোটাই স্নায়ুযুদ্ধের কাল হলেও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ব্লক ও পশ্চিমা ব্লকের শক্তির ভারসাম্য ছোট দেশগুলোকে একটা ভরসায় রেখেছিল। সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জেতার পেছনে সোভিয়েতের ভূমিকা একটি বড় উপাদান ছিল। সোভিয়েতের আহ্বানে তখন বিশ্বে পূর্ণাঙ্গ পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের আলোচনা হয়েছিল। এখন বড় শক্তিগুলো নিরস্ত্রীকরণ নয়, পারমাণবিক অস্ত্রের একচেটিয়া অধিকার হাতে রাখতে চায়।
পরাশক্তিব্যবস্থা ভেঙে পড়ার পরে আমেরিকা ভেবেছিল বিশ্ব এককেন্দ্রিক হবে। কিন্তু তা হলো না। বরং আমেরিকা একটু দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি চীন, রাশিয়া, ভারত, ইরান প্রভৃতি শক্তিধর রাষ্ট্র আছে। দুই মহাশক্তির পরিবর্তে পৃথিবী শক্তিকেন্দ্রিক। এ রকম
অবস্থায় বাংলাদেশের মতো ছোট দেশের জন্য সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই আছে। সুযোগ এই কারণে যে, একপেশে অবস্থানের পরিবর্তে কৌশলী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে আমরা স্বার্থসংশ্লিষ্ট সুবিধা আদায় করতে পারি। চ্যালেঞ্জ এই কারণে যে, বড়দের দ্বন্দ্বে আমরা পড়ে যেতে পারি একপেশে সিদ্ধান্তে। ভারসাম্য রক্ষা করে চলাই আমাদের স্বার্থানুকূল।
আপনার দৃষ্টিতে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধের মূলে কী? এটি ধর্মীয়, রাজনৈতিক, না কৌশলগত সংঘাত? আমেরিকা কেন জড়াল?
খুব ভালো প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরটা এককথায় দেওয়া যায় না। এই সংঘাত ধর্মীয়ও বটে, কৌশলগতও বটে এবং আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার নিয়েও বটে।
দুটি রাষ্ট্রই ধর্মভিত্তিক। ইহুদি রাষ্ট্রটির শাসকদের মধ্যে জায়নবাদীরা আছে। জায়নবাদ হচ্ছে ইহুদি-শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে ফ্যাসিবাদী ভাবধারা। তবে সব ইহুদি জায়নবাদী নয়। তাদের মধ্যে উদার আধুনিক মানুষ অনেক আছে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যুদ্ধে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে সব সময় ধর্মগ্রন্থ ‘তোরাহ’ ব্যবহার করেন। যেমন ১২ জুন ইরান আক্রমণের নাম ‘জাগ্রত সিংহ অপারেশন’ ওল্ড টেস্টামেন্টভিত্তিক কাহিনি থেকে। তিনি আক্রমণের আগে জেরুজালেমে ওয়েস্ট ওয়ালে গিয়ে প্রার্থনা করেন। ওদিকে জাব্বাজোব্বা পরা আয়াতুল্লাহ শাসকেরা ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যে শিয়াপন্থী অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এরা এমন ধর্মান্ধ যে ২০২২ সালে মাহশা আমিনি নামে এক তরুণীর হিজাব সরে গিয়ে চুল বেরিয়ে পড়ায় নীতি-পুলিশ তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বন্দী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হলে প্রতিবাদকারী শতাধিক কিশোরী-তরুণীকে মিছিলে গুলি করে মারা হয়। যুদ্ধে ধর্মীয় উপাদান ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত ক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্যের লড়াই। ইসরায়েল হচ্ছে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি, যাকে পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে থাকে। ইরান বড় আকারে পারমাণবিক গবেষণা করে, কিন্তু পারমাণবিক বোমা বানাতে চায়, তা স্বীকার না করে শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের কাজে ব্যবহারের কথা বলে। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থাকে পরিদর্শনের অনুমতি দেয়। আলোচনায়ও বসেছে। এর আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফা আলোচনা ভেঙে দিয়েছিলেন। ইসরায়েল এবার ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা ফেলে, কয়েকজন সেনাপতি ও পরমাণুবিজ্ঞানীকে গুপ্তহত্যা করে। ইরান কার্যকরভাবে ইসরায়েলে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারলে ইসরায়েলের ইজ্জত বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্র শঠতাপূর্ণভাবে বি-টু যুদ্ধবিমান দিয়ে ইরানে বড় হামলা করে। তার পরই ট্রাম্প যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। তিন রাষ্ট্রের দুই পক্ষের ১২ দিনের যুদ্ধ। সন্দেহ করা হয় যে ২০০৩ সালে জনবিধ্বংসী অস্ত্র আছে বলে মিথ্যা অজুহাতে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত ও ফাঁসি দেওয়ার মতো ঘটনা ইরানে ঘটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ফন্দি আঁটতে পারে।
এবার কে জিতল?
(হেসে) তিন পক্ষই। যুদ্ধ শেষ হওয়ার দিন ২৪ জুনেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া জানায়, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র বানানো অনেক পিছিয়ে দিতে পেরেছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা ইরানকে দুর্বল করে দিয়েছে। অবশ্য ইসরায়েলের আরেকটি লক্ষ্য খামেনি সরকারের পতন ঘটেনি—সে সম্পর্কে নীরব। আর ইরান বলেছে, তারা উপযুক্ত জবাব দিয়েছে। সর্বশেষ ২৬ জুন টিভিতে সম্প্রচারিত ভিডিও বার্তায় আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতকে ‘সজোরে চপেটাঘাত’ উল্লেখ করে বলেন, ‘ইসরায়েল ধসে পড়েছে।’
বলাই যায়, ইসরায়েলি ‘সিংহ’ গর্জন মোতাবেক শিকার ধরতে পারেনি। ইউরোপে কিছুটা কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতায় পড়েছে। তবে নেতানিয়াহুর ক্ষমতার আয়ু কিছু বাড়তে পারে। ইরান ধারণার চেয়ে বেশি সক্ষমতা দেখিয়েছে এবং খামেনির সরকার পড়ে যাওয়ার বিপরীতে জনমতের দিক থেকে কিছুটা সংহত হয়েছে। বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থন পেয়েছে। তারা বাংলাদেশকে ধন্যবাদও জানিয়েছে। আর আমেরিকা কিছুটা দুর্বল ইরানকে আলোচনার টেবিলে বসাবে। তিন পক্ষই বড় যুদ্ধ চায়নি, সেখানেও জিতেছে।
এই ১২ দিনের উপসংহারহীন অসমাপ্ত যুদ্ধের আরেকটি দিক হলো চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত উত্থান। চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যে ফাটল ধরুক। তারা ইরানকে কিছুটা উসকানি বা কৌশলগত সহায়তা দিয়েছে বলে ধারণা। রাশিয়াও মধ্যপ্রাচ্যে বন্ধুত্ব বাড়াতে সক্রিয়।
ইরানে বড় আক্রমণ দেখে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কার কথা বলা হচ্ছিল।
তেমন আশঙ্কা দূরবর্তী বলেই মনে হয়। তবে স্থানিক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি হতে পারে বা বলতে পারেন ‘প্রক্সিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ সম্ভব। দুটি বৈশ্বিক মেরু তৈরি হয়েছে: একদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-ন্যাটো ব্লক, অন্যদিকে চীন-রাশিয়া-ইরান-হিজবুল্লাহ-হামাস।
এই দুই মেরুর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ না হলেও তারা পরোক্ষে যুদ্ধ করছে ইউক্রেন, সিরিয়া, ইয়েমেন, গাজা প্রভৃতি যুদ্ধক্ষেত্রে। এখন তো যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের না, তথ্যেরও। মিডিয়া, সামাজিক মাধ্যম, কূটনৈতিক মঞ্চ—সবই যুদ্ধে জড়িয়ে। থেমে নেই।
বাংলাদেশের অবস্থান কী হওয়া উচিত? আমাদের কি নিরপেক্ষ থাকা উচিত, নাকি অবস্থান নিতে হবে?
দৃঢ় অবস্থান, আমরা যুদ্ধ চাই না। সাংবিধানিকভাবে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে অবশ্যই ন্যায়-অন্যায় ও মানবাধিকারের প্রশ্নে গাজা যুদ্ধে ও ইরান আক্রমণে ইসরায়েলের তীব্র নিন্দা করেছি আমরা। ইসরায়েলকে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে এখনো স্বীকৃতি দিইনি। আমাদের জনগণের একটি মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধ আছে।
তবে রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। ইরানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ও জ্বালানি সহযোগিতা আছে। আমরা আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অবশ্যই আপসহীন।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেসম্পাদকীয়

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান জেলে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং রাজনীতিবিদ ইমরান খান কারাবন্দী রয়েছেন। দীর্ঘদিন রাজনীতির মাঠে সক্রিয় থেকে একসময় তাঁর দল নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, সরকার গঠন করেছিল। এরপর কীভাবে ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না। কারাগারে তিনি সুস্থ আছেন, এই সংবাদ প্রকাশিত হলে ইমরান খানকে নিয়ে সংশয় কেটে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাঁটলে নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তন কীভাবে হয়, তা যে কেউ জেনে নিতে পারবে। নির্বাচিত সরকারপ্রধানকে সরিয়ে হয় একটা পুতুল সরকার বসানো হয় অথবা সরাসরি ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন কোনো জেনারেল। ইস্কান্দার মির্জা, আইয়ুব খান হয়ে আসিম মুনিরে এসে ঠেকেছে পাকিস্তানের বিধিলিপি। ফলে পাকিস্তানকে জেনারেলদের দুনিয়া বলা হলেও সত্যের অপলাপ হবে না। সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণহীন হতে চাইলেই সে সরকারের ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। অরাজকতা যেন সেখানকার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।
ইমরান খান জনপ্রিয় নেতা। বিগত নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু দলটির স্বতন্ত্র সদস্যরা জিতে নেন অনেকগুলো আসন। পাকিস্তানি রাজনীতিতে দলটির একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান রয়েছে। জেলখানায় বন্দী ইমরান খান পাকিস্তানে এখনো খুবই জনপ্রিয়। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি জেনারেলদের বিরোধের মধ্যে পড়ে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেন। এ ছাড়াও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা দেখা দেওয়ায় তিনি বিরোধী দলগুলোর রোষানলে পড়েন। যার ফলে তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে ইমরান খানের একটি বক্তব্য স্মর্তব্য। তিনি তাঁর দলের সঙ্গে জুলুম হচ্ছে জানিয়ে বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে কী হয়েছিল? সবচেয়ে বড় যে রাজনৈতিক দল নির্বাচনে জিতেছিল, তাদের ওপর দমনপীড়ন চালিয়েছিল সামরিক বাহিনী। তাদের যে অধিকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি।’ ইমরান আরও বলেছিলেন, ‘আমার জানা ছিল না, সেখানকার মানুষের ভেতরে কী পরিমাণ ঘৃণা জমেছিল। কেন ঘৃণা জমেছিল? তারা নির্বাচনে জিতেছিল আর আমরা তাদের সেই অধিকার দিচ্ছিলাম না। প্রধানমন্ত্রী তাদের হওয়ার কথা। কিন্তু আমরা এখানে (পশ্চিম পাকিস্তানে) বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমরা তাদের প্রধানমন্ত্রী হতে দেব না।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্র আসবে কি না, সেটা নির্ভর করবে দেশটি আইনের শাসনের প্রতি কতটা অনুগত, তার ওপর। আপাতত সেই পরিবেশের উন্নতি হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আর সেই অন্ধকারই নিয়ন্ত্রণ করছে ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
২৯ জুন ২০২৫
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেজাহীদ রেজা নূর

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত। নারীকে সেখানে লালসার শিকার হিসেবে তুলে ধরে বাণিজ্যিক লাভালাভের খোঁজ করেছেন পরিচালকেরা। এরপর ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটাই তো থমকে দাঁড়াল। এমনভাবে সাংস্কৃতিক জগৎটা নির্মাণ করা হলো, যেন মুক্তিযুদ্ধ বলে কিছুই ঘটেনি এ দেশে। এই মতলবি রাজনীতি চলেছিল অনেক দিন ধরেই। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশে পরিণত করেছিল যারা, তাদের খায়েশ ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আঁতাত করার। যে রক্ত ঝরেছিল একাত্তরে, তাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছিল দম্ভ ভরে। কিন্তু সে সময় তাদের সে খায়েশ পূরণ হয়নি। একের পর এক সামরিক শাসক দেশের শাসনভার হাতে নিয়ে সবচেয়ে যে বিষয়টিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়।
কিছুটা সামাল দিয়ে আশির দশকে আবার শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ। কিন্তু মূলধারার চলচ্চিত্রে উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র হয়নি বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না। কোনো কোনো চলচ্চিত্রে মানবিক আবেদন আছে বটে, কিন্তু তা শিল্পের দাবির সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি।
২. আজ আমরা এমন কয়েকটি চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলব, যেগুলো নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার পরে। এই চলচ্চিত্রগুলো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি নয়, স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিও নয়। এগুলো তথ্যচিত্র।
ছবিগুলোর মধ্যে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ নেই। কিন্তু এর মধ্যে কয়েকটি প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতাকে তুলে ধরে। ভাবায়।
অনেকেরই মনে পড়ে যাবে, নব্বইয়ের দশকে যখন ‘মুক্তির গান’ নিয়ে এলেন তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ, তখন কীভাবে আলোড়িত হয়েছিল দেশের তরুণ সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি এই সংযোগ একটা জাগরণী মন্ত্রের মতো কাজ করেছিল। মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন যে ফুটেজগুলো ধারণ করেছিলেন একাত্তরে এবং যেগুলো অলসভাবে পড়ে ছিল তাঁর বেজমেন্টে, সেগুলো উদ্ধার করে এনে তারেক-ক্যাথরিন জুটি যা করলেন, তা আমাদের সত্যিকারের ইতিহাসের অংশ হয়ে রইল।
হ্যাঁ, সে ছবিতে মুক্তিযোদ্ধাদেরও দেখা গেছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় হয়ে যা উঠে এসেছে, তা হলো স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কীভাবে যুক্ত হওয়া যায় এই যুদ্ধে। বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে যাওয়া শিল্পীরাই সংগঠিত হয়ে তৈরি করেছিলেন গানের দলটি। উদ্বাস্তু শিবিরে, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে তাঁরা শুনিয়েছেন জাগরণী গান। ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পীদের কারও কারও সঙ্গে কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাঁদের কাছ থেকেই জেনেছি, খেয়ে-না খেয়ে কীভাবে তাঁরা কাজ করেছেন। আবার উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ গানের শেষে জোর করে তাঁদের আপ্যায়ন করেছেন। খুবই সাধারণ খাবার, কিন্তু আন্তরিকতা? যুদ্ধে এই আন্তরিকতার প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ তো মনস্তাত্ত্বিক খেলা। প্রচারণার খেলা। সেই খেলায় জয়ী হয় তারাই, যাদের পেছনে দেশের মানুষের সমর্থন থাকে। ১৯৭১ সালে এই দেশের মানুষ কীভাবে যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য মাটির গান ছবিটি গুরুত্বপূর্ণ। আরও অনেক কারণেই তা গুরুত্বপূর্ণ। একটি কারণের কথা তো উল্লেখ করতেই হবে—যারা একাত্তর নিয়ে এখন নতুন মিথ তৈরি করার মতো চালাকি করছে, তারা যেসব কারণে হালে পানি পাবে না, তার একটি হচ্ছে তথ্যভিত্তিক ইতিহাস। এই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে নতুন বয়ান তৈরি করার চেষ্টা একসময় হাসির খোরাকে পরিণত হবে।
৩. ইদানীং দেখা যায়, অনেকেই একাত্তরে ধর্ষিতা নারীদের নিয়ে কটাক্ষ করেন। অনেকে তো বলেই থাকেন, এই নারীরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় পাকিস্তানি হানাদারদের বাহুলগ্না হয়েছেন। এই অরুচিকর মন্তব্য কারা করতে পারেন, সে বিষয়ে নিশ্চয়ই সচেতন, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের ধারণা আছে। মুশকিল হলো, তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের কোন শিক্ষাটি নেবে? মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে অনেকেই অনেক রকম ফায়দা তুলে নিয়েছেন। ফলে, যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিংবা যাদের পরিবারে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নেই, অথবা যাদের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শোনার সৌভাগ্য হয়নি, তারা তো মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হতেই পারে। তাদের সামনে প্রামাণ্য উদাহরণ থাকলে তারা মাথা খাটিয়ে নিজেই কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে। তরুণদের দোষারোপ করার কোনো কারণ নেই। তাদের কাছে সত্য ইতিহাস তুলে ধরতে না পারলে তারা অজায়গা-কুজায়গা থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেখানেই বিপদ। তাই মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য ইতিহাস খুঁজে নিতে হবে। তেমনই একটি তথ্যভান্ডার হতে পারে ইয়াসমিন কবিরের ‘এ সার্টেইন লিবারেশন।’
‘স্বাধীনতা’ বা ‘এ সার্টেইন লিবারেশন’ ছবিটি দেখতে বসলে প্রথমে বোঝাই যাবে না, এ ছবির প্রাণ কতটা গভীরে। গুরুদাসী মণ্ডলকে উন্মাদ মনে হতে পারে। খুলনার কপিলমুনির রাস্তাঘাটে যে পাগলিকে দেখা যায়, তার জীবনে একটা কাহিনি আছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে যে নারী, তাকে স্বাধীন বলা হবে নাকি পরাধীন—এই প্রশ্ন তো স্বভাবতই জেগে উঠতে পারে মনে। কাহিনি যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই মানুষ একটু একটু করে অনুভব করতে পারে আপাত এই স্বাধীনতা মোটেই মুক্তি নয়। বেঁচে থাকার অমোঘ নিয়মেই গুরুদাসীর এই পাগল বেশ।
এই ছবিতে অসাধারণ কিছু সংলাপ আছে। তার একটি এখানে বলা যেতে পারে। এক মুসলিম পরিবারের ঘরেই খাওয়াদাওয়া করে গুরুদাসী। এ কারণেই সেই পরিবারে গরুর মাংস রান্না হয় না। এই বাড়ির গৃহকর্ত্রী যখন ধর্মের বিষয়ে তার সরল স্বীকারোক্তি করে, বলে, সবার রক্তই লাল। তখন বড় বড় দার্শনিকের নানা আবিষ্কারও সেই সংলাপের কাছে ম্লান হয়ে যায়। এই নারী কথাগুলো শিখেছে জীবনে চলতে গিয়ে। তাই তা প্রগাঢ় সত্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়।
একটা সময় গুরুদাসীকে নিয়ে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পড়ে শোনানো হয়। তার স্বামী এবং সন্তানদের কীভাবে তার সামনে হত্যা করা হয়েছে এবং কীভাবে তাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করা হয়েছে, সে বিষয়টিও মূর্ত হয়ে ওঠে ছবিতে।
একজন বীরাঙ্গনার জীবনকাহিনি ছবির ভাষায় বর্ণনা করে ইতিহাসের একটি অধ্যায়কে যেভাবে এনেছেন ইয়াসমিন কবীর, তাতে তাঁকে সাধুবাদ দিতে হয়।
৪. একেবারে অন্য ধরনের একটি ছবি ‘নট এ পেনি, নট এ গান’। মকবুল চৌধুরী নির্মাণ করেছেন ছবিটি। নিজের বাবাকে নিয়ে তৈরি এ ছবিটি। যে বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে, সেদিকে সাধারণভাবে চোখ যায় না।
মকবুল চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুইয়া ছিলেন স্টিয়ারিং কমিটি অব দ্য অ্যাকশন কমিটি ফর দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইউকের কনভেনর বা আহ্বায়ক। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতেই তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। আর কখনো ব্রিটেনে ফিরে যাননি। ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবার আশা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হবে। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটেনি।
এরপর মকবুল চৌধুরী বার্মিংহামে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বার্মিংহামের বাঙালিদের সংগ্রাম এবং তাঁর নিজের বাবা মোহাম্মদ আজিজুল হক ভুঁইয়ার অবদানের কথা। সেই সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরা এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ, কিন্তু তাঁরা তাঁদের সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। রেখে দিয়েছেন সেই সংগ্রাম নিয়ে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকার কাটিং।
সেই ছবিতে পরিষ্কার হয়ে যায়, বার্মিংহাম তথা ব্রিটেনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য কত আত্মত্যাগ করেছেন কত মানুষ!
শুধু অস্ত্র হাতেই যুদ্ধ হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে কতভাবে, সেটা জানা দরকার।
৫. আরও অনেক তথ্যচিত্রের কথা আলোচনায় আনতে হবে। নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাগুলোকে। এবং সে সঙ্গে এ কথাও মনে রাখতে হবে, এই জনযুদ্ধের একজন জননায়ক ছিলেন। এই জনযুদ্ধ একটি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়েছে। সেটা মেনে নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক তুলে ধরা আজ আরও বেশি প্রয়োজন। যে তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করা হলো, সেখানেও নির্মোহভাবে এই বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করেই নতুন পরিবর্তনগুলো আসবে। অন্যভাবে নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
২৯ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেস্বপ্না রেজা

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না। প্রকৃতির বিধানে মানবজাতির সঙ্গে কুকুর ও বিড়ালের এক অভূতপূর্ব সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। বিশ্বস্ততা ও আস্থার প্রতীক হিসেবে এই দুটি প্রাণীর অবস্থান মানবজাতির সঙ্গে। এটাও যেন সৃষ্টিকর্তার বিধিভুক্ত। কুকুর, বিড়ালের মানুষের সঙ্গে অবস্থানের রহস্য সহনশীলতা, পছন্দ-অপছন্দ, ভালোবাসা—সবকিছুর পেছনে কারণ নিশ্চয়ই আছে, যা দৃশ্যমান হয় না। যেটুকু বুঝতে পারা যায় তা হলো, কুকুর-বিড়াল ভালোবেসে কেউ কেউ ঘরে পোষা প্রাণী হিসেবে রাখে, যত্ন করে। এদের সংখ্যা খুব বেশি নয় সমাজে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে। বিশেষ করে যাদের কুকুর-বিড়ালের মতো প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা কাজ করে এবং সর্বোপরি যারা প্রকৃতার্থে মানবিক, তারা এমন মর্মান্তিক ঘটনায় দুঃখ পেয়েছে। মূলধারার মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয় অন্য প্রাণীপ্রিয় মানুষকে ভীষণভাবে ব্যথিত করেছে। ঘটনাটি হলো পাবনার ঈশ্বরদী এলাকায় একজন নারী আটটি কুকুরের ছানাকে বস্তাবন্দি করে মেরে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, কুকুরের ডাকে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে এমন নির্মম কাজ করেছেন। তাঁর শিশুপুত্র বলেছে, তার মা বস্তায় ভরে কুকুরের ছানাগুলোকে পানিতে ফেলে দিয়েছে। মা কুকুর তার ছানাদের না পেয়ে পুরো এলাকায় কান্না করে বেড়িয়েছে, অসহায় হয়ে ঘুরে ফিরেছে। তার স্তনে ছিল সন্তানদের জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত আহার। সন্তানদের এই দুগ্ধপান করাতে না পারায় অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মা কুকুর তার ছানাদের খুঁজে ফিরেছে। তার কণ্ঠে তার মতোই ভাষা ছিল। চোখে ছিল অশ্রু। শরীরের ভেতর নিদারুণ অসহায়ত্ব। একজন মা মানুষের মতোই তার আর্তনাদ ছিল। যিনি হত্যা করেছেন তিনি মা হয়েও বোঝেননি সন্তান হারানোর যন্ত্রণা। স্থানীয় বাসিন্দাদের চোখে বিষয়টি পড়েছে। তাঁরা মর্মাহত হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে চারপাশের প্রতিবাদে। জানা গেছে, যিনি হত্যা করেছেন তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী এবং ফলাও করে সেটা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু এটা তাঁর বড় পরিচয় নয়। বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন মা মানুষ হয়ে একজন মা কুকুরকে নিঃসন্তান করেছেন, আটটি সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন।
যে মা কুকুর তার আটটি সন্তান হারিয়েছে তাকে স্থানীয় লোকজন ভালোবেসে নাম দিয়েছিলেন টমি। তাঁদের ভালোবাসায় সিক্ত টমি তার সন্তানদের আশ্রয় হিসেবে জায়গাটিকে সুরক্ষিত মনে করেছিল। কিন্তু সবকিছুকে অর্থহীন করে দিল একজন নিশি খাতুন, যিনি মা আর সন্তানের মধ্যকার গভীর টান, অনিবার্য সান্নিধ্যটুকু বুঝতে পারেন না। কিংবা স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটা বুঝতে শিখেছেন। সমাজে একটা বোধ বেশ প্রচলন আছে, সেটা হলো, শিশু ও ফুলকে যে ভালোবাসে না সে আদতে ভালো মানুষ নয়। মানুষসহ সব জীবের কথাই এখানে প্রযোজ্য। আমাদের সমাজে প্রায়ই একজন আরেকজনকে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিঃস্ব করে, ধ্বংস করে এবং এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা, লোভ-লালসা ইত্যাদির স্পৃহা। অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিচারহীনতার বেষ্টনীতে থেকে যায়, থেকে যাচ্ছে। যার পেছনেও থাকে হীন উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। অপরাধ করে মুক্ত জীবনে বসবাস—এই এক ধরনের সংস্কৃতির প্রচলন ঘটেছে আমাদের সমাজে। এই সংস্কৃতির চর্চা সর্বত্র এবং ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে সুবিধাবাদী করতে যথেষ্ট সহায়ক। আমাদের সমাজে শিশুদের যেভাবে হত্যা করা হয়, যেভাবে ধর্ষণ করা হয়, তার পাশে আটটি কুকুরছানাকে বস্তায় ভরে হত্যার ঘটনাটি কিন্তু বেমানান নয়, বরং বেশ মিলে যায়। কিছুদিন আগেও দেখা গেছে যে কুকুর প্রাণীদের ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। একজন প্রবীণ ব্যক্তি বলছিলেন, এই সমাজে কোনো প্রাণীই আর নিরাপদ নয়। হত্যার বিষয়টি প্রত্যেকের নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেছে। যেভাবে মানুষ হত্যা হচ্ছে, সেভাবে অন্য জীব হত্যা হচ্ছে। হত্যা করাই যেন সহজতর কাজ। এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। সরকারি ও বেসরকারি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের হরিণ মেরে খাওয়ার প্রবণতা ও স্পর্ধার তো অপ্রচলন ঘটেনি কখনো, বরং তা রয়েই গেছে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, কুকুরছানা হত্যাকারী নিশি রহমান ধরা পড়েছেন। যদিও তিনি দাবি করেছেন, তিনি বস্তায় ভরে রেখে এসেছেন কিন্তু পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেননি। কিন্তু নিশি রহমানের শিশুপুত্র বলেছে, কুকুরছানাদের বস্তায় ভরে পানিতে ফেলেছে। সব শিশুর ভেতরেই শিশুসুলভ সরলতা কাজ করে যা সত্য বলতে সহায়ক হয়। নিশি তাঁর অপরাধকে লুকাতে পারেননি নিজের শিশুপুত্রের সরলতার কারণেই। প্রকৃতির হিসাব কখনো ভুল হয়নি, ভুল হয় না। মিডিয়ায় দেখা গেল, মা কুকুরকে স্বস্তি ও শান্তি দেওয়ার জন্য দুটি কুকুরছানা এনে তার দুগ্ধপান করানো হচ্ছে। কাজটি করছেন স্থানীয় তরুণরা এবং বিষয়টি অবলোকন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। মা কুকুরের সঙ্গে কুকুরছানা দুটিকে অভ্যস্ত করা হচ্ছে, টিভির পর্দায় দেখা গেল। মা কুকুর তার দুগ্ধপানে বেশ সহায়তা করছে ছানা দুটিকে। মুহূর্তের মধ্যে মনে হলো, এই হিংস্র, হিংসাবিদ্বেষের জগতে ভিন্নতর ও সবচেয়ে মধুর ও অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করছি যেন। ভীষণ ভালো লাগল। সেই সঙ্গে প্রত্যাশা জাগল, জগতের সব প্রাণীর স্বস্তি ও শান্তি নিশ্চিত করার চেতনা জাগ্রত হোক সর্বত্র।
একজন বলছিলেন, নিশি রহমানকে গ্রেপ্তার করা ঠিক হয়েছে। প্রাণিসম্পদ রক্ষার আইনে তাঁর বিচার হলে মানুষের ভেতর সচেতনতা বাড়বে। এ ধরনের অপরাধ আর কেউ করবে না। ঠিক কথা। কিন্তু শেষ অবধি কী হয় বা হবে ? যেমন আমরা দেখি, মানবসন্তানকে হত্যা করেও অনেক অপরাধী বিচারবহির্ভূত জীবনযাপন করছে, আবার যেকোনো প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় শিশুরাই কেবল বলি হয় বা হচ্ছে, সেখানে কঠিন বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করে এবং অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, যাচ্ছে।
যেকোনো অপরাধ আইনের আওতায় আনা জরুরি এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বিচার করতে হবে। গোটা প্রক্রিয়া হতে হবে সংবিধান অনুসারে এবং দলীয় রাজনীতিমুক্ত। মিডিয়ায় প্রচারনির্ভর কর্মকাণ্ড নয়, বরং লক্ষ্য হতে হবে প্রতিটি প্রাণীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাতেই সচেতনতা বাড়বে, মায়েদের শান্তি ফিরবে। দেশ হবে সবার বসবাসের উপযোগী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
২৯ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
৩ ঘণ্টা আগেসানজিদা সামরিন

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। ভেতরের তোলপাড়ের কারণেই লিখি লিখি করে লেখা হয়ে উঠছিল না লেখাটা। গত মাসের কথা, মানে নভেম্বর; ফেসবুকের নিউজফিডে একটি খবর ভেসে আসে। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার খোড়াগাছ ইউনিয়নের জারুল্লাপুর গ্রামের ধানখেত থেকে একটি নবজাত শিশুকে উদ্ধার করা হয়। শিশুটির কান্না শুনে একজন কৃষক তাকে উদ্ধার করেন। পরে এলাকাবাসীর সহায়তা নিয়ে দ্রুত শিশুটিকে প্রাথমিক সেবা দিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। শিশুটির পরিচয় জানা যায়নি।
গত এক মাসের কথাই যদি ধরি, এ রকম আরও কতগুলো খবর পড়তে হয়েছে তার হিসাব নেই। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে পলিব্যাগে ভরে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে সন্তানের জন্মের পর মা নিজেই পালিয়ে গেছেন। একজন ডাক্তার ফেসবুক পোস্টের মাধ্য়মে জানিয়েছেন, এক নবজাতকের জন্মের পর একটি কঠিন অসুখ দেখা দেয়। বাবা-মা চিকিৎসা করাতে চাননি। সন্তানটিকে হাসপাতালে ফেলে বাড়ি চলে যান। হাসপাতাল নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চেষ্টা করেছে শিশুটিকে বাঁচাতে, কিন্তু সম্ভব হয়নি। সে মৃত্য়ুর কোলে ঢলে পড়ে। নবজাতকের মৃতদেহ নেওয়ার জন্য তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁরা কেউ আসতে রাজি হননি। কী বীভৎস তাই না? ভাবতেই গায়ে শীতকাঁটা দিচ্ছে আমার, হয়তো আপনাদেরও। আবার এমন জানা যায়, হাসপাতালের টয়লেটের ওয়াটার ট্যাংকে নবজাতককে ডুবিয়ে রেখে পালিয়ে গেছেন তারই নিজের মা।
ওপরের প্রতিটি ঘটনা বা খবরই চিরাচরিত সেই কথাটিকে মিথ্য়ে করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট, ‘মা’র মতো আপন আর কেউ হয় না।’ যদি তাই হয়, তাহলে যে শিশুটি আজ বা গতকাল পৃথিবীর আলো দেখল, তার স্থান ধানখেতে কেন। কেন সেখানে শিয়াল, কুকুর এসে আঁচড় কাটছে তার ফুলের মতো শরীরে? ময়লার স্তূপে পড়ে কাঁদছে কেন সে? কেন মা নিজেই চান তাঁর সন্তানটি মরে যাক!
অনেকেই হয়তো এর উত্তরে বলবেন, ‘উপায় ছিল না, তাই হয়তো’, অথবা ‘সেই নারী পরিস্থিতির শিকার’। যদি আমি আমার সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি নিয়ে উল্টোপথে হাঁটি, যদি বলি, এই শিশুগুলোর জীবন কোনো পরিস্থিতি নয়, বরং কারও ইচ্ছের ফল। সোজাসাপ্টাভাবে বললে, কোনো নারী, তিনি বিবাহিত হোন বা অবিবাহিত; স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্কে জড়ান বা ধর্ষণের শিকার হন; ঘটনা যাই হোক, তিনি যদি গর্ভকাল এড়াতে চান তাহলে আগে থেকেই তো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব ছিল। ২০২৫-এ এসে কোনো শিশু জন্মের পরে গিয়ে পরিত্যক্ত হবে, এ ঘটনা মেনে নেওয়া কঠিন। বাজারে বিভিন্ন রকমের জন্মনিরোধক পাওয়া যায়, অপরিকল্পিত গর্ভধারণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্য়ে অ্যাবরশনও কিন্তু করা যায়। ফলে যে নারী বা যে দম্পতি সন্তান চাইবেন না, তিনি কেন এসব উপায় বেছে নেন না? আর যদি সেই গর্ভস্থ সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিতই হয়, সমাজের ভয়েই যদি জন্মের পর সন্তানকে ডাস্টবিনে, ওয়াটার ট্যাংকে ফেলে দিতে হয়, তাহলে ৯ মাস ১০ দিন ধরে তাকে গর্ভে রেখেছেনই কীভাবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই না। যে নারী সবার চোখের সামনে নিজের গর্ভকাল পার করে ফেলতে পারেন, তিনি কিনা সমাজের দোহাই দিয়ে সদ্য় জন্মানো সন্তানকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন? কথা এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।
নিজের সন্তানকে হত্য়া করার আরও একটি কারণ পাওয়া যায়। হয়তো সেই নারী নতুন আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন। আর সেই সম্পর্ক সফল করতে হলে সন্তান নামের বাহুল্য না থাকাই হয়তো শ্রেয় বলে ভাবেন তিনি। আমার মতে, সেখানেও তো উপায় রয়েছে। এমন অনেক নিঃসন্তান মা রয়েছেন যাঁরা দিনের পর দিন মা ডাকটি শুনতে চান। এমন নিরাপদ কোনো পরিবার খুঁজে সন্তানকে দত্তক দিয়ে দিলেই তো হয়। হত্য়ার দায় না নিয়ে জীবনসঙ্গীকে ডিভোর্স ও সন্তানকে দত্তক দিলে নিজের জীবনটাও নির্বিঘ্নে কাটানো যায়। ওই জীবনগুলোও বেঁচে থাকার নতুন কারণ খুঁজে পায়।
একজন মা নিজের সন্তানের জীবননাশকারী আরও একটি কারণে হয়ে ওঠেন। এই কারণটি ২০২৫ সালে এসেও অনেকের কাছে হাস্য়রসের বিষয়। তা হলো–পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন। চিকিৎসকদের মতে, বিশ্বজুড়ে সন্তান প্রসবের পর প্রতি ১০০ জনে ৮৫ জন এই জটিলতায় ভোগেন। আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক হয়ে যান অনেকে। কিন্তু যাঁরা স্বাভাবিক হতে পারেন না, তাঁদের ক্ষেত্রেই ঘটে অঘটন। বেবি ব্লু থেকে সৃষ্টি হয় তীব্র হতাশার, তারপর তা রূপ নেয় পোস্টপার্টাম সাইকোসিসে। এসব ক্ষেত্রে মা নিজের সন্তানকে হত্য়া পর্যন্ত করতে পারেন। এমনিতেও খেয়াল করলে দেখবেন, একজন মা তাঁর সন্তানের সঙ্গে যত ধরনের বিরূপ আচরণ করেন, তার অন্যতম মূল কারণ পারিবারিক অসহযোগিতা। আমাদের দেশে এই সংকট আরও প্রবল। বেশির ভাগ পরিবারেই দেখা যায়, বাড়ির সব কাজ ও সন্তান লালন-পালনের প্রতিটি বিষয় মায়ের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে দিন শেষে, তিনিও ভারসাম্য় হারাচ্ছেন। চোটপাট করছেন অবুঝ শিশুটির ওপর।
তবে যে কথা দিয়ে এই লেখার শুরু, তাতে একটা কথাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছে; নিজেদের কাছে একটা আশা রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে, তা হলো–যদি কেউ সন্তান না চান, তাকে সুন্দর একটা জীবন দেওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা বুঝে থাকেন পৃথিবীতে এলে তাকে অবহেলাই পেতে হবে; তাহলে তাকে পৃথিবীতে আসার পথ না দেখানোই ভালো। যে শিশু নিজের ইচ্ছায় পৃথিবীতে আসে না, তাকে আপনি তো আপনার ইচ্ছাতে হত্য়া করতে পারেন না। হাওয়ায় ভেসে আসা নবজাতকের কান্না, শিয়ালের আঁচড়ে কেঁপে ওঠা তার শরীর, জলের বুদ্বুদে মিশে যাওয়া তার বুকের মৃদু ধুকপুক শব্দ প্রকৃতিতে যে অভিশাপ ঢেলে দেয়। প্রকৃতি সব মনে রাখে। সেও তো সব কড়ায়-গন্ডায় ফিরিয়ে দেয়। কী, দেয় না?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করা মোজাম্মেল হোসেন, ঘনিষ্ঠ মহলে যিনি মঞ্জু নামেই বেশি পরিচিত, ছাত্রাবস্থায় ১৯৬৯ সালে সাপ্তাহিক ‘যুগবাণী’ ও ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক ‘একতা’য় প্রতিবেদক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন।
২৯ জুন ২০২৫
পাকিস্তানের বিচারপতি কায়ানির নামে একটা রসিকতা চালু আছে। তিনি নাকি বলেছিলেন, সব দেশের একটি সেনাবাহিনী আছে, আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রয়েছে একটি দেশ। পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে নজর রাখলেই একের পর এক জেনারেল বেরিয়ে আসবে। গণতন্ত্র সেখানে সোনার হরিণ হিসেবেই রয়ে গেছে, বাস্তবজীবনে তার দেখা মেলা ভার।
৩ ঘণ্টা আগে
‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’, ‘ব্যালাড অব এ সোলজার’, ‘গানস অব নাভারন’, ‘সোফিস চয়েজ’-এর মতো চলচ্চিত্র হয়তো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তৈরি হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই। শুরুর দিকের সিনেমাগুলোয় স্থূলতার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক উপাদান যুক্ত হয়েছে খুব দ্রুত।
৩ ঘণ্টা আগে
কুকুর ও বিড়াল মানুষের সংস্পর্শ ছাড়া থাকতে পারে না। বনজঙ্গলে রেখে এলেও তারা লোকালয়ে চলে আসে। কুকুর ও বিড়ালের লোকালয়ে চলে আসার কারণ হিসেবে বলা হয় যে তারা মানুষের খাবার খেয়ে, ভালোবাসায় বেঁচে থাকে। ফলে মানুষের থেকে দূরে থাকতে তারা পারে না।
৩ ঘণ্টা আগে